১১:১২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা Industry 4.0 কী? চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ইতিহাস, কৌশল, লক্ষ্যমাত্রা, প্রবণতা, উপাদান এবং প্রতিবন্ধকতা কী কী?

বিশ্লেষণ সংকলন টিম
  • প্রকাশ: ১১:৫৭:০৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন ২০২২
  • / ২০১৪৬ বার পড়া হয়েছে

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা Industry 4.0 বর্তমানে খুবই আলোচিত একটি বিষয়। এই নিবন্ধে বিশ্লেষণ-এর পাঠকদের জন্য চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ধারণা, ইতিহাস, কৌশল, লক্ষ্যমাত্রা, প্রবণতা, উপাদান এবং প্রতিবন্ধকতাসহ নানা বিষয় তুলে ধরা হলো। একটু সময় নিয়ে ধীরেধীরে পড়ুন, আশা করা যায় চতুর্থবিপ্লব সম্পর্কে আপনি পরিস্কারভাবে বুঝতে পারবেন। মনে রাখবেন— এ সম্পর্কে আরও অধ্যয়নের জন্য আপনি বিভিন্ন বই ও রিসার্চ পেপারের সহায়তা নিন।

এখানে যা আছে

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা ইন্ডাস্ট্রি 4.0 কী?

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ (Industry 4.0) হলো আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন এবং শিল্প ব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়করণের একটি চলমান প্রক্রিয়া। ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব’ শব্দগুচ্ছ দিয়ে মূলতঃ মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই বেশিরভাগ সমস্যা নিরুপণ, সম্যসা বিশ্লেষণ, সমাধান প্রদান ও প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয়করণ করা, উন্নত যোগাযোগ এবং স্ব-পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার বাস্তবায়নে সক্ষম স্মার্ট মেশিন তৈরী করার জন্য বড়ো আকারে মেশিন-টু-মেশিন যোগাযোগ (Machine to Machine or M2M) এবং ইন্টারনেট অব থিংস (IoT) কে একত্র করার ধারণাকে চিহ্নিত করা হয়। স্ব-চালিত গাড়ি হলো চতুর্থ বিপ্লবের একটু উদাহরণ। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ইম্যাজিনেশন এইজ-এর সূচনা করে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ধারণা কীভাবে বা এর ইতিহাস কী?

‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব’-এর ইংরেজি টার্ম ‘ইন্ডাস্ট্রি ৪.০’ (Industry 4.0) সর্বপ্রথম প্রবর্তন করেন জার্মান সরকার কর্তৃক নিয়োজিত একদল বিজ্ঞানী। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (World Economic Forum) প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী চেয়ারম্যান ক্লাউস শোয়াব (Klaus Schwab) ২০১৫ সালে ফরেন অ্যাফেয়ার্স (Foreign Affairs)-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধের মাধ্যমে ‘ইন্ডাস্ট্রি ৪.০’ পদকে (term) বৃহৎ পরিসরে উপস্থাপন করেন। ২০১৬ সালে সুইজারল্যান্ডের ডেভোস-ক্লোস্টারস এ অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সভার বিষয়বস্তু ছিল ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে আয়ত্ত করা’।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জনক হলেন জার্মানির অর্থনীতিবিদ ক্লাউস শোয়াব।

ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ বা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জনক ক্লাউস শোয়াব।

অক্টোবর ১০, ২০১৬ তারিখ ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম স্যান ফ্র্যান্সিস্কোতে তাদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কেন্দ্র উদ্বোধনের ঘোষণা দেয়।

‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব’ ক্লাউস শোয়াবের ২০১৬ সালে প্রকাশিত একটি বইয়ের বিষয় এবং শিরোনামও ছিল। ক্লাউদ শোয়াবের চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সম্পর্কিত বইয়ের নাম ‘The Fourth Industrial Revolution’ (দ্য ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভোল্যুশন)।

ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ বা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জনক ক্লাউস শোয়াবের লেখা বই।

ক্লাউস শোয়াব চতুর্থ শিল্প বিপ্লব প্রসঙ্গে এমন সব প্রযুক্তির কথা উল্লেখ করেছেন যেগুলো হার্ডওয়্যার (Hardware), সফটওয়্যার (Software) এবং বায়োলজি (Biology) একসাথে নিয়ে তথা সাইবার-ফিজিক্যাল সিস্টেমস (Cyber-Physical system)-কে একত্রিত করে এবং পারস্পরিক সংযোগ স্থাপনের অগ্রগতির ওপর জোর দেয়।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বলতে হয় যে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগটি রোবোটিক্স (Robotics), কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা Artificial intelligence), ন্যানোটেকনোলজি (Nanotechnology), কোয়ান্টাম কম্পিউটিং (Quantum counting), বায়োটেকনোলজি (Biotechnology), ইন্টারনেট অফ থিংস (Internet of Things or IoT), ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইন্টারনেট অব থিংস (Industrial Internet of Things or IIoT), ডিসেন্ট্রালাইজড কনসেনসাস (Decentralised Consensus), পঞ্চম প্রজন্মের ওয়্যারলেস প্রযুক্তি (Fifth Generation Wireless Technology), থ্রিডি প্রিন্টিংয় (3D Printing) এবং সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় যানবাহন (Automatic Transportation) এর ক্ষেত্রে উদীয়মান প্রযুক্তির যুগান্তকারী যুগ হিসেবে চিহ্নিত হবে।

চতুর্থ শিল্প ও জার্মান কৌশল

‘ইন্ডাস্ট্রি ৪.০’ (Industry 4.0) সংক্ষেপে আই৪.০ (I4.0) বা শুধু আই৪ (I4) শব্দ বা পদ (Term) ২০১১ সালে জার্মান সরকারের একটি উচ্চ প্রযুক্তিগত কৌশলের একটি প্রকল্প থেকে সৃষ্ট, যেখানে উৎপাদন শিল্পে কম্পিউটারাইজেশনের বিকাশ সাধন করা হয় ।

২০১১ সালে জার্মানির হ্যানোভার ফেয়ারে (Hannover Messe) ‘ইন্ডাস্ট্রি ৪.০’ শব্দটিকে সর্বপ্রথম সর্বসমক্ষে প্রচার করা হয়। উল্লেখ্য, হ্যানোভার ফেয়ার বা হ্যানোভার মেসে হলো বিশ্বের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য মেলা (Trade fair)।

অক্টোবর, ২০১২ সালে জার্মানির ওই উচ্চ প্রযুক্তিগত কৌশল উদ্ভাবনের জন্য কার্যরত দল দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ বাস্তবায়নের সুপারিশ উপস্থাপন করে। এই দলের সদস্য এবং অংশীদারগণ ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ এর প্রতিষ্ঠাতা এবং চালিকা শক্তি হিসেবে স্বীকৃত। ২০১৩ সালের ৮ এপ্রিল হ্যানোভার ফেয়ারে কার্যরত দল তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। দলটির নেতৃত্বে ছিলেন রবার্ট বোশ জিএমবিএইচের সিগফ্রিড ডায়াস এবং জার্মান বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অ্যাকাডেমির হেনিং ক্যাগারম্যান (Henning Kagermann)।

