০৩:৩০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

ব্রিকস সম্মেলন ২০২২-এ কী আলোচনা হলো? ভারত কি ব্রিকস থেকে বেরিয়ে যাবে?

মো. আসাদুল আমীন
  • প্রকাশ: ০২:৫৫:২৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ জুলাই ২০২২
  • / ৫১৩৫ বার পড়া হয়েছে

ব্রিকস (BRICS)


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

২০২২ সালের ব্রিকস সম্মেলন হয়েছে গত ২৩-২৪ জুন, যা ছিল ১৪তম শীর্ষ সম্মেলন এবং করোনাকালীন দুই বছর সহ এবারের মতো টানা তৃতীয়বার ভার্চুয়াল সম্মেলন। এবার ব্রিকস সম্মলনের প্রেক্ষপট ভিন্ন কেননা পশ্চিমা শক্তি আগেই ঘোষণা দিয়েছে মূলত চীন ও রাশিয়া সহ সহযোগী সব রাষ্ট্র কে একঘরে করে রাখার। পশ্চিমাদের নেতৃত্বে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মুখোমুখি কর্মকাণ্ড আমাদের আবার আরেকবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যেন নিয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্ব দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো এবং বর্তমান রাশিয়া (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) গঠন করে ওয়ারশ প্যাক্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের আগ পর্যন্ত সময়কে বলা হয়ে থাকে কোল্ড ওয়ার (cold war) বা স্নায়ুযুদ্ধের পিরিয়ড। বর্তমান পরিস্থিতি যেন স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ের প্রতিচ্ছবি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার অর্থনীতি বসিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি রাশিয়ার গতি রোধ করতে বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যাচ্ছে যাতে রাশিয়ার অর্থনীতি দুর্বল হয়ে যায় এবং রাশিয়ার প্রভাব কমে যায়। রাশিয়াও পশ্চিমাদের প্রতিহত করতে প্রস্ততের বার্তা দিয়ে যাচ্ছে।

ব্রিকসের ভার্চুয়াল সম্মেলনে এবার আর্জেন্টিনা এবং ইরান যোগদেওয়ার জন্য আবেদন করেছে। এছাড়া প্রতিবছর সম্মেলনে সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধিরা যুক্ত হলেও এবার প্রথম অতিথি হিসেবে ১৩ টি রাষ্ট্র অংশগ্রহন করেছে এবং ব্রিকস সম্প্রসারণের কথা উঠেছে। এবারের ভার্চুয়াল ব্রিকস সম্মেলনে “বেইজিং ঘোষণা” বলে এক ঐক্যমত্যের দলিল স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং চীনকে সহযোগিতা করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে অপর রাষ্ট্রগুলোকে। কেননা বর্তমানে পশ্চিমাদের সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ চীন। চীনের অর্থনীতি দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে এবং বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতির দেশের দৌড়ে রয়েছে চীন। এজন্য চীন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে পশ্চিমাদের কাছে। এছাড়া রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমাদের সাথে রাশিয়া সম্পর্ক ঠিক সাপে-নেউলে। 

ব্রিকস (BRICS) কী?

ব্রিকস হলো পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র— ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার একটি জোট অর্থাৎ অন্তর্ভুক্ত সদস্য রাষ্ট্রগুলোর রয়েছে উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘটনাবলীর উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব। 

BRICS জোটের কাজ কী?

মূলত পাঁচটি দেশের আদ্যক্ষর নিয়ে ব্রিকস জোটের নামকরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে— ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা। ২০১০ সালের পূর্বে এটি ব্রিক নামে পরিচিত ছিল, তখন দক্ষিণ আফ্রিকা ছিল না। ব্রিকস এর অন্তর্ভুক্ত সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সবাই জি-২০ জোটেরও সদস্য।

২০১০ সাল থেকে ব্রিকস এর আনুষ্ঠানিক সম্মেলন হয়ে আসছে। রাশিয়া হলো ব্রিকসের প্রধান। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ ব্রিকসের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর। সদস্য দেশগুলোর কাজ হলো অর্থনৈতিক অগ্রসরতার জন্য একে অপরকে সহযোগিতা করা, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে একতাবদ্ধ হওয়া, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে নজর দেওয়া এবং ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সদা তৎপর থাকা।

ব্রিকস সম্মেলন ২০২২, চীন

কী আলোচনা হলো এবারের ব্রিকস সম্মেলনে? 

