১২:৪৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

শিক্ষা উপকরণ উন্নয়নে বিবেচ্য দিকসমূহ 

পাঠকে শিক্ষার্থীদের কাছে সহজবোধ্য, আকর্ষণীয় ও কর্মতৎপরতামূলক করার জন্য শ্রেণিতে শিক্ষক যেসব বস্তুগত সামগ্রী ব্যবহার করেন সেগুলোই শিক্ষা উপকরণ।
বিশ্লেষণ সংকলন টিম
  • প্রকাশ: ১০:২৭:০৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
  • / ৮৭৬ বার পড়া হয়েছে

পাঠকে শিক্ষার্থীদের কাছে সহজবোধ্য, আকর্ষণীয় ও কর্মতৎপরতামূলক করার জন্য শ্রেণিতে শিক্ষক যেসব বস্তুগত সামগ্রী ব্যবহার করেন সেগুলোই শিক্ষা উপকরণ।

চোখ, কান, নাক, জিহ্বা ও ত্বক এই পাঁচটি ইন্দ্রিয় মানুষ তার প্রতিদিনের নানা কাজে ব্যবহার করে। বস্তুত এ ইন্দ্রিয়গুলো মানুষের মানবীয় সত্তাকেই প্রতিষ্ঠিত করে থাকে। এগুলোর মাধ্যমে সে তার চারপাশের জগৎ ও জীবনকে কেবল প্রত্যক্ষ করে না, তাকে গ্রহণ বা বর্জনও করে। ব্যক্তি কোনো বস্তুকে কখনও হুবহু দেখে কখনওবা নিজের চিন্তা আরোপ করে বস্তুর মধ্যে অতিরিক্ত গুণ বা ধর্ম অনুসন্ধান করে নেয়। কেবল চোখ দিয়ে দেখার ক্ষেত্রেই নয়; কান, নাক, জিহবা ও ত্বকের ব্যবহারেও মানুষ একই আচরণে লিপ্ত হয়। এভাবে পাঁচটি ইন্দ্রিয় আমাদের জীবন ও জীবনবোধকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে।

শেখা ও শেখানোর কাজে ইন্দ্রিয়গুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। শোনার পাশাপাশি ‘দেখা’ কথাকে আরও অর্থময় করে তোলে। আবার যা দেখি তাকে জানতে ও বুঝতে অন্য সব ইন্দ্রিয় তৎপর হয়ে ওঠে বলে অনুধাবনের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। যেমন, ভূগোলের কোনো শিক্ষক বাংলাদেশের নদ-নদী পড়াতে গিয়ে মে․খিক বর্ণনার পাশাপাশি মানচিত্রে সে নদীগুলো দেখিয়ে এগুলোর উৎপত্তি, গতিপথ ও সাগরে পতিত হওয়া ব্যাখ্যা করলে শিক্ষার্থীরা তাদের বিভিন্ন ইন্দ্রিয় ব্যবহারের মাধ্যমে যে ধারণা লাভ করে তা অনেক স্থায়ী ও কার্যকর হয়ে থাকে। অর্থাৎ ‘মানচিত্র’ নামক শিক্ষা উপকরণটি এখানে বিশেষ একটি কার্যকর ভূমিকা রাখছে। কেবল মানচিত্র নয় অন্য যেকোনো বস্তুও শ্রেণিতে পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষার বিষয়বস্তুকে অর্থময় ও তাৎপর্যময় করে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে, শেখার বিষয়কে ষ্পষ্ট করে তুলতে পারে। যেমন ছবি, চার্ট, মডেল অথবা প্রকৃত বস্তু প্রভৃতি। 