কোম্পানিগুলো ‘ইন্ডাস্ট্রি ৪.০’-এর নীতিসমূহ প্রয়োগের ক্ষেত্রে কখনো কখনো নতুন করে সাজিয়ে নেয়। উদাহরণস্বরূপ, এরোস্পেস পার্টস প্রস্তুতকারক মেগগিট পিএলসি নিজস্ব ইন্ডাস্ট্রির ৪.০ গবেষণা প্রকল্প এম 4 তৈরী করেছে। 

“ইন্ডাস্ট্রি ৪.০” বিশেষত ডিজিটাইজেশন কিভাবে শ্রমবাজারে প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে জার্মানিতে ওয়ার্ক ৪.০ শীর্ষক আলোচনা হচ্ছে। 

জার্মান সরকারের ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ কৌশলের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো অত্যন্ত ফ্লেক্সিবল উৎপাদনের (বৃহৎ আকারে) শর্তে পণ্যের প্রবল স্বনির্ধারণ (কাস্টোমাইজেশন)। সেলফ-অপটিমাইজেশন, সেলফ-কনফিগারেশন, সেলফ-ডায়াগনজ, কগনিশন এর প্রবর্তন এবং ক্রমবর্ধমান জটিল কাজে কর্মীদের বুদ্বিমান সহায়তায় প্রয়োজনীয় স্বয়ংক্রিয়করণ প্রযুক্তির বিকাশ ঘটে চলেছে। ২০১৩ সালের জুলাই পর্যন্ত ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ এর বৃহত্তম প্রকল্প হলো জার্মান ফেডারেল শিক্ষা ও গবেষণা মন্ত্রক (বিএমবিএফ) এর শীর্ষস্থানীয় ক্লাস্টার প্রকল্প “ইন্টেলিজেন্ট টেকনিক্যাল সিস্টেমস অস্টওয়েস্টফ্যালেন-লিপ্পে (ইটস ওডাব্লুএল)। আরেকটি বড় প্রকল্প হলো বিএমবিএফ এর রেস-কম এছাড়াও ক্লাস্টার অব এক্সিলেন্স “ইন্টিগ্রেটিভ প্রোডাকশন টেকনোলজি ফর হাই-ওয়েজ কান্ট্রিজ”। ২০১৫ সালে ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ এর পৃষ্ঠপোষকতার জন্য ইউরোপীয় কমিশন CREMA (XaaS এবং ক্লাউড মডেলের ওপর ভিত্তি করে ক্লাউড ভিত্তিক র‍্যাপিড ইলাস্টিক ম্যানুফ্যাকচারিং) দিগন্ত 2020 নামের একটি গবেষণা প্রকল্প শুরু করে।

পরিবর্তনের গতিই হলো ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ এর নির্ণায়ক। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের গতি এবং এর ফলে মানুষের জীবনের আর্থ-সামাজিক এবং অবকাঠামোগত পরিবর্তনের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক আছে যা আমাদের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নির্দেশ করে এবং একটি নতুন যুগকে চিহ্নিত করে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পরিকল্পনা নীতিমালা এবং লক্ষ্যমাত্রা

পরিকল্পনা নীতি

শিল্প ৪.০ এর অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে চিহ্নিত চারটি পরিকল্পনা নীতি রয়েছে:

  1. আন্তঃসংযোগ: মেশিন, ডিভাইস, সেন্সর এবং মানুষের পরস্পরের মধ্যে ইন্টারনেট অফ থিংস অথবা ইন্টারনেট অফ পিউপল (আইওপি) এর মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন এবং যোগাযোগের ক্ষমতা।
  2. তথ্যের স্বচ্ছতা: ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ তথ্যের স্বচ্ছতা দেয় যা অপারেটরদের সিদ্বান্ত নেওয়ার জন্য ব্যাপক তথ্য সরবরাহ করে। আন্তঃসংযোগের কারনে অপারেটর উৎপাদন প্রক্রিয়ার সমস্ত পয়েন্ট থেকে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করতে পারে এবং সেসব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা শনাক্ত করতে পারে যেগুলো সিস্টেমের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করলে আরও কার্যকর হবে।
  3. প্রযুক্তিগত সহায়তা: সিদ্বান্ত গ্রহণ এবং সমস্যার সমাধানে মানুষকে সহায়তা করার জন্য সিস্টেমের প্রযুক্তিগত সুবিধা এবং কঠিন বা অনিরাপদ কাজের ক্ষেত্রে সহায়তা করার ক্ষমতা।
  4. বিকেন্দ্রীভূত সিদ্ধান্ত: সাইবার ফিজিক্যাল সিস্টেমের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং স্বতন্ত্রভাবে তাদের কাজ যথাসম্ভব সম্পাদন করার ক্ষমতা। কেবল কোনো ব্যতিক্রম, হস্তক্ষেপ বা সাংঘর্ষিক লক্ষ্যের ক্ষেত্রে উচ্চস্তরে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপাদান কী কী?

আমাদের সমাজ এবং চলতি ট্রেন্ডগুলোকে গভীরভাবে দেখলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব অনেকগুলো উপাদানে ভাগ করা যায়। এই উপাদানগুলো কতটা ব্যাপক তা বুঝার জন্য উদাহরণস্বরূপ কিছু উল্লেখযোগ্য ডিজিটাল প্রযুক্তির নাম দেয়া হলো—

  • মোবাইল ডিভাইস
  • ইন্টারনেট অব থিংস  প্ল্যাটফর্ম (Internet of Things – Iot)
  • অবস্থান সনাক্তকরণ প্রযুক্তি (বৈদ্যুতিক সনাক্তকরণ)
  • উন্নত মানব-মেশিন ইন্টারফেস
  • প্রমাণীকরণ এবং জালিয়াতি সনাক্তকরণ
  • স্মার্ট সেন্সর
  • বিগ অ্যানালিটিকস এবং উন্নত প্রক্রিয়া
  • বহুস্তরীয় গ্রাহক ইন্টারঅ্যাকশন এবং গ্রাহক প্রোফাইলিং
  • অগমেন্টেড রিয়েলিটি অথবা ওয়্যারেবল টেকনোলজি (Augmented Reality or Wearable Technology)
  • চাহিদা সাপেক্ষে কম্পিউটার সিস্টেম রিসোর্সের প্রাপ্যতা
  • সাইবার-ফিজিক্যাল সিস্টেম
  • চাহিদা সাপেক্ষে কম্পিউটার সিস্টেম রিসোর্সের প্রাপ্যতা
  • কগনিটিভ কম্পিউটিং

প্রধানত ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ বা চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ব্যাপক আকারে নতুন প্রযুক্তির সংযোগ করে উপযোগ তৈরী করে। সাইবার ফিজিক্যাল সিস্টেম ব্যবহার করে বাস্তব জগতের ভার্চুয়াল অনুলিপি তৈরী করা সম্ভব। এই সিস্টেমের বৈশিষ্টগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্বাধীনভাবে ডিসেন্ট্রালাইজড ডিসিশান নেওয়ার ক্ষমতা। ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ অনেকাংশেই বৈদ্যুতিন শনাক্তকরণের ওপর নির্ভর করতে পারে। সেক্ষেত্রে উৎপাদন পদ্বতিকে স্মার্ট করতে সেট টেকনোলজি স্থাপন করতে হবে। তাহলে আর ডিজিটাইজেশন এর প্রয়োজন হবে না।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপাদান

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মুখ্য চালক

  • ভার্টিক্যাল এবং হরাইজন্টাল ভ্যালু চেইনের সমন্বয় এবং ডিজিটালাইজেশন— ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ পণ্য উন্নয়ন, উৎপাদন, স্ট্রাকচারিং এবং সেবাসমূহকে ভার্টিকালি সমন্বয় করে। হরাইজন্টাল ভাবে সাপ্লায়ার থেকে শুরু করে গ্রাহকসহ অংশীদারদের সকল অভ্যন্তরীণ ক্রিয়াকলাপ সমন্বয় করে।
  • পণ্য এবং সেবাসমূহের ডিজিটাইজেশন- বিদ্যমান পণ্যের প্রসারণ বা নতুন ডিজিটাইজড পণ্য তৈরী করে কোম্পানিগুলোকে ডাটা তৈরী করে পণ্য পরিমার্জন করতে পারবে।
  • ডিজিটাল ব্যাবসায়িক মডেল এবং গ্রাহকদের প্রবেশাধিকার- গ্রাহক সন্তুষ্টি একটি চিরস্থায়ী প্রক্রিয়া। গ্রাহকদের পরিবর্তনশীল প্রয়োজনের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য সঠিক সময়ে সঠিক পরিবর্তন প্রয়োজন।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বৃহত্তম প্রবণতা কী কী

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হলো উৎপাদন পদ্বতিতে এবং প্রযুক্তিতে স্বয়ংক্রিয়করণ এবং তথ্য আদান-প্রদানের প্রচলন। এতে যে সকল ট্রেন্ড বা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাবে তা হলো— 

  • সাইবার ফিজিক্যাল সিস্টেম (Cyber Physical System) বা  সিপিএস (CPS)
  • Internet of Things (আইওটি)
  • ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইন্টারনেট অব থিংস (Industrial Internet of Things)
  • ক্লাউড কম্পিউটিং (Cloud Computing)
  • কগনিটিভ কম্পিউটিং (Cognitive Computing)
  • কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) ইত্যাদি।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এবং স্মার্ট কারখানা

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ব্যাপকভাবে ‘স্মার্ট ফ্যাক্টরি’ (Smart Factory) ধারণাটির পৃষ্ঠপোষকতা করে। মড্যুলার স্ট্রাকচারের স্মার্ট ফ্যাক্টরিগুলোতে সাইবার ফিজিক্যাল সিস্টেম সকল ভৌত প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে বাস্তব জগতের ভার্চুয়াল অনুলিপি তৈরী এবং কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ ছাড়াই প্রত্যাশিত ফলাফল প্রদান করতে পারে। স্মার্ট ফ্যাক্টরিতে ইন্টারনেট অব থিংস-এর মাধ্যমে সিস্টেমগুলো নিজেদের মধ্যে এবং মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপন এবং পরস্পরের সহায়তা করে। এরা সমগ্র প্রতিষ্ঠানজুড়েই ভ্যালু চেইনের সকল অংশের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম।

ভবিষ্যদ্বাণীমূলক রক্ষণাবেক্ষণ

আইওটি সেন্সর এবং প্রযুক্তির ব্যবহার করে ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ বা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে ব্যবহৃত মেশিনসমূহ রক্ষণাবেক্ষণ বিষয়ে পূর্বাভাস প্রদান করতে পারে। পূর্বাভাস বা ভবিষ্যদ্বাণী প্রদানে সক্ষম এই বিশেষ প্রক্রিয়াটি সরাসরি সমস্যা চিহ্নিত করতে পারবে যার ফলে মেশিন অচল বা নষ্ট হওয়ার অনেক আগেই সমস্যা নির্ধারণ করে সাশ্রয়ী খরচে তা সমাধান করা সম্ভব হবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের শতভাগ বাস্তবায়িত হলে। উদাহরণস্বরূপ, ধরা যাক লস অ্যাঞ্জেলসের একটি কোম্পানি বুঝতে পারল যে সিঙ্গাপুরে তাদের একটি যন্ত্রাংশ অস্বাভাবিক গতি বা তাপমাত্রায় কাজ করছে। তাহলে তারা যন্ত্রাংশটি মেরামত করার প্রয়োজন আছে কিনা সে বিষয়ে সিদ্বান্ত নিতে পারবে।

থ্রিডি প্রিন্টিং এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লব

বলা হয় যে, ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ বা চতুর্থ প্রজন্মের শিল্প ব্যাপকভাবে থ্রিডি প্রিন্টিং (3D Printing)-এর ওপর নির্ভর করবে। থ্রিডি প্রিন্টিং-এর ব্যবহার ইতোমধ্যেই বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে, এমন কি বাংলাদেশেও থ্রিডি প্রিন্টিং-এর ছোঁয়া লেগেছে অনেক আগেই।

থ্রিডি প্রিন্টিং-এর সুবিধা হলো এই পদ্ধতিতে অনেক ধরনের কাঠামো প্রিন্ট করা যায় এবং পণ্য নকশা করাও সহজ।

থ্রিডি প্রিন্টিং তুলনামূলকভাবে পরিবেশবান্ধব। স্বল্প পরিমাণে উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই পদ্বতিতে লিড টাইম এবং মোট উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে সক্ষম। তদুপরি থ্রিডি প্রিন্টিং  নমনীয়তা বৃদ্ধি করতে, গুদামজাতকরণের খরচ কমাতে এবং কোম্পানিকে ম্যাস কাস্টোমাইজেশন কৌশল গ্রহণ করতে সহায়তা করতে পারে।

উপরন্তু এটি স্পেয়ার পার্ট প্রিন্ট এবং লাগানোর জন্য বিশেষভাবে সহায়ক হতে পারে। এর ফলে সাপ্লায়ার নির্ভরতা এবং লীড টাইম হ্রাস পাবে।

থ্রিডি প্রিন্টিং এর ক্ষেত্রে নৈতিকতা এবং নিয়ণত্রণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিতভাবে মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরী হওয়া কিংবা কৃষিক্ষেত্র ছাড়াও মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপরও এর প্রভাব পড়তে পারে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে স্মার্ট সেন্সরের ব্যবহার

সেন্সর এবং ইন্সট্রুমেন্টেশন উদ্ভাবনকে ব্যবহারের উপযোগী করে মানুষের কল্যাণে চালিত করে। কেবল ইন্ডাস্ট্রি ৪.০-এর জন্য নয় বরং স্মার্ট উৎপাদন, স্মার্ট মবিলিটি, স্মার্ট হোমস, স্মার্ট শহর এবং স্মার্ট কারখানাগুলির মতো অন্যান্য স্মার্ট মেগাট্রেন্ডস (Smart Megatrends)-এর জন্যও।

স্মার্ট সেন্সর (Smart Censor) হলো সেসব ডিভাইস যেগুলো ডেটা তৈরী করে এবং সেলফ-মনিটরিং, সেলফ-কনফিগারেশনসহ জটিল প্রক্রিয়ার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। স্মার্ট সেন্সর ওয়্যারলেস যোগাযোগ করতে সক্ষম, আর এ জন্য এদের ইন্সটলেশন প্রক্রিয়া অনেকাংশেই সহজ এবং সে সাথে এসবের অ্যারেগুলো বুঝতে সুবিধা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন যে, ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ কোনোভাবেই সেন্সর সিস্টেম ছাড়া কোনো অগ্রসর হতে পারে না।

ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রে স্মার্ট সেন্সর ব্যবহারের একটি উদাহরণ হলো স্মার্ট ওয়াচ। স্মার্ট ওয়াচে সেন্সরগুলো ব্যবহারকারীর চলাচলের তথ্য গ্রহণ করে, তাদের প্রসেস করে এবং সবশেষে ব্যবহারকারী দিনে কয় পদক্ষেপ হেঁটেছে এমনকি কত ক্যালরি শক্তি ক্ষয় করেছে সে তথ্য প্রদান করে।

স্মার্ট সেন্সরের অসুবিধা থাকলে তা কী?

