০৩:১৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

অন্যায়ের প্রতিবাদে বাংলার পথিকৃৎ হাজী শরীয়তুল্লাহ

আবু নাঈম ফয়জুল্লাহ
  • প্রকাশ: ০১:৩৭:১৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ জুন ২০২৩
  • / ৭৭৮ বার পড়া হয়েছে

হাজী শরিয়তউল্লাহ

সেই প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা অঞ্চলে কেউ নির্বিঘ্নে শাসন-শোষণ করতে পারেনি। যখনই কেউ এ অঞ্চলের ওপর জুলুমের হাত প্রসারিত করেছে, তখনই গর্জে উঠেছে বাংলার চির বিদ্রোহী জাতিসত্তা। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের মধ্যে ২০০ বছরের স্বাধীন সুলতানি আমল ছাড়া পুরো সময় এ অঞ্চল অন্যদের দ্বারা শাসিত হলেও সব সময় এখানে বিদ্রোহ লেগেই থাকত। স্বাধীনতা ও নিজেদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে প্রতিবাদের আগুন ধিকিধিকি জ্বলতে থাকত এখানে-সেখানে। এ আগুন জ্বালিয়ে রাখতেন যুগে যুগে এ অঞ্চলে জন্ম নেওয়া প্রতিবাদী মানুষেরা। যারা কোনো জুলুম সহ্য করতে পারতেন না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে তারা ভয় পেতেন না পৃথিবীর কোনো শক্তিকে। পরাক্রমশালী কোনো সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ভয়ে তারা দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। হাজার বছরের সেই প্রতিবাদী চরিত্রের অর্জন হিসেবেই কালক্রমে আমরা পেয়েছি বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ভূখণ্ড। সেই মহান প্রতিবাদী মানুষদেরই একজন ছিলেন হাজী শরীয়তুল্লাহ

হাজী শরীয়তুল্লাহর প্রথম জীবন

ফরিদপুর জেলায় ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে এক দরিদ্র তালুকদার পরিবারে হাজী শরীয়তুল্লাহ জন্ম গ্রহণ করেন। তখন মুসলমানরা ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক পরাধীন। পরিবারেও ছিল অর্থের টানাপড়েন। হাজী শরীয়তুল্লাহর শৈশব ছিল নিদারুণ কষ্টের। মাত্র আট বছর বয়সে তার বাবা ইন্তেকাল করেন। এরও আগে তিনি মাকে হারান। তাই শিক্ষাদীক্ষা গ্রহণ করে বড়ো কিছু হওয়ার সুযোগ তার ছিল না যদিও তাঁর বাবা এক সময় আঞ্চলিক মুসলিম জমিদার ছিলেন। বহু জায়গা জমির মালিক ছিলেন। বাবার ইচ্ছা ছিল, শরীয়তুল্লাহ একদিন অনেক বড় হবে। মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবে। একদিকে বাবার স্বপ্ন, অপর দিকে নিজের মনেও লালন করতেন শিক্ষার প্রতি প্রবল আগ্রহ। বড় হয়ে মানুষের জন্য কিছু করার স্বপ্ন দেখতেন। তাই তিনি এক সময় বাড়ি ছেড়ে কলকাতা চলে যান। সেখানে তিনি পেয়ে যান মাওলানা বাশারত আলীকে। তিনি তাকে কোরআন শিক্ষা দান করেন। এরপর শরীয়তুল্লাহ উর্দু, ফারসি ও আরবি ভাষা রপ্ত করেন। কোরআন ও হাদিসের মৌলিক জ্ঞান অর্জন করেন। তারপর তিনি দেশে ফিরে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু নানা করণে তা আর হয়ে ওঠে না। এদিকে মাওলানা বাশারত আলী ব্রিটিশ শাসনের প্রতি বিরক্ত হয়ে মক্কায় চলে যাওয়ার ইচ্ছা করেন। উস্তাদের সঙ্গে শরীয়তুল্লাহও মক্কায় চলে যেতে চান। অবশেষে ১৭৯৯ সালে উস্তাদ ও শাগরেদ মিলে মক্কায় চলে যান।