সহায়ক সামগ্রী ও শিক্ষা উপকরণ

পাঠকে শিক্ষার্থীদের কাছে সহজবোধ্য, আকর্ষণীয় ও কর্মতৎপরতামূলক করার জন্য শ্রেণিতে শিক্ষক যেসব বস্তুগত সামগ্রী ব্যবহার করেন সেগুলোই শিক্ষা উপকরণ। তবে ক্সবশিষ্ট্যের ভিন্নতার কারণে এই দ্রব্যসমূহের কোনোটিকে সহায়ক সামগ্রী (Instructional Materials) আর কোনোটিকে শিক্ষা উপকরণ (Teaching Aids) বলা হয়। যেসব বস্তুগত ও অবস্তুগত উপাদান পাঠের বিষয়বস্তুর ধারণা প্রদান বা লাভে প্রত্যক্ষভাবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে সহায়তা করে ও দিক-নির্দেশনা দেয় সেগুলোই সহায়ক সামগ্রী (Instructional Materials)। যেমন—পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষক-নির্দেশিকা, প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল, ওয়ার্ক-বুক, তথ্যপুস্তিকা, মডেল, মানচিত্র, ফিল্ম, ভিডিও, ডিজিটাল কন্টেন্ট, তথ্য-পোস্টার, তালিকা, অনুচিত্র, শিক্ষকের ফিডব্যাক সামগ্রী, তথ্যছক, ছবি, নমুনা, বাস্তব দ্রব্যাদি ইত্যাদি। অন্যদিকে যেসব বস্তুগত উপাদান পাঠদানের ক্ষেত্রে পাঠের বিষয়বস্তু অনুধাবণে প্রত্যক্ষ কোনো ভূমিকা না রাখলেও শ্রেণিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর কাজে সহায়তা করে সেগুলোকে শিক্ষা উপকরণ বলে। যেমন—চক, ডাস্টার, চকবোর্ড, বুলেটিন বোর্ড, মাল্টিমিডিয়া, পোস্টার পেপার, ফ্লাশ কার্ড, কম্পিউটার, ওভারহেড প্রজেক্টর প্রভৃতি। অর্থাৎ উপকরণ প্রধানত শ্রেণি পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষককে কাজে সহায়তা করে আর সহায়ক সামগ্রী শিক্ষার্থীর কাছে পাঠের বিষয়বস্তুকে সহজবোধ্য, প্রাঞ্জল ও অর্থপূর্ণ করে তোলে। সেদিক থেকে বলা যায়, শ্রেণির কাজে সহায়ক সামগ্রীর ভূমিকা প্রত্যক্ষ আর শিক্ষা উপকরণের ভূমিকা পরোক্ষ। তবে সাধারণভাবে সহায়ক সামগ্রী ও উপকরণ উভয়কেই শিক্ষা উপকরণ বলা হয়।

শিক্ষা উপকরণের গুরুত্ব

শিক্ষা কার্যক্রমকে সক্রিয়তাভিত্তিক, সহজ, সাবলীল, বাস্তবমুখী করে তোলার জন্য শিক্ষা উপকরণের ব্যবহার অনস্বীকার্য। এর কার্যকর ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বিষয়বস্তু সম্পর্কে মূর্ত ধারণা লাভ করে, শিখন দীর্ঘস্থায়ী হয়, শিখনে স্বতঃস্ফূর্ততা আসে, বিষয়বস্তু আকর্ষণীয় হয়, শ্রেণির একঘেয়েমী দূর হয়। অন্যদিকে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শিক্ষক খুব সহজে, অল্পশ্রমে, অল্পসময়ে,  অল্পকথায় অনেক জটিল বিষয় শিক্ষার্থীদের সামনে অর্থপূর্ণভাবে উপস্থাপন করতে পারেন।

আধুনিক শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষা মনোবিজ্ঞান শিক্ষাদান পদ্ধতিকে নতুন চিন্তাধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছে। শিক্ষাদান আজ আর গতানুগতিকতার পথ ধরে চলে না। শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষক-কেন্দ্রিকতার যুগ আজ অতিক্রান্ত; এসেছে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষা যেহেতু ব্যক্তির অন্তর্নিহিত সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন করে তাই শ্রেণিকক্ষের চার দেওয়ালের মধ্যে পুস্তকসর্বস্ব শিক্ষা-ব্যবস্থা অপসৃত হয়ে শিক্ষার্থীর সক্রিয়তাভিত্তিক শিক্ষা আজ স্বীকৃত হচ্ছে। শিক্ষাকে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক করতে বিভিন্ন শিক্ষাসহায়ক উপকরণ আজ অপরিহার্য হয়ে উঠছে। তাই বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষা সহায়ক উপকরণের গুরুত্ব সকলেই স্বীকার করছেন। সকলের কাছেই আজ স্বীকৃত যে, শিক্ষা সহায়ক উপকরণ ব্যবহারে পাঠদান জীবন্ত হয়, বিষয়বস্তুর ধারণা (ঈড়হপবঢ়ঃ) স্পষ্ট (ঈষবধৎ) হয়, শিক্ষা আনন্দময় হয়।

