০৩:২৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট EG.5 কী উদ্বেগজনক?

প্রফেসর ড. রাশিদুল হক
  • প্রকাশ: ১২:২৯:৫৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৬ অগাস্ট ২০২৩
  • / ৫৪৬ বার পড়া হয়েছে

প্রতীকী ছবি

সার্স-কোভি-২ ভাইরাসটির জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি সময়ের ব্যবধানে জিন পরিব্যক্তি বা মিউটেশনের মাধ্যমে বারবার রূপ বদলিয়েছে। EG.5 বা "এরিস" নামকরণে নতুন এই ভ্যারিয়েন্টটি ওমিক্রন-উদ্ভুত XBB স্ট্রেনের একটি প্রাণঘাতী উত্তরসূরি। ইতোমধ্যে, এরিস এর প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ প্রায় ৩৮টি দেশে।  বিশ্বব্যাপী, গত একমাসে (৩ আগস্ট পর্যন্ত) দশ লাখেরও বেশি মানুষ এরিস (EG.5)-ভ্যারিয়েন্টে সংক্রামিত হয়েছে, যার মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন ৩,১০০ জন। তাই, বিশ্বজুড়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)।

মূল শব্দ: করোনাভাইরাস, ওমিক্রন, EG , স্পাইক প্রোটিন, মিউটেশন, কোভিড।

২০১৯ এর ডিসেম্বরে চীন দেশের উহান শহরে সার্স-কোভি-২ বা করোনাভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয়।  তারপর থেকে ২০২১ সালের শেষ অবধি করোনাভাইরাসের তান্ডবলীলা আমরা দেখেছি। আমরা অনেকেই এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছি, আর এই ভাইরাসের বিভিন্ন ধরন প্রাণ কেড়ে নিয়ে গেছে বিশ্বব্যাপী ৭০ লাখ মানুষের। বাংলাদেশেও কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন প্রায় ৩০ হাজার মানুষ (www.worldometers.info/coronavirus/)। কোভিড-১৯ শুরু হবার পর থেকে ২০২১ সালের শেষ পর্যন্ত সংক্রমণের দৌরাত্ম্যে ছিল সার্স-কোভি-২ ভাইরাসের দুটি ভ্যারিয়েন্ট- আল্ফ়া ও ডেল্টা। তবে, এই দু’য়ের দ্বন্দ্বযুদ্ধে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এবং এই জাতটির কারণেই ২০২১ ছিল বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় হুমকি। তখন বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণের খতিয়ানে শীর্ষে ছিল ডেল্টা (রা. হক: যুগান্তর, আগস্ট ২৩, ২০২১), যার দ্বারা অতিমারি (প্যান্ডেমিক-মহামারির বৈশ্বিক রূপ) আকারে সংক্রামিত হয়েছিল বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ। আর, অতিমারি শুরু হওয়ার পর থেকে ২০২২ সালের প্রথম কয়েকটি মাস (জানুয়ারি থেকে মার্চ) বিশ্ব দেখেছিল কোভিড-১৯ এর সবচেয়ে বড় ঢেউ, সার্স-কোভি-২ ভাইরাসের ওমিক্রন (প্যাঙ্গো বংশনাম বি.১.১.৫২৯) ভ্যারিয়েন্টের বিস্তারের কারণে। ২০২১ সালের শেষের দিকে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের আবির্ভাব ঘটে। সর্বোচ্চ পর্যায়ের এই তিন মাসে ওমিক্রন-সৃষ্ট এই ঢেউয়ে বিশ্ব দেখেছিল সমগ্র অতিমারির সর্বাধিক সংখ্যক (সাপ্তাহিক পরিসংখ্যান হিসেবে) সংক্রমণ এবং মৃত্যু। ২০২২ সালে শুধু যুক্তরাষ্ট্র-ই দেখেছে প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষের সংক্রমণ এবং কোভিড-১৯-আক্রান্ত আড়াই (২.৫) লাখ মানুষের মৃত্যু। তবে, ইতোমধ্যে কোভিডের বিরুদ্ধে মানবদেহে যথেষ্ট প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে, যার কারণে বিভিন্ন উপায়ে মানুষের জীবনকে অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। সার্বজনীন ভ্যাকসিন, ফলপ্রসূ অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ, কার্যকর মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি আবিষ্কারের ফলেই তা সম্ভব হয়েছে। 

