১১:৫৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

ইসলামপূর্ব চীনে ধর্ম ও বিশ্বাস

মুসা আল হাফিজ
  • প্রকাশ: ০১:৪৪:৩৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ জুন ২০২৩
  • / ৭৪২ বার পড়া হয়েছে

চীনে একটি মসজিদ

চীনা সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্রে ছিল ধর্মের অবস্থান। ধর্মের প্রাণকেন্দ্রে ঈশ্বর ছিলেন না। কিন্তু মানুষকে কেউ সৃষ্টি করেছেন। প্রথমে যাকে সৃষ্টি করা হলো, তার নাম ‘পাং-কু’। পাং-কুণ্ডএর সৃষ্টি বা উৎপত্তির ১০ লাখ বছর পরে চীনে ১০টি রাজবংশ রাজত্ব করেছিল। প্রথমে রাজত্ব করেছিল দেবতারা, তারপর দ্বিতীয় রাজত্ব করেছিল তার উপদেবতারা, আর তৃতীয় রাজত্ব করেছেন নর বা মানুষরা, চতুর্থ রাজত্ব করেন জুচানরা, পঞ্চম রাজত্ব করেন সুইজন বা অগ্ন্যুৎপাদকদের রাজত্ব ইত্যাদি। চীনে রাজা বা শাসকের মহিমা তাই অনেক। এখানকার ধর্মে সেই মহিমা স্বীকৃত ছিল প্রবলভাবে।

চীনা নীতিধর্মের প্রাণকেন্দ্রে ছিল কিছু সামাজিক সম্বন্ধ। এগুলো হচ্ছে- তিন বন্ধন (সান কাং) ছয় স্তর (লুচি) পাঁচ আত্মীয়তা (উ লুন) এবং নয় পুরুষ (চিউ সু)। সান কাং-এর বন্ধনগুলো পবিত্র। তা রক্ষা করতে হবে, সম্মান করতে হবে তাকে। এই বন্ধনের প্রথমটি হলো রাজা ও প্রজার বন্ধন, এর পরেরটা সন্তান ও মা-বাবার বন্ধন। তিন নম্বরে আছে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। ‘লু-চি’ বা ছয় বিভাগ হলো (১) ভাই ও বোন, (২) বাবা ও দাদা, (৩) বংশপরম্পরা, (৪) মা ও নানা, (৫) গুরু ও শিষ্য আর (৬) বন্ধু ও বান্ধবী। ‘উ-লুন’ ও ‘চিও-ৎসু’ হলো বর্তমান ও ঊর্ধ্বতন পুরুষদের নিয়ে।

এসব সম্বন্ধে আবদ্ধ চীনারা অনেক নীতিপালনের মধ্য দিয়ে ধর্মাচরণের সূচনা করেছিল। এখানে পরিবার ছিল সবকিছুর কেন্দ্রে এবং পরিবারের প্রতি ভক্তি অন্যান্য সামাজিক সম্পর্ককে আলোদান করত। পূর্বপুরুষকে পূজা করত চীনারা। কারণ শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য এর বিকল্প নেই। তারা অবলম্বন করত মানবকেন্দ্রিক গুণাবলি। কনফুসিয়ানিজমের সুবর্ণ নিয়ম হলো, যে কাজ আপনি নিজের জন্য পছন্দ করেন না, সেটা অন্যের সঙ্গে করবেন না। বিদ্যা নিয়েও নিজস্ব ঐতিহ্য ছিল চীনে। চীনারা মনে করত খ্রিষ্টের জন্মের দুই হাজার বছর আগে তারা ছয় প্রকার বিদ্যায় প্রাজ্ঞ ছিল। সেগুলো হচ্ছে লি (সদাচার) য়ো (সংগীত) শে (তিরন্দাজি) য়ু (গন্তব্যপ্রদর্শন) শু (রচনা) এবং সু (গণিত)।

