০৪:৫৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

দেনমোহর: বর্তমান সামাজিক এবং ধর্মীয় প্রেক্ষাপট 

দেনমোহর বা মোহর হলো ইসলাম ধর্মে বিবাহের সময় কনের দাবিকৃত অর্থ বা সম্পদ, যা বর বা বরের পরিবারের পক্ষ থেকে কনেকে প্রদান করতে হয়। এটি প্রদান করা বাধ্যতামুলক।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
  • প্রকাশ: ১১:৪৬:১১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
  • / ৫০২ বার পড়া হয়েছে

দেনমোহর বা মোহর হলো ইসলাম ধর্মে বিবাহের সময় কনের দাবিকৃত অর্থ বা সম্পদ, যা বর বা বরের পরিবারের পক্ষ থেকে কনেকে প্রদান করতে হয়। এটি প্রদান করা বাধ্যতামুলক।

দেনমোহর, ইসলামি বিবাহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা ছাড়া মুসলিম সম্প্রদায়ে বিবাহ সম্পূর্ণ হয় না। একে শুধু ‘মোহর’ বা ‘’মহর’-ও বলা হয়ে থাকে। দেনমোহরকে বলা হয় বর কতৃক তার কনেকে দেওয়া একটি সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার। কিন্তু বর্তমানে আমাদের মুসলিম সমাজে দেনমোহর নিয়ে ব্যাপক স্বেচ্ছাচারিতা এবং অইসলামিক কার্যকলাপ লক্ষণীয়। তাই বর্তমান সামাজিক এবং ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে প্রতিটি মুসলমানের এটা জানা দায়িত্ব ও কর্তব্য যে, ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে কতটুকু দেনমোহর দেওয়া যৌক্তিক এবং সুন্নাহ সম্মত। একইসাথে দেনমোহর না দিলে কিংবা আদায় না করলে ক্ষতি কী, এবং অতিরিক্ত দেনমোহরের কারণ ও এর ক্ষতিকর প্রভাব কী, ইত্যাদি আলোচনা করা হয়েছে এই নিবন্ধে।

দেনমোহর কী

ইসলামিক এবং সামাজিক নিয়মে নারী পুরুষের মধ্যে বিবাহ বন্ধনের প্রেক্ষিতে স্বামী তার স্ত্রীকে যে সম্পদ কিংবা অর্থ প্রদান করে অথবা প্রদানে আশ্বাস দেন,  তাকে দেনমোহর বলে। দেনমোহর বা মোহর হলো ইসলাম ধর্মে বিবাহের সময় কনের দাবিকৃত অর্থ বা সম্পদ, যা বর বা বরের পরিবারের পক্ষ থেকে কনেকে প্রদান করতে হয়। এটি প্রদান করা বাধ্যতামুলক। মোহরের মাধ্যমে বিয়েকে বৈধ করা হয়।

ইসলাম ধর্মে বিয়ের জন্য অবশ্যই  দেনমোহর একটি  অপরিহার্য বিষয়। এটা স্ত্রীর প্রতি স্বামীর নিছক কোন দান বা করুণা নয়। বরং ইসলামিক আইনে স্ত্রীর একটি পাকাপোক্ত অধিকার। প্রাচীনকালে আরব অঞ্চলে যৌতুক দেওয়ার প্রথা চালু ছিল, নবুয়াত প্রাপ্তির পর হজরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে যৌতুক প্রথাকে নিষিদ্ধ করে আবশ্যক দেনমহরপ্রথা চালু করেন। ইসলামে মহরের কোন সীমারেখা নেই। যা বরের আর্থিক অবস্থার উপর নির্ভর করে নির্ধারণ করা হয়।

স্বয়ং আল্লাহ  এই অধিকার সকল স্ত্রীদের জন্য নির্ধারণ করেছেন। তাই মোহর পরিশোধ না করা পর্যন্ত চাইলে যেকোনো  স্ত্রী নিজেকে তার স্বামী থেকে দূরে রাখতে পারে। মোটকথা দেনমোহর বা মোহরানা হচ্ছে একজন নারীর সতীত্বের বিনিময়সহ আত্মমর্যাদা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। একইসাথে একটি পবিত্র বন্ধনের বাহ্যিক দায়বদ্ধতা আর নারীর জীবনের নিশ্চয়তা।

কুরআনের আলোকে দেনমোহর

আল্লাহ পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্ট ভাবে মোহরানার কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেন, “আর তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশি মনে। তারা যদি খুশি হয়ে তা থেকে অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ কর। (সুরা: আন নিসা, আয়াত: ৪)”

অর্থাৎ প্রতিটি স্বামীকেই বিয়ের আগে তার স্ত্রীকে খুশি মনে মোহরানা প্রদান করতে হবে, এটা বাধ্যতামূলক। তবে কোনো স্ত্রী যদি তার মোহরানা না নিয়ে তা মাফ করে দেয়, কিংবা মোহরানা নিয়ে কিছু বা সম্পূর্ণ অংশ তার স্বামীকে দিয়ে দেয় তাহলে তা স্বামী অবশ্যই গ্রহণ করে ভোগ করতে পারবে।

সুতরাং পবিত্র কুরআনের আলোকে বুঝা গেল যে, মোহরানা আদায় করতে হবে, এবং তা স্বামী খুশিমনে যা দিতে পারে বা তার সামর্থ্য অনুযায়ী। এখানে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিমাণ উল্লেখ নেই। তাই চাইলে একজন স্বামী তার স্ত্রীকে কোটি টাকা দেনমোহর দিতে পারেন। আবার চাইলে পঞ্চাশ হাজার টাকাও দেনমোহর দিতে পারেন, যদি স্ত্রী তাতে সম্মত হন।

এক্ষেত্রে শরিয়তের কোনো ধরাবাঁধা পরিমাণ নেই। তবে মূল উদ্দেশ্য হলো স্বামীর সামর্থ্য এবং স্ত্রীর সন্তুষ্টি। যদি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে একটা সমঝোতা হয় তাহলে দেনমোহর নিয়ে শরিয়তের কোনো বাধ্যবাদকতা নেই।

হাদিসের আলোকে দেনমোহর

মুসলিম বিয়েতে দেনমোহর প্রদান এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, এই বিষয়ে আল্লাহর রাসূল সা. অসংখ্য নির্দেশ দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দেনমোহর পরিশোধ না করলে স্বামী চিরঋণী হয়ে থাকবে, আখেরাতে ব্যভিচারী হিসেবে তার বিচার হবে (তিরমিজি-২৪৬১)।”

এই হাদিসে এটা স্পষ্ট যে, দেনমোহর একজন স্বামীর জন্য বাধ্যতামূলক। তাই এটা পরিশোধ করা কর্তব্য। কেউ যদি দেনমোহর পরিশোধ না করে, তাহলে তাকে ব্যভিচারী বা যেনাকারী হিসাবে কিয়ামতে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।

অতএব এই দেনমোহর আমরা যতটা সহজ কিংবা সরল মনে করছি, বিষয়টা কখনোই এতো সহজ নয়। ইচ্ছা হলেই মনের খেয়াল খুশি মতো দেনমোহর ধরে তা আর পরিশোধ না করার যে সংস্কৃতি আমাদের উপমহাদেশে চালু আছে, তা সরাসরি শরিয়ত বহির্ভূত। সুতরাং দেনমোহর কখনোই কোনো ছেলেখেলা নয় যে, বিয়ের সময় কাবিননামায় উল্লেখ করেই দায়িত্ব শেষ। দেনমোহরের দায় এবং দায়িত্ব সরাসরি আখিরাতের সাথে সম্পৃক্ত। আর এজন্য প্রতিটি স্বামীর জবাবদিহিতা এবং দায়বদ্ধতা রয়েছে। 

দেনমোহরের প্রকারভেদ

মোহরানা পরিশোধ করা না করার উপর ভিত্তি করে দেনমোহর দুই প্রকারের হয়ে থাকে। যেমন নগদ বা তাৎক্ষণিক দেনমোহর। যা বিয়ের সম্পূর্ণ হওয়ার আগে কিংবা বিয়ে সমাপ্ত হওয়ার পর স্ত্রীকে স্পর্শ করার আগে পরিশোধ করে থাকে। অর্থাৎ যারা স্ত্রীকে দেনমোহরের সম্পূর্ণ টাকা আগে থাকতে পরিশোধ করে দেন, সেটা হচ্ছে নগদ বা তাৎক্ষণিক দেনমোহর।