তবে উদ্বেগের বিষয় যে করোনাভাইরাস অদৃশ্য হয়ে যায়নি। যদিও সম্মিলিত প্রাকৃতিক এবং ভ্যাকসিন-প্ররোচিত অনাক্রম্যতার কারণে ২০২২ সালের শেষের দিকে কোভিড-১৯ অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে, তবুও অস্ট্রেলিয়া, চীন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যত্র দেখা গেছে নভেম্বর মাসে আবারও এই সংক্রমণ শিখরে পৌঁছেছে এবং তার ধারাবাহিতা ২০২৩ সালকেও স্পর্শ করেছে। জানা গেছে, ওমিক্রন-উদ্ভুত বিভিন্ন উপভ্যারিয়েন্টের দাপটে ২০২৩ সালে (১১ আগস্ট পর্যন্ত) যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড আক্রান্তে মৃত্যুবরণ করেছেন ৫১ হাজার মানুষ এবং বিশ্বব্যাপী মাত্র ২৮ দিনে (৩ থেকে ৩০ জুলাই, ২০২৩) দশ লাখেরও বেশি নতুনভাবে কোভিড-১৯ এ সংক্রামিত হয়েছে এবং প্রাণবিয়োগ ঘটেছে ৩১০০ জনের বেশি (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)। সফল টিকা এবং উন্নত সামাজিক ব্যবস্থাপনার আবির্ভাবের সাথে করোনা-সংক্রমণ হ্রাস পেয়েছে বটে, কিন্তু ভ্যাকসিন প্রতিরোধ ক্ষমতাকে অতিক্রম ক’রে মূল ওমিক্রন (বি.১.১.৫২৯) বেশ কয়েকটি সংক্রমণশীল উপভ্যারিয়েন্টর জন্ম দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে: বিএ.১ (BA.1), বিএ.২, বিএ.৩, বিএ.৪ এবং বিএ.৫। বিএ.২ বা ‘স্টিলথ ভ্যারিয়েন্ট’ নামে পরিচিত ওমিক্রনের এই প্রকরণের দ্বারা সৃষ্ট ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, কারণ বিএ.২ ওমিক্রন উপভ্যারিয়েন্টটি ছিল বিএ.১ ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে ১.৫ গুণ বেশি সংক্রমণযোগ্য (রা. হক: যুগান্তর, ৬ ডিসেম্বর, ২০২১)। অক্টোবর ২০২২ থেকে, ওমিক্রনের বেশ কিছু নব্যসংস্করণ, যেমন বিএ.৫-উদ্ভুত বিকিউ.১ (BQ.1) এবং বিকিউ.১.১, এবং XBB আবির্ভূত হয়েছিল, যা ২০২২ সালের শেষের তিনটি মাস (অক্টবর-ডিসেম্বর) ডেল্টা সংক্রমণকে ছাড়িয়ে সারা বিশ্বকে সর্বোচ্চ সংক্রামিত করেছিল।  

"দানবীয় করোনাভাইরাস সার্স-কোভি-২: বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনা" নামে লেখক ড. রাশিদুল হক-এর একটি বইয়ের প্রচ্ছদ
“দানবীয় করোনাভাইরাস সার্স-কোভি-২: বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনা” নামে লেখক ড. রাশিদুল হক-এর একটি বইয়ের প্রচ্ছদ

২০২৩: করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্টের আবির্ভাব

সার্স-কোভি-২ ভাইরাসটির জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি সময়ের ব্যবধানে জিন পরিব্যক্তি বা মিউটেশনের মাধ্যমে বারবার রূপ বদলিয়েছে। ২০২৩ সালের প্রথম দিকে আবির্ভুত XBB-ভ্যারিয়েন্টগুলির প্রতিনিধিত্বশীল সংক্রমণ আমরা দেখেছি, যা ধীরে ধীরে অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে উঠে, জন্ম দেয় অধিকতর সংক্রমণশীল নতুন একটি ভ্যারিয়েন্টের।  EG.5-নামকরণে নতুন এই ভ্যারিয়েন্টটি ওমিক্রন-উদ্ভুত XBB স্ট্রেনের একটি প্রাণঘাতী উত্তরসূরি। ২০২৩-এর শুরুতে ওমিক্রন উপভ্যারিয়েন্ট XBB.1.5 (যাকে তুলনা করা হয়েছে কিংবদন্তি ক্র্যাকেন/Kraken বা সমুদ্র দানবের সাথে) দ্রুত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়া সে সময়ে সবচেয়ে সংক্রমণযোগ্য ওমিক্রন স্ট্রেন। XBB.1.5-এর স্পাইক প্রোটিনে রয়েছে F486P মিউটেশন, যা মানবকোষপৃষ্ঠে অবস্থিত এনজিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম-২ (এসিই-২/ACE-2) রিসেপ্টরের সাথে বর্ধিত আবদ্ধতার কারণে তার সংক্রমণ ক্ষমতা বাড়ায়। অতিসংক্রমণশীল EG.5 জাতটিকে তুলনা করা হয়েছে দ্বন্দ্ব এবং বিরোধের গ্রীক দেবী “এরিস (Eris)”-র সাথে। ইতোমধ্যে, এরিস এর প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ প্রায় ৩৮টি দেশে। বিশ্বব্যাপী, গত একমাসে (৩ আগস্ট পর্যন্ত) দশ লাখেরও বেশি মানুষ এরিস (EG.5)-ভ্যারিয়েন্টে সংক্রামিত হয়েছে, যার মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন ৩,১০০ জন। তাই, বিশ্বজুড়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)। জিনগতভাবে, EG.5 খুব দ্রুত সংক্রমণশীল হয়ে উঠছে এবং এরই মধ্যে এর একটি অনুরূপও তৈরি হয়েছে- EG.5.1। 

