০৬:৩১ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

আফ্রিকার ওপর জো বাইডেনের চাপ ও ভ্লাদিমির পুতিনের প্রভাব

রায়হান আহমেদ তপাদার
  • প্রকাশ: ০৭:২৭:৪৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ অগাস্ট ২০২৩
  • / ৩৩০ বার পড়া হয়েছে

জো বাইডেন এবং ভ্লাদিমির পুতিন

ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ থামানোর লক্ষ্য নিয়ে সাতটি আফ্রিকান দেশের নেতা মিলে এক শান্তি মিশন শুরু করেছেন। প্রথমে ভলোদিমির জেলেনস্কি এবং পরে ভলাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করছেন তারা এবং এ মিশনের প্রথম পর্বে তারা একটি ট্রেনে করে পোল্যান্ড হয়ে গিয়েছিলেন কিয়েভে। প্রশ্ন এটাই, তারা এ উদ্যোগে কতটা সাফল্য পেতে পারেন? এই প্রতিনিধিদলে ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা, মিশর, সেনেগাল, কঙ্গো-ব্রাজাভিল, কমোরোস, জাম্বিয়া আর উগান্ডার নেতারা। এমন এক সময় এ সফর হচ্ছে, যখন ইউক্রেন সবেমাত্র তাদের বহুল আলোচিত পাল্টা অভিযান শুরু করেছে—যার লক্ষ্য পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনের যেসব ভূমি এতদিনের যুদ্ধে রুশ নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে, সেগুলো পুনরুদ্ধার করা। এমন এক সময়ে এই মিশনের পক্ষে কী অর্জন করা সম্ভব—সেটা একটা প্রশ্ন। তারা যখন ইউক্রেনে পৌঁছান, ঠিক তখনই দেশটির রাজধানী কিয়েভে বিমান হামলার সতর্ক সংকেত দিতে সাইরেন বেজে ওঠে এবং বেশ কিছু ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়।

ইউক্রেনের বিমান বাহিনী বলেছে, কৃষ্ণসাগর থেকে বেশ কয়েকটি রুশ কালিবর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়। শহরের পডিলস্কি এলাকায় বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। পরে কিয়েভের মেয়র ভিতালি ক্লিৎস্কো টেলিগ্রামে এক বার্তায় বলেন, তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করেছে এবং শহরের কোনো আবাসিক ভবনের ক্ষতি হয়নি। ইউক্রেনের বিমান বাহিনী বলেছে, তারা মোট ১২টি রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করেছে। ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রি কুলেবা বলেন এসব ক্ষেপণাস্ত্র ছিল ‘আফ্রিকার প্রতি রাশিয়ার বার্তা’ যে পুতিন ‘আরো যুদ্ধ চান, শান্তি নয়’। একজন কূটনীতিক ওলেক্সান্দর শেরবা এক টুইট বার্তায় বলেছেন, কিয়েভে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের মাধ্যমে আফ্রিকান নেতাদের স্বাগত জানাচ্ছেন পুতিন। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা গত মাসে যখন এই আফ্রিকান শান্তি মিশনের কথা ঘোষণা করেছিলেন, তখন তিনি কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব বা সময়সীমার কথা বলেননি। বরং দেখা যাচ্ছে এরকম সম্ভাব্য শান্তি-স্থাপনকারীদের ময়দানে এর মধ্যেই অনেক লোকের ভিড় জমে গেছে। চীন ও তুরস্কের নেতারা এবং পোপ ফ্রান্সিস- এ রকম অনেকেই আছেন সেখানে। দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক কূটনীতিক ও বিশ্লেষক কিংসলে মাখুবেলা প্রশ্ন তোলেন, আফ্রিকান নেতাদের এই উদ্যোগের কৌশলগত কেন্দ্রবিন্দুটা কী? এটা স্পষ্ট নয়।

