০৯:৪৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

গবেষণায় নমুনা, নমুনায়ন এবং নমুনায়ন পদ্ধতি কী?

প্রফেসর মুহম্মদ এলতাস উদ্দিন
  • প্রকাশ: ০১:২০:০০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২২ অক্টোবর ২০২১
  • / ৪২৯৩১ বার পড়া হয়েছে

গবেষণায় নমুনা, নমুনায়ন এবং নমুনায়ন পদ্ধতি কী?

যে-কোনো গবেষণা কাজে (Research Work) নমুনায়ন (sampling) একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি এবং এই নমুনায়নের ব্যবহার গবেষণার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে দেখা যায়। নমুনায়নের মাধ্যমে স্বল্প সংখ্যক বিষয়ের উপর অনুসন্ধান সীমিত রেখেও বিস্তৃত পরিধির অধিক সংখ্যক বিষয়ের সম্বন্ধে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়।

তথ্যবিশ্ব বা সমগ্রক কী?

গবেষণার তথ্য সংগ্রহের অন্তর্ভুক্ত নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন গবেষণার সব উপাদানকে একত্রে সমগ্রক বা তথ্যবিশ্ব বলে।

পুরো সমগ্রক থেকে তথ্য সংগ্রহ করাকে শুমারী বলে। সকল গবেষণায় এই শুমারী ব্যবহার করা সম্ভব নয়।

নমুনা কী?

নমুনা হলো তথ্যবিশ্ব বা সমগ্রকের একটি অংশ তথা ছোটো পরিধিতে বিস্তৃত সমগ্রকের সব বৈশিষ্ট্যের প্রতিনিধিত্ব স্বরূপ।

সমগ্রকের বৈশিষ্ট্যের প্রতীক হিসেবে বৈজ্ঞানিক নিয়ম মেনে সমগ্রকের যে অংশটিকে গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করার জন্য এবং সমগ্রক সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য নির্বাচন করা হয় তাকে বলে নমুনা।

নমুনায়ন কী?

পুরো সমগ্রক থেকে তথ্য সংগ্রহ করা গবেষণার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। তাই পরিসংখ্যানবিদগণ নমুনায়নের মতো একটি সহজ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন।

সমগ্রক থেকে নমুনা সংগ্রহ করার বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াক্র নমুনায়ন বলে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি টিউব ওয়েলের পানিতে আর্সেনিক আছে কি না, তা পরীক্ষার জন্য টিউবওয়েলে যে স্তর থেকে পানি আসছে তার সমস্ত পানি পরীক্ষা করার প্রয়োজন হয় না। টিউবওয়েল থেকে কিছু পানি নিয়ে পরীক্ষা করলেই বোঝা যাবে সে পানিতে আদৌ আর্সেনিক আছে কিনা। টিউবওয়েল থেকে যে কিঞ্চিৎ পানি নিয়ে পরীক্ষা করলাম তা হলো নমুনা এবং এইভাবে সমগ্রক থেকে কিছু অংশ পরীক্ষা করার পদ্ধতিকে বলা হয় নমুনায়ন।

নমুনায়ন হলো এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে গবেষণার জন্য তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সমগ্রকের ভিতর থেকে কিছু সংখ্যক একক বেছে নেওয়া হয়।

যে পদ্ধতির সাহায্যে নমুনা নির্বাচন করা হয় সে পদ্ধতিকে বলে নমুনায়ন পদ্ধতি আর নির্বাচিত দলকে বলা হয় নমুনা দল।

নমুনায়নের প্রকারভেদ

গবেষণার সুবিধার্থে এবং নিরপেক্ষ, সঠিক, প্রতিনিধিমূলক নমুনাদল গঠনে যাতে কোনোপ্রকার বিঘ্নের সৃষ্টি না হয় সে জন্য পরিসংখ্যানবিদরা নমুনায়নের বিভিন্ন প্রকার পদ্ধতি প্রবর্তন করেছেন।

