০৮:৫৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা কী? মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার পরিধি এবং বৈশিষ্ট্য

আহমেদ মিন্টো
  • প্রকাশ: ১২:২৭:০৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২১
  • / ৪০৭৯৩ বার পড়া হয়েছে

যে-কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্যই মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মৌলিক কাজ | ছবি: সেবাস্তিয়ান হারম্যান

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা ধারণাটির ইতিহাস অনেক লম্বা। তবে বর্তমানে যে পরিপূর্ণ মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক ধারণা লক্ষ্য করছি তা মূলত বিংশ শতাব্দীর ফসল। ব্যবস্থাপনার ক্রমবিকাশ ও বিবর্তনের ধারায় মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়টিকে সামগ্রীক ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের উন্নয়নের ধারায় সংযোজিত এক নতুন অধ্যায়; একে কর্মী ব্যবস্থাপনার সমষ্টিগত আকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা হলো প্রতিষ্ঠানের কর্মরত সকল স্তরের মানবীয় উপকরণের সাথে জড়িত সব কাজের সমন্বিত দিক। অতীতে প্রতিষ্ঠানের জনশক্তিকে অন্যান্য উপকরণের ন্যায় সাধারণ একটি উপকরণ মনে করা হতো। কিন্তু বর্তমানে এ ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে জনশক্তিকে সংগঠনের সবচেয়ে মূল্যবান ও অপরিহার্য উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এই নিবন্ধে যা আছে

কর্মী ব্যবস্থাপনা থেকে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা

কর্মী ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের যে সকল ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন রবার্ট ওয়েন (Robert Owen) তাদের মধ্যে অন্যতম। রবার্ট ওয়েনকে বলা হয় আধুনিক কর্মী ব্যবস্থাপনার জনক। তিনি ছিলেন একটি বস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক। রবার্ট ওয়েন তার প্রতিষ্ঠানে শিশু শ্রম নিষিদ্ধ করে শ্রমিক কর্মীদের কল্যাণের জন্য বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি গ্রহণের সুপারিশ করেন। ১৮১৩ সালে তিনি সর্বপ্রথম A new view of society নামক একটি গ্রন্থে শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য কর্মসূচি গ্রহণের সুপারিশ করেন; এই কারণে অনেকেই মানেন আধুনিক কর্মী ব্যবস্থাপনার জনক বা প্রতিষ্ঠাতা হলেন রবার্ট ওয়েন।

১৯১১ খৃষ্টাব্দে এফ. ডব্লিউ. টেইলর (F. W. Taylor) সায়েন্টফিক ম্যানেজমেন্ট (Scientific management) গ্রন্থে পরিকল্পনা বিভাগের আওতায় এমপ্লয়েমেন্ট ব্যুরো (Employment Bureau) নামে একটি স্বতন্ত্র শাখার কথা বলে কর্মী ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের পথকে সুগম করেছেন।

১৯১২ সালে শ্রমিক কর্মীদের কল্যাণের জন্য শিল্পপতিগণ কল্যাণ সচিব (Welfare Secretaries) নিয়োগ করে। পরবর্তীতে এই কল্যাণ সচিব বা ওয়েলফেয়ার সেক্রেটারিগণ কর্মীব্যবস্থাপক হিসেবে পরিচিত লাভ করেন।

কেউ কেউ বলেন, শিল্প কারখানায় কর্মরত প্রত্যেক শ্রমিকের কার্য সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার জন্য ১৯২০ খৃষ্টাব্দে প্রথম কর্মী ব্যবস্থাপনার আত্ম প্রকাশ ঘটে। ১৯৪৫ সালের পর থেকে কর্মী ব্যবস্থাপনার দ্রুত উন্নতি ঘটে। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও সামাজিক পরিবর্তনের ফলে ব্যবস্থাপনা ও শ্রমিকদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে। ফলে পৃথক কর্মী বিভাগের প্রয়োজনীয়তা বাড়তে থাকে।

সাধারণ অর্থে কর্মী বলতে সংগঠনের নিুস্তরের কর্মচারী ও শ্রমিকদের বুঝায়, অথচ কার্য সম্পাদনের জন্য প্রত্যক্ষভাবে সংগঠনের মধ্যমে ও উচ্চস্তরের নির্বাহীগণও জড়িত থাকে। সে অর্থে কর্মী ব্যবস্থাপনা কথাটির দ্বারা এর আওতা সীমিত হয়ে পড়ে ফলে সংগঠনের সকল স্তরের মানবীয় উপাদানকে বুঝানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্ব প্রথম ১৯৫০ সালের পর থেকে কর্মী ব্যবস্থাপনা বিভাগের নাম পরিবর্তন করে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা রেখেছে। সেই থেকে এ বিষয়টি মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা নাম পরিগ্রহ করে সর্বক্ষেত্রে ব্যবহৃত ও প্রচলিত হচ্ছে।