প্রতিবছর সম্মেলনে অর্থনীতির বিষয়ে আলোচনা গুরুত্ব পায়। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। যেহেতু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলমান এবং রাশিয়া ব্রিকস জোটে রয়েছে, আবার চীন-রাশিয়া সম্পর্ক অনেকটা গভীর যা সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে। তাই এখানে ভিন্ন বিষয় আলোচনা হবার কথা এটা স্বাভাবিক। অর্থনীতি বিষয়ক আলোচনা কম গুরুত্ব পেয়ে ইউক্রেন যুদ্ধ বড়ো হয়ে উঠা বা দীর্ঘস্থায়ী হওয়া, কো-অপারেশন, চীনের আগ্রহে দেশগুলোর সার্বভৌমত্বের উপর আলোচনায় জোর দেয়া হয়েছে। চীনা প্রসিডেন্ট বলেন- পেটে ভাত থাকলে তখন মানুষ ভালো আচরণ শেখে অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছাড়া সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন প্রায় অসম্ভব। সম্মেলনে বৈশ্বিক সংকট সৃষ্টির জন্য পশ্চিমাদের দায়ী করেন পুতিন। তিনি পশ্চিমাদের স্বার্থপর কর্মকান্ড পরিচালনার অভিযোগ তোলেন।

ব্রিকস সম্মেলনের ঠিক বিপরীত হলো কোয়াড যেখানে রয়েছে – জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া। ব্রিকস এ রয়েছে চীন এবং রাশিয়া যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান টার্গেট করা দুটি দেশ। এখানে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে সজাগ থাকার আহ্বান করা হয়। আর কোয়াড প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে মূলত চীনের গতিরোধ করার জন্য। চীনের সাথে রয়েছে রাশিয়ার বন্ধুত্বের সম্পর্ক এবং পশ্চিমা শক্তিকে রাশিয়া-চীন একত্রে মোকাবিলা করার ঘোষণা দিয়েছে। 

ব্রিকস সম্মেলনের তাৎপর্য

পশ্চিমাদের সাথে পুতিনের দ্বন্দ্ব চরমে; পশ্চিমারা এবং রাশিয়ার অবস্থান মুখোমুখি। বিভিন্ন সময়ে পুতিন কে পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা দিতে দেখা যায় এবং পাল্টাপাল্টি রাশিয়াকেও বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়। পশ্চিমারা চায় রাশিয়া কে একঘরে রাখতে, রাশিয়ার বাণিজ্য যাতে সম্প্রসারিত না হয়ে মন্থর হয়, রাশিয়া অর্থনৈতিকভাবে ভেঙে পড়ে, রাশিয়ার প্রভাব কমে যায় এমন। বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়া প্রায় দিশেহারা এবং ইউক্রেন যুদ্ধ ও চলমান নিষেধাজ্ঞার মধ্যে রাশিয়ার গতি স্থবির হয়ে যায়। তবে পুতিন তা নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করে; পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে পাল্টা নিষেধাজ্ঞা, গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ করা, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা, রুবলের মাধ্যমে রাশিয়া থেকে পণ্য আমদানির উপর গুরুত্ব দেয়। ব্রিকস সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে পুতিন যেন বার্তা দিলো বা পশ্চিমারা তথা বিশ্ববাসী দেখলো রাশিয়া একা নয়, রাশিয়ার সাথে অনেকে রয়েছেন। অর্থাৎ এ যেন পুতিনের বিশ্বমঞ্চে ফিরে আসা। বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো দুটি জনসংখ্যার দেশ চীন, ভারত রয়েছে এখানে। লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার সবচেয়ে বড়ো অর্থনীতির দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা এখানে রয়েছে। 

ভারত কি ব্রিকস থেকে বেরিয়ে যাবে? 