আরব বিশ্বে হাজী শরীয়তুল্লাহ

মক্কায় গিয়ে শুরু হয় হাজী শরীয়তুল্লাহর নতুন জীবন। তিনি যেন আবে হায়াতের সন্ধান পেয়ে যান। তিনি যে ইলম অর্জনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন তা আশার চেয়েও বেশি পরিমাণে পেয়ে যান। সান্নিধ্য পান যুগশ্রেষ্ঠ ওলামায়ে কেরামের। হাদিস, তাফসির ও বিশেষত হানাফি ফিকহের ওপর তিনি অগাধ জ্ঞান অর্জন করেন। বিশ্ব বিখ্যাত ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় আল আজহারেও দুই বছর অবস্থান করে ইসলামি জ্ঞান ভাণ্ডারের আরো গভীরে ডুব দেন। শিক্ষা জীবন শেষ করে তিনি আরবেই অবস্থান করতে থাকেন। সেখানেও তার প্রতিভার দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে। অল্প সময়েই তিনি পরিচিত হয়ে উঠেন। সেখানে তিনি ইলমে দ্বীনের পাঠদান করতে থাকেন। বাংলার এক এতিম বালক নবীর দেশে হয়ে ওঠেন ইলমের ফেরিওয়ালা। ১৮১৮ সাল পর্যন্ত তিনি আরবে ছিলেন। এ সময় তার চোখের সামনেই আরবে নানা উত্থান-পতন হয়। বিশেষ করে ওয়াহেবি আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে। মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াব নজদীর সংস্কার আন্দোলনে আরব নতুন করে সেজে ওঠতে থাকে।

মক্কায় অবস্থান করাকালে হাজী শরীয়তুল্লাহ মুসলিম বিশ্বের নানা দেশের নানা সংস্কৃতির মানুষের দেখা পান। গভীরভাবে অবলোকন করেন মুসলিম বিশ্বের আচার-অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতি। মনে গেঁথে নেন ইসলামের প্রকৃত রূপ। বিশেষ করে এই সময়েই হজের উদ্দেশে মক্কায় আগমন করেন ভারতের মুসলিম জাগরণের অন্যতম সিপাহসালার সাইয়েদ আহমদ শহীদ (রহ.)। তিনি বিশাল অনুসারী বাহিনী নিয়ে এক বছর মক্কায় অবস্থান করেন। মুসলমানদের মাঝে নবজাগরণ সৃষ্টি করার জন্য তিনি জিহাদ ও সংস্কার আন্দোলনের ডাক দেন। হাজী শরীয়তুল্লাহ সাইয়েদ আহমদ শহীদের দ্বারাও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এভাবে মক্কায় অবস্থানের ২০ বছর সময়ের মধ্যে হাজী শরীয়তুল্লাহর ভেতরে মুসলিম নবজাগরণের এক বিপ্লবী আগুন জ্বলে ওঠে।

ফরায়েজি আন্দোলনের সূচনা

হাজী শরীয়তুল্লাহ যখন দেশে ফিরে আসেন তখন এ দেশের হিন্দু জমিদাররা সাধারণ মুসলমানদের অনেকটা গোলাম বানিয়ে রেখেছিল। নিজেদের পৈতৃক সম্পত্তির জন্যও তাদের খাজনা দিতে হতো। মারোওয়ারি সম্প্রদায় ব্রিটিশদের কাছ থেকে বড় বড় জায়গির ক্রয় করে নিয়েছিল। নীলকর সাহেবরা বাঙালি কৃষকদের নীল চাষে বাধ্য করে বিশাল মুনাফা তুলে নিচ্ছিল এদেশ থেকে। হাজী শরীয়তুল্লাহ এসব দেখে মারাত্মভাবে ব্যথিত হন। তিনি এর কারণ অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেন। তিনি দেখতে পান মুসলমানরা নিজেদের পরিচয় হারিয়ে ফেলেছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর যে নববি আদর্শ, তা থেকে মুসলমানরা বহু দূরে সরে গেছে। ইসলামের মৌলিক অনুশাসন ভুলে তারা হিন্দুদের পূজা-পার্বণ ও নানা সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। নামাজ, রোজা, জাকাত ও হজের মতো মৌলিক বিধানগুলোও মুসলিমরা পালন করছে না। ইসলামের যেটুকু আকিদা-বিশ্বাস টিকে আছে তাও বিপথগামী সুফিবাদের প্রভাবে শিরক ও বিদআতের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে আছে। তিনি বুঝতে পারেন, আগে মুসলমানাদের নিজেদের আত্মপরিচয় সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। ইসলামের মৌলিক ফরজ বিধানের ওপর তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। তাহলেই মুসলমানরা জেগে ওঠবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে সকল জুলুমের শৃঙ্খল থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করবে। তখনই শুধু খুলতে পারে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমৃদ্ধির দুয়ার। কারণ কোনো পরাধীন জাতি অর্থনৈতিকভাবে মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে সক্ষম নয়।

