০৫:৫৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

জীবন দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষার ধারণা, বৈশিষ্ট্য প্রয়োজনীয়তা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১০ টি জীবন দক্ষতা

জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের জীবন দক্ষতাসমূহ আয়ত্ত ও আত্মস্থ করানোর উদ্দেশ্যে প্রণীত একটি শিক্ষা।
বিশ্লেষণ সংকলন টিম
  • প্রকাশ: ১২:২৪:২৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
  • / ১৩৩১ বার পড়া হয়েছে

জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের জীবন দক্ষতাসমূহ আয়ত্ত ও আত্মস্থ করানোর উদ্দেশ্যে প্রণীত একটি শিক্ষা।

জীবন দক্ষতা হলো মানসিক স্বাস্থ্য-সক্ষমতার অংশ, যার সাহায্যে যে কোন পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার এবং ইতিবাচক আচরণের ক্ষমতা বা দক্ষতা, যা মানুষকে তার দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা ও চ্যালেঞ্জগুলির সাথে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম করে তোলে। অন্য কথায়, জীবন দক্ষতা হলো মনোসামাজিক পারদর্শিতা বা সক্ষমতা।

জীবন দক্ষতার ধারণা

জীবন দক্ষতা হলো এক ধরণের বিমূর্ত বিষয়। এটি অর্জন করা ও লালন করে চলার বিষয়। ব্যক্তি মানসিকতার সামাজিক সম্পর্কায়ন। অর্থাৎ ব্যক্তি মানসের সাথে সমাজের সম্পর্ক বিষয়ক দক্ষতা যা চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করতে সক্ষম। জীবন দক্ষতা ব্যক্তির সম্ভাবনা ও উদ্ভাবনী শক্তিকে বিকশিত করে জীবনের সব ক্ষেত্রে সাফল্য তৈরিতে সহায়তা করে। জীবন দক্ষতাকে মানবদক্ষতা, মনোসামাজিক দক্ষতা, ব্যক্তিদক্ষতা, আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা, আত্ম নিয়ন্ত্রণ দক্ষতা বলেও অভিহিত করা হয়। জীবন দক্ষতার কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ:

জীবন দক্ষতার ধারণার সাথে সুস্থ দেহ, সুস্থ মন ও সুস্থ বিকাশের সম্পর্ক রয়েছে। সুস্বাস্থ্য শব্দটি শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সম্পর্কিত। দক্ষ মানুষ হয়ে উঠতে চাইলে সুস্থ মন ও দেহের অধিকারী হতে হবে। তাহলে সমাজে সুস্থতা তৈরি হবে। শিক্ষার্থী তেমন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আগ্রহী হবে তেমনি নানা রকম ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ পরিহারে সমর্থ হবে ফলে বিভিন্ন সংক্রমণজনিত রোগ থেকে রেহাই পাবে।

জীবন দক্ষতা তৈরিতে দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার ধারণা

জীবন দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষা হলো এমন একটি শিখন-শেখানো অভিজ্ঞতা বা যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা জীবন দক্ষতাসমূহ অর্জন করে। যে-কোনো শিক্ষা প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের আচরণিক পরিবর্তন ঘটানো। আচরণিক পরিবর্তন ঘটে জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি/মানসিকতা এগুলো পরিবর্তনের সম্মিলিত প্রভাবে। সুতরাং যে কোনো শিক্ষা কর্মসূচির মধ্যে বিষয়সংশ্লিষ্ট জ্ঞান, জ্ঞানকে প্রয়োগের জন্য দক্ষতার অনুশীলন এবং দক্ষতাকে কাজে লাগানোর মানসিকতা সৃষ্টির ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত থাকা আবশ্যিক। জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের জীবন দক্ষতাসমূহ আয়ত্ত ও আত্মস্থ করানোর উদ্দেশ্যে প্রণীত একটি শিক্ষা। এটি শিক্ষাক্রম ও শিক্ষা কার্যক্রমে এমনভাবে পরিকল্পিত ও প্রণীত হয় যে পাঠসমূহ ও সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির মধ্যেই দক্ষতাসমূহ অর্জন করার একটি অন্তলীন ব্যবস্থা সৃষ্টি করে দেওয়া হয়।

জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য

  1. শিক্ষার্থীকে সুরক্ষামূলক আচরণ করতে এবং ঝুকিপূর্ণ আচরণ পরিহার করতে সামর্থ করে শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা ও মানসিকতার মধ্যে ভারসাম্য বিধান করে শিক্ষার্থীর আরচণিক পরিবর্তন ঘটায়
  2. জীবন দক্ষতা সনাক্ত করা যায়, প্রদর্শন করা যায় উপদক্ষতা ও অনুদক্ষতায় বিভাজন করা যায়, অনুকরণ ও অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জন করা যায়, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করা যায়
  3. জীবন দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষা জেন্ডারপ্রবণ, অধিকারভিত্তিক ও বয়সোপযোগী
  4. অভিজ্ঞতাপ্রসূত জ্ঞান ও দক্ষতা জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার একটি বড় উপাদান
  5. এ শিক্ষাকে স্বাস্থ্যশিক্ষাও বলা হয়
  6. এ শিক্ষা শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন করে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে সহায়তা করে
  7. এ শিক্ষার সফল বাস্তবায়নের জন্য কিশোর বান্ধব স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সেবার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা আবশ্যক

জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার সার্বিক বা সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য

শিক্ষক কর্তৃক বয়সোপযোগী জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতাসম্পন্ন উপযুক্ত ও দক্ষ কিশোর কিশোরী গড়ে তোলা। তাদের মধ্যে নিজেদের সকল সম্ভাবনা ও প্রচ্ছন্ন শক্তির পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটিয়ে একজন সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার সামর্থ্য ও প্রণোদনা সৃষ্টি করা।

  1. শিক্ষার্থীদের আধুনিক জীবন ও সমাজ সম্পর্কে সচেতন করা এবং সফলতা লাভের জন্য আত্মবিশ্বাসী করে তোলা
  2. শিক্ষার্থী কর্তৃক দৈনন্দিন জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ও প্রতিকূলতা উত্তরণে সক্ষমতা অর্জন
  3. শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ, সবল ও নিরাপদ জীবনযাপনে সক্ষমতা অর্জন
  4. ব্যক্তিক ও সামষ্টিক উন্নয়নে অবদান রাখার সামর্থ্য অর্জন

জীবন দক্ষতা তৈরিতে শিক্ষার্থীর দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা

ব্যক্তিজীবনে একজন শিক্ষার্থীকে জীবন দক্ষতা অর্জন করতে হলে জীবন দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষকরাই এ দায়িত্ব পালন করবেন। তারাই জীবন ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এনে প্রকৃত সহায়কের ভুমিকা পালন করতে পারেন।

এ দক্ষতা শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত সকল শক্তি ও সম্ভাবনার বিকাশ ঘটিয়ে জীবনের সকল ক্ষেত্রে সফল হওয়ার ভিত্তি তৈরি করে দেয়। জীবন ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা শিক্ষার্থীকে আত্মসচেতন ও আত্মবিশ্বাসী হতে, তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্তগ্রহণ, সূক্ষ্ম ও সৃজনশীল চিন্তনে কার্যকর যোগাযোগ সৃষ্টিতে, সুস্থ সম্পর্ক গড়তে, অন্যের প্রতি সহমর্মী হতে এবং চাপ ও আবেগ মোকাবিলায় সমর্থ করে তোলে। এর ফলে শিক্ষার্থী ইতিবাচক আচরণ আত্মস্থ করারমাধ্যমে নিজেকে দক্ষ ও বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা ও মানসিকতার মধ্যে ভারসাম্য বিধান করে শিক্ষার্থীর আচরণিক পরিবর্তন ঘটে। এ শিক্ষা প্রদানে অংশ গ্রহণমূলক ও শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিখন শেখানো পদ্ধতি অবশ্য এ শিক্ষা জেন্ডার প্রবণ, অধিকার ভিত্তিক ও বয়স উপযোগী। এটি ছেলে মেয়ে উভয়েরই ব্যক্তিগত ও সামাজিক সমস্যা প্রতিকূলতা মোকাবিলার ও মানবাধিকারের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয়। 

জীবন দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষা শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন করে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে সহায়তা করে। জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্কে উন্নয়ন সাধন করে। বিদ্যালয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ বৃদ্ধি করে, উপস্থিতির হার বৃদ্ধি করে ও শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার হ্রাস করে। এ শিক্ষা শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধন করে এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অবদান রাখতে সক্ষম, সুস্থ, দক্ষ, নীতিবান ও বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ গড়ে তুলে সুষ্ঠুু সমাজ গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার সার্বিক উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীর আধুনিক জীবন ও সমাজ সম্পর্কে সচেতন করা এবং সফলতা লাভের জন্য আত্মবিশ্বাসী করে তোলা। স্থান, কাল, পাত্র সামাজিক মূল্যায়ন, রীতিনীতি ও গোষ্ঠীর প্রত্যাশাভেদে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে।