কনফুসিয়াস ও অন্যান্য চীনা মনীষীরা সুখের উপায়কে সজ্জিত করেছিলেন। সুখী হওয়ার জন্য তারা শেখান উং চাং বা পাঁচ কর্মনীতি। সেগুলো হলো ই, লি, রেন, ঝি এবং সিন। ‘ই’ হলো সততা এবং ন্যায়পরায়ণতা, ‘লি’ হলো সদাচার ও ভদ্রতা, ‘রেন’ হলো দানশীলতা ও মানবতা, ‘ঝি’ হলো জ্ঞান ও শিক্ষা এবং ‘সিন’ হলো বিশ্বস্ততা ও আনুগত্য। সবকিছু মিলে তৈরি হয়েছিল নীতিদর্শনের একটি আকার ও বিধান বা ‘লি’। লি কথাটি কনফুসিয় নীতিধর্মে মৌলিক এক পরিভাষা। ‘লি’ দ্বারা বুঝানো হয় বিধান, বস্তু, জগতের শৃঙ্খলা, আকার ইত্যাদিকে। সৎ ব্যবহার, ভারসম্যপূর্ণ আচরণ ও ভদ্রতা বুঝাতে এর ব্যবহার হয়। গোটা দর্শনের কেন্দ্রে যার অবস্থান। ভদ্রতা বলতে কনফুসিয়াস সুশিং বা চার গুণের সমাবেশকেই বুঝতেন। সেগুলো হচ্ছে- শিয়াও-মহানুভবতা, তি-ভ্রাতৃত্ব, চুং- সৎ বিশ্বাস, শিন-সত্যনিষ্ঠা। ভদ্রলোক আগে চর্চা করে, তারপর প্রচারে নিমগ্ন হয়। ভাববাদী দার্শনিকরা ‘লি’কে ভাববাচক ধারণা হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। এর বিপরীতে আছে বস্তুবোধক ‘চি’র অবস্থান। লি হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে সামাজিক বিধানের সমাহার।

এসবের সমন্বয়ে চীনে বিকশিত হয় বিশেষ রকমের ধর্মচেতনা। কালের ধারায় এখানে কনফুসিয় শিক্ষা, তাও ধর্মের নীতিমালা এবং বৌদ্ধধর্ম একাকার হয়েছিল।

লাওৎজু বা লাগুৎসির শিক্ষা ছিল কনফুসিয়াসের অনেকটা বিপরীত। এ শিক্ষা তাও নামে বিখ্যাত। তাও কথাটির অর্থ পথ, জগতের প্রাকৃতিক উপায় বা নীতি। তাও বলতে বুঝাতো স্বভাব, প্রকৃতি। পরবর্তী সময়ে প্রাকৃতিক বিধান বুঝাতে তাও কথাটি ব্যবহৃত হয়। কোনো নীতির সূত্র বা মৌল আদর্শ হিসেবেও কথাটির ব্যবহার প্রচলিত ছিল। কনফুসিয়াস সাধারণ মানুষকে দৈনন্দিন সমাজজীবনের সুস্থতার পথ দেখিয়েছিল, আর লাওৎজু দেখিয়েছিল বুদ্ধিচর্চার পথ, নিষ্কাম কর্মযোগের পথ, যে পথ ধরলে মানুষ ধৈর্য, বিনয়, প্রজ্ঞা, প্রেম, করুণা, অহিংসা প্রভৃতি সৎগুণের অধিকারী হতে পারে। তাওবাদ মূলত প্রকৃতিবাদী মতবাদ। তার মতে, আগুন, মাটি, পানি, কাঠ এবং ধাতু, এই পাঁচ মূল উপাদানে দুনিয়া গঠিত। এগুলোই হচ্ছে নিখিলের উ-শিং বা পাঁচ মহামূল। মহাবিশ্বের সূচনা ইন এবং ইয়াং নামক দুই পরস্পরবিরোধী শক্তি থেকে। তাদের মধ্যবর্তী আরেকটি জীবনীশক্তি হচ্ছে চি। এ দুই শক্তি জগতের সব সৃষ্টি ও ঘটনাচক্রে নিহিত আছে। মানুষ হচ্ছে ছোট আকারের মহাবিশ্ব আর মহাবিশ্ব হচ্ছে বড়ো আকারের মানুষ।

