দিমিত্রি মেন্ডেলিয়েভের অভাব্য চিন্তাশক্তি
- প্রকাশ: ০৭:৫৮:১৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১১ মার্চ ২০২২
- / ১২০৯ বার পড়া হয়েছে
ছাত্র থাকা অবস্থায় অধ্যয়নের কিছু কিছু বিষয় আমাদের শিক্ষা জীবনে, এমনকি কর্ম জীবনেও পাথেয় হয়ে থাকে। আমাদের পাঠ্যসূচিতে সেরকমই একটি বিষয় ছিল ‘পর্যায় সারণি’ বা পিরিয়ডিক টেবিল (Periodic table)’। সত্তর দশকের গোড়ার দিকে যখন উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পড়ালেখা শেষ করেছি, তখন সে সময় মোট ১০৫টি মৌল হয় প্রকৃতি থেকে পাওয়া বা গবেষণাগারে আবিষ্কৃত হয়েছিল। ১০৫ নম্বর মৌলটি ছিল ডুবনিয়াম (Dubnium -Db), অতিমাত্রায় তেজস্ক্রিয় একটি আইসোটোপ। রাশিয়ার ডুবনা শহরের নামানুসারে এই মৌলটির নামকরণ করা হয়, কারণ সেখানেই এর প্রথম উৎপত্তি। এর অর্ধেক জীবন হচ্ছে প্রায় ২৮ ঘণ্টা। কিন্তু ডুবনিয়ামের পরে পর্যায়ক্রমে আরও ১৩টি পরমাণুর আবিষ্কার হয়েছে যা পর্যায় সারণিতে সংযুক্ত হয়েছে।
দিমিত্রি ইভানোভিচ মেন্দেলিয়েভ রসায়নশাস্ত্রে এক কিংবদন্তি। তিনি একজন রুশ রসায়নবিদ ও উদ্ভাবক। মৌলিক পদার্থসমূহের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম বিশ্লেষণ করে তিনি মৌলসমূহের পর্যায়ভিত্তিক ধর্ম আবিষ্কার করেন এবং তা কাজে লাগিয়ে সর্বপ্রথম একটি আধুনিক সার্থক ‘পর্যায় সারণি’ তৈরি করেন। তিনি রাশিয়ার ‘সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে সেখানেই দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষকতা ও গবেষণা করেন। ‘পানি ও অ্যালকোহলের মধ্যে সংযোগ’ নিয়ে তার অসামান্য গবেষণার কৃতিত্বে ১৮৬৫ সনে তিনি ‘ডক্টর অব ফিলোসফি’ ডিগ্রি অর্জন করেন।
মেন্ডেলিয়েভের মৌল তালিকা দেয়ার হাজার বছর আগে থেকেই মৌলিক পদার্থের সত্যিকার ধারণা দিতে বিভিন্ন গবেষক ও বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন চিন্তা ভাবনা করেছেন। তাদের মধ্যে দার্শনিক ডেমোক্রিটাস ও অ্যারিস্টটল, আরব বিজ্ঞানী জাবির ইবনে হাইয়ান, সুইস চিকিৎসা বিজ্ঞানী প্যারাসেলসাস অন্যতম। ১৮০৩ সালে ইংরেজ পদার্থ ও রসায়ন বিজ্ঞানী জন ডাল্টন পরমাণু সম্পর্কে একটি তত্ত্ব প্রকাশ করেন যা ‘ডাল্টনের পরমাণুবাদ’ নামে পরিচিত। এরপরই আস্তে আস্তে মৌলিক পদার্থের সত্যিকার ধারণা মানুষ বুঝতে শুরু করে। ততদিনে মানুষ বুঝে ফেলেছে যে মৌলিক পদার্থের যে ক্ষুদ্রতম কণার মধ্যে মৌলটির সমস্ত ধর্ম উপস্থিত থাকে এবং যা রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে তাকে মৌলিক পদার্থটির ‘পরমাণু’ বলে। ডাল্টন পরমাণুবাদে পরমাণুকে অবিভাজ্য ধরা হয়েছে। কিন্তু পরমাণুবাদের এই ‘অবিভাজ্য’ তত্ত্বটি এখন অচল। কারণ, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে প্রমাণিত হয় যে, পরমাণুর তিনটি উপাদান। এরা হচ্ছে ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রন ।
