০৬:৩৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

স্টেথোস্কোপ আবিষ্কারের গল্প

অনির্বাণ জানা
  • প্রকাশ: ০৯:০৩:৪১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১
  • / ৩৪৪০ বার পড়া হয়েছে

ডাক্তারের সুন্দরীর বুকে কান পাতায় আপত্তি থেকেই জন্ম নেয় স্টেথোস্কোপ


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

ভীষণ বিপদে পড়েছেন ডক্টর রেনে। পুরো নাম রেনে থিওফাইল হায়াসিন্থে লেনেক (Rene Theophile Hyacinthe Laënnec) । সালটা ১৮১৬। ফরাসী চিকিৎসক রেনের এমনিতে বেশ নামডাক। প্যারিসের ইকোল প্রাতিক ডাক্তারি শিক্ষার স্কুল থেকে মেডিসিন আর সার্জারি দুটো বিষয়েই প্রথম হয়েছিলেন। মেডিসিনে তো তাঁর জ্ঞান ঈর্ষা করার মতো। অনেক আশা নিয়ে এক তরুণীকে তার অভিভাবকরা রেনের কাছে এনেছে। অল্পবয়সি মেয়েটিকে দেখতেও বেশ সুন্দর। কিন্তু মেয়েটি বিশ্রি রকম মোটাসোটা। মেয়েটির শ্বাসের অসুবিধা। হার্ট কিংবা লাঙস থেকে প্রবলেমটা আসছে। ফলে লাঙস ও হার্টের শব্দ খুঁটিয়ে শোনা উচিত। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত ডাক্তারদের এই শব্দগুলো শুনতে হত রোগীর বুকে কান রেখে। একেতো স্থুলাঙ্গী বলে শব্দ ঠিকঠাক শোনার অসুবিধে। তারওপর স্বভাবলাজুক ডাক্তারের সুন্দর মহিলার বুকে কান পাতায় আপত্তি আছে। সে এক মহা ফ্যাসাদ।

ছোটবেলায় বেশ ভাল বাঁশি বাজাতেন ডক্টর রেনে। রেনেকে একটা জিনিস খুব অবাক করত-কেমন করে যেন আস্তে করে ফুঁ দেওয়ার শব্দ। কী সুন্দরভাবে সাত সুরে সাজিয়ে বাঁশির সামনের গর্তগুলো দিয়ে বেরোয়। অবচেতনে বাঁশির ব্যাপারটা মাথায় ছিল। তবে সেটা নিয়ে বেশি চিন্তাভাবনা করেননি রেনে। নতুন আসা পেশেন্টটির ডায়াগনোসিস নিয়ে বরং তিনি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন। আনমনে হেঁটে যাচ্ছিলেন ল্যুভর ক্যাসলের সামনে দিয়ে। সেপ্টেম্বর মাস। ক্যাসলের সামনের গাছগুলো ফুল দিয়ে সাজতে শুরু করেছে। বাচ্চারা হইচই করে মাঠে খেলা করছে। এরমধ্যে দুটো বাচ্চা অদ্ভুত খেলা খেলছে। একটা লম্বা বাঁশের একপ্রান্তে একজন শব্দ করছে আর তার বন্ধু অন্যপ্রান্তে বাঁশের চোঙে কান লাগিয়ে সেই শব্দ শুনছে। রেনে গিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে খেলায় নেমে পড়েন। বাঁশের অন্যপ্রান্তে তিনিও কান পাতেন। কি অদ্ভুত ব্যাপার! শব্দগুলো বহুগুণে বেড়ে গিয়ে তাঁর কানে আসছে। তিনি চটপট বাড়ি ফিরে এসে একটা ফাঁপা বাঁশ নিয়ে বসে পড়েন। তৈরি হয় প্রথম স্টেথোস্কোপ (Stethoscope)। ১৮১৬ সালে রেনে থিওফাইল হায়াসিন্থে লেনেক স্টেথোস্কোপ আবিষ্কার করেন। এর কারণ ছিল সুন্দর মেয়ে বা মহিলাদের বুকে কান পাতায় আপত্তি।