স্রষ্টা আছেন। সবার ওপরে আদিস্রষ্টা হলেন ইউচিং, তিনি সব সৃষ্টির সূচনাকারী এবং সব মহাগ্রন্থের প্রকৃত জনক। সর্বোচ্চ স্বর্গীয় বাহক হলেন শাংচিং, তিনি পবিত্র দূত, স্বর্গীয় বাণী বহন করে অর্ধদেবতা মানুষের কাছে আসেন। সর্বোচ্চ প্রজ্ঞাবান পুরুষ হলেন থাইচিং, তিনি মানুষের মাঝে থাকা স্বর্গীয় অবতার, পূর্ণ অবতার। তিনজনই উপাস্য। প্রথমজন সৃষ্টিশক্তির প্রতীক, দ্বিতীয়জন জীবনীশক্তির প্রতীক, তৃতীয়জন আধ্যাত্মিকতার প্রতীক। স্বর্গীয় অবতার নানারকম। গুরু লাওৎজুও এক অবতার।

সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি রাজা কীভাবে দেশ শাসন করবেন, লাওৎজু এরও নির্দেশনা দেন। তার মতে, রাজার নীতি হলো নিঃস্বার্থ প্রজাপালন। প্রত্যেক মানুষই ভেতর থেকে ভালো। কিন্তু সেই ভালোকে জাগাতে হবে। জগতের পরিবর্তনশীলতার কাছে সমর্পণ করতে হবে নিজেকে। ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষাকে ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা পরিহার আসলে ছিল অবাস্তব। অবাস্তব এবং সহজবুদ্ধিগ্রাহ্য নয় বলেই তাও ধর্ম জনতার মধ্যে তেমন প্রিয়তা পায়নি। তবে সে পেয়েছিল রাজপৃষ্ঠপোষকতা। সম্রাট শুয়াংচং (৭১২-৭৫৬ খ্রি.) তাওবাদী গ্রন্থাবলি অধ্যয়নকে বাধ্যতামূলক করেন। রাজ্যের সব ঘরে রাখতে হতো তাওধর্মের বই। এখনো চীনে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত পাঁচ ঐতিহ্যের একটি হচ্ছে তাওবাদ। তাওবাদ চীনকে দিয়েছিল প্রতীকের ভাষা পাঠের উদ্যম। তাওবাদী উৎসব এবং মন্ত্রগুলো দেবতা ও আত্মার সমাবেশে রহস্যময় বিবেচিত হতো। তাওবাদ নিখিলজোড়া দ্বন্দ্বময়তাকে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছে। ইন-ইয়াং হচ্ছে এ ধর্মের এক প্রতীক। যেখানে দেখানো হয় পরস্পরে মিলিত দুই পরস্পরবিরোধী শক্তিকে! জন্ম লাভের কয়েক শতাব্দী পরে প্রাচীন চৈনিক ধর্মগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করে তাওবাদ। এ মতবাদ বিশ্বাস করে জগতে যা কিছু অস্তিত্ববান, তার মূলে অবশ্যই বিদ্যমান আছে অমোঘ এক শক্তি। মহাজাগতিক ধারণা তাওবাদের গোড়ায় নিহিত। এই ধারণা এসেছে ‘ইন-ইয়াং’ বা তাইচির মতবাদ থেকে। ইন আর ইয়াং হচ্ছে জীবন পরিচালনার দুই বিপরীত শক্তি। একটি রাত হলে আরেকটি দিন, একটি আকার হলে আরেকটি নিরাকার, একটি ঘুম হলে আরেকটি জাগরণ, একটি বেদনা হলে আরেকটি আনন্দ, একটি নারী হলে আরেকটি পুরুষ। এই যে দুই শক্তির পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও টানাপড়েন, এরই মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয় জীবন, অগ্রসর হয় সভ্যতা। চীনারা যে ঐতিহাসিক-বস্তুবাদী দ্বন্দ্বতত্ত্বকে কবুল করেছিল, এর পেছনেও সহায়তা করেছিল তাদের এই বিরোধদর্শী ঐতিহ্য।

প্রায় ১ হাজার ৮০০ বছরের প্রাচীন এ ধর্ম বহু সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়। পরে প্রধান দুই স্রোতে মিলিত হয়, এখনো তাওবাদীরা দুই মুখ্য সম্প্রদায়ে বিভক্ত। একদল ছুয়েন চেন তাও, আরেকদল চেন ই তাও। এই ধর্ম লোকদের উদ্বুদ্ধ করেছে প্রকৃতি আর পূর্বপুরুষদের আত্মার উদ্দেশে পূজা নিবেদনে। তাওধর্মের প্রভাব সবচেয়ে বেশি দেখা যায় হান জাতির মধ্যে। এই ধর্মের অনুসারী হওয়ার জন্য বিশেষ কোনো নিয়মণ্ডকানুন নেই। চীনে তাওধর্মের অনুসারীদের সংখ্যা বিপুল।

খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে বৌদ্ধধর্ম প্রবেশ করে চীনে। হানবংশীয় সম্রাট মিং তি এই ধর্মের প্রচারে আগ্রহী ছিলেন। তার আমন্ত্রণে ভারত থেকে চীনে যান দুই বৌদ্ধ শ্রমণ। একজনের নাম কাশ্যপ মাতঙ্গ, আরেকজন ধর্মারণ্য। ধীর গতিতে চীনে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার হয়। সামাজিকভাবে সমাদৃত হতে এসে যায় খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতক। চীনা নৈতিকতার সঙ্গে বৌদ্ধ-জীবনবোধের আত্মীয়তা লক্ষ্য করেছিল জনগণ। চীনা লোকধর্ম জগৎ সৃষ্টিতে কোনো অলৌকিক প্রক্রিয়ার কথা মানেনি, সে সৃষ্টিবাদ কিংবা অদ্বৈতবাদকে গ্রহণ করেনি। কোনো অতীন্দ্রিয় শক্তি তাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করছেন, এমনটিও বিশ্বাস করত না তারা। ফলে বৌদ্ধ জীবনদর্শন চীনাদের অভ্যস্ত উপলব্ধির খুব কাছাকাছি বলে বিবেচিত হয়। এখানে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায় বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান শাখা। তবে হীনযান শাখার প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল মূলত চীনেই।

বৌদ্ধ ধর্ম এখানে এসে অনেক উপায়ে চীনা স্বাদ অর্জন করেছিল। তাওবাদ এবং কনফুসিয়ানিজমের সঙ্গে সংসার করেছিল। এসব ধর্ম ও ঐতিহ্য থেকে অনেক কিছুই অধিগ্রহণ করতে হয়েছিল। তারপর থেকে বৌদ্ধধর্ম চীনের ধর্মের তৃতীয় অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। ইসলাম যখন চীনে প্রবেশ করছে, এই সময়ে বৌদ্ধধর্ম চীনে প্রতিষ্ঠিত প্রধান এক ধর্ম।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

মুসা আল হাফিজ

কবি, লেখক ও গবেষক

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

ইসলামপূর্ব চীনে ধর্ম ও বিশ্বাস

প্রকাশ: ০১:৪৪:৩৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ জুন ২০২৩

চীনা সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্রে ছিল ধর্মের অবস্থান। ধর্মের প্রাণকেন্দ্রে ঈশ্বর ছিলেন না। কিন্তু মানুষকে কেউ সৃষ্টি করেছেন। প্রথমে যাকে সৃষ্টি করা হলো, তার নাম ‘পাং-কু’। পাং-কুণ্ডএর সৃষ্টি বা উৎপত্তির ১০ লাখ বছর পরে চীনে ১০টি রাজবংশ রাজত্ব করেছিল। প্রথমে রাজত্ব করেছিল দেবতারা, তারপর দ্বিতীয় রাজত্ব করেছিল তার উপদেবতারা, আর তৃতীয় রাজত্ব করেছেন নর বা মানুষরা, চতুর্থ রাজত্ব করেন জুচানরা, পঞ্চম রাজত্ব করেন সুইজন বা অগ্ন্যুৎপাদকদের রাজত্ব ইত্যাদি। চীনে রাজা বা শাসকের মহিমা তাই অনেক। এখানকার ধর্মে সেই মহিমা স্বীকৃত ছিল প্রবলভাবে।

চীনা নীতিধর্মের প্রাণকেন্দ্রে ছিল কিছু সামাজিক সম্বন্ধ। এগুলো হচ্ছে- তিন বন্ধন (সান কাং) ছয় স্তর (লুচি) পাঁচ আত্মীয়তা (উ লুন) এবং নয় পুরুষ (চিউ সু)। সান কাং-এর বন্ধনগুলো পবিত্র। তা রক্ষা করতে হবে, সম্মান করতে হবে তাকে। এই বন্ধনের প্রথমটি হলো রাজা ও প্রজার বন্ধন, এর পরেরটা সন্তান ও মা-বাবার বন্ধন। তিন নম্বরে আছে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। ‘লু-চি’ বা ছয় বিভাগ হলো (১) ভাই ও বোন, (২) বাবা ও দাদা, (৩) বংশপরম্পরা, (৪) মা ও নানা, (৫) গুরু ও শিষ্য আর (৬) বন্ধু ও বান্ধবী। ‘উ-লুন’ ও ‘চিও-ৎসু’ হলো বর্তমান ও ঊর্ধ্বতন পুরুষদের নিয়ে।