“স্পাইক (Spike)” প্রোটিন-এর বৈশিষ্ট্যগুলো ফিরে দেখা

ইতোপূর্বে, করোনাভাইরাস-সম্পর্কিত আমার নানা প্রবন্ধে স্পাইক প্রোটিন সমন্ধে বিশদ ব্যাখ্যা করেছি। তবুও, প্রোটিনটির বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য আমার এই নিবন্ধে আবারো সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো।  করোনাভাইরাস (সার্স-কোভি-২) তার ‘আরএনএ জিনোম (RNA genome)’-এর জিনগত কোড অনুযায়ী সর্বসাকুল্যে ৩০-৩২টি প্রোটিন তৈরি করতে সক্ষম, যার মধ্যে চারটি প্রধান কাঠামোপ্রোটিন হলো: স্পাইক (S) গ্লাইকোপ্রোটিন, এনভেলপ (E) প্রোটিন, মেমব্রেন (M) প্রোটিন এবং নিউক্লিওক্যাপসিড (N) প্রোটিন। স্পাইক প্রোটিনের দুটি সাবইউনিট রয়েছে- S1 এবং S2। মানবকোষে এই ভাইরাসটির প্রবেশ স্পাইক প্রোটিন (S1 সাবইউনিট) দ্বারা মধ্যস্থতা করা হয়, যা মানব কোষঝিল্লিতে অবস্থিত “অ্যাঞ্জিওটেনসিন-রূপান্তরিত এনজাইম-২” রিসেপ্টরের সাথে আবদ্ধ হওয়ার জন্য দায়ী এবং ভাইরাস ও কোষীয় মেমব্রেন একীকরণের জন্য দায়ী স্পাইক প্রোটিনের S2 সাবইউনিট (ছবি দেখুন)। মানবকোষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার পর কোষের প্রোটিন-সংশ্লেষণকারী উপাদান ব্যবহার ক’রে ভাইরাসগুলো তাদের অসংখ্য প্রতিলিপি তৈরি করে, যা আমাদের ফুসফুসসহ দেহের অন্যান্য অঙ্গগুলিকে অকার্যকর করে দেয়। এসিই-২’র সাথে এই বন্ধন বাধ্যবাধকতাপূর্ণ বলেই আমাদের দেহে যেসব অঙ্গে বা কোষগুলিতে এসিই-২ প্রোটিন বিদ্যমান নয়, সেসব কোষগুলির ভিতর করোনাভাইরাস প্রবেশ করার কোনো সুযোগ থাকে না। সংক্রমণশীল স্পাইক প্রোটিনের যে অংশটুকু সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো ‘রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইন’ (RBD/আরবিডি), অর্থাৎ পুরো স্পাইক প্রোটিনের পরিবর্তে কেবলমাত্র ‘আরবিডি’ (অ্যামিনো অ্যাসিড ৩৩৮-৫৩০) এসিই-২ রিসেপ্টর প্রোটিনের সাথে সংযুক্ত হয়ে পুরো ভাইরাসকে কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার সুযোগ করে দেয়।  রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইন ১৯২টি অ্যামিনো অ্যাসিড নিয়ে গঠিত।

EG.5 প্রকরণটির অতিমাত্রায় সংক্রমণশীলতার কারণ কী?

EG.5 প্রকরণটির অতিমাত্রায় সংক্রমণশীলতার কারণ কী?

এটি প্রথম শনাক্ত হয়েছে ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)। EG.5 হলো XBB.1.9.2-এর একটি বংশধর, যার XBB.1.5-এর মতো একই স্পাইক প্রোটিনের অ্যামিনো অ্যাসিড প্রোফাইল রয়েছে। ওমিক্রন XBB-ভ্যারিয়েন্টগুলোতে আমরা দেখেছি নানা ধরনের মিউটেশন বা পরিব্যক্তি, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো S:486P, S:456L এবং S:478R, যা সহজেই দেহের ইমিউন সিস্টেমের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে এড়িয়ে যেতে পারে; এছাড়াও, এসব মিউটেশন তাদের বংশবৃদ্ধির সুবিধাও প্রদান করে থাকে। এর বাইরেও, পূর্বসূরি XBB.1.9.2 এবং XBB.1.5 এর তুলনায় EG.5 স্পাইক প্রোটিনটির আরবিডি অঞ্চলে অতিরিক্ত একটি মিউটেশন (S:F456L) বহন করে, যেখানে ফেনিল্যালানিন (F: Phe)-র পরিবর্তে প্রতিস্থাপিত হয়েছে লিউসিন (L: Leu) অ্যামিনো অ্যাসিড, যা মানব এসিই-২ রিসেপ্টরের সাথে শক্তবন্ধনে আবদ্ধ হবার সক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এই মিউটেশনটি সম্ভবত ভাইরাসকে দেহের ইমিউন সিস্টেমকেও এড়াতে সাহায্য করে। এছাড়াও, EG.5-এর নব্যসংস্করণ EG.5.1 স্ট্রেনে রয়েছে আরও একটি নতুন স্পাইক মিউটেশন, S:Q52H (গ্লুটামেটের পরিবর্তে হিস্টিডিনের প্রতিস্থাপন), যা এই স্ট্রেনটির সংক্রমণশীলতা আরো বৃদ্ধি করেছে। EG.5 ভারতেও শনাক্ত হয়েছে মে-জুন মাসে, কিস্তু অস্ট্রেলিয়ার মতো ভারতে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট XBB পরিবার এখনও সংক্রমণরাজ্যে আধিপত্য বজায় রেখেছে যা সেখানকার ৯০-৯২% সংক্রমণের জন্য দায়ী।   

EG.5 এর সাথে কী কী উপসর্গ যুক্ত হতে পারে?

EG.5 সংক্রমণের লক্ষণগুলো সাধারণভাবে অন্যান্য করোনভাইরাস, বিশেষকরে ওমিক্রন লক্ষণগুলোর মতোই, যার প্রভাব হালকা থেকে গুরুতর অসুস্থতা পর্যন্ত হতে পারে। এর মধ্যে হাঁচি-কাশি, জ্বর বা ঠান্ডা লাগা, শ্বাসকষ্ট, ক্লান্তি, পেশিসমূহে ব্যথা, স্বাদ বা গন্ধ অনুভূতির পরিবর্তন এবং মাথাব্যথা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। তবে, ঋতুগত ওঠানামা এবং নমুনা পরীক্ষার অভাবের কারণে ফ্লু বা সাধারণ সর্দি থেকে EG.5-সংক্রমণকে পার্থক্য করা কঠিন হতে পারে। মানুষের কিছু গ্রুপের মধ্যে গুরুতর অসুস্থতা বা জটিলতা হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে, যার মধ্যে রয়েছে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিরা এবং যারা ইমিউনো-কমপ্রোমাইজড বা যাদের রয়েছে অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্যগত সমস্যা। তবে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে EG.5 তাৎক্ষণিকভাবে উদ্বেগের কোনো কারণ নয়, যদিও এটি বিশ্বব্যাপী খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়া নতুন একটি কোভিড সাবভ্যারিয়েন্ট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে VOI (ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট) ক্যাটেগরিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে, VOI এর পরবর্তী স্তরই হচ্ছে VOC (ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন)। 

নতুন বুস্টার কী EG.5 এর বিরুদ্ধে কাজ করবে?

