০৮:০৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

জৈবিক ঘড়ি—মোরগের বাঁকে ঘুম যখন ভাঙল

প্রফেসর ড. রাশিদুল হক
  • প্রকাশ: ০১:১৫:০২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৪ অগাস্ট ২০২৩
  • / ৭৪৭ বার পড়া হয়েছে
সারাংশ: পৃথিবীর আহ্নিক গতির কারণে আমাদের শারীরবৃত্তীয় অনেক কার্যাবলি বাহ্যিক পরিবেশ, অর্থাৎ আলো বা তাপমাত্রার পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হয়েছে ছন্দময়, যেমন, ঘুম-জাগরণ, জ্ঞানীয় কর্মক্ষমতা, বিপাক ও হজম প্রক্রিয়া, রেচন, রক্তচাপ, শ্বসন, যৌন উত্তেজনা, প্রজনন, হরমোন উৎপাদন, স্নায়বিক কার্যাবলি ইত্যাদি, যার প্রতিটি নিজ নিজ ছন্দে জৈবিক ঘড়ি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। শারীরবৃত্তীয় কোনো প্রক্রিয়া সূর্যের আলোয় সক্রিয় হয়, আবার কোনোটি সক্রিয় নিরালোকে, এমনকি গভীর রাতেও। দিন-রাতের এই জৈবিক ছন্দকে বলা হয় “সির্কাডিয়ান ছন্দ (circadian rhythm)”। পুরো দেহ জুড়েই বিভিন্ন টিস্যুর প্রতিটি কোষে রয়েছে আপন ক্লক যেগুলোকে বলা হয় দেহের পার্শ্বীয় (peripheral) ক্লক, যাদের নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের হাইপোথালামাসের সুপ্রাকায়াজম্যাটিক নিউক্লিয়াসে (SCN) অবস্থিত একটি মাস্টার ক্লক বা দেহের কেন্দ্রীয় ঘড়ি।

মূলশব্দসমূহ: জৈবিক ঘড়ি, দেহঘড়ি, সির্কাডিয়ান ছন্দ, মেলাটোনিন, ক্লক জিন, জেট ল্যাগ, মস্তিষ্ক।

সূর্যোদয়ের আগেই ভোরের বার্তা নিয়ে আসে “কুক্কুড়ু কু” ডাক। আমাদের ঘুম ভাঙায় মোরগের “জৈবিক-ঘড়ি” বা বায়োলজিক্যাল ক্লক। শুধু মোরগ কেন, জগতের সমস্ত প্রাণী প্রাকৃতিক এই অ্যালার্মে জেগে উঠে সূর্যের আলোর অবলোকনে। আর, বিজ্ঞান বলে সূর্যের কিরণ যখন আমাদের বন্ধ চোখের পাতাভেদ করে ঢুকে পড়ে, তখন সেটি মস্তিষ্ককে কর্টিসল (CORTISOL) হরমোন ছড়িয়ে দিতে উদ্দীপিত করে। ফলে আমরা জেগে উঠি। তাই কী পরিমাণ কর্টিসল হরমোন দেহে ক্ষরিত হয় তার ওপর নির্ভর করে দিনটি কেমন যাবে। কর্টিসলের সংশ্লেষণ এবং নিঃসরণ হাইপোথ্যালামিক-পিটুইটারি-অ্যাড্রিনাল অক্ষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কর্টিসল একটি সঠিক ২৪-ঘণ্টা দিবানিশি ছন্দ প্রদর্শন করে। জেগে ওঠার পরে কর্টিসলের শিখর-নিঃসরণ ঘুম-জাগরণ এবং আলো-অন্ধকার উভয় চক্রের সাথে দেহকে ছন্দবদ্ধ পদ্ধতিতে সমন্বয় করতে একটি নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করে। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, আমার এই নিবন্ধে জিন ও প্রোটিনগুলি ইংরেজিতে লিখা হয়েছে যথাক্রমে ছোটো বর্ণ ও বড়ো বর্ণে।

পৃথিবীর আহ্নিক গতি (নিজ অক্ষের উপর ২৪-ঘণ্টায় আবর্তন)-র কারণে আমাদের অনেক শারীরবৃত্তীয় কার্যাবলি বাহ্যিক পরিবেশ, অর্থাৎ আলো বা তাপমাত্রার পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হয়েছে ছন্দময়, যেমন, ঘুম-জাগরণ, জ্ঞানীয় কর্মক্ষমতা, বিপাক ও হজম প্রক্রিয়া, রেচন, রক্তচাপ, শ্বসন, যৌন উত্তেজনা, প্রজনন, হরমোন উৎপাদন, স্নায়বিক কার্যাবলি ইত্যাদি, যার প্রতিটি নিজ নিজ ছন্দে জৈবিক ঘড়ি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত—দিবা-রাত্রির এই জৈবিক ছন্দকে বলা হয় “সির্কাডিয়ান ছন্দ (circadian rhythm)”। পুরো দেহ জুড়েই বিভিন্ন টিস্যুর প্রতিটি কোষে রয়েছে নিজস্বী ক্লক যেগুলোকে বলা হয় দেহের পার্শ্বীয় (peripheral) ক্লক, যাদের নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের হাইপোথালামাসের সুপ্রাকায়াজম্যাটিক নিউক্লিয়াসে (SCN) অবস্থিত এক মাস্টার ক্লক বা দেহের কেন্দ্রীয় ঘড়ি। পার্শ্বীয় ক্লকগুলোকে অনেক বিশেষজ্ঞ বলে থাকেন মাস্টার ক্লকের দাস। তা অনেকটা বটে, কারণ মাস্টার ক্লকের নির্দেশ ছাড়া পার্শ্বীয় ক্লক বেশি দিন সক্রিয় থাকতে পারে না। SCN অঞ্চলটিতে মাত্র ২০ হাজার স্নায়ুকোষ থাকে যেগুলো মাস্টার ক্লক-ও ধারণ করে। SCN এর অনেক ধরনের কাজের মধ্যে তার অন্যতম একটি কাজ হলো জৈবছন্দ নিয়ন্ত্রণ করা, এবং এই ছন্দ ব্যাকটেরিয়া থেকে মানুষ পর্যন্ত সবার মাঝেই একটি গুর্রুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া।

প্রত্যুষে মোরগের ডাক কি অভ্যাসগত?

প্রত্যুষে মোরগের ডাক অভ্যাসগত নয়, এটি জিনগত- এ কথাটি জানালেন জাপানের নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিজ্ঞানী তাকাশি ইয়োশিমুরা। বিজ্ঞানীমহলে হিড়িক পড়ে গেলো সেই “ঊষা-জিন”টি আবিষ্কারের। পাওয়াও গেলো সেই অজানা জিনটি, নাম দেয়া হলো “পিরিয়ড (Period, Per)”। জিনটি প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন মার্কিন বিজ্ঞানী সিমোর বেঞ্জার (Seymour Benzer) ড্রোসোফিলা (ফলের মাছি)-র X-ক্রোমোজোমে, ১৯৭১ সালে। স্তন্যপায়ী প্রাণিদের Per পরিবারে তিনটি জিন রয়েছে: Per1, Per2, Per3। দেখা গেলো, Per জিনের সংশ্লিষ্ট প্রোটিন PER একা কাজ করতে পারে না, তাকে সক্রিয় হতে হলে তার একজন পার্টনার দরকার। সেই জিনটিও খুঁজে পাওয়া গেলো, নাম তার “ক্রিপ্টোক্রম (Cryptochrome, Cry), আবিষ্কার করলেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চার্লস উইজ (Charles Weitz) ও তার গবেষক দল। মাইকেল রসব্যাশ ১৯৮৪ সালে Per জিনটি ক্লোন ক’রে জৈবিক ঘড়ি-সম্পর্কিত বিষয়টি আরও এগিয়ে নিয়ে গেলেন এবং আবিষ্কার করলেন ড্রোসোফিলায় আরও একটি ক্লক-জিন, নাম তার “Cycle”, স্তন্যপায়ীদের যার সমকক্ষ জিন হলো Bmal1। ড্রোসোফিলায় রসব্যাশ-ই প্রথম আণবিক প্রক্রিয়ায় প্রমাণ করলেন যে এই জিনদুটি দিন-রাতে তাদের কার্যকলাপকে ছন্দময় করে তুলেছে। তাঁর এই আবিষ্কার (মাইকেল ইয়ং ও জেফ্রি হল-সহ) তাঁকে ভূষিত করলো নোবেল পুরস্কারে ২০১৭ সালে। 