গবেষণার উদ্দেশ্য, তথ্যের প্রকৃতি, সময় ও গবেষণার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের দিকে নজর রেখে নমুনায়ন পদ্ধতিগুলো থেকে যে-কোনো একটি গবেষক বেছে নিতে পারেন।

সম্ভাবনা তথ্যের ভিত্তিতে নমুনায়ন পদ্ধতিকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-

  • সম্ভাবনা নমুনায়ন
  • নিঃসম্ভাবনা নমুনায়ন

সম্ভাবনা নমুনায়নও আবার কয়েক রকম হতে পারে, যেমন:

  • দৈবচয়িত নমুনায়ন
  • স্তরিত নমুনায়ন
  • দ্বৈত চয়ন নমুনায়ন
  • নিয়মক্রমিক নমুনায়ন
  • গুচ্ছ নমুনায়ন
  • এলাকাগত নমুনায়ন

তাছাড়া নিঃসম্ভাবনা নমুনায়নকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন:

  • আকস্মিক নমুনায়ন
  • উদ্দেশ্যমূলক নমুনায়ন

এ ধরনের নমুনায়ন সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করা হলো। 

দৈব চয়ন নমুনায়ন 

দৈব চয়ন পদ্ধতির প্রধান লক্ষ্য হলো যে সমগ্রক থেকে এমনভাবে নমুনা বাছাই করতে হবে যাতে সমগ্রকের অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেকটি দ্রব্য বা বস্তুর নমুনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সমান সুযোগ থাকে। এই পদ্ধতিতে নমুনা বাছাইয়ের জন্য কয়েকটি পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়। তথ্য বিশ্বের তালিকা ব্যবহার করে আলাদা কাগজের টুকরায় নাম লিখে সেগুলো কোনোপাত্রে রেখে ভালো করে নাড়াচড়া করে একটি করে নমুনা পাত্র থেকে তুলতে হবে।

একটি নমুনা তোলার পর আবার পাত্রের লিখিত নামসমূহ ওলট-পালট করতে হবে। সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি হলো একটি দৈব শাখার তালিকা ব্যবহার করে নমুনা নির্বাচন করা।

তালিকা অনুসারে নিয়মমাফিক পাঁচ সংখ্যা পরপর অথবা দশ সংখ্যা পর পর একটি নমুনা গ্রহণ করা হয়। গবেষকের সুবিধার জন্য এই ধরনের দৈব চয়ন তালিকা পরিসংখ্যানবিদরা তৈরি করে রেখেছেন। গবেষক শুধু তার প্রয়োজনুসারে এই তালিকা ব্যবহার করে দৈব চয়ন পদ্ধতিতে নমুনা বাছাই করতে পারেন। 

দ্বৈত চয়ন পদ্ধতি 

ডাকযোগে প্রশ্নমালা পাঠিয়ে যখন তথ্য সংগ্রহের চেষ্ট করা হয় সেক্ষেত্রে প্রথমবার হয়তো প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রশ্নমালা ফেরত না পাওয়া গেলে দ্বিতীয়বার আবার প্রশ্নমালা পাঠানো হয়। তাছাড়া কিছু সময়ের ব্যবধানে একটি ব্যক্তির কাছে দুইবার প্রশ্নমালা পাঠিয়ে তাঁর মতামতের স্থিরতা বা বিশ্বস্ততা আছে কিনা তা প্রমাণ করা যায়।

দ্বিতীয় কারণ হলো একই এলাকা বা জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে সময়ের ব্যবধানে একাধিক বার তথ্য সংগ্রহ করে তা পর্যালোচনা করা হয়। এক্ষেত্রে দুইভাবে তথ্য সংগ্রহ করা যায়।

যেমন: একই নমুনার কাছ থেকে দুইবার তথ্য আহরণ করা যায় কিংবা প্রয়োজন হলে দ্বিতীয়বার নতুন নমুনার কাছ থেকে তথ্য আহরণ করা যায়। 

