অ্যান্টিকোলেস্টেরল ওষুধের ঢালাও ব্যবহার বিপজ্জনক হতে পারে
- প্রকাশ: ১১:৪৪:১৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৬ নভেম্বর ২০২২
- / ৮৩৫ বার পড়া হয়েছে
কোলেস্টেরল সম্পর্কে ভুল ধারণা শীর্ষক আমার একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল কিছু দিন আগে; এ ধারাবাহিকতায় আমি আজ অ্যান্টিকোলেস্টেরল ওষুধের ঢালাও ব্যবহার কেন বিপজ্জনক হতে পারে, তার ওপর বিস্তারিত আলোকপাত করতে চাই। কারণ অনেক চিকিৎসকের মতো রোগীরাও মনে করে অ্যান্টিকোলেস্টেরল ওষুধ নিরাপদ এবং এসব ওষুধের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। একজন ওষুধ বিশেষজ্ঞ হিসাবে এ ভুল ধারণা দূর করা আমার দায়িত্ব বলে মনে করি।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ৪৫ বয়সোর্ধ্ব প্রতি চারজনের একজন স্ট্যাটিন গ্রুপের ওষুধ (অ্যাটরভ্যাস্ট্যাটিন, লোভাস্ট্যাটিন, রসুভ্যাস্ট্যাটিন, সিমভ্যাস্ট্যাটিন, ইমভ্যাস্ট্যাটিন, ফ্লুভ্যাস্ট্যাটিন, প্রেভ্যাস্ট্যাটিন) গ্রহণ করে। শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানোর জন্য বিশ্বব্যাপী ব্যাপকহারে স্ট্যাটিন গ্রুপের এ ওষুধগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। কোলেস্টেরল কমানোর ক্ষেত্রে স্ট্যাটিন ওষুধগুলো বেশ কার্যকর হলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রাকৃতিক উপায় অবলম্বন করেও সমপরিমাণ কোলেস্টেরল কমানো সম্ভব।
এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে পরিচালিত প্রায় ৯০০ গবেষণা ফলাফলে দেখা গেছে, কোলেস্টেরল কমানোর জন্য ব্যবহৃত স্ট্যাটিন গ্রুপের এসব ওষুধের মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। পেশি ধ্বংস, ডায়াবেটিস ও ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধি-এমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে অন্যতম। পরিচালিত গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, জন্মগতভাবে যাদের রক্তে মাত্রাতিরিক্ত কোলেস্টেরল থাকে, তাদের জন্য স্ট্যাটিন গ্রুপের ওষুধগুলো প্রযোজ্য হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যান সব দেশে সমভাবে প্রযোজ্য না হলেও বিশ্বের লাখো কোটি মানুষ অ্যান্টিকোলেস্টেরল ওষুধ গ্রহণ করে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ভবিষ্যতেও হয়তো আরও অনেক বেশি মানুষ এসব ওষুধ গ্রহণ করবে। ব্যবহার ও বিক্রয়ের দিক থেকে বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় ওষুধগুলোর মধ্যে প্রথম স্থানটি দখল করে রয়েছে স্ট্যাটিন গ্রুপের ওষুধ।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় অ্যাটরভ্যাস্ট্যাটিন। ফাইজারের অ্যাটরভ্যাস্ট্যাটিনের ব্র্যান্ড নাম লিপিটর। ২০০৭ সালে সারা বিশ্বে লিপিটরের মোট বিক্রির পরিমাণ ছিল ১২ বিলিয়ন ডলার। স্ট্যাটিন গ্রুপের ওষুধগুলো শরীরে কীভাবে কাজ করে, তা জানা গেলে আমরা এ জাতীয় ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজনিত নানা জটিল সমস্যা থেকে অনেকাংশে মুক্তিলাভ করতে পারি।