অপরটি হচ্ছে বিলম্বিত দেনমোহর যা বিয়ে সমাপ্ত হওয়ার পর স্বামী কতৃক স্ত্রীকে দেনমোহরের টাকা পরে পরিশোধ করবে কিংবা উভয়ের সম্মতিতে স্ত্রী থেকে দেনমোহরের টাকা মাফ চেয়ে নিয়ে সংসার করা। কিন্তু যখনই কোনো কারণে সংসার বা বিয়ে ভেঙে যায়, তখনই সেই দেনমোহরের টাকা স্ত্রী সালিশি বৈঠকের মাধ্যমে নিয়ে নেয়।

এটা একধরনের চুক্তির মতো। অর্থাৎ  স্বামীর স্ত্রীর মধ্যে সুন্দর সংসার তাদের মৃত্যুর আগপর্যন্ত ঠিকমতো চললে, এই দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করতে হয় না বা হবেনা। কিন্তু কোনো কারণে সংসার নষ্ট হলে অবশ্যই সেই দেনমোহর পরিশোধ করতে হয়। এই রীতিই আমাদের উপমহাদেশে বহুল প্রচলিত। যার শরিয়তের কোনো ভিত্তি নেই। 

দেনমোহর কত দিতে হয়

আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল দেনমোহরের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ধারণ করে দেননি। তাই দেনমোহর হিসেবে যে কোন পরিমাণ অর্থ সম্পদ নির্ধারণ করা যেতে পারে, তবে এটার পরিমাণ কোনো  ভাবেই দশ দিরহামের কম হবে না। এই সম্পর্কে একটি হাদিসে এসেছে, ১০ দিরহামের কম কোনো মোহর নেই (বায়হাকি শরিফ, ৭/২৪০)”

এখানে ১০ দিরহাম সমান  ৩০.৬১৮ গ্রাম রুপা অথবা এর সমপরিমাণ মূল্য। এর চেয়ে কম পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করা স্ত্রী রাজি হলেও তা শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ হবে না। এক্ষেত্রে অনেকে ফাতেমি দেনমোহরকে নূন্যতম দেনমোহর বিবেচনা করে। যার পরিমাণ হচ্ছে ৫০০ দিরহাম বা ১৫৩০.৯ গ্রাম রূপা। এই পরিমাণ দেনমোহরের মাধ্যমে হজরত ফাতেমা (রা.) এর বিয়ে হয়েছিল। (জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া, ৪/৩৫০)

আমরা পবিত্র কুরআন থেকেই আগেই জেনেছি যে, দেনমোহর হচ্ছে একজন স্বামী খুশিমনে তাঁর স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করে যা দিতে পারেন, কিংবা যতবেশী দিতে পারেন। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ কোনো সীমারেখা ইসলামে নেই। তবে আমাদের দেশে অনেকে খুশিমনে দেনমোহর নির্ধারণ (যদিও তা নগদে পরিশোধ করে না) করলেও অধিকাংশেরও বেশি বিয়েতে কনে পক্ষের (যৌক্তিক কিংবা অযৌক্তিক) দাবিকেই মেনে নেওয়া হয়। যদিও তা নগদে কখনোই পরিশোধ করা বা আদায় করা হয়না। 

তাই বিয়ের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের মুরুব্বী কিংবা অভিভাবকরা স্ত্রীর পিতার পরিবারের অন্যান্য মহিলা সদস্যদের ক্ষেত্রে যেমন মেয়ের বোন, ফুফু, খালা, ইত্যাদির দেনমোহরের অনুপাতে নির্ধারণ করে থাকেন। আবার ছেলের পক্ষেরও ছেলের অন্যান্য ভাইদের স্ত্রীদের কত দেনমোহর দিয়েছে সেটাকেও বিবেচনা করে।

আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলের বিয়ে গুলোতে অনেক সময় কাগজপত্র বা সরাসরি কাবিন করা হয় না। এক্ষেত্রে কোন কারণে বিয়ের সময় দেনমোহর ঠিক করা থাকে না বা যথাযথ হয়ে থাকে না। যদিও শরিয়তের দৃষ্টিতে এটা অবৈধ তবে প্রচলিত আইনে দেনমোহর নির্দিষ্ট করা না থাকলে, কোনো কারণে সেই বিয়ে ভেঙে গেলে আদালত একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ দেনমোহরের অর্থ নির্ধারণ করতে পারেন।

দেনমোহরের বর্তমান প্রেক্ষাপট 

দেনমোহর কিংবা মোহরানা নিয়ে আমাদের বর্তমান সমাজে যা চলছে তা খুবই জঘন্য এবং নিকৃষ্টতম কাজ। যার সাথে প্রকৃত ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। এই দেনমোহরকে পুঁজি করে আমাদের সমাজে একধরনের অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছে। এরফলে যে দেনমোহর নির্ভর ছিলো স্বামীর সন্তুষ্টি এবং সামর্থ্যের উপর। এখন সেই দেনমোহরের হিসাব চলে গেছে সামাজিক স্ট্যাটাসের উপর।

এখনকার বিয়ে গুলোতে দেনমোহরের হিসাব বরের সামর্থ্য কিংবা ইসলামিক ভিত্তির উপর নেই। বরং তা অইসলামিক ভিত্তি এবং অনৈতিক কার্যকলাপে রুপান্তর নিয়েছে। ফলে এই দেনমোহর আর আদায়ের বিষয়ে নেই, বরং লোকদেখানো ও ভণ্ডামিতে পরিণত হয়েছে। দেনমোহর এখন প্রতিযোগিতায় পরিনত হয়েছে। কে কার থেকে বেশি দেনমোহর দিতে পারে (আদায় নয়) কিংবা কার মেয়ে কতবেশী দেনমোহরে বিয়ে হয়েছে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

একারণে দিনদিন সামাজিক এবং ইসলামিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার পাশাপাশি ধর্মীয় এবং নৈতিক অবক্ষয়ও দেখা দিচ্ছে।  মুসলিম বিয়ে গুলোতে গণহারে অতিরিক্ত দেনমোহরের কারণে বিভিন্ন সামাজিক এবং ধর্মীয় বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে।

অতিরিক্ত দেনমোহরের কারণ

আমাদের দেশে অতিরিক্ত দেনমোহর ধরার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। যদিও এই বিষয়টা পাত্রপক্ষ নির্ধারণ করার কথা। তবুও কনের পরিবারের পক্ষ থেকে সবসময়ই চেষ্টা করা হয় অতিরিক্ত দেনমোহর ধরার। আর এর প্রধান কারণ হচ্ছে, বিবাহ বিচ্ছেদ বা ডিভোর্স ঠেকানো। 

অর্থাৎ যতবেশী দেনমোহর ধরা যাবে স্বামী ততবেশী ডিভোর্স দিতে ভয় পাবে। কিংবা স্ত্রী হাজার অপরাধ করলেও দেনমোহরের টাকা আদায় করার অপারগতার কারণে স্বামী সহজে স্ত্রীকে ডিভোর্স দিবে না। একইসাথে কোনো কারণে ডিভোর্স হয়ে গেলেও যেন, কনেপক্ষ ভালো একটি ক্ষতিপূরণ পায়।

এইজাতীয় ভবিষ্যৎ চিন্তা থেকেই বর্তমান সমাজের বিয়ে গুলোতে অতিরিক্ত দেনমোহর ধরা হচ্ছে। যদিও অতিরিক্ত দেনমোহর কখনোই একটি অশান্তির সংসারকে টিকিয়ে রাখতে পারে না। 

এছাড়াও অতিরিক্ত দেনমোহরের কারণ হচ্ছে সামাজিক স্ট্যাটাস। অর্থাৎ মানুষের কাছে জাহির করার জন্যও অনেক স্বামী  স্বেচ্ছায় এবং কনেপক্ষ জোরপূর্বক অতিরিক্ত দেনমোহর নিয়ে থাকেন। যদিও এই দেনমোহর আদায়ের বা উসুলের কোনো পক্ষকেই তৎপর দেখা যায় না। শুধু সামাজিকতা রক্ষার জন্যই অতিরিক্ত দেনমোহর ধরা হয়। 