প্রসঙ্গতঃ ড্রোসোফিলা জৈবিক ঘড়ির আণবিক প্রক্রিয়াতে Per ট্রান্সক্রিপ্ট (mRNA) এবং এর সংশ্লিষ্ট প্রোটিন PER গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উভয় স্তরে Per জিন ও প্রোটিনের প্রকাশ ২৪ ঘণ্টা বরাবর সির্কাডিয়ান ছন্দ বজায় রাখে, যা ইক্লোশন (কীট-পতঙ্গদের ডিম অথবা পিউপা থেকে বের হবার সময়) এবং নড়াচড়া কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে- যেমন, প্রজাপতির ইক্লোশন সময় প্রায়শঃ ভোর বেলায়, কিন্তু মশা পিউপা থেকে বের হয় রাত্রিতে। প্রসঙ্গত, BMAL1-এর পার্টনার CLOCK প্রোটিনের জিনটি (এটি একটি স্বতন্ত্র জিন/প্রোটিন) প্রথম শনাক্ত ও ক্লোন করেন টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপানি বংশোদ্ভূত জোসেফ তাকাহাশি। BMAL1-CLOCK-জুটি জীবের প্রায় প্রতিটি কোষেই একটি পজিটিভ রেগুলেটের হিসেবে কাজ করে। এর ব্যতিক্রম দেখা দিলো মোরগের রেটিনার ফটোরিসেপ্টর কোষগুলোতে, যেখানে CLOCK-এর পরিবর্তে BMAL1-এর যুগলবন্দী হয় NPAS2, আবিষ্কৃত হলো আরও একটি ক্লক প্রোটিন (পড়ুন: Haque R et al., J Neurochem. 2010)। PER-CRY যুগলের প্রধান কাজই হলো প্রত্যুষ এবং দিনের জিনগুলোকে জাগিয়ে তোলা, অর্থাৎ উদ্দীপ্ত করা (যেমন টেস্টোস্টেরোন, অ্যাসিটিলকোলিন, cFos, cJun ইন্সুলিন ও ইন্সুলিন রিসেপ্টর, গ্লুকোজ বিপাকীয় এনজাইম), এবং রাতে প্রকাশিত জিনগুলি (যেমন মেলাটোনিন, HMG-CoA রিডাকটেজ, গ্লুকাগন, গ্লুকোনিওজেনেসিস-সম্পর্কিত জিন)-র অভিব্যক্তি স্তিমিত করা। ATP (অ্যাডিনোসাইট ট্রাইফসফেট) শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয় জীবিত কোষের প্রায় প্রতিটি জৈবিক প্রক্রিয়ায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেগুলোর ব্যাপক ব্যবহার দিনের বেলায়। তাই, তার সংশ্লেষণ (এটিপি সিন্থেজ দ্বারা) শিখরে ওঠে শেষ রাতে, ঠিক সূর্যোদয়ের পূর্বমুহূর্তে, যেন সেগুলোর পূর্ণমাত্রায় সরবরাহ থাকে দিনের কার্যক্রমে।  

জৈবিক ঘড়ির জিনগত কাঠামো

দেহের মাস্টার ক্লক ও পার্শ্বীয় ক্লক উভয়ই একটি নির্দিষ্ট জীনগত বৈশিষ্ট্য দ্বারা পরিচালিত, যার মুলে রয়েছে চারটি জিন, যা ঘড়ি-গুলোর একটি “নেগেটিভ ফিডব্যাক লুপ” তৈরি করে (দেখুন ছবি১)। মানুষসহ মেরুদন্ডী প্রাণিদের জৈবিক ঘড়ির জিনগত মৌলিক উপাদান হচ্ছে: Period (Per1/2/3) ও Cryptochrome (Cry1/Cry2) এবং  Bmal1 ও Clock জিন। এগুলোকে ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টরও বলা হয়। সির্কাডিয়ান জৈবিক ঘড়ির মূল ট্রান্সক্রিপশন কমপ্লেক্সটি, যা দেহের প্রায় ৩০% জিনের প্রকাশকে সূর্যালোকের উপর ভিত্তি করে নিয়ন্ত্রণ করে, অর্থাৎ কোনো জিন বেশি প্রকাশ পায় দিনে, কোনোটি রাতে। একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, জৈবিক ঘড়ি-নিয়ন্ত্রিত জিনগুলোর সর্ব্বোচ প্রকাশ পায় ফুসফুসে (২৪১৮টি জিন), হৃৎপিণ্ডের বাম নিলয়ে (২২০২টি জিন) এবং রক্ত-প্লাজমায় (১৯০০টি জিন)। 

সূর্যোদয়ের আগেই ভোরের বার্তা নিয়ে আসে “কুক্কুড়ু কু” ডাক। আমাদের ঘুম ভাঙায় মোরগের “জৈবিক-ঘড়ি” বা বায়োলজিক্যাল ক্লক।

সারাদিন উৎফুল্ল থাকার নিয়ামক হচ্ছে প্রোটিনযুগল PER ও CRY। দিনের আলোয়, PER ও CRY প্রোটিন-দুটি জুটি বেঁধে (হেটারোডাইমার) ঘড়ি-নিয়ন্ত্রিত দিনের জিনগুলিকে প্রকাশ করে এবং BMAL1 ও CLOCK (অথবা BMAL1:NPAS2) হেটারোডাইমার স্বচ্ছ অন্ধকার বা গভীর রাতের জিনগুলির প্রকাশ নিয়ন্ত্রণ করে। রাতে সংশ্লেষিত প্রোটিন বা হরমোনগুলোর অন্যতম হলো মেলাটোনিন, একটি ঘুমের হরমোন, যা সংশ্লেষিত ও ক্ষরিত হয় মস্তিষ্কে অবস্থিত পাইনিল (pineal) গ্রন্থি থেকে। এছাড়া, চোখের রেটিনা থেকেও সংশ্লেষিত হয় মেলাটোনিন। মেলাটোনিন সরাসরি কোনো জিন থেকে নির্দেশপ্রাপ্ত নয়। বরং, মেলাটোনিন সংশ্লেষণকে ছন্দময় করতে যে জিনটি মূলত দায়ী সেটি হলো N-অ্যাসিটিলট্রান্সফারেজ (Arylalkyl N-acetyltransferase, Aanat), যার দিন-রাত্রির অভিব্যক্তির তারতম্য নিয়ন্ত্রণ করে জৈবিক ঘড়ি (দেখুন ছবি২)। এই AANAT-প্রোটিনটির কার্যক্ষমতা দিনের থেকে ১০ থেকে ১০০ গুণ বেশি রাতে (অন্ধকার অবস্থায়), বলা যায় গভীর রাতে। এই জিন বা প্রোটিনটির কারণেই মানুষ বিভোর থাকে ঘুমের রাজ্যে। বিপরীতে, এই জিনটির মিউটেশন ঘটে গেলে রাতের ঘুম কেড়ে নিয়ে যায়, যা ইনসোমনিয়া ও বিলম্বিত ঘুমের ফেজ ডিসঅর্ডারের প্রধান একটি কারণ।