বর্তমানে শিক্ষা-সহায়ক উপকরণ সকল বিষয়ের প্রচলিত পঠনপাঠনের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। পাঠ-সহায়ক হিসেবে শিক্ষাদানকে সম্পূর্ণ করে তোলে বলেই আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতিতে শিক্ষা উপকরণকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষাদানের ক্ষেত্রেও এসব উপকরণের ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষককে তাই বিষয় উপযোগী উপকরণ সংগ্রহ ও তার ব্যবহার সম্বন্ধে যথাযথভাবে জানতে হবে। এই জানাকে সঠিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমেই তিনি ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষাদানকে সার্থক করে তুলতে পারবেন। 

শিক্ষা উপকরণ নির্বাচন ও ব্যবহার

বিষয় ও বিষয়বস্তুর স্বাতন্ত্র্য অনুযায়ী শিক্ষা উপকরণ নির্বাচন ও ব্যবহারে বিভিন্নতা ও ক্সবচিত্র্য লক্ষ করা যায় । সামাজিক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান বিষয়ের ক্ষেত্রে শিক্ষা সহায়ক উপকরণের সংগ্রহ ও ব্যবহার অধিকতর সহজসাধ্য। কিš‧ ভাষা ও সাহিত্য পাঠদানের ক্ষেত্রে উপকরণ সংগ্রহ ও ব্যবহার দুইই খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। এক্ষেত্রে বিষয়ানুগ, প্রাসঙ্গিক ও ব্যবহারযোগ্য উপকরণ নির্বাচন, সংগ্রহ ও ব্যবহার যথেষ্ট বিচার বিবেচনার অপেক্ষা রাখে। আবার, প্রাথমিক ও নিম্নমাধ্যমিক শ্রেণিতে ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষাদানে উপকরণের সংগ্রহ ও ব্যবহার যতটা সহজ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ততটা সহজ নয়। তবে শিক্ষক যে উপকরণই নির্বাচন করেন না কেন, তার মূল্যমান, সুলভতা এবং সর্বোপরি, উপযোগিতার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। 

শিক্ষা উপকরণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে শিক্ষককে অত্যন্ত কৌশলী হতে হয়। শিক্ষার্থীর বয়স, সামর্থ্য, চিন্তা, মেধা, আগ্রহ, প্রবণতা, শিক্ষণের উদ্দেশ্য, পদ্ধতি, কলাকৌশল, সময়, ব্যবহারের প্রক্রিয়া/কৌশল, বিষয়বস্তুর সাথে সম্পৃক্ততা, ব্যবহারযোগ্যতা, শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা, পরবর্তী সময়ের জন্য সংরক্ষণের সুবিধা-অসুবিধা তথা উপকরণের উপযোগিতা, নির্ভরযোগ্যতা, সহজলভ্যতা প্রভৃতি দিক বিবেচনায় রেখে শিক্ষা উপকরণ নির্বাচন ও ব্যবহার করতে হয়।

শিক্ষা-সহায়ক উপকরণের ব্যবহার যথাযথ হওয়া প্রয়োজন। সব সময় মনে রাখতে হবে যে, উপকরণ শিক্ষা-সহায়ক হবে, সুনির্বাচিত হবে, প্রাসঙ্গিক হবে । উপকরণ শিক্ষার্থীদের শ্রেণি, বয়স, ও বুদ্ধির উপযোগী হবে। এসব বিষয় মনে না রেখে শ্রেণিতে উপকরণ দেখানোর কোনো অর্থ হয় না। আরো মনে রাখা আবশ্যক, শিক্ষা উপকরণ ব্যবহারের সময় এগুলোকে নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করতে পারলে শিক্ষার্থীদের মনে তীব্র আবেদন ও অনুভূতির সৃষ্টি হয়। তাই উপকরণ ব্যবহারের জন্য পূর্বপরিকল্পনা থাকা আবশ্যিক। একই উপকরণ বিভিন্ন শ্রেণিতে দেখানো উচিত নয়। উপকরণের সংখ্যাধিক্য যেন শিক্ষার অগ্রগতিকে ব্যাহত না করে, সেদিকেও শিক্ষককে লক্ষ রাখতে হবে। উপকরণ এমন স্পষ্ট, সুন্দর ও শিল্পমণ্ডিত হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের বুঝতে কোনো অসুবিধা না হয়। এসব দিক বিবেচনায় শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্সে অথবা কর্মকালীন বিশেষ কোনো ট্রেনিং-এর মাধ্যমে এসব উপকরণ প্রস্তুত ও প্রয়োগের কৌশল শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। তাহলে শিক্ষক ও প্রশিক্ষক উভয়ের মধ্যেই উপকরণ ব্যবহার সম্পর্কিত ইতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠবে, সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে, শিক্ষা দান ও গ্রহণের কাজটি সহজ ও সুন্দর হবে আর নিশ্চিত হবে কার্যকর শিখন।