বর্তমান সার্স-কোভি-২ বুস্টার ভ্যাকসিনগুলো EG- এবং অন্যান্য XBB-সাবভেরিয়েন্টের সংক্রমণ থেকে পর্যাপ্ত সুরক্ষা প্রদান করতে পারে না, ফলে প্রয়োজন XBB- ও EG-নির্দিষ্ট ভ্যাকসিনের। তাই, যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য আধিকারিকরা EG.5-স্ট্রেনটি আবির্ভুত হওয়ার পূর্বেই XBB-সাবভেরিয়েন্টগুলোর স্পাইক প্রোটিনের উপর ভিত্তি করে করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজ তৈরি করার একটি নতুন পরিকল্পনা হাতে  নিয়েছেন। এ বিষয়ে ফাইজার ওষুধ কোম্পানি এগিয়ে রয়েছে। আশা করা যায়, আসন্ন অক্টবরের মধ্যেই নতুন বুস্টারটি যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (FDA)কর্তৃক অনুমোদন পাবে। দুৰ্ভাগ্যবশত, EG.5 ও EG.5.1 নব্যসংস্করণ-দুটি সে প্রকল্পের আওতায় পড়েনি। তবে, আশা করা যায় যে, XBB-নির্দিষ্ট নতুন বুস্টারটি EG.5-এ সংক্রমিত ব্যক্তিদের পক্ষেও কাজ করবে। কারণ, তাদের উপপ্রকরণগুলোর মধ্যে স্পাইক প্রোটিনের বৈশিষ্টে খুব একটা বিস্তর পার্থক্য নেই, EG-প্রকরণের দুটি নব্য মিউটেশন ছাড়া।     

উপসংহার: কোভিড-১৯ এখনও কি একটি বড় হুমকি

যদিও করোনাভাইরাস বা কোভিড দৈনিক পত্র-পত্রিকায় এখন আর প্রথম পাতার খবর হয় না, কিন্তু এটি সত্য যে আমরা এখনও এই ভাইরাসটির সাথেই বাস করে চলেছি। ল্যাবেই তৈরি হোক বা বাদুড়জাতীয় প্রাণী থেকে এসে থাকুক (রা.হক: দৈনিক আমাদেরসময় জুলাই ২, ২০২১), করোনাভাইরাস সারা বিশ্বে এক ভীতি সঞ্চার করেছিল, প্রাণ কেড়েও নিয়ে গেছে সত্তর লাখ মানুষের, এখনও মারা যাচ্ছে বহুসহস্রে। ২০২০-২০২১ সালের করোনাকালীন অবস্থায় মানুষ আর ফিরে যেতে চায় না। দুৰ্ভাগ্যবশতঃ করোনাভাইরাস নতুন রূপে আবারো ফিরে এসেছে মানবসমাজে। EG.5, বা “এরিস” এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে প্রচলিত বৈকল্পিক, যা সংক্রমণের মাত্রায় XBB.1.16 (যাকে বলা হয় “আর্কটুরাস”, উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলির মধ্যে একটি)কেও ছাড়িয়ে গেছে এবং এটি বিশ্বব্যাপী দ্রুত সংক্রমণশীল বংশের মধ্যে একটি। বাংলাদেশেও XBB ভ্যারিয়েন্টসহ ওমিক্রনের অন্যান্য প্রকরণগুলো শনাক্ত হয়েছে ২০২২ সালে (Jubair M et al., Health Sci Rep. 2023, 6-3: e1134)। EG.5 ভারতে শনাক্ত হলেও বাংলাদেশে শনাক্ত হয়েছে কিনা তার তথ্য আমার জানা নেই। তবে, বাংলাদেশে ২০২৩ সালে (১১ আগস্ট পর্যন্ত) করোনাভাইরাসে নতুনভাবে সংক্রমিত হয়েছে প্রায় ৭ হাজার মানুষ। ধারণা করা যায়, এসব সংক্রমণের পেছনে XBB- ও EG.5-প্রকরণগুলোই অধিকাংশক্ষেত্রে দায়ী। সাধারণভাবে, করোনভাইরাস বিশ্বজুড়ে বিস্তার লাভ করছে দ্রুত, তাই এখনও এই ভাইরাসটি হুমকি হিসেবেই রয়ে গেছে। এই মুহূর্তে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) পরামর্শ দিয়েছে যে, নতুন ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির জন্য যেন সব দেশ প্রস্তুত থাকে; তাদের প্রতিষ্ঠিত কোভিড-১৯ অবকাঠামো যেন বজায় রাখে। তাই, রোগপরীক্ষা, নজরদারি ও রিপোর্টিং, বৈকল্পিক ট্র্যাকিং এবং প্রারম্ভিক স্বাস্থ্যসেবা বিধান বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

প্রফেসর ড. রাশিদুল হক

প্রফেসর ড. রাশিদুল হক: সাবেক উপ-উপাচার্য, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী, এবং সাবেক অধ্যাপক, এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়, আটলান্টা, যুক্তরাষ্ট্র, ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট EG.5 কী উদ্বেগজনক?