স্তরিত নমুনায়ন 

এই পদ্ধতিতে সমগ্রক বা তথ্য বিশ্বকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। এই ভাগগুলোকে উপ সমগ্রক এবং প্রতিটি ভাগকে স্তর বলা হয়।

একটি বিশেষ বস্তি এলাকার বাসিন্দাদের আয়ের হিসাব করতে হলে ঐ জনগোষ্ঠীকে আর্থসামাজিক অবস্থার ভিত্তিতে কয়েকটি উপবিভাগ করা যেতে পারে, যেমন- দক্ষ শ্রমিক, অদক্ষ শ্রমিক, দোকানদার, পেশাজীবী শ্রমিক ইত্যাদি; এইভাবে প্রত্যেকটি উপ-বিভাগ থেকে নমুনা নিয়ে দল গঠন করাকে স্তরিত নমুনায়ন বলে। নিয়মক্রমিক নমুনায়ন এই পদ্ধতিতে দৈব চয়ন পদ্ধতির ব্যবহার করা হয়।

গবেষকের সুবিধা অনুসারে কোনোনির্দিষ্ট নমুনা বাছাই করতে হলে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়।

উদাহরণ: যদি কোনোগবেষণার জন্য ৭০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৭০ জন শিক্ষার্থীর জন্য নমুনার প্রয়োজন হয়, তখন একটি বিশেষ পদ্ধতিতে ঐ ৭০ জন শিক্ষার্থীকে নমুনা হিসাবে নির্বাচন করা হয়। যেহেতু ৭০০ থেকে ৭০ জন নিতে হবে তাই এখানে ১-১০ পর্যন্ত ক্রমিক সংখ্যার যে-কোনো একটি নির্বাচন করার স্বাধীনতা গবেষকের আছে। গবেষক যদি প্রথম সংখ্যা ৭ নির্বাচন করেন তবে পরেরটি ১৭, তৃতীয়টি ২৭, চতুর্থটি ৩৭ এমনিভাবে ৭০ জন শিক্ষার্থী নাম নির্বাচন করতে পারেন।

এখানে যদিও দৈব চয়নের প্রাধান্য রয়েছে তবুও যেহেতু গবেষকের নির্দিষ্ট নমুনা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কিছুটা স্বাধীনতা রয়েছে তাই একে নিয়মক্রমিক নমুনা বাছাই পদ্ধতি বলা যেতে পারে। 

গবেষণায় নমুনায়ন হলো এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে গবেষণার জন্য তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সমগ্রকের ভিতর থেকে কিছু সংখ্যক একক বেছে নেওয়া হয়।

গুচ্ছ চয়ন পদ্ধতি 

গুচ্ছ নমুনায়ন দৈব চয়িত নমুনায়নের অন্য একটি রূপ। প্রকৃতপক্ষে যখন সমগ্রক বা তথ্য বিশ্ব আকারে খুব বড়ো হয় এবং ভৌগোলিক দিক থেকে বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে থাকে তখন এই প্রকার নমুনায়ন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়।

যদি কোনোগবেষণার জন্য দেশের সকল বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে নমুনা দল গঠনের প্রয়োজন হয়, সেটা হবে কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এক্ষেত্রে সর্বদা প্রত্যেক জেলা থেকে কিছু মাধ্যমিক বিদ্যালয় বেছে নিয়ে সেইসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে দল গঠন করা হয়। তবে সেটা হবে সহজসাধ্য ব্যাপার; এই প্রকার নমুনায়নকে বলা হয় গুচ্ছ নমুনায়ন।

