১১:০৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ও তাঁর প্রাসঙ্গিকতা

আবু রাইহান
  • প্রকাশ: ১০:৪৮:২৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১ অগাস্ট ২০২২
  • / ২৪৯৩ বার পড়া হয়েছে

ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের জন্ম ১১ ফেব্রুয়ারি ১৮৮২ সালে। তাঁর পৈর্তৃক নিবাস বর্ধমান-এর চুপী গ্রামে। তাঁর পিতামহ (দাদা) অক্ষয় কুমার দত্ত ছিলেন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জনপ্রিয় কবি ও ছড়াকার সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর কবিতায় নানা ভাষার শব্দ নিপুণ ছন্দে যুক্ত হয়েছে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন রবীন্দ্রযুগের খ্যাতনামা ‘ছন্দোরাজ’ কবি। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে ১৯২২ সালের ২৫ জুন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত পরলোকগমন করেন।

বাংলা সাহিত্যে সত্যেন্দ্রনাথ খুবই গুরুত্বপূর্ণ

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মৃত্যুর শতবর্ষ হলো কিন্তু তাকে নিয়ে বিশেষ কোনো আয়োজন চোখে পড়ে না। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সাহিত্য পত্র-পত্রিকা এবং কবি-সাহিত্যিকরা অদ্ভুতভাবে নীরব।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরে এবং কাজী নজরুল ইসলামের আগে যে দু-একজন কবি নানা কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁদের একজন। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, তাঁর কবিতা ও সাহিত্য, বিশেষ করে বিষয় এবং শৈলীর ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যে যথেষ্ট রকম নতুন প্রাণ দান করেছিল। মৃত্যুর শতবর্ষ পরেও এখনো বাংলা সাহিত্যে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি এবং প্রাসঙ্গিক। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মূল বিষয়টি হলো বাংলা সাহিত্যের বিষয় কেন্দ্রিক যে বিবর্তন বা শৈলী কেন্দ্রিক বিবর্তন, সেখানে আমাদের মনে কয়েকটি বিষয় রাখতে হবে।

সত্যন্দ্রনাথ দত্তকে মনেপ্রাণে ধারণ করতেন কাজী নজরুল ইসলাম

কল্লোল যুগের আগে, এমন কী কাজী নজরুল ইসলামের আগে মানবতা কেন্দ্রিক সাহিত্য রচনার যে জরুরি বিষয়টি ছিল আধুনিকতার ক্ষেত্রে, যৌক্তিক ক্ষেত্রে, বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে, সেটি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত শুরু করেছিলেন। এমনকী নজরুলের আবির্ভাবে যে দু-একজন কবি প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত প্রধানতম। এটি নজরুল ব্যাপকভাবে স্মরণ করেছেন। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে কেন্দ্র করে নজরুল চাকরিও ছেড়েছিলেন। ভালোবাসার প্রতিদান জানাতে গিয়ে, কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত মারা যাওয়ার পর কাজী নজরুল ইসলাম একটি আবেগপ্রবণ সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখেছিলেন মাওলানা আকরাম খাঁ সম্পাদিত ‘সেবক’ পত্রিকায়। এই লেখাটিতে এতটাই আবেগঘন বিষয় ছিল, যা আবুল কালাম শামসুদ্দীন এবং এস ওয়াজেদ আলী সেটিকে কিছুটা সংশোধন করেছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, নজরুলের এই সম্পাদকীয় রচনার মধ্যে অতিরিক্ত আবেগ এবং বেশি হিন্দুয়ানী শব্দ রয়েছে, যা মাওলানা আকরাম খাঁ পছন্দ করবেন না। কিংবা তাঁদের নিজেদের হয়তো পছন্দ হয়নি। সংশোধিত সম্পাদকীয়টি প্রকাশিত হওয়ার পর কাজী নজরুল ইসলাম আর সেবক পত্রিকায় ফিরে যাননি। তখন নজরুল ইসলামের বয়স খুব বেশি নয়। তখনও তিনি ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখেননি। তখনও কাজী নজরুল ইসলামের কবি হিসেবে সে রকম নামযশ হয়নি। তার পরেও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রতি গভীর ভালোবাসার টানে তিনি এই চাকরি ছাড়ার ঝুঁকি নিয়েছিলেন।

কাজী নজরুল ইসলামের কবি হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে যে সমস্ত কবি-সাহিত্যিক অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কবি ইসমাইল সিরাজী বা শুরুতে কবি মোহিতলাল মজুমদার। এই তিনজন কবি নজরুলের ‘কবি নজরুল’ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

