০৭:৩৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ জুলাই ২০২৪, ৯ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার কয়েকটি জাদু অজানাই থেকে যাচ্ছে

মাছুম বিল্লাহ
  • প্রকাশ: ০১:১৮:১৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ মে ২০২৪
  • / ৫০৬ বার পড়া হয়েছে


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ তারিখ সারাদেশে একযোগে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু  হয়, লিখিত পরীক্ষা  শেষ হয় গত ১২মার্চ।  ১৩ মার্চ থেকে ২০ মার্চের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় ব্যবাহারিক পরীক্ষা। বলা যায় দু’মাসেরও কম সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীদের জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয় ১২ মে, ২০২৪। প্রতি বছরের মতোই এবারও বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রথা অনুযায়ী ফল প্রকাশ করেছেন। এটি আমাদের দেশের একটি আলাদা ট্রাডিশন এবং এটি  আলাদা একটি গুরুত্ব বহন করে। পৃথিবীর সব  দেশেই পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় কিন্তু রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীকে আমরা এসব বিষয় কোন কথা বলতে সাধারনত দেখিনা।কিন্তু আমাদের দেশের রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী এই ফল প্রকাশ করেন এবং ফলের সার্বিক বিষয়ে খোঁজখবর নেন, পরামর্শ দেন, অনেক বিষয় সংশ্লিষ্টদের কাছে জানতে চান।  এবার এসএসসি পরীক্ষায় গড় পাস করেছে ৮৩দশমিক ০৪শতাংশ। ।এদের মধ্যে ছাত্রদের পাসের হার ৮১দশমিক ৫৭শতাংশ, ছাত্রীদের-পাসের হার ৮৪দশমিক ৪৭শতাংশ। এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ছেলেদের সংখ্যা কম দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী এবং তাদের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণও জানতে চেয়েছেন। দেশে স্বাক্ষরতার হার বেড়েছে, শিক্ষায় অংশ নেয়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। মেয়েদের হার বেড়েছে অনেক। প্রাথমিকে এক সময় ৫৪শতাংশ ছাত্রী যেত, এখন ৯৮ শতাংশ যাচ্ছে। মাত্র তিনটি বোর্ডে ছাত্রের সংখ্যা একটু বেশি, অধিকাংশ জায়গায় ছাত্রীদের সংখ্যা বেশি। নারী শিক্ষার ওপর জোর দেয়ার ফল হচ্ছে এটি। এবার ১১টি বোর্ডে ছাত্র সংখ্যা ৯ লাখ ৯৯ হাজার ৩৬৪ জন আর ছাত্রী সংখ্যা ১০ লাখ ৩৮ হাজার ৭৮৬জন। পাসের হারেও মেয়েরা এগিয়ে। যারা অকৃতকার্য হয়েছেন তাদের প্রতি কোন ধরনের নেতিবাচক আচরণ না করার জন্যও প্রধানমন্ত্রী  পরামর্শ দিয়েছেন। 