গত লেখায় আমি লিখেছিলাম, শরীরে কোলেস্টেরলের উৎস মূলত দুটি। কোলেস্টেরলসমৃদ্ধ খাবার (ডিম, দুধ, খাসি, গরু, শূকর, মগজ, লিভার) থেকে আমরা কোলেস্টেরল পেয়ে থাকি। কিন্তু শরীরে বেশির ভাগ অর্থাৎ প্রায় ৮৫ শতাংশ কোলেস্টেরল তৈরি হয় লিভার বা যকৃতে সংশ্লেষণের মাধ্যমে।
এ সংশ্লেষণের জন্য আবশ্যক যৌগটির নাম অ্যাসিটাইল কো-এ বা অ্যাসিটাইল কো-এনজাইম-এ। অ্যাসিটাইল কো-এর উৎস হলো মূলত কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা (গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ, সুক্রোজ বা চিনি, স্টার্চ বা ভাত, গম, আটা, ময়দা), প্রোটিন বা আমিষ ও ফ্যাট বা চর্বি। যারা মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে শর্করা জাতীয় খাবার খান, তাদের কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি হবে। তবে কৃত্রিমভাবে তৈরি কোলেস্টেরল ভীতি আমাদের অতিমাত্রায় নৈর্বাচিক (selective) করে তুলেছে। সপ্তাহে একটি বা দুটি ডিম, মাঝে মধ্যে দু-এক টুকরো খাসি বা গরুর গোশত খেলে কোলেস্টেরলের মাত্রা খুব একটা বাড়ে না। আমরা অনর্থক ভয়ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে অন্যায়ভাবে কোলেস্টেরলসমৃদ্ধ খাবার থেকে মানুষকে সম্পূর্ণ বিরত রাখছি।
স্ট্রোক বা হৃদ্রোগীদের মধ্যে অনেককেই আমি জানি, যারা বছরের পর বছর ধরে ডিমের সাদা অংশ খেয়ে যাচ্ছেন, কুসুম অংশ স্পর্শও করেন না। সপ্তাহে হয়তো দুয়েকবার ডিমের কুসুম খান। অনেকেই আবার বহু বছর ধরে খাসি বা গরুর গোশত কেনাই বন্ধ করে দিয়েছেন, খাওয়া তো দূরের কথা।
এ মানসিকতা অবশ্যই ঠিক নয়। বাড়াবাড়ি না করে মাঝে মধ্যে দুয়েক টুকরা গরু বা খাসির গোশত খেলে শরীরের তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। তবে রেড মিট বা গরু বা খাসির গোশত খেলে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে বলে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে।
ফিরে যাই আবার লিভারে কোলেস্টেরল তৈরির প্রক্রিয়ায়। একাধিক অ্যাসিটাইল কো-এ একে অপরের সঙ্গে বিক্রিয়া করে কোলেস্টেরল সংশ্লেষণের সূত্রপাত করে। তারপর ক্রমধারায় অসংখ্য বিক্রিয়ার মাধ্যমে কোলেস্টেরল উৎপন্ন হয়। কোলেস্টেরল সংশ্লেষণের একটি ধাপে হাইড্রোক্সিমিথাইল গ্লুটারাইল কো-এ রিডাক্টেজ নামের একটি এনজাইম হাইড্রোক্সিমিথাইল গ্লুটারাইল কো-একে মেভালনিক অ্যাসিডে রূপান্তরিত করে। মেভালনিক অ্যাসিড থেকে অসংখ্য ধাপ পেরিয়ে আমাদের পৌঁছাতে হয় কোলস্টেরলে।
স্ট্যান্টিন গ্রুপের ওষুধগুলো হাইড্রোক্সিমিথাইল গ্লুটারাইল কো-এ রিডাক্টেজ এনজাইমকে প্রতিহত করে মেভালনিক অ্যাসিডে রূপান্তর বন্ধ করে দেয়। ফলে বিক্রিয়া আর এগোতে না পারার কারণে কোলেস্টেরল সংশ্লেষণ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে রক্ত কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে যায়। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি কমে গেলে সমস্যা আছে। শরীরে অসংখ্য অত্যাবশ্যকীয় যৌগ রয়েছে, যেগুলো কোলেস্টেরল থেকে লিভারে তৈরি হয়। এসব অত্যাবশ্যকীয় যৌগের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন-ডি, শরীরের সেক্স হরমোন (টেস্টোস্টেরন, প্রোজেস্টেরন ইসট্রোজেন ইত্যাদি), কর্টিসন, কর্টিসলের মতো প্রয়োজনীয় স্টেরয়েড, ডলিকলস, কোলিক অ্যাসিড, যা আমাদের অন্ত্রে খাবার পরিপাকে সাহায্য করে। শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা অনিয়মতান্ত্রিকভাবে কমে গেলে উল্লিখিত যৌগগুলোর উৎপাদন হ্রাস পায় বা বন্ধ হয়ে যায়। এতে শরীর ঠিকমতো কাজ করতে পারে না।
আগের লেখায় আমি বলেছিলাম, প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত কোলেস্টেরল স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়। ১২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা তার চেয়েও বেশি তাপমাত্রায় ১ ঘণ্টা উত্তপ্ত বা পোড়ানো হলে কোলেস্টেরল অক্সিডেশনের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক যৌগে রূপান্তরিত হয়। ২০০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করা হলে কোলেস্টেরলের গাঠনিক সংকেত পুরো ভেঙে যায়। কেউ যদি প্রতিনিয়ত ক্ষতিকর কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ খাবার খায়, তবে এসব ক্ষতিকর উপাদান রক্তের ঘনত্ব বাড়িয়ে দেবে এবং শিরা-উপশিরার অভ্যন্তরীণ দেওয়ালে জমতে শুরু করবে, যা পরবর্তী পর্যায়ে হৃদরোগ বা স্ট্রোকের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
কোলেস্টেরল আমাদের শরীরের জন্য একটি আবশ্যকীয় রাসায়নিক যৌগ। আমাদের শরীরের কয়েকশ কোটি সেল বা কোষের প্রাচীর তৈরির জন্য কোলেস্টেরল প্রয়োজন হয়। কোলেস্টেরলের অভাবে কোষপ্রাচীর ঠিকভাবে তৈরি হতে পারে না। অথচ ভালো-মন্দ বিচার না করেই এ অত্যাবশ্যকীয় উপাদানটি কমানোর জন্য আমরা মানুষকে ঢালাওভাবে ওষুধ দিচ্ছি। স্ট্যাটিন গ্রুপের ওষুধের কারণে সৃষ্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যায় যাওয়ার আগে অন্যসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে একটু আলোচনা করি। কোচরান লাইব্রেরি কর্তৃক প্রকাশিত এক সমীক্ষায় বলা হয়, ৩৪ হাজার রোগীর মধ্যে স্ট্যাটিনের ১৪টি ট্রায়ালের ফলাফলে হতাশা, মেজাজ পরিবর্তন, লিভারের ক্ষতিসাধন বা কর্মক্ষমতা হ্রাস, কিডনি বিকল, চোখে ছানি পড়া, পেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া অন্যতম বলে প্রমাণিত হয়েছে। স্ট্যাটিন গ্রুপের ওষুধের কারণে ডায়াবেটিস ও ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধির কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এবার মূল সমস্যাটির কথা বলি। হাজার হাজার মানুষের মধ্যে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা স্ট্যাটিন গ্রুপের ওষুধ গ্রহণ করেন, তাদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যৌনক্ষমতা বা যৌনবাসনা হ্রাস পায় বা বিলুপ্ত হয়। ওষুধের ডোজ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্যাও তত বাড়ে। বেশি মাত্রায় অর্থাৎ ২০ থেকে ৪০ মিলিগ্রামের স্ট্যাটিন নিলে যৌন অক্ষমতা দেখা দেয়। বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষ এ ধরনের সমস্যার কথা চিকিৎসকের কাছে প্রতিনিয়তই উপস্থাপন করেন। স্ট্যাটিন গ্রুপের ওষুধের সঙ্গে যৌনবাসনা হ্রাস বা বিলুপ্ত হওয়ার কী সম্পর্ক, তা নিয়ে একটু আলোচনা করা দরকার।