এই চিন্তা থেকে হাজী শরীয়তুল্লাহ দুটি বিষয় সামনে রেখে মুসলিম সমাজে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করেন। এক. আল্লাহর একত্ববাদকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা। দুই. মুসলমানদের ইসলামের মৌলিক ফরজ বিধানের ওপর ফিরিয়ে আনা। সে লক্ষ্যে তিনি সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন প্রথা, যেমন- মাজারে সিজদা করা, মাজারে মানত করা, হিন্দুদের পূজা-পার্বণে যোগদান করাকে সুস্পষ্ট শিরক বলে ঘোষণা করেন। মানুষের মৃত্যুর পর চল্লিশার নামে অযথা টাকা খরচ করা, কবর পাকা করাসহ কোরআন ও হাদিসে দলিল পাওয়া যায় না- এমন সবকিছুকে তিনি বিদআত হিসেবে প্রচার করতে থাকেন। মুসলামনদের এসব থেকে ফিরে আসতে বলেন। এবং ইসলামের মৌলিক ফরজ বিধান নামাজ, রোজা, জাকাত ও হজ পালনের ব্যাপারে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেন। ব্যাপকভাবে তিনি এই প্রচারণা চালান। তিনি যেতেতু ইসলামের ফরজ বিধানের ওপর মুসলমানদের পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন, তাই তার আন্দোলনকে ফরায়েজি আন্দোলন নামে অভিহিত করা হয়।

প্রতিবাদ ও সংগ্রামে হাজী শরীয়তুল্লাহ

হাজী শরীয়তুল্লাহর সংস্কার আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে তৎকালীন বাংলায়। বৃহত্তর ফরিদপুর, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও ঢাকা অঞ্চলের মানুষ ব্যাপকভাবে এ আন্দোলনে যোগ দিতে থাকে। ফলে মুসলমানরা তাদের আত্মপরিচয়ের ব্যাপারে সচেতন হতে শুরু করে। হিন্দু জমিদার ও নীলকর সাহেবদের অত্যাচার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য পথ খুঁজতে থাকে। হিন্দু জমিদাররা মুসলমানদের এই পরিবর্তন লক্ষ করে এবং তারা দেখে মুসলমানরা এখন আর আগের মতো পূজা-পার্বণে অংশ নেয় না। তখন তারা মুসলমানদের ওপর দুর্গাপূজা, কালী পূজাসহ নানা উৎসব আয়োজনের জন্য অতিরিক্ত কর আরোপ করতে থাকে। যারা নিয়মিত নামাজ, রোজা ও হজ পালন করতে চাইত তাদের ওপরও অতিরিক্ত কর আরোপ করা হয়। হাজী শরীয়তুল্লাহ স্পষ্ট প্রতিবাদ জানান। তিনি বলে দেন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীনে হিন্দু জমিদাররা যে খাজনা নেয় এবং অন্যান্য আরো যেসব কর ধার্য করে রেখেছে তা দিতে মুসলমানরা বাধ্য নয়।