স্মার্ট সেন্সর ব্যবহারে বেশ কিছু অসুবিধা আছে যেমন—

  • সিনক্রোনাইজেশন ত্রুটি
  • ডেটা হারানো
  • বৃহৎ পরিসরে হারভেস্টেড ডেটা নিয়ে কাজ করা এসব একটি সম্পূর্ণ সিস্টেম বাস্তবায়নকে সীমাবদ্ধ করে
  • ব্যাটারি পাওয়ারও একটি অন্যতম সীমাবদ্বতা 

ইন্ডাস্ট্রি ৪.০-তে কৃষি ও খাদ্য শিল্প

খাদ্য ও শিল্প— এই দুই ক্ষেত্রে স্মার্ট সেন্সর এখনো অনেকটা পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আছে। এই উদ্ভাবনধর্মী, সংযুক্ত সেন্সরগুলি জমিতে প্রাপ্ত তথ্য (পাতা-সংক্রান্ত, ভেজিটেশন ইন্ডেক্স, ক্লোরোফিল, হাইগ্রোমেট্রি, তাপমাত্রা, পানির প্রাপ্যতা, বিকিরণ) সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে যোগাযোগ করে। এর উদ্দেশ্য হলো বৈজ্ঞানিক তথ্যসমূহের ওপর ভিত্তি করে স্মার্টফোন দিয়ে সঠিক সময়ে পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ প্রদান করে ফলাফল, সময় এবং অর্থের দিক দিয়ে জমি পরিচালনাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে কার্যকর করা।

খামারে স্মার্ট সেন্সর ব্যবহার করে শস্যের অবস্থা বোঝা যাবে এবং সঠিক সময়ে ইনপুট এবং চিকিৎসা পরামর্শ পাওয়া যাবে। এমনকি সেচের পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব: লিঙ্গবৈষম্য ও নারীদের ভূমিকা

গবেষকরা ধারণা করেন যে, ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ লিঙ্গবৈষম্যকে প্রভাবিত করবে। ভবিষ্যতে যে সকল পেশার অটোমেশন দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা কম তার মধ্যে অন্যতম হলো ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত (ম্যানেজারিয়াল) পেশা। এ ধরনের কাজের জন্য অবশ্যই জটিল পরিস্থিতিতে সিদ্বান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকতে হবে। নেতৃত্ব, কর্মদক্ষতা, মানবিক গুণের দিক দিয়ে নারীরা পুরুষদের চেয়ে এগিয়ে থাকার প্রমাণ থাকলেও নারীদের অপেক্ষাকৃত কম সুযোগ-সুবিধা ও অংশগ্রহণ, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জটিলতা, পূর্বের তুলনায় ঘন-ঘন এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা, বাঁধাধরা সামাজিক রীতি এসবই বৈষম্য তৈরী করতে পারে। আবার প্রায়োগিক বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণে নারীদের আগ্রহ এবং সুযোগ কম থাকায় অটোমেশনের ফলে নারীদের চাকরির ক্ষেত্র আরও কমে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হবে। সার্বিকভাবে নারীদের জন্য ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ এর সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলা আরও কঠিন হয়ে যেতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতা

ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতাসমূহ নিচে উল্লেখ করা হলো—

অর্থনৈতিক

  • উচ্চ ব্যয়
  • উপযুক্ত ব্যবসায়িক মডেলের সাথে খাপ খাওয়ানো
  • অস্পষ্ট অর্থনৈতিক সুবিধা/অতিরিক্ত বিনিয়োগ 

সামাজিক

  • ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিষয়ক উদ্বেগ
  • নজরদারি এবং অবিশ্বাস
  • অংশীদারদের পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেওয়ার অনীহা
  • কর্পোরেট আইটি ডিপার্টমেন্টের অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ার আশঙ্কা
  • সামাজিক বৈষম্য এবং অস্থিরতা বৃদ্বি
  • স্বয়ংক্রিয় এবং আইটি নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়ার জন্য বিশেষত শ্রমিকদের চাকরি হারানো

রাজনৈতিক

  • ব্যবস্থাপনা, মানদন্ড এবং সার্টিফিকেশন ফর্মের অভাব
  • জনসাধারণ বিশেষত বিরোধিতাকারীদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের সম্ভাব্যতা
  • অস্পষ্ট আইনি ব্যবস্থা এবং ডেটা সুরক্ষা

সাংগঠনিক

  • আইটি সুরক্ষাজনিত সমস্যা, যেগুলো পূর্বে বন্ধ থাকা দোকান পুনরায় চালু করার সহজাত প্রয়োজনের জন্য ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে
  • জটিল মেশিন টু মেশিন (M2M) যোগাযোগ স্থাপন, স্বল্প ও স্থিতিশীল বিলম্ব কাল রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় নির্ভরশীলতা ও স্থিতিশীলতা
  • উৎপাদন প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে অখন্ডতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা
  • যেকোনো ধরনের তথ্য প্রযুক্তিগত বাধা এড়িয়ে চলা কেননা এগুলো উৎপাদনে ব্যয়বহুল বিভ্রাট ঘটায়
  • শিল্প কৌশল সম্পর্কে প্রায়োগিক জ্ঞান রাখার প্রয়োজনীয়তা (ইন্ডাস্ট্রিয়াল অটোমেশন গিয়ারের কন্ট্রোল ফাইলগুলোতে অন্তুর্ভূক্ত থাকে)
  • চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে দ্রুত রূপান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রিক দক্ষতার অভাব
  • শীর্ষ পরিচালকবর্গের নিবেদনের অভাব
  • কর্মীদের অপর্যাপ্ত যোগ্যতা

উপসংহার

ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইন্টারনেট অব থিংসের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারকে বশ এবং জার্মানিতে ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এর প্রয়োগের মধ্যে আছে সেসব মেশিন যারা ফেইলিয়র-এর পূর্বাভাস দিয়ে নিজেরাই মেরামত করতে পারে এবং অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নিজে নিজেই সমন্বয় করতে পারে। ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ অ্যাকাডেমিয়া এবং গবেষণা ও উন্নয়নে ডিজিটাইজেশনের পৃষ্ঠপোষকতা করে যা ইনোভেশন ৪.০ নামে পরিচিত। ২০১৭ সালে লিভারপুল ইউনিভার্সিটিতে ৮১ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে কম্পিউটার-এইডেড ম্যানুফ্যাকচারিং এর কেন্দ্র হিসেবে ম্যাটেরিয়ালস ইনোভেশন ফ্যাক্টরির (এমআইএফ) উদ্বোধন করা হয় যেখানে রোবোটিক ফর্মুলেশন, ডেটা ক্যাপচার এবং মডেলিং উন্নয়ন কাজে ব্যবহ্রত হয়।

শেয়ার করুন

2 thoughts on “চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা Industry 4.0 কী? চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ইতিহাস, কৌশল, লক্ষ্যমাত্রা, প্রবণতা, উপাদান এবং প্রতিবন্ধকতা কী কী?