মোট ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এ বছর ২০ লাখ ২৪হাজার ১৯২জন পরীক্ষার্থী এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে ৯ টি সাধারন শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পরীক্ষার্থী ছিলেন ১৬ লাখ ৬ হাজার ৮৭৯ জন। মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে দাখিল পরীক্ষা দিয়েছেন মোট ২ লাখ ৪২ হাজার ৩১৪ জন। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি  (ভোকেশনাল) ও দাখিল (ভোকেশনাল) পরীক্ষায় অংশ নেন ১ লাখ ২৬ হাজার ৩৭৩ জন। গত বছর এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন মোটা ২০ লাখ ৪১ হাজার ৪৫০ জন। গতবার পাসের হার ছিল ৮০ দশমিক ৩৯ শতাংশ , তার মানে হচ্ছে ২০২৪ সালের পাসের হার বেড়েছে। ঢাকা বোর্ডে এবার পাসের হার ৮৯ দশমিক ৩২ শতাংশ, রাজশাহী বোর্ডে  ৮৯ দশমিক ২৫ শতাংশ, কুমিল্লায় ৭৯ দশমিক ২৩ শতাংশ, চট্টগ্রাম বোর্ডে ৮২দশমিক ৮০ শতাংশ, বরিশালে ৮৯ দশমিক ১৩ শতাংশ, দিনাজপুরে ৭৮ দশমিক ৪০ শতাংশ ও ময়মনসিংহে ৮৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এবার যশোর বোর্ডে পাসের হার ৯২দশমিক ৩২শতাংশ আর সর্বনিম্ন সিলেট বোর্ডে, সেখানে পাসের হার ৭৩দশমিক ৩৫ শতাংশ অর্থাৎ সিলেট বোর্ডে ১৮.৯৭ মানে ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থী কম পাস করেছে। এই জাদুর অর্থ আজও জানা গেল না। একই সিলেবাস, একই সময়ে পরীক্ষা, একই ধরনের শিক্ষকগণ পড়িয়ে থাকেন তাহলে কি কারণ কিংবা কি কি কারনে এক বোর্ডের ফল অন্য বোর্ড থেকে এত বেশি পার্থক্য প্রদর্শন করে। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে দেখা যাবে, সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া বোর্ডটির ফল পরবর্তী বছর হঠাৎ করে সবাই উপরে চলে যায়! আমাদের বোর্ডগুলো কি বিষয়টি নিয়ে কোনো আলোচনা করে?  কারণ অনুসন্ধান করে জাতিকে জানানো উচিত নয়? তা না হলে বিষয়টিতো গুরুত্বহীন থেকে যাবে। 

মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা পাস ফেলে একটু পিছিয়ে থাকে, এ নিয়ে গবেষণা না থাকলেও অনুমিত কিছু কারন বা আমাদের অবজারভেশন থেকেই কারন আমরা জানতে পারি। আর একটি বিষয় প্রতি বছরই দেখা যেত , যে মাদরাসা বোর্ড ফলের দিক থেকে সাধারন শিক্ষা বোর্ডগুলো থেকে এগিয়ে থাকে।  এর পেছনে যৌক্তিক কোনো কারণই নেই। যাই হোক বিষয়টি এবার সেভাবে ঘটেনি। এবার মাদরাসা বোর্ডে পাসের হার ৭৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ, আর জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা ১৪ হাজার ২০৬ জন। কারিগরি বোর্ডে পাসের হার ৮১ দশমিক ৩৮শতাংশ। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পাস ফেল আমাদের খুব একটা স্পষ্ট মেসেজ দেয় না। এখানে বেশির ভাগই প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা হওয়ার কথা কিন্তু এই ফল আমাদের কি বলে তার ব্যাখ্যা আমরা কোথাও দেখতে পাইনা। তাছাড়া কারিগরি শিক্ষা যে পরিমান গুরুত্ব পাওয়ার কথা বর্তমান অবস্থা সেটি থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে।  

আর একটি বিষয় আমরা প্রতিবছরই দেখি যে, কিছু সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে একজন শিক্ষার্থীও পাস করেনা, গত বছর এই সংখ্যা ছিল ৪৮টি, এবার দেখলাম ৫১টি অর্থাৎ বেড়ে গেছে। প্রথমেই বলা যায়, পাস করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট রিল্যাক্সিং অবস্থা থাকে , তারমধ্যেও এই অবস্থা! তার মানে হচ্ছে পুরো অকৃতকার্যের বিষয় নিয়ে ফলাফলের পর আর কোন আলোচনা খুব একটা হয়না। আলোচনা হলে এ বিষয়টি বার বার দেখা যেত না। মিডিয়ার কল্যাণে এবং কিছু শিক্ষা সাংবাদিকদের কারণে আমরা  শূন্য পাস প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু কারণ জানতে পারি কিন্তু বোর্ড কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে খুব একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা আমরা শুনতে পাইনা। 

এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ মানে দেশব্যাপী স্কুল-মাদরাসায় উৎসবমুখর পরিবেশ। ফল প্রকাশের দিন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে শাসনের গাম্ভীর্যের বেড়াজাল ভেঙ্গে একাকার হয়ে যান সবাই, উপভোগ করেন যৌথপ্রয়াসে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া শিক্ষাকার্যক্রমের মুল্যায়ন। শিক্ষক ভুলে যান পাঁচ বছর পরে এই শিক্ষার্থীরা কে কোথায় থাকবে, তাদের ক’ জনের সাথে যোগাযোগ থাকবে, কিন্তু সমস্ত সংকীর্ণতার  উধের্ব উঠে শিক্ষকগন আনন্দে শামিল হন প্রানপ্রিয় শিক্ষার্থীদের সাথে। শিক্ষকের বাসায় হয়তো বাজার করার অর্থ নেই, বাসার বহু সমস্যা । সবকিছু ফেলে এই দিনটি তারা ঈদের চেয়েও যেন আনন্দ নিয়ে উদযাপন করেন। শিক্ষকতা জীবনে এইটুকুই তো পাওয়া। 

কোন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক পাস, জিপিএ-৫ প্রাপ্তি ও সহপাঠক্রমিক কার্যবালীর সাথে শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্টতা ও অংশগ্রহন ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের র‌্যাংকিং থাকা প্রয়োজন এবং এটি  কোন থার্ড পার্টি করলে ভাল হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট সরকারি কোন বিভাগের করা ঠিক নয়।   সরকারি, বেসরকারি, এমপিওভুক্ত, নন-এমপিওভুক্ত নির্বিশেষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান র‌্যাংকিং থাকা প্রয়োজন। দেশে একটি র‌্যাংকিং পদ্ধতি থাকলে আমরা সহজে বুঝতে পারি বোর্ডগুলোর ফলাফলের সাথে র‌্যাংকিং কতটা সাদৃশ্যপূর্ণ।  তাছাড়া র‌্যাংকিং বিষয়টি  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানুগলোর মধ্যে  একটি সুস্থ  প্রতিযোগিতা  সৃষ্টি করে আর শিক্ষার জরুরী অথচ  উপেক্ষিত  উপদানগুলো যেমন খেলাধূলা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, নৈতিক শিক্ষা, সামাজিক শিক্ষা, আচার আচরণ এগুলোর কোন প্রতিফলন এসব ফলে দেখা যায়ন, বুঝা যায়না অথচ জীবনে চলতে, এগুতে, কাজ করতে, এগুলোর খুব প্রয়োজন। নতুন কারিকুলামে এগুলো মূল্যায়নের বিষয় উল্লেখ আছে, কিন্তু সেখানেও খুব আশাবাদী হতে পারছিনা কারণ বিষয়গুলো সেভাবে এগুচ্ছেনা আর বাস্তবের চেয়ে  উচচাশার প্রতিফলন বেশি দেখা যাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান র‌্যংকিং হলে এসব বিষয় চলে আসে এবং তখন বলা যায় কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের সার্বিক শিক্ষা প্রদান করছে। 