এলাকাগত নমুনায়ন 

কৃষি সংক্রান্ত জরিপ কাজের জন্য যখন সমগ্র দেশ ভিত্তিক জরিপ কাজ পরিচালনার প্রয়োজন হয় তখন এলাকাগত নমুনায়ন পদ্ধতি অধিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। সাধারণত দেশের একটি মানচিত্রে কেন্দ্র বিন্দু স্থির করা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে দৈবচয়িতভাবে এই বিন্দুর মাধ্যমে বিভিন্ন দিকে রেখা অঙ্কন করা হয়। যে সকল স্থান এই রেখার মধ্যে পড়ে সেগুলো দিয়ে নমুনাদল গঠন করা হয় এবং এই দল থেকে তথ্য সংগ্রহ করা যায়। 

পূর্বেই বলা হয়েছে নিঃসম্ভাবনা নমুনায়ন দুই প্রকার। যথা- আকস্মিক নমুনায়ন ও উদ্দেশ্যমূলক নমুনায়ন। 

আকস্মিক নমুনায়ন 

গবেষক অনেক সময় নমুনায়নের বিশেষ কোনোপদ্ধতি অনুসরণ না করে তাঁর নিজের ইচ্ছা ও সুবিধা অনুযায়ী এবং যা কাছে পাওয়া যায় সেগুলোকে নমুনা হিসাবে ব্যবহার করে থাকেন। 

এই ধরনের নমুনা প্রতিনিধিত্বশীল এবং বিজ্ঞানসম্মত না হলেও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ গবেষণার উপযোগী বলে প্রমাণিত হয়েছে। 

উদ্দেশ্যমূলক নমুনায়ন 

এই পদ্ধতিতে নমুনা নির্বাচন করতে সম্ভাবনা তত্ত্ব ব্যবহার প্রয়োজন হয় না। গবেষক নিজের পছন্দ বা অভিজ্ঞতালবদ্ধ জ্ঞান প্রয়োগ করে দল গঠন করেন। এক্ষেত্রে নির্বাচনকারীর বিচার বুদ্ধিই হলো নমুনা নির্বাচনের ভিত্তি, ফলে একে বিচার নমুনায়নও বলা হয়। সংগৃহীত তথ্যগুলোতে যাতে কোনোপ্রকার ভাব প্রবণতা বা পক্ষপাতিত্ব প্রকাশ না পায় সে জন্য গবেষককে সচেতন থাকতে হয়। বিচার বিবেচনা করে এবং যুক্তি প্রয়োগ করে নমুনা দল গঠন করা হয়। নিঃসম্ভাবনা নমুনায়ন যদিও বহুল ব্যবহৃত হয় কিন্তু এই নমুনায়নের সাহায্যে সীমিত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। সাধারণীকরণের ক্ষেত্রে এই নমুনায়ন মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। 

নমুনা দলের আকৃতি নির্ধারণ

গবেষণার প্রকার, প্রকৃতি, পরিধি ও গভীরতা অনুযায়ী নমুনা দলের আকৃতি নির্ভর করে। বর্ণনামূলক গবেষণার জন্য সমগ্রক থেকে ১০ শতাংশ নিয়ে নমুনা দল গঠন করা যায়। সীমিত আকারের বা ছোটো তথ্য বিশ্বের জন্য শতকরা ২০ জনকে নিয়ে নমুনা দল গঠন করা যায়। সহ সম্পর্কিত গবেষণার জন্য কমপক্ষে ৩০ জন শিক্ষার্থীর প্রয়োজন হয়। কঠোর নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় 

কোনোকোনোপরীক্ষণমূলক গবেষণা পরিচালিত হলে প্রতিটি নমুনা দলে ১৫ জন শিক্ষার্থী হলেও চলে। 

একটি সঠিক প্রতিনিধিত্বশীল নমুনাদল গঠন করা বেশ কঠিন কাজ। নমুনায়নের বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে সাধারণ সম্ভাবনা নমুনায়ন বা স্তরিত নমুনায়ন পদ্ধতি অধিকতর উপযুক্ত। 

দৈবচয়ন পদ্ধতি অন্যান্য নমুনায়ন পদ্ধতির চেয়ে সহজ ও বৈজ্ঞানিক। কোনোকোনোসময়ে গুচ্ছ নমুনায়ন বা নিয়মমাফিক নমুনায়নও ব্যবহার করা যেতে পারে।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

প্রফেসর মুহম্মদ এলতাস উদ্দিন

সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠপুস্তক বোর্ড, বাংলাদেশ

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

গবেষণায় নমুনা, নমুনায়ন এবং নমুনায়ন পদ্ধতি কী?

