প্রশাসন এবং ব্যবস্থাপনার ধারণা, পরিসর ও পার্থক্য
- প্রকাশ: ১০:২০:১৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২
- / ১০১৬১ বার পড়া হয়েছে
‘প্রশাসন’ ও ‘ব্যবস্থাপনা’ শব্দ দুটির মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা দুরূহ কাজ। বাস্তবে একজন প্রশাসক যে কাজ করে থাকেন সেই একই কাজ একজন ব্যবস্থাপকও করে থাকেন।
কোনো প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য নীতি প্রণয়ন করা প্রশাসনের কাজ এবং সে নীতিগুলো সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা তা দেখাশোনা ও তদারকি করার দায়িত্ব ব্যবস্থাপনার। প্রশাসন সুচিন্তিত উপায়ে প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় কর্মসূচির পরিকল্পনা প্রণয়ন, কর্মী নিয়োগ ও নির্দেশনা, প্রতিষ্ঠানের মানবিক ও বস্তুগত সম্পদ ও উপাদানের মধ্যে সমন্বয় সাধন ও পরিকল্পনা মোতাবেক সকল কাজের সুষ্ঠু সমাধান নিশ্চিত করে, এতে প্রশাসনকে সরাসরি সহায়তা করে ব্যবস্থাপনা।
এখানে যা আছে
প্রশাসনের ধারণা
প্রশাসন শব্দটি বহু প্রাচীন। যখন থেকে মানুষ দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে শিখল, তখন থেকেই প্রশাসনের প্রয়োজনীয়তা পরিলক্ষিত হল। যেখানেই কোন দল বা সংগঠন বিদ্যমান, সেখানেই প্রশাসনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। প্রশাসনের ইংরেজি প্রতিশব্দ Administration। Ad থেকে বিচ্ছিন্ন করে Ministration শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব এর অর্থ হচ্ছে ‘কারো জন্য মনোযোগ দেয়া’ বা ‘যত্ন করা’। এই অর্থে প্রশাসনকে আমরা সেবামূলক কাজ বা প্রক্রিয়া বলতে পারি। কোন প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য কাজ করাকে বোঝায়। অপরদিকে, বাংলা প্রশাসন শব্দের অর্থ করলে দাঁড়ায় প্র + শাসন। এখানে শাসন শব্দটি শাস্তি প্রদানের ইঙ্গিত বহন করে। অধ্যাপক নিউম্যান (Newman) এর মতে “প্রশাসন হচ্ছে একটি সাধারণ উদ্দেশ্য অর্জনার্থে কোন জনগোষ্ঠীর সহযোগিতা লাভের লক্ষ্যে তাদের নেতৃত্ব, নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণ করা”। অন্যদিকে সিমন (Simon)-এর মতে “প্রশাসন হচ্ছে সংগঠনের উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যে মানবিক ও বস্তুগত সম্পদের ব্যবহার করা”। যদিও প্রশাসনে নিয়ম, নীতি ও শৃঙ্খলার প্রশ্ন জড়িত, তথাপি
আধুনিক অর্থে প্রশাসনের সেবামূলক দিকটিই প্রাধান্য পেয়ে আসছে। সংগঠন মাত্রই উদ্দেশ্যমুখী। প্রতিটিসংগঠন কিছু নির্দিষ্ট লক্ষ্যরে দিকে ধাবমান। লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য গৃহীত সুনিয়ন্ত্রিত ও সুপরিচালিত ব্যবস্থার নামই প্রশাসন।
ব্যবস্থাপনার ধারণা
ইংরেজি Management শব্দটি ইতালীয় শব্দ Maneggiare শব্দ থেকে উৎপত্তি হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। যার অর্থ “To train up the horse”— ঘোড়াকে পরিচালনা করা। আবার অনেকের মতে এটি ফরাসি শব্দ “Manager I Manage” শব্দদ্বয় থেকে উৎপত্তি হয়েছে। যার অর্থ যথাক্রমে পরিচালনা করা (To direct the household) ও প্রদর্শন কাজ (An act of guiding or leading)। সাধারণভাবে বলতে গেলে কোন নির্দিষ্ট
লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে অন্যদের দ্বারা প্রয়োজনীয় কাজ করিয়ে নেয়ার কৌশলকে ব্যবস্থাপনা বলে। ব্যবস্থাপনার ধারণাটি উদ্ভব হয়েছে ব্যবসায়ী সমাজের ব্যবসা পরিচালনা পদ্ধতি থেকে। নিউম্যানের মতে, “ব্যবস্থাপনা হচ্ছে এমন একটি কার্যক্রম যা প্রশাসন কর্তৃক গৃহীত নীতিমালা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্য সম্পাদন করে”। ব্যবস্থাপনা হচ্ছে এমন একটি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া বা কৌশল যাতে সকল ধরনের জনবল ও উপকরণ সম্মিলিতভাবে কাজে লাগিয়ে লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টা চালানো হয়।
প্রশাসনের পরিসর
কোনো প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যে যাবতীয় কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করা, নীতি নির্ধারণ করা এবং প্রয়োজনীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর সামগ্রিক প্রক্রিয়াকে প্রশাসন বলা হয়।