এসব সম্বন্ধে আবদ্ধ চীনারা অনেক নীতিপালনের মধ্য দিয়ে ধর্মাচরণের সূচনা করেছিল। এখানে পরিবার ছিল সবকিছুর কেন্দ্রে এবং পরিবারের প্রতি ভক্তি অন্যান্য সামাজিক সম্পর্ককে আলোদান করত। পূর্বপুরুষকে পূজা করত চীনারা। কারণ শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য এর বিকল্প নেই। তারা অবলম্বন করত মানবকেন্দ্রিক গুণাবলি। কনফুসিয়ানিজমের সুবর্ণ নিয়ম হলো, যে কাজ আপনি নিজের জন্য পছন্দ করেন না, সেটা অন্যের সঙ্গে করবেন না। বিদ্যা নিয়েও নিজস্ব ঐতিহ্য ছিল চীনে। চীনারা মনে করত খ্রিষ্টের জন্মের দুই হাজার বছর আগে তারা ছয় প্রকার বিদ্যায় প্রাজ্ঞ ছিল। সেগুলো হচ্ছে লি (সদাচার) য়ো (সংগীত) শে (তিরন্দাজি) য়ু (গন্তব্যপ্রদর্শন) শু (রচনা) এবং সু (গণিত)।

কনফুসিয়াস ও অন্যান্য চীনা মনীষীরা সুখের উপায়কে সজ্জিত করেছিলেন। সুখী হওয়ার জন্য তারা শেখান উং চাং বা পাঁচ কর্মনীতি। সেগুলো হলো ই, লি, রেন, ঝি এবং সিন। ‘ই’ হলো সততা এবং ন্যায়পরায়ণতা, ‘লি’ হলো সদাচার ও ভদ্রতা, ‘রেন’ হলো দানশীলতা ও মানবতা, ‘ঝি’ হলো জ্ঞান ও শিক্ষা এবং ‘সিন’ হলো বিশ্বস্ততা ও আনুগত্য। সবকিছু মিলে তৈরি হয়েছিল নীতিদর্শনের একটি আকার ও বিধান বা ‘লি’। লি কথাটি কনফুসিয় নীতিধর্মে মৌলিক এক পরিভাষা। ‘লি’ দ্বারা বুঝানো হয় বিধান, বস্তু, জগতের শৃঙ্খলা, আকার ইত্যাদিকে। সৎ ব্যবহার, ভারসম্যপূর্ণ আচরণ ও ভদ্রতা বুঝাতে এর ব্যবহার হয়। গোটা দর্শনের কেন্দ্রে যার অবস্থান। ভদ্রতা বলতে কনফুসিয়াস সুশিং বা চার গুণের সমাবেশকেই বুঝতেন। সেগুলো হচ্ছে- শিয়াও-মহানুভবতা, তি-ভ্রাতৃত্ব, চুং- সৎ বিশ্বাস, শিন-সত্যনিষ্ঠা। ভদ্রলোক আগে চর্চা করে, তারপর প্রচারে নিমগ্ন হয়। ভাববাদী দার্শনিকরা ‘লি’কে ভাববাচক ধারণা হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। এর বিপরীতে আছে বস্তুবোধক ‘চি’র অবস্থান। লি হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে সামাজিক বিধানের সমাহার।

এসবের সমন্বয়ে চীনে বিকশিত হয় বিশেষ রকমের ধর্মচেতনা। কালের ধারায় এখানে কনফুসিয় শিক্ষা, তাও ধর্মের নীতিমালা এবং বৌদ্ধধর্ম একাকার হয়েছিল।

