মিশরীয় সভ্যতা এবং প্রাচীন মিশরের কাল, ভৌগোলিক অবস্থান, শাসনব্যবস্থা, বিশ্বাস ও ধর্ম-দর্শন
- প্রকাশ: ১০:৪৭:০৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২১
- / ১৬৬০১ বার পড়া হয়েছে
মিশরীয় সভ্যতা কেমন ছিল বা মিশরীয় সভ্যতা কেন এত বিখ্যাত? এই প্রশ্নের উত্তর যাদের অজানা তাদের জন্য মিশরীয় সভ্যতা সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু তথ্য এখানে তুলে ধরা হলো:
মিশরীয় সভ্যতার কাল ও ভৌগোলিক অবস্থান
বর্তমান উত্তর আফ্রিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম দেশ মিশর। প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমির দেশ মিশর। আজ থেকেপ্রায় ৬ হাজার বছর পূর্বে নীলনদের আববাহিকায় মিশরীয় সভ্যতার উন্মেষ ঘটে। নীল নদের দান বলে খ্যাতভৌগোলিক দিক থেকে মিশর দক্ষিণাঞ্চল (Upper) এবং উত্তরাঞ্চল (Lower) এইরূপ দুভাগে বিভক্ত। মিশরেরমধ্যদিয়ে প্রবাহিত নীলনদ ভূমধ্যসাগরে মিলিত হয়েছে। ফলে নীলনদের পণ্ঢাবনে মিশরে উভয় অঞ্চলে পলিমাটি জমেউর্বরতা বৃদ্ধি পায়। এ সকল কারণে মিশরে নদীমাতৃক নগর সভ্যতা গড়ে ওঠার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
প্রাচীন মিশরের রাজনৈতিক ইতিহাস
৫০০০ থেকে ৩২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে মিশরের ইতিহাসে প্রাক-রাজবংশীয় যুগ বলা হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০ অব্দে রাজা মেনেস নামে এক শক্তিশালী সামন্ত উত্তর ও দক্ষিণ মিশরকে একত্রিত করে একটি বড় রাজ্যে পরিণত করেন। মেমফিশ শহরে মেনেস তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে এই রাজধানী থিবস শহরে স্থানান্তরিত হয়। রাজা মেনেসের পর থেকে তিন হাজার বছর পর্যন্ত প্রাচীন মিশরে ৩১টি রাজবংশের ইতহিাস পাওয়া যায়।
মিশরের প্রাচীন ইতিহাসকে ঐতিহাসিকগণ কয়েকটি পর্বে বিভক্ত করেন- প্রথমতঃ প্রাক্ রাজবংশীয় (খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০-৩২০০), প্রাচীন রাজত্বের যুগ (খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০-২৩০০), মধ্য রাজত্বের যুগ (২৩০০-১৭৮৮), বৈদেশিক হিক্সসদের আক্রমণ (১৭৫০-১৫৮০), নতুন রাজত্বের যুগ (১৫০০-১০৯০)।
প্রাচীন মিশরের শাসন ব্যবস্থা
প্রাক-রাজবংশীয় যুগে নীল নদের অববাহিকায় মিশরীয় সভ্যতার সূচনা হয়। এ যুগে মিশরীয়রা কৃষি কাজে সেচব্যবস্থার বিভিন্ন কৌশল আবিস্কার করে। এ ছাড়া তারা লিখন পদ্ধতি, উন্নতমানের কাপড়, সৌরপঞ্জিকা প্রস্তুত করতে শিখে। ৩২০০ খ্রি. পূর্বাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রাচীন রাজত্বকাল। রাজা মেনেস উত্তর ও দক্ষিণ মিশরকে এক করে একটি বড় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাচীন মিশরের সম্রাটদের ‘ফারাও’ বলা হতো। ফারাও শব্দের অর্থ ‘বড়োবাড়ি’।