প্রকাশ: ১২:২৯:৫৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৬ অগাস্ট ২০২৩
সার্স-কোভি-২ ভাইরাসটির জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি সময়ের ব্যবধানে জিন পরিব্যক্তি বা মিউটেশনের মাধ্যমে বারবার রূপ বদলিয়েছে। EG.5 বা "এরিস" নামকরণে নতুন এই ভ্যারিয়েন্টটি ওমিক্রন-উদ্ভুত XBB স্ট্রেনের একটি প্রাণঘাতী উত্তরসূরি। ইতোমধ্যে, এরিস এর প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ প্রায় ৩৮টি দেশে।  বিশ্বব্যাপী, গত একমাসে (৩ আগস্ট পর্যন্ত) দশ লাখেরও বেশি মানুষ এরিস (EG.5)-ভ্যারিয়েন্টে সংক্রামিত হয়েছে, যার মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন ৩,১০০ জন। তাই, বিশ্বজুড়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)।

মূল শব্দ: করোনাভাইরাস, ওমিক্রন, EG , স্পাইক প্রোটিন, মিউটেশন, কোভিড।

২০১৯ এর ডিসেম্বরে চীন দেশের উহান শহরে সার্স-কোভি-২ বা করোনাভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয়।  তারপর থেকে ২০২১ সালের শেষ অবধি করোনাভাইরাসের তান্ডবলীলা আমরা দেখেছি। আমরা অনেকেই এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছি, আর এই ভাইরাসের বিভিন্ন ধরন প্রাণ কেড়ে নিয়ে গেছে বিশ্বব্যাপী ৭০ লাখ মানুষের। বাংলাদেশেও কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন প্রায় ৩০ হাজার মানুষ (www.worldometers.info/coronavirus/)। কোভিড-১৯ শুরু হবার পর থেকে ২০২১ সালের শেষ পর্যন্ত সংক্রমণের দৌরাত্ম্যে ছিল সার্স-কোভি-২ ভাইরাসের দুটি ভ্যারিয়েন্ট- আল্ফ়া ও ডেল্টা। তবে, এই দু’য়ের দ্বন্দ্বযুদ্ধে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এবং এই জাতটির কারণেই ২০২১ ছিল বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় হুমকি। তখন বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণের খতিয়ানে শীর্ষে ছিল ডেল্টা (রা. হক: যুগান্তর, আগস্ট ২৩, ২০২১), যার দ্বারা অতিমারি (প্যান্ডেমিক-মহামারির বৈশ্বিক রূপ) আকারে সংক্রামিত হয়েছিল বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ। আর, অতিমারি শুরু হওয়ার পর থেকে ২০২২ সালের প্রথম কয়েকটি মাস (জানুয়ারি থেকে মার্চ) বিশ্ব দেখেছিল কোভিড-১৯ এর সবচেয়ে বড় ঢেউ, সার্স-কোভি-২ ভাইরাসের ওমিক্রন (প্যাঙ্গো বংশনাম বি.১.১.৫২৯) ভ্যারিয়েন্টের বিস্তারের কারণে। ২০২১ সালের শেষের দিকে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের আবির্ভাব ঘটে। সর্বোচ্চ পর্যায়ের এই তিন মাসে ওমিক্রন-সৃষ্ট এই ঢেউয়ে বিশ্ব দেখেছিল সমগ্র অতিমারির সর্বাধিক সংখ্যক (সাপ্তাহিক পরিসংখ্যান হিসেবে) সংক্রমণ এবং মৃত্যু। ২০২২ সালে শুধু যুক্তরাষ্ট্র-ই দেখেছে প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষের সংক্রমণ এবং কোভিড-১৯-আক্রান্ত আড়াই (২.৫) লাখ মানুষের মৃত্যু। তবে, ইতোমধ্যে কোভিডের বিরুদ্ধে মানবদেহে যথেষ্ট প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে, যার কারণে বিভিন্ন উপায়ে মানুষের জীবনকে অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। সার্বজনীন ভ্যাকসিন, ফলপ্রসূ অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ, কার্যকর মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি আবিষ্কারের ফলেই তা সম্ভব হয়েছে। 