প্রকাশ: ০১:২০:০০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২২ অক্টোবর ২০২১

যে-কোনো গবেষণা কাজে (Research Work) নমুনায়ন (sampling) একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি এবং এই নমুনায়নের ব্যবহার গবেষণার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে দেখা যায়। নমুনায়নের মাধ্যমে স্বল্প সংখ্যক বিষয়ের উপর অনুসন্ধান সীমিত রেখেও বিস্তৃত পরিধির অধিক সংখ্যক বিষয়ের সম্বন্ধে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়।

তথ্যবিশ্ব বা সমগ্রক কী?

গবেষণার তথ্য সংগ্রহের অন্তর্ভুক্ত নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন গবেষণার সব উপাদানকে একত্রে সমগ্রক বা তথ্যবিশ্ব বলে।

পুরো সমগ্রক থেকে তথ্য সংগ্রহ করাকে শুমারী বলে। সকল গবেষণায় এই শুমারী ব্যবহার করা সম্ভব নয়।

নমুনা কী?

নমুনা হলো তথ্যবিশ্ব বা সমগ্রকের একটি অংশ তথা ছোটো পরিধিতে বিস্তৃত সমগ্রকের সব বৈশিষ্ট্যের প্রতিনিধিত্ব স্বরূপ।

সমগ্রকের বৈশিষ্ট্যের প্রতীক হিসেবে বৈজ্ঞানিক নিয়ম মেনে সমগ্রকের যে অংশটিকে গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করার জন্য এবং সমগ্রক সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য নির্বাচন করা হয় তাকে বলে নমুনা।

নমুনায়ন কী?

পুরো সমগ্রক থেকে তথ্য সংগ্রহ করা গবেষণার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। তাই পরিসংখ্যানবিদগণ নমুনায়নের মতো একটি সহজ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন।

সমগ্রক থেকে নমুনা সংগ্রহ করার বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াক্র নমুনায়ন বলে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি টিউব ওয়েলের পানিতে আর্সেনিক আছে কি না, তা পরীক্ষার জন্য টিউবওয়েলে যে স্তর থেকে পানি আসছে তার সমস্ত পানি পরীক্ষা করার প্রয়োজন হয় না। টিউবওয়েল থেকে কিছু পানি নিয়ে পরীক্ষা করলেই বোঝা যাবে সে পানিতে আদৌ আর্সেনিক আছে কিনা। টিউবওয়েল থেকে যে কিঞ্চিৎ পানি নিয়ে পরীক্ষা করলাম তা হলো নমুনা এবং এইভাবে সমগ্রক থেকে কিছু অংশ পরীক্ষা করার পদ্ধতিকে বলা হয় নমুনায়ন।

নমুনায়ন হলো এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে গবেষণার জন্য তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সমগ্রকের ভিতর থেকে কিছু সংখ্যক একক বেছে নেওয়া হয়।

যে পদ্ধতির সাহায্যে নমুনা নির্বাচন করা হয় সে পদ্ধতিকে বলে নমুনায়ন পদ্ধতি আর নির্বাচিত দলকে বলা হয় নমুনা দল।

নমুনায়নের প্রকারভেদ

গবেষণার সুবিধার্থে এবং নিরপেক্ষ, সঠিক, প্রতিনিধিমূলক নমুনাদল গঠনে যাতে কোনোপ্রকার বিঘ্নের সৃষ্টি না হয় সে জন্য পরিসংখ্যানবিদরা নমুনায়নের বিভিন্ন প্রকার পদ্ধতি প্রবর্তন করেছেন।