অতিরিক্ত দেনমোহরের কুফল

আমাদের সমাজে আজ অতিরিক্ত দেনমোহরের ছড়াছড়ি। আর এই মাত্রাতিরক্ত দেনমোহরের কারণেই অসংখ্য সংসার বর্তমানে হুমকির মুখে রয়েছে। এরফলে সমাজে নানাবিধ সমস্যার দেখা দিয়েছে। যেমন: 

বিয়েতে কনে পক্ষের বাড়তি খরচ

যখন কনেপক্ষ অতিরিক্ত দেনমোহর দাবি করে, তখন তাদের দাবি মেনে নিয়ে বরপক্ষও নানান অজুহাতে কনেপক্ষ থেকে বিভিন্ন বিষয়ের উপর চাপ প্রয়োগ করে। বিশেষকরে খাওয়া দাওয়া নিয়ে বেশ চাপে রাখে বরপক্ষ। এক্ষেত্রে তারা অতিরিক্ত বরযাত্রীর দাবি করে। ফলে কনেপক্ষকে নিজেদের সাধ্যে না থাকলেও অনেক মানুষের খানাপিনার আয়োজন করতে হয়।  এছাড়াও প্রথম দু চার বছর কনেপক্ষ থেকে বরপক্ষকে বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয়  দিবস উপলক্ষে নানান কিছু বাধ্যতামূলক দিতে হয়। এইসব খরচ সামলাতেও কনেপক্ষকে অনেক খরচাপাতি করতে হয়।  

যৌতুকের প্রচলন 

অতিরিক্ত দেনমোহরের সবচেয়ে খারাপ দিক হলো বরপক্ষকে যৌতুক দেওয়া। যখন বরপক্ষ কনেপক্ষের দাবি মেনে অতিরিক্ত দেনমোহর দিতে রাজি হয়, তখন বরপক্ষ কনেপক্ষ থেকে যাবতীয় যৌতুক দাবি করে বসে। কনেপক্ষেও তাদের দাবি মেটাতে গিয়ে ব্যাপক যৌতুকের ব্যবস্থা করে। আর এইভাবে যৌতুক দিতে গিয়ে দেখা যায় যে, দেনমোহরের টাকার চাইতে কনেপক্ষের খরচ আরও বেশি হয়ে যায়। যা আমরা সাধারণ মানুষেরা কখনোই চিন্তা করি না।

বিয়ে করতে না পারা

অতিরিক্ত দেনমোহরের কারণে সমাজের বিয়ে উপযুক্ত ছেলেরা সহজে বিয়ে করতে পারছে না। কেননা আমাদের সমাজে খুব কম মানুষেরই সামর্থ্য আছে অতিরিক্ত দেনমোহর দেওয়ার। তাই যারা মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, তারা সহজেই বিয়ে করতে পারে না কিংবা সাহস করে না। এরফলে সমাজে যুবক শ্রেণিদের মধ্যে নানান হতাশা ছড়িয়ে পড়ছে।

নৈতিক অবক্ষয়

অতিরিক্ত দেনমোহরের কারণে দিনদিন আমাদের সমাজে নৈতিক অবক্ষয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। আর এই অবক্ষয়ের মাধ্যমে সমাজে পরকীয়া বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুবক ছেলেরা বিয়ে করতে না পারার কারণে পাড়ার কিংবা আত্মীয়স্বজনের স্ত্রীদের সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত হচ্ছে ফ্রিস্টাইলে। আর এতে নারী পুরুষ উভয়েরই নৈতিক অবক্ষয় হচ্ছে।

অশ্লীলতা বৃদ্ধি

অতিরিক্ত দেনমোহর দিতে না পারার কারণে যুবক ছেলেরা বিয়ে করতে পারছে না। ফলে তারা তাদের যৌবন অতিবাহিত করার জন্য বিভিন্ন পতিতালয় কিংবা হোটেল রাত্রিযাপন করছে। এছাড়াও অধিকাংশ ছেলে মেয়ে বিয়ে করার নামে প্রেম করে প্রেমিকার সাথে অশ্লীলতায় মেতে আছে। শুধু তাইনয়, সরকারি আইনে নারীদের ১৮ বছরের নীচে বিয়ে না হওয়ার কারণে ছেলেমেয়েরা অবাধে বিভিন্ন পার্ক এবং পর্যটন কেন্দ্রে মেলামেশা করছে। এইসব বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক আজ গুলো সমাজ এবং রাষ্ট্রের  জন্য অশ্লীলতা বয়ে আনছে।  

বিয়ে করতে নিস্পৃহা 

অতিরিক্ত দেনমোহর একজন পুরুষকে অর্থনৈতিক, সামাজিক, শারিরীক এবং নৈতিকভাবে পঙ্গু করে ফেলে। এরফলে কোনো যুবক আর বিয়ে করতে আগ্রহী হয়ে উঠে না। কেননা বিয়ে করতে গেলেই অনেক খরচের ধাক্কা সামলাতে হয়। যা আমাদের সমাজের মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্ত ছেলেদের দ্বারা  সম্ভব হয়ে উঠে না। তাই তারা বিয়েতে দিনদিন অনাগ্রহী হয়ে উঠে। 

নারীদের স্বেচ্ছাচারিতা বৃদ্ধি

অতিরিক্ত দেনমোহরের কারণে দিনদিন  নারীদের একটি শ্রেণির মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এইসব উশৃঙ্খল নারী শ্রেণি আজ সমাজ কিংবা ধর্মীয় কোনো বাঁধাকেই তোয়াক্কা করে না। এরা সংসার করার চাইতে সংসারে আগুন লাগাতে ব্যস্ত থাকে। এরা বিভিন্ন ছোটখাটো বিষয় নিয়ে সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করে স্বামীকে পরিবার থেকে আলাদা করে ফেলে। অন্যথায় পরিবারে নানান অশান্তি সৃষ্টি করে নিজের জিদ বজায় রাখে।

আর এইসব নারীদের মূল শক্তি হচ্ছে অতিরিক্ত দেনমোহর। যদি স্ত্রীর অত্যাচারে কিংবা যেকোনো অজুহাতে স্বামী সংসার করতে না চাইলে স্ত্রীকে অবশ্যই মোটা অংকের ক্ষতিপূরণসহ দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করতে হবে। যা অধিকাংশের বেশি স্বামীর পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভব হয় না। ফলে স্বামীসহ পুরো পরিবার পরবর্তীতে  ডিভোর্স দিতে চাইলেও টাকার জন্য দিতে পারে না। 

সহজ দেনমোহর রাসূলের সুন্নাহ

দেনমোহর সহজের মাধ্যমে বিয়েকে সহজতর করা রাসূলের সুন্নাহ। আল্লাহর রাসূল সা. বলেন, –“সে নারী বরকতের মাঝে আছে যাকে প্রস্তাব দেয়া সহজ ও যার দেনমোহর অল্প” (মুসনাদে আহমাদ; হাসান সানাদে)

অর্থাৎ ঐ নারীর প্রতি আল্লাহ বরকত নাযিল করেন, যাকে সহজে প্রস্তাব দিয়ে বিয়ে করা যায় এবং সচারচর সাধারণ মানের দেনমোহরের মাধ্যমে বিয়ে করা যায়। যদি এমনটা হয় তাহলে অবশ্যই ঐ পরিবারে বরকত নাযিল হবে। 

বিয়েতে বরকত হওয়া সম্পর্কে আরেকটি হাদিস উম্মাহাতুল মুমিনীন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “সবচেয়ে বরকতময় বিয়ে হচ্ছে সুন্নতি বিয়ে, অর্থাৎ যে বিয়েতে খরচ কম হয় এবং কোনো জাঁকজমক থাকে না।”-মিশকাত শরিফ