প্রধানত উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশের শিশু কিশোরদের এসব সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা বেশি করতে হয়। বিশ্বব্যাপী ও অঞ্চল বিশেষে বিরাজমান সমস্যা উভয় ক্ষেত্রেই জীবন দক্ষতা কার্যকর সমাধান দেয়। এসব ছাড়াও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু, যেমন:  অটিজম আক্রান্ত বা শারীরিকভাবে অসমর্থ এমন শিশুদের সমস্যা মোকাবিলার ক্ষেত্রেও জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা অত্যন্ত কার্যকর। এসব শিশুদের স্বাবলম্বী জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় মনোসামাজিক এবং মনো‣দহিক দক্ষতাগুলো জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে। এ কারণে শারীরিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী এসব শিশুর নানা রকম চাহিদা পূরণের বিষয়টি জীবনদক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষার আওতাভুক্ত। এই শিক্ষা কর্মসূচির সাথে সমাজ কল্যাণ বা সমাজ কর্ম বিষয়ক কর্মসূচির সম্পৃক্ততা আছে। জীবন দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষাকে অনেক সময় ‘দক্ষতাভিত্তিক স্বাস্থ্য শিক্ষা হিসাবে অভিহিত করা হয়। এসব পপরিস্থিতি মোকাবিলায় জীবন দক্ষতা অত্যন্তকার্যকর এবং সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।

যেহেতু জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার অন্যতম উপায় বা হাতিয়ার সেহেতু এই শিক্ষা কর্মসূচির সাথে সমাজকল্যাণ বা সমাজকর্ম বিষয়ক কর্মসূচিরও সম্পৃক্ততা রয়েছে। জীবন দক্ষতাভিত্তিক বিষয়ব¯‧র আওতাভুক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মাতৃত্ব পিতৃত্ব শিক্ষা। গর্ভকালীন অবস্থা থেকে শুরু করে শিশুর জন্ম ও বেড়ে ওঠার পুরো সময়েই যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য মাতাপিতাকে জীবন দক্ষতা শিক্ষা দেওয়া জরুরি। এছাড়া মাতাপিতার আচরণের কারণে, আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির কারণে বা সন্তানের বিভিন্ন রকম ঝুকিপূর্ণ আচরণের (যেমন— মাদকাসক্তি, সমাজবিরোধী কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়া, মাতাপিতার সাথে অসদাচরণ) কারণে-যে কারণেই হোক না কেন সনাতন পারিবারিক কাঠামো ভেঙ্গে যেতে পারে বা পরিবারের মধ্যে সুসম্পর্কের অভাব দেখা দিতে পারে। এসব পরিস্থিতির মোকাবিলায় জীবন দক্ষতা অত্যন্তকার্যকর ও সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। সহিংসতা, সংঘর্ষ মোকাবিলায় ও এ সকল প্রতিরোধের ক্ষেত্রে জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা অত্যন্ত ফলপ্রসূ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক সনাক্তকৃত ও সংজ্ঞায়িত দশটি জীবন দক্ষতা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১০টি মূল জীবন দক্ষতাকে সনাক্ত ও সংজ্ঞায়িত করেছেন। এ সংস্থাটির মতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে অবশ্যই এ দক্ষতাগুলো অর্জন করবে।

