মঙ্গলবার, অক্টোবর ৩, ২০২৩

কল্লোল পত্রিকা, কল্লোল গোষ্ঠী এবং কল্লোল যুগ

কল্লোল যুগের কবিতার ক্ষেত্রে যাদের নাম কল্লোল যুগের শ্রেষ্ঠ নায়ক বিবেচনায় প্রচারিত তারা হলেন কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে। এই পাঁচজন বিশিষ্ট কবিকে একসাথে বলা হয় বাংলা সাহিত্যের পঞ্চপাণ্ডব। কল্লোল পত্রিকার প্রথম সম্পাদক— শ্রী দীনেশচন্দ্র দাশ।

For all latest articles, follow on Google News

‘কল্লোল’ হলো একটি সাহিত্য-পত্রিকা, যা অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের কলকাতা থেকে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়। ‘কল্লোল’ পত্রিকাটি ১৯২৩ থেকে ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ভেতরে সংগঠিত প্রভাবশালী বাংলা সাহিত্য বিপ্লবের সমনামিক। কল্লোল যে সকল নব্য-লেখকদের প্রধান মুখপাত্র ছিল, যাদের অন্যতম ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, কাজী নজরুল ইসলাম, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ। অন্যান্য সাময়িক পত্রিকা যেগুলো কল্লোল পত্রিকাকে অনুসরণ করে সেগুলো হলো– উত্তরা (১৯২৫), প্রগতি (১৯২৬) এবং কালিকলম (১৯২৬)।

কল্লোল পত্রিকার কার্তিক ১৩৩৮ সংখ্যার প্রচ্ছদ। সম্পাদক— শ্রী দীনেশচন্দ্র দাশ।

কল্লোল পত্রিকার ইতিহাস

১৯২৩ সালে প্রবর্তিত কল্লোল পত্রিকার কর্ণধার ছিলেন শ্রী দীনেশরঞ্জন দাশ ও গোকুলচন্দ্র নাগ।

১৯২১ খ্রিস্টাব্দে গোকুলচন্দ্র নাগ, দীনেশরঞ্জন দাশ, সুনীতা দেবী এবং মনীন্দ্রলাল বসু প্রমুখ কলকাতার হাজরা রোডে ‘ফোর আর্টস ক্লাব’ (Four Arts Club) নামে একটি ক্লাবের সূচনা করেন। ফোর আর্টস ক্লাবের উদ্দেশ্য ছিল সাহিত্য, ললিত কলা, সংগীত ও নাটক সৃষ্টি ও চর্চা করা।

১৯২২ সালে ‘ঝড়ের দোলা’ নামে ফোর আর্টস ক্লাব থেকে প্রথমে চার সদস্য একটি ছোটোগল্পের সংকলন বের করেন। পরের বছর অর্থাৎ ১৯২৩ সালে দীনেশরঞ্জন দাশ এবং গোকুলচন্দ্র নাগ একটি সাময়িক পত্র প্রকাশ করেন, ওই সাময়িক পত্রিকার নাম দেন ‘কল্লোল’। কল্লোল পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন শ্রী দীনেশরঞ্জন দাশ

প্রতিদিন সাহিত্য আলোচনার আড্ডার জন্য দিনেশচন্দ্রের পটুয়াতলা লেনের বাড়িটি নির্দিষ্ট ছিল।

কল্লোল পত্রিকার আবহে সমসাময়িক আরও কিছু পত্রিকা হলো— ‘প্রগতি’, ‘উত্তরা’, ‘কালিকলম’, ‘পূর্বাশা’ ইত্যাদি। অন্যদিকে আধুনিকতার নামে যথেচ্ছাচারিতা ও অশ্লীলতার প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে অভিযোগ এনে ‘শনিবারের চিঠি’ নামের আরেকটি পত্রিকা এনে ভিন্ন বলয় গড়ে তোলেন মোহিতলাল মজুমদার, সজনীকান্ত দাস ও নীরদ চৌধুরী।

বাংলা সাহিত্যে কল্লোল গোষ্ঠী

১৯২৩ সাল থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত ‘কল্লোল’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে ও আধুনিকতাকে লালন করে যে সকল সাহিত্যিক সাহিত্যের চর্চা করেন তাদেরকে বলা হয় বাংলা সাহিত্যের কল্লোল সাহিত্যগোষ্ঠী। কল্লোল সাহিত্যগোষ্ঠীর সিংহভাগ ছিল তরুণ এবং সাহিত্যে নতুন।

কল্লোল সাহিত্যগোষ্ঠী সম্ভবত বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক নবজাগরণের সূচনা করে। যদিও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিছক মানবপ্রেমী সাহিত্যের বৃত্ত থেকে দূরে সরে গিয়ে আধুনিক সাহিত্যের এই ঝড়কে সাধারণ পাঠকরা খুব সহজে মেনে নেয়নি।