অর্থাৎ যে বিয়েতে যাবতীয় খরচ কম হবে, সেই বিয়ে হবে সবচেয়ে বরকতপূর্ণ বিয়ে। এক্ষেত্রে দেনমোহরের টাকাটাও একটি মূখ্য বিষয়। কেননা বর্তমানে অতিরিক্ত দেনমোহরের টাকার কারণে বিয়ের আনুষাঙ্গিক খরচও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এছাড়াও আমরা সাহাবীদের জীবনী থেকে এমন দৃষ্টান্তও পাই যে, তাঁরা শুধু কুরআন শিক্ষার বিনিময়েও বিয়ের দেনমোহর নির্ধারণ করেছিলেন। 

এছাড়াও আমরা হজরত উমর (রা.) এর খেলাফতকালের দিকে তাকালে দেখতে পাই যে, বিভিন্ন কারণে তখন মুসলমানদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসে। এরফলে সাহাবারা (রা.) তাদের সন্তানদের বিয়েতে দেনমোহরে ফাতেমির চেয়ে অনেক গুণ বেশি দেনমোহর দেওয়া  শুরু করেন। এটা দেখে হজরত উমর (রা.) সংকিত হন। তাই তিনি অতিরিক্ত  দেনমোহরের  গতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন। কেননা সবাই যদি অহেতুক এভাবে অতিরিক্ত দেনমোহর দেওয়া শুরু করে, তাহলে গরিব মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা বেকায়দায় পড়ে যাবে। সমাজে একধরনের বিভেদ সৃষ্টি হতে পারে। তাই হঠাৎ করে এত বেশি পরিমান দেনমহর দেওয়ার পক্ষে তিনি ছিলেন না। কিন্তু সুরা নিসার ৪ নম্বর আয়াত এর কারনে তিনি তা পারেননি। অথচ তখনকার সময়ে অতিরিক্ত  দেনমোহর দেওয়া ছিলো শরিয়ত সম্মত স্বামীর খুশিতে। একইসাথে তখনকার দেনমোহর নির্ধারণের সাথে সাথে আদায়ও করা হতো। 

কিন্তু বর্তমান সময়ে যেভাবে অতিরিক্ত দেনমোহর নির্ধারণ করা হচ্ছে, এটা কখনোই স্বামীর সন্তুষ্টি নিয়ে নয়। বরং জোরজবরদস্তিমূলক। ফলে বর্তমান দেনমোহর মোটেই আদায় করা হচ্ছে না। তাই কুরআনের আলোকে বেশি দেনমোহর নির্ধারণের সুযোগ থাকলেও, কুরআনের আইন অনুযায়ী কোথাও তা আদায় করা হচ্ছে না। এটা শরিয়ত নিয়ে একধরনের ভন্ডামির নামান্তর তথা মুনাফিকী। কারণ বর্তমানে দেনমোহর শুধু কাগজপত্রে ধার্য করা হচ্ছে। ব্যাপারটা এমন যে, দেনমোহর ধার্য করা হলো, স্ত্রী সেটা গ্রহণ করবে না, স্বামীকে কখনো পরিশোধ করতেও হবে না। সুতরাং এইসব জোচ্চুরি বাদ দিয়ে আমাদের প্রকৃত মুসলমান হতে হলে, অবশ্যই যৌক্তিক দেনমোহর ধার্য করতে হবে। একইসাথে তা তৎক্ষণাৎ আদায়ও করতে হবে। কোনোধরনের ছলছাতুরি ইসলামে কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। 

অতিরিক্ত দেনমোহর ইসলাম ধর্মের অংশ নয়

আমাদের বিয়ে গুলোতে যে ব্যবস্থায় দেনমোহর আদায় করা ছাড়া ধরা হচ্ছে তা খুবই নিকৃষ্ট একটি কাজ। অথচ সাহাবীগণ উচ্চমূল্য দেনমোহর ধার্য করে আদায় করার পরও উমর (রা.) তা অপছন্দ করতেন। এক‌টি হাদিসে এসেছে, যা আবুল আজফা (রহ.) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেছেন, সাবধান! তোমরা নারীদের  মোহরানা  উচ্চহারে বাড়িয়ে দিও না। কেননা, তা দুনিয়াতে যদি সম্মানের বস্তু অথবা আল্লাহ্ তা’আলার নিকট তাকওয়ার বস্তু হত তবে এ ব্যাপারে আল্লাহর নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তোমাদের চেয়ে বেশি উদ্যোগী হতেন। কিন্তু বার উকিয়ার বেশি পরিমাণ মোহরে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার কোন স্ত্রীকে বিয়ে করেছেন অথবা তার কোন কন্যাকে বিয়ে দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। সহীহ, ইবনু মা-জাহ (১৮৮৭)

এই হাদিস থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, অতিরিক্ত দেনমোহর কখনোই আল্লাহর কাছে তাকওয়ার বিষয় নয়। কেননা এটাতে কোনো কল্যাণ থাকলে তা আমাদের রাসূল সা.ই এই কাজে এগিয়ে থাকতেন। তারমানে এটা নয় যে, অতিরিক্ত দেনমোহর দেওয়া যাবে না।

তবে আমাদের দেশে যে সংস্কৃতি আজকাল সৃষ্টি হয়েছে, আদায় করা ছাড়া অতিরিক্ত দেনমোহর দেওয়া, এটার কথাই উমার (রা.) ইঙ্গিত করেছিলেন। আজকাল আমরা দেনমোহরের নামে যা করছি তাতে ইসলামের কোনো অংশ নেই বরং ধর্মের সুযোগকে দুনিয়াবী হাতিয়ার বানিয়ে নিয়েছি। যা একধরনের মুনাফিকী। কেননা আমরা দেনমোহরের ওয়াদা করছি, অথচ আদায় করছি কিংবা আদায় করার নিয়তও নেই। যা সরাসরি ওয়াদার বরখেলাফ। 

দেনমোহর স্ত্রীর অধিকার

দেনমোহর মুসলিম নারীদের একটি অধিকার। আল্লাহ বলেন, “এদেরকে ছাড়া তোমাদের জন্যে সব নারী হালাল করা হয়েছে, শর্ত এই যে, তোমরা তাদেরকে স্বীয় অর্থের বিনিময়ে তলব করবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য-ব্যভিচারের জন্য নয়। অনন্তর তাদের মধ্যে যাকে তোমরা ভোগ করবে, তাকে তার নির্ধারিত হক দান কর। তোমাদের কোন গোনাহ হবে না যদি নির্ধারণের পর তোমরা পরস্পরে সম্মত হও। নিশ্চয় আল্লাহ সুবিজ্ঞ, রহস্যবিদ। (সুরা: আন নিসা, আয়াত: ২৪)”

অর্থাৎ আল্লাহ পবিত্র কুরআনে স্ত্রীদের দেনমোহরকে তাদের সুস্পষ্ট হক বা অধিকার বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু আমাদের বর্তমান সমাজে বিভিন্ন সামাজিক সীমাবদ্ধ দেখিয়ে নারীদের এই হক থেকে বিচ্যুতি করা হচ্ছে। বরং অতিরিক্ত দেনমোহরের নামে কনেপক্ষ থেকে ব্যাপক খরচাপাতি করিয়ে নিচ্ছে। অথচ অতিরিক্ত দেনমোহর দিলেও আদায় না করার কারণে কনেপক্ষের লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না। বরং মেয়ে বিয়ে দিতে গিয়ে দেনমোহরের চাইতে বেশি খরচ  করতে হচ্ছে। তাই বিয়েতে অবশ্যই যৌক্তিক দেনমোহর আদায়ের পাশাপাশি যৌতুক বন্ধ হওয়া উচিত। আর এটা নারীদের একটি ধর্মীয় অধিকার।

শেষকথা

অতিরিক্ত দেনমোহর আজ আমাদের সমাজকে একটি ধ্বংসের পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। এতে গরিব মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই আসুন অতিরিক্ত দেনমোহর নির্ধারণ বন্ধ করে, যৌক্তিক দেনমোহর আদায়ের চেষ্টা করি। আর এভাবেই আমরা সঠিক ভাবে ইসলাম ধর্ম পালন করার চেষ্টা করি।

বিষয়:

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী জন্ম চট্টগ্রামে। জীবিকার প্রয়োজনে একসময় প্রবাসী ছিলেন। প্রবাসের সেই কঠিন সময়ে লেখেলেখির হাতেখড়ি। গল্প, কবিতা, সাহিত্যের পাশাপাশি প্রবাসী বাংলা পত্রিকায়ও নিয়মিত কলাম লিখেছেন। প্রবাসের সেই চাকচিক্যের মায়া ত্যাগ করে মানুষের ভালোবাসার টানে দেশে এখন স্থায়ী বসবাস। বর্তমানে বেসরকারি চাকুরিজীবী। তাঁর ভালোলাগে বই পড়তে এবং পরিবারকে সময় দিতে।

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

দেনমোহর বা মোহর হলো ইসলাম ধর্মে বিবাহের সময় কনের দাবিকৃত অর্থ বা সম্পদ, যা বর বা বরের পরিবারের পক্ষ থেকে কনেকে প্রদান করতে হয়। এটি প্রদান করা বাধ্যতামুলক।

দেনমোহর: বর্তমান সামাজিক এবং ধর্মীয় প্রেক্ষাপট 

প্রকাশ: ১১:৪৬:১১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

দেনমোহর, ইসলামি বিবাহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা ছাড়া মুসলিম সম্প্রদায়ে বিবাহ সম্পূর্ণ হয় না। একে শুধু ‘মোহর’ বা ‘’মহর’-ও বলা হয়ে থাকে। দেনমোহরকে বলা হয় বর কতৃক তার কনেকে দেওয়া একটি সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার। কিন্তু বর্তমানে আমাদের মুসলিম সমাজে দেনমোহর নিয়ে ব্যাপক স্বেচ্ছাচারিতা এবং অইসলামিক কার্যকলাপ লক্ষণীয়। তাই বর্তমান সামাজিক এবং ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে প্রতিটি মুসলমানের এটা জানা দায়িত্ব ও কর্তব্য যে, ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে কতটুকু দেনমোহর দেওয়া যৌক্তিক এবং সুন্নাহ সম্মত। একইসাথে দেনমোহর না দিলে কিংবা আদায় না করলে ক্ষতি কী, এবং অতিরিক্ত দেনমোহরের কারণ ও এর ক্ষতিকর প্রভাব কী, ইত্যাদি আলোচনা করা হয়েছে এই নিবন্ধে।

দেনমোহর কী

ইসলামিক এবং সামাজিক নিয়মে নারী পুরুষের মধ্যে বিবাহ বন্ধনের প্রেক্ষিতে স্বামী তার স্ত্রীকে যে সম্পদ কিংবা অর্থ প্রদান করে অথবা প্রদানে আশ্বাস দেন,  তাকে দেনমোহর বলে। দেনমোহর বা মোহর হলো ইসলাম ধর্মে বিবাহের সময় কনের দাবিকৃত অর্থ বা সম্পদ, যা বর বা বরের পরিবারের পক্ষ থেকে কনেকে প্রদান করতে হয়। এটি প্রদান করা বাধ্যতামুলক। মোহরের মাধ্যমে বিয়েকে বৈধ করা হয়।

ইসলাম ধর্মে বিয়ের জন্য অবশ্যই  দেনমোহর একটি  অপরিহার্য বিষয়। এটা স্ত্রীর প্রতি স্বামীর নিছক কোন দান বা করুণা নয়। বরং ইসলামিক আইনে স্ত্রীর একটি পাকাপোক্ত অধিকার। প্রাচীনকালে আরব অঞ্চলে যৌতুক দেওয়ার প্রথা চালু ছিল, নবুয়াত প্রাপ্তির পর হজরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে যৌতুক প্রথাকে নিষিদ্ধ করে আবশ্যক দেনমহরপ্রথা চালু করেন। ইসলামে মহরের কোন সীমারেখা নেই। যা বরের আর্থিক অবস্থার উপর নির্ভর করে নির্ধারণ করা হয়।

স্বয়ং আল্লাহ  এই অধিকার সকল স্ত্রীদের জন্য নির্ধারণ করেছেন। তাই মোহর পরিশোধ না করা পর্যন্ত চাইলে যেকোনো  স্ত্রী নিজেকে তার স্বামী থেকে দূরে রাখতে পারে। মোটকথা দেনমোহর বা মোহরানা হচ্ছে একজন নারীর সতীত্বের বিনিময়সহ আত্মমর্যাদা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। একইসাথে একটি পবিত্র বন্ধনের বাহ্যিক দায়বদ্ধতা আর নারীর জীবনের নিশ্চয়তা।

কুরআনের আলোকে দেনমোহর

আল্লাহ পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্ট ভাবে মোহরানার কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেন, “আর তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশি মনে। তারা যদি খুশি হয়ে তা থেকে অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ কর। (সুরা: আন নিসা, আয়াত: ৪)”

অর্থাৎ প্রতিটি স্বামীকেই বিয়ের আগে তার স্ত্রীকে খুশি মনে মোহরানা প্রদান করতে হবে, এটা বাধ্যতামূলক। তবে কোনো স্ত্রী যদি তার মোহরানা না নিয়ে তা মাফ করে দেয়, কিংবা মোহরানা নিয়ে কিছু বা সম্পূর্ণ অংশ তার স্বামীকে দিয়ে দেয় তাহলে তা স্বামী অবশ্যই গ্রহণ করে ভোগ করতে পারবে।

সুতরাং পবিত্র কুরআনের আলোকে বুঝা গেল যে, মোহরানা আদায় করতে হবে, এবং তা স্বামী খুশিমনে যা দিতে পারে বা তার সামর্থ্য অনুযায়ী। এখানে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিমাণ উল্লেখ নেই। তাই চাইলে একজন স্বামী তার স্ত্রীকে কোটি টাকা দেনমোহর দিতে পারেন। আবার চাইলে পঞ্চাশ হাজার টাকাও দেনমোহর দিতে পারেন, যদি স্ত্রী তাতে সম্মত হন।

এক্ষেত্রে শরিয়তের কোনো ধরাবাঁধা পরিমাণ নেই। তবে মূল উদ্দেশ্য হলো স্বামীর সামর্থ্য এবং স্ত্রীর সন্তুষ্টি। যদি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে একটা সমঝোতা হয় তাহলে দেনমোহর নিয়ে শরিয়তের কোনো বাধ্যবাদকতা নেই।

হাদিসের আলোকে দেনমোহর

মুসলিম বিয়েতে দেনমোহর প্রদান এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, এই বিষয়ে আল্লাহর রাসূল সা. অসংখ্য নির্দেশ দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দেনমোহর পরিশোধ না করলে স্বামী চিরঋণী হয়ে থাকবে, আখেরাতে ব্যভিচারী হিসেবে তার বিচার হবে (তিরমিজি-২৪৬১)।”

এই হাদিসে এটা স্পষ্ট যে, দেনমোহর একজন স্বামীর জন্য বাধ্যতামূলক। তাই এটা পরিশোধ করা কর্তব্য। কেউ যদি দেনমোহর পরিশোধ না করে, তাহলে তাকে ব্যভিচারী বা যেনাকারী হিসাবে কিয়ামতে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।

অতএব এই দেনমোহর আমরা যতটা সহজ কিংবা সরল মনে করছি, বিষয়টা কখনোই এতো সহজ নয়। ইচ্ছা হলেই মনের খেয়াল খুশি মতো দেনমোহর ধরে তা আর পরিশোধ না করার যে সংস্কৃতি আমাদের উপমহাদেশে চালু আছে, তা সরাসরি শরিয়ত বহির্ভূত। সুতরাং দেনমোহর কখনোই কোনো ছেলেখেলা নয় যে, বিয়ের সময় কাবিননামায় উল্লেখ করেই দায়িত্ব শেষ। দেনমোহরের দায় এবং দায়িত্ব সরাসরি আখিরাতের সাথে সম্পৃক্ত। আর এজন্য প্রতিটি স্বামীর জবাবদিহিতা এবং দায়বদ্ধতা রয়েছে। 