কাজী নজরুলের কবিতার বিষয়ের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, তিনি বিষয়ের ক্ষেত্রে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে বেশি অবলম্বন করেছিলেন। শুধু তাই নয়— কবি নজরুল ইসলাম সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে নিয়ে চারটি কবিতা এবং একটি গান লিখেছিলেন। একটি দীর্ঘ কবিতায় তিনি লিখেছেন—

‘যশ লোভী এই অন্ধ ভণ্ড স্বজ্ঞান ভীরু

দলে তুমি একাকী রণ দুন্দুভি বাজালে গভীর রোলে!’

রবীন্দ্রযুগে স্বতন্ত্র সত্যেন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বীকৃতি

কবিতায় ছন্দের কারুকাজ, শব্দ ও ভাষা যথোপযুক্ত ব্যবহারের কৃতিত্বের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে ‘ছন্দের যাদুকর’ নামে আখ্যায়িত করেন। তিনি ছিলেন ‘ভারতী’ পত্রিকাগোষ্ঠীর অন্যতম কবি। প্রথম জীবনে তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, অক্ষয় কুমার বড়োাল প্রমুখের দ্বারা প্রভাবিত হন। পরে রবীন্দ্র অনুসারী হলেও তিনি স্বতন্ত্র হয়ে ওঠেন।

বাংলা শব্দের সঙ্গে আরবি-ফার্সি শব্দের সমন্বিত ব্যবহার দ্বারা বাংলা কাব্যভাষার শক্তি বৃদ্ধির প্রাথমিক কৃতিত্ব ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের। অনুবাদের মাধ্যমে তিনি বিশ্বের কাব্যসাহিত্যের সঙ্গে বাংলার যোগাযোগ ঘটান।

দেশাত্মবোধ, মানবপ্রীতি, ঐতিহ্যচেতনা, শক্তিসাধনা প্রভৃতি তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু। আরবি-ফার্সি, চিনা, জাপানি, ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষার বহু কবিতা অনুবাদ করে বাংলাসাহিত্যের বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধি সাধন করেন।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা মূলত প্রবাসী ভারতীয় পত্র— বাণী বিচিত্রা, বঙ্গলক্ষ্মী, দেশ ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের রচিত কাব্যগ্রন্থ গুলি হলো— সবিতা (১৯০০), সন্ধিক্ষণ (১৯০৫), বেণু ও বীণা (১৯০৬), হোমশিখা (১৯০৭)।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মৃত্যুর পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন—

‘তুমি বঙ্গভারতীর তন্ত্রী-পরে একটি অপূর্ব তন্ত্র এসেছিলে পরাবার তরে এ শুধু প্রিয়জনের প্রশংসা নয়, এ এক ঐতিহাসিক সত্য।’

প্রখ্যাত সাহিত্যিক, বিজ্ঞানানুরাগী, ইতিহাস প্রেমিক পিতামহ অক্ষয় কুমারের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি সাহিত্যিক প্রতিভা, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি ও ইতিহাস প্রিয়তা লাভ করেছিলেন। যে যুগে তাঁর আবির্ভাব, সে যুগ ছিল তাঁর মনবিকাশের অনুকূল। এই পরিবেশে জন্মগ্রহণ করে বৈজ্ঞানিক ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিকদের উত্তরাধিকারী সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বিশেষ করে সে যুগেরই সন্তান হয়ে উঠলেন। তিনি স্বদেশকে ভালোবাসলেন। স্বদেশের দুঃখ-দুর্দশা তাঁর প্রাণে বড়ো গভীর করে বাজল। তিনি উপলব্ধি করলেন মানুষে মানুষে একাত্মবোধ জাগাতে হবে সবার আগে। এর জন্য চাই জ্ঞান আর প্রেম। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি মানবতার জয়গান গেয়েছেন। ভারতবাসীকে তাঁর মহিমা উজ্জ্বল ঐতিহ্য স্মরণ করে দিয়েছেন। 

বিশ্বপ্রেমিক, মানবতার পূজারী ও সাম্যবাদী সত্যেন্দ্রনাথ মুক্তকণ্ঠে গেয়ে গেছেন—

‘জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে সে জাতির নাম মানুষ জাতি…’