সূর্যোদয়ের আগেই ভোরের বার্তা নিয়ে আসে “কুক্কুড়ু কু” ডাক। আমাদের ঘুম ভাঙায় মোরগের “জৈবিক-ঘড়ি” বা বায়োলজিক্যাল ক্লক।

Aanat-জিনসহ জৈবিক ঘড়ি নিয়ন্ত্রিত জিনগুলির প্রোমোটর (promoter) অঞ্চলে রয়েছে বেশ কিছু খন্ড-খন্ড নির্দিষ্ট সিকোয়েন্স যাকে বলা হয় এনহ্যানসার (enhancer), যা জিনের অভিব্যক্তিকে অতিমাত্রায় বৃদ্ধি করে। এ রকম একটি ডিএনএ ক্রম হচ্ছে E-box (CACGTG), যেখানে যুক্ত হয় যুগল ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর PER-CRY (দিনের আলোয়) এবং BMAL1-CLOCK (নিরালোকে)। REV-ERBα ও RORα (retinoic acid orphan receptor alpha) এই দুটি পৃথক জিন বা প্রোটিনও জৈবিক ঘড়ির অংশ হিসেবে বিবেচিত; তবে,, ঘড়ির মূল কমপ্লেক্সের অংশ হিসেবে নয়, বরং ক্লক সিস্টেমের একটি  সাব-লুপ (sub-loop) হিসেবে কাজ করে এবং নিয়ন্ত্রণ করে Bmal1 ও Clock জিনের অভিব্যক্তি (দেখুন ছবি১)। REV-ERB হলো ঊষার প্রোটিন, সে বাধা দেয় Bmal1-এর প্রকাশকে, কিন্তু Bmal1 পুনরায় সক্রিয় হয় গোধূলি বেলায় ROR প্রোটিন দ্বারা। REV-ERB এবং ROR দুটোই হলো নিউক্লীয় রিসেপ্টর ও ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর। এছাড়া, ডিএনএ-তে আরও একটি নিত্য-ব্যবহৃত এনহ্যান্সার ক্রম হচ্ছে CRE (TGACGTCA), যার সঙ্গে যুক্ত হয় একটি ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর CREB (cAMP-রেস্পন্সিভ বাইন্ডিং প্রোটিন), যা মস্তিষ্কে (হিপ্পোক্যাম্পাস এবং অ্যামিগডালা অঞ্চলে) স্মৃতি-গঠন এবং জ্ঞানীয় কর্মক্ষমতার দিবারাত্রি ছন্দ পরিচালনা করে। শেষোক্ত দুটি প্রক্রিয়া সাধারণত দিনের প্রথমার্ধে সর্বোচ্চ হয়। সে কারণেই, অ্যাসিটিলকোলিনের মত স্মৃতিধারক প্রোটিনগুলি সর্বাধিক পাওয়া যায় ভোর বেলায়।

জৈবিক ঘড়ির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে—আলোর দ্বারা ঘড়িটি সমন্বিত হয়ে গেলে, মেঘলা দিনে বা কোনো বাহ্যিক সংকেত ছাড়াই, ধ্রুবক অন্ধকারেও ২/৩ দিন শারীরবৃত্তীয় কার্যাদির ছন্দ মুক্ত-চলমান (free running) থাকতে পারে, অর্থাৎ তারা আগের মতই দিবা-রাত্রির দোলন বজায় রাখতে পারে।

পাইনিল গ্রন্থি, মেলাটোনিন ও ঘুম

মেলাটোনিন হরমোনের নাম আমাদের অনেকেরই জানা। এটি ট্রিপটোফ্যান-সেরোটোনিন-উৎপন্ন নিশিরাতের একটি হরমোন। পূর্বেই বলেছি মস্তিষ্কের পাইনিল (pineal) গ্রন্থি থেকে মেলাটোনিন নিঃসৃত হয় এবং এটি আমাদের ঘুম-জাগরণ সির্কাডিয়ান ছন্দকে সমন্বয় করে। মস্তিষ্কের এপিথ্যালামাসে ও তৃতীয় ভেন্ট্রিকলের ঠিক পেছনে অবস্থান করে পাইনিল গ্রন্থি, যা একটি ছোট্ট একক অন্তঃস্রাবী গ্রন্থি। এটি বেশিরভাগ মেরুদণ্ডী প্রাণীর মস্তিষ্কে পাওয়া যায়। পাইনিল গ্রন্থির কোষগুলোকে বলা হয় পাইনিলোসাইট (pinealocytes)। মস্তিষ্কের অন্যান্য অঞ্চলের মত, পাইনিল গ্রন্থি রক্ত-মস্তিষ্কের প্রতিবন্ধক (blood-brain barrier) ব্যবস্থা দ্বারা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়; ফলে, পোস্টেরিয়র সেরিব্রাল ধমনী দ্বারা এটিতে প্রচুর রক্ত ​​প্রবাহ রয়েছে। পাইনিল গ্রন্থির প্রধান কাজটি হচ্ছে মেলাটোনিন সংশ্লেষণ করা এবং সেটি ক্ষরিত হয় রাত্রিকালীন (অন্ধকার বা নিরালোক) সময়ে, দিনের আলোয় তার ক্ষরণ হয় স্তিমিত। 

চোখের রেটিনার কোষগুলোতে রয়েছে ওদের আপন জৈবিক ঘড়ি। চোখের রেটিনার আলোক সংবেদনশীল গ্যাংলিয়ন (ganglion)কোষগুলো আলো শনাক্ত করে এবং এই দৃষ্টিবোধ (যা রূপান্তরিত হয় তড়িৎ-রাসায়নিক শক্তিতে) প্রেরিত হয় রেটিনোহাইপোথ্যালামিক স্নায়ু/ট্র্যাক্ট (RHT) দ্বারা হাইপোথ্যালামাসের সুপ্রাকায়াজম্যাটিক নিউক্লিয়াসে (SCN), যেখানে অবস্থান করে মাস্টার বা কেন্দ্রীয় জৈবিক ঘড়িটি। SCN সেই সংকেতগুলো দিন-রাত্রি চক্রের সাথে সমন্বয় করে। স্নায়ু তন্তুগুলি SCN থেকে সংকেত নিয়ে যায় হাইপোথ্যালামাসের প্যারাভেন্ট্রিকুলার নিউক্লিয়াস (PVN), তারপর মেরুদন্ডে (ট্রাইজেমিনাল অঞ্চল, T1/T3) এবং সমবেদী সিস্টেমের মাধ্যমে সুপিরিয়র সার্ভিকাল গ্যাংলিয়ায় (SCG), এবং সেখান থেকে অবশেষে সংকেত পৌঁছয় পাইনিল গ্রন্থিতে (দেখুন ছবি৩)। রাত্রিকালীন অন্ধকারাছন্ন পরিবেশ PVN-এর এই পথটিকে নিষ্ক্রিয় রাখে, যখন SCG-এর মাধ্যমে পাইনিল গ্রন্থি মেলাটোনিন সংশ্লেষণের পথ সক্রিয় করে। ঘুমোনোর পালা যখন শেষ, মেলাটোনিন মিলিয়ে যায় ভোরের আবছা আলোয়, কর্টিসল ও ডোপামিনের প্রভুত্বে।

