০৯:০২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

সামাজিক সমস্যা: সামাজিক সমস্যার সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য, কারণ ও এটি মোকাবেলার উপায়

আহমেদ মিন্টো
  • প্রকাশ: ০৬:৩৯:২৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২১
  • / ৬১৫৮৪ বার পড়া হয়েছে

সামাজিক সমস্যা হলো সমাজ হতে উদ্ভূত একটি অপ্রত্যাশিত অবস্থা যা সমাজের অধিকাংশ লোকের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে।


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

কম হোক কিংবা বেশি, যে-কোনো সমাজে সমস্যা আছে। মানুষ যেমন ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক জীবনে বিভিন্ন রকম সমস্যার মধ্য দিয়ে যায়, তেমনি সমাজেও তাকে নানান সমস্যার মধ্য দিয়ে বসবাস করতে হয় যেহেতু মানুষ সামাজিক জীব এবং সমাজেই বাস করে। সমাজে বসবাসকালে মানুষ যে সকল সমস্যার সম্মুখীন হয় সেগুলোকেই বলে সামাজিক সমস্যা বলা হয়। সামাজিক সমস্যা মূলত সমাজেরই এক ধরনের অবস্থা যা মানুষ পছন্দ করে না আর কামনাও করে না। সামাজিক সমস্যা হলো এমন একটি নেতিবাচক ও অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থা মানুষ যার মুখোমুখি হতে চায় না, আবার কেউ মুখোমুখি হয়ে পড়লে তা থেকে মুক্তি পেতে চায়। সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির কিছু কারণ হলো প্রাকৃতিক, ভৌগলিক, দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি নানা কারণ সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির জন্যে দায়ী। উল্লেখ্য, একটি মাত্র কারণে সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হয় না; একাধিক কারণের ফলে একটি সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। এবং সামাজিক সমস্যা মোকাবেলা করার পন্থাও একটি নয়, বরং বিভিন্ন উপায়ে এবং কৌশলে সামাজিক সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এখানে সামাজিক সমস্যার সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য এবং সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির কারণ ও প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করা হলো।

সামাজিক সমস্যার সংজ্ঞা 

মানুষ যে দিন থেকে সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস শুরু করেছে ঠিক সে দিন থেকেই সামাজিক সমস্যা অনুভব করা হচ্ছে। সামাজিক সমস্যা হলো এমন অপ্রত্যাশিত অবস্থা যা সমাজ হতেই সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন সামাজিক বিজ্ঞানী সামাজিক সমস্যার সংজ্ঞা বিভিন্নভাবে দিয়েছেন, তবে কোনো সংজ্ঞাকেই এক্ষেত্রে পরিপূর্ণ বলা যাবে না। 

  • হর্টন ও লেসলি বলেছেন, “সামাজিক সমস্যা হলো এমন এক সামাজিক অবস্থা যা সমাজের অধিকাংশ লোকের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে এবং সংঘবদ্ধভাবে যা মোকাবেলা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়।” 
  • ড্রাইডেন-এত মতে, “সামাজিক সমস্যা বলতে এমন এক পরিস্থিতিকে বুঝায় যা চাপ, উত্তেজনা, দ্বন্দ্ব এবং হতাশা সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের বিভিন্ন চাহিদা পূরণে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।” 

সামাজিক বিজ্ঞানীদের সামাজিক সমস্যার বিভিন্ন সংজ্ঞা পর্যালোচনা বোঝা যায় যে, সামাজিক সমস্যা হলো এমন এক অনাকাঙ্খিত সামাজিক পরিস্থিতি যা অধিকাংশ সমাজবাসীর ওপর চাপ, উত্তেজনা, দ্বন্দ্ব, হতাশা ও ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে; তবে সদস্যরা এ পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এবং সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হয়। (হানিফ, ২০১৪)

সামাজিক সমস্যার বৈশিষ্ট্য 

সমাজেই বিভিন্ন ধরনের সমস্যা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সব সমস্যাই সামাজিক সমস্যা না। সামাজিক বিজ্ঞানীরা সামাজিক সমস্যার কিছু বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করেছেন, এগুলো নিচে উল্লেখ হলো:

১. অনাকাঙ্খিত সামাজিক অবস্থা: সামাজিক সমস্যা এমন এক ধরনের সামাজিক অবস্থা যার উদ্ভব কিংবা উপস্থিতি সমাজের মানুষ কামনা করে না এবং পছন্দও করে না। সামাজিক সমস্যা সব সময় অবাঞ্চিত সামাজিক পরিস্থিতি বলে বিবেচিত হয়। যেমন, দারিদ্র হলো একটি অনাকাঙ্খিত সামাজিক অবস্থা। 