হিন্দু মুসলমানের বিরোধ তাঁর অন্তরকে ব্যথিত করত। সে যুগের হিন্দু-মুসলিম মিলনকামী মহাপুরুষদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মধ্যে বহুমুখী চৈতন্যের প্রকাশ ঘটেছিল। রবীন্দ্রনাথ কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের এই প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সম্পর্কে বলে—

‘আমি মুক্তকণ্ঠে বিন্দুমাত্র বিনয় প্রকাশ না করে বলিতেছি যে, বাংলা ভাষা ও ছন্দে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের যে অসামান্য অধিকার ছিল তাহা আর-কাহারো সঙ্গে তুলনীয় নহে।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে ছন্দের জাদুকর বলার পরে অনেকেই সেটির ভুল ব্যাখ্যা করেছেন। কবি মোহিতলাল মজুমদার এবং কবি বুদ্ধদেব বসু কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার সমালোচনা করে বলেছেন—

‘তাঁর কবিতায় কেবল শব্দের ঝংকার, কোন প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি।’

যদিও বেশির ভাগ সাহিত্য সমালোচকরা মনে করেন, এই সমালোচনা কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ক্ষেত্রে যথার্থ নয়। 

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের যে সমস্ত দেশাত্মবোধক কবিতা, মানবিক কবিতা এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে, কবিতায় যদি কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে না পারতেন তাহলে মৃত্যুর শতবর্ষ পরেও তাঁর কবিতা মানুষের মনে এভাবে দাগ কেটে থেকে যেত না। আর শব্দের ঝংকার কবিতা রচনার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ শৈলী। ছন্দের ঝংকারের কারণেই শৈশবে পড়া কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা আজও মনে গেঁথে রয়ে গেছে। যেমন—

‘ছিপখান তিন-দাঁড় তিনজন মাল্লা…

চৌপর দিন-ভর দেয় দৌড়-পাল্লা!..’

এই যে ছন্দের দোলা- স্বরবৃত্ত এবং স্বরমাত্রিক ছন্দকে ব্যবহার করার অসাধারণ দক্ষতা, যা আমাদের দৈনন্দিন কর্ম জীবনকে কবিতায় ধারণ করতে পেরেছে। এই জন্য কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মানবিক রচনা, দেশাত্মবোধক কবিতা এবং অনুবাদ সাহিত্য চর্চা জরুরি।

অনুবাদক হিসেবে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

অনুবাদ সাহিত্যের ক্ষেত্রে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। তিনি বোদলেয়ার অনুবাদ করছেন, পল ভারলেন অনুবাদ করছেন, ইংরেজ কবিদের কবিতা অনুবাদ করছেন। একই সঙ্গে কুরআন শরীফ থেকে অনুবাদ করছেন, হাদিস নিয়ে অনুবাদ করছেন। আবার পারস্যের কবিদের কবিতার অনুবাদ করছেন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের একটি কবিতা আমাদের মুখে মুখে ফেরে। যদিও সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত নিজেই বলেছেন, এই কবিতাটি তিনি হাদিস থেকে রচনা করেছেন।

‘‘জোটে যদি মোটে একটি পয়সা খাদ্য কিনিয়ো ক্ষুধার লাগি..’

আবার সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কুরআনের সূরা ‘আদ দোহা’র অনুবাদ করেছেন। এটি এত ভালো অনুবাদ হয়েছে, যার দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না! সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অনুবাদ করা সুরা আদ দোহা—

‘মধ্যদিনের আলোর দোহাই,

নিশার দোহাই ওরে

প্রভু তোরে ছেড়ে যাননি কভু

ঘৃণা না করেন তোরে।

পথ ভুলেছিলি তিনি সুপথ

দেখায়ে দেছেন তোরে,

সে কৃপার কথা স্মরণে রাখিস;

অসহায় জনে ওরে।’

শুধু তাই নয় ফার্সি ভাষার শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ গুলিস্তানের বিখ্যাত কবি শেখ সাদীর কবিতার অনুবাদ করেছেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর অনুবাদের একটি অংশ—

‘কুকুরের কাজ কুকুর করেছে কামড় দিয়েছে পায়,

তা ব’লে কুকুরে কামড়ানো কি রে মানুষের শোভা পায়?’