এটা কি আফ্রিকান রাষ্ট্রপ্রধানদের একটা ফটো-অপ? আন্তর্জাতিক সংঘাতের ক্ষেত্রে সাধারণত আফ্রিকার নেতাদের এ রকম সক্রিয়তা দেখা যায় না। সেদিক থেকে এই উদ্যোগ একটা বিরল ঘটনা। কারণ ইউক্রেন সংকটকে সাধারণত দেখা হয় রাশিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যেকার একটা সংঘাত হিসেবে। গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) আফ্রিকাবিষয়ক পরিচালক মুরিথি মুথিগা বলছেন, আফ্রিকা মহাদেশের বাইরে ঘটনা নিয়ে এ কূটনৈতিক উদ্যোগকে তিনি স্বাগত জানান, কারণ আফ্রিকা অনেক দিন ধরেই জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে আরো জোরালো ভূমিকা পাবার জন্য দাবি জানিয়ে আসছে। এই উদ্যোগের ভিত্তি স্থাপন করেছেন ব্রাজাভিল ফাউন্ডেশন নামে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান জঁ-ইভেস অলিভিয়ের। তিনি অবশ্য খুব বেশি বড় কোনো লক্ষ্যের কথা বলছেন না। তার মতে লক্ষ্যটা হচ্ছে, একটা সংলাপ শুরু করা, তা ছাড়া রুশ ও ইউক্রেনীয় যুদ্ধবন্দি বিনিময়ের জন্য কাজ করা। বিবিসির বিশ্লেষক অ্যারন আকিনিয়েমি বলছেন, আফ্রিকান নেতাদের এই ইউক্রেন শান্তি মিশন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন আফ্রিকান দেশগুলোর অনেকে। সামাজিকমাধ্যমে অনেকে সংশয় প্রকাশ করছেন যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ওপর প্রভাব ফেলার মতো কোনো ক্ষমতা বা সুবিধা এই নেতাদের আছে কিনা। অন্য অনেকে বলছেন, এই সংকটের ক্ষেত্রে আফ্রিকার দেশগুলো যে অবস্থান নিয়েছে তা ‘অস্পষ্ট বা ধোঁয়াটে’ এবং তা এই মিশনের কোন অর্থপূর্ণ প্রভাব ফেলার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে না।

ইউক্রেনে সর্বাত্মক আগ্রাসন ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে ক্রমাগত একঘরে হয়ে পড়ায় রাশিয়া এখন আফ্রিকা মহাদেশে তাদের পুরোনো ও অনুগত মিত্রদের একখানে জড়ো করেছে। সেন্ট পিটার্সবার্গে রাশিয়া-আফ্রিকা ইকোনমিক ও হিউম্যানিটারিয়ান ফোরামে সেই দৃশ্যই দেখা গেল। এই সম্মেলনের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য। এই প্রতিপাদ্য অবশ্যই পূর্ব ইউরোপে রাশিয়া যে নিষ্ঠুর ও আগ্রাসী আচরণ করছে, পুরোপুরি তার বিপরীত। এ কারণেই আফ্রিকার নেতাদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন অনেক বিশেষজ্ঞরা। কারণ, তারা যেন অসাবধানতাবশত ইউক্রেন আগ্রাসনের ঘটনাটির অনুমোদন না দেন এবং কোনো ধরনের সমস্যাজনক বাণিজ্য চুক্তি না করেন। ২০১৯ সালে প্রথম যখন আফ্রিকা মহাদেশের ৪৭ জন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান সমুদ্রতীরবর্তী শহর সোচিতে প্রথম রাশিয়া-আফ্রিকা ইকোনমিক ও হিউম্যানিটারিয়ান ফোরামের সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলেন, সে সময় প্রতিবেশী দেশের ওপর পুরো মাত্রায় সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন শুরু করেনি রাশিয়া।