মৌলিক পদার্থই হচ্ছে সব পদার্থ তৈরির মূল। তাই অনেক বিজ্ঞানী চেষ্টা করেছেন মৌলগুলিকে একসঙ্গে করে কীভাবে একটি উপযোগী তালিকা করা যায়। অবশেষে, সবাইকে চমকিয়ে দিয়ে সার্ধশত বছর আগে ১৮৬৯ সালে দিমিত্রি মেন্ডেলিয়েভ ৬৩ মৌলের সমন্বয়ে তাঁর ‘পর্যায় সারণি’ প্রকাশ করেন। তিনি তাঁর তালিকা সাজিয়েছিলেন পারমাণবিক ভরের ওপর ভিত্তি করে। কারণ, তত দিনে বিজ্ঞানীরা জেনে গেছেন যে প্রতিটা মৌলের একটা নির্দিষ্ট পারমাণবিক ভর (atomic mass) আছে। পারমাণবিক ভর হলো কোন মৌলিক পদার্থের একটি পরমাণুর ভর। মেন্ডেলিয়েভ তাঁর ‘পর্যায় সারণি’তে শুধু জানা মৌলের তালিকাই নয়, অজানা মৌলের অস্তিত্বের কথাও তিনি জানিয়েছেন। বর্তমানে একের পর এক কৃত্রিম মৌল তৈরি হয়েছে গবেষণাগারে, যা প্রকৃতিতে কোন সময় ছিল না। তাই, মেন্ডেলিয়েভের ৬৩ মৌলের তালিকা এখন ১১৮-তে গিয়ে ঠেকেছে।
পারমাণবিক ভরের ওপর ভিত্তি করে মেন্ডেলিয়েভ মৌলগুলির খুব সুন্দর একটি ছক তৈরি করেন যা পর্যায়ক্রমে কতগুলো সারি বা পিরিয়ড ও কলাম বা গ্ৰুপে মৌলগুলোকে সাজানো হয়েছে, তাতে মৌলগুলির ধর্মও মিলে যায় বেশ। পিরিয়ড আর গ্রুপ মিলে হয় আমাদের পর্যায় সারণি।
তবে, দিমিত্রি মেন্ডেলিয়েভের পর্যায় সারণি তৈরির প্রায় তিন দশক পরে জটিলতা বাধে যখন ইলেকট্রন আবিষ্কার করেন নোবেল বিজয়ী ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্যার জোসেফ জন থমসন ১৮৯৭ সালে। তখন জানা গেলো পরমাণু কোনো অবিভাজ্য বস্তু নয়, বরং তারও একটি গঠন আছে। আধুনিক রসায়ণ যুগে ও পদার্থবিজ্ঞানে নতুন তত্ত্ব যেমন কোয়ান্টাম তত্ত্বে পরমাণু গঠন সমন্ধে ধারণা আরও প্রসারিত হয়। পরমাণু গঠনের আধুনিক তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা ডেনিশ পদার্থবিজ্ঞানী নেল্স হেনরিক বোর পরমাণু মডেলকে সূর্যের কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান গ্রহের সাথে তুলনা করেন। তিনি প্রমাণ করেন পরমাণুর কেন্দ্রে নিউক্লিয়াস অবস্থিত এবং কীভাবে নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘূর্ণায়মান ইলেকট্রন স্তরে স্তরে অবস্থান করে। পর্যায় সারণিতে এক গ্রুপের মৌলগুলো যে প্রায় একই ধর্ম ধারণ করে তার মূলে আছে ওই পরমাণুর চারপাশে থাকা ইলেকট্রন বিন্যাস। বোরের পরমাণু মডেল রসায়নের ইতিহাসে আজও বিখ্যাত হয়ে আছে। মূলত পদার্থের আণবিক গঠন এবং কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানে তাঁর অবদানের জন্য ১৯২২ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পান।
নিউজিল্যান্ডীয় নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড ও ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী স্যার জেমস চ্যাডউইক যথাক্রমে আবিষ্কার করেন প্রোটন ও নিউট্রন। উভয়-ই ছিলেন নোবেল বিজয়ী। প্রোটন একটি মৌলিক কণিকা। এটি স্থিতিশীল। নিউট্রনসংখ্যা সাধারণত প্রোটনের কাছাকাছি হয়। এটি আধানবিহীন (neutral) হওয়ায় এর নাম দেয়া হয়েছে নিউট্রন। প্রোটনের সাথে ইলেকট্রনের