শিক্ষা উপকরণ উন্নয়ন

সহায়ক সামগ্রী ও শিক্ষা উপকরণের গুণগত মান উন্নয়নের জন্যও শিক্ষককে সবসময় চিন্তাশীল থাকতে হয়। শিক্ষা উপকরণ উন্নয়ন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। ব্যবহার করতে গিয়ে যখনই কোনো সমস্যা দেখা দেয় তখন থেকেই শিক্ষককে ভাবতে হয়-কী পদক্ষেপ গ্রহণ করলে পরবর্তীতে ঐ সমস্যা এড়ানো যাবে। উপকরণ নির্বাচন ও এর ব্যবহার কৌশল উন্নয়নে শিক্ষককে প্রতিনিয়তই নিম্নলিখিত বিষয়ে চিন্তাশীল থাকা আবশ্যক:

  1. কী কী বিষয় নতুন সংযোজন ও বিয়োজন দরকার
  2. শিক্ষার্থীরা কোন দিকটিকে আনন্দের সাথে গ্রহণ করছে
  3. কোন দিকটি শিক্ষার্থীর কাছে বিরক্তিকর মনে হচ্ছে
  4. শিক্ষার্থীরা বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাচ্ছে কি না
  5. ব্যবহার করতে গিয়ে কী কী সমস্যা দেখা দিচ্ছে
  6. কী পদক্ষেপ নিলে ঐ সমস্যাসমূহ দূরীভূত হবে
  7. পাঠকে কীভাবে আরো সহজ ও আকর্ষণীয় করা যায়
  8. তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে কীভাবে এর উপযোগিতা আরও বাড়ানো যায়
  9. পরিবেশিত তথ্য কতটা যুক্তিনির্ভর, বাস্তবসম্মত ও মূর্তিত রূপায়ণের?

সূত্র: বাউবি কর্তৃক প্রকাশিত পাঠ্যবই/মডিউল

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

পাঠকে শিক্ষার্থীদের কাছে সহজবোধ্য, আকর্ষণীয় ও কর্মতৎপরতামূলক করার জন্য শ্রেণিতে শিক্ষক যেসব বস্তুগত সামগ্রী ব্যবহার করেন সেগুলোই শিক্ষা উপকরণ।

শিক্ষা উপকরণ উন্নয়নে বিবেচ্য দিকসমূহ 

প্রকাশ: ১০:২৭:০৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

চোখ, কান, নাক, জিহ্বা ও ত্বক এই পাঁচটি ইন্দ্রিয় মানুষ তার প্রতিদিনের নানা কাজে ব্যবহার করে। বস্তুত এ ইন্দ্রিয়গুলো মানুষের মানবীয় সত্তাকেই প্রতিষ্ঠিত করে থাকে। এগুলোর মাধ্যমে সে তার চারপাশের জগৎ ও জীবনকে কেবল প্রত্যক্ষ করে না, তাকে গ্রহণ বা বর্জনও করে। ব্যক্তি কোনো বস্তুকে কখনও হুবহু দেখে কখনওবা নিজের চিন্তা আরোপ করে বস্তুর মধ্যে অতিরিক্ত গুণ বা ধর্ম অনুসন্ধান করে নেয়। কেবল চোখ দিয়ে দেখার ক্ষেত্রেই নয়; কান, নাক, জিহবা ও ত্বকের ব্যবহারেও মানুষ একই আচরণে লিপ্ত হয়। এভাবে পাঁচটি ইন্দ্রিয় আমাদের জীবন ও জীবনবোধকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে।