২০০৮ সালে রাশিয়া অবৈধভাবে জর্জিয়ার ওসেটিয়া ও আবখাজিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ২০১৪ সালে ইউক্রেনের কাছ থেকে বেআইনিভাবে ক্রিমিয়া দখল করে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে। এরপর রাশিয়াপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দেওয়ার জন্য পূর্ব ইউরোপে দোনেৎস্ক ও লুহানেস্কে গোপনে নিয়মিত বাহিনীর সেনা ও ভাড়াটে সেনা নিয়োগ দেয়। বিশ্বাসযোগ্য বৈশ্বিক শক্তি ও অংশীদার হওয়ার মতো কোনো কাজই রাশিয়া করেনি। তবে আফ্রিকার নেতারা সতর্ক থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা ভাবছেন না। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে তারা এমন একটি আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যেটা পাওয়ার যোগ্য তিনি নন। সোচিতে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী সম্মেলনে আফ্রিকার নেতাদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে পুতিন আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলোর স্বাধীনতাসংগ্রাম এবং সদ্য স্বাধীন দেশগুলোকে দেওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। রাশিয়ার সঙ্গে আফ্রিকার পুরোনো সম্পর্কের বিষয়েও জোর দিয়েছিলেন পুতিন। পুতিন ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন যে তার সামনে বসা ছদ্মগণতন্ত্রী ও স্বৈরশাসকরা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশের নেতার কাছ থেকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ব্যাপারে ভিন্ন ব্যাখ্যা শুনতে পছন্দ করবেন।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আফ্রিকায় রাশিয়ার প্রভাব সংকুচিত হয়ে যায়। চীনসহ অন্য শক্তিগুলো সেখানকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। প্রকৃতপক্ষে চীন এখন আফ্রিকার সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত চীন-আফ্রিকা সহযোগিতা ফোরামের বৈঠকে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং আফ্রিকা মহাদেশে ৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেন। চীনের অর্থায়নে সেতু, রেল, বন্দর, স্টেডিয়ামের মতো প্রকল্পে আফ্রিকা মহাদেশ ভরে উঠছে। পক্ষান্তরে, ২০১৯ সালে পুতিন আফ্রিকার জন্য সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসব সমঝোতা স্মারকের বেশির ভাগের আইনগত বাধ্যবাধকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এর মধ্যে কিছু চুক্তি হয়েছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অস্ত্র কারখানা রসোবোরন নেক্সপোর্টের সঙ্গে সম্পাদিত অস্ত্রচুক্তি। এ ছাড়া আফ্রিকার ৩০টি দেশের সঙ্গে সম্পাদিত সামরিক প্রযুক্তি সহায়তা চুক্তি। উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইউয়ারি মুসেভিনি ও জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট এমারসন নানগাগওয়ার মতো স্বৈরশাসকদের কাছে এ চুক্তির বিশাল মূল্য রয়েছে। মুসেভিনি এ বছরের ২৫ মার্চ বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের সহযোগিতার ব্যাপারে আমরা অত্যন্ত সন্তুষ্ট এবং তাদের উঁচু মানের অস্ত্র ও প্রযুক্তি নিয়েও আমরা সন্তুষ্ট। এই সন্তোষ প্রকাশের আগে তিনি পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়নের আদেশ দেন। তাতে করে অনেক বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়, অনেকে আহত হন। জুলাই মাসে উগান্ডার কিছু নাগরিক আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মুসেভেনি ও তার ছেলে মুহোজি কিনেরুগাবার (উগান্ডার সেনাবাহিনীর জেনারেল) বিরুদ্ধে সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছেন। জিম্বাবুয়ে অনেক বেশি দামে রাশিয়া থেকে ৩২টি হেলিকপ্টার কিনেছে। জিম্বাবুয়ের জনগণ যখন অতি উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও আর্থসামাজিক দুর্বিপাকের সঙ্গে লড়াই করছে, তখনই এমারসন মানাঙ্গগাওয়ার সরকার উচ্চ মূল্যে হেলিকপ্টার কিনছে। এসব চুক্তি সমস্যাজনক। এগুলো আফ্রিকার সঙ্গে রাশিয়ার একমুখী সম্পর্কের দৃষ্টান্ত। অস্ত্র কেনার প্রস্তাব থাকলেও এমন কোনো বিনিয়োগের প্রস্তাব নেই, যাতে করে মহাদেশটির জনগণের দৈনন্দিন জীবনের উন্নতি হয় কিংবা কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়। আফ্রিকায় আসা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের মাত্র ১ শতাংশ রাশিয়ার। চীন কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়নের তুলনায় আফ্রিকায় রাশিয়ার বিনিয়োগ প্রকৃতপক্ষেই বামনাকৃতির।