ব্রিকসের মূল উদ্দেশ্য হলো অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা এবং পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রেখে সহযোগিতা করা। কিন্তু বর্তমান সময়ে ব্রিকসের মূল উদ্দেশ্য বড়ো ধরনের অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে, পাল্টে গেছে যেন কার্যক্রম।

ভারতের প্রত্যাশা ব্রিকস হবে এমন একটা জোট যা ভারতের আন্তর্জাতিক প্রভাব বাড়াতে সুযোগ-সুবিধা দেবে। কিন্তু ইদানীং ব্রিকস রাশিয়া ও চীনের স্বার্থে ভূ-রাজনৈতিক জোট করার এবং সম্প্রসারণের নামে সমমনা দেশ ইরানকেও যুক্ত করার প্রচেষ্টা হতে পারে সামনে। তখন তা ভারতের জন্য মোটেও সন্তোষজনক বা স্বস্তিদায়ক হবে না। ব্রিকস সম্প্রসারণের এই পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে চীন পুরোপুরিভাবে ভারতের বিষয়ে বিবেচনায় নেয়নি। ব্রিকস কে আরও চীনকেন্দ্রিক করা হোক ভারত তা চায় না।

ভারতের উদ্বেগের আরেকটি কারণ হলো চীনের পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তান। যদি পাকিস্তান এখানে আসে তাহলে তা ভারতের জন্য মোটেও কাম্য নয় কেননা কাশ্মির ইস্যু নিয়ে এদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো নেই। তাই ভারতের জন্য ব্রিকসের যে অবস্থা তাতে ব্রিকস থেকে বের হয়ে যেতে পারে ভারত।

শেয়ার করুন

One thought on “ব্রিকস সম্মেলন ২০২২-এ কী আলোচনা হলো? ভারত কি ব্রিকস থেকে বেরিয়ে যাবে?

  1. মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম, উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। says:

    বাংলাদেশ ব্রিকস এর সদস্য হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? বাংলাদেশ ব্রিকস এর সদস্য হলে সাউথ আফ্রিকা ব্রাজিলের সাথে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারবে।বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের ক্ষেত্রে ভারত কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারে বা এবিষয়টি ভারত কিভাবে দেখবে?

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

মো. আসাদুল আমীন

শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

ব্রিকস সম্মেলন ২০২২-এ কী আলোচনা হলো? ভারত কি ব্রিকস থেকে বেরিয়ে যাবে?

প্রকাশ: ০২:৫৫:২৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ জুলাই ২০২২

২০২২ সালের ব্রিকস সম্মেলন হয়েছে গত ২৩-২৪ জুন, যা ছিল ১৪তম শীর্ষ সম্মেলন এবং করোনাকালীন দুই বছর সহ এবারের মতো টানা তৃতীয়বার ভার্চুয়াল সম্মেলন। এবার ব্রিকস সম্মলনের প্রেক্ষপট ভিন্ন কেননা পশ্চিমা শক্তি আগেই ঘোষণা দিয়েছে মূলত চীন ও রাশিয়া সহ সহযোগী সব রাষ্ট্র কে একঘরে করে রাখার। পশ্চিমাদের নেতৃত্বে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মুখোমুখি কর্মকাণ্ড আমাদের আবার আরেকবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যেন নিয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্ব দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো এবং বর্তমান রাশিয়া (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) গঠন করে ওয়ারশ প্যাক্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের আগ পর্যন্ত সময়কে বলা হয়ে থাকে কোল্ড ওয়ার (cold war) বা স্নায়ুযুদ্ধের পিরিয়ড। বর্তমান পরিস্থিতি যেন স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ের প্রতিচ্ছবি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার অর্থনীতি বসিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি রাশিয়ার গতি রোধ করতে বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যাচ্ছে যাতে রাশিয়ার অর্থনীতি দুর্বল হয়ে যায় এবং রাশিয়ার প্রভাব কমে যায়। রাশিয়াও পশ্চিমাদের প্রতিহত করতে প্রস্ততের বার্তা দিয়ে যাচ্ছে।

