১১:০২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

SWIFT: সুইফট কী? সুইফটের ইতিহাস, সুইফট কীভাবে কাজ করে এবং সুইফট কোড কী?

আহমেদ মিন্টো
  • প্রকাশ: ০৯:৩৪:৪০ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২
  • / ১৭৪৭৪ বার পড়া হয়েছে

সুইফট লোগো

আন্তঃব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে লেনদেনের ক্ষেত্রে সুইফট একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রায় সকলেই, বিশেষ করে যারা বৈদেশিক লেনদেনের সাথে জড়িত বা জড়িতে ছিলেন তারা এই সুইফট শব্দ এবং সুইফট কোড সম্পর্কে মোটামুটিভাবে পরিচিত। কিন্ত এই সুইফট আসলে কী তা নিয়ে এখানে উল্লেখ করা হলো।

সুইফট কী?

সুইফট (SWIFT)-এর পূর্ণরূপ- সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন (Society for Worldwide International Financial Telecommunication)। বিশ্বব্যাপী ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে আর্থিক লেনদেন করতে এই সুইফট নেটওয়ার্ক ব্যবহার করা হয়। বেলিজিয়ামের ব্রাসেলসে মে ৩,১৯৭৩ খ্রি. তারিখে প্রতিষ্ঠিত হয় সুইফট (SWIFT)।

সুইফট হলো মূলত আন্তঃব্যাংক সংক্রান্ত তাৎক্ষনিক মেসেজিং ব্যবস্থা যা কোনো লেনদেনের ব্যাপারে গ্রাহককে তৎক্ষণাৎ জানিয়ে দেয়। বিশ্বের অধিকাংশ ব্যাংক নিজেদের মধ্যকার বার্তা আদান প্রদানের কাজে সুইফট নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে।

সুইফট নেটওয়ার্ক হলো শুধুই একটি যোগাযোগের মাধ্যম, এর মাধ্যে সরাসরি অর্থ প্রেরণ করা যায় না। সুইফট শুধু অনলাইনে পেমেন্ট অর্ডার প্রেরণ করে। একটি ব্যাংক তাদের সুইফট নেটওয়ার্ক এ সংযুক্ত অন্য একটি ব্যাংককে অর্থ পরিশোধের অনুরোধ পাঠায় এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক সেই আদেশ গ্রহণ করে সে অনুযায়ী কাজ করে।

বিশ্বের ২০০ টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইফটের সদস্য। আর্থিক লেনদেনের ব্যাপারে তথ্য আদান প্রদানের জন্য সুইফটকে একটি নিরাপদ নেটওয়ার্ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বিশ্বব্যাপী খুবই গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ভূমিকা রাখলেও, কোনো দেশের উপর অবরোধ আরোপের আইনি ক্ষমতা নেই এই প্রতিষ্ঠানটির।

কীভাবে সৃষ্টি/প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সুইফট, এর ইতিহাস কী?

সুইফট ১৯৭৩ সালে বেলজিয়ামের ব্রাসেলস এ প্রতিষ্ঠিত হয়, এর সদরদপ্তর লা হাল্পে।। সুইফট এর প্রতিষ্ঠাতা কার্ল রয়টার্স কিল্ড। পরবর্তীতে এটি আর্থিক লেনদেনের জন্য একটি সাধারণ মানদণ্ড, ডাটা প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি ও বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করে যেটি বুরো কর্পোরেশন (Burroughs Corporation) এর তৈরি করা। সুইফট-এর মাধ্যমে সর্ব প্রথম ১৯৭৭ সালে বার্তা বা মেসেজ প্রদান করা হয়।

সুইফট সৃষ্টি হয়েছিল আমেরিকান ও ইউরোপিয়ান ব্যাংকসমূহের উদ্যোগে, যারা চাননি একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান কোনো একক সিস্টেম তৈরি করে কাজ করবে এবং নিজেদের একচেটিয়া ব্যবস্থার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক লেনদেন পরিচালনা করবে।

যৌথভাবে সুইফট নেটওয়ার্কের মালিক বিশ্বের দুই হাজার ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান।

সুইফট নিয়ন্ত্রণ করে কারা?