দেনমোহরের প্রকারভেদ

মোহরানা পরিশোধ করা না করার উপর ভিত্তি করে দেনমোহর দুই প্রকারের হয়ে থাকে। যেমন নগদ বা তাৎক্ষণিক দেনমোহর। যা বিয়ের সম্পূর্ণ হওয়ার আগে কিংবা বিয়ে সমাপ্ত হওয়ার পর স্ত্রীকে স্পর্শ করার আগে পরিশোধ করে থাকে। অর্থাৎ যারা স্ত্রীকে দেনমোহরের সম্পূর্ণ টাকা আগে থাকতে পরিশোধ করে দেন, সেটা হচ্ছে নগদ বা তাৎক্ষণিক দেনমোহর।

অপরটি হচ্ছে বিলম্বিত দেনমোহর যা বিয়ে সমাপ্ত হওয়ার পর স্বামী কতৃক স্ত্রীকে দেনমোহরের টাকা পরে পরিশোধ করবে কিংবা উভয়ের সম্মতিতে স্ত্রী থেকে দেনমোহরের টাকা মাফ চেয়ে নিয়ে সংসার করা। কিন্তু যখনই কোনো কারণে সংসার বা বিয়ে ভেঙে যায়, তখনই সেই দেনমোহরের টাকা স্ত্রী সালিশি বৈঠকের মাধ্যমে নিয়ে নেয়।

এটা একধরনের চুক্তির মতো। অর্থাৎ  স্বামীর স্ত্রীর মধ্যে সুন্দর সংসার তাদের মৃত্যুর আগপর্যন্ত ঠিকমতো চললে, এই দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করতে হয় না বা হবেনা। কিন্তু কোনো কারণে সংসার নষ্ট হলে অবশ্যই সেই দেনমোহর পরিশোধ করতে হয়। এই রীতিই আমাদের উপমহাদেশে বহুল প্রচলিত। যার শরিয়তের কোনো ভিত্তি নেই। 

দেনমোহর কত দিতে হয়

আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল দেনমোহরের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ধারণ করে দেননি। তাই দেনমোহর হিসেবে যে কোন পরিমাণ অর্থ সম্পদ নির্ধারণ করা যেতে পারে, তবে এটার পরিমাণ কোনো  ভাবেই দশ দিরহামের কম হবে না। এই সম্পর্কে একটি হাদিসে এসেছে, ১০ দিরহামের কম কোনো মোহর নেই (বায়হাকি শরিফ, ৭/২৪০)”

এখানে ১০ দিরহাম সমান  ৩০.৬১৮ গ্রাম রুপা অথবা এর সমপরিমাণ মূল্য। এর চেয়ে কম পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করা স্ত্রী রাজি হলেও তা শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ হবে না। এক্ষেত্রে অনেকে ফাতেমি দেনমোহরকে নূন্যতম দেনমোহর বিবেচনা করে। যার পরিমাণ হচ্ছে ৫০০ দিরহাম বা ১৫৩০.৯ গ্রাম রূপা। এই পরিমাণ দেনমোহরের মাধ্যমে হজরত ফাতেমা (রা.) এর বিয়ে হয়েছিল। (জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া, ৪/৩৫০)

আমরা পবিত্র কুরআন থেকেই আগেই জেনেছি যে, দেনমোহর হচ্ছে একজন স্বামী খুশিমনে তাঁর স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করে যা দিতে পারেন, কিংবা যতবেশী দিতে পারেন। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ কোনো সীমারেখা ইসলামে নেই। তবে আমাদের দেশে অনেকে খুশিমনে দেনমোহর নির্ধারণ (যদিও তা নগদে পরিশোধ করে না) করলেও অধিকাংশেরও বেশি বিয়েতে কনে পক্ষের (যৌক্তিক কিংবা অযৌক্তিক) দাবিকেই মেনে নেওয়া হয়। যদিও তা নগদে কখনোই পরিশোধ করা বা আদায় করা হয়না। 

তাই বিয়ের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের মুরুব্বী কিংবা অভিভাবকরা স্ত্রীর পিতার পরিবারের অন্যান্য মহিলা সদস্যদের ক্ষেত্রে যেমন মেয়ের বোন, ফুফু, খালা, ইত্যাদির দেনমোহরের অনুপাতে নির্ধারণ করে থাকেন। আবার ছেলের পক্ষেরও ছেলের অন্যান্য ভাইদের স্ত্রীদের কত দেনমোহর দিয়েছে সেটাকেও বিবেচনা করে।

আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলের বিয়ে গুলোতে অনেক সময় কাগজপত্র বা সরাসরি কাবিন করা হয় না। এক্ষেত্রে কোন কারণে বিয়ের সময় দেনমোহর ঠিক করা থাকে না বা যথাযথ হয়ে থাকে না। যদিও শরিয়তের দৃষ্টিতে এটা অবৈধ তবে প্রচলিত আইনে দেনমোহর নির্দিষ্ট করা না থাকলে, কোনো কারণে সেই বিয়ে ভেঙে গেলে আদালত একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ দেনমোহরের অর্থ নির্ধারণ করতে পারেন।

দেনমোহরের বর্তমান প্রেক্ষাপট 

দেনমোহর কিংবা মোহরানা নিয়ে আমাদের বর্তমান সমাজে যা চলছে তা খুবই জঘন্য এবং নিকৃষ্টতম কাজ। যার সাথে প্রকৃত ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। এই দেনমোহরকে পুঁজি করে আমাদের সমাজে একধরনের অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছে। এরফলে যে দেনমোহর নির্ভর ছিলো স্বামীর সন্তুষ্টি এবং সামর্থ্যের উপর। এখন সেই দেনমোহরের হিসাব চলে গেছে সামাজিক স্ট্যাটাসের উপর।

এখনকার বিয়ে গুলোতে দেনমোহরের হিসাব বরের সামর্থ্য কিংবা ইসলামিক ভিত্তির উপর নেই। বরং তা অইসলামিক ভিত্তি এবং অনৈতিক কার্যকলাপে রুপান্তর নিয়েছে। ফলে এই দেনমোহর আর আদায়ের বিষয়ে নেই, বরং লোকদেখানো ও ভণ্ডামিতে পরিণত হয়েছে। দেনমোহর এখন প্রতিযোগিতায় পরিনত হয়েছে। কে কার থেকে বেশি দেনমোহর দিতে পারে (আদায় নয়) কিংবা কার মেয়ে কতবেশী দেনমোহরে বিয়ে হয়েছে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

একারণে দিনদিন সামাজিক এবং ইসলামিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার পাশাপাশি ধর্মীয় এবং নৈতিক অবক্ষয়ও দেখা দিচ্ছে।  মুসলিম বিয়ে গুলোতে গণহারে অতিরিক্ত দেনমোহরের কারণে বিভিন্ন সামাজিক এবং ধর্মীয় বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে।

অতিরিক্ত দেনমোহরের কারণ

আমাদের দেশে অতিরিক্ত দেনমোহর ধরার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। যদিও এই বিষয়টা পাত্রপক্ষ নির্ধারণ করার কথা। তবুও কনের পরিবারের পক্ষ থেকে সবসময়ই চেষ্টা করা হয় অতিরিক্ত দেনমোহর ধরার। আর এর প্রধান কারণ হচ্ছে, বিবাহ বিচ্ছেদ বা ডিভোর্স ঠেকানো। 

অর্থাৎ যতবেশী দেনমোহর ধরা যাবে স্বামী ততবেশী ডিভোর্স দিতে ভয় পাবে। কিংবা স্ত্রী হাজার অপরাধ করলেও দেনমোহরের টাকা আদায় করার অপারগতার কারণে স্বামী সহজে স্ত্রীকে ডিভোর্স দিবে না। একইসাথে কোনো কারণে ডিভোর্স হয়ে গেলেও যেন, কনেপক্ষ ভালো একটি ক্ষতিপূরণ পায়।

এইজাতীয় ভবিষ্যৎ চিন্তা থেকেই বর্তমান সমাজের বিয়ে গুলোতে অতিরিক্ত দেনমোহর ধরা হচ্ছে। যদিও অতিরিক্ত দেনমোহর কখনোই একটি অশান্তির সংসারকে টিকিয়ে রাখতে পারে না। 