ইংরেজি ও গণিত মাধ্যমিক পর্যায়ে একটি ক্রিটিক্যাল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে কারন এ দুটি বিষয়ে একমাত্র স্বনামধন্য কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকীগুলোতে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকই নেই। শিক্ষার্থীরা স্বভাবতই এ দুটি বিষয়ের দুর্বলতা নিয়ে উচচ-মাধ্যমিক ও উচচশিক্ষা স্তর পার করে। অথচ পাবলিক পরীক্ষা পাশের হারে কোন এক জাদুর পরশে দেখা যায় এ দুটো বিষয়ে পাশের হার আকাশ ছোঁয়া। এবার ঢাকা বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৯৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ, গণিতে ৮৮ শতাংশ। পাসের হারে এগিয়ে থাকে যেশার বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৯৬শতাংশ আর গণিতে ৯৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এই ফল ও আমাদের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ও গণিতের প্রকৃত দক্ষতা তুলে ধরছে কিনা সেটি একটি প্রশ্ন। আমাদের শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল, তারা দেশের বাইরে গিয়ে কিংবা দেশেও বিভিন্নভাবে তাদের মেধার ও সৃজনশীলতার সাক্ষর রেখে চলেছেন অথচ তাদেরকে সিস্টেম্যাটিক্যালি দুর্বল মূল্যায়নের দিক দিয়ে যেতে হয় আর তাদের ফল নিয়ে তাই অনেকেই প্রশ্ন তোলেন। বিষয়টিতে নজর দেওয়া একান্তই প্রয়োজন। শিক্ষাক্ষেত্রে  বোর্ডগুলোর ভূমিকা কি দেখি? শুধুমাত্র পরীক্ষার ফরম পূরন করা আর পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়ার মধ্যেই তাদের অধিকাংশ সময় চলে যায়। শিক্ষার মানোন্নয়নে বোর্ড কি ধরনের ভূমিকা রাখে বা রেখে চলেছে সে বিষয়ে দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ নেই। শিক্ষা বোর্ড কি কখনও বিষয় শিক্ষক কিংবা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নিয়ে শিক্ষা প্রশাসন  কিংবা  বিষয়ভিত্তিক মানোন্নয়নের জন্য বছরে দু’একটি  কার্যকরী ওয়ার্কশপ কিংবা সেমিনারের আয়োজন করে যেখানে দেশের শিক্ষাবিদদের সাথে শিক্ষকদের মত বিনিময়ের ব্যবস্থা থাকে? এর রকম তো খুব একটা দেখা যায়না। বোর্ডে খাতা আনার সময় দেখতাম বিভিন্ন পরীক্ষকদের একটি প্রশ্নের উত্তর কীভাবে লিখতে হবে, কীভাবে লিখলে কত নম্বর দেওয়া হবে এটি নিয়ে মতবিরোধ চলতে থাকত, এখনও নিশ্চয়ই আছে। ফলে,  শিক্ষকগন যার যার মত অনুযায়ী নম্বর দিয়ে থাকেন। ইউনিফর্ম কোনো নিয়ম মেনে অনেক ক্ষেত্রেই তা করা হয়না। এতে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরীক্ষার ফল বের হলে চেয়ারম্যনাগন অনেক ধরনের ব্যাখ্যা ও আশার কথা শুনিয়ে থাকেন। এটি বাস্তবে কতটা সম্ভব কিংবা এ ধরনের কালচার আমরা তৈরি করতে পেরেছি কিনা সেটি বিবেচনার বিষয়।

বিষয়:

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

মাছুম বিল্লাহ

শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক এবং প্রেসিডেন্ট: ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)। সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর- ভাব বাংলাদেশ এবং শিক্ষা বিশেষজ্ঞ -ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি। ইমেইল: [email protected]

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার কয়েকটি জাদু অজানাই থেকে যাচ্ছে

প্রকাশ: ০১:১৮:১৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ মে ২০২৪

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ তারিখ সারাদেশে একযোগে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু  হয়, লিখিত পরীক্ষা  শেষ হয় গত ১২মার্চ।  ১৩ মার্চ থেকে ২০ মার্চের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় ব্যবাহারিক পরীক্ষা। বলা যায় দু’মাসেরও কম সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীদের জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয় ১২ মে, ২০২৪। প্রতি বছরের মতোই এবারও বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রথা অনুযায়ী ফল প্রকাশ করেছেন। এটি আমাদের দেশের একটি আলাদা ট্রাডিশন এবং এটি  আলাদা একটি গুরুত্ব বহন করে। পৃথিবীর সব  দেশেই পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় কিন্তু রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীকে আমরা এসব বিষয় কোন কথা বলতে সাধারনত দেখিনা।কিন্তু আমাদের দেশের রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী এই ফল প্রকাশ করেন এবং ফলের সার্বিক বিষয়ে খোঁজখবর নেন, পরামর্শ দেন, অনেক বিষয় সংশ্লিষ্টদের কাছে জানতে চান।  এবার এসএসসি পরীক্ষায় গড় পাস করেছে ৮৩দশমিক ০৪শতাংশ। ।এদের মধ্যে ছাত্রদের পাসের হার ৮১দশমিক ৫৭শতাংশ, ছাত্রীদের-পাসের হার ৮৪দশমিক ৪৭শতাংশ। এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ছেলেদের সংখ্যা কম দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী এবং তাদের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণও জানতে চেয়েছেন। দেশে স্বাক্ষরতার হার বেড়েছে, শিক্ষায় অংশ নেয়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। মেয়েদের হার বেড়েছে অনেক। প্রাথমিকে এক সময় ৫৪শতাংশ ছাত্রী যেত, এখন ৯৮ শতাংশ যাচ্ছে। মাত্র তিনটি বোর্ডে ছাত্রের সংখ্যা একটু বেশি, অধিকাংশ জায়গায় ছাত্রীদের সংখ্যা বেশি। নারী শিক্ষার ওপর জোর দেয়ার ফল হচ্ছে এটি। এবার ১১টি বোর্ডে ছাত্র সংখ্যা ৯ লাখ ৯৯ হাজার ৩৬৪ জন আর ছাত্রী সংখ্যা ১০ লাখ ৩৮ হাজার ৭৮৬জন। পাসের হারেও মেয়েরা এগিয়ে। যারা অকৃতকার্য হয়েছেন তাদের প্রতি কোন ধরনের নেতিবাচক আচরণ না করার জন্যও প্রধানমন্ত্রী  পরামর্শ দিয়েছেন। 

