সোমবার, জুন ৫, ২০২৩

রাজা তৃতীয় চার্লস: যুক্তরাজ্যের রাজার কাজ কী, অভিষেক অনুষ্ঠান কেমন হয়, রাজপরিবারে কারা আছেন

নতুন রাজা তৃতীয় চার্লস কমনওয়েলথের প্রধান। এটি ৫৬টি স্বাধীন দেশের ২৪০ কোটি মানুষের একটি সংস্থা। এর মধ্যে ১৪টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানও তিনি। নতুন রাজকীয় ডাকটিকেট ও ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের নোটে মায়ের ছবির জায়গায় এখন রাজা তৃতীয় চার্লসের ছবি প্রতিস্থাপিত হবে। ব্রিটিশ পাসপোর্টের ভিতরে 'হার ম্যাজেস্টি' শব্দের পরিবর্তন করে 'হিজ ম্যাজেস্টি' লেখা হবে।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ৯৬ বছর বয়সে মৃত্যুর পর রাজসিংহাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন তার বড়ো ছেলে রাজা তৃতীয় চার্লস। যুক্তরাজ্যের জাতীয় সঙ্গীতের একটি লাইন বদলে যাবে যেখানে ‘ঈশ্বর রানিকে রক্ষা করুন’-এর বদলে গাওয়া হবে ‘ঈশ্বর রাজাকে রক্ষা করুন’। এ বছরের শুরুতে রানি প্লাটিনাম জুবিলি অর্থাৎ রাজ্যশাসনের সত্তর বছর উদযাপন করেছিলেন। ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ইতিহাসে তিনিই সবচেয়ে লম্বা সময় এ দায়িত্ব পালন করেছেন। এই পুরো নিবন্ধটি বিবিসি কর্তৃক প্রস্তুতকৃত।

এখন কী হবে

রানির মৃত্যুর সাথে সাথে রাজসিংহাসনে আসীন হয়েছেন সাবেক প্রিন্স অব ওয়েলস চার্লস, যিনি এখন থেকে রাজা তৃতীয় চার্লস নামে পরিচিত হচ্ছেন। শনিবার সেন্ট জেমসেস প্রাসাদে অ্যাকসেশন কাউন্সিল নামে একটি পরিষদের সামনে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

যুক্তরাজ্যের রাজা কী করেন

রাজা যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রপ্রধান। তবে তার ক্ষমতা অনেকটাই প্রতীকী ও আনুষ্ঠানিক এবং তিনি রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করেন। একটি লাল চামড়ার বাক্সে করে তিনি প্রতিদিন সরকারি বার্তা পাবেন। যেমন আসন্ন কোন গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক নিয়ে ব্রিফিং বা তার সাক্ষর দরকার এমন কোন দলিল। প্রধানমন্ত্রী সরকারি বিষয়ে রাজাকে অবহিত করতে সাধারণত বুধবার বাকিংহাম প্যালেসে গিয়ে রাজার সাথে সাক্ষাৎ করেন। এসব বৈঠক একেবারেই গোপনীয় এবং এগুলোতে কে কী বলেন তার কোনো রেকর্ড থাকে না।

এছাড়া সংসদীয় বিষয়েও রাজার কিছু কার্যক্রম আছে—

সরকার নিয়োগ

সংসদ নির্বাচনে জয়ী দলের নেতা সাধারণত বাকিংহাম প্যালেসে রাজার সাথে দেখা করেন, যেখানে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানানো হয়। আবার সংসদ নির্বাচনের আগে রাজাই আনুষ্ঠানিকভাবে একটি সরকার ভেঙ্গে দেন।

স্টেট ওপেনিং এবং রাজার ভাষণ

স্টেট ওপেনিং হলো যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের বার্ষিক সূচনা অধিবেশন। রাজা এই সংসদীয় বর্ষের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। হাউজ অব লর্ডসে ভাষণে রাজা সরকারের পরিকল্পনাগুলো তুলে ধরেন।

রাজকীয় সম্মতি

যখন পার্লামেন্টে কোন বিল পাশ হয় সেটাকে আইনে পরিণত করার জন্য রাজার অনুমোদন বা সম্মতির দরকার হয়। সবশেষ এই সম্মতি না দেয়ার ঘটনা ঘটেছিল ১৭০৮ সালে। এর বাইরেও রাজা সফররত রাষ্ট্রপ্রধানদের আতিথ্য দেন এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিদেশি রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের সাক্ষাৎ দেন।

তিনি সাধারণত নভেম্বর মাসে বার্ষিক স্মরণ অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ বিভিন্ন যুদ্ধ বা সংঘাতে দেশটির নিহতদের স্মরণে এই অনুষ্ঠান হয়।

নতুন রাজা কমনওয়েলথের প্রধান। এটি ৫৬টি স্বাধীন দেশের ২৪০ কোটি মানুষের একটি সংস্থা। এর মধ্যে ১৪টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানও তিনি।