পাইনিল গ্রন্থি ও রেটিনা ছাড়াও, মেলাটোনিন উৎপন্ন হয় মাইটোকন্ড্রিয়া থেকে, যেখানে এটি একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে, যা ইঙ্গিত দেয় যে মেলাটোনিন হলো একটি "প্রাচীন অণু" যা প্রাথমিকভাবে অক্সিজেনের ধ্বংসাত্মক ক্রিয়া থেকে কোষকে সুরক্ষা প্রদান করে।

পাইনিল গ্রন্থি ও রেটিনা ছাড়াও, মেলাটোনিন উৎপন্ন হয় মাইটোকন্ড্রিয়া থেকে, যেখানে এটি একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে, যা ইঙ্গিত দেয় যে মেলাটোনিন হলো একটি “প্রাচীন অণু” যা প্রাথমিকভাবে অক্সিজেনের ধ্বংসাত্মক ক্রিয়া থেকে কোষকে সুরক্ষা প্রদান করে। নারীদেহে প্রজনন হরমোন নিঃসরণেও মেলাটোনিনের ভূমিকা রয়েছে। জেনে রাখা ভালো, মেলাটোনিন তার প্রভাব ফেলে আপন মেলাটোনিন রিসেপ্টরকে সক্রিয় করার মাধ্যমে। মানব কোষঝিল্লিতে আবদ্ধ দুই ধরনের মেলাটোনিন রিসেপ্টর MT1 ও MT2 হচ্ছে জি প্রোটিন-সংযুক্ত রিসেপ্টর (GPCR)। রিসেপ্টরগুলির অবস্থান সাধারণত মস্তিষ্কে, রেটিনায় ও প্রান্তিক কিছু অঙ্গে। মেলাটোনিনের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে ডোপামিনের মাত্রা কমে আসে। ডোপামিন দিনের হরমোন। বার্ধক্যের সাথে সাথে মেলাটোনিন সংশ্লেষণ কমে আসে। ফলে, প্রদাহের বিরুদ্ধে শরীরের কাজ করার ক্ষমতা হ্রাস পায় ও এর প্রতিক্রিয়ায় ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে। এছাড়া, আমাদের ইমিউন সিস্টেমও দুর্বল হয়ে পড়ে।

জেট ল্যাগ

পৃথিবীর এক অর্ধাংশে যখন দিন, তখন অপর অর্ধাংশে রাত। সৌর দিন-রাত্রির আবর্তে জৈবিক ঘড়ি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত দেহের এই ছন্দময় বৈশিষ্ট্য স্থানীয় বহিরাগত উদ্দীপনা (যেমন সূর্যালোক, তাপ, এমনকি খাদ্য)-র সাথে সম্পর্কযুক্ত। জেট ল্যাগ হচ্ছে বিমানযোগে পূর্ব-পশ্চিম (বা উল্টো দিকে) বরাবর দূর পারে ভ্রমণের কারণে সৃষ্ট বেশ কিছু উপসর্গ। এটি একটি জৈবিক ঘড়িজনিত সমস্যা। লম্বা ভ্রমণে অনেকগুলো টাইম জোন (time zone) বদলানোর ফলে জৈবিক ঘড়ির ছন্দপতন ঘটে, ব্যাহত হয় ক্ষুধা, ঘুম, হরমোন নিঃসরণ ইত্যাদি। বলা যায়, দেহের অভ্যন্তরীণ সময় আর নতুন বাইরের সময়ের সাথে তাৎক্ষণিক সারিবদ্ধ হয় না। তাই, স্থানীয় সময় ও পরিবেশের সাথে অভিযোজিত হতে, অর্থাৎ দেহের ছন্দ পুনরায় সেট বা সমন্বয় করে নিতে ভ্রমণকারীর মস্তিষ্কে ও চোখের রেটিনায় অবস্থিত ঘড়িগুলোর দিন কয়েক সময় লেগে যায়। এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় এনট্রেনমেন্ট (entrainment)। অভিযোজনের মূল উদ্দীপক বা “জাইটগিবার” (Zeitgeber/ZT, জার্মান শব্দ) হলো সূর্যের আলো। টাইম জোনের সংখ্যা অনুযায়ী বিলম্বিত হয় অভিযোজনের সময়ও। ধরা যাক, ঢাকা থেকে লন্ডন ভ্রমণে অভিযোজিত হতে যে কদিন (২/৩ দিন) সময় লাগে, তার থেকে বেশি সময় (৬/৭ দিন) লেগে যায় যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণকালে, যদিও বিভিন্ন ফ্যাক্টরভেদে স্থানীয় সময়ের সাথে মানিয়ে নেয়ার সময়টুকুর কিছুটা তারতম্য হতে পারে। প্রসঙ্গতঃ জেট স্ট্রিম অনুকূলে থাকায় পশ্চিমে ভ্রমণের চেয়ে পূব দিকে ভ্রমণ করা সহজ। কারণ, যত পূবদিকে যাওয়া যায়, ঘড়ির সময় তত এগিয়ে যায়। আর যত পশ্চিমে যাওয়া যায়, ঘড়ির সময় তত পেছয়। জেট স্ট্রিম হলো উচ্চ অ্যাল্টিচ্যুড (ভূপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা)-র বায়ুপ্রবাহ, যা বিশ্ব জুড়ে পশ্চিম থেকে পূবে প্রবাহিত- তাই পূব দিকে উড়ে যাওয়া বিমানগুলো দ্রুত চলমান বাতাসের সুবিধা নিতে পারে। আর, পশ্চিমে উড়ে যাওয়া বিমানগুলো বাতাসের বিপরীতে যায়।

উপসংহার

শহুরে জীবনযাত্রায় আধুনিক যুগের মানুষ মোরগের কুক্কুটধ্বনিতে এখন আর জেগে ওঠে না। তার একটি বড়ো কারণ আধুনিক জীবনবাবস্থায় প্রযুক্তির ব্যবহার। স্মার্ট ফোনে রয়েছে অ্যালার্মের সুবিধা—এছাড়াও, অনেকে রাতে বিছানায় আলো নিভিয়ে হাতে স্মার্টফোন ব্যবহারে অভ্যাস। ফলে, তরুণ-যুবারা অনেক ক্ষেত্রেই ঘুমোতে যায় খুব দেরি করে, অস্বাভাবিক সময়ে। স্মার্টফোনের নীল আলো শরীরে মেলাটোনিন নামের হরমোন উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। মেলাটোনিন একটি ঘুমপাড়ানি হরমোন। তাই, মেলাটোনিনের স্বাভাবিক সংশ্লেষণ ব্যাহত হলে সহজে আর ঘুম আসতে চায় না। আর, শরীর পর্যাপ্ত ঘুম না পেলে বা ঘুমের স্বাভাবিক চক্রটা অনিয়মিত হয়ে গেলে হৃদ্‌যন্ত্রের সমস্যা, স্নায়ুর রোগ, স্থূলতা, ক্যান্সার (স্তন ও প্রোস্টেট), বন্ধ্যত্ব এবং রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতার মতো অজস্র সমস্যা দেখা দিতে পারে। তিরিক্ষি মেজাজ, মানসিক চাপ, স্ট্রেসও এর একটা বড় কারণ। মানব জীবনের যে দিবানিশি ছন্দ শুরু হয় মধ্যগর্ভকালীন পর্যায় থেকে (যখন ভ্রূণের মস্তিষ্কে SCN ও তার জৈবিক ঘড়ি পূর্ণমাত্রায় সংগঠিত হয়ে যায়) এবং বহমান থাকে আমরণ, তার সুস্থতা বজায় রাখার দায়িত্বটুকু হচ্ছে একান্তই আমাদের।