ব্রিকসের ভার্চুয়াল সম্মেলনে এবার আর্জেন্টিনা এবং ইরান যোগদেওয়ার জন্য আবেদন করেছে। এছাড়া প্রতিবছর সম্মেলনে সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধিরা যুক্ত হলেও এবার প্রথম অতিথি হিসেবে ১৩ টি রাষ্ট্র অংশগ্রহন করেছে এবং ব্রিকস সম্প্রসারণের কথা উঠেছে। এবারের ভার্চুয়াল ব্রিকস সম্মেলনে “বেইজিং ঘোষণা” বলে এক ঐক্যমত্যের দলিল স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং চীনকে সহযোগিতা করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে অপর রাষ্ট্রগুলোকে। কেননা বর্তমানে পশ্চিমাদের সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ চীন। চীনের অর্থনীতি দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে এবং বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতির দেশের দৌড়ে রয়েছে চীন। এজন্য চীন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে পশ্চিমাদের কাছে। এছাড়া রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমাদের সাথে রাশিয়া সম্পর্ক ঠিক সাপে-নেউলে। 

ব্রিকস (BRICS) কী?

ব্রিকস হলো পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র— ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার একটি জোট অর্থাৎ অন্তর্ভুক্ত সদস্য রাষ্ট্রগুলোর রয়েছে উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘটনাবলীর উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব। 

BRICS জোটের কাজ কী?

মূলত পাঁচটি দেশের আদ্যক্ষর নিয়ে ব্রিকস জোটের নামকরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে— ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা। ২০১০ সালের পূর্বে এটি ব্রিক নামে পরিচিত ছিল, তখন দক্ষিণ আফ্রিকা ছিল না। ব্রিকস এর অন্তর্ভুক্ত সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সবাই জি-২০ জোটেরও সদস্য।

২০১০ সাল থেকে ব্রিকস এর আনুষ্ঠানিক সম্মেলন হয়ে আসছে। রাশিয়া হলো ব্রিকসের প্রধান। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ ব্রিকসের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর। সদস্য দেশগুলোর কাজ হলো অর্থনৈতিক অগ্রসরতার জন্য একে অপরকে সহযোগিতা করা, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে একতাবদ্ধ হওয়া, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে নজর দেওয়া এবং ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সদা তৎপর থাকা।

ব্রিকস সম্মেলন ২০২২, চীন

কী আলোচনা হলো এবারের ব্রিকস সম্মেলনে? 

প্রতিবছর সম্মেলনে অর্থনীতির বিষয়ে আলোচনা গুরুত্ব পায়। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। যেহেতু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলমান এবং রাশিয়া ব্রিকস জোটে রয়েছে, আবার চীন-রাশিয়া সম্পর্ক অনেকটা গভীর যা সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে। তাই এখানে ভিন্ন বিষয় আলোচনা হবার কথা এটা স্বাভাবিক। অর্থনীতি বিষয়ক আলোচনা কম গুরুত্ব পেয়ে ইউক্রেন যুদ্ধ বড়ো হয়ে উঠা বা দীর্ঘস্থায়ী হওয়া, কো-অপারেশন, চীনের আগ্রহে দেশগুলোর সার্বভৌমত্বের উপর আলোচনায় জোর দেয়া হয়েছে। চীনা প্রসিডেন্ট বলেন- পেটে ভাত থাকলে তখন মানুষ ভালো আচরণ শেখে অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছাড়া সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন প্রায় অসম্ভব। সম্মেলনে বৈশ্বিক সংকট সৃষ্টির জন্য পশ্চিমাদের দায়ী করেন পুতিন। তিনি পশ্চিমাদের স্বার্থপর কর্মকান্ড পরিচালনার অভিযোগ তোলেন।