সুইফটের ব্যবস্থাপনায় আছে একটি খুবই দক্ষ পরিচালনা পরিষদ, এই পরিষদ বা বোর্ডের প্রধান হলেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (Chief Executive Officer) বা সিইও (CEO)। সুইফট পরিচালনা পরিষদের অন্য সদস্যরা কোম্পানির প্রতিদিনের পরিচালনার তথ্য প্রধান নির্বাহীর নিকট রিপোর্ট করে। সুইফটের বর্তমান প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাভিয়ের পেরেজ-তাসো।

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ এবং ব্যাংক অব ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের বড়ো বড়ো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে মিলে বেলজিয়ামের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক অব বেলজিয়াম সুইফটের কাজকর্ম তদারক করে থাকে।

সুইফট হেডকয়ার্টারস, লা হাল্প, বেলজিয়াম

সুইফটের ডেটা সেন্টার (SWIFT Data Centre)

সুইফট সারা বিশ্বের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লেনদেন সংক্রান্ত বার্তা আদান-প্রদানের কার্যক্রম মাত্র তিনটি তথ্য কেন্দ্র বা ডেটা সেন্টারের (Data Centre) মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। সুইফট যে তিনটি ডেটা সেন্টারের মাধ্যমে যোগাযোগের কাজ করে থাকে সেগুলো শতভাগ সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করা হয়।

ডেটা সেন্টারগুলোর একটি যুক্তরাষ্ট্রে, একটি নেদারল্যান্ডস এবং একটি সুইজারল্যান্ডে অবস্থিত। সুইফট তথ্য প্রেরণের জন্য সাবমেরিন কেবল যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যবহার করে থাকে। যখন একটি তথ্য কেন্দ্র তথ্য প্রেরণে ব্যর্থ হয় তখন অন্য একটি কেন্দ্র তথ্য সম্পূর্ণ নেটওয়ার্ক ট্র্যাফিক পরিচালনা করে।

সুইফটের নেটওয়ার্ক কতটা সুরক্ষিত?

প্রায় সকলেই মনে করে থাকতে পারেন যে, সুইফট যেভাবে কাজ করছে তা প্রমাণ করে যে, ব্যাংকিং জগতে এটি খুবই নিরাপদ একটি যোগাযোগের মাধ্যম। কিন্তু নিরাপত্তার বিষয়ে সুইফট এখনো ১০০ ভাগ আস্থা করতে পারেনি, যা ২০১৬ সালের স্পষ্ট হয়। ২০১৬ সালে নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রক্ষিত বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংকের (Bangladesh Bank) $৮১ মিলিয়ন ডলার সুইফট নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে হ্যাকাররা চুরি করে। এই ঘটনার সূত্র ধরে পরবর্তীতে সুইফট স্বীকার করেছে যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ যেভাবে চুরি হয়েছে সেরকম কিছু ঘটনার চেষ্টা পূর্বেও হয়েছে। বাংলাদেশর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে চুরির খবর প্রকাশিত হওয়ার পরপরই জানা যায় যে ভিয়েতনামের একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকেও সুইফট নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে হ্যাকাররা এই ধরনের হামলা চালিয়েছে। উভয় আক্রমণে অননুমোদিত সুইট বার্তা ইস্যু ও প্রেরন করা হয়েছিলো এবং ম্যালওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছিলো

সুইফট নেটওয়ার্ক থেকে কোনো দেশকে কি নিষিদ্ধ করা হয়?

সুইফট নেটওয়ার্কের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পরিচালিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিশ্চিত হয় সুইফটের মাধ্যমে। কোনো বিরোধের ক্ষেত্রে পক্ষ অবলম্বন করার কথা নয় প্রতিষ্ঠানটির। আইনি দিক থেকেও বিশেষ কোনো সদস্য রাষ্ট্রের বিপক্ষে নেতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না সুইফট। কিন্তু, ২০১২ সালে পরমাণু কর্মসূচির কারণে ইরানের ওপর সুইফট নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। সুইফট বলছে, কারো ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ব্যাপারে তাদের কোনো প্রভাব থাকে না, বরং নিষেধাজ্ঞা দেয়ার সিদ্ধান্ত নির্ভর করে কোনো দেশের সরকারের ওপর।

সুইফট থেকে কোনো দেশকে নিষিদ্ধ করার ফল কী হতে পারে?