তবে উদ্বেগের বিষয় যে করোনাভাইরাস অদৃশ্য হয়ে যায়নি। যদিও সম্মিলিত প্রাকৃতিক এবং ভ্যাকসিন-প্ররোচিত অনাক্রম্যতার কারণে ২০২২ সালের শেষের দিকে কোভিড-১৯ অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে, তবুও অস্ট্রেলিয়া, চীন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যত্র দেখা গেছে নভেম্বর মাসে আবারও এই সংক্রমণ শিখরে পৌঁছেছে এবং তার ধারাবাহিতা ২০২৩ সালকেও স্পর্শ করেছে। জানা গেছে, ওমিক্রন-উদ্ভুত বিভিন্ন উপভ্যারিয়েন্টের দাপটে ২০২৩ সালে (১১ আগস্ট পর্যন্ত) যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড আক্রান্তে মৃত্যুবরণ করেছেন ৫১ হাজার মানুষ এবং বিশ্বব্যাপী মাত্র ২৮ দিনে (৩ থেকে ৩০ জুলাই, ২০২৩) দশ লাখেরও বেশি নতুনভাবে কোভিড-১৯ এ সংক্রামিত হয়েছে এবং প্রাণবিয়োগ ঘটেছে ৩১০০ জনের বেশি (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)। সফল টিকা এবং উন্নত সামাজিক ব্যবস্থাপনার আবির্ভাবের সাথে করোনা-সংক্রমণ হ্রাস পেয়েছে বটে, কিন্তু ভ্যাকসিন প্রতিরোধ ক্ষমতাকে অতিক্রম ক’রে মূল ওমিক্রন (বি.১.১.৫২৯) বেশ কয়েকটি সংক্রমণশীল উপভ্যারিয়েন্টর জন্ম দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে: বিএ.১ (BA.1), বিএ.২, বিএ.৩, বিএ.৪ এবং বিএ.৫। বিএ.২ বা ‘স্টিলথ ভ্যারিয়েন্ট’ নামে পরিচিত ওমিক্রনের এই প্রকরণের দ্বারা সৃষ্ট ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, কারণ বিএ.২ ওমিক্রন উপভ্যারিয়েন্টটি ছিল বিএ.১ ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে ১.৫ গুণ বেশি সংক্রমণযোগ্য (রা. হক: যুগান্তর, ৬ ডিসেম্বর, ২০২১)। অক্টোবর ২০২২ থেকে, ওমিক্রনের বেশ কিছু নব্যসংস্করণ, যেমন বিএ.৫-উদ্ভুত বিকিউ.১ (BQ.1) এবং বিকিউ.১.১, এবং XBB আবির্ভূত হয়েছিল, যা ২০২২ সালের শেষের তিনটি মাস (অক্টবর-ডিসেম্বর) ডেল্টা সংক্রমণকে ছাড়িয়ে সারা বিশ্বকে সর্বোচ্চ সংক্রামিত করেছিল।  

"দানবীয় করোনাভাইরাস সার্স-কোভি-২: বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনা" নামে লেখক ড. রাশিদুল হক-এর একটি বইয়ের প্রচ্ছদ
“দানবীয় করোনাভাইরাস সার্স-কোভি-২: বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনা” নামে লেখক ড. রাশিদুল হক-এর একটি বইয়ের প্রচ্ছদ

২০২৩: করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্টের আবির্ভাব

সার্স-কোভি-২ ভাইরাসটির জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি সময়ের ব্যবধানে জিন পরিব্যক্তি বা মিউটেশনের মাধ্যমে বারবার রূপ বদলিয়েছে। ২০২৩ সালের প্রথম দিকে আবির্ভুত XBB-ভ্যারিয়েন্টগুলির প্রতিনিধিত্বশীল সংক্রমণ আমরা দেখেছি, যা ধীরে ধীরে অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে উঠে, জন্ম দেয় অধিকতর সংক্রমণশীল নতুন একটি ভ্যারিয়েন্টের।  EG.5-নামকরণে নতুন এই ভ্যারিয়েন্টটি ওমিক্রন-উদ্ভুত XBB স্ট্রেনের একটি প্রাণঘাতী উত্তরসূরি। ২০২৩-এর শুরুতে ওমিক্রন উপভ্যারিয়েন্ট XBB.1.5 (যাকে তুলনা করা হয়েছে কিংবদন্তি ক্র্যাকেন/Kraken বা সমুদ্র দানবের সাথে) দ্রুত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়া সে সময়ে সবচেয়ে সংক্রমণযোগ্য ওমিক্রন স্ট্রেন। XBB.1.5-এর স্পাইক প্রোটিনে রয়েছে F486P মিউটেশন, যা মানবকোষপৃষ্ঠে অবস্থিত এনজিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম-২ (এসিই-২/ACE-2) রিসেপ্টরের সাথে বর্ধিত আবদ্ধতার কারণে তার সংক্রমণ ক্ষমতা বাড়ায়। অতিসংক্রমণশীল EG.5 জাতটিকে তুলনা করা হয়েছে দ্বন্দ্ব এবং বিরোধের গ্রীক দেবী “এরিস (Eris)”-র সাথে। ইতোমধ্যে, এরিস এর প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ প্রায় ৩৮টি দেশে। বিশ্বব্যাপী, গত একমাসে (৩ আগস্ট পর্যন্ত) দশ লাখেরও বেশি মানুষ এরিস (EG.5)-ভ্যারিয়েন্টে সংক্রামিত হয়েছে, যার মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন ৩,১০০ জন। তাই, বিশ্বজুড়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)। জিনগতভাবে, EG.5 খুব দ্রুত সংক্রমণশীল হয়ে উঠছে এবং এরই মধ্যে এর একটি অনুরূপও তৈরি হয়েছে- EG.5.1। 