বিদেশি কবিতার ভাষান্তরে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলা ভাষার উপর অধিকার বিশেষভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনটি অনুবাদগ্রন্থে পাঁচশোর বেশি কবিতা তিনি অনুবাদ করেছেন। তাঁর কবি স্বভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কবিতার ভাষান্তর আশ্চর্য সাফল্য লাভ করেছে। বাঙালি কবিদের মধ্যে অনুবাদ কর্মকে তাঁর মতো আন্তরিক নিষ্ঠাভরে গ্রহণ করতে খুব বেশি দেখা যায় না। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, ‘বিশ্বমানবের নানা বেশ, নানা মূর্তি ও নানাভাবের সহিত পরিচয় সাধন।’ 

রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন,

‘তোমার এই অনুবাদগুলি যেন জন্মান্তর প্রাপ্তি-আত্মা এক দেহ হইতে অন্য দেহে সঞ্চারিত হইয়াছে- ইহা শিল্পকার্য নহে, ইহা সৃষ্টি কার্য।’ তখন তার মধ্যে কোন অতিশয়োক্তি নেই।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কিছু অনুবাদ হলো— তীর্থ সলীল (১৯০৮), তীর্থ রেণু (১৯১০), ফুলের ফসল (১৯১১)।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছদ্মনাম

নবকুমার, কবিরত্ন, অশীতিপর শর্মা, ত্রিবিক্রম বর্মন, কলমগীর প্রভৃতি ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত।

শেষকথা

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত শ্রুতিমধুর সূক্ষ্মতায় ও বিশ্লেষণী বুদ্ধিতে বাংলা কবিতায় কেবল ছন্দ নয়, কবিতার ক্ষেত্রকেও অনেকখানি প্রসারিত করতে পেরেছিলেন। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁর এই ঐতিহাসিক ভূমিকাকে সাহিত্য সমালোচকদের স্বীকার না করে কোনো উপায় নেই। তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্থান পাওয়ার জন্য কবিতা লেখেননি, তিনি কবিতা লিখে বাঙালির হৃদয়ে স্থান পেতে চেয়েছেন।

‘কোন দেশেতে তরুলতা

সকল দেশের চাইতে শ্যামল?

কোন দেশেতে চলতে গেলেই’

এই কবিতা যে কবি লিখতে পারেন, তিনি মৃত্যুর শতবর্ষ পরেও যে প্রাসঙ্গিক থাকবেন, সে কথা বলাই বাহুল্য।

বিষয়:

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ও তাঁর প্রাসঙ্গিকতা

প্রকাশ: ১০:৪৮:২৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১ অগাস্ট ২০২২

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের জন্ম ১১ ফেব্রুয়ারি ১৮৮২ সালে। তাঁর পৈর্তৃক নিবাস বর্ধমান-এর চুপী গ্রামে। তাঁর পিতামহ (দাদা) অক্ষয় কুমার দত্ত ছিলেন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জনপ্রিয় কবি ও ছড়াকার সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর কবিতায় নানা ভাষার শব্দ নিপুণ ছন্দে যুক্ত হয়েছে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন রবীন্দ্রযুগের খ্যাতনামা ‘ছন্দোরাজ’ কবি। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে ১৯২২ সালের ২৫ জুন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত পরলোকগমন করেন।

বাংলা সাহিত্যে সত্যেন্দ্রনাথ খুবই গুরুত্বপূর্ণ

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মৃত্যুর শতবর্ষ হলো কিন্তু তাকে নিয়ে বিশেষ কোনো আয়োজন চোখে পড়ে না। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সাহিত্য পত্র-পত্রিকা এবং কবি-সাহিত্যিকরা অদ্ভুতভাবে নীরব।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরে এবং কাজী নজরুল ইসলামের আগে যে দু-একজন কবি নানা কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁদের একজন। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, তাঁর কবিতা ও সাহিত্য, বিশেষ করে বিষয় এবং শৈলীর ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যে যথেষ্ট রকম নতুন প্রাণ দান করেছিল। মৃত্যুর শতবর্ষ পরেও এখনো বাংলা সাহিত্যে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি এবং প্রাসঙ্গিক। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মূল বিষয়টি হলো বাংলা সাহিত্যের বিষয় কেন্দ্রিক যে বিবর্তন বা শৈলী কেন্দ্রিক বিবর্তন, সেখানে আমাদের মনে কয়েকটি বিষয় রাখতে হবে।