২. অধিকাংশ লোকের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে: সামাজিক সমস্যা কখনো কোনো বিশেষ ব্যক্তির জন্য না হয়ে সমাজের বেশিরভাগ মানুষের জন্যে ক্ষতির কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। সমাজের অধিকাংশ মানুষ যখন তাদের স্বার্থ, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের দৃষ্টিতে একটি সামাজিক অবস্থাকে তাদের জন্যে ক্ষতিকারক বলে মনে করবে তখন তাকে সামাজিক সমস্যা বলে গণ্য করা হবে। এ অবস্থায় তাদের জীবনযাত্রার মান ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং উন্নতি ব্যাহত। প্রাথমিকভাবে মানুষ সামাজিক সমস্যাকে বিভিন্ন কারণে অনুভব নাও করতে পারে; কিন্তু এর ভয়াবহতা অধিকাংশকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে।

৩. সামাজিক চাপ, উত্তেজনা, দ্বন্দ্ব ও হতাশা সৃষ্টিকারী: যখন সমাজে অনাকাঙ্ক্ষিত একটি সামাজিক অবস্থার সৃষ্টি হয় তখন মানুষের মধ্যে ও সমাজে চাপ, উত্তেজনা, দ্বন্দ্ব, হতাশা ইত্যাদির উদ্ভব হয়ে থাকে। এতে করে সামাজিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে অন্তরায় সৃষ্টি হয়। কারণ সামাজিক সমস্যা সামাজিক শৃঙ্খলা, সংহতি ও কাঠামোকে দুর্বল করে দেয়। যেমন, সন্ত্রাষের কারণে সমাজের প্রায় প্রতিজন সদস্যই ভয়ের মধ্যে থাকে। 

৪. একাধিক কারণে সৃষ্ট, জটিল ও পরিবর্তনশীল: সামাজিক সমস্যা হলো এমন এক প্রকারের জটিল অবস্থা যার সৃষ্টি হয় একাধিক কারণে। যে সব কারণে সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হয় সেগুলো হয়ে থাকে দৈহিক, প্রাকৃতিক, ভৌগওলিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি। সমাজ যেমন পরিবর্তনশীল তেমনই সামাজিক সমস্যাও পরিবর্তনশীল। সময় ও স্থানভেদে সামাজিক সমস্যার রূপ পরিবর্তিত হয়। আজকের স্বাভাবক অবস্থা আগামীকাল সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে; আবার যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রচলিত নিয়ম বাংলাদেশে জটিল সমস্যা বলে বিবেচিত হতে পারে। 

৫. সমস্যা মোকাবেলায় যৌথ উদ্যোগ: সমাজে যখন একটি নেতিবাচক, অনাকাঙ্ক্ষিত কিংবা ক্ষতিকর কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে যাতে অধিকাংশ মানুষ উত্তেজিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে এবং দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হয় তখন তারা এ পরিস্থিতির হাত হতে মুক্তির জন্যে সংঘবদ্ধ হয়। উদ্ভুত সমস্যা মোকাবেলায় জনগণ যৌথ উদ্যোগ গড়ে তোলে সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করলে  এ সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। 

৬. সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় এ সমস্যা মোকাবেলা সম্ভব: সামাজিক সমস্যার চুড়ান্ত বৈশিষ্ট্য হলো, সংশ্লিষ্ট সমাজবাসীর সম্মিলিত বা যৌথ প্রচেষ্টায় এ সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব। সামাজিক সমস্যা কারো একার পক্ষে মোকাবেলা করা সম্ভব হয় না; তবে এ সমস্যার সমাধান থাকে মানুষের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার মধ্যে, যার জন্য প্রয়োজন সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা।  যেমন, জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে এদশে বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধিহার বাংলাদেশে হ্রাস পেয়েছে।

সামাজিক সমস্যার কারণসমূহ

সামাজিক সমস্যার জন্য বিশেষ কোনো একটি কারণকে এককভবে দায়ী করা ঠিক নয়। যেমন জনসংখ্যাবৃদ্ধি বাংলাদেশ কিংবা ভারতের মতো দেশের জন্য সব চেয়ে বড়ো সামাজিক সমস্যা। তবে শুধু একটি নয় বরং এই জনসংখ্যা বিস্ফোরণের জন্য বা অতিহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধর জন্য অনেকগুলো কারণ জড়িত রয়েছে। প্রাকৃতিক, মানসিক, শারীরিক, আর্থিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদির প্রভাব রয়েছে অপ্রত্যাশিত হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির  জন্য। সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করে এমন কারণসমূহ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ উভয়ভাবেই থাকতে পারে।

সামাজিক বিজ্ঞানীরা সামাজিক সমস্যার পেছনে মূল কারণ হিসেবে যেগুলো চিহ্নিত করেছেন, সেগুলো নিচে সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলো:

১. প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক কারণ: প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। বন্যা, খরা, জলোচ্ছাস, মহামারী, ঝড় ইত্যাদির জন্য সন্ত্রাস, দারিদ্র, অপরাধ, ভিক্ষাবৃত্তি ইত্যাদির সৃষ্টি হতে পারে। আবার অতি উষ্ণ অথবা শীত অঞ্চল, পাহাড়িয়া অথবা উপকূলীয় এলাকায়ও এসমস্ত সামাজিক সমস্যার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তবে সামাজিক সমস্যা সৃষ্টিতে প্রাকৃতিক ও ভৌগলিক কারণের প্রভাব পরোক্ষ ধরনের। 