শেখা ও শেখানোর কাজে ইন্দ্রিয়গুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। শোনার পাশাপাশি ‘দেখা’ কথাকে আরও অর্থময় করে তোলে। আবার যা দেখি তাকে জানতে ও বুঝতে অন্য সব ইন্দ্রিয় তৎপর হয়ে ওঠে বলে অনুধাবনের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। যেমন, ভূগোলের কোনো শিক্ষক বাংলাদেশের নদ-নদী পড়াতে গিয়ে মে․খিক বর্ণনার পাশাপাশি মানচিত্রে সে নদীগুলো দেখিয়ে এগুলোর উৎপত্তি, গতিপথ ও সাগরে পতিত হওয়া ব্যাখ্যা করলে শিক্ষার্থীরা তাদের বিভিন্ন ইন্দ্রিয় ব্যবহারের মাধ্যমে যে ধারণা লাভ করে তা অনেক স্থায়ী ও কার্যকর হয়ে থাকে। অর্থাৎ ‘মানচিত্র’ নামক শিক্ষা উপকরণটি এখানে বিশেষ একটি কার্যকর ভূমিকা রাখছে। কেবল মানচিত্র নয় অন্য যেকোনো বস্তুও শ্রেণিতে পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষার বিষয়বস্তুকে অর্থময় ও তাৎপর্যময় করে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে, শেখার বিষয়কে ষ্পষ্ট করে তুলতে পারে। যেমন ছবি, চার্ট, মডেল অথবা প্রকৃত বস্তু প্রভৃতি। 

সহায়ক সামগ্রী ও শিক্ষা উপকরণ

পাঠকে শিক্ষার্থীদের কাছে সহজবোধ্য, আকর্ষণীয় ও কর্মতৎপরতামূলক করার জন্য শ্রেণিতে শিক্ষক যেসব বস্তুগত সামগ্রী ব্যবহার করেন সেগুলোই শিক্ষা উপকরণ। তবে ক্সবশিষ্ট্যের ভিন্নতার কারণে এই দ্রব্যসমূহের কোনোটিকে সহায়ক সামগ্রী (Instructional Materials) আর কোনোটিকে শিক্ষা উপকরণ (Teaching Aids) বলা হয়। যেসব বস্তুগত ও অবস্তুগত উপাদান পাঠের বিষয়বস্তুর ধারণা প্রদান বা লাভে প্রত্যক্ষভাবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে সহায়তা করে ও দিক-নির্দেশনা দেয় সেগুলোই সহায়ক সামগ্রী (Instructional Materials)। যেমন—পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষক-নির্দেশিকা, প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল, ওয়ার্ক-বুক, তথ্যপুস্তিকা, মডেল, মানচিত্র, ফিল্ম, ভিডিও, ডিজিটাল কন্টেন্ট, তথ্য-পোস্টার, তালিকা, অনুচিত্র, শিক্ষকের ফিডব্যাক সামগ্রী, তথ্যছক, ছবি, নমুনা, বাস্তব দ্রব্যাদি ইত্যাদি। অন্যদিকে যেসব বস্তুগত উপাদান পাঠদানের ক্ষেত্রে পাঠের বিষয়বস্তু অনুধাবণে প্রত্যক্ষ কোনো ভূমিকা না রাখলেও শ্রেণিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর কাজে সহায়তা করে সেগুলোকে শিক্ষা উপকরণ বলে। যেমন—চক, ডাস্টার, চকবোর্ড, বুলেটিন বোর্ড, মাল্টিমিডিয়া, পোস্টার পেপার, ফ্লাশ কার্ড, কম্পিউটার, ওভারহেড প্রজেক্টর প্রভৃতি। অর্থাৎ উপকরণ প্রধানত শ্রেণি পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষককে কাজে সহায়তা করে আর সহায়ক সামগ্রী শিক্ষার্থীর কাছে পাঠের বিষয়বস্তুকে সহজবোধ্য, প্রাঞ্জল ও অর্থপূর্ণ করে তোলে। সেদিক থেকে বলা যায়, শ্রেণির কাজে সহায়ক সামগ্রীর ভূমিকা প্রত্যক্ষ আর শিক্ষা উপকরণের ভূমিকা পরোক্ষ। তবে সাধারণভাবে সহায়ক সামগ্রী ও উপকরণ উভয়কেই শিক্ষা উপকরণ বলা হয়।