নতুন রাজকীয় ডাকটিকেট ও ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের নোটে মায়ের ছবির জায়গায় এখন রাজা তৃতীয় চার্লসের ছবি প্রতিস্থাপিত হবে। ব্রিটিশ পাসপোর্টের ভিতরে ‘হার ম্যাজেস্টি’ শব্দের পরিবর্তন করে ‘হিজ ম্যাজেস্টি’ লেখা হবে।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ

উত্তরাধিকার কীভাবে কাজ করে

উত্তরাধিকারের ক্রমই ঠিক করে দেয় রাজা বা রানির মৃত্যু বা পদত্যাগের পর রাজপরিবারের কোন সদস্য রাজা হিসেবে দায়িত্ব নেবেন। রানি এলিজাবেথের প্রথম সন্তান চার্লস যেমন তার মায়ের মৃত্যুর পর রাজা হলেন আর তার স্ত্রী ক্যামিলা হলেন কুইন কনসর্ট।

রাজপরিবারের উত্তরাধিকারের নিয়ম ২০১৩ সালে সংশোধন করা হয়েছিলো এটা নিশ্চিত করতে যে, ছেলেরা তাদের বড়ো বোনকে টপকিয়ে কর্তৃত্ব পাবে না। রাজা চার্লসের উত্তরাধিকার তার বড়ো সন্তান প্রিন্স উইলিয়াম। যিনি তার বাবার ডিউক অব কর্ণওয়াল পদবী পেয়েছেন। কিন্তু তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই প্রিন্স অব ওয়েলস হবেন না। এটি রাজা যদি তাকে অর্পণ করেন তাহলেই তিনি পাবেন।

প্রিন্স উইলিয়ামের বড়ো সন্তান প্রিন্স জর্জ রাজসিংহাসনের দ্বিতীয় উত্তরাধিকার আর তার কন্যা প্রিন্সেস শার্লট তৃতীয়।

যুক্তরাজ্যের রাজার অভিষেকে কী কী করা হয়?

অভিষেক হলো এমন একটা অনুষ্ঠান যেখানে রাজাকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজমুকুট পরানো হয়। এটা সাধারণত শোকের সময়টা কিছুটা কাটিয়ে ওঠার পর হয়।

বাবা রাজা জর্জ ষষ্ঠ এর মৃত্যুর পর দ্বিতীয় এলিজাবেথ রানি হয়েছিলেন ৬ই ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে। আর তাকে মুকুট পরানো হয়েছিলো ২রা জুন ১৯৫৩ সালে। 

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অভিষেক অনুষ্ঠান প্রথম টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়েছিলো এবং দুই কোটিরও বেশি মানুষ সেটি দেখেছিলো।

গত নয়শত বছর ধরে অভিষেক অনুষ্ঠান হচ্ছে ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাবেতে। উইলিয়াম দ্য কনকোয়ারার ছিলেন প্রথম রাজা, যাকে এখানেই মুকুট পরানো হয়েছিলো এবং চার্লস হবেন ৪০তম। এটি অ্যাংলিকান ধর্মীয় অনুষ্ঠান, যা পরিচালনা করেন আর্চবিশপ অব ক্যান্টারবারি।

‘পবিত্র তেল’ ছিটিয়ে রাজার অভিষেক করানো হয়। তারপরই তার কাছে রাজকীয় প্রতীক স্বর্ণের রাজদণ্ড এবং রাজকীয় গোলক হস্তান্তর করা হয়। আনুষ্ঠানিকতার চূড়ান্ত পর্বে আর্চবিশপ চার্লসের মাথায় সেন্ট এডওয়ার্ড মুকুট স্থাপন করবেন। এটি খাঁটি স্বর্ণের তৈরি, যা ১৬৬১ সাল থেকে ব্যবহার করা হচ্ছে। টাওয়ার অফ লন্ডনে যেসব মণিমাণিক্য রাখা আছে, এটি তার মধ্যমণি। একমাত্র রাজা বা রানির অভিষেকের সময় এটি তারা পরেন।

রাজকীয় বিয়ে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান না হলেও অভিষেক একটি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান। সরকার এই অনুষ্ঠানের খরচ সরকার বহন করে এবং সরকারই এর অতিথি তালিকা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দেয়।

Royal Coat of Arms of the United Kingdom

রাজপরিবারে আর কারা আছেন?