গবেষণার উদ্দেশ্য, তথ্যের প্রকৃতি, সময় ও গবেষণার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের দিকে নজর রেখে নমুনায়ন পদ্ধতিগুলো থেকে যে-কোনো একটি গবেষক বেছে নিতে পারেন।

সম্ভাবনা তথ্যের ভিত্তিতে নমুনায়ন পদ্ধতিকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-

  • সম্ভাবনা নমুনায়ন
  • নিঃসম্ভাবনা নমুনায়ন

সম্ভাবনা নমুনায়নও আবার কয়েক রকম হতে পারে, যেমন:

  • দৈবচয়িত নমুনায়ন
  • স্তরিত নমুনায়ন
  • দ্বৈত চয়ন নমুনায়ন
  • নিয়মক্রমিক নমুনায়ন
  • গুচ্ছ নমুনায়ন
  • এলাকাগত নমুনায়ন

তাছাড়া নিঃসম্ভাবনা নমুনায়নকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন:

  • আকস্মিক নমুনায়ন
  • উদ্দেশ্যমূলক নমুনায়ন

এ ধরনের নমুনায়ন সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করা হলো। 

দৈব চয়ন নমুনায়ন 

দৈব চয়ন পদ্ধতির প্রধান লক্ষ্য হলো যে সমগ্রক থেকে এমনভাবে নমুনা বাছাই করতে হবে যাতে সমগ্রকের অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেকটি দ্রব্য বা বস্তুর নমুনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সমান সুযোগ থাকে। এই পদ্ধতিতে নমুনা বাছাইয়ের জন্য কয়েকটি পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়। তথ্য বিশ্বের তালিকা ব্যবহার করে আলাদা কাগজের টুকরায় নাম লিখে সেগুলো কোনোপাত্রে রেখে ভালো করে নাড়াচড়া করে একটি করে নমুনা পাত্র থেকে তুলতে হবে।

একটি নমুনা তোলার পর আবার পাত্রের লিখিত নামসমূহ ওলট-পালট করতে হবে। সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি হলো একটি দৈব শাখার তালিকা ব্যবহার করে নমুনা নির্বাচন করা।

তালিকা অনুসারে নিয়মমাফিক পাঁচ সংখ্যা পরপর অথবা দশ সংখ্যা পর পর একটি নমুনা গ্রহণ করা হয়। গবেষকের সুবিধার জন্য এই ধরনের দৈব চয়ন তালিকা পরিসংখ্যানবিদরা তৈরি করে রেখেছেন। গবেষক শুধু তার প্রয়োজনুসারে এই তালিকা ব্যবহার করে দৈব চয়ন পদ্ধতিতে নমুনা বাছাই করতে পারেন। 

দ্বৈত চয়ন পদ্ধতি 

ডাকযোগে প্রশ্নমালা পাঠিয়ে যখন তথ্য সংগ্রহের চেষ্ট করা হয় সেক্ষেত্রে প্রথমবার হয়তো প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রশ্নমালা ফেরত না পাওয়া গেলে দ্বিতীয়বার আবার প্রশ্নমালা পাঠানো হয়। তাছাড়া কিছু সময়ের ব্যবধানে একটি ব্যক্তির কাছে দুইবার প্রশ্নমালা পাঠিয়ে তাঁর মতামতের স্থিরতা বা বিশ্বস্ততা আছে কিনা তা প্রমাণ করা যায়।

দ্বিতীয় কারণ হলো একই এলাকা বা জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে সময়ের ব্যবধানে একাধিক বার তথ্য সংগ্রহ করে তা পর্যালোচনা করা হয়। এক্ষেত্রে দুইভাবে তথ্য সংগ্রহ করা যায়।

যেমন: একই নমুনার কাছ থেকে দুইবার তথ্য আহরণ করা যায় কিংবা প্রয়োজন হলে দ্বিতীয়বার নতুন নমুনার কাছ থেকে তথ্য আহরণ করা যায়। 