“স্পাইক (Spike)” প্রোটিন-এর বৈশিষ্ট্যগুলো ফিরে দেখা

ইতোপূর্বে, করোনাভাইরাস-সম্পর্কিত আমার নানা প্রবন্ধে স্পাইক প্রোটিন সমন্ধে বিশদ ব্যাখ্যা করেছি। তবুও, প্রোটিনটির বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য আমার এই নিবন্ধে আবারো সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো।  করোনাভাইরাস (সার্স-কোভি-২) তার ‘আরএনএ জিনোম (RNA genome)’-এর জিনগত কোড অনুযায়ী সর্বসাকুল্যে ৩০-৩২টি প্রোটিন তৈরি করতে সক্ষম, যার মধ্যে চারটি প্রধান কাঠামোপ্রোটিন হলো: স্পাইক (S) গ্লাইকোপ্রোটিন, এনভেলপ (E) প্রোটিন, মেমব্রেন (M) প্রোটিন এবং নিউক্লিওক্যাপসিড (N) প্রোটিন। স্পাইক প্রোটিনের দুটি সাবইউনিট রয়েছে- S1 এবং S2। মানবকোষে এই ভাইরাসটির প্রবেশ স্পাইক প্রোটিন (S1 সাবইউনিট) দ্বারা মধ্যস্থতা করা হয়, যা মানব কোষঝিল্লিতে অবস্থিত “অ্যাঞ্জিওটেনসিন-রূপান্তরিত এনজাইম-২” রিসেপ্টরের সাথে আবদ্ধ হওয়ার জন্য দায়ী এবং ভাইরাস ও কোষীয় মেমব্রেন একীকরণের জন্য দায়ী স্পাইক প্রোটিনের S2 সাবইউনিট (ছবি দেখুন)। মানবকোষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার পর কোষের প্রোটিন-সংশ্লেষণকারী উপাদান ব্যবহার ক’রে ভাইরাসগুলো তাদের অসংখ্য প্রতিলিপি তৈরি করে, যা আমাদের ফুসফুসসহ দেহের অন্যান্য অঙ্গগুলিকে অকার্যকর করে দেয়। এসিই-২’র সাথে এই বন্ধন বাধ্যবাধকতাপূর্ণ বলেই আমাদের দেহে যেসব অঙ্গে বা কোষগুলিতে এসিই-২ প্রোটিন বিদ্যমান নয়, সেসব কোষগুলির ভিতর করোনাভাইরাস প্রবেশ করার কোনো সুযোগ থাকে না। সংক্রমণশীল স্পাইক প্রোটিনের যে অংশটুকু সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো ‘রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইন’ (RBD/আরবিডি), অর্থাৎ পুরো স্পাইক প্রোটিনের পরিবর্তে কেবলমাত্র ‘আরবিডি’ (অ্যামিনো অ্যাসিড ৩৩৮-৫৩০) এসিই-২ রিসেপ্টর প্রোটিনের সাথে সংযুক্ত হয়ে পুরো ভাইরাসকে কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার সুযোগ করে দেয়।  রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইন ১৯২টি অ্যামিনো অ্যাসিড নিয়ে গঠিত।

EG.5 প্রকরণটির অতিমাত্রায় সংক্রমণশীলতার কারণ কী?

EG.5 প্রকরণটির অতিমাত্রায় সংক্রমণশীলতার কারণ কী?

এটি প্রথম শনাক্ত হয়েছে ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)। EG.5 হলো XBB.1.9.2-এর একটি বংশধর, যার XBB.1.5-এর মতো একই স্পাইক প্রোটিনের অ্যামিনো অ্যাসিড প্রোফাইল রয়েছে। ওমিক্রন XBB-ভ্যারিয়েন্টগুলোতে আমরা দেখেছি নানা ধরনের মিউটেশন বা পরিব্যক্তি, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো S:486P, S:456L এবং S:478R, যা সহজেই দেহের ইমিউন সিস্টেমের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে এড়িয়ে যেতে পারে; এছাড়াও, এসব মিউটেশন তাদের বংশবৃদ্ধির সুবিধাও প্রদান করে থাকে। এর বাইরেও, পূর্বসূরি XBB.1.9.2 এবং XBB.1.5 এর তুলনায় EG.5 স্পাইক প্রোটিনটির আরবিডি অঞ্চলে অতিরিক্ত একটি মিউটেশন (S:F456L) বহন করে, যেখানে ফেনিল্যালানিন (F: Phe)-র পরিবর্তে প্রতিস্থাপিত হয়েছে লিউসিন (L: Leu) অ্যামিনো অ্যাসিড, যা মানব এসিই-২ রিসেপ্টরের সাথে শক্তবন্ধনে আবদ্ধ হবার সক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এই মিউটেশনটি সম্ভবত ভাইরাসকে দেহের ইমিউন সিস্টেমকেও এড়াতে সাহায্য করে। এছাড়াও, EG.5-এর নব্যসংস্করণ EG.5.1 স্ট্রেনে রয়েছে আরও একটি নতুন স্পাইক মিউটেশন, S:Q52H (গ্লুটামেটের পরিবর্তে হিস্টিডিনের প্রতিস্থাপন), যা এই স্ট্রেনটির সংক্রমণশীলতা আরো বৃদ্ধি করেছে। EG.5 ভারতেও শনাক্ত হয়েছে মে-জুন মাসে, কিস্তু অস্ট্রেলিয়ার মতো ভারতে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট XBB পরিবার এখনও সংক্রমণরাজ্যে আধিপত্য বজায় রেখেছে যা সেখানকার ৯০-৯২% সংক্রমণের জন্য দায়ী।   

EG.5 এর সাথে কী কী উপসর্গ যুক্ত হতে পারে?