  • ১. আত্মসচেতনতামূলক দক্ষতা (Self Awareness): নিজের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি ও পোষণ করা, নিজ সামর্থ্য, সবলতা, দুর্বলতা, গুণাবলি ও ত্রুটি নিরূপণ করা। শিক্ষার্থীর নিজ আচরণ সংশোধন করা, স্বনির্দেশনা এবং নিজের ও অন্যের কাছে গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করা। নিজ আবেগ ও অনুভূতি সম্পর্কে সচেতনতা, নিজ বিশ্বাস ও মূল্যবোধ সনাক্ত করা, অনভিপ্রেত ও নেতিবাচক চিন্তাভাবনা বন্ধ করা।
  • ২. সহমর্মিতা দক্ষতা (Empathy): প্রত্যেকের অন্যের সমস্যা মন দিয়ে কোনোা, অন্যের অবস্থা বুঝতে চেষ্টা করা, অন্যের গুণগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করা। অপরের যে কোনো বিষয়ে ইতিবাচক হওয়া, অনুভূতিতে সাড়া দেওয়া এবং প্রয়োজনে সাহায্য ও সহযোগিতা করার প্রস্তাব করা।
  • ৩. আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা (Interpersonal Relationships): ব্যক্তির নিজের আবেগ জানা, বোঝা ও নিয়ন্ত্রণে রাখার সক্ষমতা তৈরি করা। নিজের সবল ও দুর্বল দিকগুলো জানা, রাগ, ক্ষোভ তথা অপ্রত্যাশিত আবেগের বহি:প্রকাশ নিয়ন্ত্রণে রাখা। আত্ম-প্রত্যয়/আত্ম-বিশ্বাসী হয়ে দায়িত্ব গ্রহণ, কর্মসম্পাদনে সীমিত ঝুঁকি নিতে তৈরি থাকা, সমস্যা সমাধানে নানা বিরোধিতা সত্ত্বেও নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাওয়া, পরিস্থিতি ভেদে ক্ষমা করার এবং তা ভুলে যাওয়ার মানসিকতা অর্জন এবং ব্যর্থতা উত্তরণ করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা।
  • ৪. বিশ্লেষণমূলক গভীর চিন্তন দক্ষতা (Critical Thinking Skill): সঙ্গী, সাথী ও মিডিয়ার প্রভাব, তথ্য ও পরিস্থিতি, বিজ্ঞাপন, বিবৃতি ইত্যাদি ব¯‧নিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করার দক্ষতা। প্রাসঙ্গিক তথ্য চিহ্নিত করা, তথ্যের উৎস অনুসন্ধান ও তথ্য সংগ্রহের দক্ষতা। সংগৃহীত তথ্য প্রণালীবদ্ধভাবে বিশ্লেষণের ও যে․ক্তিক উপসংহারে উপনীত হওয়ার দক্ষতা।
  • ৫. যোগাযোগ দক্ষতা (Effective Communication Skill): মন দিয়ে কোনোার অভ্যাস গড়ে তোলা, বুঝতে না পারলে জিজ্ঞাসা করা, নিজে যখন বলবেন বা লিখবেন-সুস্পষ্ট স্বরে, সঠিক শব্দ ব্যবহার করে পূর্ণ বাক্য বলা বা লেখার অভ্যাস করা। অন্যকে দোষারোপ করে কথা বলার অভ্যাস পরিত্যাগ করা, আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার না করা, কথা বলার সময় যাচাই করা যেন সবাই বুঝতে পারছেন কিনা, কথাবার্তা বা আলাপ আলোচনায় আগ্রহ দেখানো, সততার সঙ্গে কথা বলা, বর্ণনার সময় খুঁটিনাটি বিষয় ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বাদ না দেওয়া, প্রয়োজন হলে ক্ষমা চাওয়া। 
  • ৬. সৃজনশীল চিন্তন দক্ষতা (Creative Thinking Skill): শিক্ষার্থীর প্রচুর পড়াশোনা ও ভাবনাচিন্তা করার অভ্যাস করা, গতানুগতিকতার বাইরে কিছু করার চেষ্টা করা, সব বিষয়ে নতুন ধারণা সৃষ্টি করা, নতুন কোনো রচনা, বস্তু তৈরি করা, নতুন যুক্তি উপস্থাপন করা। 
  • ৭. সমস্যা সমাধান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা অর্জনের ধাপসমূহ (Problem Solving Skill ): পরিস্থিতি, সমস্যা, বিপদ, চ্যালেঞ্জ বা কাজ ঠিক মতো বুঝে নেওয়া, সংশ্লিষ্ট তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা, সম্ভাব্য সমাধানসমূহ চিহ্নিত করা, প্রতিটি বিকল্প সমাধানের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ ফলাফল বিবেচনার সমাধান করতে পারা।
  • ৮. সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা (Decision Making Skill): সমস্যা সমাধানের দক্ষতার মতোই সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা অর্জনের রূপ হয়ে থাকে। তবে এক্ষেত্রে সমাধানের জন্য উপলব্ধ একাধিক বিকল্প থেকে সবচেয়ে উপযুক্ত বিকল্প খুঁজে বের করে সে অনুযায়ী সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়াই হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় অধিকাংশ সময়েই সুযোগ ব্যয় করতে হয়।
  • ৯. চাপ মোকাবিলার দক্ষতা (Stress Managment): মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী উপাদন/পরিস্থিতি/ব্যক্তি সনাক্ত করতে পারা। ব্যক্তির শরীর ও মন কিভাবে এই সকল চাপ সৃষ্টিকারী উপাদানের প্রতি সাড়া দেয়, তা সনাক্ত করতে পারা। নিজেকে শান্তরাখা, চাপ বা আবেগ এর জন্য দায়ী উপাদান হ্রাস করা বা দর করার চেষ্টা করা। বন্ধু বা নির্ভরযোগ্য কারো সাথে আলোচনা করা। সহমর্মী কারো সাথে মনের কষ্টের কথা বললে চাপ লাঘব হয়, গ্রহণযোগ্য পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করা।
  • ১০. আবেগ নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা (Emotion Managment): আবেগ (রাগ, ভয়, হিংসা, ঈর্ষা, হতাশা ইত্যাদি) এর কারণ সঠিকভাবে চিহ্নিত করে কারণগুলো দর করা বা সেগুলোর তীব্রতা হ্রাস করার ব্যবস্থা করা। আবেগ কাটিয়ে ওঠার জন্য দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করা, মনে রাখতে হবে, কোনো অবস্থাই স্থায়ী নয়-ভবিষ্যতের সম্ভাব্য কোনো আনন্দময় বা খুশির ঘটনা মনে করা, যে কোনো পরিস্থিতিতেই মনোবল বজায় রাখা, নিজেকে শান্ত থাকতে বলা এবং ৈধর্য ধারণ করা। নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত আত্মীয়, বন্ধু, শিক্ষক এর সাথে মানসিক অবস্থা শেয়ার করা এবং তার কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়া। 