  • দ্য ডিউক অব কর্নওয়াল অ্যান্ড ক্যামব্রিজ (প্রিন্স উইলিয়াম) রাজা চার্লস এবং তার প্রথম স্ত্রী ডায়ানা, প্রিন্সেস অব ওয়েলস- এর প্রথম সন্তান । তার স্ত্রী দ্য ডাচেস অব কর্নওয়াল অ্যান্ড ক্যামব্রিজ (ক্যাথরিন)। তাদের তিন সন্তান – প্রিন্স জর্জ, প্রিন্সেস শারলট ও প্রিন্স লুই।
  • দ্য প্রিন্সেস রয়্যাল (প্রিন্সেস অ্যান) ছিলেন রানির দ্বিতীয় সন্তান এবং একমাত্র কন্যা। তিনি বিয়ে করেছেন ভাইস অ্যাডমিরাল টিমোথি লরেন্সকে। তার প্রথম স্বামী ক্যাপ্টেন মার্ক ফিলিপসের সাথে দুইজন সন্তান আছে – পিটার ফিলিপস অ্যান্ড জারা টিনডাল।
  • দ্য আর্ল অব ওয়েসেক্স (প্রিন্স এডওয়ার্ড) রানির কনিষ্ঠ সন্তান। তিনি বিয়ে করেছেন কাউন্টেস অব ওয়েসেক্সকে (সোফি রাইস-জোনস)। তাদের দুইজন সন্তান – লুই ও জেমস মাউন্টব্যাটেন উইন্ডসর।
  • দ্য ডিউক অব ইয়র্ক (প্রিন্স এন্ড্রু) রানির দ্বিতীয় সন্তান। তার ও সাবেক স্ত্রী দ্য ডাচেস অব ইয়র্ক-এর (সারাহ ফার্গুসন) দুই কন্যা – প্রিন্সেস বিয়েট্রিস এবং প্রিন্সেস ইউজেনি। প্রিন্স এন্ড্রু ২০১৯ সালে রাজকীয় কাজ থেকে সরে দাঁড়ান ভার্জিনিয়া জিফরেকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ নিয়ে একটি বিতর্কিত সাক্ষাৎকারের পর। দুই হাজার বাইশ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মিস জিফরে মামলা করার পর তিনি এটি নিষ্পত্তির জন্য অর্থ দিয়েছিলেন। তবে কত দিয়েছিলেন সেটি প্রকাশ করা হয়নি।
  • দ্য ডিউক অব সাসেক্স (প্রিন্স হ্যারি) উইলিয়ামের ছোটো ভাই। তিনি বিয়ে করেছেন ডাচেস অব সাসেক্সকে (মেগান মার্কেল)। তাদের দুই সন্তান – আর্চি ও লিলিবেট। দুই হাজার কুড়ি সালে তারা রাজকীয় দায়িত্ব ত্যাগ করে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান।

রাজপরিবারের সদস্যরা কোথায় বাস করেন

যুক্তরাজ্যের রাজা তার স্ত্রীকে নিয়ে বাকিংহাম প্রাসাদে  থাকেন। বর্তমান রাজা তৃতীয় চার্লস তার স্ত্রীকে রাজা হবার আগে আগে লন্ডনে ক্লিয়ারেন্স হাউসে এবং গ্লুষ্টারশায়ারের হাইগ্রোভে বাস করতেন।

প্রিন্স উইলিয়াম ও ক্যাথরিন, ডাচেস অব কর্নওয়াল অ্যান্ড ক্যামব্রিজ সম্প্রতি পশ্চিম লন্ডনের কেনসিংটন প্রাসাদ থেকে রানির উইন্ডসর এস্টেটে অ্যাডেলেইড কটেজে উঠেছেন।

প্রিন্স জর্জ, প্রিন্সেস শার্লট ও প্রিন্স লুইস ল্যামব্রুক স্কুলে যাচ্ছে যা বার্কশায়ারের আস্কটের কাছে। প্রিন্স হ্যারি ও মেগান মার্কেল আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় বাস করছেন।

যুক্তরাজ্যে রাজতন্ত্র কতটা জনপ্রিয়?

প্লাটিনাম জুবিলির সময়ে ইয়ুগভ পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় ৬২ ভাগ মানুষ রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখার পক্ষপাতী। আর ২২ শতাংশ মনে করে এর পরিবর্তে রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া উচিত নির্বাচিত।

দ্বিতীয় ইপসস মোরি জরিপ ২০২১ সালে প্রায় একই ফল দেখিয়েছিল, যেখানে প্রতি পাঁচ জনে একজন বিশ্বাস করেন রাজতন্ত্রের অবসান যুক্তরাজ্যের জন্য ভালো হবে। তবে ইয়ুগভ জরিপে দেখা যায় আগের দশকের চেয়ে রাজতন্ত্রের পক্ষে সমর্থন কমেছে। দুই হাজার বার সালে ছিলো ৭৫ ভাগ যেটা ২০২২ সালে ৬২ভাগ।

রাজতন্ত্রের সমর্থকদের বড়ো অংশ বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে। যদিও জরিপ ইঙ্গিত করছে যে তরুণদের জন্য এটি সত্যি নয়। ২০১১ সালে ইয়ুগভ যখন প্রথম ইস্যুটি নিয়ে কাজ শুরু করে তখন ১৮-২৪ বছর বয়সীদের ৫৯ শতাংশ রাজতন্ত্রের পক্ষে ছিলো। দুই হাজার বাইশ সালে সেটি ৩৩ শতাংশ।

For all latest articles, follow on Google News

বাংলাদেশি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে 'বিশ্লেষণ'-এর জন্য স্পনসরশিপ খোঁজা হচ্ছে। আগ্রহীদের যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হলো। ইমেইল: contact.bishleshon@gmail.com

এ বিষয়ের আরও নিবন্ধ
আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here