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা Industry 4.0 কী? চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ইতিহাস, কৌশল, লক্ষ্যমাত্রা, প্রবণতা, উপাদান এবং প্রতিবন্ধকতা কী কী?

প্রকাশ: ১১:৫৭:০৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন ২০২২

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা Industry 4.0 বর্তমানে খুবই আলোচিত একটি বিষয়। এই নিবন্ধে বিশ্লেষণ-এর পাঠকদের জন্য চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ধারণা, ইতিহাস, কৌশল, লক্ষ্যমাত্রা, প্রবণতা, উপাদান এবং প্রতিবন্ধকতাসহ নানা বিষয় তুলে ধরা হলো। একটু সময় নিয়ে ধীরেধীরে পড়ুন, আশা করা যায় চতুর্থবিপ্লব সম্পর্কে আপনি পরিস্কারভাবে বুঝতে পারবেন। মনে রাখবেন— এ সম্পর্কে আরও অধ্যয়নের জন্য আপনি বিভিন্ন বই ও রিসার্চ পেপারের সহায়তা নিন।

এখানে যা আছে

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা ইন্ডাস্ট্রি 4.0 কী?

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ (Industry 4.0) হলো আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন এবং শিল্প ব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়করণের একটি চলমান প্রক্রিয়া। ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব’ শব্দগুচ্ছ দিয়ে মূলতঃ মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই বেশিরভাগ সমস্যা নিরুপণ, সম্যসা বিশ্লেষণ, সমাধান প্রদান ও প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয়করণ করা, উন্নত যোগাযোগ এবং স্ব-পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার বাস্তবায়নে সক্ষম স্মার্ট মেশিন তৈরী করার জন্য বড়ো আকারে মেশিন-টু-মেশিন যোগাযোগ (Machine to Machine or M2M) এবং ইন্টারনেট অব থিংস (IoT) কে একত্র করার ধারণাকে চিহ্নিত করা হয়। স্ব-চালিত গাড়ি হলো চতুর্থ বিপ্লবের একটু উদাহরণ। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ইম্যাজিনেশন এইজ-এর সূচনা করে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ধারণা কীভাবে বা এর ইতিহাস কী?

‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব’-এর ইংরেজি টার্ম ‘ইন্ডাস্ট্রি ৪.০’ (Industry 4.0) সর্বপ্রথম প্রবর্তন করেন জার্মান সরকার কর্তৃক নিয়োজিত একদল বিজ্ঞানী। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (World Economic Forum) প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী চেয়ারম্যান ক্লাউস শোয়াব (Klaus Schwab) ২০১৫ সালে ফরেন অ্যাফেয়ার্স (Foreign Affairs)-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধের মাধ্যমে ‘ইন্ডাস্ট্রি ৪.০’ পদকে (term) বৃহৎ পরিসরে উপস্থাপন করেন। ২০১৬ সালে সুইজারল্যান্ডের ডেভোস-ক্লোস্টারস এ অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সভার বিষয়বস্তু ছিল ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে আয়ত্ত করা’।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জনক হলেন জার্মানির অর্থনীতিবিদ ক্লাউস শোয়াব।

ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ বা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জনক ক্লাউস শোয়াব।

অক্টোবর ১০, ২০১৬ তারিখ ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম স্যান ফ্র্যান্সিস্কোতে তাদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কেন্দ্র উদ্বোধনের ঘোষণা দেয়।

‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব’ ক্লাউস শোয়াবের ২০১৬ সালে প্রকাশিত একটি বইয়ের বিষয় এবং শিরোনামও ছিল। ক্লাউদ শোয়াবের চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সম্পর্কিত বইয়ের নাম ‘The Fourth Industrial Revolution’ (দ্য ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভোল্যুশন)।

ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ বা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জনক ক্লাউস শোয়াবের লেখা বই।

ক্লাউস শোয়াব চতুর্থ শিল্প বিপ্লব প্রসঙ্গে এমন সব প্রযুক্তির কথা উল্লেখ করেছেন যেগুলো হার্ডওয়্যার (Hardware), সফটওয়্যার (Software) এবং বায়োলজি (Biology) একসাথে নিয়ে তথা সাইবার-ফিজিক্যাল সিস্টেমস (Cyber-Physical system)-কে একত্রিত করে এবং পারস্পরিক সংযোগ স্থাপনের অগ্রগতির ওপর জোর দেয়।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বলতে হয় যে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগটি রোবোটিক্স (Robotics), কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা Artificial intelligence), ন্যানোটেকনোলজি (Nanotechnology), কোয়ান্টাম কম্পিউটিং (Quantum counting), বায়োটেকনোলজি (Biotechnology), ইন্টারনেট অফ থিংস (Internet of Things or IoT), ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইন্টারনেট অব থিংস (Industrial Internet of Things or IIoT), ডিসেন্ট্রালাইজড কনসেনসাস (Decentralised Consensus), পঞ্চম প্রজন্মের ওয়্যারলেস প্রযুক্তি (Fifth Generation Wireless Technology), থ্রিডি প্রিন্টিংয় (3D Printing) এবং সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় যানবাহন (Automatic Transportation) এর ক্ষেত্রে উদীয়মান প্রযুক্তির যুগান্তকারী যুগ হিসেবে চিহ্নিত হবে।

চতুর্থ শিল্প ও জার্মান কৌশল

‘ইন্ডাস্ট্রি ৪.০’ (Industry 4.0) সংক্ষেপে আই৪.০ (I4.0) বা শুধু আই৪ (I4) শব্দ বা পদ (Term) ২০১১ সালে জার্মান সরকারের একটি উচ্চ প্রযুক্তিগত কৌশলের একটি প্রকল্প থেকে সৃষ্ট, যেখানে উৎপাদন শিল্পে কম্পিউটারাইজেশনের বিকাশ সাধন করা হয় ।

২০১১ সালে জার্মানির হ্যানোভার ফেয়ারে (Hannover Messe) ‘ইন্ডাস্ট্রি ৪.০’ শব্দটিকে সর্বপ্রথম সর্বসমক্ষে প্রচার করা হয়। উল্লেখ্য, হ্যানোভার ফেয়ার বা হ্যানোভার মেসে হলো বিশ্বের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য মেলা (Trade fair)।

অক্টোবর, ২০১২ সালে জার্মানির ওই উচ্চ প্রযুক্তিগত কৌশল উদ্ভাবনের জন্য কার্যরত দল দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ বাস্তবায়নের সুপারিশ উপস্থাপন করে। এই দলের সদস্য এবং অংশীদারগণ ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ এর প্রতিষ্ঠাতা এবং চালিকা শক্তি হিসেবে স্বীকৃত। ২০১৩ সালের ৮ এপ্রিল হ্যানোভার ফেয়ারে কার্যরত দল তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। দলটির নেতৃত্বে ছিলেন রবার্ট বোশ জিএমবিএইচের সিগফ্রিড ডায়াস এবং জার্মান বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অ্যাকাডেমির হেনিং ক্যাগারম্যান (Henning Kagermann)।