হাজী শরীয়তুল্লাহ মুসলামনের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এসব অর্থনৈতিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। নীলকরদের চাপিয়ে দেওয়া নীল চাষ না করে এ দেশের জন্য সুবিধাজনক ফসল চাষ করার প্রতি সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেন। ভারতকে তিনি দারুল হরব তথা শত্রু কবলিত রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করেন। এবং মুসলমানদের ওপর জিহাদ করা আবশ্যক বলে ঘোষণা দেন। তার আহ্বানে ব্যাপকভাবে বাংলার কৃষক, তাঁতি ও সাধারণ মুসলমানরা সাড়া দেয়। তারা হিন্দু জমিদারদের খাজনা দিতে অস্বীকার করে। নীল চাষ না করার চেষ্টা করতে থাকে। এতে হিন্দু জমিদার ও নীলকর সাহেবরা হাজী শরীয়তুল্লাহর ওপর ক্ষুব্ধ হয়। ব্রিটিশরা মূলত হিন্দু জমিদার ও মরোওয়ারি জায়গিরদারদের মাধ্যমে এ দেশের সাধারণ মুসলমানদের ওপর জুলুম করত। তারা সরাসরি খাজনা উসুল করতে আসত না। ফলে ফরায়েজিদের সরাসরি সংঘর্ষ শুরু হয় হিন্দু জমিদার ও নীলকর সাহেবদের সঙ্গে। হাজী শরীয়তুল্লাহর ওপর পুলিশি নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা হয়। হাজী শরীয়তুল্লাহ সাধারণ মুসলামনদেরকে রক্ষা করার জন্য একটি শক্তিশালী লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তোলেন। তিনি তার অনুসারীদেরকে ব্রিটিশদের প্রতিষ্ঠিত আদালতে বিচারপ্রার্থী হয়ে যেতে বারণ করেন। কারণ, তারা আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী বিচার করে না। তাই তিনি ইসলামি ফিকহের হেদায়া কিতাবের আলোকে এলাকাভিত্তিক শালিশি ব্যবস্থা চালু করেন। এতে ব্রিটিশরাও তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে।

ফরায়েজিরা চতুর্মুখী বাধার মুখে পড়েন। একদিকে অন্যায় ও জুলুমণ্ডনির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য হিন্দু জমিদার, নীলকর সাহেব ও ব্রিটিশদের বাধার সম্মুখীন হন। অপরদিকে শিরক ও বিদআতের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার কারণে বিপথগামী সুফিবাদের দ্বারা প্রভাবিত মুসলমানরাও ব্যাপকভাবে তার বিরোধী হয়ে ওঠে। ঢাকার নয়াবাড়িতে এমন একটি দাঙ্গাও সংঘটিত হয়। যার ফলে তিনি ঢাকা ছেড়ে চলে আসেন। চতুর্মুখী বাধা মোকাবিলা করেই তিনি তার প্রতিবাদ ও সংস্কার আন্দোলন চালিয়ে যান। ১৮৩৭ সালে সরাসরি ফরায়েজি আন্দোলনে সক্রিয় অনুসারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ হাজার। এর বাইরে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপকভাবে তার চিন্তা ও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। জায়গায় জায়গায় অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে সরাসরি সংঘর্ষও বেঁধে যায়। তার আন্দোলন মূলত ছিল জুলুম, নির্যাতন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তাই কোনো মুসলমান জমিদারও যদি প্রজাদের অধিকার নষ্ট করত, তাহলেও তিনি প্রতিবাদ করতেন।

এভাবে চলতে থাকে হাজী শরীয়তুল্লাহর প্রতিবাদ ও সংগ্রাম। ১৮৪০ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্তই তিনি এই সংগ্রাম চালিয়ে যান। ফরায়েজী আন্দোলনের একেবারে যৌবন কালে এসে তিনি দুনিয়া ত্যাগ করে পরপারে চলে যান। তার যোগ্য উত্তরসূরি পুত্র মুহসিন উদ্দিন আহমদ ওরফে দুদু মিয়ার হাত ধরে ফরায়েজি আন্দোলন আরো বেগবান হয়। প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে ওঠে ফরায়েজি আন্দোলন। বঞ্চিত বাঙালির আশ্রয়ের জায়গা হয়ে ওঠে হাজী শরীয়তুল্লাহর এ আন্দোলন।

আজও তিনি ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন। তিনি বাঙালিকে শিখিয়েছেন ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর চেতনা। অসহায়ের পক্ষ নিয়ে শক্তিধর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ইস্পাতের মতো দাঁড়িয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। যুগ যুগ ধরে বাঙালি যখনই কারো দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, তখনই হাজী শরীয়তুল্লাহ অলক্ষে এসে দাঁড়িয়েছেন সামনে। জেগে উঠতে বলেছেন নতুন করে। প্রতিবাদ ও সংগ্রামের প্রেরণা হয়ে বাঙালির মনোজগৎকে আন্দোলিত করে গেছেন বারবার।