সত্যন্দ্রনাথ দত্তকে মনেপ্রাণে ধারণ করতেন কাজী নজরুল ইসলাম

কল্লোল যুগের আগে, এমন কী কাজী নজরুল ইসলামের আগে মানবতা কেন্দ্রিক সাহিত্য রচনার যে জরুরি বিষয়টি ছিল আধুনিকতার ক্ষেত্রে, যৌক্তিক ক্ষেত্রে, বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে, সেটি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত শুরু করেছিলেন। এমনকী নজরুলের আবির্ভাবে যে দু-একজন কবি প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত প্রধানতম। এটি নজরুল ব্যাপকভাবে স্মরণ করেছেন। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে কেন্দ্র করে নজরুল চাকরিও ছেড়েছিলেন। ভালোবাসার প্রতিদান জানাতে গিয়ে, কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত মারা যাওয়ার পর কাজী নজরুল ইসলাম একটি আবেগপ্রবণ সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখেছিলেন মাওলানা আকরাম খাঁ সম্পাদিত ‘সেবক’ পত্রিকায়। এই লেখাটিতে এতটাই আবেগঘন বিষয় ছিল, যা আবুল কালাম শামসুদ্দীন এবং এস ওয়াজেদ আলী সেটিকে কিছুটা সংশোধন করেছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, নজরুলের এই সম্পাদকীয় রচনার মধ্যে অতিরিক্ত আবেগ এবং বেশি হিন্দুয়ানী শব্দ রয়েছে, যা মাওলানা আকরাম খাঁ পছন্দ করবেন না। কিংবা তাঁদের নিজেদের হয়তো পছন্দ হয়নি। সংশোধিত সম্পাদকীয়টি প্রকাশিত হওয়ার পর কাজী নজরুল ইসলাম আর সেবক পত্রিকায় ফিরে যাননি। তখন নজরুল ইসলামের বয়স খুব বেশি নয়। তখনও তিনি ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখেননি। তখনও কাজী নজরুল ইসলামের কবি হিসেবে সে রকম নামযশ হয়নি। তার পরেও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রতি গভীর ভালোবাসার টানে তিনি এই চাকরি ছাড়ার ঝুঁকি নিয়েছিলেন।

কাজী নজরুল ইসলামের কবি হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে যে সমস্ত কবি-সাহিত্যিক অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কবি ইসমাইল সিরাজী বা শুরুতে কবি মোহিতলাল মজুমদার। এই তিনজন কবি নজরুলের ‘কবি নজরুল’ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

কাজী নজরুলের কবিতার বিষয়ের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, তিনি বিষয়ের ক্ষেত্রে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে বেশি অবলম্বন করেছিলেন। শুধু তাই নয়— কবি নজরুল ইসলাম সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে নিয়ে চারটি কবিতা এবং একটি গান লিখেছিলেন। একটি দীর্ঘ কবিতায় তিনি লিখেছেন—

‘যশ লোভী এই অন্ধ ভণ্ড স্বজ্ঞান ভীরু

দলে তুমি একাকী রণ দুন্দুভি বাজালে গভীর রোলে!’

রবীন্দ্রযুগে স্বতন্ত্র সত্যেন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বীকৃতি

কবিতায় ছন্দের কারুকাজ, শব্দ ও ভাষা যথোপযুক্ত ব্যবহারের কৃতিত্বের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে ‘ছন্দের যাদুকর’ নামে আখ্যায়িত করেন। তিনি ছিলেন ‘ভারতী’ পত্রিকাগোষ্ঠীর অন্যতম কবি। প্রথম জীবনে তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, অক্ষয় কুমার বড়োাল প্রমুখের দ্বারা প্রভাবিত হন। পরে রবীন্দ্র অনুসারী হলেও তিনি স্বতন্ত্র হয়ে ওঠেন।

বাংলা শব্দের সঙ্গে আরবি-ফার্সি শব্দের সমন্বিত ব্যবহার দ্বারা বাংলা কাব্যভাষার শক্তি বৃদ্ধির প্রাথমিক কৃতিত্ব ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের। অনুবাদের মাধ্যমে তিনি বিশ্বের কাব্যসাহিত্যের সঙ্গে বাংলার যোগাযোগ ঘটান।