কোম্পানিগুলো ‘ইন্ডাস্ট্রি ৪.০’-এর নীতিসমূহ প্রয়োগের ক্ষেত্রে কখনো কখনো নতুন করে সাজিয়ে নেয়। উদাহরণস্বরূপ, এরোস্পেস পার্টস প্রস্তুতকারক মেগগিট পিএলসি নিজস্ব ইন্ডাস্ট্রির ৪.০ গবেষণা প্রকল্প এম 4 তৈরী করেছে। 

“ইন্ডাস্ট্রি ৪.০” বিশেষত ডিজিটাইজেশন কিভাবে শ্রমবাজারে প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে জার্মানিতে ওয়ার্ক ৪.০ শীর্ষক আলোচনা হচ্ছে। 

জার্মান সরকারের ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ কৌশলের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো অত্যন্ত ফ্লেক্সিবল উৎপাদনের (বৃহৎ আকারে) শর্তে পণ্যের প্রবল স্বনির্ধারণ (কাস্টোমাইজেশন)। সেলফ-অপটিমাইজেশন, সেলফ-কনফিগারেশন, সেলফ-ডায়াগনজ, কগনিশন এর প্রবর্তন এবং ক্রমবর্ধমান জটিল কাজে কর্মীদের বুদ্বিমান সহায়তায় প্রয়োজনীয় স্বয়ংক্রিয়করণ প্রযুক্তির বিকাশ ঘটে চলেছে। ২০১৩ সালের জুলাই পর্যন্ত ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ এর বৃহত্তম প্রকল্প হলো জার্মান ফেডারেল শিক্ষা ও গবেষণা মন্ত্রক (বিএমবিএফ) এর শীর্ষস্থানীয় ক্লাস্টার প্রকল্প “ইন্টেলিজেন্ট টেকনিক্যাল সিস্টেমস অস্টওয়েস্টফ্যালেন-লিপ্পে (ইটস ওডাব্লুএল)। আরেকটি বড় প্রকল্প হলো বিএমবিএফ এর রেস-কম এছাড়াও ক্লাস্টার অব এক্সিলেন্স “ইন্টিগ্রেটিভ প্রোডাকশন টেকনোলজি ফর হাই-ওয়েজ কান্ট্রিজ”। ২০১৫ সালে ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ এর পৃষ্ঠপোষকতার জন্য ইউরোপীয় কমিশন CREMA (XaaS এবং ক্লাউড মডেলের ওপর ভিত্তি করে ক্লাউড ভিত্তিক র‍্যাপিড ইলাস্টিক ম্যানুফ্যাকচারিং) দিগন্ত 2020 নামের একটি গবেষণা প্রকল্প শুরু করে।

পরিবর্তনের গতিই হলো ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ এর নির্ণায়ক। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের গতি এবং এর ফলে মানুষের জীবনের আর্থ-সামাজিক এবং অবকাঠামোগত পরিবর্তনের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক আছে যা আমাদের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নির্দেশ করে এবং একটি নতুন যুগকে চিহ্নিত করে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পরিকল্পনা নীতিমালা এবং লক্ষ্যমাত্রা

পরিকল্পনা নীতি

শিল্প ৪.০ এর অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে চিহ্নিত চারটি পরিকল্পনা নীতি রয়েছে:

  1. আন্তঃসংযোগ: মেশিন, ডিভাইস, সেন্সর এবং মানুষের পরস্পরের মধ্যে ইন্টারনেট অফ থিংস অথবা ইন্টারনেট অফ পিউপল (আইওপি) এর মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন এবং যোগাযোগের ক্ষমতা।
  2. তথ্যের স্বচ্ছতা: ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ তথ্যের স্বচ্ছতা দেয় যা অপারেটরদের সিদ্বান্ত নেওয়ার জন্য ব্যাপক তথ্য সরবরাহ করে। আন্তঃসংযোগের কারনে অপারেটর উৎপাদন প্রক্রিয়ার সমস্ত পয়েন্ট থেকে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করতে পারে এবং সেসব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা শনাক্ত করতে পারে যেগুলো সিস্টেমের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করলে আরও কার্যকর হবে।
  3. প্রযুক্তিগত সহায়তা: সিদ্বান্ত গ্রহণ এবং সমস্যার সমাধানে মানুষকে সহায়তা করার জন্য সিস্টেমের প্রযুক্তিগত সুবিধা এবং কঠিন বা অনিরাপদ কাজের ক্ষেত্রে সহায়তা করার ক্ষমতা।
  4. বিকেন্দ্রীভূত সিদ্ধান্ত: সাইবার ফিজিক্যাল সিস্টেমের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং স্বতন্ত্রভাবে তাদের কাজ যথাসম্ভব সম্পাদন করার ক্ষমতা। কেবল কোনো ব্যতিক্রম, হস্তক্ষেপ বা সাংঘর্ষিক লক্ষ্যের ক্ষেত্রে উচ্চস্তরে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপাদান কী কী?

আমাদের সমাজ এবং চলতি ট্রেন্ডগুলোকে গভীরভাবে দেখলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব অনেকগুলো উপাদানে ভাগ করা যায়। এই উপাদানগুলো কতটা ব্যাপক তা বুঝার জন্য উদাহরণস্বরূপ কিছু উল্লেখযোগ্য ডিজিটাল প্রযুক্তির নাম দেয়া হলো—

  • মোবাইল ডিভাইস
  • ইন্টারনেট অব থিংস  প্ল্যাটফর্ম (Internet of Things – Iot)
  • অবস্থান সনাক্তকরণ প্রযুক্তি (বৈদ্যুতিক সনাক্তকরণ)
  • উন্নত মানব-মেশিন ইন্টারফেস
  • প্রমাণীকরণ এবং জালিয়াতি সনাক্তকরণ
  • স্মার্ট সেন্সর
  • বিগ অ্যানালিটিকস এবং উন্নত প্রক্রিয়া
  • বহুস্তরীয় গ্রাহক ইন্টারঅ্যাকশন এবং গ্রাহক প্রোফাইলিং
  • অগমেন্টেড রিয়েলিটি অথবা ওয়্যারেবল টেকনোলজি (Augmented Reality or Wearable Technology)
  • চাহিদা সাপেক্ষে কম্পিউটার সিস্টেম রিসোর্সের প্রাপ্যতা
  • সাইবার-ফিজিক্যাল সিস্টেম
  • চাহিদা সাপেক্ষে কম্পিউটার সিস্টেম রিসোর্সের প্রাপ্যতা
  • কগনিটিভ কম্পিউটিং

প্রধানত ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ বা চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ব্যাপক আকারে নতুন প্রযুক্তির সংযোগ করে উপযোগ তৈরী করে। সাইবার ফিজিক্যাল সিস্টেম ব্যবহার করে বাস্তব জগতের ভার্চুয়াল অনুলিপি তৈরী করা সম্ভব। এই সিস্টেমের বৈশিষ্টগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্বাধীনভাবে ডিসেন্ট্রালাইজড ডিসিশান নেওয়ার ক্ষমতা। ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ অনেকাংশেই বৈদ্যুতিন শনাক্তকরণের ওপর নির্ভর করতে পারে। সেক্ষেত্রে উৎপাদন পদ্বতিকে স্মার্ট করতে সেট টেকনোলজি স্থাপন করতে হবে। তাহলে আর ডিজিটাইজেশন এর প্রয়োজন হবে না।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপাদান

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মুখ্য চালক

  • ভার্টিক্যাল এবং হরাইজন্টাল ভ্যালু চেইনের সমন্বয় এবং ডিজিটালাইজেশন— ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ পণ্য উন্নয়ন, উৎপাদন, স্ট্রাকচারিং এবং সেবাসমূহকে ভার্টিকালি সমন্বয় করে। হরাইজন্টাল ভাবে সাপ্লায়ার থেকে শুরু করে গ্রাহকসহ অংশীদারদের সকল অভ্যন্তরীণ ক্রিয়াকলাপ সমন্বয় করে।
  • পণ্য এবং সেবাসমূহের ডিজিটাইজেশন- বিদ্যমান পণ্যের প্রসারণ বা নতুন ডিজিটাইজড পণ্য তৈরী করে কোম্পানিগুলোকে ডাটা তৈরী করে পণ্য পরিমার্জন করতে পারবে।
  • ডিজিটাল ব্যাবসায়িক মডেল এবং গ্রাহকদের প্রবেশাধিকার- গ্রাহক সন্তুষ্টি একটি চিরস্থায়ী প্রক্রিয়া। গ্রাহকদের পরিবর্তনশীল প্রয়োজনের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য সঠিক সময়ে সঠিক পরিবর্তন প্রয়োজন।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বৃহত্তম প্রবণতা কী কী

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হলো উৎপাদন পদ্বতিতে এবং প্রযুক্তিতে স্বয়ংক্রিয়করণ এবং তথ্য আদান-প্রদানের প্রচলন। এতে যে সকল ট্রেন্ড বা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাবে তা হলো— 

  • সাইবার ফিজিক্যাল সিস্টেম (Cyber Physical System) বা  সিপিএস (CPS)
  • Internet of Things (আইওটি)
  • ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইন্টারনেট অব থিংস (Industrial Internet of Things)
  • ক্লাউড কম্পিউটিং (Cloud Computing)
  • কগনিটিভ কম্পিউটিং (Cognitive Computing)
  • কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) ইত্যাদি।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এবং স্মার্ট কারখানা

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ব্যাপকভাবে ‘স্মার্ট ফ্যাক্টরি’ (Smart Factory) ধারণাটির পৃষ্ঠপোষকতা করে। মড্যুলার স্ট্রাকচারের স্মার্ট ফ্যাক্টরিগুলোতে সাইবার ফিজিক্যাল সিস্টেম সকল ভৌত প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে বাস্তব জগতের ভার্চুয়াল অনুলিপি তৈরী এবং কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ ছাড়াই প্রত্যাশিত ফলাফল প্রদান করতে পারে। স্মার্ট ফ্যাক্টরিতে ইন্টারনেট অব থিংস-এর মাধ্যমে সিস্টেমগুলো নিজেদের মধ্যে এবং মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপন এবং পরস্পরের সহায়তা করে। এরা সমগ্র প্রতিষ্ঠানজুড়েই ভ্যালু চেইনের সকল অংশের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম।

ভবিষ্যদ্বাণীমূলক রক্ষণাবেক্ষণ

আইওটি সেন্সর এবং প্রযুক্তির ব্যবহার করে ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ বা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে ব্যবহৃত মেশিনসমূহ রক্ষণাবেক্ষণ বিষয়ে পূর্বাভাস প্রদান করতে পারে। পূর্বাভাস বা ভবিষ্যদ্বাণী প্রদানে সক্ষম এই বিশেষ প্রক্রিয়াটি সরাসরি সমস্যা চিহ্নিত করতে পারবে যার ফলে মেশিন অচল বা নষ্ট হওয়ার অনেক আগেই সমস্যা নির্ধারণ করে সাশ্রয়ী খরচে তা সমাধান করা সম্ভব হবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের শতভাগ বাস্তবায়িত হলে। উদাহরণস্বরূপ, ধরা যাক লস অ্যাঞ্জেলসের একটি কোম্পানি বুঝতে পারল যে সিঙ্গাপুরে তাদের একটি যন্ত্রাংশ অস্বাভাবিক গতি বা তাপমাত্রায় কাজ করছে। তাহলে তারা যন্ত্রাংশটি মেরামত করার প্রয়োজন আছে কিনা সে বিষয়ে সিদ্বান্ত নিতে পারবে।

থ্রিডি প্রিন্টিং এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লব

বলা হয় যে, ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ বা চতুর্থ প্রজন্মের শিল্প ব্যাপকভাবে থ্রিডি প্রিন্টিং (3D Printing)-এর ওপর নির্ভর করবে। থ্রিডি প্রিন্টিং-এর ব্যবহার ইতোমধ্যেই বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে, এমন কি বাংলাদেশেও থ্রিডি প্রিন্টিং-এর ছোঁয়া লেগেছে অনেক আগেই।

থ্রিডি প্রিন্টিং-এর সুবিধা হলো এই পদ্ধতিতে অনেক ধরনের কাঠামো প্রিন্ট করা যায় এবং পণ্য নকশা করাও সহজ।

থ্রিডি প্রিন্টিং তুলনামূলকভাবে পরিবেশবান্ধব। স্বল্প পরিমাণে উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই পদ্বতিতে লিড টাইম এবং মোট উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে সক্ষম। তদুপরি থ্রিডি প্রিন্টিং  নমনীয়তা বৃদ্ধি করতে, গুদামজাতকরণের খরচ কমাতে এবং কোম্পানিকে ম্যাস কাস্টোমাইজেশন কৌশল গ্রহণ করতে সহায়তা করতে পারে।

উপরন্তু এটি স্পেয়ার পার্ট প্রিন্ট এবং লাগানোর জন্য বিশেষভাবে সহায়ক হতে পারে। এর ফলে সাপ্লায়ার নির্ভরতা এবং লীড টাইম হ্রাস পাবে।

থ্রিডি প্রিন্টিং এর ক্ষেত্রে নৈতিকতা এবং নিয়ণত্রণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিতভাবে মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরী হওয়া কিংবা কৃষিক্ষেত্র ছাড়াও মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপরও এর প্রভাব পড়তে পারে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে স্মার্ট সেন্সরের ব্যবহার

সেন্সর এবং ইন্সট্রুমেন্টেশন উদ্ভাবনকে ব্যবহারের উপযোগী করে মানুষের কল্যাণে চালিত করে। কেবল ইন্ডাস্ট্রি ৪.০-এর জন্য নয় বরং স্মার্ট উৎপাদন, স্মার্ট মবিলিটি, স্মার্ট হোমস, স্মার্ট শহর এবং স্মার্ট কারখানাগুলির মতো অন্যান্য স্মার্ট মেগাট্রেন্ডস (Smart Megatrends)-এর জন্যও।

স্মার্ট সেন্সর (Smart Censor) হলো সেসব ডিভাইস যেগুলো ডেটা তৈরী করে এবং সেলফ-মনিটরিং, সেলফ-কনফিগারেশনসহ জটিল প্রক্রিয়ার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। স্মার্ট সেন্সর ওয়্যারলেস যোগাযোগ করতে সক্ষম, আর এ জন্য এদের ইন্সটলেশন প্রক্রিয়া অনেকাংশেই সহজ এবং সে সাথে এসবের অ্যারেগুলো বুঝতে সুবিধা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন যে, ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ কোনোভাবেই সেন্সর সিস্টেম ছাড়া কোনো অগ্রসর হতে পারে না।

ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রে স্মার্ট সেন্সর ব্যবহারের একটি উদাহরণ হলো স্মার্ট ওয়াচ। স্মার্ট ওয়াচে সেন্সরগুলো ব্যবহারকারীর চলাচলের তথ্য গ্রহণ করে, তাদের প্রসেস করে এবং সবশেষে ব্যবহারকারী দিনে কয় পদক্ষেপ হেঁটেছে এমনকি কত ক্যালরি শক্তি ক্ষয় করেছে সে তথ্য প্রদান করে।

স্মার্ট সেন্সরের অসুবিধা থাকলে তা কী?