বিশাল প্রাসাদে বসবাসকারী ফারাওদের মনে করা হতো ঈশ্বরের সন্তান। তাঁরা একই সঙ্গে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। সম্রাটের প্রধান পরামর্শদাতা হিসেবে নিযোজিত থাকতেন একজন উজির বা প্রধানমন্ত্রী।
মিশরের ‘ফারাও’ বা সম্রাটের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন রাজা মেনেস, প্রথমত আহমোজ, রাজা তুথমোস, সম্রাট ইখনাটন এবং প্রথম ও দ্বিতীয় র্যামেসিস। পরাক্রমশালী তৃতীয় র্যামেসিসের মৃত্যুর পর ফারাওদের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে।
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার পতন
প্রাচীন মিশরের বিশতম রাজবংশের শেষসম্রাট ছিলেন একাদশ রামসেস। এ সময় মিশরে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়।
১০৮০ খ্রিঃপূর্বাব্দে থিবস শহরের প্রধান পুরোহিত বা ধর্মযাজক সিংহাসন দখল করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫২৫ অব্দে পারস্য রাজশক্তি মিশর অধিকার করলে মিশরীয় সভ্যতার অবসান ঘটে। অতঃপর ৩৩২ খ্রিঃপূর্বাব্দে গ্রীক সম্রাট
আলেকজান্ডার মিশর অধিকার করেন। তার পর থেকে মিশরে “টলেমী রাজবংশ” প্রতিষ্ঠিত হয়। টলেমী রাজবংশ দীর্ঘদিন মিশর শাসন করে। এই বংশেরই রাণী ছিলেন বহু আলোচিত ও জগত খ্যাত রানী ক্লিওপেট্টা। ক্লেওপেট্রার সময় মিশর বারবার রোমানদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। কালক্রমে রোমানরা মিশরে রোমান শাসন বিস্তার করে।
প্রাচীন মিশরীয় জীবন যাত্রা ও সংস্কৃতির পরিচয়
ধর্ম বিশ্বাস: প্রাচীন মিশরীয় সমাজে ধর্মের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ধর্মের প্রভাব ছিল অত্যন্ত প্রকট। রাজা বা ফারাও ছিল প্রধান ধর্মীয় নেতা। তাদের প্রধান দেবতার নাম ছিল ‘আমন রে’ (Ammon Re)। নীলদের দেবতা নামে খ্যাত ছিল ওসিরিস (Osiris)। মিশরীয়রা আত্মার অবিনশ্বরতা ও পূনর্জন্মে বিশ্বাসী ছিল। তাদের ধারণা ছিল দেহ ছাড়া আত্মা ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভে বঞ্চিত হবে। এজন্যই তারা ফারাও বা সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের মৃতদেহ সংরক্ষণের জন্য বিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতিতে মমি প্রস্তুত করত। মমিকে যুগ পরস্পরায় অক্ষত রাখার জন্য নির্মাণ করা হয় সমাধি স্তম্ভ পিরামিড তবে ধর্ম বিশ্বাসে ন্যায় অন্যায়ের বা পাপ-পূণ্যের বিশ্বাস ও জড়িত ছিল। মিশরীয় সমাজে পুরোহিতদের দৌরাত্ম ছিল ব্যাপক। খ্রিস্টপূর্ব ১৩৭৫ অব্দে রাজা চতুর্থ আমেনহোটেপের নেতৃত্বে একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। তিনি প্রধান পুরোহিতদের মন্দির থেকে বহিস্কার করে একক দেবতা এটন (Aton) (বা একেশ্বর) এর পূজা করার নির্দেশ দেন।