দেশাত্মবোধ, মানবপ্রীতি, ঐতিহ্যচেতনা, শক্তিসাধনা প্রভৃতি তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু। আরবি-ফার্সি, চিনা, জাপানি, ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষার বহু কবিতা অনুবাদ করে বাংলাসাহিত্যের বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধি সাধন করেন।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা মূলত প্রবাসী ভারতীয় পত্র— বাণী বিচিত্রা, বঙ্গলক্ষ্মী, দেশ ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের রচিত কাব্যগ্রন্থ গুলি হলো— সবিতা (১৯০০), সন্ধিক্ষণ (১৯০৫), বেণু ও বীণা (১৯০৬), হোমশিখা (১৯০৭)।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মৃত্যুর পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন—

‘তুমি বঙ্গভারতীর তন্ত্রী-পরে একটি অপূর্ব তন্ত্র এসেছিলে পরাবার তরে এ শুধু প্রিয়জনের প্রশংসা নয়, এ এক ঐতিহাসিক সত্য।’

প্রখ্যাত সাহিত্যিক, বিজ্ঞানানুরাগী, ইতিহাস প্রেমিক পিতামহ অক্ষয় কুমারের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি সাহিত্যিক প্রতিভা, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি ও ইতিহাস প্রিয়তা লাভ করেছিলেন। যে যুগে তাঁর আবির্ভাব, সে যুগ ছিল তাঁর মনবিকাশের অনুকূল। এই পরিবেশে জন্মগ্রহণ করে বৈজ্ঞানিক ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিকদের উত্তরাধিকারী সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বিশেষ করে সে যুগেরই সন্তান হয়ে উঠলেন। তিনি স্বদেশকে ভালোবাসলেন। স্বদেশের দুঃখ-দুর্দশা তাঁর প্রাণে বড়ো গভীর করে বাজল। তিনি উপলব্ধি করলেন মানুষে মানুষে একাত্মবোধ জাগাতে হবে সবার আগে। এর জন্য চাই জ্ঞান আর প্রেম। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি মানবতার জয়গান গেয়েছেন। ভারতবাসীকে তাঁর মহিমা উজ্জ্বল ঐতিহ্য স্মরণ করে দিয়েছেন। 

বিশ্বপ্রেমিক, মানবতার পূজারী ও সাম্যবাদী সত্যেন্দ্রনাথ মুক্তকণ্ঠে গেয়ে গেছেন—

‘জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে সে জাতির নাম মানুষ জাতি…’

হিন্দু মুসলমানের বিরোধ তাঁর অন্তরকে ব্যথিত করত। সে যুগের হিন্দু-মুসলিম মিলনকামী মহাপুরুষদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মধ্যে বহুমুখী চৈতন্যের প্রকাশ ঘটেছিল। রবীন্দ্রনাথ কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের এই প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সম্পর্কে বলে—

‘আমি মুক্তকণ্ঠে বিন্দুমাত্র বিনয় প্রকাশ না করে বলিতেছি যে, বাংলা ভাষা ও ছন্দে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের যে অসামান্য অধিকার ছিল তাহা আর-কাহারো সঙ্গে তুলনীয় নহে।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে ছন্দের জাদুকর বলার পরে অনেকেই সেটির ভুল ব্যাখ্যা করেছেন। কবি মোহিতলাল মজুমদার এবং কবি বুদ্ধদেব বসু কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার সমালোচনা করে বলেছেন—

‘তাঁর কবিতায় কেবল শব্দের ঝংকার, কোন প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি।’

যদিও বেশির ভাগ সাহিত্য সমালোচকরা মনে করেন, এই সমালোচনা কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ক্ষেত্রে যথার্থ নয়। 

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের যে সমস্ত দেশাত্মবোধক কবিতা, মানবিক কবিতা এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে, কবিতায় যদি কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে না পারতেন তাহলে মৃত্যুর শতবর্ষ পরেও তাঁর কবিতা মানুষের মনে এভাবে দাগ কেটে থেকে যেত না। আর শব্দের ঝংকার কবিতা রচনার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ শৈলী। ছন্দের ঝংকারের কারণেই শৈশবে পড়া কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা আজও মনে গেঁথে রয়ে গেছে। যেমন—

‘ছিপখান তিন-দাঁড় তিনজন মাল্লা…

চৌপর দিন-ভর দেয় দৌড়-পাল্লা!..’