লাওৎজু বা লাগুৎসির শিক্ষা ছিল কনফুসিয়াসের অনেকটা বিপরীত। এ শিক্ষা তাও নামে বিখ্যাত। তাও কথাটির অর্থ পথ, জগতের প্রাকৃতিক উপায় বা নীতি। তাও বলতে বুঝাতো স্বভাব, প্রকৃতি। পরবর্তী সময়ে প্রাকৃতিক বিধান বুঝাতে তাও কথাটি ব্যবহৃত হয়। কোনো নীতির সূত্র বা মৌল আদর্শ হিসেবেও কথাটির ব্যবহার প্রচলিত ছিল। কনফুসিয়াস সাধারণ মানুষকে দৈনন্দিন সমাজজীবনের সুস্থতার পথ দেখিয়েছিল, আর লাওৎজু দেখিয়েছিল বুদ্ধিচর্চার পথ, নিষ্কাম কর্মযোগের পথ, যে পথ ধরলে মানুষ ধৈর্য, বিনয়, প্রজ্ঞা, প্রেম, করুণা, অহিংসা প্রভৃতি সৎগুণের অধিকারী হতে পারে। তাওবাদ মূলত প্রকৃতিবাদী মতবাদ। তার মতে, আগুন, মাটি, পানি, কাঠ এবং ধাতু, এই পাঁচ মূল উপাদানে দুনিয়া গঠিত। এগুলোই হচ্ছে নিখিলের উ-শিং বা পাঁচ মহামূল। মহাবিশ্বের সূচনা ইন এবং ইয়াং নামক দুই পরস্পরবিরোধী শক্তি থেকে। তাদের মধ্যবর্তী আরেকটি জীবনীশক্তি হচ্ছে চি। এ দুই শক্তি জগতের সব সৃষ্টি ও ঘটনাচক্রে নিহিত আছে। মানুষ হচ্ছে ছোট আকারের মহাবিশ্ব আর মহাবিশ্ব হচ্ছে বড়ো আকারের মানুষ।

স্রষ্টা আছেন। সবার ওপরে আদিস্রষ্টা হলেন ইউচিং, তিনি সব সৃষ্টির সূচনাকারী এবং সব মহাগ্রন্থের প্রকৃত জনক। সর্বোচ্চ স্বর্গীয় বাহক হলেন শাংচিং, তিনি পবিত্র দূত, স্বর্গীয় বাণী বহন করে অর্ধদেবতা মানুষের কাছে আসেন। সর্বোচ্চ প্রজ্ঞাবান পুরুষ হলেন থাইচিং, তিনি মানুষের মাঝে থাকা স্বর্গীয় অবতার, পূর্ণ অবতার। তিনজনই উপাস্য। প্রথমজন সৃষ্টিশক্তির প্রতীক, দ্বিতীয়জন জীবনীশক্তির প্রতীক, তৃতীয়জন আধ্যাত্মিকতার প্রতীক। স্বর্গীয় অবতার নানারকম। গুরু লাওৎজুও এক অবতার।

সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি রাজা কীভাবে দেশ শাসন করবেন, লাওৎজু এরও নির্দেশনা দেন। তার মতে, রাজার নীতি হলো নিঃস্বার্থ প্রজাপালন। প্রত্যেক মানুষই ভেতর থেকে ভালো। কিন্তু সেই ভালোকে জাগাতে হবে। জগতের পরিবর্তনশীলতার কাছে সমর্পণ করতে হবে নিজেকে। ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষাকে ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা পরিহার আসলে ছিল অবাস্তব। অবাস্তব এবং সহজবুদ্ধিগ্রাহ্য নয় বলেই তাও ধর্ম জনতার মধ্যে তেমন প্রিয়তা পায়নি। তবে সে পেয়েছিল রাজপৃষ্ঠপোষকতা। সম্রাট শুয়াংচং (৭১২-৭৫৬ খ্রি.) তাওবাদী গ্রন্থাবলি অধ্যয়নকে বাধ্যতামূলক করেন। রাজ্যের সব ঘরে রাখতে হতো তাওধর্মের বই। এখনো চীনে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত পাঁচ ঐতিহ্যের একটি হচ্ছে তাওবাদ। তাওবাদ চীনকে দিয়েছিল প্রতীকের ভাষা পাঠের উদ্যম। তাওবাদী উৎসব এবং মন্ত্রগুলো দেবতা ও আত্মার সমাবেশে রহস্যময় বিবেচিত হতো। তাওবাদ নিখিলজোড়া দ্বন্দ্বময়তাকে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছে। ইন-ইয়াং হচ্ছে এ ধর্মের এক প্রতীক। যেখানে দেখানো হয় পরস্পরে মিলিত দুই পরস্পরবিরোধী শক্তিকে! জন্ম লাভের কয়েক শতাব্দী পরে প্রাচীন চৈনিক ধর্মগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করে তাওবাদ। এ মতবাদ বিশ্বাস করে জগতে যা কিছু অস্তিত্ববান, তার মূলে অবশ্যই বিদ্যমান আছে অমোঘ এক শক্তি। মহাজাগতিক ধারণা তাওবাদের গোড়ায় নিহিত। এই ধারণা এসেছে ‘ইন-ইয়াং’ বা তাইচির মতবাদ থেকে। ইন আর ইয়াং হচ্ছে জীবন পরিচালনার দুই বিপরীত শক্তি। একটি রাত হলে আরেকটি দিন, একটি আকার হলে আরেকটি নিরাকার, একটি ঘুম হলে আরেকটি জাগরণ, একটি বেদনা হলে আরেকটি আনন্দ, একটি নারী হলে আরেকটি পুরুষ। এই যে দুই শক্তির পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও টানাপড়েন, এরই মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয় জীবন, অগ্রসর হয় সভ্যতা। চীনারা যে ঐতিহাসিক-বস্তুবাদী দ্বন্দ্বতত্ত্বকে কবুল করেছিল, এর পেছনেও সহায়তা করেছিল তাদের এই বিরোধদর্শী ঐতিহ্য।