২. শারীরিক ও মানসিক কারণ: শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা, অনেক সময় জনসংখ্যাবৃদ্ধি, অপসাংস্কৃতির অনুকরণ, বঞ্চনা, হতাশা, চাপ ও পীড়ন, নেশাগ্রস্থতা ইত্যাদি সমাজে সমস্যার জম্ম দেয়। শারীরিক গঠন ও অনেক সময় মানুষকে অপরাধ প্রবণ করে তোলে। 

৩. অর্থনৈতিক কারণ: সমাজের প্রত্যেকেরই ন্যূনতম অর্থনৈতিক নিরাপত্তা থাকা অত্যাবশ্যক। মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে আর্থিক সঙ্গতি থাকা দরকার। সমাজে সম্পদ ও সুযোগের সুষম বন্টন, সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা, আয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ ইত্যাদির নিশ্চয়তা না থাকলে সৃষ্টি হয় বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা। দারিদ্রকে বলা হয় সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির মূল কারণ। সত্যিকার অর্থে, অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা এবং অতি স্বচছলতা উভয় কারণই সমাজে দুর্নীতি, অপরাধ, সন্ত্রাস, নিরক্ষরতা, অপুষ্টি, বস্তিসহ নানা ধরনের সামাজিক সমস্যার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। 

৪. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণ: সামাজিক পরিবর্তন, শহুরে দারিদ্র ও বস্তি সমস্যা, অপরাধ ও কিশোর অপরাধ, অজ্ঞতা ও কুসংস্কার, মূল্যবোধের অবক্ষয়, কর্মমুখী ও নৈতিক শিক্ষার অভাব, সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত ইত্যাদি সামাজিক সমস্যার পেছনে বড়ো কারণ হিসেবে দেখা দেয়। 

৫. রাজনৈতিক কারণ: রাজনৈতিক কারণেও সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হয়ে থাকে। দ্রুত ও ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, গণতন্ত্র চর্চার অভাব, সুশাসনের অনুপস্থিতি, দেশপ্রেমের অভাব, রাজনৈতিক সন্ত্রাস ইত্যাদির কারণে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হয়। গঠনমূলক সামাজিক নীতি ও পরিকল্পনা এবং দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে না উঠলে উপস্থিত সামাজিক সমস্যাগুলোও মোকাবেলা করা যায় না। 

৬. আন্তর্জাতিক প্রভাবজনিত কারণ: বিজ্ঞানের উন্নতিতে বর্তমান বিশ্বে যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই সহজ ও দ্রুততর হয়েছে। বিজ্ঞান মানুষের কল্যাণ বয়ে এনেছে সত্য, কিন্তু এর পাশাপাশি কিছু সমস্যারও সৃষ্টি হয়েছে। বিজ্ঞানের উন্নতিতে অনেক রকমের সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হয়। যেমন, ড্রাগ ও অস্ত্রের চোরাচালান বৃদ্ধি পেয়েছে, বৈধ-অবৈধ বাণিজ্যচক্রের প্রভাব বেড়েছে, রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তৃত হয়েছে, সাংস্কৃতিক অনুপ্রবেশ ঘটছে ইত্যাদি যা সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির কিছু বড়ো বড়ো কারণ। বর্তমান যুগ সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ, এ যুগে সোশ্যাল মিডিয়াতে বিভিন্ন রকম গুজব, আপত্তিকর কন্টেন্ট, বক্তব্য ছড়িয়ে পড়লে সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়।

সামাজিক সমস্যা সমাধান বা মোকাবেলার উপায়সমূহ 

যেখানে সমাজ আছে, সেখানে সমস্যাও আছে। সমাজে বিরাজমান ওই সমস্যাই হলো সামাজিক সমস্যা। আবার সামাজিক সমস্যাগুলো এমন নয় যে, ওগুলো সমাধান, মোকাবেলা বা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। কিন্তু সামাজিক সমস্যা যেমন একদিনে কিংবা একবারে সৃষ্টি হয় না, তেমনই একদিনে বা একবারে শেষও হয় না। তবে কথা হলো কোনো একটি সামাজিক সমস্যা চরম আকার ধারণ করার আগেই তা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং তা করতে হবে সংঘবদ্ধ হয়ে।

নিচে সামাজিক সমস্যা মোকাবেলা করার বিভিন্ন উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হলো: 

১. সামাজিক গবেষণা ও অনুসন্ধান কাজ পরিচালনা: সামাজিক সমস্যা মোকাবেলা করতে হবে সুপরিকল্পিতভাবে; এর জন্য বিভিন্ন জরিপ, গবেষণা ও অনুসন্ধানমূলক কাজ জরুরি। এই প্রক্রিয়ায় সমস্যার ধরন, কারণ, প্রভাব, নিরসনের উপায় ইত্যাদি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ও সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যাবে।