[তথ্যসূত্র: বাংলা পিডিয়া; দেওবন্দ আন্দোলন : ইতিহাস, ঐতিহ্য, অবদান]

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

অন্যায়ের প্রতিবাদে বাংলার পথিকৃৎ হাজী শরীয়তুল্লাহ

প্রকাশ: ০১:৩৭:১৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ জুন ২০২৩

সেই প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা অঞ্চলে কেউ নির্বিঘ্নে শাসন-শোষণ করতে পারেনি। যখনই কেউ এ অঞ্চলের ওপর জুলুমের হাত প্রসারিত করেছে, তখনই গর্জে উঠেছে বাংলার চির বিদ্রোহী জাতিসত্তা। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের মধ্যে ২০০ বছরের স্বাধীন সুলতানি আমল ছাড়া পুরো সময় এ অঞ্চল অন্যদের দ্বারা শাসিত হলেও সব সময় এখানে বিদ্রোহ লেগেই থাকত। স্বাধীনতা ও নিজেদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে প্রতিবাদের আগুন ধিকিধিকি জ্বলতে থাকত এখানে-সেখানে। এ আগুন জ্বালিয়ে রাখতেন যুগে যুগে এ অঞ্চলে জন্ম নেওয়া প্রতিবাদী মানুষেরা। যারা কোনো জুলুম সহ্য করতে পারতেন না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে তারা ভয় পেতেন না পৃথিবীর কোনো শক্তিকে। পরাক্রমশালী কোনো সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ভয়ে তারা দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। হাজার বছরের সেই প্রতিবাদী চরিত্রের অর্জন হিসেবেই কালক্রমে আমরা পেয়েছি বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ভূখণ্ড। সেই মহান প্রতিবাদী মানুষদেরই একজন ছিলেন হাজী শরীয়তুল্লাহ

হাজী শরীয়তুল্লাহর প্রথম জীবন

ফরিদপুর জেলায় ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে এক দরিদ্র তালুকদার পরিবারে হাজী শরীয়তুল্লাহ জন্ম গ্রহণ করেন। তখন মুসলমানরা ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক পরাধীন। পরিবারেও ছিল অর্থের টানাপড়েন। হাজী শরীয়তুল্লাহর শৈশব ছিল নিদারুণ কষ্টের। মাত্র আট বছর বয়সে তার বাবা ইন্তেকাল করেন। এরও আগে তিনি মাকে হারান। তাই শিক্ষাদীক্ষা গ্রহণ করে বড়ো কিছু হওয়ার সুযোগ তার ছিল না যদিও তাঁর বাবা এক সময় আঞ্চলিক মুসলিম জমিদার ছিলেন। বহু জায়গা জমির মালিক ছিলেন। বাবার ইচ্ছা ছিল, শরীয়তুল্লাহ একদিন অনেক বড় হবে। মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবে। একদিকে বাবার স্বপ্ন, অপর দিকে নিজের মনেও লালন করতেন শিক্ষার প্রতি প্রবল আগ্রহ। বড় হয়ে মানুষের জন্য কিছু করার স্বপ্ন দেখতেন। তাই তিনি এক সময় বাড়ি ছেড়ে কলকাতা চলে যান। সেখানে তিনি পেয়ে যান মাওলানা বাশারত আলীকে। তিনি তাকে কোরআন শিক্ষা দান করেন। এরপর শরীয়তুল্লাহ উর্দু, ফারসি ও আরবি ভাষা রপ্ত করেন। কোরআন ও হাদিসের মৌলিক জ্ঞান অর্জন করেন। তারপর তিনি দেশে ফিরে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু নানা করণে তা আর হয়ে ওঠে না। এদিকে মাওলানা বাশারত আলী ব্রিটিশ শাসনের প্রতি বিরক্ত হয়ে মক্কায় চলে যাওয়ার ইচ্ছা করেন। উস্তাদের সঙ্গে শরীয়তুল্লাহও মক্কায় চলে যেতে চান। অবশেষে ১৭৯৯ সালে উস্তাদ ও শাগরেদ মিলে মক্কায় চলে যান।