পার্থক্য শুধু এটুকুই যে, ইলেকট্রনের আধান (charge) ঋণাত্মক আর প্রোটনের আধান ধনাত্মক। প্রোটন আর নিউট্রন থাকে পরমাণুর কেন্দ্রে, যাকে বলে নিউক্লিয়াস। তাহলে দেখা যাচ্ছে একটি পরমাণুতে থাকে ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন। নিউক্লিয়াসে বিদ্যমান প্রোটনের সংখ্যা-ই নির্ণয় করে দেয় সেইটা কিসের পরমাণু। যেমন ১৯টি প্রোটন থাকলে সেটা পটাসিয়াম, ২০টি প্রোটন থাকলে ক্যালসিয়াম। তেমনিভাবে পারমাণবিক সংখ্যা ১১৮ হলো একটি কৃত্রিম রাসায়নিক উপাদান ‘ওগানেসন’ (আবিষ্কারক রাশিয়ান পারমাণবিক পদার্থবিদ ইউরি ওগানেসিয়ান), যা পর্যায়সারণিতে তালিকাভুক্ত এ যাবৎ সবচেয়ে ভারী মৌল। তেজস্ক্রিয় ওগানেসন খুবই অস্থায়ী একটি মৌল। এর অর্ধেক জীবন এক মিলিসেকেন্ডের থেকেও কম। তবে প্রকৃতি থেকে পাওয়া সব থেকে ভারী মৌল হচ্ছে ইউরেনিয়াম যা পর্যায় সারণীর ৯২তম মৌল। তাছাড়া, অসমিয়ামকেও (পারমাণবিক সংখ্যা ৭৬) ঘনত্বের বিচারে একটি ভারী মৌল ধরা হয় । এটি সীসার থেকে প্রায় দ্বিগুণ ঘন।
একটি পরমাণুতে সাধারণত যতগুলো প্রোটন থাকে, ইলেকট্রনও থাকে ঠিক ততটা। সেই কারণে প্রোটন ও ইলেকট্রনের আধান সমমানের। তবে, নিউক্লিয়াসের বাইরে অবস্থিত ইলেকট্রন মাঝেমধ্যে একটা–দুইটা ছুটে যেতে পারে বা বাড়তিও হতে পারে। এই অবস্থাকে বলা হয় আয়নিত অবস্থা বা চার্জিত অবস্থা। ইলেকট্রন নিয়ে বা দিয়ে একটা পরমাণু খুব সহজেই ফিরে যেতে পারে তার আগের অবস্থায়।
প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, আদিতে পর্যায় সারণি পারমাণবিক ভর দ্বারা ব্যাখ্যা করা হতো, কিন্তু পারমাণবিক ভরের ক্রম ঠিক না থাকায় তা নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে পর্যায়বৃত্ত ধর্ম অনুসারে মৌলসমূহের রাসায়নিক ধর্ম পর্যায়বৃত্তভাবে ব্যাপকহারে পরিবর্তীত হয় এবং সেটিই বর্তমানে পর্যায় সারণির ভিত্তি রচনা করেছে। ১৯১৩ সালে বিজ্ঞানী অঁরি মোসলে পারমাণবিক সংখ্যার ধারণা প্রবর্তন করে প্রতিটি পরমাণুর মধ্যস্থিত প্রোটন সংখ্যা দ্বারা পর্যায়বৃত্ত ধর্ম ব্যাখ্যা করেন। পর্যায়বৃত্ত ধর্ম হলো কোন মৌলের গ্রুপ এবং পর্যায় পরিবর্তনের ফলে যেসব ধর্মাবলী পর্যায়ক্রমে আবর্তিত হয়। এসব ধর্ম পর্যায় সারণিতে মৌলের অবস্থান পরিবর্তনের উপর ভিত্তি করে পরিবর্তিত হয়। আবার, সে বছরেই নেলস বোর দেখান যে, ইলেকট্রনই প্রকৃতপক্ষে পর্যায় সারণির মূল ভিত্তি।
এখন অনেকেরই কৌতূহল যে ১১৮ নম্বর ভারী মৌলের পর আরও ভারী কোনো পরমাণু গবেষণাগারে সৃষ্টি করা সম্ভব হবে কি না। রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশের বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করেছেন ১১৯ বা ১২০ উৎপাদন করতে- তবে, সেখানে সফলতা আসেনি। ১১৯/১২০ বা আরও বেশি পারমাণবিক সংখ্যার মৌল আমাদের বর্তমান জানা প্রযুক্তিতে পাওয়া সম্ভব না বলেই মনে করছেন বেশির ভাগ বিজ্ঞানী। তৈরি হলেও তা কতক্ষণ স্থায়ী হবে সেটা নিয়েও এক বড় প্রশ্ন!