রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত কী? রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের কারণ, শর্ত ও ফলাফল কী?
- প্রকাশ: ০১:৩৮:২০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২২
- / ২৬৪২৮ বার পড়া হয়েছে
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যতগুলো সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন ঘটায় সেগুলোর মধ্য একটি হলো রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত। এখানে খুবই সংক্ষেপে রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত (The Ryotwari System) সম্পর্কে উল্লেখ করা হলো।
এখানে যা আছে
রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত কী
রায়ত শব্দের অর্থ হলো ‘চাষী’ ও ‘প্রজা’। জমিদার কিংবা শাসকের অধীন কোনো জমির দখল-স্বত্ব বিশিষ্ট প্রজাদের বলা হয় রায়ত।
রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত হলো ভারতে ১৮২০ সালে প্রবর্তিত এক ধরনের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থাপনা।
আঠারো শতকে দিকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শুধু মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি বাদে দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় স্যার টমাস মনরাের এবং বােম্বাই প্রদেশে লিফিনস্টোনের নেতৃত্বে এক ধরনের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করে, যা রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত নামে পরিচিতি লাভ করে। রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত চালু হয় ১৮২০ সালে।
রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের কারণ
রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত চালু করার পেছনে কারণ ছিল দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনে সুনির্দিষ্ট কিছু অসুবিধা বা বাধা।
রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের দুইটি প্রধান কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
- দক্ষিণ ভারতে জমিদারশ্রেণির অপ্রতুলতা
- সংখ্যায় অল্প হলেও দক্ষিণ ভারতের জমিদারগণ ব্রিটিশবিরোধী ভূমিকা নিয়েছিল
রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের শর্তাবলি
- কৃষক ও সরকারের মধ্যে সরাসরি ভূমি বন্দোবস্ত ব্যবস্থা, যেখানে সকল জমির মালিক সরকার। অর্থাৎ কৃষকদের জমির মালিকানা স্বত্ব ছিল না।
- নির্দিষ্ট রাজস্বের বিনিময়ে কৃষকরা জমির ভােগদখলি স্বত্ব লাভ করে।
- ২০ থেকে ৩২ বছর পর পর কৃষকদের সাথে আলোচনা করে সরকার ভূমিরাজস্বের পরিমাণ বাড়াবে হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
- রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারিত হয় মােট উৎপাদিত ফসলের ৪৫ থেকে ৫৫ শতাংশ।
- জমি জরিপের মাধ্যমে এবং উৎপাদনের মাপকাঠিতে জমিকে ৯ ভাগে ভাগ করা হয়।
- বন্যা, খরা বা যে-কোনো প্রকারের দুর্যোগের কারণে শস্যহানি হলেও কৃষকরা খাজনা দিতে বাধ্য থাকত।
রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের ফলাফল
রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের সুফল
- রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া সরকারের সঙ্গে রায়তদের সরাসরি সম্পর্ক গড়ে ওঠায় প্রশাসনিক জটিলতা হ্রাস পায় ও জমি সংক্রান্ত ভুল বােঝাবুঝি অনেকাংশেরই অবসান ঘটে।
- রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত প্রবর্তন করার ফলে মধ্যস্বত্বভােগীর কোনাে অস্তিত্ব না থাকায় কৃষকরা অন্যায় জোরজুলুম ও অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পায়।
- জমিদাররা ইচ্ছেমতো মতাে কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারত না।
- রায়তওয়ারি বন্দোবস্তে ফলে বেশিরভাগ রায়তেরই ভূমিদাস রাখার ক্ষমতা না থাকায় ভূমিদাস প্রথার অবসান ঘটে।
রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের কুফল
- রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত চালু হওয়ার পর থেকেই বেশিরভাগ কৃষক সরাসরি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের হাতে শােষিত ও অত্যাচারিত হতো।
- রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত ব্যবস্থাতে জমির ওপর কৃষকের মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
- ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কৃষক প্রজাদের কাছ থেকে অধিক হারে (শতকরা ৪৫ থেকে ৫৫ ভাগ) রাজস্ব আদায় করত।
- রায়তওয়ারি বন্দোবস্তে খাজনার হার অত্যন্ত বেশি হওয়ায় কোম্পানিকে খাজনা দেওয়ার পর কৃষকের হাতে অবশিষ্ট যা থাকত তা দিয়ে সারাবছর জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন ছিল।
- বন্যা, খরার কিংবা যে-কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে শস্যহানি ঘটলেও প্রজারা খাজনা বা রাজস্ব দিতে বাধ্য থাকত; এর ফলে প্রজারা জমিরক্ষার তাগিদে সাউকার ও মহাজনদের কাছে ঋণ নিয়ে দেনায় আকণ্ঠ ডুবে থাকত।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, স্বাধীনতার পরে ভারতে ‘রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০’ আইনের মাধ্যমে রায়তরা জমির প্রকৃত মালিকে পরিণত হয়।