[বাউবি ও বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত মডিউল অবলম্বনে]

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের জীবন দক্ষতাসমূহ আয়ত্ত ও আত্মস্থ করানোর উদ্দেশ্যে প্রণীত একটি শিক্ষা।

জীবন দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষার ধারণা, বৈশিষ্ট্য প্রয়োজনীয়তা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১০ টি জীবন দক্ষতা

প্রকাশ: ১২:২৪:২৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

জীবন দক্ষতা হলো মানসিক স্বাস্থ্য-সক্ষমতার অংশ, যার সাহায্যে যে কোন পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার এবং ইতিবাচক আচরণের ক্ষমতা বা দক্ষতা, যা মানুষকে তার দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা ও চ্যালেঞ্জগুলির সাথে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম করে তোলে। অন্য কথায়, জীবন দক্ষতা হলো মনোসামাজিক পারদর্শিতা বা সক্ষমতা।

জীবন দক্ষতার ধারণা

জীবন দক্ষতা হলো এক ধরণের বিমূর্ত বিষয়। এটি অর্জন করা ও লালন করে চলার বিষয়। ব্যক্তি মানসিকতার সামাজিক সম্পর্কায়ন। অর্থাৎ ব্যক্তি মানসের সাথে সমাজের সম্পর্ক বিষয়ক দক্ষতা যা চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করতে সক্ষম। জীবন দক্ষতা ব্যক্তির সম্ভাবনা ও উদ্ভাবনী শক্তিকে বিকশিত করে জীবনের সব ক্ষেত্রে সাফল্য তৈরিতে সহায়তা করে। জীবন দক্ষতাকে মানবদক্ষতা, মনোসামাজিক দক্ষতা, ব্যক্তিদক্ষতা, আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা, আত্ম নিয়ন্ত্রণ দক্ষতা বলেও অভিহিত করা হয়। জীবন দক্ষতার কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ:

জীবন দক্ষতার ধারণার সাথে সুস্থ দেহ, সুস্থ মন ও সুস্থ বিকাশের সম্পর্ক রয়েছে। সুস্বাস্থ্য শব্দটি শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সম্পর্কিত। দক্ষ মানুষ হয়ে উঠতে চাইলে সুস্থ মন ও দেহের অধিকারী হতে হবে। তাহলে সমাজে সুস্থতা তৈরি হবে। শিক্ষার্থী তেমন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আগ্রহী হবে তেমনি নানা রকম ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ পরিহারে সমর্থ হবে ফলে বিভিন্ন সংক্রমণজনিত রোগ থেকে রেহাই পাবে।

জীবন দক্ষতা তৈরিতে দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার ধারণা

জীবন দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষা হলো এমন একটি শিখন-শেখানো অভিজ্ঞতা বা যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা জীবন দক্ষতাসমূহ অর্জন করে। যে-কোনো শিক্ষা প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের আচরণিক পরিবর্তন ঘটানো। আচরণিক পরিবর্তন ঘটে জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি/মানসিকতা এগুলো পরিবর্তনের সম্মিলিত প্রভাবে। সুতরাং যে কোনো শিক্ষা কর্মসূচির মধ্যে বিষয়সংশ্লিষ্ট জ্ঞান, জ্ঞানকে প্রয়োগের জন্য দক্ষতার অনুশীলন এবং দক্ষতাকে কাজে লাগানোর মানসিকতা সৃষ্টির ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত থাকা আবশ্যিক। জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের জীবন দক্ষতাসমূহ আয়ত্ত ও আত্মস্থ করানোর উদ্দেশ্যে প্রণীত একটি শিক্ষা। এটি শিক্ষাক্রম ও শিক্ষা কার্যক্রমে এমনভাবে পরিকল্পিত ও প্রণীত হয় যে পাঠসমূহ ও সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির মধ্যেই দক্ষতাসমূহ অর্জন করার একটি অন্তলীন ব্যবস্থা সৃষ্টি করে দেওয়া হয়।

জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য

  1. শিক্ষার্থীকে সুরক্ষামূলক আচরণ করতে এবং ঝুকিপূর্ণ আচরণ পরিহার করতে সামর্থ করে শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা ও মানসিকতার মধ্যে ভারসাম্য বিধান করে শিক্ষার্থীর আরচণিক পরিবর্তন ঘটায়
  2. জীবন দক্ষতা সনাক্ত করা যায়, প্রদর্শন করা যায় উপদক্ষতা ও অনুদক্ষতায় বিভাজন করা যায়, অনুকরণ ও অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জন করা যায়, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করা যায়
  3. জীবন দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষা জেন্ডারপ্রবণ, অধিকারভিত্তিক ও বয়সোপযোগী
  4. অভিজ্ঞতাপ্রসূত জ্ঞান ও দক্ষতা জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার একটি বড় উপাদান
  5. এ শিক্ষাকে স্বাস্থ্যশিক্ষাও বলা হয়
  6. এ শিক্ষা শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন করে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে সহায়তা করে
  7. এ শিক্ষার সফল বাস্তবায়নের জন্য কিশোর বান্ধব স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সেবার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা আবশ্যক

জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার সার্বিক বা সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য

শিক্ষক কর্তৃক বয়সোপযোগী জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতাসম্পন্ন উপযুক্ত ও দক্ষ কিশোর কিশোরী গড়ে তোলা। তাদের মধ্যে নিজেদের সকল সম্ভাবনা ও প্রচ্ছন্ন শক্তির পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটিয়ে একজন সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার সামর্থ্য ও প্রণোদনা সৃষ্টি করা।

  1. শিক্ষার্থীদের আধুনিক জীবন ও সমাজ সম্পর্কে সচেতন করা এবং সফলতা লাভের জন্য আত্মবিশ্বাসী করে তোলা
  2. শিক্ষার্থী কর্তৃক দৈনন্দিন জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ও প্রতিকূলতা উত্তরণে সক্ষমতা অর্জন
  3. শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ, সবল ও নিরাপদ জীবনযাপনে সক্ষমতা অর্জন
  4. ব্যক্তিক ও সামষ্টিক উন্নয়নে অবদান রাখার সামর্থ্য অর্জন

জীবন দক্ষতা তৈরিতে শিক্ষার্থীর দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা

ব্যক্তিজীবনে একজন শিক্ষার্থীকে জীবন দক্ষতা অর্জন করতে হলে জীবন দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষকরাই এ দায়িত্ব পালন করবেন। তারাই জীবন ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এনে প্রকৃত সহায়কের ভুমিকা পালন করতে পারেন।

এ দক্ষতা শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত সকল শক্তি ও সম্ভাবনার বিকাশ ঘটিয়ে জীবনের সকল ক্ষেত্রে সফল হওয়ার ভিত্তি তৈরি করে দেয়। জীবন ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা শিক্ষার্থীকে আত্মসচেতন ও আত্মবিশ্বাসী হতে, তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্তগ্রহণ, সূক্ষ্ম ও সৃজনশীল চিন্তনে কার্যকর যোগাযোগ সৃষ্টিতে, সুস্থ সম্পর্ক গড়তে, অন্যের প্রতি সহমর্মী হতে এবং চাপ ও আবেগ মোকাবিলায় সমর্থ করে তোলে। এর ফলে শিক্ষার্থী ইতিবাচক আচরণ আত্মস্থ করারমাধ্যমে নিজেকে দক্ষ ও বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা ও মানসিকতার মধ্যে ভারসাম্য বিধান করে শিক্ষার্থীর আচরণিক পরিবর্তন ঘটে। এ শিক্ষা প্রদানে অংশ গ্রহণমূলক ও শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিখন শেখানো পদ্ধতি অবশ্য এ শিক্ষা জেন্ডার প্রবণ, অধিকার ভিত্তিক ও বয়স উপযোগী। এটি ছেলে মেয়ে উভয়েরই ব্যক্তিগত ও সামাজিক সমস্যা প্রতিকূলতা মোকাবিলার ও মানবাধিকারের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয়। 

জীবন দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষা শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন করে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে সহায়তা করে। জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্কে উন্নয়ন সাধন করে। বিদ্যালয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ বৃদ্ধি করে, উপস্থিতির হার বৃদ্ধি করে ও শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার হ্রাস করে। এ শিক্ষা শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধন করে এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অবদান রাখতে সক্ষম, সুস্থ, দক্ষ, নীতিবান ও বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ গড়ে তুলে সুষ্ঠুু সমাজ গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার সার্বিক উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীর আধুনিক জীবন ও সমাজ সম্পর্কে সচেতন করা এবং সফলতা লাভের জন্য আত্মবিশ্বাসী করে তোলা। স্থান, কাল, পাত্র সামাজিক মূল্যায়ন, রীতিনীতি ও গোষ্ঠীর প্রত্যাশাভেদে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে।