এই যে ছন্দের দোলা- স্বরবৃত্ত এবং স্বরমাত্রিক ছন্দকে ব্যবহার করার অসাধারণ দক্ষতা, যা আমাদের দৈনন্দিন কর্ম জীবনকে কবিতায় ধারণ করতে পেরেছে। এই জন্য কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মানবিক রচনা, দেশাত্মবোধক কবিতা এবং অনুবাদ সাহিত্য চর্চা জরুরি।

অনুবাদক হিসেবে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

অনুবাদ সাহিত্যের ক্ষেত্রে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। তিনি বোদলেয়ার অনুবাদ করছেন, পল ভারলেন অনুবাদ করছেন, ইংরেজ কবিদের কবিতা অনুবাদ করছেন। একই সঙ্গে কুরআন শরীফ থেকে অনুবাদ করছেন, হাদিস নিয়ে অনুবাদ করছেন। আবার পারস্যের কবিদের কবিতার অনুবাদ করছেন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের একটি কবিতা আমাদের মুখে মুখে ফেরে। যদিও সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত নিজেই বলেছেন, এই কবিতাটি তিনি হাদিস থেকে রচনা করেছেন।

‘‘জোটে যদি মোটে একটি পয়সা খাদ্য কিনিয়ো ক্ষুধার লাগি..’

আবার সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কুরআনের সূরা ‘আদ দোহা’র অনুবাদ করেছেন। এটি এত ভালো অনুবাদ হয়েছে, যার দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না! সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অনুবাদ করা সুরা আদ দোহা—

‘মধ্যদিনের আলোর দোহাই,

নিশার দোহাই ওরে

প্রভু তোরে ছেড়ে যাননি কভু

ঘৃণা না করেন তোরে।

পথ ভুলেছিলি তিনি সুপথ

দেখায়ে দেছেন তোরে,

সে কৃপার কথা স্মরণে রাখিস;

অসহায় জনে ওরে।’

শুধু তাই নয় ফার্সি ভাষার শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ গুলিস্তানের বিখ্যাত কবি শেখ সাদীর কবিতার অনুবাদ করেছেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর অনুবাদের একটি অংশ—

‘কুকুরের কাজ কুকুর করেছে কামড় দিয়েছে পায়,

তা ব’লে কুকুরে কামড়ানো কি রে মানুষের শোভা পায়?’

বিদেশি কবিতার ভাষান্তরে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলা ভাষার উপর অধিকার বিশেষভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনটি অনুবাদগ্রন্থে পাঁচশোর বেশি কবিতা তিনি অনুবাদ করেছেন। তাঁর কবি স্বভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কবিতার ভাষান্তর আশ্চর্য সাফল্য লাভ করেছে। বাঙালি কবিদের মধ্যে অনুবাদ কর্মকে তাঁর মতো আন্তরিক নিষ্ঠাভরে গ্রহণ করতে খুব বেশি দেখা যায় না। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, ‘বিশ্বমানবের নানা বেশ, নানা মূর্তি ও নানাভাবের সহিত পরিচয় সাধন।’ 

রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন,

‘তোমার এই অনুবাদগুলি যেন জন্মান্তর প্রাপ্তি-আত্মা এক দেহ হইতে অন্য দেহে সঞ্চারিত হইয়াছে- ইহা শিল্পকার্য নহে, ইহা সৃষ্টি কার্য।’ তখন তার মধ্যে কোন অতিশয়োক্তি নেই।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কিছু অনুবাদ হলো— তীর্থ সলীল (১৯০৮), তীর্থ রেণু (১৯১০), ফুলের ফসল (১৯১১)।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছদ্মনাম

নবকুমার, কবিরত্ন, অশীতিপর শর্মা, ত্রিবিক্রম বর্মন, কলমগীর প্রভৃতি ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত।

শেষকথা

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত শ্রুতিমধুর সূক্ষ্মতায় ও বিশ্লেষণী বুদ্ধিতে বাংলা কবিতায় কেবল ছন্দ নয়, কবিতার ক্ষেত্রকেও অনেকখানি প্রসারিত করতে পেরেছিলেন। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁর এই ঐতিহাসিক ভূমিকাকে সাহিত্য সমালোচকদের স্বীকার না করে কোনো উপায় নেই। তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্থান পাওয়ার জন্য কবিতা লেখেননি, তিনি কবিতা লিখে বাঙালির হৃদয়ে স্থান পেতে চেয়েছেন।

‘কোন দেশেতে তরুলতা

সকল দেশের চাইতে শ্যামল?

কোন দেশেতে চলতে গেলেই’

এই কবিতা যে কবি লিখতে পারেন, তিনি মৃত্যুর শতবর্ষ পরেও যে প্রাসঙ্গিক থাকবেন, সে কথা বলাই বাহুল্য।