প্রশাসন সুচিন্তিত উপায়ে প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় কর্মসূচির পরিকল্পনা প্রণয়ন, কর্মী নিয়োগ ও নির্দেশনা, প্রতিষ্ঠানের মানবিক ও বস্তুগত সম্পদ ও উপাদানের মধ্যে সমন্বয় সাধন ও পরিকল্পনা মোতাবেক সকল কাজের সুষ্ঠু সমাধান নিশ্চিত করে। লুথারগুলিক মনে করেন যে, প্রশাসন হলো সংগঠন ও ব্যবস্থাপনার একটি সাধারণ বিজ্ঞান।
POSDCORB
লুথার গুলিক সকল প্রশাসনিক সংগঠনের কর্মকান্ড বিশেষ করে তাদের ব্যবস্থাপনা কর্মকান্ডের বর্ণনা ও ব্যখ্যা করার জন্য “POSDCORB” কথাটির ব্যবহার করেছেন। লুথার গুলিক POSDCORB-এর পূর্ণরূপ হলো—
- P = Planning (পরিকল্পনা)
- O = Organisation (সংগঠন)
- S = Staffing (কর্মী সংগঠন)
- D = Directing (নির্দেশনা)
- Co = Coordination (সমন্বয়)
- R = Reporting (প্রতিবেদন লিখন)
- B = Budgeting (বাজেট প্রণয়ণ)
ব্যবস্থাপনার পরিসর
ব্যবস্থাপনা হচ্ছে একটি বিজ্ঞানসম্মত মানবীয় সামাজিক প্রক্রিয়া। উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করেই ব্যবস্থাপনা কার্য আবর্তিত হয়। ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সাথে সম্পর্কিত। ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্য বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার উদ্দেশ্যেও সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কোন ব্যবসায়ী সংস্থার উদ্দেশ্য হলো সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করা। এ উদ্দেশ্যের সাথে সহযোগী নানাবিধ উদ্দেশ্যও প্রতিষ্ঠানের থাকতে পারে। এই সহযোগী উদ্দেশ্যের যথাযথ বাস্তবায়ন প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য অর্জনের পথকে প্রশস্ত করে। ব্রেকের (Breck) মতে, “Management is concerned with seeing that the job gets done”. অর্থাৎ দক্ষতার সঙ্গে কাজটি সম্পাদিত হয়েছে কিনা তা যাচাই করা হলো ব্যবস্থাপনার কাজ”।
প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে পার্থক্য
প্রশাসন শব্দটি প্রাচীন। ব্যবস্থাপনা সে ক্ষেত্রে বেশ নতুন। ব্যবস্থাপনা ধারণার উদ্ভব হয়েছে শিল্প বিপ্লবের পরে। অন্যদিকে প্রাচীন কাল থেকেই রাষ্ট্র, গির্জা ও সেনাবাহিনী পরিচালনার কার্যাবলিকে প্রশাসন বলে অভিহিত করা হতো। কোন প্রতিষ্ঠানের প্রশাসক কর্তৃক প্রণীত ও গৃহীত নীতিসমূহ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা তা দেখাশোনা ও তদারকি করার দায়িত্ব ব্যবস্থাপনার। অধুনা প্রশাসন শব্দটির চেয়ে ব্যবস্থাপনা শব্দটি বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসন শব্দ দুইটির ব্যবহার প্রায় সমার্থক। প্রশাসন হচ্ছে নীতি নির্ধারণী স্তর এবং ব্যবস্থাপনা হচ্ছে বাস্তবায়ন স্তর। এ জন্য অনেকে প্রশাসনকে প্রতিষ্ঠানের মস্তিষ্ক ও ব্যবস্থাপনাকে চক্ষু বলে অভিহিত করেন। আবার অনেক শিক্ষাবিদ প্রশাসন প্রত্যয়টির মধ্যে সামন্তবাদী ও স্বৈরতান্ত্রিকতার গন্ধ পান বলে প্রশাসনের বিপরীতে ব্যবস্থাপনা শব্দটিকে উপযুক্ত মনে করেন।
‘প্রশাসন’ ও ‘ব্যবস্থাপনা’ শব্দ দুটির মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা দুরূহ কাজ। বাস্তবে একজন প্রশাসক যে কাজ করে থাকেন সেই একই কাজ একজন ব্যবস্থাপকও করে থাকেন। তবে ব্যবস্থাপনাবিদগণ তাত্ত্বিকভাবে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন। পার্থক্যগুলো হলো:
- ব্যবস্থাপনার উচ্চ স্তরকে প্রশাসন বলে। অপর দিকে প্রশাসনের মধ্যম ও নিম্নস্তরকে ব্যবস্থাপনা বলে।
- প্রশাসন প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে পক্ষান্তরে ব্যবস্থাপনা উদ্দেশ্য অর্জনের চেষ্টা করে।
- প্রশাসন পরিকল্পনা ও নীতি নির্ধারণ করে অন্য দিকে ব্যবস্থাপনা প্রণীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সচেষ্ট হয়।
- প্রশাসন শারীরিক শ্রমের চেয়ে মানসিক শ্রম (চিন্তামূলক কাজ) বেশি করে থাকে পক্ষান্তরে ব্যবস্থাপনার শারিরীক ও মানসিক উভয় শ্রমের প্রয়োজন হয়।