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার সংজ্ঞা (Definition of Human resource management)

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা হলো সার্বজনীন মৌলিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাপনা। সাধারণ অর্থে শিল্প কারখানায় ও অফিসে কর্মরত শ্রমিক কর্মীদের ব্যবস্থাপনাকে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বলে।

ব্যবস্থাপনার যে অংশের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের কর্মরত মানবীয় উপাদান সংক্রান্ত প্রশাসন পরিচালনা করা হয় তাই মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা নামে পরিচিত।

পূর্বে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনাকে কর্মী ব্যবস্থাপনা (Personnel management), শ্রম ব্যবস্থাপনা (Labour management), কর্মী প্রশাসন (Personal administration), শিল্প ব্যবস্থাপনা (Industrial management) ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হতো।

Gray Dessler- এর মতে, “মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যা কর্মী সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ, মূল্যায়ন, ক্ষতিপূরণ এবং তাদের শ্রম সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা এবং ন্যায় নিষ্ঠার সাথে সম্পর্কিত”  [Human resource management is the process of acquiring, training, appraising and compensating, employees, and attending to their labour relations, health and safety, and fairness concerns..]

Ricky W. Griffin এর মতে, “মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা হলো পরস্পর সম্পূরক কতিপয় সাংগঠনিক কাজ যা কার্যকর কর্মীদল আকর্ষণ, উন্নয়ন ও সংরক্ষণের সাথে জড়িত ।  [Human resource management is the set of organizational activities directed at attracting developing and maintaining an effective workforce.]

David A. Decenzo and Stephen P. Robbins এর মতে, “মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা চারটি কাজের সমন্বয়ে গঠিত (১) স্টাফিং (২) প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন (৩) প্রেষণা দান এবং (৪) সংরক্ষণ বা ধারে রাখার ব্যবস্থা করা [Human resource management is made of four activities (i) Staffing (ii) Training and development (iii) Motivation and (iv) Maintenance.]

উল্লেখিত আলোচনা ও বিশেষজ্ঞ সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করে চূড়ান্তভাবে বলা যায়, প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নয়ন সুদক্ষ কর্মী বাহিনীর উপর নির্ভরশীল- যাদের সার্বিক ভাবে গড়ে তোলার দায়িত্ব ন্যাস্ত থাকে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার উপর। তাই বলা যায়, প্রতিষ্ঠানের মানবীয় উপাদান সংক্রান্ত সকল কার্যের সমষ্টিকে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা (HRM) হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। প্রতিষ্ঠানের মানব সম্পদ একমাত্র উপাদান যার সেবা কার্য ও উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য ব্যবহৃত অন্যান্য উপাদান গুলোকে সমন্বয় করে।

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার আওতা বা পরিধি (Scope of Human Resource Management)

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা মৌলিক ব্যবস্থাপনার অংশ হলেও এর গুরুত্ব অফিসের অন্যান্য বিভাগের তুলনায় বেশ ব্যাপক। প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন কার্যাবলি সম্পাদনের যে সকল উপাদান ব্যবহৃত হয় সেগুলোর সমন্বয় পূর্বক মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা অফিসকে রাখে সর্বদা সচল ও গতিশীল। শিল্প সম্পর্ক উন্নয়ন, পারিতোষিক ও মজুরি নির্ধারণ সর্বপরি তাদের উন্নয়ন ও সংরক্ষণ করা মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার প্রধান দায়িত্ব্। তাই বলা যায় প্রতিষ্ঠানের কর্মরত সকল স্তরের কর্মী সংক্রান্ত নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার কাজ বলে এর আওতা বা পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক।

নিচে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত বিষয়সমূহ উপস্থাপন করা হলো

১. মানব সম্পদ পরিকল্পনা (Human Resource Planning)

মানব সম্পদ পরিকল্পনার একটি মৌলিক উদ্দেশ্য হলো প্রতিষ্ঠানের কাজের প্রকৃতি ও ধরন অনুযায়ী কার্য বিভক্তি করে যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মীদের মধ্যে তা বণ্টন করে দেওয়া। সময়মতো সঠিক ব্যক্তিকে সঠিক দায়িত্বে নিয়োজিত করার জন্য বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে সে অনুযায়ী বিভিন্ন মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়।

২. সংগঠন ও পদের নকশা প্রণয়ন (Design of Organization & Job)

প্রতিষ্ঠানের সামগ্রীক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ। তাই কার্যকর সংগঠন কাঠামো নির্ধারণ, কার্যভিত্তিক পদ সৃষ্টি ও বিন্যাস, পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ, দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রদর্শন করা মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভূক্ত। এজন্য পদ অনুযায়ী মানব সম্পদের চাহিদা নির্ধারণ ও উৎস নির্বাচন করে পদভিত্তিক কর্মী নিয়োগ করতে হয়।

৩. কার্য বর্ণনা (Description of Work)