হায়ারোগ্লিফিক্স: প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার লিখন ও লিপি পদ্ধতি
মিশরীয়রা প্রথম লিখন ও লিপি পদ্ধতি আবিস্কার করে, মিশরীয়দের এই লিখন পদ্ধতির নাম ছিল হায়ারোগ্লিফিক (Hieroglyphic) বা চিত্র লিখন পদ্ধতি। খোদাই কাজ করা বা চিত্রে পদর্শন করা- এই পদ্ধতির ২৫টি বর্ণ ছিল এবং প্রতিটি বর্ণ একটি বিশেষ চিহ্ন বা অর্থ প্রকাশ করতো। এই প্রথম মানব জাতি ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে লিখন পদ্ধতির উদ্ভাবনে সক্ষম হয়।
প্রাচামীন মিশরের দর্শন ও বিজ্ঞান
আধুনিক সভ্যতা অনেকটা প্রাচীন মিশরীয় দর্শন ও বিজ্ঞানের নিকট দায়বদ্ধ। সে যুগে অশেষ জ্ঞানচর্চার সূত্রপাত হয়। প্রাচীন মিশরে কারিগরি বিদ্যার প্রসার লাভ করেছিল। ব্রোঞ্জ ব্যবহারের ফলে নানা প্রকার অস্ত্র ও যন্ত্র আবিস্কার হয়। মিশরীয়রা গণিত শাস্ত্র ও জ্যোতির্বিদ্যায় বিশেষ পারদর্শি ছিল। তারা নিকটবর্তী নক্ষত্রদের পর্যবেক্ষণ করার কৌশল ও আয়ত্ব করেছিল। তারা নীলনদের জোয়ার-ভাটা নির্ণয় করে এবং এ সম্বন্ধীয় সম্যক জ্ঞান আয়ত্ত্ব করে। মিশরীয় বিজ্ঞানীরা সর্বপ্রথম জ্যামিতি ও গণিত শাস্ত্রের উদ্ভাবন করেন। তারা যোগ-বিয়োগের ব্যবহার জানলে গুণ ও ভাগ করতে জানতো না।
মধ্য রাজবংশের যুগ থেকে মিশরীয়গণ চিকিৎসা বিজ্ঞানে দক্ষতা অর্জন করেন। মিশরে চক্ষু, দন্ত ও পেটের পীড়া রোগের চিকিৎসা আবিষ্কারে সক্ষম হয়। তারা বিভিন্ন রোগ ও ওষুধের নাম লিপিবদ্ধ করে এবং সেটিরিয়া মেডিকা’ নামক ওষুধের তালিকা প্রণয়ন করেন। মৃতদেহকে অক্ষত রাখার জন্য মিশরীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানী একধরনের ঔষুধ আবিষ্কার করেছিল।
মিশরের পিরামিড
প্রাচীন মিশরীয় শিল্পকলা ও স্থাপত্যের আশ্চর্য নিদর্শন ‘পিরামিড’। পাথর দিয়ে তৈরী ত্রিকোনাকার পিরামিড আজও মিশরের কায়রে শহরে অদূরে সভ্যতার ইতিহাস বহন করছে। এ সকল পিরামিডের অভ্যন্তরে মিশরের রাজা এবং সম্ভ্রান্ত লোকদের মৃতদেহ মমি করে রাখা হয়েছে। লক্ষাধিক পাথর টুকরো করে নিখুঁতভাবে জোড়া দিয়ে এই পিরামিড তৈরী করা হতো এবং এক একটা পিরামিড চার থেকে পাঁচশ ফুট উচু ছিল। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় মিশরীয়দের বিজ্ঞান ও কারিগরি কৌশল কত উন্নত ছিল।
মিশরীয় সভ্যতা ছিল ব্রোঞ্জযুগের সভ্যতা। ব্রোঞ্জ ব্যবহারের ফলে নগর সভ্যতা সৃষ্টিতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এ সময় নানা আবিস্কারই নগর সভ্যতা বিশেষ করে মিশরে নগর সভ্যতার উদ্ভবে সক্ষম হয়। মিশরীয় সভ্যতা আধুনিক সভ্যতার পথ প্রদর্শক হিসেবে বিবেচিত।
প্রফেসর মোঃ মাহমুদুর রহমান ও ডক্টর মুহাম্মাদ আবদুর রাহীম কর্তৃক রচিত ইসলামের ইতিহাস বই থেকে নেওয়া হয়েছে।
মিশরীয় সভ্যতা সংস্কৃতি বলতে কি বুঝায়???