২. পরিকল্পনা প্রণয়ন: গবেষণা করে বা পদ্ধতিগত অনুসন্ধান করে তা থেকে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে সমস্যা মোকাবেলার জন্যে উপযোগী পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। পরিকল্পনা মাফিক কাজ করতে পারলে খরচ, শ্রম ও সময় যেমন কম লাগবে, তেমনি সমস্যা দূরীকরণও সহজ হবে। 

৩. মানব সম্পদ উন্নয়ন: সামাজিক সমস্যা সমাধান করার জন্য এ সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য ও পরিকল্পনা বিষয়ে জনসাধারণকে অবহিত করতে হবে। এতে জনগণ সচেতন, সক্রিয় ও উদ্যোগী হয়ে সমস্যা মোকাবেলায় স্বতঃস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করবে। তাছাড়া দেশের সকল শ্রেণিরর নাগরিকদেরকে শিক্ষিত করতে হবে এবং স্বাস্থ্য, অধিকার-কর্তব্য, জাতীয় উন্নয়ন, সম্পদের সদ্ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষিত করে তাদেরকে মানব সম্পদে রূপান্তরিত করতে হবে। এতে সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির আগে যেমন প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হবে, তেমনি উপস্থিত সমস্যা সমাধানেও সফল হতে পারবে। দেশের  জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে বা মানবসম্পদে রূপান্তরিত করতে হবে। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। 

৪. সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার: দেশের মানবীয় ও বস্তুগত সম্পদের সর্বোত্তম সদ্ব্যবহার করতে হবে। কেননা, মানুষের সমস্যা মেকাবেলায় উপযোগী বহু সম্পদই অব্যবহৃত থেকে যায়। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে উপস্থিত সম্পদ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে যে-কোনো সামাজিক সমস্যাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। 

৫. মৌলিক ও মানবিক চাহিদাপূরণ এবং সম্পদ ও সুযোগের সুষম বণ্টন: মানুষের মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণ না হলে সমাজ থেকে সমস্যা দূর হবে না। তাই সকলের ন্যূনতম আয় ও কর্মসংস্থান খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, নিরাপত্তা ইত্যাদির নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। পাশাপাশি, দেশের সকল সম্পদ ও সুযোগের বন্টন সুষম করতে হবে। তা না হলে সৃষ্টি হবে বৈষম্য, শোষণ, শ্রেণিদ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ ইত্যাদি। ফলে নানা ধরনের সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হবে এবং তা ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করবে।

৬. সুনেতৃত্ব ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা: সমাজের প্রতিটি বিষয়ই রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে হয়। দেশে সুশাসন, ভালো রাজনীতি, যোগ্য নেতৃত্ব এবং সুশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তবেই সুষ্ঠুভাবে যে-কোনো সমস্যা নিরসন করা সম্ভব হবে। দেশ ও সমাজ উন্নয়নের এটিই হলো প্রধান পূর্বশর্ত। 

৭. স্থানীয় ক্ষমতাকাঠামো শক্তিশালীকরণ ও গনতন্ত্র চর্চা: সরকারের (কেন্দ্রীয় প্রশাসন) একার পক্ষে দেশের সকল সমস্যা সম্পর্কে জানা ও মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। তাই বিভিন্ন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটিয়ে সকলকে সুযোগ দিতে হবে সামাজিক সমস্যা মোকাবেলায় অংশগ্রহণ করতে। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদ ইত্যাদির মাধ্যমে সামাজিক সমস্যা দূরীকরণ সহজ হয়।

৮. বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও (NGO) এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করা: বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধানে প্রতিটি দেশেই অনেক রকমের এনজিও কাজ করে। সরকার বা প্রশাসনের উচিৎ হবে এনজিওগুলোকে আরও কাছে টেনে নিয়ে তাদের সহযোগিতায় সামাজিক সমস্যামুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা। তাছাড়া দেশের বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকেও এক্ষেত্রে কাজে লাগানো যেতে পারে। ধর্মীয় নেতাদের উপদেশ ও পরামর্শে মানুষ আরও আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসবে সামাজিক সমস্যা মোকাবেলা করতে।

উপসংহার

সামাজিক সমস্যা সমাজ হতে উদ্ভূত একটি অপ্রত্যাশিত অবস্থা যা সমাজের অধিকাংশ লোকের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে। এতে মানুষ উদ্বিগ্ন, উত্তেজিত ও আন্দোলনমুখী হয়। সমস্যা মোকাবেলায় সমাজ সদস্যরা সংঘবদ্ধ হয় এবং এর মাধ্যমে সমস্যা সমাধান বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। সমাজে সমস্যা যেমন আছে, তেমনি সমস্যা সমাধান করার উপায়ও রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য সংঘবদ্ধভাবে বা সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা করতে হবে।

এ. টি. এম. হানিফ কর্তৃক সম্পাদিত ও বাউবি কর্তৃক প্রকাশিত ‘সমাজকল্যান দ্বিতীয় পত্র’ পাঠ্যবই অনুকরণ করে লিখিত।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