সংগঠনের জন্য প্রণীত নকশায় পদ ভিত্তিক বণ্টনকৃত কার্যের বর্ণনা মনব সম্পদ ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভূক্ত। এতে বিভিন্ন পদের বিপরীতে কার্যের সীমানা নির্ধারণ করা হয় এবং কাজের সামগ্রীক বর্ণনা সহজতর হয়।

৪. নির্বাচন ও স্টাফিং (Selections & Staffing)

প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে প্রয়োজনীয় দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মী খুঁজে বের করা হয় এবং তাদের কাজের জন্য নির্বাচন করে উপযুক্ত ব্যক্তিকে সঠিক স্থানে পদায়ন করা হয়। এ পর্যায়ে কর্তৃপক্ষ কর্মীর প্রয়োজন সনাক্তকরণ, কর্মী সংগ্রহের উৎস নির্বাচন, পদোন্নতি, বদলি ইত্যাদি কার্য সম্পাদন করেন।

৫. প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন (Training & Development)

কর্মীকে তার কার্য পরিবেশ, পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও কাজ সম্পর্কে হাতে কলমে শিক্ষা দেয়াকে প্রশিক্ষণ বলে। অন্যদিকে কর্মরত কর্মীকে অধিক দক্ষ করে গড়ে তোলার কাজকে উন্নয়ন বলে। প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে কর্মীকে কাজের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলা যায়।

৬. সাংগঠনিক উন্নয়ন (Organizational Development)

প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মীদের সন্তুষ্টির জন্য সঠিক ভাবে কার্য মূল্যায়ন ও পদ মূল্যায়ন করে সংগঠনের সকল স্তরের কর্মকর্তা ও কর্মীর মধ্যে আন্তঃব্যক্তিক ও আন্তঃদলীয় সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যবস্থা করা হয়।

৭. মজুরি ও বেতন (Wages & Salaries)

মানুষ তার অভাব পূরণের জন্য অর্থের বিনিময়ে শ্রম বিক্রি করে। শ্রমিকদের দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী মজুরি ও বেতন কাঠামো নির্ধারন করতে হয়। মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা কর্মীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুবিধাসহ স্থায়ী মজুরি ও বেতনের ব্যবস্থা করে থাকে।

৮. কার্য পরিবেশ (Working Environment)

প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের জন্য কার্য পরিবেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রতিষ্ঠানের কার্য সময়, কাজের ভৌত পরিবেশ, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়সমূহ উন্নত ও সম্প্রসারিত হলে কর্মীকে সহজে কাজের প্রতি আকর্ষিত করা যায়। তাই এগুলো মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত।

৯. শ্রমিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক (Labour Management Relations)

শিল্প প্রতিষ্ঠানে শান্তি, শৃঙ্খলা, সেবা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি সর্বোপরি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন সুন্দর শ্রম ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভরশীল। সুষ্ঠুশ্রম ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক সৃষ্টির কাজটি মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত বিষয়।

১০. বিনোদন সুবিধা (Entertainment Benefit)

বিনোদন ব্যবস্থার মাধ্যমে শ্রমিক কর্মীকে সতেজ ও উদ্যোমী রাখা যায়। তাই কর্মীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের বিনোদনমূলক ব্যবস্থা যেমন- খেলাধুলা, চিত্তবিনোদন, বনভোজন, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ইত্যাদির ব্যবস্থা করা মানব সম্পদ উন্নয়ন বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

১১. ব্যক্তিক গবেষণা ও তথ্য ব্যবস্থাপনা (Personal Resource & Information System)

প্রযুক্তির উন্নয়নে আজ পৃথিবী পরিবর্তীত হচ্ছে অহরহ। তাই পরিবর্তীত অবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে তথা প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থেকে নিজেদের উন্নয়নের জন্য ব্যক্তিক গবেষণা ও তথ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। কর্মীর প্রত্যাশা ও আচরণ অনুধাবন করে তাদের মাধ্যমে প্রত্যাশা মাফিক কাজ আদায় করতে মানব সম্পদ উন্নয়নে গবেষণা ও তথ্য ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক।

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যসমূহ (Objective of Human Resource Management)

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার মৌলিক উদ্দেশ্য হলো প্রতিষ্ঠানের বস্তুগত সম্পদ ও কর্মরত মানবীয় সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করে সামগ্রীক কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের জন্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মী সংগ্রহ করে দক্ষতা অনুযায়ী তাদের কাজে নিয়োগ দিয়ে থাকে। অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ কর্মীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে থাকে। ফলে অতি সহজেই তাদের দ্বারা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়।

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা সামগ্রীক ভাবে যে সব উদ্দেশ্য অর্জনে তৎপর থাতে সেগুলো নিম্নরূপ:

১. দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা (To Make Skilled Manpower)