আরব বিশ্বে হাজী শরীয়তুল্লাহ

মক্কায় গিয়ে শুরু হয় হাজী শরীয়তুল্লাহর নতুন জীবন। তিনি যেন আবে হায়াতের সন্ধান পেয়ে যান। তিনি যে ইলম অর্জনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন তা আশার চেয়েও বেশি পরিমাণে পেয়ে যান। সান্নিধ্য পান যুগশ্রেষ্ঠ ওলামায়ে কেরামের। হাদিস, তাফসির ও বিশেষত হানাফি ফিকহের ওপর তিনি অগাধ জ্ঞান অর্জন করেন। বিশ্ব বিখ্যাত ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় আল আজহারেও দুই বছর অবস্থান করে ইসলামি জ্ঞান ভাণ্ডারের আরো গভীরে ডুব দেন। শিক্ষা জীবন শেষ করে তিনি আরবেই অবস্থান করতে থাকেন। সেখানেও তার প্রতিভার দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে। অল্প সময়েই তিনি পরিচিত হয়ে উঠেন। সেখানে তিনি ইলমে দ্বীনের পাঠদান করতে থাকেন। বাংলার এক এতিম বালক নবীর দেশে হয়ে ওঠেন ইলমের ফেরিওয়ালা। ১৮১৮ সাল পর্যন্ত তিনি আরবে ছিলেন। এ সময় তার চোখের সামনেই আরবে নানা উত্থান-পতন হয়। বিশেষ করে ওয়াহেবি আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে। মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াব নজদীর সংস্কার আন্দোলনে আরব নতুন করে সেজে ওঠতে থাকে।

মক্কায় অবস্থান করাকালে হাজী শরীয়তুল্লাহ মুসলিম বিশ্বের নানা দেশের নানা সংস্কৃতির মানুষের দেখা পান। গভীরভাবে অবলোকন করেন মুসলিম বিশ্বের আচার-অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতি। মনে গেঁথে নেন ইসলামের প্রকৃত রূপ। বিশেষ করে এই সময়েই হজের উদ্দেশে মক্কায় আগমন করেন ভারতের মুসলিম জাগরণের অন্যতম সিপাহসালার সাইয়েদ আহমদ শহীদ (রহ.)। তিনি বিশাল অনুসারী বাহিনী নিয়ে এক বছর মক্কায় অবস্থান করেন। মুসলমানদের মাঝে নবজাগরণ সৃষ্টি করার জন্য তিনি জিহাদ ও সংস্কার আন্দোলনের ডাক দেন। হাজী শরীয়তুল্লাহ সাইয়েদ আহমদ শহীদের দ্বারাও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এভাবে মক্কায় অবস্থানের ২০ বছর সময়ের মধ্যে হাজী শরীয়তুল্লাহর ভেতরে মুসলিম নবজাগরণের এক বিপ্লবী আগুন জ্বলে ওঠে।

ফরায়েজি আন্দোলনের সূচনা

হাজী শরীয়তুল্লাহ যখন দেশে ফিরে আসেন তখন এ দেশের হিন্দু জমিদাররা সাধারণ মুসলমানদের অনেকটা গোলাম বানিয়ে রেখেছিল। নিজেদের পৈতৃক সম্পত্তির জন্যও তাদের খাজনা দিতে হতো। মারোওয়ারি সম্প্রদায় ব্রিটিশদের কাছ থেকে বড় বড় জায়গির ক্রয় করে নিয়েছিল। নীলকর সাহেবরা বাঙালি কৃষকদের নীল চাষে বাধ্য করে বিশাল মুনাফা তুলে নিচ্ছিল এদেশ থেকে। হাজী শরীয়তুল্লাহ এসব দেখে মারাত্মভাবে ব্যথিত হন। তিনি এর কারণ অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেন। তিনি দেখতে পান মুসলমানরা নিজেদের পরিচয় হারিয়ে ফেলেছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর যে নববি আদর্শ, তা থেকে মুসলমানরা বহু দূরে সরে গেছে। ইসলামের মৌলিক অনুশাসন ভুলে তারা হিন্দুদের পূজা-পার্বণ ও নানা সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। নামাজ, রোজা, জাকাত ও হজের মতো মৌলিক বিধানগুলোও মুসলিমরা পালন করছে না। ইসলামের যেটুকু আকিদা-বিশ্বাস টিকে আছে তাও বিপথগামী সুফিবাদের প্রভাবে শিরক ও বিদআতের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে আছে। তিনি বুঝতে পারেন, আগে মুসলমানাদের নিজেদের আত্মপরিচয় সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। ইসলামের মৌলিক ফরজ বিধানের ওপর তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। তাহলেই মুসলমানরা জেগে ওঠবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে সকল জুলুমের শৃঙ্খল থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করবে। তখনই শুধু খুলতে পারে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমৃদ্ধির দুয়ার। কারণ কোনো পরাধীন জাতি অর্থনৈতিকভাবে মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে সক্ষম নয়।