আহমেদ মিন্টো

মিন্টো একজন ফ্রিল্যান্স লেখক এবং বিশ্লেষণ'র কন্ট্রিবিউটর।

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

সামাজিক সমস্যা: সামাজিক সমস্যার সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য, কারণ ও এটি মোকাবেলার উপায়

প্রকাশ: ০৬:৩৯:২৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২১

কম হোক কিংবা বেশি, যে-কোনো সমাজে সমস্যা আছে। মানুষ যেমন ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক জীবনে বিভিন্ন রকম সমস্যার মধ্য দিয়ে যায়, তেমনি সমাজেও তাকে নানান সমস্যার মধ্য দিয়ে বসবাস করতে হয় যেহেতু মানুষ সামাজিক জীব এবং সমাজেই বাস করে। সমাজে বসবাসকালে মানুষ যে সকল সমস্যার সম্মুখীন হয় সেগুলোকেই বলে সামাজিক সমস্যা বলা হয়। সামাজিক সমস্যা মূলত সমাজেরই এক ধরনের অবস্থা যা মানুষ পছন্দ করে না আর কামনাও করে না। সামাজিক সমস্যা হলো এমন একটি নেতিবাচক ও অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থা মানুষ যার মুখোমুখি হতে চায় না, আবার কেউ মুখোমুখি হয়ে পড়লে তা থেকে মুক্তি পেতে চায়। সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির কিছু কারণ হলো প্রাকৃতিক, ভৌগলিক, দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি নানা কারণ সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির জন্যে দায়ী। উল্লেখ্য, একটি মাত্র কারণে সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হয় না; একাধিক কারণের ফলে একটি সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। এবং সামাজিক সমস্যা মোকাবেলা করার পন্থাও একটি নয়, বরং বিভিন্ন উপায়ে এবং কৌশলে সামাজিক সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এখানে সামাজিক সমস্যার সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য এবং সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির কারণ ও প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করা হলো।

সামাজিক সমস্যার সংজ্ঞা 

মানুষ যে দিন থেকে সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস শুরু করেছে ঠিক সে দিন থেকেই সামাজিক সমস্যা অনুভব করা হচ্ছে। সামাজিক সমস্যা হলো এমন অপ্রত্যাশিত অবস্থা যা সমাজ হতেই সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন সামাজিক বিজ্ঞানী সামাজিক সমস্যার সংজ্ঞা বিভিন্নভাবে দিয়েছেন, তবে কোনো সংজ্ঞাকেই এক্ষেত্রে পরিপূর্ণ বলা যাবে না। 

  • হর্টন ও লেসলি বলেছেন, “সামাজিক সমস্যা হলো এমন এক সামাজিক অবস্থা যা সমাজের অধিকাংশ লোকের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে এবং সংঘবদ্ধভাবে যা মোকাবেলা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়।” 
  • ড্রাইডেন-এত মতে, “সামাজিক সমস্যা বলতে এমন এক পরিস্থিতিকে বুঝায় যা চাপ, উত্তেজনা, দ্বন্দ্ব এবং হতাশা সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের বিভিন্ন চাহিদা পূরণে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।” 

সামাজিক বিজ্ঞানীদের সামাজিক সমস্যার বিভিন্ন সংজ্ঞা পর্যালোচনা বোঝা যায় যে, সামাজিক সমস্যা হলো এমন এক অনাকাঙ্খিত সামাজিক পরিস্থিতি যা অধিকাংশ সমাজবাসীর ওপর চাপ, উত্তেজনা, দ্বন্দ্ব, হতাশা ও ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে; তবে সদস্যরা এ পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এবং সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হয়। (হানিফ, ২০১৪)

সামাজিক সমস্যার বৈশিষ্ট্য 

সমাজেই বিভিন্ন ধরনের সমস্যা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সব সমস্যাই সামাজিক সমস্যা না। সামাজিক বিজ্ঞানীরা সামাজিক সমস্যার কিছু বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করেছেন, এগুলো নিচে উল্লেখ হলো:

১. অনাকাঙ্খিত সামাজিক অবস্থা: সামাজিক সমস্যা এমন এক ধরনের সামাজিক অবস্থা যার উদ্ভব কিংবা উপস্থিতি সমাজের মানুষ কামনা করে না এবং পছন্দও করে না। সামাজিক সমস্যা সব সময় অবাঞ্চিত সামাজিক পরিস্থিতি বলে বিবেচিত হয়। যেমন, দারিদ্র হলো একটি অনাকাঙ্খিত সামাজিক অবস্থা। 