শেয়ার করুন

2 thoughts on “জৈবিক ঘড়ি—মোরগের বাঁকে ঘুম যখন ভাঙল

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

প্রফেসর ড. রাশিদুল হক

প্রফেসর ড. রাশিদুল হক: সাবেক উপ-উপাচার্য, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী, এবং সাবেক অধ্যাপক, এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়, আটলান্টা, যুক্তরাষ্ট্র, ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

জৈবিক ঘড়ি—মোরগের বাঁকে ঘুম যখন ভাঙল

প্রকাশ: ০১:১৫:০২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৪ অগাস্ট ২০২৩
সারাংশ: পৃথিবীর আহ্নিক গতির কারণে আমাদের শারীরবৃত্তীয় অনেক কার্যাবলি বাহ্যিক পরিবেশ, অর্থাৎ আলো বা তাপমাত্রার পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হয়েছে ছন্দময়, যেমন, ঘুম-জাগরণ, জ্ঞানীয় কর্মক্ষমতা, বিপাক ও হজম প্রক্রিয়া, রেচন, রক্তচাপ, শ্বসন, যৌন উত্তেজনা, প্রজনন, হরমোন উৎপাদন, স্নায়বিক কার্যাবলি ইত্যাদি, যার প্রতিটি নিজ নিজ ছন্দে জৈবিক ঘড়ি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। শারীরবৃত্তীয় কোনো প্রক্রিয়া সূর্যের আলোয় সক্রিয় হয়, আবার কোনোটি সক্রিয় নিরালোকে, এমনকি গভীর রাতেও। দিন-রাতের এই জৈবিক ছন্দকে বলা হয় “সির্কাডিয়ান ছন্দ (circadian rhythm)”। পুরো দেহ জুড়েই বিভিন্ন টিস্যুর প্রতিটি কোষে রয়েছে আপন ক্লক যেগুলোকে বলা হয় দেহের পার্শ্বীয় (peripheral) ক্লক, যাদের নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের হাইপোথালামাসের সুপ্রাকায়াজম্যাটিক নিউক্লিয়াসে (SCN) অবস্থিত একটি মাস্টার ক্লক বা দেহের কেন্দ্রীয় ঘড়ি।

মূলশব্দসমূহ: জৈবিক ঘড়ি, দেহঘড়ি, সির্কাডিয়ান ছন্দ, মেলাটোনিন, ক্লক জিন, জেট ল্যাগ, মস্তিষ্ক।

সূর্যোদয়ের আগেই ভোরের বার্তা নিয়ে আসে “কুক্কুড়ু কু” ডাক। আমাদের ঘুম ভাঙায় মোরগের “জৈবিক-ঘড়ি” বা বায়োলজিক্যাল ক্লক। শুধু মোরগ কেন, জগতের সমস্ত প্রাণী প্রাকৃতিক এই অ্যালার্মে জেগে উঠে সূর্যের আলোর অবলোকনে। আর, বিজ্ঞান বলে সূর্যের কিরণ যখন আমাদের বন্ধ চোখের পাতাভেদ করে ঢুকে পড়ে, তখন সেটি মস্তিষ্ককে কর্টিসল (CORTISOL) হরমোন ছড়িয়ে দিতে উদ্দীপিত করে। ফলে আমরা জেগে উঠি। তাই কী পরিমাণ কর্টিসল হরমোন দেহে ক্ষরিত হয় তার ওপর নির্ভর করে দিনটি কেমন যাবে। কর্টিসলের সংশ্লেষণ এবং নিঃসরণ হাইপোথ্যালামিক-পিটুইটারি-অ্যাড্রিনাল অক্ষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কর্টিসল একটি সঠিক ২৪-ঘণ্টা দিবানিশি ছন্দ প্রদর্শন করে। জেগে ওঠার পরে কর্টিসলের শিখর-নিঃসরণ ঘুম-জাগরণ এবং আলো-অন্ধকার উভয় চক্রের সাথে দেহকে ছন্দবদ্ধ পদ্ধতিতে সমন্বয় করতে একটি নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করে। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, আমার এই নিবন্ধে জিন ও প্রোটিনগুলি ইংরেজিতে লিখা হয়েছে যথাক্রমে ছোটো বর্ণ ও বড়ো বর্ণে।

পৃথিবীর আহ্নিক গতি (নিজ অক্ষের উপর ২৪-ঘণ্টায় আবর্তন)-র কারণে আমাদের অনেক শারীরবৃত্তীয় কার্যাবলি বাহ্যিক পরিবেশ, অর্থাৎ আলো বা তাপমাত্রার পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হয়েছে ছন্দময়, যেমন, ঘুম-জাগরণ, জ্ঞানীয় কর্মক্ষমতা, বিপাক ও হজম প্রক্রিয়া, রেচন, রক্তচাপ, শ্বসন, যৌন উত্তেজনা, প্রজনন, হরমোন উৎপাদন, স্নায়বিক কার্যাবলি ইত্যাদি, যার প্রতিটি নিজ নিজ ছন্দে জৈবিক ঘড়ি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত—দিবা-রাত্রির এই জৈবিক ছন্দকে বলা হয় “সির্কাডিয়ান ছন্দ (circadian rhythm)”। পুরো দেহ জুড়েই বিভিন্ন টিস্যুর প্রতিটি কোষে রয়েছে নিজস্বী ক্লক যেগুলোকে বলা হয় দেহের পার্শ্বীয় (peripheral) ক্লক, যাদের নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের হাইপোথালামাসের সুপ্রাকায়াজম্যাটিক নিউক্লিয়াসে (SCN) অবস্থিত এক মাস্টার ক্লক বা দেহের কেন্দ্রীয় ঘড়ি। পার্শ্বীয় ক্লকগুলোকে অনেক বিশেষজ্ঞ বলে থাকেন মাস্টার ক্লকের দাস। তা অনেকটা বটে, কারণ মাস্টার ক্লকের নির্দেশ ছাড়া পার্শ্বীয় ক্লক বেশি দিন সক্রিয় থাকতে পারে না। SCN অঞ্চলটিতে মাত্র ২০ হাজার স্নায়ুকোষ থাকে যেগুলো মাস্টার ক্লক-ও ধারণ করে। SCN এর অনেক ধরনের কাজের মধ্যে তার অন্যতম একটি কাজ হলো জৈবছন্দ নিয়ন্ত্রণ করা, এবং এই ছন্দ ব্যাকটেরিয়া থেকে মানুষ পর্যন্ত সবার মাঝেই একটি গুর্রুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া।

প্রত্যুষে মোরগের ডাক কি অভ্যাসগত?

প্রত্যুষে মোরগের ডাক অভ্যাসগত নয়, এটি জিনগত- এ কথাটি জানালেন জাপানের নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিজ্ঞানী তাকাশি ইয়োশিমুরা। বিজ্ঞানীমহলে হিড়িক পড়ে গেলো সেই “ঊষা-জিন”টি আবিষ্কারের। পাওয়াও গেলো সেই অজানা জিনটি, নাম দেয়া হলো “পিরিয়ড (Period, Per)”। জিনটি প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন মার্কিন বিজ্ঞানী সিমোর বেঞ্জার (Seymour Benzer) ড্রোসোফিলা (ফলের মাছি)-র X-ক্রোমোজোমে, ১৯৭১ সালে। স্তন্যপায়ী প্রাণিদের Per পরিবারে তিনটি জিন রয়েছে: Per1, Per2, Per3। দেখা গেলো, Per জিনের সংশ্লিষ্ট প্রোটিন PER একা কাজ করতে পারে না, তাকে সক্রিয় হতে হলে তার একজন পার্টনার দরকার। সেই জিনটিও খুঁজে পাওয়া গেলো, নাম তার “ক্রিপ্টোক্রম (Cryptochrome, Cry), আবিষ্কার করলেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চার্লস উইজ (Charles Weitz) ও তার গবেষক দল। মাইকেল রসব্যাশ ১৯৮৪ সালে Per জিনটি ক্লোন ক’রে জৈবিক ঘড়ি-সম্পর্কিত বিষয়টি আরও এগিয়ে নিয়ে গেলেন এবং আবিষ্কার করলেন ড্রোসোফিলায় আরও একটি ক্লক-জিন, নাম তার “Cycle”, স্তন্যপায়ীদের যার সমকক্ষ জিন হলো Bmal1। ড্রোসোফিলায় রসব্যাশ-ই প্রথম আণবিক প্রক্রিয়ায় প্রমাণ করলেন যে এই জিনদুটি দিন-রাতে তাদের কার্যকলাপকে ছন্দময় করে তুলেছে। তাঁর এই আবিষ্কার (মাইকেল ইয়ং ও জেফ্রি হল-সহ) তাঁকে ভূষিত করলো নোবেল পুরস্কারে ২০১৭ সালে। 