মোট ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এ বছর ২০ লাখ ২৪হাজার ১৯২জন পরীক্ষার্থী এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে ৯ টি সাধারন শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পরীক্ষার্থী ছিলেন ১৬ লাখ ৬ হাজার ৮৭৯ জন। মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে দাখিল পরীক্ষা দিয়েছেন মোট ২ লাখ ৪২ হাজার ৩১৪ জন। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি  (ভোকেশনাল) ও দাখিল (ভোকেশনাল) পরীক্ষায় অংশ নেন ১ লাখ ২৬ হাজার ৩৭৩ জন। গত বছর এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন মোটা ২০ লাখ ৪১ হাজার ৪৫০ জন। গতবার পাসের হার ছিল ৮০ দশমিক ৩৯ শতাংশ , তার মানে হচ্ছে ২০২৪ সালের পাসের হার বেড়েছে। ঢাকা বোর্ডে এবার পাসের হার ৮৯ দশমিক ৩২ শতাংশ, রাজশাহী বোর্ডে  ৮৯ দশমিক ২৫ শতাংশ, কুমিল্লায় ৭৯ দশমিক ২৩ শতাংশ, চট্টগ্রাম বোর্ডে ৮২দশমিক ৮০ শতাংশ, বরিশালে ৮৯ দশমিক ১৩ শতাংশ, দিনাজপুরে ৭৮ দশমিক ৪০ শতাংশ ও ময়মনসিংহে ৮৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এবার যশোর বোর্ডে পাসের হার ৯২দশমিক ৩২শতাংশ আর সর্বনিম্ন সিলেট বোর্ডে, সেখানে পাসের হার ৭৩দশমিক ৩৫ শতাংশ অর্থাৎ সিলেট বোর্ডে ১৮.৯৭ মানে ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থী কম পাস করেছে। এই জাদুর অর্থ আজও জানা গেল না। একই সিলেবাস, একই সময়ে পরীক্ষা, একই ধরনের শিক্ষকগণ পড়িয়ে থাকেন তাহলে কি কারণ কিংবা কি কি কারনে এক বোর্ডের ফল অন্য বোর্ড থেকে এত বেশি পার্থক্য প্রদর্শন করে। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে দেখা যাবে, সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া বোর্ডটির ফল পরবর্তী বছর হঠাৎ করে সবাই উপরে চলে যায়! আমাদের বোর্ডগুলো কি বিষয়টি নিয়ে কোনো আলোচনা করে?  কারণ অনুসন্ধান করে জাতিকে জানানো উচিত নয়? তা না হলে বিষয়টিতো গুরুত্বহীন থেকে যাবে। 

মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা পাস ফেলে একটু পিছিয়ে থাকে, এ নিয়ে গবেষণা না থাকলেও অনুমিত কিছু কারন বা আমাদের অবজারভেশন থেকেই কারন আমরা জানতে পারি। আর একটি বিষয় প্রতি বছরই দেখা যেত , যে মাদরাসা বোর্ড ফলের দিক থেকে সাধারন শিক্ষা বোর্ডগুলো থেকে এগিয়ে থাকে।  এর পেছনে যৌক্তিক কোনো কারণই নেই। যাই হোক বিষয়টি এবার সেভাবে ঘটেনি। এবার মাদরাসা বোর্ডে পাসের হার ৭৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ, আর জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা ১৪ হাজার ২০৬ জন। কারিগরি বোর্ডে পাসের হার ৮১ দশমিক ৩৮শতাংশ। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পাস ফেল আমাদের খুব একটা স্পষ্ট মেসেজ দেয় না। এখানে বেশির ভাগই প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা হওয়ার কথা কিন্তু এই ফল আমাদের কি বলে তার ব্যাখ্যা আমরা কোথাও দেখতে পাইনা। তাছাড়া কারিগরি শিক্ষা যে পরিমান গুরুত্ব পাওয়ার কথা বর্তমান অবস্থা সেটি থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে।  

আর একটি বিষয় আমরা প্রতিবছরই দেখি যে, কিছু সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে একজন শিক্ষার্থীও পাস করেনা, গত বছর এই সংখ্যা ছিল ৪৮টি, এবার দেখলাম ৫১টি অর্থাৎ বেড়ে গেছে। প্রথমেই বলা যায়, পাস করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট রিল্যাক্সিং অবস্থা থাকে , তারমধ্যেও এই অবস্থা! তার মানে হচ্ছে পুরো অকৃতকার্যের বিষয় নিয়ে ফলাফলের পর আর কোন আলোচনা খুব একটা হয়না। আলোচনা হলে এ বিষয়টি বার বার দেখা যেত না। মিডিয়ার কল্যাণে এবং কিছু শিক্ষা সাংবাদিকদের কারণে আমরা  শূন্য পাস প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু কারণ জানতে পারি কিন্তু বোর্ড কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে খুব একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা আমরা শুনতে পাইনা। 

এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ মানে দেশব্যাপী স্কুল-মাদরাসায় উৎসবমুখর পরিবেশ। ফল প্রকাশের দিন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে শাসনের গাম্ভীর্যের বেড়াজাল ভেঙ্গে একাকার হয়ে যান সবাই, উপভোগ করেন যৌথপ্রয়াসে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া শিক্ষাকার্যক্রমের মুল্যায়ন। শিক্ষক ভুলে যান পাঁচ বছর পরে এই শিক্ষার্থীরা কে কোথায় থাকবে, তাদের ক’ জনের সাথে যোগাযোগ থাকবে, কিন্তু সমস্ত সংকীর্ণতার  উধের্ব উঠে শিক্ষকগন আনন্দে শামিল হন প্রানপ্রিয় শিক্ষার্থীদের সাথে। শিক্ষকের বাসায় হয়তো বাজার করার অর্থ নেই, বাসার বহু সমস্যা । সবকিছু ফেলে এই দিনটি তারা ঈদের চেয়েও যেন আনন্দ নিয়ে উদযাপন করেন। শিক্ষকতা জীবনে এইটুকুই তো পাওয়া। 

কোন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক পাস, জিপিএ-৫ প্রাপ্তি ও সহপাঠক্রমিক কার্যবালীর সাথে শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্টতা ও অংশগ্রহন ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের র‌্যাংকিং থাকা প্রয়োজন এবং এটি  কোন থার্ড পার্টি করলে ভাল হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট সরকারি কোন বিভাগের করা ঠিক নয়।   সরকারি, বেসরকারি, এমপিওভুক্ত, নন-এমপিওভুক্ত নির্বিশেষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান র‌্যাংকিং থাকা প্রয়োজন। দেশে একটি র‌্যাংকিং পদ্ধতি থাকলে আমরা সহজে বুঝতে পারি বোর্ডগুলোর ফলাফলের সাথে র‌্যাংকিং কতটা সাদৃশ্যপূর্ণ।  তাছাড়া র‌্যাংকিং বিষয়টি  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানুগলোর মধ্যে  একটি সুস্থ  প্রতিযোগিতা  সৃষ্টি করে আর শিক্ষার জরুরী অথচ  উপেক্ষিত  উপদানগুলো যেমন খেলাধূলা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, নৈতিক শিক্ষা, সামাজিক শিক্ষা, আচার আচরণ এগুলোর কোন প্রতিফলন এসব ফলে দেখা যায়ন, বুঝা যায়না অথচ জীবনে চলতে, এগুতে, কাজ করতে, এগুলোর খুব প্রয়োজন। নতুন কারিকুলামে এগুলো মূল্যায়নের বিষয় উল্লেখ আছে, কিন্তু সেখানেও খুব আশাবাদী হতে পারছিনা কারণ বিষয়গুলো সেভাবে এগুচ্ছেনা আর বাস্তবের চেয়ে  উচচাশার প্রতিফলন বেশি দেখা যাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান র‌্যংকিং হলে এসব বিষয় চলে আসে এবং তখন বলা যায় কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের সার্বিক শিক্ষা প্রদান করছে। 