২. অধিকাংশ লোকের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে: সামাজিক সমস্যা কখনো কোনো বিশেষ ব্যক্তির জন্য না হয়ে সমাজের বেশিরভাগ মানুষের জন্যে ক্ষতির কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। সমাজের অধিকাংশ মানুষ যখন তাদের স্বার্থ, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের দৃষ্টিতে একটি সামাজিক অবস্থাকে তাদের জন্যে ক্ষতিকারক বলে মনে করবে তখন তাকে সামাজিক সমস্যা বলে গণ্য করা হবে। এ অবস্থায় তাদের জীবনযাত্রার মান ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং উন্নতি ব্যাহত। প্রাথমিকভাবে মানুষ সামাজিক সমস্যাকে বিভিন্ন কারণে অনুভব নাও করতে পারে; কিন্তু এর ভয়াবহতা অধিকাংশকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে।

৩. সামাজিক চাপ, উত্তেজনা, দ্বন্দ্ব ও হতাশা সৃষ্টিকারী: যখন সমাজে অনাকাঙ্ক্ষিত একটি সামাজিক অবস্থার সৃষ্টি হয় তখন মানুষের মধ্যে ও সমাজে চাপ, উত্তেজনা, দ্বন্দ্ব, হতাশা ইত্যাদির উদ্ভব হয়ে থাকে। এতে করে সামাজিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে অন্তরায় সৃষ্টি হয়। কারণ সামাজিক সমস্যা সামাজিক শৃঙ্খলা, সংহতি ও কাঠামোকে দুর্বল করে দেয়। যেমন, সন্ত্রাষের কারণে সমাজের প্রায় প্রতিজন সদস্যই ভয়ের মধ্যে থাকে। 

৪. একাধিক কারণে সৃষ্ট, জটিল ও পরিবর্তনশীল: সামাজিক সমস্যা হলো এমন এক প্রকারের জটিল অবস্থা যার সৃষ্টি হয় একাধিক কারণে। যে সব কারণে সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হয় সেগুলো হয়ে থাকে দৈহিক, প্রাকৃতিক, ভৌগওলিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি। সমাজ যেমন পরিবর্তনশীল তেমনই সামাজিক সমস্যাও পরিবর্তনশীল। সময় ও স্থানভেদে সামাজিক সমস্যার রূপ পরিবর্তিত হয়। আজকের স্বাভাবক অবস্থা আগামীকাল সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে; আবার যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রচলিত নিয়ম বাংলাদেশে জটিল সমস্যা বলে বিবেচিত হতে পারে। 

৫. সমস্যা মোকাবেলায় যৌথ উদ্যোগ: সমাজে যখন একটি নেতিবাচক, অনাকাঙ্ক্ষিত কিংবা ক্ষতিকর কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে যাতে অধিকাংশ মানুষ উত্তেজিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে এবং দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হয় তখন তারা এ পরিস্থিতির হাত হতে মুক্তির জন্যে সংঘবদ্ধ হয়। উদ্ভুত সমস্যা মোকাবেলায় জনগণ যৌথ উদ্যোগ গড়ে তোলে সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করলে  এ সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। 

৬. সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় এ সমস্যা মোকাবেলা সম্ভব: সামাজিক সমস্যার চুড়ান্ত বৈশিষ্ট্য হলো, সংশ্লিষ্ট সমাজবাসীর সম্মিলিত বা যৌথ প্রচেষ্টায় এ সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব। সামাজিক সমস্যা কারো একার পক্ষে মোকাবেলা করা সম্ভব হয় না; তবে এ সমস্যার সমাধান থাকে মানুষের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার মধ্যে, যার জন্য প্রয়োজন সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা।  যেমন, জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে এদশে বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধিহার বাংলাদেশে হ্রাস পেয়েছে।

সামাজিক সমস্যার কারণসমূহ

সামাজিক সমস্যার জন্য বিশেষ কোনো একটি কারণকে এককভবে দায়ী করা ঠিক নয়। যেমন জনসংখ্যাবৃদ্ধি বাংলাদেশ কিংবা ভারতের মতো দেশের জন্য সব চেয়ে বড়ো সামাজিক সমস্যা। তবে শুধু একটি নয় বরং এই জনসংখ্যা বিস্ফোরণের জন্য বা অতিহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধর জন্য অনেকগুলো কারণ জড়িত রয়েছে। প্রাকৃতিক, মানসিক, শারীরিক, আর্থিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদির প্রভাব রয়েছে অপ্রত্যাশিত হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির  জন্য। সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করে এমন কারণসমূহ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ উভয়ভাবেই থাকতে পারে।

সামাজিক বিজ্ঞানীরা সামাজিক সমস্যার পেছনে মূল কারণ হিসেবে যেগুলো চিহ্নিত করেছেন, সেগুলো নিচে সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলো:

১. প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক কারণ: প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। বন্যা, খরা, জলোচ্ছাস, মহামারী, ঝড় ইত্যাদির জন্য সন্ত্রাস, দারিদ্র, অপরাধ, ভিক্ষাবৃত্তি ইত্যাদির সৃষ্টি হতে পারে। আবার অতি উষ্ণ অথবা শীত অঞ্চল, পাহাড়িয়া অথবা উপকূলীয় এলাকায়ও এসমস্ত সামাজিক সমস্যার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তবে সামাজিক সমস্যা সৃষ্টিতে প্রাকৃতিক ও ভৌগলিক কারণের প্রভাব পরোক্ষ ধরনের। 