এর পরিমাণ আফ্রিকার সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পুরো বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ এবং চীনের তুলনায় ৬ শতাংশের বেশি নয়। রাশিয়ায় রপ্তানির তুলনায় ৫ গুণ বেশি আমদানি করে আফ্রিকা। এর ফলে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ২০১৯ সালে রাশিয়া ঘোষণা দিয়েছিল যে চীনের সঙ্গে তারা বাণিজ্য দ্বিগুণ বাড়াবে। কিন্তু সেটা অর্জন করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। চার বছরে আরো অনেক দৃশ্যপটের পরিবর্তন হয়েছে। ২০২২ সালে ইউক্রেনে অবৈধ আগ্রাসন শুরুর পর রাশিয়ার অর্থনীতি ২ দশমিক ১ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, কানাডা, তাইওয়ানসহ অনেক দেশ রাশিয়ার ব্যাংক, তেল শোধনাগার ও সামরিক রপ্তানির ওপর সমন্বিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। রাশিয়ার জ্বালানি ও সামরিক সরবরাহ শৃঙ্খল ও অবকাঠামো খাত লক্ষ্যবস্তু করেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ক্রেমলিনের ঘনিষ্ঠ সম্পদশালী ব্যক্তিদের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাশিয়ার ব্যবসায়িক গোষ্ঠী আফ্রিকা মহাদেশকে তাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিতে মরিয়া। এটা সত্য যে অতীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফ্রিকা মহাদেশের বড় বন্ধু ছিল। কিন্তু সময় এখন পাল্টেছে। এতকাল অনেক আফ্রিকান দেশই জোট-নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়ে আসছিল এবং এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের কারণে যুক্তরাষ্ট্র এতকাল মেনে নিয়েছিল যে, এর অর্থ মস্কোকে সমর্থন করা নয়। কিন্তু এখন তারা ‘প্রকৃত জোট-নিরপেক্ষতা’ চেয়েছে। বলেন ভাইনস, দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর চাপটা এ কারণেই, তাদের এখন প্রমাণ করতে হবে যে, তারা সত্যিই জোট-নিরপেক্ষ। আফ্রিকান শান্তি উদ্যোগ এবং এই সফরের ক্ষেত্রে প্রধান চালিকা শক্তির ভূমিকা নিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট রামাফোসা। তিনি পুতিন ও জেলেনস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন টেলিফোনে। এ ছাড়া জাতিসংঘের মহাসচিব এন্টোনিও গুটেরেসকেও এ ব্যাপারে বিস্তারিত ব্রিফিং করেছেন।

রাশিয়া এবং ইউক্রেন এখন পর্যন্ত শান্তি আলোচনার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখায়নি, তবে তারা আফ্রিকান নেতাদের এ সফরটির ব্যাপারে আগ্রহী। মস্কো বেশ কিছুকাল করে আফ্রিকায় তাদের প্রভাব বাড়ানোর জন্য কাজ করে চলেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সেন্ট পিটার্সবুর্গে একটি রাশিয়া-আফ্রিকা শীর্ষ সম্মেলনে তারা সেটার একটা নমুনা দেখাবে বলে আশা করছে। ইউক্রেন ও আফ্রিকান কূটনীতির ক্ষেত্রে জায়গা করে করে নেবার চেষ্টা করছে।

সম্প্রতি ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রি কুলেবা এ মহাদেশে একটি সফর করে এসেছেন। ড. মাখুবেলা বলছেন, ইউক্রেন সম্ভবত আফ্রিকান মধ্যস্থতাকারীদের বোঝানোর চেষ্টা করবে, যেন তারা সেন্ট পিটার্সবুর্গের সম্মেলনে যোগ না দেন। তিনি বলেন, রাশিয়ানরা এটা দেখাতে চায় যে তারা বিচ্ছিন্ন নয়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ওই সম্মেলনটি রাশিয়ার সঙ্গে আফ্রিকার সম্পর্কের একটা গুরুত্বপূর্ণ সূচক; কিন্তু তা আদর্শিক নয়। ড. ভাইনস বলছেন, আফ্রিকানরা এ ক্ষেত্রে দেনা-পাওনায় বিশ্বাসী। তার মতে, সম্প্রতি মোজাম্বিকের যে সাবেক গেরিলা যোদ্ধাদের সঙ্গে তার কথা হয়েছে- তারা জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি নিয়েই বেশি চিন্তিত- যার কারণ ‘বহু দূরের একটি ইউরোপিয়ান যুদ্ধ’। এটা তাদের কোনো যুদ্ধ নয়। আফ্রিকান নেতাদের জন্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে এটাকে একটা সুবিধাই বলা যায়। আসল প্রশ্ন হলো, যাদের মধ্যে এ যুদ্ধ হচ্ছে- সেই রাশিয়া ও ইউক্রেন আদৌ আলোচনার টেবিলে এসে বসবে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