দক্ষ জনশক্তি প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের জন্য মূল্যবান সম্পদ। যে প্রতিষ্ঠানের কর্মী বাহিনী যত দক্ষ তাদের সামগ্রীক কার্যক্রম তত উন্নত। তাই মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য হলো প্রতিষ্ঠানের দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা। প্রতিষ্ঠানের সামগ্রীক অবস্থার সাথে সমন্বয় করে কর্মরত কর্মীদের দক্ষ করে গড়ে তোলা।

২. সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার (To Ensure Maximum Utilizations of the Assets)

মনুষ্য সম্পদ ছাড়াও দৈনন্দিন কার্যাবলি সম্পাদনে বিভিন্ন ধরনের বস্তুগত সম্পদ ব্যবহৃত হয়। উৎপাদন ও সেবা পরিবেশনে ব্যবহৃত সব উপকরণের সর্বোত্তম কাম্য ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে যেমন উৎপাদন বাড়ে তেমনি সেবার মানও হয় উন্নত। মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের বস্তুগত সহ সকল উপকরণের ব্যবহার নিশ্চিত করে।

৩. উপযুক্ত কর্মী নিয়োগ (To appoint appropriate Person)

সঠিক পদের জন্য উপযুক্ত কর্মী খুঁজে বের করে কাজে নিয়োগ দেয়া মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগে ভিন্ন ভিন্ন কাজ হয়। সকল কাজের ধরন ও গুরুত্ব এক নয়। কাজেই কাজের ধরন ও গুরুত্ব ভেদে আলাদা আলাদা কর্মী নিয়োগ করতে হয়। এতে করে সকল অপচয় রোধ করে মান সম্মত পণ্য অধিক পরিমাণে উৎপাদন করা যায়।

৪. প্রশিক্ষণ (Training)

প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মী সংগ্রহ ও নির্বাচন করে তাদের কাজের দক্ষতা বৃদ্ধি কল্পে প্রশিক্ষণ দিতে হয়। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মীর কাজ সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান অর্জন করতে পারে। কাজেই প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার আর একটি উদ্দেশ্য।

৫. প্রেষণা দান (To Give Incentives)

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা যেহেতু সরাসরি কর্মীদের নিয়ে কাজ করে সেহেতু কর্মরত কর্মীদের আচরণ ও মনোভাব ভালভাবে অনুধাবন করে বিভিন্ন ধরনের প্রেষণা দানের ব্যবস্থা করে থাকে। সঠিক প্রেষণা দিতে পারলে কর্মী স্বেচ্ছায় কাজে আত্মনিয়োগ করে ফলে কাজের মান ও গতি বাড়ে।

৬. কার্য বিশ্লেষণ (Job Analysis)

একটি প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের কার্যাবলি সম্পাদন হয়ে থাকে। কাজের ধরন, প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কার্য বিভাজন করে কর্মীকে তার পছন্দ অনুযায়ী কাজে নিয়োগ দান এবং সে অনুযায়ী পারিতোষিকের ব্যবস্থা করা।

৭. কর্ম সম্পাদন মূল্যায়ন (Performance Evaluation)

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো কার্য মূল্যায়ন করা। কর্মীর কর্ম সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে সে অনুযায়ী মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করলে কর্মী কাজের প্রতি অধিক যত্নশীল হয়। ফলে প্রতিষ্ঠানের প্রভুত উন্নতি সাধিত হয়ে থাকে।

৮. মানবীয় সম্পর্ক উন্নয়ন (Development of Human Relations)

একটি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ধরনের কাজ হয়ে থাকে। এসমস্ত কার্যাবলি সম্পাদনের জন্য কর্মীও থাকে ভিন্ন ভিন্ন। কাজেই কর্মরত সকল কর্মীদের মধ্যে উন্নত সম্পর্ক যাতে বজায় থাকে সেজন্য মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

৯. উত্তম কার্য পরিবেশ (Good Working condition)

প্রতিষ্ঠানে সামগ্রীক কার্য পরিবেশ বিভিন্ন ধরনের বস্তুগত ও অবস্তুগত উপাদান ও উকরণের সমন্বয়ে গঠিত হয়। কাজেই এ সকল মানবীয় এবং বস্তুগত সকল উপকরণের মধ্যে সুষম সমন্বয়পূর্বক একটি সুন্দর কার্য পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য সচেষ্ট থাকে।

১০. উৎপাদন বৃদ্ধি (To Increase Production)

উৎপাদন বৃদ্ধি করা ব্যবস্থাপনার একটি অন্যতম উদ্দেশ্য। সঠিক ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে কর্মীদের নির্দেশনা প্রদান ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কর্মীদের কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি করা যায়।

(বাউবি মডিউল অনুকরণ করে লেখা হয়েছে। এখানে ‘মানব সম্পদ’কে সমাসবদ্ধ পদ হিসেবে ‘মানবসম্পদ’ লেখা যাবে)