প্রধানত উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশের শিশু কিশোরদের এসব সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা বেশি করতে হয়। বিশ্বব্যাপী ও অঞ্চল বিশেষে বিরাজমান সমস্যা উভয় ক্ষেত্রেই জীবন দক্ষতা কার্যকর সমাধান দেয়। এসব ছাড়াও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু, যেমন:  অটিজম আক্রান্ত বা শারীরিকভাবে অসমর্থ এমন শিশুদের সমস্যা মোকাবিলার ক্ষেত্রেও জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা অত্যন্ত কার্যকর। এসব শিশুদের স্বাবলম্বী জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় মনোসামাজিক এবং মনো‣দহিক দক্ষতাগুলো জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে। এ কারণে শারীরিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী এসব শিশুর নানা রকম চাহিদা পূরণের বিষয়টি জীবনদক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষার আওতাভুক্ত। এই শিক্ষা কর্মসূচির সাথে সমাজ কল্যাণ বা সমাজ কর্ম বিষয়ক কর্মসূচির সম্পৃক্ততা আছে। জীবন দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষাকে অনেক সময় ‘দক্ষতাভিত্তিক স্বাস্থ্য শিক্ষা হিসাবে অভিহিত করা হয়। এসব পপরিস্থিতি মোকাবিলায় জীবন দক্ষতা অত্যন্তকার্যকর এবং সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।

যেহেতু জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার অন্যতম উপায় বা হাতিয়ার সেহেতু এই শিক্ষা কর্মসূচির সাথে সমাজকল্যাণ বা সমাজকর্ম বিষয়ক কর্মসূচিরও সম্পৃক্ততা রয়েছে। জীবন দক্ষতাভিত্তিক বিষয়ব¯‧র আওতাভুক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মাতৃত্ব পিতৃত্ব শিক্ষা। গর্ভকালীন অবস্থা থেকে শুরু করে শিশুর জন্ম ও বেড়ে ওঠার পুরো সময়েই যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য মাতাপিতাকে জীবন দক্ষতা শিক্ষা দেওয়া জরুরি। এছাড়া মাতাপিতার আচরণের কারণে, আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির কারণে বা সন্তানের বিভিন্ন রকম ঝুকিপূর্ণ আচরণের (যেমন— মাদকাসক্তি, সমাজবিরোধী কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়া, মাতাপিতার সাথে অসদাচরণ) কারণে-যে কারণেই হোক না কেন সনাতন পারিবারিক কাঠামো ভেঙ্গে যেতে পারে বা পরিবারের মধ্যে সুসম্পর্কের অভাব দেখা দিতে পারে। এসব পরিস্থিতির মোকাবিলায় জীবন দক্ষতা অত্যন্তকার্যকর ও সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। সহিংসতা, সংঘর্ষ মোকাবিলায় ও এ সকল প্রতিরোধের ক্ষেত্রে জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা অত্যন্ত ফলপ্রসূ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক সনাক্তকৃত ও সংজ্ঞায়িত দশটি জীবন দক্ষতা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১০টি মূল জীবন দক্ষতাকে সনাক্ত ও সংজ্ঞায়িত করেছেন। এ সংস্থাটির মতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে অবশ্যই এ দক্ষতাগুলো অর্জন করবে।