প্রসঙ্গতঃ ড্রোসোফিলা জৈবিক ঘড়ির আণবিক প্রক্রিয়াতে Per ট্রান্সক্রিপ্ট (mRNA) এবং এর সংশ্লিষ্ট প্রোটিন PER গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উভয় স্তরে Per জিন ও প্রোটিনের প্রকাশ ২৪ ঘণ্টা বরাবর সির্কাডিয়ান ছন্দ বজায় রাখে, যা ইক্লোশন (কীট-পতঙ্গদের ডিম অথবা পিউপা থেকে বের হবার সময়) এবং নড়াচড়া কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে- যেমন, প্রজাপতির ইক্লোশন সময় প্রায়শঃ ভোর বেলায়, কিন্তু মশা পিউপা থেকে বের হয় রাত্রিতে। প্রসঙ্গত, BMAL1-এর পার্টনার CLOCK প্রোটিনের জিনটি (এটি একটি স্বতন্ত্র জিন/প্রোটিন) প্রথম শনাক্ত ও ক্লোন করেন টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপানি বংশোদ্ভূত জোসেফ তাকাহাশি। BMAL1-CLOCK-জুটি জীবের প্রায় প্রতিটি কোষেই একটি পজিটিভ রেগুলেটের হিসেবে কাজ করে। এর ব্যতিক্রম দেখা দিলো মোরগের রেটিনার ফটোরিসেপ্টর কোষগুলোতে, যেখানে CLOCK-এর পরিবর্তে BMAL1-এর যুগলবন্দী হয় NPAS2, আবিষ্কৃত হলো আরও একটি ক্লক প্রোটিন (পড়ুন: Haque R et al., J Neurochem. 2010)। PER-CRY যুগলের প্রধান কাজই হলো প্রত্যুষ এবং দিনের জিনগুলোকে জাগিয়ে তোলা, অর্থাৎ উদ্দীপ্ত করা (যেমন টেস্টোস্টেরোন, অ্যাসিটিলকোলিন, cFos, cJun ইন্সুলিন ও ইন্সুলিন রিসেপ্টর, গ্লুকোজ বিপাকীয় এনজাইম), এবং রাতে প্রকাশিত জিনগুলি (যেমন মেলাটোনিন, HMG-CoA রিডাকটেজ, গ্লুকাগন, গ্লুকোনিওজেনেসিস-সম্পর্কিত জিন)-র অভিব্যক্তি স্তিমিত করা। ATP (অ্যাডিনোসাইট ট্রাইফসফেট) শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয় জীবিত কোষের প্রায় প্রতিটি জৈবিক প্রক্রিয়ায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেগুলোর ব্যাপক ব্যবহার দিনের বেলায়। তাই, তার সংশ্লেষণ (এটিপি সিন্থেজ দ্বারা) শিখরে ওঠে শেষ রাতে, ঠিক সূর্যোদয়ের পূর্বমুহূর্তে, যেন সেগুলোর পূর্ণমাত্রায় সরবরাহ থাকে দিনের কার্যক্রমে।  

জৈবিক ঘড়ির জিনগত কাঠামো

দেহের মাস্টার ক্লক ও পার্শ্বীয় ক্লক উভয়ই একটি নির্দিষ্ট জীনগত বৈশিষ্ট্য দ্বারা পরিচালিত, যার মুলে রয়েছে চারটি জিন, যা ঘড়ি-গুলোর একটি “নেগেটিভ ফিডব্যাক লুপ” তৈরি করে (দেখুন ছবি১)। মানুষসহ মেরুদন্ডী প্রাণিদের জৈবিক ঘড়ির জিনগত মৌলিক উপাদান হচ্ছে: Period (Per1/2/3) ও Cryptochrome (Cry1/Cry2) এবং  Bmal1 ও Clock জিন। এগুলোকে ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টরও বলা হয়। সির্কাডিয়ান জৈবিক ঘড়ির মূল ট্রান্সক্রিপশন কমপ্লেক্সটি, যা দেহের প্রায় ৩০% জিনের প্রকাশকে সূর্যালোকের উপর ভিত্তি করে নিয়ন্ত্রণ করে, অর্থাৎ কোনো জিন বেশি প্রকাশ পায় দিনে, কোনোটি রাতে। একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, জৈবিক ঘড়ি-নিয়ন্ত্রিত জিনগুলোর সর্ব্বোচ প্রকাশ পায় ফুসফুসে (২৪১৮টি জিন), হৃৎপিণ্ডের বাম নিলয়ে (২২০২টি জিন) এবং রক্ত-প্লাজমায় (১৯০০টি জিন)। 

সূর্যোদয়ের আগেই ভোরের বার্তা নিয়ে আসে “কুক্কুড়ু কু” ডাক। আমাদের ঘুম ভাঙায় মোরগের “জৈবিক-ঘড়ি” বা বায়োলজিক্যাল ক্লক।

সারাদিন উৎফুল্ল থাকার নিয়ামক হচ্ছে প্রোটিনযুগল PER ও CRY। দিনের আলোয়, PER ও CRY প্রোটিন-দুটি জুটি বেঁধে (হেটারোডাইমার) ঘড়ি-নিয়ন্ত্রিত দিনের জিনগুলিকে প্রকাশ করে এবং BMAL1 ও CLOCK (অথবা BMAL1:NPAS2) হেটারোডাইমার স্বচ্ছ অন্ধকার বা গভীর রাতের জিনগুলির প্রকাশ নিয়ন্ত্রণ করে। রাতে সংশ্লেষিত প্রোটিন বা হরমোনগুলোর অন্যতম হলো মেলাটোনিন, একটি ঘুমের হরমোন, যা সংশ্লেষিত ও ক্ষরিত হয় মস্তিষ্কে অবস্থিত পাইনিল (pineal) গ্রন্থি থেকে। এছাড়া, চোখের রেটিনা থেকেও সংশ্লেষিত হয় মেলাটোনিন। মেলাটোনিন সরাসরি কোনো জিন থেকে নির্দেশপ্রাপ্ত নয়। বরং, মেলাটোনিন সংশ্লেষণকে ছন্দময় করতে যে জিনটি মূলত দায়ী সেটি হলো N-অ্যাসিটিলট্রান্সফারেজ (Arylalkyl N-acetyltransferase, Aanat), যার দিন-রাত্রির অভিব্যক্তির তারতম্য নিয়ন্ত্রণ করে জৈবিক ঘড়ি (দেখুন ছবি২)। এই AANAT-প্রোটিনটির কার্যক্ষমতা দিনের থেকে ১০ থেকে ১০০ গুণ বেশি রাতে (অন্ধকার অবস্থায়), বলা যায় গভীর রাতে। এই জিন বা প্রোটিনটির কারণেই মানুষ বিভোর থাকে ঘুমের রাজ্যে। বিপরীতে, এই জিনটির মিউটেশন ঘটে গেলে রাতের ঘুম কেড়ে নিয়ে যায়, যা ইনসোমনিয়া ও বিলম্বিত ঘুমের ফেজ ডিসঅর্ডারের প্রধান একটি কারণ।