রায়হান আহমেদ তপাদার

রায়হান আহমেদ তপাদার, গবেষক ও কলামিস্ট, [email protected]

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

আফ্রিকার ওপর জো বাইডেনের চাপ ও ভ্লাদিমির পুতিনের প্রভাব

প্রকাশ: ০৭:২৭:৪৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ অগাস্ট ২০২৩

ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ থামানোর লক্ষ্য নিয়ে সাতটি আফ্রিকান দেশের নেতা মিলে এক শান্তি মিশন শুরু করেছেন। প্রথমে ভলোদিমির জেলেনস্কি এবং পরে ভলাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করছেন তারা এবং এ মিশনের প্রথম পর্বে তারা একটি ট্রেনে করে পোল্যান্ড হয়ে গিয়েছিলেন কিয়েভে। প্রশ্ন এটাই, তারা এ উদ্যোগে কতটা সাফল্য পেতে পারেন? এই প্রতিনিধিদলে ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা, মিশর, সেনেগাল, কঙ্গো-ব্রাজাভিল, কমোরোস, জাম্বিয়া আর উগান্ডার নেতারা। এমন এক সময় এ সফর হচ্ছে, যখন ইউক্রেন সবেমাত্র তাদের বহুল আলোচিত পাল্টা অভিযান শুরু করেছে—যার লক্ষ্য পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনের যেসব ভূমি এতদিনের যুদ্ধে রুশ নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে, সেগুলো পুনরুদ্ধার করা। এমন এক সময়ে এই মিশনের পক্ষে কী অর্জন করা সম্ভব—সেটা একটা প্রশ্ন। তারা যখন ইউক্রেনে পৌঁছান, ঠিক তখনই দেশটির রাজধানী কিয়েভে বিমান হামলার সতর্ক সংকেত দিতে সাইরেন বেজে ওঠে এবং বেশ কিছু ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়।

ইউক্রেনের বিমান বাহিনী বলেছে, কৃষ্ণসাগর থেকে বেশ কয়েকটি রুশ কালিবর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়। শহরের পডিলস্কি এলাকায় বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। পরে কিয়েভের মেয়র ভিতালি ক্লিৎস্কো টেলিগ্রামে এক বার্তায় বলেন, তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করেছে এবং শহরের কোনো আবাসিক ভবনের ক্ষতি হয়নি। ইউক্রেনের বিমান বাহিনী বলেছে, তারা মোট ১২টি রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করেছে। ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রি কুলেবা বলেন এসব ক্ষেপণাস্ত্র ছিল ‘আফ্রিকার প্রতি রাশিয়ার বার্তা’ যে পুতিন ‘আরো যুদ্ধ চান, শান্তি নয়’। একজন কূটনীতিক ওলেক্সান্দর শেরবা এক টুইট বার্তায় বলেছেন, কিয়েভে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের মাধ্যমে আফ্রিকান নেতাদের স্বাগত জানাচ্ছেন পুতিন। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা গত মাসে যখন এই আফ্রিকান শান্তি মিশনের কথা ঘোষণা করেছিলেন, তখন তিনি কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব বা সময়সীমার কথা বলেননি। বরং দেখা যাচ্ছে এরকম সম্ভাব্য শান্তি-স্থাপনকারীদের ময়দানে এর মধ্যেই অনেক লোকের ভিড় জমে গেছে। চীন ও তুরস্কের নেতারা এবং পোপ ফ্রান্সিস- এ রকম অনেকেই আছেন সেখানে। দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক কূটনীতিক ও বিশ্লেষক কিংসলে মাখুবেলা প্রশ্ন তোলেন, আফ্রিকান নেতাদের এই উদ্যোগের কৌশলগত কেন্দ্রবিন্দুটা কী? এটা স্পষ্ট নয়।