এছাড়াও অতিরিক্ত দেনমোহরের কারণ হচ্ছে সামাজিক স্ট্যাটাস। অর্থাৎ মানুষের কাছে জাহির করার জন্যও অনেক স্বামী  স্বেচ্ছায় এবং কনেপক্ষ জোরপূর্বক অতিরিক্ত দেনমোহর নিয়ে থাকেন। যদিও এই দেনমোহর আদায়ের বা উসুলের কোনো পক্ষকেই তৎপর দেখা যায় না। শুধু সামাজিকতা রক্ষার জন্যই অতিরিক্ত দেনমোহর ধরা হয়। 

অতিরিক্ত দেনমোহরের কুফল

আমাদের সমাজে আজ অতিরিক্ত দেনমোহরের ছড়াছড়ি। আর এই মাত্রাতিরক্ত দেনমোহরের কারণেই অসংখ্য সংসার বর্তমানে হুমকির মুখে রয়েছে। এরফলে সমাজে নানাবিধ সমস্যার দেখা দিয়েছে। যেমন: 

বিয়েতে কনে পক্ষের বাড়তি খরচ

যখন কনেপক্ষ অতিরিক্ত দেনমোহর দাবি করে, তখন তাদের দাবি মেনে নিয়ে বরপক্ষও নানান অজুহাতে কনেপক্ষ থেকে বিভিন্ন বিষয়ের উপর চাপ প্রয়োগ করে। বিশেষকরে খাওয়া দাওয়া নিয়ে বেশ চাপে রাখে বরপক্ষ। এক্ষেত্রে তারা অতিরিক্ত বরযাত্রীর দাবি করে। ফলে কনেপক্ষকে নিজেদের সাধ্যে না থাকলেও অনেক মানুষের খানাপিনার আয়োজন করতে হয়।  এছাড়াও প্রথম দু চার বছর কনেপক্ষ থেকে বরপক্ষকে বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয়  দিবস উপলক্ষে নানান কিছু বাধ্যতামূলক দিতে হয়। এইসব খরচ সামলাতেও কনেপক্ষকে অনেক খরচাপাতি করতে হয়।  

যৌতুকের প্রচলন 

অতিরিক্ত দেনমোহরের সবচেয়ে খারাপ দিক হলো বরপক্ষকে যৌতুক দেওয়া। যখন বরপক্ষ কনেপক্ষের দাবি মেনে অতিরিক্ত দেনমোহর দিতে রাজি হয়, তখন বরপক্ষ কনেপক্ষ থেকে যাবতীয় যৌতুক দাবি করে বসে। কনেপক্ষেও তাদের দাবি মেটাতে গিয়ে ব্যাপক যৌতুকের ব্যবস্থা করে। আর এইভাবে যৌতুক দিতে গিয়ে দেখা যায় যে, দেনমোহরের টাকার চাইতে কনেপক্ষের খরচ আরও বেশি হয়ে যায়। যা আমরা সাধারণ মানুষেরা কখনোই চিন্তা করি না।

বিয়ে করতে না পারা

অতিরিক্ত দেনমোহরের কারণে সমাজের বিয়ে উপযুক্ত ছেলেরা সহজে বিয়ে করতে পারছে না। কেননা আমাদের সমাজে খুব কম মানুষেরই সামর্থ্য আছে অতিরিক্ত দেনমোহর দেওয়ার। তাই যারা মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, তারা সহজেই বিয়ে করতে পারে না কিংবা সাহস করে না। এরফলে সমাজে যুবক শ্রেণিদের মধ্যে নানান হতাশা ছড়িয়ে পড়ছে।

নৈতিক অবক্ষয়

অতিরিক্ত দেনমোহরের কারণে দিনদিন আমাদের সমাজে নৈতিক অবক্ষয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। আর এই অবক্ষয়ের মাধ্যমে সমাজে পরকীয়া বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুবক ছেলেরা বিয়ে করতে না পারার কারণে পাড়ার কিংবা আত্মীয়স্বজনের স্ত্রীদের সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত হচ্ছে ফ্রিস্টাইলে। আর এতে নারী পুরুষ উভয়েরই নৈতিক অবক্ষয় হচ্ছে।

অশ্লীলতা বৃদ্ধি

অতিরিক্ত দেনমোহর দিতে না পারার কারণে যুবক ছেলেরা বিয়ে করতে পারছে না। ফলে তারা তাদের যৌবন অতিবাহিত করার জন্য বিভিন্ন পতিতালয় কিংবা হোটেল রাত্রিযাপন করছে। এছাড়াও অধিকাংশ ছেলে মেয়ে বিয়ে করার নামে প্রেম করে প্রেমিকার সাথে অশ্লীলতায় মেতে আছে। শুধু তাইনয়, সরকারি আইনে নারীদের ১৮ বছরের নীচে বিয়ে না হওয়ার কারণে ছেলেমেয়েরা অবাধে বিভিন্ন পার্ক এবং পর্যটন কেন্দ্রে মেলামেশা করছে। এইসব বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক আজ গুলো সমাজ এবং রাষ্ট্রের  জন্য অশ্লীলতা বয়ে আনছে।  

বিয়ে করতে নিস্পৃহা 

অতিরিক্ত দেনমোহর একজন পুরুষকে অর্থনৈতিক, সামাজিক, শারিরীক এবং নৈতিকভাবে পঙ্গু করে ফেলে। এরফলে কোনো যুবক আর বিয়ে করতে আগ্রহী হয়ে উঠে না। কেননা বিয়ে করতে গেলেই অনেক খরচের ধাক্কা সামলাতে হয়। যা আমাদের সমাজের মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্ত ছেলেদের দ্বারা  সম্ভব হয়ে উঠে না। তাই তারা বিয়েতে দিনদিন অনাগ্রহী হয়ে উঠে। 

নারীদের স্বেচ্ছাচারিতা বৃদ্ধি

অতিরিক্ত দেনমোহরের কারণে দিনদিন  নারীদের একটি শ্রেণির মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এইসব উশৃঙ্খল নারী শ্রেণি আজ সমাজ কিংবা ধর্মীয় কোনো বাঁধাকেই তোয়াক্কা করে না। এরা সংসার করার চাইতে সংসারে আগুন লাগাতে ব্যস্ত থাকে। এরা বিভিন্ন ছোটখাটো বিষয় নিয়ে সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করে স্বামীকে পরিবার থেকে আলাদা করে ফেলে। অন্যথায় পরিবারে নানান অশান্তি সৃষ্টি করে নিজের জিদ বজায় রাখে।

আর এইসব নারীদের মূল শক্তি হচ্ছে অতিরিক্ত দেনমোহর। যদি স্ত্রীর অত্যাচারে কিংবা যেকোনো অজুহাতে স্বামী সংসার করতে না চাইলে স্ত্রীকে অবশ্যই মোটা অংকের ক্ষতিপূরণসহ দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করতে হবে। যা অধিকাংশের বেশি স্বামীর পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভব হয় না। ফলে স্বামীসহ পুরো পরিবার পরবর্তীতে  ডিভোর্স দিতে চাইলেও টাকার জন্য দিতে পারে না। 

সহজ দেনমোহর রাসূলের সুন্নাহ

দেনমোহর সহজের মাধ্যমে বিয়েকে সহজতর করা রাসূলের সুন্নাহ। আল্লাহর রাসূল সা. বলেন, –“সে নারী বরকতের মাঝে আছে যাকে প্রস্তাব দেয়া সহজ ও যার দেনমোহর অল্প” (মুসনাদে আহমাদ; হাসান সানাদে)

অর্থাৎ ঐ নারীর প্রতি আল্লাহ বরকত নাযিল করেন, যাকে সহজে প্রস্তাব দিয়ে বিয়ে করা যায় এবং সচারচর সাধারণ মানের দেনমোহরের মাধ্যমে বিয়ে করা যায়। যদি এমনটা হয় তাহলে অবশ্যই ঐ পরিবারে বরকত নাযিল হবে। 

বিয়েতে বরকত হওয়া সম্পর্কে আরেকটি হাদিস উম্মাহাতুল মুমিনীন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “সবচেয়ে বরকতময় বিয়ে হচ্ছে সুন্নতি বিয়ে, অর্থাৎ যে বিয়েতে খরচ কম হয় এবং কোনো জাঁকজমক থাকে না।”-মিশকাত শরিফ