EG.5 সংক্রমণের লক্ষণগুলো সাধারণভাবে অন্যান্য করোনভাইরাস, বিশেষকরে ওমিক্রন লক্ষণগুলোর মতোই, যার প্রভাব হালকা থেকে গুরুতর অসুস্থতা পর্যন্ত হতে পারে। এর মধ্যে হাঁচি-কাশি, জ্বর বা ঠান্ডা লাগা, শ্বাসকষ্ট, ক্লান্তি, পেশিসমূহে ব্যথা, স্বাদ বা গন্ধ অনুভূতির পরিবর্তন এবং মাথাব্যথা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। তবে, ঋতুগত ওঠানামা এবং নমুনা পরীক্ষার অভাবের কারণে ফ্লু বা সাধারণ সর্দি থেকে EG.5-সংক্রমণকে পার্থক্য করা কঠিন হতে পারে। মানুষের কিছু গ্রুপের মধ্যে গুরুতর অসুস্থতা বা জটিলতা হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে, যার মধ্যে রয়েছে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিরা এবং যারা ইমিউনো-কমপ্রোমাইজড বা যাদের রয়েছে অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্যগত সমস্যা। তবে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে EG.5 তাৎক্ষণিকভাবে উদ্বেগের কোনো কারণ নয়, যদিও এটি বিশ্বব্যাপী খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়া নতুন একটি কোভিড সাবভ্যারিয়েন্ট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে VOI (ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট) ক্যাটেগরিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে, VOI এর পরবর্তী স্তরই হচ্ছে VOC (ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন)। 

নতুন বুস্টার কী EG.5 এর বিরুদ্ধে কাজ করবে?

বর্তমান সার্স-কোভি-২ বুস্টার ভ্যাকসিনগুলো EG- এবং অন্যান্য XBB-সাবভেরিয়েন্টের সংক্রমণ থেকে পর্যাপ্ত সুরক্ষা প্রদান করতে পারে না, ফলে প্রয়োজন XBB- ও EG-নির্দিষ্ট ভ্যাকসিনের। তাই, যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য আধিকারিকরা EG.5-স্ট্রেনটি আবির্ভুত হওয়ার পূর্বেই XBB-সাবভেরিয়েন্টগুলোর স্পাইক প্রোটিনের উপর ভিত্তি করে করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজ তৈরি করার একটি নতুন পরিকল্পনা হাতে  নিয়েছেন। এ বিষয়ে ফাইজার ওষুধ কোম্পানি এগিয়ে রয়েছে। আশা করা যায়, আসন্ন অক্টবরের মধ্যেই নতুন বুস্টারটি যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (FDA)কর্তৃক অনুমোদন পাবে। দুৰ্ভাগ্যবশত, EG.5 ও EG.5.1 নব্যসংস্করণ-দুটি সে প্রকল্পের আওতায় পড়েনি। তবে, আশা করা যায় যে, XBB-নির্দিষ্ট নতুন বুস্টারটি EG.5-এ সংক্রমিত ব্যক্তিদের পক্ষেও কাজ করবে। কারণ, তাদের উপপ্রকরণগুলোর মধ্যে স্পাইক প্রোটিনের বৈশিষ্টে খুব একটা বিস্তর পার্থক্য নেই, EG-প্রকরণের দুটি নব্য মিউটেশন ছাড়া।     

উপসংহার: কোভিড-১৯ এখনও কি একটি বড় হুমকি

যদিও করোনাভাইরাস বা কোভিড দৈনিক পত্র-পত্রিকায় এখন আর প্রথম পাতার খবর হয় না, কিন্তু এটি সত্য যে আমরা এখনও এই ভাইরাসটির সাথেই বাস করে চলেছি। ল্যাবেই তৈরি হোক বা বাদুড়জাতীয় প্রাণী থেকে এসে থাকুক (রা.হক: দৈনিক আমাদেরসময় জুলাই ২, ২০২১), করোনাভাইরাস সারা বিশ্বে এক ভীতি সঞ্চার করেছিল, প্রাণ কেড়েও নিয়ে গেছে সত্তর লাখ মানুষের, এখনও মারা যাচ্ছে বহুসহস্রে। ২০২০-২০২১ সালের করোনাকালীন অবস্থায় মানুষ আর ফিরে যেতে চায় না। দুৰ্ভাগ্যবশতঃ করোনাভাইরাস নতুন রূপে আবারো ফিরে এসেছে মানবসমাজে। EG.5, বা “এরিস” এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে প্রচলিত বৈকল্পিক, যা সংক্রমণের মাত্রায় XBB.1.16 (যাকে বলা হয় “আর্কটুরাস”, উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলির মধ্যে একটি)কেও ছাড়িয়ে গেছে এবং এটি বিশ্বব্যাপী দ্রুত সংক্রমণশীল বংশের মধ্যে একটি। বাংলাদেশেও XBB ভ্যারিয়েন্টসহ ওমিক্রনের অন্যান্য প্রকরণগুলো শনাক্ত হয়েছে ২০২২ সালে (Jubair M et al., Health Sci Rep. 2023, 6-3: e1134)। EG.5 ভারতে শনাক্ত হলেও বাংলাদেশে শনাক্ত হয়েছে কিনা তার তথ্য আমার জানা নেই। তবে, বাংলাদেশে ২০২৩ সালে (১১ আগস্ট পর্যন্ত) করোনাভাইরাসে নতুনভাবে সংক্রমিত হয়েছে প্রায় ৭ হাজার মানুষ। ধারণা করা যায়, এসব সংক্রমণের পেছনে XBB- ও EG.5-প্রকরণগুলোই অধিকাংশক্ষেত্রে দায়ী। সাধারণভাবে, করোনভাইরাস বিশ্বজুড়ে বিস্তার লাভ করছে দ্রুত, তাই এখনও এই ভাইরাসটি হুমকি হিসেবেই রয়ে গেছে। এই মুহূর্তে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) পরামর্শ দিয়েছে যে, নতুন ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির জন্য যেন সব দেশ প্রস্তুত থাকে; তাদের প্রতিষ্ঠিত কোভিড-১৯ অবকাঠামো যেন বজায় রাখে। তাই, রোগপরীক্ষা, নজরদারি ও রিপোর্টিং, বৈকল্পিক ট্র্যাকিং এবং প্রারম্ভিক স্বাস্থ্যসেবা বিধান বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।