সূর্যোদয়ের আগেই ভোরের বার্তা নিয়ে আসে “কুক্কুড়ু কু” ডাক। আমাদের ঘুম ভাঙায় মোরগের “জৈবিক-ঘড়ি” বা বায়োলজিক্যাল ক্লক।

Aanat-জিনসহ জৈবিক ঘড়ি নিয়ন্ত্রিত জিনগুলির প্রোমোটর (promoter) অঞ্চলে রয়েছে বেশ কিছু খন্ড-খন্ড নির্দিষ্ট সিকোয়েন্স যাকে বলা হয় এনহ্যানসার (enhancer), যা জিনের অভিব্যক্তিকে অতিমাত্রায় বৃদ্ধি করে। এ রকম একটি ডিএনএ ক্রম হচ্ছে E-box (CACGTG), যেখানে যুক্ত হয় যুগল ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর PER-CRY (দিনের আলোয়) এবং BMAL1-CLOCK (নিরালোকে)। REV-ERBα ও RORα (retinoic acid orphan receptor alpha) এই দুটি পৃথক জিন বা প্রোটিনও জৈবিক ঘড়ির অংশ হিসেবে বিবেচিত; তবে,, ঘড়ির মূল কমপ্লেক্সের অংশ হিসেবে নয়, বরং ক্লক সিস্টেমের একটি  সাব-লুপ (sub-loop) হিসেবে কাজ করে এবং নিয়ন্ত্রণ করে Bmal1 ও Clock জিনের অভিব্যক্তি (দেখুন ছবি১)। REV-ERB হলো ঊষার প্রোটিন, সে বাধা দেয় Bmal1-এর প্রকাশকে, কিন্তু Bmal1 পুনরায় সক্রিয় হয় গোধূলি বেলায় ROR প্রোটিন দ্বারা। REV-ERB এবং ROR দুটোই হলো নিউক্লীয় রিসেপ্টর ও ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর। এছাড়া, ডিএনএ-তে আরও একটি নিত্য-ব্যবহৃত এনহ্যান্সার ক্রম হচ্ছে CRE (TGACGTCA), যার সঙ্গে যুক্ত হয় একটি ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর CREB (cAMP-রেস্পন্সিভ বাইন্ডিং প্রোটিন), যা মস্তিষ্কে (হিপ্পোক্যাম্পাস এবং অ্যামিগডালা অঞ্চলে) স্মৃতি-গঠন এবং জ্ঞানীয় কর্মক্ষমতার দিবারাত্রি ছন্দ পরিচালনা করে। শেষোক্ত দুটি প্রক্রিয়া সাধারণত দিনের প্রথমার্ধে সর্বোচ্চ হয়। সে কারণেই, অ্যাসিটিলকোলিনের মত স্মৃতিধারক প্রোটিনগুলি সর্বাধিক পাওয়া যায় ভোর বেলায়।

জৈবিক ঘড়ির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে—আলোর দ্বারা ঘড়িটি সমন্বিত হয়ে গেলে, মেঘলা দিনে বা কোনো বাহ্যিক সংকেত ছাড়াই, ধ্রুবক অন্ধকারেও ২/৩ দিন শারীরবৃত্তীয় কার্যাদির ছন্দ মুক্ত-চলমান (free running) থাকতে পারে, অর্থাৎ তারা আগের মতই দিবা-রাত্রির দোলন বজায় রাখতে পারে।

পাইনিল গ্রন্থি, মেলাটোনিন ও ঘুম

মেলাটোনিন হরমোনের নাম আমাদের অনেকেরই জানা। এটি ট্রিপটোফ্যান-সেরোটোনিন-উৎপন্ন নিশিরাতের একটি হরমোন। পূর্বেই বলেছি মস্তিষ্কের পাইনিল (pineal) গ্রন্থি থেকে মেলাটোনিন নিঃসৃত হয় এবং এটি আমাদের ঘুম-জাগরণ সির্কাডিয়ান ছন্দকে সমন্বয় করে। মস্তিষ্কের এপিথ্যালামাসে ও তৃতীয় ভেন্ট্রিকলের ঠিক পেছনে অবস্থান করে পাইনিল গ্রন্থি, যা একটি ছোট্ট একক অন্তঃস্রাবী গ্রন্থি। এটি বেশিরভাগ মেরুদণ্ডী প্রাণীর মস্তিষ্কে পাওয়া যায়। পাইনিল গ্রন্থির কোষগুলোকে বলা হয় পাইনিলোসাইট (pinealocytes)। মস্তিষ্কের অন্যান্য অঞ্চলের মত, পাইনিল গ্রন্থি রক্ত-মস্তিষ্কের প্রতিবন্ধক (blood-brain barrier) ব্যবস্থা দ্বারা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়; ফলে, পোস্টেরিয়র সেরিব্রাল ধমনী দ্বারা এটিতে প্রচুর রক্ত ​​প্রবাহ রয়েছে। পাইনিল গ্রন্থির প্রধান কাজটি হচ্ছে মেলাটোনিন সংশ্লেষণ করা এবং সেটি ক্ষরিত হয় রাত্রিকালীন (অন্ধকার বা নিরালোক) সময়ে, দিনের আলোয় তার ক্ষরণ হয় স্তিমিত। 

চোখের রেটিনার কোষগুলোতে রয়েছে ওদের আপন জৈবিক ঘড়ি। চোখের রেটিনার আলোক সংবেদনশীল গ্যাংলিয়ন (ganglion)কোষগুলো আলো শনাক্ত করে এবং এই দৃষ্টিবোধ (যা রূপান্তরিত হয় তড়িৎ-রাসায়নিক শক্তিতে) প্রেরিত হয় রেটিনোহাইপোথ্যালামিক স্নায়ু/ট্র্যাক্ট (RHT) দ্বারা হাইপোথ্যালামাসের সুপ্রাকায়াজম্যাটিক নিউক্লিয়াসে (SCN), যেখানে অবস্থান করে মাস্টার বা কেন্দ্রীয় জৈবিক ঘড়িটি। SCN সেই সংকেতগুলো দিন-রাত্রি চক্রের সাথে সমন্বয় করে। স্নায়ু তন্তুগুলি SCN থেকে সংকেত নিয়ে যায় হাইপোথ্যালামাসের প্যারাভেন্ট্রিকুলার নিউক্লিয়াস (PVN), তারপর মেরুদন্ডে (ট্রাইজেমিনাল অঞ্চল, T1/T3) এবং সমবেদী সিস্টেমের মাধ্যমে সুপিরিয়র সার্ভিকাল গ্যাংলিয়ায় (SCG), এবং সেখান থেকে অবশেষে সংকেত পৌঁছয় পাইনিল গ্রন্থিতে (দেখুন ছবি৩)। রাত্রিকালীন অন্ধকারাছন্ন পরিবেশ PVN-এর এই পথটিকে নিষ্ক্রিয় রাখে, যখন SCG-এর মাধ্যমে পাইনিল গ্রন্থি মেলাটোনিন সংশ্লেষণের পথ সক্রিয় করে। ঘুমোনোর পালা যখন শেষ, মেলাটোনিন মিলিয়ে যায় ভোরের আবছা আলোয়, কর্টিসল ও ডোপামিনের প্রভুত্বে।