শেয়ার করুন

One thought on “মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা কী? মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার পরিধি এবং বৈশিষ্ট্য

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

আহমেদ মিন্টো

মিন্টো একজন ফ্রিল্যান্স লেখক এবং বিশ্লেষণ'র কন্ট্রিবিউটর।

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা কী? মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার পরিধি এবং বৈশিষ্ট্য

প্রকাশ: ১২:২৭:০৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২১

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা ধারণাটির ইতিহাস অনেক লম্বা। তবে বর্তমানে যে পরিপূর্ণ মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক ধারণা লক্ষ্য করছি তা মূলত বিংশ শতাব্দীর ফসল। ব্যবস্থাপনার ক্রমবিকাশ ও বিবর্তনের ধারায় মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়টিকে সামগ্রীক ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের উন্নয়নের ধারায় সংযোজিত এক নতুন অধ্যায়; একে কর্মী ব্যবস্থাপনার সমষ্টিগত আকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা হলো প্রতিষ্ঠানের কর্মরত সকল স্তরের মানবীয় উপকরণের সাথে জড়িত সব কাজের সমন্বিত দিক। অতীতে প্রতিষ্ঠানের জনশক্তিকে অন্যান্য উপকরণের ন্যায় সাধারণ একটি উপকরণ মনে করা হতো। কিন্তু বর্তমানে এ ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে জনশক্তিকে সংগঠনের সবচেয়ে মূল্যবান ও অপরিহার্য উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এই নিবন্ধে যা আছে

কর্মী ব্যবস্থাপনা থেকে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা

কর্মী ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের যে সকল ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন রবার্ট ওয়েন (Robert Owen) তাদের মধ্যে অন্যতম। রবার্ট ওয়েনকে বলা হয় আধুনিক কর্মী ব্যবস্থাপনার জনক। তিনি ছিলেন একটি বস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক। রবার্ট ওয়েন তার প্রতিষ্ঠানে শিশু শ্রম নিষিদ্ধ করে শ্রমিক কর্মীদের কল্যাণের জন্য বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি গ্রহণের সুপারিশ করেন। ১৮১৩ সালে তিনি সর্বপ্রথম A new view of society নামক একটি গ্রন্থে শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য কর্মসূচি গ্রহণের সুপারিশ করেন; এই কারণে অনেকেই মানেন আধুনিক কর্মী ব্যবস্থাপনার জনক বা প্রতিষ্ঠাতা হলেন রবার্ট ওয়েন।

১৯১১ খৃষ্টাব্দে এফ. ডব্লিউ. টেইলর (F. W. Taylor) সায়েন্টফিক ম্যানেজমেন্ট (Scientific management) গ্রন্থে পরিকল্পনা বিভাগের আওতায় এমপ্লয়েমেন্ট ব্যুরো (Employment Bureau) নামে একটি স্বতন্ত্র শাখার কথা বলে কর্মী ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের পথকে সুগম করেছেন।

১৯১২ সালে শ্রমিক কর্মীদের কল্যাণের জন্য শিল্পপতিগণ কল্যাণ সচিব (Welfare Secretaries) নিয়োগ করে। পরবর্তীতে এই কল্যাণ সচিব বা ওয়েলফেয়ার সেক্রেটারিগণ কর্মীব্যবস্থাপক হিসেবে পরিচিত লাভ করেন।

কেউ কেউ বলেন, শিল্প কারখানায় কর্মরত প্রত্যেক শ্রমিকের কার্য সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার জন্য ১৯২০ খৃষ্টাব্দে প্রথম কর্মী ব্যবস্থাপনার আত্ম প্রকাশ ঘটে। ১৯৪৫ সালের পর থেকে কর্মী ব্যবস্থাপনার দ্রুত উন্নতি ঘটে। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও সামাজিক পরিবর্তনের ফলে ব্যবস্থাপনা ও শ্রমিকদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে। ফলে পৃথক কর্মী বিভাগের প্রয়োজনীয়তা বাড়তে থাকে।

সাধারণ অর্থে কর্মী বলতে সংগঠনের নিুস্তরের কর্মচারী ও শ্রমিকদের বুঝায়, অথচ কার্য সম্পাদনের জন্য প্রত্যক্ষভাবে সংগঠনের মধ্যমে ও উচ্চস্তরের নির্বাহীগণও জড়িত থাকে। সে অর্থে কর্মী ব্যবস্থাপনা কথাটির দ্বারা এর আওতা সীমিত হয়ে পড়ে ফলে সংগঠনের সকল স্তরের মানবীয় উপাদানকে বুঝানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্ব প্রথম ১৯৫০ সালের পর থেকে কর্মী ব্যবস্থাপনা বিভাগের নাম পরিবর্তন করে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা রেখেছে। সেই থেকে এ বিষয়টি মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা নাম পরিগ্রহ করে সর্বক্ষেত্রে ব্যবহৃত ও প্রচলিত হচ্ছে।