এই চিন্তা থেকে হাজী শরীয়তুল্লাহ দুটি বিষয় সামনে রেখে মুসলিম সমাজে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করেন। এক. আল্লাহর একত্ববাদকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা। দুই. মুসলমানদের ইসলামের মৌলিক ফরজ বিধানের ওপর ফিরিয়ে আনা। সে লক্ষ্যে তিনি সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন প্রথা, যেমন- মাজারে সিজদা করা, মাজারে মানত করা, হিন্দুদের পূজা-পার্বণে যোগদান করাকে সুস্পষ্ট শিরক বলে ঘোষণা করেন। মানুষের মৃত্যুর পর চল্লিশার নামে অযথা টাকা খরচ করা, কবর পাকা করাসহ কোরআন ও হাদিসে দলিল পাওয়া যায় না- এমন সবকিছুকে তিনি বিদআত হিসেবে প্রচার করতে থাকেন। মুসলামনদের এসব থেকে ফিরে আসতে বলেন। এবং ইসলামের মৌলিক ফরজ বিধান নামাজ, রোজা, জাকাত ও হজ পালনের ব্যাপারে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেন। ব্যাপকভাবে তিনি এই প্রচারণা চালান। তিনি যেতেতু ইসলামের ফরজ বিধানের ওপর মুসলমানদের পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন, তাই তার আন্দোলনকে ফরায়েজি আন্দোলন নামে অভিহিত করা হয়।

প্রতিবাদ ও সংগ্রামে হাজী শরীয়তুল্লাহ

হাজী শরীয়তুল্লাহর সংস্কার আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে তৎকালীন বাংলায়। বৃহত্তর ফরিদপুর, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও ঢাকা অঞ্চলের মানুষ ব্যাপকভাবে এ আন্দোলনে যোগ দিতে থাকে। ফলে মুসলমানরা তাদের আত্মপরিচয়ের ব্যাপারে সচেতন হতে শুরু করে। হিন্দু জমিদার ও নীলকর সাহেবদের অত্যাচার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য পথ খুঁজতে থাকে। হিন্দু জমিদাররা মুসলমানদের এই পরিবর্তন লক্ষ করে এবং তারা দেখে মুসলমানরা এখন আর আগের মতো পূজা-পার্বণে অংশ নেয় না। তখন তারা মুসলমানদের ওপর দুর্গাপূজা, কালী পূজাসহ নানা উৎসব আয়োজনের জন্য অতিরিক্ত কর আরোপ করতে থাকে। যারা নিয়মিত নামাজ, রোজা ও হজ পালন করতে চাইত তাদের ওপরও অতিরিক্ত কর আরোপ করা হয়। হাজী শরীয়তুল্লাহ স্পষ্ট প্রতিবাদ জানান। তিনি বলে দেন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীনে হিন্দু জমিদাররা যে খাজনা নেয় এবং অন্যান্য আরো যেসব কর ধার্য করে রেখেছে তা দিতে মুসলমানরা বাধ্য নয়।