এটা কি আফ্রিকান রাষ্ট্রপ্রধানদের একটা ফটো-অপ? আন্তর্জাতিক সংঘাতের ক্ষেত্রে সাধারণত আফ্রিকার নেতাদের এ রকম সক্রিয়তা দেখা যায় না। সেদিক থেকে এই উদ্যোগ একটা বিরল ঘটনা। কারণ ইউক্রেন সংকটকে সাধারণত দেখা হয় রাশিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যেকার একটা সংঘাত হিসেবে। গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) আফ্রিকাবিষয়ক পরিচালক মুরিথি মুথিগা বলছেন, আফ্রিকা মহাদেশের বাইরে ঘটনা নিয়ে এ কূটনৈতিক উদ্যোগকে তিনি স্বাগত জানান, কারণ আফ্রিকা অনেক দিন ধরেই জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে আরো জোরালো ভূমিকা পাবার জন্য দাবি জানিয়ে আসছে। এই উদ্যোগের ভিত্তি স্থাপন করেছেন ব্রাজাভিল ফাউন্ডেশন নামে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান জঁ-ইভেস অলিভিয়ের। তিনি অবশ্য খুব বেশি বড় কোনো লক্ষ্যের কথা বলছেন না। তার মতে লক্ষ্যটা হচ্ছে, একটা সংলাপ শুরু করা, তা ছাড়া রুশ ও ইউক্রেনীয় যুদ্ধবন্দি বিনিময়ের জন্য কাজ করা। বিবিসির বিশ্লেষক অ্যারন আকিনিয়েমি বলছেন, আফ্রিকান নেতাদের এই ইউক্রেন শান্তি মিশন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন আফ্রিকান দেশগুলোর অনেকে। সামাজিকমাধ্যমে অনেকে সংশয় প্রকাশ করছেন যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ওপর প্রভাব ফেলার মতো কোনো ক্ষমতা বা সুবিধা এই নেতাদের আছে কিনা। অন্য অনেকে বলছেন, এই সংকটের ক্ষেত্রে আফ্রিকার দেশগুলো যে অবস্থান নিয়েছে তা ‘অস্পষ্ট বা ধোঁয়াটে’ এবং তা এই মিশনের কোন অর্থপূর্ণ প্রভাব ফেলার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে না।

ইউক্রেনে সর্বাত্মক আগ্রাসন ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে ক্রমাগত একঘরে হয়ে পড়ায় রাশিয়া এখন আফ্রিকা মহাদেশে তাদের পুরোনো ও অনুগত মিত্রদের একখানে জড়ো করেছে। সেন্ট পিটার্সবার্গে রাশিয়া-আফ্রিকা ইকোনমিক ও হিউম্যানিটারিয়ান ফোরামে সেই দৃশ্যই দেখা গেল। এই সম্মেলনের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য। এই প্রতিপাদ্য অবশ্যই পূর্ব ইউরোপে রাশিয়া যে নিষ্ঠুর ও আগ্রাসী আচরণ করছে, পুরোপুরি তার বিপরীত। এ কারণেই আফ্রিকার নেতাদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন অনেক বিশেষজ্ঞরা। কারণ, তারা যেন অসাবধানতাবশত ইউক্রেন আগ্রাসনের ঘটনাটির অনুমোদন না দেন এবং কোনো ধরনের সমস্যাজনক বাণিজ্য চুক্তি না করেন। ২০১৯ সালে প্রথম যখন আফ্রিকা মহাদেশের ৪৭ জন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান সমুদ্রতীরবর্তী শহর সোচিতে প্রথম রাশিয়া-আফ্রিকা ইকোনমিক ও হিউম্যানিটারিয়ান ফোরামের সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলেন, সে সময় প্রতিবেশী দেশের ওপর পুরো মাত্রায় সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন শুরু করেনি রাশিয়া।