শিক্ষা উপকরণের গুরুত্ব

শিক্ষা কার্যক্রমকে সক্রিয়তাভিত্তিক, সহজ, সাবলীল, বাস্তবমুখী করে তোলার জন্য শিক্ষা উপকরণের ব্যবহার অনস্বীকার্য। এর কার্যকর ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বিষয়বস্তু সম্পর্কে মূর্ত ধারণা লাভ করে, শিখন দীর্ঘস্থায়ী হয়, শিখনে স্বতঃস্ফূর্ততা আসে, বিষয়বস্তু আকর্ষণীয় হয়, শ্রেণির একঘেয়েমী দূর হয়। অন্যদিকে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শিক্ষক খুব সহজে, অল্পশ্রমে, অল্পসময়ে,  অল্পকথায় অনেক জটিল বিষয় শিক্ষার্থীদের সামনে অর্থপূর্ণভাবে উপস্থাপন করতে পারেন।

আধুনিক শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষা মনোবিজ্ঞান শিক্ষাদান পদ্ধতিকে নতুন চিন্তাধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছে। শিক্ষাদান আজ আর গতানুগতিকতার পথ ধরে চলে না। শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষক-কেন্দ্রিকতার যুগ আজ অতিক্রান্ত; এসেছে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষা যেহেতু ব্যক্তির অন্তর্নিহিত সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন করে তাই শ্রেণিকক্ষের চার দেওয়ালের মধ্যে পুস্তকসর্বস্ব শিক্ষা-ব্যবস্থা অপসৃত হয়ে শিক্ষার্থীর সক্রিয়তাভিত্তিক শিক্ষা আজ স্বীকৃত হচ্ছে। শিক্ষাকে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক করতে বিভিন্ন শিক্ষাসহায়ক উপকরণ আজ অপরিহার্য হয়ে উঠছে। তাই বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষা সহায়ক উপকরণের গুরুত্ব সকলেই স্বীকার করছেন। সকলের কাছেই আজ স্বীকৃত যে, শিক্ষা সহায়ক উপকরণ ব্যবহারে পাঠদান জীবন্ত হয়, বিষয়বস্তুর ধারণা (ঈড়হপবঢ়ঃ) স্পষ্ট (ঈষবধৎ) হয়, শিক্ষা আনন্দময় হয়।

বর্তমানে শিক্ষা-সহায়ক উপকরণ সকল বিষয়ের প্রচলিত পঠনপাঠনের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। পাঠ-সহায়ক হিসেবে শিক্ষাদানকে সম্পূর্ণ করে তোলে বলেই আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতিতে শিক্ষা উপকরণকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষাদানের ক্ষেত্রেও এসব উপকরণের ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষককে তাই বিষয় উপযোগী উপকরণ সংগ্রহ ও তার ব্যবহার সম্বন্ধে যথাযথভাবে জানতে হবে। এই জানাকে সঠিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমেই তিনি ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষাদানকে সার্থক করে তুলতে পারবেন। 

শিক্ষা উপকরণ নির্বাচন ও ব্যবহার

বিষয় ও বিষয়বস্তুর স্বাতন্ত্র্য অনুযায়ী শিক্ষা উপকরণ নির্বাচন ও ব্যবহারে বিভিন্নতা ও ক্সবচিত্র্য লক্ষ করা যায় । সামাজিক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান বিষয়ের ক্ষেত্রে শিক্ষা সহায়ক উপকরণের সংগ্রহ ও ব্যবহার অধিকতর সহজসাধ্য। কিš‧ ভাষা ও সাহিত্য পাঠদানের ক্ষেত্রে উপকরণ সংগ্রহ ও ব্যবহার দুইই খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। এক্ষেত্রে বিষয়ানুগ, প্রাসঙ্গিক ও ব্যবহারযোগ্য উপকরণ নির্বাচন, সংগ্রহ ও ব্যবহার যথেষ্ট বিচার বিবেচনার অপেক্ষা রাখে। আবার, প্রাথমিক ও নিম্নমাধ্যমিক শ্রেণিতে ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষাদানে উপকরণের সংগ্রহ ও ব্যবহার যতটা সহজ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ততটা সহজ নয়। তবে শিক্ষক যে উপকরণই নির্বাচন করেন না কেন, তার মূল্যমান, সুলভতা এবং সর্বোপরি, উপযোগিতার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। 