এলডিএলকে আমরা ঢালাওভাবে আখ্যায়িত করি বিষ বা সবচেয়ে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল হিসাবে। কিন্তু এলডিএলের উপকারিতার কথা আমরা খুব কমই জানি। শিরা-উপশিরার অভ্যন্তর দেওয়ালে যদি প্রদাহ বা ক্ষত সৃষ্টি হয়, তখন শুধু এনডিএল দেওয়ালগাত্রে জমে যেতে পারে এবং অ্যাথেরোসক্লেরোসিস সৃষ্টি করতে পারে। শিরা-উপশিরার দেওয়াল স্বাভাবিক থাকলে এলডিএলের কারণে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়; বরং এলডিএল কোষ দেওয়াল তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এলডিএলের মুখ্য ভূমিকা হলো টেস্টোস্টেরন প্রস্তুত। টেস্টোস্টেরন হলো একটি গুরুত্বর্পূণ সেক্স হরমোন, যার অভাবে যৌনবাসনা হ্রাস পায় বা বিলুপ্ত হয়। টেস্টিকল বা অণ্ডকোষের লেইডিগ কোষ এলডিএল কোলেস্টেরল থেকে টেস্টোস্টেরন তৈরি করে। এ ধরনের কোষগুলো রক্তপ্রবাহ থেকে এলডিএল কোলেস্টেরল সংগ্রহ করে টেস্টোস্টেরন উৎপাদনে বেশ পারদর্শী। অনেক ক্ষেত্রে কোষ অভ্যন্তরে পুঞ্জীভূত এলডিএল কোলেস্টেরল থেকেও তারা টেস্টোস্টেরন উৎপাদন করতে পারে। এ অবস্থায় কেউ স্ট্যাটিন গ্রুপের ওষুধ গ্রহণ করলে রক্তপ্রবাহে এলডিএলের মাত্রা কমে যায়। ফলে লেইডিগ কোষ রক্তপ্রবাহ থেকে পর্যাপ্ত এলডিএল সংগ্রহ করতে পারে না। লেইডিগ কোষ ঠিক লিভারের মতো একই এনজাইম ব্যবহার করে কোলেস্টেরল উৎপন্ন করে। লেইডিগ কোষ পর্যাপ্ত পরিমাণ স্ট্যাটিন গ্রুপের ওষুধ শোষণ করে নিতে সক্ষম বলে এনজাইম প্রতিহত হওয়ার কারণে এলডিএল কোলেস্টেরল থেকে টেস্টোস্টেরন উৎপাদন যথেষ্ট মাত্রায় বাধাগ্রস্ত হয়। স্ট্যাটিন গ্রুপের ওষুধ সিমভ্যাস্ট্যাটিন কোলেস্টেরল উৎপাদনে বাড়তি সমস্যা সৃষ্টি করে। এ ওষুধ অণ্ডকোষে এলডিএল কোলেস্টেরল বিশোষণ শুধু বাধাগ্রস্তই করে না; উলটো টেস্টোস্টেরন ও অ্যানড্রোস্টেনডাইওল প্রস্তুতে দুটি মধ্যবর্তী যৌগের উৎপাদনও প্রতিহত করে। ডিহাইড্রো এপিয়েন্ড্রোস্টেরন, ডিহাইড্রো-অ্যান্ড্রোস্টেরনডাইওন বা টেস্টোস্টেরন শুধু পুরুষের যৌনবাসনার জন্য প্রয়োজন, তা নয়; সিমভ্যাস্ট্যাটিন গ্রহণ করার কারণে মহিলারাও লস অব লিবিডো বা যৌন অক্ষমতায় ভোগেন।
এতক্ষণ শুধু বিদেশের কথা বললাম। এবার বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দুয়েকটি কথা বলি। কোলেস্টেরল কমানোর জন্য স্ট্যাটিন গ্রুপের ওষুধ প্রেসক্রাইব করার ক্ষেত্রে অনিয়ম ও যুক্তিহীনতা প্রায়ই পরিলক্ষিত হয় বাংলাদেশে। লাখ লাখ রোগী ও সুস্থ মানুষকে স্ট্যাটিন গ্রুপের ওষুধ প্রদান করা হয়। এদের মধ্যে হৃদ্রোগ, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ, হাইপার কোলেস্টেরলেমিয়ায় আক্রান্ত রোগী ছাড়াও সুস্থ ও স্বাভাবিক কোলেস্টরল মাত্রার মানুষও রয়েছে।