ইংরেজি ও গণিত মাধ্যমিক পর্যায়ে একটি ক্রিটিক্যাল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে কারন এ দুটি বিষয়ে একমাত্র স্বনামধন্য কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকীগুলোতে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকই নেই। শিক্ষার্থীরা স্বভাবতই এ দুটি বিষয়ের দুর্বলতা নিয়ে উচচ-মাধ্যমিক ও উচচশিক্ষা স্তর পার করে। অথচ পাবলিক পরীক্ষা পাশের হারে কোন এক জাদুর পরশে দেখা যায় এ দুটো বিষয়ে পাশের হার আকাশ ছোঁয়া। এবার ঢাকা বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৯৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ, গণিতে ৮৮ শতাংশ। পাসের হারে এগিয়ে থাকে যেশার বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৯৬শতাংশ আর গণিতে ৯৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এই ফল ও আমাদের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ও গণিতের প্রকৃত দক্ষতা তুলে ধরছে কিনা সেটি একটি প্রশ্ন। আমাদের শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল, তারা দেশের বাইরে গিয়ে কিংবা দেশেও বিভিন্নভাবে তাদের মেধার ও সৃজনশীলতার সাক্ষর রেখে চলেছেন অথচ তাদেরকে সিস্টেম্যাটিক্যালি দুর্বল মূল্যায়নের দিক দিয়ে যেতে হয় আর তাদের ফল নিয়ে তাই অনেকেই প্রশ্ন তোলেন। বিষয়টিতে নজর দেওয়া একান্তই প্রয়োজন। শিক্ষাক্ষেত্রে  বোর্ডগুলোর ভূমিকা কি দেখি? শুধুমাত্র পরীক্ষার ফরম পূরন করা আর পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়ার মধ্যেই তাদের অধিকাংশ সময় চলে যায়। শিক্ষার মানোন্নয়নে বোর্ড কি ধরনের ভূমিকা রাখে বা রেখে চলেছে সে বিষয়ে দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ নেই। শিক্ষা বোর্ড কি কখনও বিষয় শিক্ষক কিংবা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নিয়ে শিক্ষা প্রশাসন  কিংবা  বিষয়ভিত্তিক মানোন্নয়নের জন্য বছরে দু’একটি  কার্যকরী ওয়ার্কশপ কিংবা সেমিনারের আয়োজন করে যেখানে দেশের শিক্ষাবিদদের সাথে শিক্ষকদের মত বিনিময়ের ব্যবস্থা থাকে? এর রকম তো খুব একটা দেখা যায়না। বোর্ডে খাতা আনার সময় দেখতাম বিভিন্ন পরীক্ষকদের একটি প্রশ্নের উত্তর কীভাবে লিখতে হবে, কীভাবে লিখলে কত নম্বর দেওয়া হবে এটি নিয়ে মতবিরোধ চলতে থাকত, এখনও নিশ্চয়ই আছে। ফলে,  শিক্ষকগন যার যার মত অনুযায়ী নম্বর দিয়ে থাকেন। ইউনিফর্ম কোনো নিয়ম মেনে অনেক ক্ষেত্রেই তা করা হয়না। এতে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরীক্ষার ফল বের হলে চেয়ারম্যনাগন অনেক ধরনের ব্যাখ্যা ও আশার কথা শুনিয়ে থাকেন। এটি বাস্তবে কতটা সম্ভব কিংবা এ ধরনের কালচার আমরা তৈরি করতে পেরেছি কিনা সেটি বিবেচনার বিষয়।