পৃথিবীর প্রথম স্টেথোস্কোপটি সেহেতু বাঁশের তৈরি ছিল। লম্বায় মোটামুটি ২৫ সেন্টিমিটার। চওড়ায় ২.৫ সেন্টিমিটার। তিনভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল স্টেথোস্কোপটি। স্টেথোস্কোপ নামকরণ হয়েছে দুটো শব্দ জোড়া লাগিয়ে। (stethos মানে বুক এবং (skopos) মানে খোঁজ করা।

প্রথমদিকে চিকিৎসকদের একদম নাপছন্দ ছিল এই আবিষ্কার। আস্তে আস্তে কিছু ডাক্তার এটা ব্যবহার করতে শুরু করেন। ১৮৪০ সালে গোল্ডিং বার্ড নামের একজন কাঠের স্টেথোস্কোপের সঙ্গে একটা নল জুড়ে দেন। তাতে দেখা গেল যন্ত্রটি ব্যবহারের অনেক সুবিধা হচ্ছে। তখনও পর্যন্ত স্টেথোস্কোপ এক কানেই ব্যবহার হতো।

১৮৫১ সালে আয়ারল্যান্ডের চিকিৎসক আর্থার লিয়ারেড দুই কানে নল দিয়ে যন্ত্রটিকে ব্যবহার করেন। পরের বছর জর্জ ফিলিপ কামাম আরও কিছু অংশের পরিবর্তন ঘটিয়ে বেশ কিছুটা আধুনিক রূপ দেন স্টেথোস্কোপের।

১৮৫২ থেকে রীতিমতো বাণিজ্যিকভাবে স্টেথোস্কোপ বাজারে আসে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কোম্পানির স্টেথোস্কোপ বিখ্যাত হয়েছে। গত শতাব্দীর চারের দশকে বাজারে আসে হিউলেট-প্যাকার্ডের স্টেথোস্কোপ।

ছয়ের দশক থেকে ডাক্তারদের পছন্দের স্টেথোস্কোপ হয় ডেভিড লিটম্যান-এর তৈরি যন্ত্র। লিটম্যানের স্টেথোস্কোপ এখনও ডাক্তারদের পছন্দের তালিকার প্রথমদিকের নাম।

ফিরে যাই ডক্টর রেনের গল্পে। স্টেথোস্কোপ আবিষ্কারের মূল উদ্দেশ্যই হল ব্রঙ্কাইটিস, অ্যাস্থমা, হার্টের রোগ আলাদা-আলাদাভাবে ডায়াগনোসিস করা। আরও একটা রোগ হল টিউবারকিউলোসিস বা টিবি। টিবি রোগের গবেষণা বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে দেয় স্টেথোস্কোপ আবিষ্কার। রেনে লেনেক নিজের এই আবিষ্কার নিয়ে বেশ গর্বিত ছিলেন। ভাগ্নে মেরিয়াদকে স্টেথোস্কোপ নিয়ে বলেছিলেন – “It is the greatest legacy of my life”

বেশ বেশি বয়সে মিস আর্গনকে বিয়ে করেন ডক্টর রেনে। ১৮২৪ সালে বিয়ের পরে তাঁর অসুস্থতা বাড়ে। এমনিতেই মানুষটি ছিলেন রোগাভোগা। এরসঙ্গে যোগ হয় জ্বর আর শ্বাসকষ্ট। মেরিয়াদকে বলেন, তাঁর আবিষ্কৃত যন্ত্র দিয়ে তাঁরই ফুসফুসের আওয়াজ শুনে তাঁকে জানাতে। শধগুলো বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারেন যে তিনি নিজেই টিবি রোগে আক্রান্ত। টিবি রোগের তখন কোনও চিকিৎসা ছিলনা। ১৮২৬ সালের তেরোই আগস্ট মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে মারা যান রেনে লেনেক। নিঃসন্তান ছিলেন রেনে। তাঁর সমস্ত সম্পত্তি উইল করে যান ভাগ্নে মেরিয়াদের নামে। তাঁর মধ্যে স্টেথোস্কোপও ছিল।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