স্মার্ট সেন্সর ব্যবহারে বেশ কিছু অসুবিধা আছে যেমন—

  • সিনক্রোনাইজেশন ত্রুটি
  • ডেটা হারানো
  • বৃহৎ পরিসরে হারভেস্টেড ডেটা নিয়ে কাজ করা এসব একটি সম্পূর্ণ সিস্টেম বাস্তবায়নকে সীমাবদ্ধ করে
  • ব্যাটারি পাওয়ারও একটি অন্যতম সীমাবদ্বতা 

ইন্ডাস্ট্রি ৪.০-তে কৃষি ও খাদ্য শিল্প

খাদ্য ও শিল্প— এই দুই ক্ষেত্রে স্মার্ট সেন্সর এখনো অনেকটা পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আছে। এই উদ্ভাবনধর্মী, সংযুক্ত সেন্সরগুলি জমিতে প্রাপ্ত তথ্য (পাতা-সংক্রান্ত, ভেজিটেশন ইন্ডেক্স, ক্লোরোফিল, হাইগ্রোমেট্রি, তাপমাত্রা, পানির প্রাপ্যতা, বিকিরণ) সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে যোগাযোগ করে। এর উদ্দেশ্য হলো বৈজ্ঞানিক তথ্যসমূহের ওপর ভিত্তি করে স্মার্টফোন দিয়ে সঠিক সময়ে পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ প্রদান করে ফলাফল, সময় এবং অর্থের দিক দিয়ে জমি পরিচালনাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে কার্যকর করা।

খামারে স্মার্ট সেন্সর ব্যবহার করে শস্যের অবস্থা বোঝা যাবে এবং সঠিক সময়ে ইনপুট এবং চিকিৎসা পরামর্শ পাওয়া যাবে। এমনকি সেচের পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব: লিঙ্গবৈষম্য ও নারীদের ভূমিকা

গবেষকরা ধারণা করেন যে, ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ লিঙ্গবৈষম্যকে প্রভাবিত করবে। ভবিষ্যতে যে সকল পেশার অটোমেশন দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা কম তার মধ্যে অন্যতম হলো ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত (ম্যানেজারিয়াল) পেশা। এ ধরনের কাজের জন্য অবশ্যই জটিল পরিস্থিতিতে সিদ্বান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকতে হবে। নেতৃত্ব, কর্মদক্ষতা, মানবিক গুণের দিক দিয়ে নারীরা পুরুষদের চেয়ে এগিয়ে থাকার প্রমাণ থাকলেও নারীদের অপেক্ষাকৃত কম সুযোগ-সুবিধা ও অংশগ্রহণ, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জটিলতা, পূর্বের তুলনায় ঘন-ঘন এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা, বাঁধাধরা সামাজিক রীতি এসবই বৈষম্য তৈরী করতে পারে। আবার প্রায়োগিক বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণে নারীদের আগ্রহ এবং সুযোগ কম থাকায় অটোমেশনের ফলে নারীদের চাকরির ক্ষেত্র আরও কমে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হবে। সার্বিকভাবে নারীদের জন্য ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ এর সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলা আরও কঠিন হয়ে যেতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতা

ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতাসমূহ নিচে উল্লেখ করা হলো—

অর্থনৈতিক

  • উচ্চ ব্যয়
  • উপযুক্ত ব্যবসায়িক মডেলের সাথে খাপ খাওয়ানো
  • অস্পষ্ট অর্থনৈতিক সুবিধা/অতিরিক্ত বিনিয়োগ 

সামাজিক

  • ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিষয়ক উদ্বেগ
  • নজরদারি এবং অবিশ্বাস
  • অংশীদারদের পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেওয়ার অনীহা
  • কর্পোরেট আইটি ডিপার্টমেন্টের অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ার আশঙ্কা
  • সামাজিক বৈষম্য এবং অস্থিরতা বৃদ্বি
  • স্বয়ংক্রিয় এবং আইটি নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়ার জন্য বিশেষত শ্রমিকদের চাকরি হারানো

রাজনৈতিক

  • ব্যবস্থাপনা, মানদন্ড এবং সার্টিফিকেশন ফর্মের অভাব
  • জনসাধারণ বিশেষত বিরোধিতাকারীদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের সম্ভাব্যতা
  • অস্পষ্ট আইনি ব্যবস্থা এবং ডেটা সুরক্ষা

সাংগঠনিক

  • আইটি সুরক্ষাজনিত সমস্যা, যেগুলো পূর্বে বন্ধ থাকা দোকান পুনরায় চালু করার সহজাত প্রয়োজনের জন্য ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে
  • জটিল মেশিন টু মেশিন (M2M) যোগাযোগ স্থাপন, স্বল্প ও স্থিতিশীল বিলম্ব কাল রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় নির্ভরশীলতা ও স্থিতিশীলতা
  • উৎপাদন প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে অখন্ডতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা
  • যেকোনো ধরনের তথ্য প্রযুক্তিগত বাধা এড়িয়ে চলা কেননা এগুলো উৎপাদনে ব্যয়বহুল বিভ্রাট ঘটায়
  • শিল্প কৌশল সম্পর্কে প্রায়োগিক জ্ঞান রাখার প্রয়োজনীয়তা (ইন্ডাস্ট্রিয়াল অটোমেশন গিয়ারের কন্ট্রোল ফাইলগুলোতে অন্তুর্ভূক্ত থাকে)
  • চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে দ্রুত রূপান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রিক দক্ষতার অভাব
  • শীর্ষ পরিচালকবর্গের নিবেদনের অভাব
  • কর্মীদের অপর্যাপ্ত যোগ্যতা

উপসংহার

ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইন্টারনেট অব থিংসের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারকে বশ এবং জার্মানিতে ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এর প্রয়োগের মধ্যে আছে সেসব মেশিন যারা ফেইলিয়র-এর পূর্বাভাস দিয়ে নিজেরাই মেরামত করতে পারে এবং অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নিজে নিজেই সমন্বয় করতে পারে। ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ অ্যাকাডেমিয়া এবং গবেষণা ও উন্নয়নে ডিজিটাইজেশনের পৃষ্ঠপোষকতা করে যা ইনোভেশন ৪.০ নামে পরিচিত। ২০১৭ সালে লিভারপুল ইউনিভার্সিটিতে ৮১ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে কম্পিউটার-এইডেড ম্যানুফ্যাকচারিং এর কেন্দ্র হিসেবে ম্যাটেরিয়ালস ইনোভেশন ফ্যাক্টরির (এমআইএফ) উদ্বোধন করা হয় যেখানে রোবোটিক ফর্মুলেশন, ডেটা ক্যাপচার এবং মডেলিং উন্নয়ন কাজে ব্যবহ্রত হয়।