পাইনিল গ্রন্থি ও রেটিনা ছাড়াও, মেলাটোনিন উৎপন্ন হয় মাইটোকন্ড্রিয়া থেকে, যেখানে এটি একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে, যা ইঙ্গিত দেয় যে মেলাটোনিন হলো একটি "প্রাচীন অণু" যা প্রাথমিকভাবে অক্সিজেনের ধ্বংসাত্মক ক্রিয়া থেকে কোষকে সুরক্ষা প্রদান করে।

পাইনিল গ্রন্থি ও রেটিনা ছাড়াও, মেলাটোনিন উৎপন্ন হয় মাইটোকন্ড্রিয়া থেকে, যেখানে এটি একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে, যা ইঙ্গিত দেয় যে মেলাটোনিন হলো একটি “প্রাচীন অণু” যা প্রাথমিকভাবে অক্সিজেনের ধ্বংসাত্মক ক্রিয়া থেকে কোষকে সুরক্ষা প্রদান করে। নারীদেহে প্রজনন হরমোন নিঃসরণেও মেলাটোনিনের ভূমিকা রয়েছে। জেনে রাখা ভালো, মেলাটোনিন তার প্রভাব ফেলে আপন মেলাটোনিন রিসেপ্টরকে সক্রিয় করার মাধ্যমে। মানব কোষঝিল্লিতে আবদ্ধ দুই ধরনের মেলাটোনিন রিসেপ্টর MT1 ও MT2 হচ্ছে জি প্রোটিন-সংযুক্ত রিসেপ্টর (GPCR)। রিসেপ্টরগুলির অবস্থান সাধারণত মস্তিষ্কে, রেটিনায় ও প্রান্তিক কিছু অঙ্গে। মেলাটোনিনের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে ডোপামিনের মাত্রা কমে আসে। ডোপামিন দিনের হরমোন। বার্ধক্যের সাথে সাথে মেলাটোনিন সংশ্লেষণ কমে আসে। ফলে, প্রদাহের বিরুদ্ধে শরীরের কাজ করার ক্ষমতা হ্রাস পায় ও এর প্রতিক্রিয়ায় ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে। এছাড়া, আমাদের ইমিউন সিস্টেমও দুর্বল হয়ে পড়ে।

জেট ল্যাগ

পৃথিবীর এক অর্ধাংশে যখন দিন, তখন অপর অর্ধাংশে রাত। সৌর দিন-রাত্রির আবর্তে জৈবিক ঘড়ি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত দেহের এই ছন্দময় বৈশিষ্ট্য স্থানীয় বহিরাগত উদ্দীপনা (যেমন সূর্যালোক, তাপ, এমনকি খাদ্য)-র সাথে সম্পর্কযুক্ত। জেট ল্যাগ হচ্ছে বিমানযোগে পূর্ব-পশ্চিম (বা উল্টো দিকে) বরাবর দূর পারে ভ্রমণের কারণে সৃষ্ট বেশ কিছু উপসর্গ। এটি একটি জৈবিক ঘড়িজনিত সমস্যা। লম্বা ভ্রমণে অনেকগুলো টাইম জোন (time zone) বদলানোর ফলে জৈবিক ঘড়ির ছন্দপতন ঘটে, ব্যাহত হয় ক্ষুধা, ঘুম, হরমোন নিঃসরণ ইত্যাদি। বলা যায়, দেহের অভ্যন্তরীণ সময় আর নতুন বাইরের সময়ের সাথে তাৎক্ষণিক সারিবদ্ধ হয় না। তাই, স্থানীয় সময় ও পরিবেশের সাথে অভিযোজিত হতে, অর্থাৎ দেহের ছন্দ পুনরায় সেট বা সমন্বয় করে নিতে ভ্রমণকারীর মস্তিষ্কে ও চোখের রেটিনায় অবস্থিত ঘড়িগুলোর দিন কয়েক সময় লেগে যায়। এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় এনট্রেনমেন্ট (entrainment)। অভিযোজনের মূল উদ্দীপক বা “জাইটগিবার” (Zeitgeber/ZT, জার্মান শব্দ) হলো সূর্যের আলো। টাইম জোনের সংখ্যা অনুযায়ী বিলম্বিত হয় অভিযোজনের সময়ও। ধরা যাক, ঢাকা থেকে লন্ডন ভ্রমণে অভিযোজিত হতে যে কদিন (২/৩ দিন) সময় লাগে, তার থেকে বেশি সময় (৬/৭ দিন) লেগে যায় যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণকালে, যদিও বিভিন্ন ফ্যাক্টরভেদে স্থানীয় সময়ের সাথে মানিয়ে নেয়ার সময়টুকুর কিছুটা তারতম্য হতে পারে। প্রসঙ্গতঃ জেট স্ট্রিম অনুকূলে থাকায় পশ্চিমে ভ্রমণের চেয়ে পূব দিকে ভ্রমণ করা সহজ। কারণ, যত পূবদিকে যাওয়া যায়, ঘড়ির সময় তত এগিয়ে যায়। আর যত পশ্চিমে যাওয়া যায়, ঘড়ির সময় তত পেছয়। জেট স্ট্রিম হলো উচ্চ অ্যাল্টিচ্যুড (ভূপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা)-র বায়ুপ্রবাহ, যা বিশ্ব জুড়ে পশ্চিম থেকে পূবে প্রবাহিত- তাই পূব দিকে উড়ে যাওয়া বিমানগুলো দ্রুত চলমান বাতাসের সুবিধা নিতে পারে। আর, পশ্চিমে উড়ে যাওয়া বিমানগুলো বাতাসের বিপরীতে যায়।

উপসংহার

শহুরে জীবনযাত্রায় আধুনিক যুগের মানুষ মোরগের কুক্কুটধ্বনিতে এখন আর জেগে ওঠে না। তার একটি বড়ো কারণ আধুনিক জীবনবাবস্থায় প্রযুক্তির ব্যবহার। স্মার্ট ফোনে রয়েছে অ্যালার্মের সুবিধা—এছাড়াও, অনেকে রাতে বিছানায় আলো নিভিয়ে হাতে স্মার্টফোন ব্যবহারে অভ্যাস। ফলে, তরুণ-যুবারা অনেক ক্ষেত্রেই ঘুমোতে যায় খুব দেরি করে, অস্বাভাবিক সময়ে। স্মার্টফোনের নীল আলো শরীরে মেলাটোনিন নামের হরমোন উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। মেলাটোনিন একটি ঘুমপাড়ানি হরমোন। তাই, মেলাটোনিনের স্বাভাবিক সংশ্লেষণ ব্যাহত হলে সহজে আর ঘুম আসতে চায় না। আর, শরীর পর্যাপ্ত ঘুম না পেলে বা ঘুমের স্বাভাবিক চক্রটা অনিয়মিত হয়ে গেলে হৃদ্‌যন্ত্রের সমস্যা, স্নায়ুর রোগ, স্থূলতা, ক্যান্সার (স্তন ও প্রোস্টেট), বন্ধ্যত্ব এবং রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতার মতো অজস্র সমস্যা দেখা দিতে পারে। তিরিক্ষি মেজাজ, মানসিক চাপ, স্ট্রেসও এর একটা বড় কারণ। মানব জীবনের যে দিবানিশি ছন্দ শুরু হয় মধ্যগর্ভকালীন পর্যায় থেকে (যখন ভ্রূণের মস্তিষ্কে SCN ও তার জৈবিক ঘড়ি পূর্ণমাত্রায় সংগঠিত হয়ে যায়) এবং বহমান থাকে আমরণ, তার সুস্থতা বজায় রাখার দায়িত্বটুকু হচ্ছে একান্তই আমাদের।