শিক্ষা উপকরণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে শিক্ষককে অত্যন্ত কৌশলী হতে হয়। শিক্ষার্থীর বয়স, সামর্থ্য, চিন্তা, মেধা, আগ্রহ, প্রবণতা, শিক্ষণের উদ্দেশ্য, পদ্ধতি, কলাকৌশল, সময়, ব্যবহারের প্রক্রিয়া/কৌশল, বিষয়বস্তুর সাথে সম্পৃক্ততা, ব্যবহারযোগ্যতা, শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা, পরবর্তী সময়ের জন্য সংরক্ষণের সুবিধা-অসুবিধা তথা উপকরণের উপযোগিতা, নির্ভরযোগ্যতা, সহজলভ্যতা প্রভৃতি দিক বিবেচনায় রেখে শিক্ষা উপকরণ নির্বাচন ও ব্যবহার করতে হয়।

শিক্ষা-সহায়ক উপকরণের ব্যবহার যথাযথ হওয়া প্রয়োজন। সব সময় মনে রাখতে হবে যে, উপকরণ শিক্ষা-সহায়ক হবে, সুনির্বাচিত হবে, প্রাসঙ্গিক হবে । উপকরণ শিক্ষার্থীদের শ্রেণি, বয়স, ও বুদ্ধির উপযোগী হবে। এসব বিষয় মনে না রেখে শ্রেণিতে উপকরণ দেখানোর কোনো অর্থ হয় না। আরো মনে রাখা আবশ্যক, শিক্ষা উপকরণ ব্যবহারের সময় এগুলোকে নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করতে পারলে শিক্ষার্থীদের মনে তীব্র আবেদন ও অনুভূতির সৃষ্টি হয়। তাই উপকরণ ব্যবহারের জন্য পূর্বপরিকল্পনা থাকা আবশ্যিক। একই উপকরণ বিভিন্ন শ্রেণিতে দেখানো উচিত নয়। উপকরণের সংখ্যাধিক্য যেন শিক্ষার অগ্রগতিকে ব্যাহত না করে, সেদিকেও শিক্ষককে লক্ষ রাখতে হবে। উপকরণ এমন স্পষ্ট, সুন্দর ও শিল্পমণ্ডিত হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের বুঝতে কোনো অসুবিধা না হয়। এসব দিক বিবেচনায় শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্সে অথবা কর্মকালীন বিশেষ কোনো ট্রেনিং-এর মাধ্যমে এসব উপকরণ প্রস্তুত ও প্রয়োগের কৌশল শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। তাহলে শিক্ষক ও প্রশিক্ষক উভয়ের মধ্যেই উপকরণ ব্যবহার সম্পর্কিত ইতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠবে, সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে, শিক্ষা দান ও গ্রহণের কাজটি সহজ ও সুন্দর হবে আর নিশ্চিত হবে কার্যকর শিখন।

শিক্ষা উপকরণ উন্নয়ন

সহায়ক সামগ্রী ও শিক্ষা উপকরণের গুণগত মান উন্নয়নের জন্যও শিক্ষককে সবসময় চিন্তাশীল থাকতে হয়। শিক্ষা উপকরণ উন্নয়ন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। ব্যবহার করতে গিয়ে যখনই কোনো সমস্যা দেখা দেয় তখন থেকেই শিক্ষককে ভাবতে হয়-কী পদক্ষেপ গ্রহণ করলে পরবর্তীতে ঐ সমস্যা এড়ানো যাবে। উপকরণ নির্বাচন ও এর ব্যবহার কৌশল উন্নয়নে শিক্ষককে প্রতিনিয়তই নিম্নলিখিত বিষয়ে চিন্তাশীল থাকা আবশ্যক:

  1. কী কী বিষয় নতুন সংযোজন ও বিয়োজন দরকার
  2. শিক্ষার্থীরা কোন দিকটিকে আনন্দের সাথে গ্রহণ করছে
  3. কোন দিকটি শিক্ষার্থীর কাছে বিরক্তিকর মনে হচ্ছে
  4. শিক্ষার্থীরা বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাচ্ছে কি না
  5. ব্যবহার করতে গিয়ে কী কী সমস্যা দেখা দিচ্ছে
  6. কী পদক্ষেপ নিলে ঐ সমস্যাসমূহ দূরীভূত হবে
  7. পাঠকে কীভাবে আরো সহজ ও আকর্ষণীয় করা যায়
  8. তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে কীভাবে এর উপযোগিতা আরও বাড়ানো যায়
  9. পরিবেশিত তথ্য কতটা যুক্তিনির্ভর, বাস্তবসম্মত ও মূর্তিত রূপায়ণের?

সূত্র: বাউবি কর্তৃক প্রকাশিত পাঠ্যবই/মডিউল