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার সংজ্ঞা (Definition of Human resource management)

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা হলো সার্বজনীন মৌলিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাপনা। সাধারণ অর্থে শিল্প কারখানায় ও অফিসে কর্মরত শ্রমিক কর্মীদের ব্যবস্থাপনাকে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বলে।

ব্যবস্থাপনার যে অংশের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের কর্মরত মানবীয় উপাদান সংক্রান্ত প্রশাসন পরিচালনা করা হয় তাই মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা নামে পরিচিত।

পূর্বে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনাকে কর্মী ব্যবস্থাপনা (Personnel management), শ্রম ব্যবস্থাপনা (Labour management), কর্মী প্রশাসন (Personal administration), শিল্প ব্যবস্থাপনা (Industrial management) ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হতো।

Gray Dessler- এর মতে, “মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যা কর্মী সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ, মূল্যায়ন, ক্ষতিপূরণ এবং তাদের শ্রম সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা এবং ন্যায় নিষ্ঠার সাথে সম্পর্কিত”  [Human resource management is the process of acquiring, training, appraising and compensating, employees, and attending to their labour relations, health and safety, and fairness concerns..]

Ricky W. Griffin এর মতে, “মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা হলো পরস্পর সম্পূরক কতিপয় সাংগঠনিক কাজ যা কার্যকর কর্মীদল আকর্ষণ, উন্নয়ন ও সংরক্ষণের সাথে জড়িত ।  [Human resource management is the set of organizational activities directed at attracting developing and maintaining an effective workforce.]

David A. Decenzo and Stephen P. Robbins এর মতে, “মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা চারটি কাজের সমন্বয়ে গঠিত (১) স্টাফিং (২) প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন (৩) প্রেষণা দান এবং (৪) সংরক্ষণ বা ধারে রাখার ব্যবস্থা করা [Human resource management is made of four activities (i) Staffing (ii) Training and development (iii) Motivation and (iv) Maintenance.]

উল্লেখিত আলোচনা ও বিশেষজ্ঞ সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করে চূড়ান্তভাবে বলা যায়, প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নয়ন সুদক্ষ কর্মী বাহিনীর উপর নির্ভরশীল- যাদের সার্বিক ভাবে গড়ে তোলার দায়িত্ব ন্যাস্ত থাকে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার উপর। তাই বলা যায়, প্রতিষ্ঠানের মানবীয় উপাদান সংক্রান্ত সকল কার্যের সমষ্টিকে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা (HRM) হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। প্রতিষ্ঠানের মানব সম্পদ একমাত্র উপাদান যার সেবা কার্য ও উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য ব্যবহৃত অন্যান্য উপাদান গুলোকে সমন্বয় করে।

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার আওতা বা পরিধি (Scope of Human Resource Management)

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা মৌলিক ব্যবস্থাপনার অংশ হলেও এর গুরুত্ব অফিসের অন্যান্য বিভাগের তুলনায় বেশ ব্যাপক। প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন কার্যাবলি সম্পাদনের যে সকল উপাদান ব্যবহৃত হয় সেগুলোর সমন্বয় পূর্বক মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা অফিসকে রাখে সর্বদা সচল ও গতিশীল। শিল্প সম্পর্ক উন্নয়ন, পারিতোষিক ও মজুরি নির্ধারণ সর্বপরি তাদের উন্নয়ন ও সংরক্ষণ করা মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার প্রধান দায়িত্ব্। তাই বলা যায় প্রতিষ্ঠানের কর্মরত সকল স্তরের কর্মী সংক্রান্ত নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার কাজ বলে এর আওতা বা পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক।

নিচে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত বিষয়সমূহ উপস্থাপন করা হলো

১. মানব সম্পদ পরিকল্পনা (Human Resource Planning)

মানব সম্পদ পরিকল্পনার একটি মৌলিক উদ্দেশ্য হলো প্রতিষ্ঠানের কাজের প্রকৃতি ও ধরন অনুযায়ী কার্য বিভক্তি করে যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মীদের মধ্যে তা বণ্টন করে দেওয়া। সময়মতো সঠিক ব্যক্তিকে সঠিক দায়িত্বে নিয়োজিত করার জন্য বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে সে অনুযায়ী বিভিন্ন মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়।

২. সংগঠন ও পদের নকশা প্রণয়ন (Design of Organization & Job)

প্রতিষ্ঠানের সামগ্রীক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ। তাই কার্যকর সংগঠন কাঠামো নির্ধারণ, কার্যভিত্তিক পদ সৃষ্টি ও বিন্যাস, পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ, দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রদর্শন করা মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভূক্ত। এজন্য পদ অনুযায়ী মানব সম্পদের চাহিদা নির্ধারণ ও উৎস নির্বাচন করে পদভিত্তিক কর্মী নিয়োগ করতে হয়।