স্তরিত নমুনায়ন 

এই পদ্ধতিতে সমগ্রক বা তথ্য বিশ্বকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। এই ভাগগুলোকে উপ সমগ্রক এবং প্রতিটি ভাগকে স্তর বলা হয়।

একটি বিশেষ বস্তি এলাকার বাসিন্দাদের আয়ের হিসাব করতে হলে ঐ জনগোষ্ঠীকে আর্থসামাজিক অবস্থার ভিত্তিতে কয়েকটি উপবিভাগ করা যেতে পারে, যেমন- দক্ষ শ্রমিক, অদক্ষ শ্রমিক, দোকানদার, পেশাজীবী শ্রমিক ইত্যাদি; এইভাবে প্রত্যেকটি উপ-বিভাগ থেকে নমুনা নিয়ে দল গঠন করাকে স্তরিত নমুনায়ন বলে। নিয়মক্রমিক নমুনায়ন এই পদ্ধতিতে দৈব চয়ন পদ্ধতির ব্যবহার করা হয়।

গবেষকের সুবিধা অনুসারে কোনোনির্দিষ্ট নমুনা বাছাই করতে হলে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়।

উদাহরণ: যদি কোনোগবেষণার জন্য ৭০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৭০ জন শিক্ষার্থীর জন্য নমুনার প্রয়োজন হয়, তখন একটি বিশেষ পদ্ধতিতে ঐ ৭০ জন শিক্ষার্থীকে নমুনা হিসাবে নির্বাচন করা হয়। যেহেতু ৭০০ থেকে ৭০ জন নিতে হবে তাই এখানে ১-১০ পর্যন্ত ক্রমিক সংখ্যার যে-কোনো একটি নির্বাচন করার স্বাধীনতা গবেষকের আছে। গবেষক যদি প্রথম সংখ্যা ৭ নির্বাচন করেন তবে পরেরটি ১৭, তৃতীয়টি ২৭, চতুর্থটি ৩৭ এমনিভাবে ৭০ জন শিক্ষার্থী নাম নির্বাচন করতে পারেন।

এখানে যদিও দৈব চয়নের প্রাধান্য রয়েছে তবুও যেহেতু গবেষকের নির্দিষ্ট নমুনা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কিছুটা স্বাধীনতা রয়েছে তাই একে নিয়মক্রমিক নমুনা বাছাই পদ্ধতি বলা যেতে পারে। 

গবেষণায় নমুনায়ন হলো এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে গবেষণার জন্য তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সমগ্রকের ভিতর থেকে কিছু সংখ্যক একক বেছে নেওয়া হয়।

গুচ্ছ চয়ন পদ্ধতি 

গুচ্ছ নমুনায়ন দৈব চয়িত নমুনায়নের অন্য একটি রূপ। প্রকৃতপক্ষে যখন সমগ্রক বা তথ্য বিশ্ব আকারে খুব বড়ো হয় এবং ভৌগোলিক দিক থেকে বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে থাকে তখন এই প্রকার নমুনায়ন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়।

যদি কোনোগবেষণার জন্য দেশের সকল বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে নমুনা দল গঠনের প্রয়োজন হয়, সেটা হবে কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এক্ষেত্রে সর্বদা প্রত্যেক জেলা থেকে কিছু মাধ্যমিক বিদ্যালয় বেছে নিয়ে সেইসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে দল গঠন করা হয়। তবে সেটা হবে সহজসাধ্য ব্যাপার; এই প্রকার নমুনায়নকে বলা হয় গুচ্ছ নমুনায়ন।

এলাকাগত নমুনায়ন 

কৃষি সংক্রান্ত জরিপ কাজের জন্য যখন সমগ্র দেশ ভিত্তিক জরিপ কাজ পরিচালনার প্রয়োজন হয় তখন এলাকাগত নমুনায়ন পদ্ধতি অধিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। সাধারণত দেশের একটি মানচিত্রে কেন্দ্র বিন্দু স্থির করা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে দৈবচয়িতভাবে এই বিন্দুর মাধ্যমে বিভিন্ন দিকে রেখা অঙ্কন করা হয়। যে সকল স্থান এই রেখার মধ্যে পড়ে সেগুলো দিয়ে নমুনাদল গঠন করা হয় এবং এই দল থেকে তথ্য সংগ্রহ করা যায়। 