অর্থাৎ যে বিয়েতে যাবতীয় খরচ কম হবে, সেই বিয়ে হবে সবচেয়ে বরকতপূর্ণ বিয়ে। এক্ষেত্রে দেনমোহরের টাকাটাও একটি মূখ্য বিষয়। কেননা বর্তমানে অতিরিক্ত দেনমোহরের টাকার কারণে বিয়ের আনুষাঙ্গিক খরচও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এছাড়াও আমরা সাহাবীদের জীবনী থেকে এমন দৃষ্টান্তও পাই যে, তাঁরা শুধু কুরআন শিক্ষার বিনিময়েও বিয়ের দেনমোহর নির্ধারণ করেছিলেন। 

এছাড়াও আমরা হজরত উমর (রা.) এর খেলাফতকালের দিকে তাকালে দেখতে পাই যে, বিভিন্ন কারণে তখন মুসলমানদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসে। এরফলে সাহাবারা (রা.) তাদের সন্তানদের বিয়েতে দেনমোহরে ফাতেমির চেয়ে অনেক গুণ বেশি দেনমোহর দেওয়া  শুরু করেন। এটা দেখে হজরত উমর (রা.) সংকিত হন। তাই তিনি অতিরিক্ত  দেনমোহরের  গতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন। কেননা সবাই যদি অহেতুক এভাবে অতিরিক্ত দেনমোহর দেওয়া শুরু করে, তাহলে গরিব মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা বেকায়দায় পড়ে যাবে। সমাজে একধরনের বিভেদ সৃষ্টি হতে পারে। তাই হঠাৎ করে এত বেশি পরিমান দেনমহর দেওয়ার পক্ষে তিনি ছিলেন না। কিন্তু সুরা নিসার ৪ নম্বর আয়াত এর কারনে তিনি তা পারেননি। অথচ তখনকার সময়ে অতিরিক্ত  দেনমোহর দেওয়া ছিলো শরিয়ত সম্মত স্বামীর খুশিতে। একইসাথে তখনকার দেনমোহর নির্ধারণের সাথে সাথে আদায়ও করা হতো। 

কিন্তু বর্তমান সময়ে যেভাবে অতিরিক্ত দেনমোহর নির্ধারণ করা হচ্ছে, এটা কখনোই স্বামীর সন্তুষ্টি নিয়ে নয়। বরং জোরজবরদস্তিমূলক। ফলে বর্তমান দেনমোহর মোটেই আদায় করা হচ্ছে না। তাই কুরআনের আলোকে বেশি দেনমোহর নির্ধারণের সুযোগ থাকলেও, কুরআনের আইন অনুযায়ী কোথাও তা আদায় করা হচ্ছে না। এটা শরিয়ত নিয়ে একধরনের ভন্ডামির নামান্তর তথা মুনাফিকী। কারণ বর্তমানে দেনমোহর শুধু কাগজপত্রে ধার্য করা হচ্ছে। ব্যাপারটা এমন যে, দেনমোহর ধার্য করা হলো, স্ত্রী সেটা গ্রহণ করবে না, স্বামীকে কখনো পরিশোধ করতেও হবে না। সুতরাং এইসব জোচ্চুরি বাদ দিয়ে আমাদের প্রকৃত মুসলমান হতে হলে, অবশ্যই যৌক্তিক দেনমোহর ধার্য করতে হবে। একইসাথে তা তৎক্ষণাৎ আদায়ও করতে হবে। কোনোধরনের ছলছাতুরি ইসলামে কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। 

অতিরিক্ত দেনমোহর ইসলাম ধর্মের অংশ নয়

আমাদের বিয়ে গুলোতে যে ব্যবস্থায় দেনমোহর আদায় করা ছাড়া ধরা হচ্ছে তা খুবই নিকৃষ্ট একটি কাজ। অথচ সাহাবীগণ উচ্চমূল্য দেনমোহর ধার্য করে আদায় করার পরও উমর (রা.) তা অপছন্দ করতেন। এক‌টি হাদিসে এসেছে, যা আবুল আজফা (রহ.) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেছেন, সাবধান! তোমরা নারীদের  মোহরানা  উচ্চহারে বাড়িয়ে দিও না। কেননা, তা দুনিয়াতে যদি সম্মানের বস্তু অথবা আল্লাহ্ তা’আলার নিকট তাকওয়ার বস্তু হত তবে এ ব্যাপারে আল্লাহর নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তোমাদের চেয়ে বেশি উদ্যোগী হতেন। কিন্তু বার উকিয়ার বেশি পরিমাণ মোহরে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার কোন স্ত্রীকে বিয়ে করেছেন অথবা তার কোন কন্যাকে বিয়ে দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। সহীহ, ইবনু মা-জাহ (১৮৮৭)

এই হাদিস থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, অতিরিক্ত দেনমোহর কখনোই আল্লাহর কাছে তাকওয়ার বিষয় নয়। কেননা এটাতে কোনো কল্যাণ থাকলে তা আমাদের রাসূল সা.ই এই কাজে এগিয়ে থাকতেন। তারমানে এটা নয় যে, অতিরিক্ত দেনমোহর দেওয়া যাবে না।

তবে আমাদের দেশে যে সংস্কৃতি আজকাল সৃষ্টি হয়েছে, আদায় করা ছাড়া অতিরিক্ত দেনমোহর দেওয়া, এটার কথাই উমার (রা.) ইঙ্গিত করেছিলেন। আজকাল আমরা দেনমোহরের নামে যা করছি তাতে ইসলামের কোনো অংশ নেই বরং ধর্মের সুযোগকে দুনিয়াবী হাতিয়ার বানিয়ে নিয়েছি। যা একধরনের মুনাফিকী। কেননা আমরা দেনমোহরের ওয়াদা করছি, অথচ আদায় করছি কিংবা আদায় করার নিয়তও নেই। যা সরাসরি ওয়াদার বরখেলাফ। 

দেনমোহর স্ত্রীর অধিকার

দেনমোহর মুসলিম নারীদের একটি অধিকার। আল্লাহ বলেন, “এদেরকে ছাড়া তোমাদের জন্যে সব নারী হালাল করা হয়েছে, শর্ত এই যে, তোমরা তাদেরকে স্বীয় অর্থের বিনিময়ে তলব করবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য-ব্যভিচারের জন্য নয়। অনন্তর তাদের মধ্যে যাকে তোমরা ভোগ করবে, তাকে তার নির্ধারিত হক দান কর। তোমাদের কোন গোনাহ হবে না যদি নির্ধারণের পর তোমরা পরস্পরে সম্মত হও। নিশ্চয় আল্লাহ সুবিজ্ঞ, রহস্যবিদ। (সুরা: আন নিসা, আয়াত: ২৪)”

অর্থাৎ আল্লাহ পবিত্র কুরআনে স্ত্রীদের দেনমোহরকে তাদের সুস্পষ্ট হক বা অধিকার বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু আমাদের বর্তমান সমাজে বিভিন্ন সামাজিক সীমাবদ্ধ দেখিয়ে নারীদের এই হক থেকে বিচ্যুতি করা হচ্ছে। বরং অতিরিক্ত দেনমোহরের নামে কনেপক্ষ থেকে ব্যাপক খরচাপাতি করিয়ে নিচ্ছে। অথচ অতিরিক্ত দেনমোহর দিলেও আদায় না করার কারণে কনেপক্ষের লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না। বরং মেয়ে বিয়ে দিতে গিয়ে দেনমোহরের চাইতে বেশি খরচ  করতে হচ্ছে। তাই বিয়েতে অবশ্যই যৌক্তিক দেনমোহর আদায়ের পাশাপাশি যৌতুক বন্ধ হওয়া উচিত। আর এটা নারীদের একটি ধর্মীয় অধিকার।

শেষকথা

অতিরিক্ত দেনমোহর আজ আমাদের সমাজকে একটি ধ্বংসের পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। এতে গরিব মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই আসুন অতিরিক্ত দেনমোহর নির্ধারণ বন্ধ করে, যৌক্তিক দেনমোহর আদায়ের চেষ্টা করি। আর এভাবেই আমরা সঠিক ভাবে ইসলাম ধর্ম পালন করার চেষ্টা করি।