৩. কার্য বর্ণনা (Description of Work)

সংগঠনের জন্য প্রণীত নকশায় পদ ভিত্তিক বণ্টনকৃত কার্যের বর্ণনা মনব সম্পদ ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভূক্ত। এতে বিভিন্ন পদের বিপরীতে কার্যের সীমানা নির্ধারণ করা হয় এবং কাজের সামগ্রীক বর্ণনা সহজতর হয়।

৪. নির্বাচন ও স্টাফিং (Selections & Staffing)

প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে প্রয়োজনীয় দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মী খুঁজে বের করা হয় এবং তাদের কাজের জন্য নির্বাচন করে উপযুক্ত ব্যক্তিকে সঠিক স্থানে পদায়ন করা হয়। এ পর্যায়ে কর্তৃপক্ষ কর্মীর প্রয়োজন সনাক্তকরণ, কর্মী সংগ্রহের উৎস নির্বাচন, পদোন্নতি, বদলি ইত্যাদি কার্য সম্পাদন করেন।

৫. প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন (Training & Development)

কর্মীকে তার কার্য পরিবেশ, পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও কাজ সম্পর্কে হাতে কলমে শিক্ষা দেয়াকে প্রশিক্ষণ বলে। অন্যদিকে কর্মরত কর্মীকে অধিক দক্ষ করে গড়ে তোলার কাজকে উন্নয়ন বলে। প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে কর্মীকে কাজের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলা যায়।

৬. সাংগঠনিক উন্নয়ন (Organizational Development)

প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মীদের সন্তুষ্টির জন্য সঠিক ভাবে কার্য মূল্যায়ন ও পদ মূল্যায়ন করে সংগঠনের সকল স্তরের কর্মকর্তা ও কর্মীর মধ্যে আন্তঃব্যক্তিক ও আন্তঃদলীয় সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যবস্থা করা হয়।

৭. মজুরি ও বেতন (Wages & Salaries)

মানুষ তার অভাব পূরণের জন্য অর্থের বিনিময়ে শ্রম বিক্রি করে। শ্রমিকদের দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী মজুরি ও বেতন কাঠামো নির্ধারন করতে হয়। মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা কর্মীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুবিধাসহ স্থায়ী মজুরি ও বেতনের ব্যবস্থা করে থাকে।

৮. কার্য পরিবেশ (Working Environment)

প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের জন্য কার্য পরিবেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রতিষ্ঠানের কার্য সময়, কাজের ভৌত পরিবেশ, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়সমূহ উন্নত ও সম্প্রসারিত হলে কর্মীকে সহজে কাজের প্রতি আকর্ষিত করা যায়। তাই এগুলো মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত।

৯. শ্রমিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক (Labour Management Relations)

শিল্প প্রতিষ্ঠানে শান্তি, শৃঙ্খলা, সেবা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি সর্বোপরি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন সুন্দর শ্রম ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভরশীল। সুষ্ঠুশ্রম ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক সৃষ্টির কাজটি মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত বিষয়।

১০. বিনোদন সুবিধা (Entertainment Benefit)

বিনোদন ব্যবস্থার মাধ্যমে শ্রমিক কর্মীকে সতেজ ও উদ্যোমী রাখা যায়। তাই কর্মীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের বিনোদনমূলক ব্যবস্থা যেমন- খেলাধুলা, চিত্তবিনোদন, বনভোজন, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ইত্যাদির ব্যবস্থা করা মানব সম্পদ উন্নয়ন বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

১১. ব্যক্তিক গবেষণা ও তথ্য ব্যবস্থাপনা (Personal Resource & Information System)

প্রযুক্তির উন্নয়নে আজ পৃথিবী পরিবর্তীত হচ্ছে অহরহ। তাই পরিবর্তীত অবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে তথা প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থেকে নিজেদের উন্নয়নের জন্য ব্যক্তিক গবেষণা ও তথ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। কর্মীর প্রত্যাশা ও আচরণ অনুধাবন করে তাদের মাধ্যমে প্রত্যাশা মাফিক কাজ আদায় করতে মানব সম্পদ উন্নয়নে গবেষণা ও তথ্য ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক।

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যসমূহ (Objective of Human Resource Management)

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার মৌলিক উদ্দেশ্য হলো প্রতিষ্ঠানের বস্তুগত সম্পদ ও কর্মরত মানবীয় সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করে সামগ্রীক কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের জন্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মী সংগ্রহ করে দক্ষতা অনুযায়ী তাদের কাজে নিয়োগ দিয়ে থাকে। অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ কর্মীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে থাকে। ফলে অতি সহজেই তাদের দ্বারা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়।

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা সামগ্রীক ভাবে যে সব উদ্দেশ্য অর্জনে তৎপর থাতে সেগুলো নিম্নরূপ:

১. দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা (To Make Skilled Manpower)