হাজী শরীয়তুল্লাহ মুসলামনের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এসব অর্থনৈতিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। নীলকরদের চাপিয়ে দেওয়া নীল চাষ না করে এ দেশের জন্য সুবিধাজনক ফসল চাষ করার প্রতি সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেন। ভারতকে তিনি দারুল হরব তথা শত্রু কবলিত রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করেন। এবং মুসলমানদের ওপর জিহাদ করা আবশ্যক বলে ঘোষণা দেন। তার আহ্বানে ব্যাপকভাবে বাংলার কৃষক, তাঁতি ও সাধারণ মুসলমানরা সাড়া দেয়। তারা হিন্দু জমিদারদের খাজনা দিতে অস্বীকার করে। নীল চাষ না করার চেষ্টা করতে থাকে। এতে হিন্দু জমিদার ও নীলকর সাহেবরা হাজী শরীয়তুল্লাহর ওপর ক্ষুব্ধ হয়। ব্রিটিশরা মূলত হিন্দু জমিদার ও মরোওয়ারি জায়গিরদারদের মাধ্যমে এ দেশের সাধারণ মুসলমানদের ওপর জুলুম করত। তারা সরাসরি খাজনা উসুল করতে আসত না। ফলে ফরায়েজিদের সরাসরি সংঘর্ষ শুরু হয় হিন্দু জমিদার ও নীলকর সাহেবদের সঙ্গে। হাজী শরীয়তুল্লাহর ওপর পুলিশি নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা হয়। হাজী শরীয়তুল্লাহ সাধারণ মুসলামনদেরকে রক্ষা করার জন্য একটি শক্তিশালী লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তোলেন। তিনি তার অনুসারীদেরকে ব্রিটিশদের প্রতিষ্ঠিত আদালতে বিচারপ্রার্থী হয়ে যেতে বারণ করেন। কারণ, তারা আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী বিচার করে না। তাই তিনি ইসলামি ফিকহের হেদায়া কিতাবের আলোকে এলাকাভিত্তিক শালিশি ব্যবস্থা চালু করেন। এতে ব্রিটিশরাও তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে।

ফরায়েজিরা চতুর্মুখী বাধার মুখে পড়েন। একদিকে অন্যায় ও জুলুমণ্ডনির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য হিন্দু জমিদার, নীলকর সাহেব ও ব্রিটিশদের বাধার সম্মুখীন হন। অপরদিকে শিরক ও বিদআতের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার কারণে বিপথগামী সুফিবাদের দ্বারা প্রভাবিত মুসলমানরাও ব্যাপকভাবে তার বিরোধী হয়ে ওঠে। ঢাকার নয়াবাড়িতে এমন একটি দাঙ্গাও সংঘটিত হয়। যার ফলে তিনি ঢাকা ছেড়ে চলে আসেন। চতুর্মুখী বাধা মোকাবিলা করেই তিনি তার প্রতিবাদ ও সংস্কার আন্দোলন চালিয়ে যান। ১৮৩৭ সালে সরাসরি ফরায়েজি আন্দোলনে সক্রিয় অনুসারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ হাজার। এর বাইরে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপকভাবে তার চিন্তা ও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। জায়গায় জায়গায় অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে সরাসরি সংঘর্ষও বেঁধে যায়। তার আন্দোলন মূলত ছিল জুলুম, নির্যাতন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তাই কোনো মুসলমান জমিদারও যদি প্রজাদের অধিকার নষ্ট করত, তাহলেও তিনি প্রতিবাদ করতেন।

এভাবে চলতে থাকে হাজী শরীয়তুল্লাহর প্রতিবাদ ও সংগ্রাম। ১৮৪০ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্তই তিনি এই সংগ্রাম চালিয়ে যান। ফরায়েজী আন্দোলনের একেবারে যৌবন কালে এসে তিনি দুনিয়া ত্যাগ করে পরপারে চলে যান। তার যোগ্য উত্তরসূরি পুত্র মুহসিন উদ্দিন আহমদ ওরফে দুদু মিয়ার হাত ধরে ফরায়েজি আন্দোলন আরো বেগবান হয়। প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে ওঠে ফরায়েজি আন্দোলন। বঞ্চিত বাঙালির আশ্রয়ের জায়গা হয়ে ওঠে হাজী শরীয়তুল্লাহর এ আন্দোলন।

আজও তিনি ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন। তিনি বাঙালিকে শিখিয়েছেন ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর চেতনা। অসহায়ের পক্ষ নিয়ে শক্তিধর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ইস্পাতের মতো দাঁড়িয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। যুগ যুগ ধরে বাঙালি যখনই কারো দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, তখনই হাজী শরীয়তুল্লাহ অলক্ষে এসে দাঁড়িয়েছেন সামনে। জেগে উঠতে বলেছেন নতুন করে। প্রতিবাদ ও সংগ্রামের প্রেরণা হয়ে বাঙালির মনোজগৎকে আন্দোলিত করে গেছেন বারবার।

[তথ্যসূত্র: বাংলা পিডিয়া; দেওবন্দ আন্দোলন : ইতিহাস, ঐতিহ্য, অবদান]