ব্রিকস সম্মেলনের ঠিক বিপরীত হলো কোয়াড যেখানে রয়েছে – জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া। ব্রিকস এ রয়েছে চীন এবং রাশিয়া যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান টার্গেট করা দুটি দেশ। এখানে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে সজাগ থাকার আহ্বান করা হয়। আর কোয়াড প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে মূলত চীনের গতিরোধ করার জন্য। চীনের সাথে রয়েছে রাশিয়ার বন্ধুত্বের সম্পর্ক এবং পশ্চিমা শক্তিকে রাশিয়া-চীন একত্রে মোকাবিলা করার ঘোষণা দিয়েছে। 

ব্রিকস সম্মেলনের তাৎপর্য

পশ্চিমাদের সাথে পুতিনের দ্বন্দ্ব চরমে; পশ্চিমারা এবং রাশিয়ার অবস্থান মুখোমুখি। বিভিন্ন সময়ে পুতিন কে পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা দিতে দেখা যায় এবং পাল্টাপাল্টি রাশিয়াকেও বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়। পশ্চিমারা চায় রাশিয়া কে একঘরে রাখতে, রাশিয়ার বাণিজ্য যাতে সম্প্রসারিত না হয়ে মন্থর হয়, রাশিয়া অর্থনৈতিকভাবে ভেঙে পড়ে, রাশিয়ার প্রভাব কমে যায় এমন। বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়া প্রায় দিশেহারা এবং ইউক্রেন যুদ্ধ ও চলমান নিষেধাজ্ঞার মধ্যে রাশিয়ার গতি স্থবির হয়ে যায়। তবে পুতিন তা নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করে; পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে পাল্টা নিষেধাজ্ঞা, গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ করা, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা, রুবলের মাধ্যমে রাশিয়া থেকে পণ্য আমদানির উপর গুরুত্ব দেয়। ব্রিকস সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে পুতিন যেন বার্তা দিলো বা পশ্চিমারা তথা বিশ্ববাসী দেখলো রাশিয়া একা নয়, রাশিয়ার সাথে অনেকে রয়েছেন। অর্থাৎ এ যেন পুতিনের বিশ্বমঞ্চে ফিরে আসা। বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো দুটি জনসংখ্যার দেশ চীন, ভারত রয়েছে এখানে। লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার সবচেয়ে বড়ো অর্থনীতির দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা এখানে রয়েছে। 

ভারত কি ব্রিকস থেকে বেরিয়ে যাবে? 

ব্রিকসের মূল উদ্দেশ্য হলো অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা এবং পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রেখে সহযোগিতা করা। কিন্তু বর্তমান সময়ে ব্রিকসের মূল উদ্দেশ্য বড়ো ধরনের অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে, পাল্টে গেছে যেন কার্যক্রম।

ভারতের প্রত্যাশা ব্রিকস হবে এমন একটা জোট যা ভারতের আন্তর্জাতিক প্রভাব বাড়াতে সুযোগ-সুবিধা দেবে। কিন্তু ইদানীং ব্রিকস রাশিয়া ও চীনের স্বার্থে ভূ-রাজনৈতিক জোট করার এবং সম্প্রসারণের নামে সমমনা দেশ ইরানকেও যুক্ত করার প্রচেষ্টা হতে পারে সামনে। তখন তা ভারতের জন্য মোটেও সন্তোষজনক বা স্বস্তিদায়ক হবে না। ব্রিকস সম্প্রসারণের এই পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে চীন পুরোপুরিভাবে ভারতের বিষয়ে বিবেচনায় নেয়নি। ব্রিকস কে আরও চীনকেন্দ্রিক করা হোক ভারত তা চায় না।

ভারতের উদ্বেগের আরেকটি কারণ হলো চীনের পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তান। যদি পাকিস্তান এখানে আসে তাহলে তা ভারতের জন্য মোটেও কাম্য নয় কেননা কাশ্মির ইস্যু নিয়ে এদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো নেই। তাই ভারতের জন্য ব্রিকসের যে অবস্থা তাতে ব্রিকস থেকে বের হয়ে যেতে পারে ভারত।