দক্ষ জনশক্তি প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের জন্য মূল্যবান সম্পদ। যে প্রতিষ্ঠানের কর্মী বাহিনী যত দক্ষ তাদের সামগ্রীক কার্যক্রম তত উন্নত। তাই মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য হলো প্রতিষ্ঠানের দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা। প্রতিষ্ঠানের সামগ্রীক অবস্থার সাথে সমন্বয় করে কর্মরত কর্মীদের দক্ষ করে গড়ে তোলা।

২. সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার (To Ensure Maximum Utilizations of the Assets)

মনুষ্য সম্পদ ছাড়াও দৈনন্দিন কার্যাবলি সম্পাদনে বিভিন্ন ধরনের বস্তুগত সম্পদ ব্যবহৃত হয়। উৎপাদন ও সেবা পরিবেশনে ব্যবহৃত সব উপকরণের সর্বোত্তম কাম্য ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে যেমন উৎপাদন বাড়ে তেমনি সেবার মানও হয় উন্নত। মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের বস্তুগত সহ সকল উপকরণের ব্যবহার নিশ্চিত করে।

৩. উপযুক্ত কর্মী নিয়োগ (To appoint appropriate Person)

সঠিক পদের জন্য উপযুক্ত কর্মী খুঁজে বের করে কাজে নিয়োগ দেয়া মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগে ভিন্ন ভিন্ন কাজ হয়। সকল কাজের ধরন ও গুরুত্ব এক নয়। কাজেই কাজের ধরন ও গুরুত্ব ভেদে আলাদা আলাদা কর্মী নিয়োগ করতে হয়। এতে করে সকল অপচয় রোধ করে মান সম্মত পণ্য অধিক পরিমাণে উৎপাদন করা যায়।

৪. প্রশিক্ষণ (Training)

প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মী সংগ্রহ ও নির্বাচন করে তাদের কাজের দক্ষতা বৃদ্ধি কল্পে প্রশিক্ষণ দিতে হয়। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মীর কাজ সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান অর্জন করতে পারে। কাজেই প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার আর একটি উদ্দেশ্য।

৫. প্রেষণা দান (To Give Incentives)

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা যেহেতু সরাসরি কর্মীদের নিয়ে কাজ করে সেহেতু কর্মরত কর্মীদের আচরণ ও মনোভাব ভালভাবে অনুধাবন করে বিভিন্ন ধরনের প্রেষণা দানের ব্যবস্থা করে থাকে। সঠিক প্রেষণা দিতে পারলে কর্মী স্বেচ্ছায় কাজে আত্মনিয়োগ করে ফলে কাজের মান ও গতি বাড়ে।

৬. কার্য বিশ্লেষণ (Job Analysis)

একটি প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের কার্যাবলি সম্পাদন হয়ে থাকে। কাজের ধরন, প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কার্য বিভাজন করে কর্মীকে তার পছন্দ অনুযায়ী কাজে নিয়োগ দান এবং সে অনুযায়ী পারিতোষিকের ব্যবস্থা করা।

৭. কর্ম সম্পাদন মূল্যায়ন (Performance Evaluation)

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো কার্য মূল্যায়ন করা। কর্মীর কর্ম সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে সে অনুযায়ী মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করলে কর্মী কাজের প্রতি অধিক যত্নশীল হয়। ফলে প্রতিষ্ঠানের প্রভুত উন্নতি সাধিত হয়ে থাকে।

৮. মানবীয় সম্পর্ক উন্নয়ন (Development of Human Relations)

একটি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ধরনের কাজ হয়ে থাকে। এসমস্ত কার্যাবলি সম্পাদনের জন্য কর্মীও থাকে ভিন্ন ভিন্ন। কাজেই কর্মরত সকল কর্মীদের মধ্যে উন্নত সম্পর্ক যাতে বজায় থাকে সেজন্য মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

৯. উত্তম কার্য পরিবেশ (Good Working condition)

প্রতিষ্ঠানে সামগ্রীক কার্য পরিবেশ বিভিন্ন ধরনের বস্তুগত ও অবস্তুগত উপাদান ও উকরণের সমন্বয়ে গঠিত হয়। কাজেই এ সকল মানবীয় এবং বস্তুগত সকল উপকরণের মধ্যে সুষম সমন্বয়পূর্বক একটি সুন্দর কার্য পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য সচেষ্ট থাকে।

১০. উৎপাদন বৃদ্ধি (To Increase Production)

উৎপাদন বৃদ্ধি করা ব্যবস্থাপনার একটি অন্যতম উদ্দেশ্য। সঠিক ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে কর্মীদের নির্দেশনা প্রদান ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কর্মীদের কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি করা যায়।

(বাউবি মডিউল অনুকরণ করে লেখা হয়েছে। এখানে ‘মানব সম্পদ’কে সমাসবদ্ধ পদ হিসেবে ‘মানবসম্পদ’ লেখা যাবে)