পূর্বেই বলা হয়েছে নিঃসম্ভাবনা নমুনায়ন দুই প্রকার। যথা- আকস্মিক নমুনায়ন ও উদ্দেশ্যমূলক নমুনায়ন। 

আকস্মিক নমুনায়ন 

গবেষক অনেক সময় নমুনায়নের বিশেষ কোনোপদ্ধতি অনুসরণ না করে তাঁর নিজের ইচ্ছা ও সুবিধা অনুযায়ী এবং যা কাছে পাওয়া যায় সেগুলোকে নমুনা হিসাবে ব্যবহার করে থাকেন। 

এই ধরনের নমুনা প্রতিনিধিত্বশীল এবং বিজ্ঞানসম্মত না হলেও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ গবেষণার উপযোগী বলে প্রমাণিত হয়েছে। 

উদ্দেশ্যমূলক নমুনায়ন 

এই পদ্ধতিতে নমুনা নির্বাচন করতে সম্ভাবনা তত্ত্ব ব্যবহার প্রয়োজন হয় না। গবেষক নিজের পছন্দ বা অভিজ্ঞতালবদ্ধ জ্ঞান প্রয়োগ করে দল গঠন করেন। এক্ষেত্রে নির্বাচনকারীর বিচার বুদ্ধিই হলো নমুনা নির্বাচনের ভিত্তি, ফলে একে বিচার নমুনায়নও বলা হয়। সংগৃহীত তথ্যগুলোতে যাতে কোনোপ্রকার ভাব প্রবণতা বা পক্ষপাতিত্ব প্রকাশ না পায় সে জন্য গবেষককে সচেতন থাকতে হয়। বিচার বিবেচনা করে এবং যুক্তি প্রয়োগ করে নমুনা দল গঠন করা হয়। নিঃসম্ভাবনা নমুনায়ন যদিও বহুল ব্যবহৃত হয় কিন্তু এই নমুনায়নের সাহায্যে সীমিত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। সাধারণীকরণের ক্ষেত্রে এই নমুনায়ন মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। 

নমুনা দলের আকৃতি নির্ধারণ

গবেষণার প্রকার, প্রকৃতি, পরিধি ও গভীরতা অনুযায়ী নমুনা দলের আকৃতি নির্ভর করে। বর্ণনামূলক গবেষণার জন্য সমগ্রক থেকে ১০ শতাংশ নিয়ে নমুনা দল গঠন করা যায়। সীমিত আকারের বা ছোটো তথ্য বিশ্বের জন্য শতকরা ২০ জনকে নিয়ে নমুনা দল গঠন করা যায়। সহ সম্পর্কিত গবেষণার জন্য কমপক্ষে ৩০ জন শিক্ষার্থীর প্রয়োজন হয়। কঠোর নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় 

কোনোকোনোপরীক্ষণমূলক গবেষণা পরিচালিত হলে প্রতিটি নমুনা দলে ১৫ জন শিক্ষার্থী হলেও চলে। 

একটি সঠিক প্রতিনিধিত্বশীল নমুনাদল গঠন করা বেশ কঠিন কাজ। নমুনায়নের বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে সাধারণ সম্ভাবনা নমুনায়ন বা স্তরিত নমুনায়ন পদ্ধতি অধিকতর উপযুক্ত। 

দৈবচয়ন পদ্ধতি অন্যান্য নমুনায়ন পদ্ধতির চেয়ে সহজ ও বৈজ্ঞানিক। কোনোকোনোসময়ে গুচ্ছ নমুনায়ন বা নিয়মমাফিক নমুনায়নও ব্যবহার করা যেতে পারে।