২০০৮ সালে রাশিয়া অবৈধভাবে জর্জিয়ার ওসেটিয়া ও আবখাজিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ২০১৪ সালে ইউক্রেনের কাছ থেকে বেআইনিভাবে ক্রিমিয়া দখল করে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে। এরপর রাশিয়াপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দেওয়ার জন্য পূর্ব ইউরোপে দোনেৎস্ক ও লুহানেস্কে গোপনে নিয়মিত বাহিনীর সেনা ও ভাড়াটে সেনা নিয়োগ দেয়। বিশ্বাসযোগ্য বৈশ্বিক শক্তি ও অংশীদার হওয়ার মতো কোনো কাজই রাশিয়া করেনি। তবে আফ্রিকার নেতারা সতর্ক থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা ভাবছেন না। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে তারা এমন একটি আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যেটা পাওয়ার যোগ্য তিনি নন। সোচিতে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী সম্মেলনে আফ্রিকার নেতাদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে পুতিন আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলোর স্বাধীনতাসংগ্রাম এবং সদ্য স্বাধীন দেশগুলোকে দেওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। রাশিয়ার সঙ্গে আফ্রিকার পুরোনো সম্পর্কের বিষয়েও জোর দিয়েছিলেন পুতিন। পুতিন ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন যে তার সামনে বসা ছদ্মগণতন্ত্রী ও স্বৈরশাসকরা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশের নেতার কাছ থেকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ব্যাপারে ভিন্ন ব্যাখ্যা শুনতে পছন্দ করবেন।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আফ্রিকায় রাশিয়ার প্রভাব সংকুচিত হয়ে যায়। চীনসহ অন্য শক্তিগুলো সেখানকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। প্রকৃতপক্ষে চীন এখন আফ্রিকার সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত চীন-আফ্রিকা সহযোগিতা ফোরামের বৈঠকে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং আফ্রিকা মহাদেশে ৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেন। চীনের অর্থায়নে সেতু, রেল, বন্দর, স্টেডিয়ামের মতো প্রকল্পে আফ্রিকা মহাদেশ ভরে উঠছে। পক্ষান্তরে, ২০১৯ সালে পুতিন আফ্রিকার জন্য সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসব সমঝোতা স্মারকের বেশির ভাগের আইনগত বাধ্যবাধকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এর মধ্যে কিছু চুক্তি হয়েছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অস্ত্র কারখানা রসোবোরন নেক্সপোর্টের সঙ্গে সম্পাদিত অস্ত্রচুক্তি। এ ছাড়া আফ্রিকার ৩০টি দেশের সঙ্গে সম্পাদিত সামরিক প্রযুক্তি সহায়তা চুক্তি। উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইউয়ারি মুসেভিনি ও জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট এমারসন নানগাগওয়ার মতো স্বৈরশাসকদের কাছে এ চুক্তির বিশাল মূল্য রয়েছে। মুসেভিনি এ বছরের ২৫ মার্চ বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের সহযোগিতার ব্যাপারে আমরা অত্যন্ত সন্তুষ্ট এবং তাদের উঁচু মানের অস্ত্র ও প্রযুক্তি নিয়েও আমরা সন্তুষ্ট। এই সন্তোষ প্রকাশের আগে তিনি পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়নের আদেশ দেন। তাতে করে অনেক বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়, অনেকে আহত হন। জুলাই মাসে উগান্ডার কিছু নাগরিক আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মুসেভেনি ও তার ছেলে মুহোজি কিনেরুগাবার (উগান্ডার সেনাবাহিনীর জেনারেল) বিরুদ্ধে সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছেন। জিম্বাবুয়ে অনেক বেশি দামে রাশিয়া থেকে ৩২টি হেলিকপ্টার কিনেছে। জিম্বাবুয়ের জনগণ যখন অতি উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও আর্থসামাজিক দুর্বিপাকের সঙ্গে লড়াই করছে, তখনই এমারসন মানাঙ্গগাওয়ার সরকার উচ্চ মূল্যে হেলিকপ্টার কিনছে। এসব চুক্তি সমস্যাজনক। এগুলো আফ্রিকার সঙ্গে রাশিয়ার একমুখী সম্পর্কের দৃষ্টান্ত। অস্ত্র কেনার প্রস্তাব থাকলেও এমন কোনো বিনিয়োগের প্রস্তাব নেই, যাতে করে মহাদেশটির জনগণের দৈনন্দিন জীবনের উন্নতি হয় কিংবা কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়। আফ্রিকায় আসা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের মাত্র ১ শতাংশ রাশিয়ার। চীন কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়নের তুলনায় আফ্রিকায় রাশিয়ার বিনিয়োগ প্রকৃতপক্ষেই বামনাকৃতির।