সেই সময়ের আরেক বিখ্যাত সাময়িক পত্র ‘শনিবারের চিঠি’র সাথে ‘কল্লোল’ গোষ্ঠীর বেশ কিছু বছর ধরে চলেছিল বিখ্যাত সাহিত্যের লড়াই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও এই বিতর্কে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং কল্লোল পত্রিকায় বেশ কিছু রচনা লিখেছিলেন। কল্লোল পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন যে, তিনি নব্য সাহিত্যের ওই উদ্যোগের প্রশংসা করলেও বাস্তবমুখী সাহিত্যকে মানুষের আদিম ইচ্ছার বশবর্তী করে আনার সারশূন্যতা তাকেও অস্বীকার করেননি। এখানে উল্লেখ্য যে তিনি তার শেষের কবিতা উপন্যাসের অমিত রায়ের বক্তব্যের মাধ্যমে নিজেকে অর্থাৎ মানবিক সাহিত্যস্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের লেখার সমালোচনা করেছিলেন।

কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকরা সিগমুন্ড ফ্রয়েড এবং কার্ল মার্ক্স-এর প্রভাবে প্রভাবিত ছিলেন। কল্লোল সাহিত্যগোষ্ঠীর সাহিত্য আলোচনা সে সময়ের বহু বিখ্যাত প্রগতিশীল সাহিত্যিকদের ভাবনাকে প্রভাবিত করেছিল এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। নিয়মিত না হলেও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এই গোষ্ঠীর আলোচনায় মাঝে মাঝে যোগ দিতেন। প্রখ্যাত বাঙালি অনুবাদক পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় কল্লোল পত্রিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন।

কল্লোল পত্রিকায় লেখার সময় কাজী নজরুলের বয়স ছিল ২৫ বছর, প্রেমেন্দ্র মিত্রের বয়স ছিল ১৯ বছর এবং বুদ্ধদেব বসুর বয়স ছিল ১৫ বছর।

কল্লোল যুগ

‘কল্লোল’ সাহিত্য পত্রের সময়কালকে কল্লোল যুগ হিসাবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। কল্লোল পত্রিকাকে কেন্দ্র করে ১৯২৩ থেকে ১৯২৯ খ্রীস্টাব্দ কাল-পরিধিতে বাংলা সাহিত্যে প্রভাবশালী আন্দোলন সংগঠিত হয়। বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাতে এই আন্দোলনের ভূমিকাই মুখ্য বলে বিবেচিত। কল্লোল যুগ বলতে বাঙলা সাহিত্যের একটি ক্রান্তি লগ্নকে বোঝায় যখন বাংলা কবিতা ও কথাসাহিত্যে পাশ্চাত্য সাহিত্যের অনুকরণে আধুনিকতার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল। কল্লোল যুগের নাবিকদের মূল লক্ষ্য ছিল রবীন্দ্রবৃত্তের বাইরে সাহিত্যের একটি মৃত্তিকাসংলগ্ন জগৎ সৃষ্টি করা।

কাজী নজরুল ইসলাম কল্লোল যুগের অন্যতম প্রধান কবি ছিলেন তবে কল্লোল যুগের কবিতার ক্ষেত্রে যাদের নাম কল্লোল যুগের শ্রেষ্ঠ নায়ক বিবেচনায় প্রচারিত হয় তারা হলেন কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, জীবনানন্দ দাশ এবং বিষ্ণু দে; এই পাঁচজন বিশিষ্ট কবিকে একসাথে বলা হয় বাংলা সাহিত্যের পঞ্চপাণ্ডব বলা হয়। এ পঞ্চপাণ্ডবই ছিলেন মূলত কল্লোল যুগের কাণ্ডারি। তবে কাজী নজরুল ইসলাম, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, সঞ্জয় ভট্টাচর্য, অবনীনাথ রায় প্রমুখ অনেকেরই ভূমিকা কোন অংশে খাটো করে দেখবার উপায় নেই।

কল্লোল যুগ নিয়ে কল্লোল যুগ নামে বই লিখেছেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। অচ্যিন্তকুমার সেন রচিত কল্লোল যুগ এ বিষয়ে একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ।

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত রচনা করেন ‘কল্লোল যুগ’ গ্রন্থ

কল্লোল যুগের বৈশিষ্ট্য

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে ১৯৩০-এর দশক কল্লোল যুগের সমার্থক। কবি বুদ্ধদেব বসু এই নবযুগের অন্যতম কাণ্ডারী। যে সময়ে কল্লোলের আবির্ভাব তখন বাঙলা সাহিত্যের দিগন্ত সর্বকোণে কবি রবীন্দ্রনাথের প্রভাবে প্রোজ্জ্বল।

  • পাশ্চাত্য সাহিত্যকে অনুকরণ করে সাহিত্য রচনা করা শুরু হয় কল্লোল যুগে।
  • কল্লোল যুগের কবিদের মূল লক্ষ্য ছিল রবীন্দ্র বৃত্তের বাইরে সাহিত্যের একটি মৃত্তিকাসংলগ্ন জগৎ সৃষ্টি করা।
  • কল্লোল যুগের একটি প্রধান বৈশিষ্ট ছিল রবীন্দ্র বিরোধিতা।
  • আধুনিকতার নামে যথেচ্ছাচারিতা ও অশ্লীলতার প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছিল বলে অভিযোগ ছিল।

কল্লোল যুগের কবিতার ক্ষেত্রে যাদের নাম কল্লোল যুগের শ্রেষ্ঠ নায়ক বিবেচনায় প্রচারিত তারা হলেন কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে। এই পাঁচজন বিশিষ্ট কবিকে একসাথে বলা হয় বাংলা সাহিত্যের পঞ্চপাণ্ডব।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

এ বিষয়ের আরও নিবন্ধ