২. শারীরিক ও মানসিক কারণ: শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা, অনেক সময় জনসংখ্যাবৃদ্ধি, অপসাংস্কৃতির অনুকরণ, বঞ্চনা, হতাশা, চাপ ও পীড়ন, নেশাগ্রস্থতা ইত্যাদি সমাজে সমস্যার জম্ম দেয়। শারীরিক গঠন ও অনেক সময় মানুষকে অপরাধ প্রবণ করে তোলে। 

৩. অর্থনৈতিক কারণ: সমাজের প্রত্যেকেরই ন্যূনতম অর্থনৈতিক নিরাপত্তা থাকা অত্যাবশ্যক। মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে আর্থিক সঙ্গতি থাকা দরকার। সমাজে সম্পদ ও সুযোগের সুষম বন্টন, সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা, আয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ ইত্যাদির নিশ্চয়তা না থাকলে সৃষ্টি হয় বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা। দারিদ্রকে বলা হয় সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির মূল কারণ। সত্যিকার অর্থে, অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা এবং অতি স্বচছলতা উভয় কারণই সমাজে দুর্নীতি, অপরাধ, সন্ত্রাস, নিরক্ষরতা, অপুষ্টি, বস্তিসহ নানা ধরনের সামাজিক সমস্যার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। 

৪. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণ: সামাজিক পরিবর্তন, শহুরে দারিদ্র ও বস্তি সমস্যা, অপরাধ ও কিশোর অপরাধ, অজ্ঞতা ও কুসংস্কার, মূল্যবোধের অবক্ষয়, কর্মমুখী ও নৈতিক শিক্ষার অভাব, সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত ইত্যাদি সামাজিক সমস্যার পেছনে বড়ো কারণ হিসেবে দেখা দেয়। 

৫. রাজনৈতিক কারণ: রাজনৈতিক কারণেও সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হয়ে থাকে। দ্রুত ও ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, গণতন্ত্র চর্চার অভাব, সুশাসনের অনুপস্থিতি, দেশপ্রেমের অভাব, রাজনৈতিক সন্ত্রাস ইত্যাদির কারণে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হয়। গঠনমূলক সামাজিক নীতি ও পরিকল্পনা এবং দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে না উঠলে উপস্থিত সামাজিক সমস্যাগুলোও মোকাবেলা করা যায় না। 

৬. আন্তর্জাতিক প্রভাবজনিত কারণ: বিজ্ঞানের উন্নতিতে বর্তমান বিশ্বে যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই সহজ ও দ্রুততর হয়েছে। বিজ্ঞান মানুষের কল্যাণ বয়ে এনেছে সত্য, কিন্তু এর পাশাপাশি কিছু সমস্যারও সৃষ্টি হয়েছে। বিজ্ঞানের উন্নতিতে অনেক রকমের সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হয়। যেমন, ড্রাগ ও অস্ত্রের চোরাচালান বৃদ্ধি পেয়েছে, বৈধ-অবৈধ বাণিজ্যচক্রের প্রভাব বেড়েছে, রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তৃত হয়েছে, সাংস্কৃতিক অনুপ্রবেশ ঘটছে ইত্যাদি যা সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির কিছু বড়ো বড়ো কারণ। বর্তমান যুগ সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ, এ যুগে সোশ্যাল মিডিয়াতে বিভিন্ন রকম গুজব, আপত্তিকর কন্টেন্ট, বক্তব্য ছড়িয়ে পড়লে সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়।

সামাজিক সমস্যা সমাধান বা মোকাবেলার উপায়সমূহ 

যেখানে সমাজ আছে, সেখানে সমস্যাও আছে। সমাজে বিরাজমান ওই সমস্যাই হলো সামাজিক সমস্যা। আবার সামাজিক সমস্যাগুলো এমন নয় যে, ওগুলো সমাধান, মোকাবেলা বা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। কিন্তু সামাজিক সমস্যা যেমন একদিনে কিংবা একবারে সৃষ্টি হয় না, তেমনই একদিনে বা একবারে শেষও হয় না। তবে কথা হলো কোনো একটি সামাজিক সমস্যা চরম আকার ধারণ করার আগেই তা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং তা করতে হবে সংঘবদ্ধ হয়ে।

নিচে সামাজিক সমস্যা মোকাবেলা করার বিভিন্ন উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হলো: 

১. সামাজিক গবেষণা ও অনুসন্ধান কাজ পরিচালনা: সামাজিক সমস্যা মোকাবেলা করতে হবে সুপরিকল্পিতভাবে; এর জন্য বিভিন্ন জরিপ, গবেষণা ও অনুসন্ধানমূলক কাজ জরুরি। এই প্রক্রিয়ায় সমস্যার ধরন, কারণ, প্রভাব, নিরসনের উপায় ইত্যাদি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ও সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যাবে।