অনির্বাণ জানা

ভারতীয় চিকিৎসক

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

স্টেথোস্কোপ আবিষ্কারের গল্প

প্রকাশ: ০৯:০৩:৪১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১

ভীষণ বিপদে পড়েছেন ডক্টর রেনে। পুরো নাম রেনে থিওফাইল হায়াসিন্থে লেনেক (Rene Theophile Hyacinthe Laënnec) । সালটা ১৮১৬। ফরাসী চিকিৎসক রেনের এমনিতে বেশ নামডাক। প্যারিসের ইকোল প্রাতিক ডাক্তারি শিক্ষার স্কুল থেকে মেডিসিন আর সার্জারি দুটো বিষয়েই প্রথম হয়েছিলেন। মেডিসিনে তো তাঁর জ্ঞান ঈর্ষা করার মতো। অনেক আশা নিয়ে এক তরুণীকে তার অভিভাবকরা রেনের কাছে এনেছে। অল্পবয়সি মেয়েটিকে দেখতেও বেশ সুন্দর। কিন্তু মেয়েটি বিশ্রি রকম মোটাসোটা। মেয়েটির শ্বাসের অসুবিধা। হার্ট কিংবা লাঙস থেকে প্রবলেমটা আসছে। ফলে লাঙস ও হার্টের শব্দ খুঁটিয়ে শোনা উচিত। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত ডাক্তারদের এই শব্দগুলো শুনতে হত রোগীর বুকে কান রেখে। একেতো স্থুলাঙ্গী বলে শব্দ ঠিকঠাক শোনার অসুবিধে। তারওপর স্বভাবলাজুক ডাক্তারের সুন্দর মহিলার বুকে কান পাতায় আপত্তি আছে। সে এক মহা ফ্যাসাদ।

ছোটবেলায় বেশ ভাল বাঁশি বাজাতেন ডক্টর রেনে। রেনেকে একটা জিনিস খুব অবাক করত-কেমন করে যেন আস্তে করে ফুঁ দেওয়ার শব্দ। কী সুন্দরভাবে সাত সুরে সাজিয়ে বাঁশির সামনের গর্তগুলো দিয়ে বেরোয়। অবচেতনে বাঁশির ব্যাপারটা মাথায় ছিল। তবে সেটা নিয়ে বেশি চিন্তাভাবনা করেননি রেনে। নতুন আসা পেশেন্টটির ডায়াগনোসিস নিয়ে বরং তিনি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন। আনমনে হেঁটে যাচ্ছিলেন ল্যুভর ক্যাসলের সামনে দিয়ে। সেপ্টেম্বর মাস। ক্যাসলের সামনের গাছগুলো ফুল দিয়ে সাজতে শুরু করেছে। বাচ্চারা হইচই করে মাঠে খেলা করছে। এরমধ্যে দুটো বাচ্চা অদ্ভুত খেলা খেলছে। একটা লম্বা বাঁশের একপ্রান্তে একজন শব্দ করছে আর তার বন্ধু অন্যপ্রান্তে বাঁশের চোঙে কান লাগিয়ে সেই শব্দ শুনছে। রেনে গিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে খেলায় নেমে পড়েন। বাঁশের অন্যপ্রান্তে তিনিও কান পাতেন। কি অদ্ভুত ব্যাপার! শব্দগুলো বহুগুণে বেড়ে গিয়ে তাঁর কানে আসছে। তিনি চটপট বাড়ি ফিরে এসে একটা ফাঁপা বাঁশ নিয়ে বসে পড়েন। তৈরি হয় প্রথম স্টেথোস্কোপ (Stethoscope)। ১৮১৬ সালে রেনে থিওফাইল হায়াসিন্থে লেনেক স্টেথোস্কোপ আবিষ্কার করেন। এর কারণ ছিল সুন্দর মেয়ে বা মহিলাদের বুকে কান পাতায় আপত্তি।