প্রায় ১ হাজার ৮০০ বছরের প্রাচীন এ ধর্ম বহু সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়। পরে প্রধান দুই স্রোতে মিলিত হয়, এখনো তাওবাদীরা দুই মুখ্য সম্প্রদায়ে বিভক্ত। একদল ছুয়েন চেন তাও, আরেকদল চেন ই তাও। এই ধর্ম লোকদের উদ্বুদ্ধ করেছে প্রকৃতি আর পূর্বপুরুষদের আত্মার উদ্দেশে পূজা নিবেদনে। তাওধর্মের প্রভাব সবচেয়ে বেশি দেখা যায় হান জাতির মধ্যে। এই ধর্মের অনুসারী হওয়ার জন্য বিশেষ কোনো নিয়মণ্ডকানুন নেই। চীনে তাওধর্মের অনুসারীদের সংখ্যা বিপুল।

খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে বৌদ্ধধর্ম প্রবেশ করে চীনে। হানবংশীয় সম্রাট মিং তি এই ধর্মের প্রচারে আগ্রহী ছিলেন। তার আমন্ত্রণে ভারত থেকে চীনে যান দুই বৌদ্ধ শ্রমণ। একজনের নাম কাশ্যপ মাতঙ্গ, আরেকজন ধর্মারণ্য। ধীর গতিতে চীনে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার হয়। সামাজিকভাবে সমাদৃত হতে এসে যায় খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতক। চীনা নৈতিকতার সঙ্গে বৌদ্ধ-জীবনবোধের আত্মীয়তা লক্ষ্য করেছিল জনগণ। চীনা লোকধর্ম জগৎ সৃষ্টিতে কোনো অলৌকিক প্রক্রিয়ার কথা মানেনি, সে সৃষ্টিবাদ কিংবা অদ্বৈতবাদকে গ্রহণ করেনি। কোনো অতীন্দ্রিয় শক্তি তাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করছেন, এমনটিও বিশ্বাস করত না তারা। ফলে বৌদ্ধ জীবনদর্শন চীনাদের অভ্যস্ত উপলব্ধির খুব কাছাকাছি বলে বিবেচিত হয়। এখানে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায় বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান শাখা। তবে হীনযান শাখার প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল মূলত চীনেই।

বৌদ্ধ ধর্ম এখানে এসে অনেক উপায়ে চীনা স্বাদ অর্জন করেছিল। তাওবাদ এবং কনফুসিয়ানিজমের সঙ্গে সংসার করেছিল। এসব ধর্ম ও ঐতিহ্য থেকে অনেক কিছুই অধিগ্রহণ করতে হয়েছিল। তারপর থেকে বৌদ্ধধর্ম চীনের ধর্মের তৃতীয় অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। ইসলাম যখন চীনে প্রবেশ করছে, এই সময়ে বৌদ্ধধর্ম চীনে প্রতিষ্ঠিত প্রধান এক ধর্ম।