এর পরিমাণ আফ্রিকার সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পুরো বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ এবং চীনের তুলনায় ৬ শতাংশের বেশি নয়। রাশিয়ায় রপ্তানির তুলনায় ৫ গুণ বেশি আমদানি করে আফ্রিকা। এর ফলে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ২০১৯ সালে রাশিয়া ঘোষণা দিয়েছিল যে চীনের সঙ্গে তারা বাণিজ্য দ্বিগুণ বাড়াবে। কিন্তু সেটা অর্জন করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। চার বছরে আরো অনেক দৃশ্যপটের পরিবর্তন হয়েছে। ২০২২ সালে ইউক্রেনে অবৈধ আগ্রাসন শুরুর পর রাশিয়ার অর্থনীতি ২ দশমিক ১ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, কানাডা, তাইওয়ানসহ অনেক দেশ রাশিয়ার ব্যাংক, তেল শোধনাগার ও সামরিক রপ্তানির ওপর সমন্বিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। রাশিয়ার জ্বালানি ও সামরিক সরবরাহ শৃঙ্খল ও অবকাঠামো খাত লক্ষ্যবস্তু করেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ক্রেমলিনের ঘনিষ্ঠ সম্পদশালী ব্যক্তিদের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাশিয়ার ব্যবসায়িক গোষ্ঠী আফ্রিকা মহাদেশকে তাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিতে মরিয়া। এটা সত্য যে অতীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফ্রিকা মহাদেশের বড় বন্ধু ছিল। কিন্তু সময় এখন পাল্টেছে। এতকাল অনেক আফ্রিকান দেশই জোট-নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়ে আসছিল এবং এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের কারণে যুক্তরাষ্ট্র এতকাল মেনে নিয়েছিল যে, এর অর্থ মস্কোকে সমর্থন করা নয়। কিন্তু এখন তারা ‘প্রকৃত জোট-নিরপেক্ষতা’ চেয়েছে। বলেন ভাইনস, দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর চাপটা এ কারণেই, তাদের এখন প্রমাণ করতে হবে যে, তারা সত্যিই জোট-নিরপেক্ষ। আফ্রিকান শান্তি উদ্যোগ এবং এই সফরের ক্ষেত্রে প্রধান চালিকা শক্তির ভূমিকা নিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট রামাফোসা। তিনি পুতিন ও জেলেনস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন টেলিফোনে। এ ছাড়া জাতিসংঘের মহাসচিব এন্টোনিও গুটেরেসকেও এ ব্যাপারে বিস্তারিত ব্রিফিং করেছেন।

রাশিয়া এবং ইউক্রেন এখন পর্যন্ত শান্তি আলোচনার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখায়নি, তবে তারা আফ্রিকান নেতাদের এ সফরটির ব্যাপারে আগ্রহী। মস্কো বেশ কিছুকাল করে আফ্রিকায় তাদের প্রভাব বাড়ানোর জন্য কাজ করে চলেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সেন্ট পিটার্সবুর্গে একটি রাশিয়া-আফ্রিকা শীর্ষ সম্মেলনে তারা সেটার একটা নমুনা দেখাবে বলে আশা করছে। ইউক্রেন ও আফ্রিকান কূটনীতির ক্ষেত্রে জায়গা করে করে নেবার চেষ্টা করছে।

সম্প্রতি ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রি কুলেবা এ মহাদেশে একটি সফর করে এসেছেন। ড. মাখুবেলা বলছেন, ইউক্রেন সম্ভবত আফ্রিকান মধ্যস্থতাকারীদের বোঝানোর চেষ্টা করবে, যেন তারা সেন্ট পিটার্সবুর্গের সম্মেলনে যোগ না দেন। তিনি বলেন, রাশিয়ানরা এটা দেখাতে চায় যে তারা বিচ্ছিন্ন নয়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ওই সম্মেলনটি রাশিয়ার সঙ্গে আফ্রিকার সম্পর্কের একটা গুরুত্বপূর্ণ সূচক; কিন্তু তা আদর্শিক নয়। ড. ভাইনস বলছেন, আফ্রিকানরা এ ক্ষেত্রে দেনা-পাওনায় বিশ্বাসী। তার মতে, সম্প্রতি মোজাম্বিকের যে সাবেক গেরিলা যোদ্ধাদের সঙ্গে তার কথা হয়েছে- তারা জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি নিয়েই বেশি চিন্তিত- যার কারণ ‘বহু দূরের একটি ইউরোপিয়ান যুদ্ধ’। এটা তাদের কোনো যুদ্ধ নয়। আফ্রিকান নেতাদের জন্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে এটাকে একটা সুবিধাই বলা যায়। আসল প্রশ্ন হলো, যাদের মধ্যে এ যুদ্ধ হচ্ছে- সেই রাশিয়া ও ইউক্রেন আদৌ আলোচনার টেবিলে এসে বসবে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়।