আমি এমন বহু লোককে জানি, স্বাভাবিক কোলেস্টরল মাত্রা থাকা সত্ত্বেও যাদের ২০ মি. গ্রামের অ্যাটরভ্যাস্ট্যাটিন প্রদান করা হয়েছে। এ ওষুধ গ্রহণ করার কয়েক দিনের মধ্যেই তারা পূর্বোল্লিখিত যৌন সমস্যায় আক্রান্ত হন। তারা বুঝে উঠতে পারছিলেন না কী কারণে এমন হলো এবং তাদের কী করা উচিত। এ ধরনের সমস্যার কথা আমাকে অনেকেই জানিয়েছেন এবং আমি তাদের ওষুধটি বন্ধ করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেছিলাম, তারা যেন প্রাকৃতিক উপায়ে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করেন। মাঝেমধ্যে তাদের লিপিড প্রোপাইল মেপে দেখতেও বলেছিলাম। কয়েকদিন পরে কয়েকজন ভদ্রলোক আমাকে জানালেন, তাদের সমস্যাটি এখন আর নেই। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এ রকম অসংখ্য ঘটনার সঙ্গে আমি পরিচিত। একজন ফার্মাসিস্ট হওয়ার সুবাদে পরামর্শ দেওয়ার যোগ্যতা ও এখতিয়ার আমার আছে বলে বহু রোগী ও মানুষের কাছ থেকে আমি নানাবিধ সমস্যার কথা প্রায়ই অবগত হই এবং সমাধান দিতে চেষ্টা করি। আমাদের দেশে বহু প্রগতিবাদী চিকিৎসক রয়েছেন। এসব চিকিৎসক বিবেক, বুদ্ধি ও যুক্তি প্রয়োগ করে অল্প ওষুধে বহু রোগী সারিয়ে তোলেন। তাদের আমি শ্রদ্ধা করি। তারা অপ্রয়োজনে রোগীকে ওষুধ প্রদান করেন না। রোগ এবং রোগীকে এক্সপ্লয়েট করে যারা ব্যবসা করেন; আমি মনে করি, তারা অপরাধ করছেন।
অন্যদিকে বহু চিকিৎসককে আমি জানি, যারা পেশাগত দিক থেকে সৎ নন। তারা সুস্থ মানুষকে অসুস্থ করে তোলেন এবং রোগী বানিয়ে ছাড়েন। ওষুধ কোম্পানির স্বার্থ রক্ষার্থে এসব চিকিৎসক রোগীকে অহেতুক গাদাগাদা ওষুধ প্রদান করেন। এভাবে স্ট্যাটিন গ্রুপের ওষুধগুলোও মারাত্মকভাবে অপব্যবহার হচ্ছে, যার খেসারত দিচ্ছে নিরীহ রোগী ও মানুষ। মাত্রাতিরিক্ত কোলেস্টেরলের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমরা কিছু কার্যকর পন্থা অবলম্বন করতে পারি। খাদ্যতালিকা হতে হবে পরিমিত ও সুষম। চর্বিজাতীয় খাবার কম খেতে হবে। শর্করাজাতীয় খাবারের আধিক্য পরিত্যাগ করতে হবে। ভাত ও রুটি একদম কম খাবেন। চিনি, ফ্রুকটোজ কর্ন সিরাপসমৃদ্ধ কোমল পানীয় বর্জন করতে হবে। ফাইবার বা আঁশজাতীয় শাক, সবজি, ফলমূল, খোসাযুক্ত আটা খাবারের মূল অংশ হতে হবে। স্বাস্থ্যের উপযোগী চর্বির জন্য অ্যাভাকাডো, অলিভ, নারকেল, অর্গানিক ডিম, মিঠা পানির মাছ খেতে হবে। তেল বা ডালডায় পোড়া খাবার, আগুনে ঝলসানো ও উচ্চ তাপে রান্না প্রাণিজ খাবার একেবারেই কম খেতে হবে। আর রইল ব্যায়াম। সুস্থ-সুন্দর জীবনের জন্য ব্যায়ামের কোনো বিকল্প নেই। এসব নিয়ম মেনে চললে প্রাকৃতিক উপায়ে আপনার কোলেস্টেরলের মাত্রা স্বাভাবিক থাকবে। তখন আর আপনাকে অনর্থক ওষুধ থেকে হবে না। আর মনে রাখবেন, যেমনটা আমি বলে থাকি-আপনি সুস্থ থাকলে আপনার কোলেস্টেরল ভীতিও থাকবে না। কোলেস্টেরল ভীতি আমাদের সর্বক্ষণ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আর তাই হয়তো আমরা এত বেশি ওষুধনির্ভর হয়ে পড়েছি। মনে রাখবেন, ওষুধ খেলে ‘ওষুধের অসুখ’ সারানোর জন্য আবার আপনাকে ওষুধ খেতে হবে। আর কত ওষুধ খাবেন?