  • ১. আত্মসচেতনতামূলক দক্ষতা (Self Awareness): নিজের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি ও পোষণ করা, নিজ সামর্থ্য, সবলতা, দুর্বলতা, গুণাবলি ও ত্রুটি নিরূপণ করা। শিক্ষার্থীর নিজ আচরণ সংশোধন করা, স্বনির্দেশনা এবং নিজের ও অন্যের কাছে গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করা। নিজ আবেগ ও অনুভূতি সম্পর্কে সচেতনতা, নিজ বিশ্বাস ও মূল্যবোধ সনাক্ত করা, অনভিপ্রেত ও নেতিবাচক চিন্তাভাবনা বন্ধ করা।
  • ২. সহমর্মিতা দক্ষতা (Empathy): প্রত্যেকের অন্যের সমস্যা মন দিয়ে কোনোা, অন্যের অবস্থা বুঝতে চেষ্টা করা, অন্যের গুণগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করা। অপরের যে কোনো বিষয়ে ইতিবাচক হওয়া, অনুভূতিতে সাড়া দেওয়া এবং প্রয়োজনে সাহায্য ও সহযোগিতা করার প্রস্তাব করা।
  • ৩. আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা (Interpersonal Relationships): ব্যক্তির নিজের আবেগ জানা, বোঝা ও নিয়ন্ত্রণে রাখার সক্ষমতা তৈরি করা। নিজের সবল ও দুর্বল দিকগুলো জানা, রাগ, ক্ষোভ তথা অপ্রত্যাশিত আবেগের বহি:প্রকাশ নিয়ন্ত্রণে রাখা। আত্ম-প্রত্যয়/আত্ম-বিশ্বাসী হয়ে দায়িত্ব গ্রহণ, কর্মসম্পাদনে সীমিত ঝুঁকি নিতে তৈরি থাকা, সমস্যা সমাধানে নানা বিরোধিতা সত্ত্বেও নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাওয়া, পরিস্থিতি ভেদে ক্ষমা করার এবং তা ভুলে যাওয়ার মানসিকতা অর্জন এবং ব্যর্থতা উত্তরণ করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা।
  • ৪. বিশ্লেষণমূলক গভীর চিন্তন দক্ষতা (Critical Thinking Skill): সঙ্গী, সাথী ও মিডিয়ার প্রভাব, তথ্য ও পরিস্থিতি, বিজ্ঞাপন, বিবৃতি ইত্যাদি ব¯‧নিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করার দক্ষতা। প্রাসঙ্গিক তথ্য চিহ্নিত করা, তথ্যের উৎস অনুসন্ধান ও তথ্য সংগ্রহের দক্ষতা। সংগৃহীত তথ্য প্রণালীবদ্ধভাবে বিশ্লেষণের ও যে․ক্তিক উপসংহারে উপনীত হওয়ার দক্ষতা।
  • ৫. যোগাযোগ দক্ষতা (Effective Communication Skill): মন দিয়ে কোনোার অভ্যাস গড়ে তোলা, বুঝতে না পারলে জিজ্ঞাসা করা, নিজে যখন বলবেন বা লিখবেন-সুস্পষ্ট স্বরে, সঠিক শব্দ ব্যবহার করে পূর্ণ বাক্য বলা বা লেখার অভ্যাস করা। অন্যকে দোষারোপ করে কথা বলার অভ্যাস পরিত্যাগ করা, আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার না করা, কথা বলার সময় যাচাই করা যেন সবাই বুঝতে পারছেন কিনা, কথাবার্তা বা আলাপ আলোচনায় আগ্রহ দেখানো, সততার সঙ্গে কথা বলা, বর্ণনার সময় খুঁটিনাটি বিষয় ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বাদ না দেওয়া, প্রয়োজন হলে ক্ষমা চাওয়া। 
  • ৬. সৃজনশীল চিন্তন দক্ষতা (Creative Thinking Skill): শিক্ষার্থীর প্রচুর পড়াশোনা ও ভাবনাচিন্তা করার অভ্যাস করা, গতানুগতিকতার বাইরে কিছু করার চেষ্টা করা, সব বিষয়ে নতুন ধারণা সৃষ্টি করা, নতুন কোনো রচনা, বস্তু তৈরি করা, নতুন যুক্তি উপস্থাপন করা। 
  • ৭. সমস্যা সমাধান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা অর্জনের ধাপসমূহ (Problem Solving Skill ): পরিস্থিতি, সমস্যা, বিপদ, চ্যালেঞ্জ বা কাজ ঠিক মতো বুঝে নেওয়া, সংশ্লিষ্ট তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা, সম্ভাব্য সমাধানসমূহ চিহ্নিত করা, প্রতিটি বিকল্প সমাধানের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ ফলাফল বিবেচনার সমাধান করতে পারা।
  • ৮. সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা (Decision Making Skill): সমস্যা সমাধানের দক্ষতার মতোই সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা অর্জনের রূপ হয়ে থাকে। তবে এক্ষেত্রে সমাধানের জন্য উপলব্ধ একাধিক বিকল্প থেকে সবচেয়ে উপযুক্ত বিকল্প খুঁজে বের করে সে অনুযায়ী সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়াই হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় অধিকাংশ সময়েই সুযোগ ব্যয় করতে হয়।
  • ৯. চাপ মোকাবিলার দক্ষতা (Stress Managment): মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী উপাদন/পরিস্থিতি/ব্যক্তি সনাক্ত করতে পারা। ব্যক্তির শরীর ও মন কিভাবে এই সকল চাপ সৃষ্টিকারী উপাদানের প্রতি সাড়া দেয়, তা সনাক্ত করতে পারা। নিজেকে শান্তরাখা, চাপ বা আবেগ এর জন্য দায়ী উপাদান হ্রাস করা বা দর করার চেষ্টা করা। বন্ধু বা নির্ভরযোগ্য কারো সাথে আলোচনা করা। সহমর্মী কারো সাথে মনের কষ্টের কথা বললে চাপ লাঘব হয়, গ্রহণযোগ্য পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করা।
  • ১০. আবেগ নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা (Emotion Managment): আবেগ (রাগ, ভয়, হিংসা, ঈর্ষা, হতাশা ইত্যাদি) এর কারণ সঠিকভাবে চিহ্নিত করে কারণগুলো দর করা বা সেগুলোর তীব্রতা হ্রাস করার ব্যবস্থা করা। আবেগ কাটিয়ে ওঠার জন্য দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করা, মনে রাখতে হবে, কোনো অবস্থাই স্থায়ী নয়-ভবিষ্যতের সম্ভাব্য কোনো আনন্দময় বা খুশির ঘটনা মনে করা, যে কোনো পরিস্থিতিতেই মনোবল বজায় রাখা, নিজেকে শান্ত থাকতে বলা এবং ৈধর্য ধারণ করা। নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত আত্মীয়, বন্ধু, শিক্ষক এর সাথে মানসিক অবস্থা শেয়ার করা এবং তার কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়া। 

[বাউবি ও বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত মডিউল অবলম্বনে]