পৃথিবীর প্রথম স্টেথোস্কোপটি সেহেতু বাঁশের তৈরি ছিল। লম্বায় মোটামুটি ২৫ সেন্টিমিটার। চওড়ায় ২.৫ সেন্টিমিটার। তিনভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল স্টেথোস্কোপটি। স্টেথোস্কোপ নামকরণ হয়েছে দুটো শব্দ জোড়া লাগিয়ে। (stethos মানে বুক এবং (skopos) মানে খোঁজ করা।

প্রথমদিকে চিকিৎসকদের একদম নাপছন্দ ছিল এই আবিষ্কার। আস্তে আস্তে কিছু ডাক্তার এটা ব্যবহার করতে শুরু করেন। ১৮৪০ সালে গোল্ডিং বার্ড নামের একজন কাঠের স্টেথোস্কোপের সঙ্গে একটা নল জুড়ে দেন। তাতে দেখা গেল যন্ত্রটি ব্যবহারের অনেক সুবিধা হচ্ছে। তখনও পর্যন্ত স্টেথোস্কোপ এক কানেই ব্যবহার হতো।

১৮৫১ সালে আয়ারল্যান্ডের চিকিৎসক আর্থার লিয়ারেড দুই কানে নল দিয়ে যন্ত্রটিকে ব্যবহার করেন। পরের বছর জর্জ ফিলিপ কামাম আরও কিছু অংশের পরিবর্তন ঘটিয়ে বেশ কিছুটা আধুনিক রূপ দেন স্টেথোস্কোপের।

১৮৫২ থেকে রীতিমতো বাণিজ্যিকভাবে স্টেথোস্কোপ বাজারে আসে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কোম্পানির স্টেথোস্কোপ বিখ্যাত হয়েছে। গত শতাব্দীর চারের দশকে বাজারে আসে হিউলেট-প্যাকার্ডের স্টেথোস্কোপ।

ছয়ের দশক থেকে ডাক্তারদের পছন্দের স্টেথোস্কোপ হয় ডেভিড লিটম্যান-এর তৈরি যন্ত্র। লিটম্যানের স্টেথোস্কোপ এখনও ডাক্তারদের পছন্দের তালিকার প্রথমদিকের নাম।

ফিরে যাই ডক্টর রেনের গল্পে। স্টেথোস্কোপ আবিষ্কারের মূল উদ্দেশ্যই হল ব্রঙ্কাইটিস, অ্যাস্থমা, হার্টের রোগ আলাদা-আলাদাভাবে ডায়াগনোসিস করা। আরও একটা রোগ হল টিউবারকিউলোসিস বা টিবি। টিবি রোগের গবেষণা বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে দেয় স্টেথোস্কোপ আবিষ্কার। রেনে লেনেক নিজের এই আবিষ্কার নিয়ে বেশ গর্বিত ছিলেন। ভাগ্নে মেরিয়াদকে স্টেথোস্কোপ নিয়ে বলেছিলেন – “It is the greatest legacy of my life”

বেশ বেশি বয়সে মিস আর্গনকে বিয়ে করেন ডক্টর রেনে। ১৮২৪ সালে বিয়ের পরে তাঁর অসুস্থতা বাড়ে। এমনিতেই মানুষটি ছিলেন রোগাভোগা। এরসঙ্গে যোগ হয় জ্বর আর শ্বাসকষ্ট। মেরিয়াদকে বলেন, তাঁর আবিষ্কৃত যন্ত্র দিয়ে তাঁরই ফুসফুসের আওয়াজ শুনে তাঁকে জানাতে। শধগুলো বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারেন যে তিনি নিজেই টিবি রোগে আক্রান্ত। টিবি রোগের তখন কোনও চিকিৎসা ছিলনা। ১৮২৬ সালের তেরোই আগস্ট মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে মারা যান রেনে লেনেক। নিঃসন্তান ছিলেন রেনে। তাঁর সমস্ত সম্পত্তি উইল করে যান ভাগ্নে মেরিয়াদের নামে। তাঁর মধ্যে স্টেথোস্কোপও ছিল।