২. পরিকল্পনা প্রণয়ন: গবেষণা করে বা পদ্ধতিগত অনুসন্ধান করে তা থেকে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে সমস্যা মোকাবেলার জন্যে উপযোগী পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। পরিকল্পনা মাফিক কাজ করতে পারলে খরচ, শ্রম ও সময় যেমন কম লাগবে, তেমনি সমস্যা দূরীকরণও সহজ হবে। 

৩. মানব সম্পদ উন্নয়ন: সামাজিক সমস্যা সমাধান করার জন্য এ সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য ও পরিকল্পনা বিষয়ে জনসাধারণকে অবহিত করতে হবে। এতে জনগণ সচেতন, সক্রিয় ও উদ্যোগী হয়ে সমস্যা মোকাবেলায় স্বতঃস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করবে। তাছাড়া দেশের সকল শ্রেণিরর নাগরিকদেরকে শিক্ষিত করতে হবে এবং স্বাস্থ্য, অধিকার-কর্তব্য, জাতীয় উন্নয়ন, সম্পদের সদ্ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষিত করে তাদেরকে মানব সম্পদে রূপান্তরিত করতে হবে। এতে সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির আগে যেমন প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হবে, তেমনি উপস্থিত সমস্যা সমাধানেও সফল হতে পারবে। দেশের  জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে বা মানবসম্পদে রূপান্তরিত করতে হবে। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। 

৪. সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার: দেশের মানবীয় ও বস্তুগত সম্পদের সর্বোত্তম সদ্ব্যবহার করতে হবে। কেননা, মানুষের সমস্যা মেকাবেলায় উপযোগী বহু সম্পদই অব্যবহৃত থেকে যায়। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে উপস্থিত সম্পদ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে যে-কোনো সামাজিক সমস্যাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। 

৫. মৌলিক ও মানবিক চাহিদাপূরণ এবং সম্পদ ও সুযোগের সুষম বণ্টন: মানুষের মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণ না হলে সমাজ থেকে সমস্যা দূর হবে না। তাই সকলের ন্যূনতম আয় ও কর্মসংস্থান খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, নিরাপত্তা ইত্যাদির নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। পাশাপাশি, দেশের সকল সম্পদ ও সুযোগের বন্টন সুষম করতে হবে। তা না হলে সৃষ্টি হবে বৈষম্য, শোষণ, শ্রেণিদ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ ইত্যাদি। ফলে নানা ধরনের সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হবে এবং তা ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করবে।

৬. সুনেতৃত্ব ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা: সমাজের প্রতিটি বিষয়ই রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে হয়। দেশে সুশাসন, ভালো রাজনীতি, যোগ্য নেতৃত্ব এবং সুশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তবেই সুষ্ঠুভাবে যে-কোনো সমস্যা নিরসন করা সম্ভব হবে। দেশ ও সমাজ উন্নয়নের এটিই হলো প্রধান পূর্বশর্ত। 

৭. স্থানীয় ক্ষমতাকাঠামো শক্তিশালীকরণ ও গনতন্ত্র চর্চা: সরকারের (কেন্দ্রীয় প্রশাসন) একার পক্ষে দেশের সকল সমস্যা সম্পর্কে জানা ও মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। তাই বিভিন্ন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটিয়ে সকলকে সুযোগ দিতে হবে সামাজিক সমস্যা মোকাবেলায় অংশগ্রহণ করতে। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদ ইত্যাদির মাধ্যমে সামাজিক সমস্যা দূরীকরণ সহজ হয়।

৮. বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও (NGO) এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করা: বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধানে প্রতিটি দেশেই অনেক রকমের এনজিও কাজ করে। সরকার বা প্রশাসনের উচিৎ হবে এনজিওগুলোকে আরও কাছে টেনে নিয়ে তাদের সহযোগিতায় সামাজিক সমস্যামুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা। তাছাড়া দেশের বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকেও এক্ষেত্রে কাজে লাগানো যেতে পারে। ধর্মীয় নেতাদের উপদেশ ও পরামর্শে মানুষ আরও আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসবে সামাজিক সমস্যা মোকাবেলা করতে।

উপসংহার

সামাজিক সমস্যা সমাজ হতে উদ্ভূত একটি অপ্রত্যাশিত অবস্থা যা সমাজের অধিকাংশ লোকের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে। এতে মানুষ উদ্বিগ্ন, উত্তেজিত ও আন্দোলনমুখী হয়। সমস্যা মোকাবেলায় সমাজ সদস্যরা সংঘবদ্ধ হয় এবং এর মাধ্যমে সমস্যা সমাধান বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। সমাজে সমস্যা যেমন আছে, তেমনি সমস্যা সমাধান করার উপায়ও রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য সংঘবদ্ধভাবে বা সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা করতে হবে।

এ. টি. এম. হানিফ কর্তৃক সম্পাদিত ও বাউবি কর্তৃক প্রকাশিত ‘সমাজকল্যান দ্বিতীয় পত্র’ পাঠ্যবই অনুকরণ করে লিখিত।