সুইফট যদি যদি কোনো দেশকে নিষিদ্ধ করে তাহলে ওই দেশের লেনদেন সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয় না কারণ সুইফট লেনদেন করার মাধ্যম নয়। তবে সুইফট যেহেতু সদপ্পপস্য দেশগুলোর ব্যাংকগুলোর মধ্যে স্বচ্ছভাবে খুব দ্রুত যোগাযোগ স্থাপনের সুযোগ করে দেয় সেহেতু লেনদেন বা অর্থ স্থানান্তর খুবই দ্রুত (তাৎক্ষণিকভাবে) সম্পন্ন হয়। লেনদেন যখন দ্রুত হয় তখন বাজারে এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

সুইফট কর্তৃত কোনো সদস্য দেশকে নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য হচ্ছে ওই দেশের কোম্পানিসমূহ যাতে সুইফটের মাধ্যমে স্বাভাবিক সময়ের মতো নির্ঝঞ্ঝাটে এবং তাৎক্ষণিক লেনদেন পরিচালনা করতে না পারে।

নির্ঝঞ্ঝাটে লেনদেন না করতে পারার ফলে ২০১২ সালে ইরান ৩০ শতাংশের মতো আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছিল।

সুতরাং, বলা যায় যে, সুইফট কর্তৃক নিষিদ্ধ হলে লেনদেনে প্রকৃতভাবে বাধাগ্রস্ত না হলেও লেনদেন সম্পন্ন হতে বড্ড বেশি সময় লাগে। কোনো লেনদেন সম্পন্ন হতে যদি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সমত লাগে তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাব দেশের বাজার ও আন্তর্জাতিক বাজারে পড়াটাই স্বাভাবিক।

সুইফট কোড কী? (What is SWIFT Code?)

সুইফট কোড হলো সুইফট কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমোদন প্রাপ্ত এমন একটি কোড যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট দেশ, ব্যাংক এবং ব্যাংকের শাখা সনাক্ত করা হয়। যখন কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিদেশের কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ পাঠায় তখন এই সুইফট কোডের প্রয়োজন হয়। সুইফট কোডকে অনেক সময় ব্যাংক আইডেন্টিফায়ার কোড (Bank Identifier Code) বা বি‌আইসি (BIC) বলে।

সুইফট কোড ৮ টি বর্ণ অথবা ১১টি ক্যারেক্টার নিয়ে গঠিত। যখন ৮ বর্ণের কোড দেওয়া হয়, তখন প্রথম চার বর্ণকে প্রাথমিক ব্যাংক বা অফিস বোঝায়। এর পরের দুই বর্ণ দিয়ে দেশ ও শেষের দুই বর্ণ দিয়ে স্থান নির্দিষ্ট শহরকে নির্দেশ করে। তবে যখন ১১ টি ক্যারেক্টার দেওয়া হয় তখন ৮ টি বর্ণের সাথে অতিরিক্ত ৩ টি বর্ণ বা অঙ্ক (Letter or Digit) দিয়ে নির্দিষ্ট শাখাকে বোঝানো হয়। ব্যাংকিং লেনদেন্র জন্য এই অতরিক্ত ৩ লেটার বা ডিজিট হলো ঐচ্ছিক, কেউ যদি শেষের এই ৩ ক্যারেক্টার ব্যবহার করতে না চায় তাহলেও কোনো রকম সমস্যা হবে না।

  • উদাহরণ ১—

৮ বর্ণের সুইফট কোড: ABBLBDDH

এখানে, ABBL হলো ব্যাংকের নাম— AB Bank Limited; BD দিয়ে নির্দেশ করে বাংলাদেশ; DH হলো ঢাকা শহর।

  • উদাহরণ ২—

১১ ক্যারেক্টারের সুইফট কোড:

এখানে DBBL দিয়ে ডাচ-বাংলা ব্যাংক; BD দিয়ে বাংলাদেশ; DH দিয়ে ঢাকা শহর; শেষের 114 দিয়ে ঢাকার মহাখালী ব্রাঞ্চকে বোঝানো হয়েছে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকের সুইফট কোড (SWIFT Codes for Several Bangladeshi Banks)

  • AB Bank Limited: ABBLBDDH
  • Agrani Bank Limited: JANBBDDH
  • Al-Arafah Islami Bank Limited: ALARBDDH
  • Bangladesh Commerce Bank Limited: BCBLBDDH
  • Bangladesh Krishi Bank: BKBABDDH
  • Bank Al-Falah Limited (Bangladesh): ALFHBDDH
  • Bank Asia Limited: BALBBDDH
  • BASIC Bank Limited: BKSIBDDH
  • BRAC Bank Limited: BRAKBDDHCitibank N.A (Bangladesh): CITIBDDX
  • Commercial Bank of Ceylon Limited: CCEYBDDH
  • Dhaka Bank Limited: DHBLBDDH
  • Dutch-Bangla Bank Limited: DBBLBDDH
  • Eastern Bank Limited: EBLDBDDH
  • EXIM Bank Limited: EXBKBDDH
  • First Security Islami Bank Limited: FSEBBDDH
  • Habib Bank Ltd. (Bangladesh): HABBBDDH
  • ICB Islamic Bank Limited: BBSHBDDH
  • IFIC Bank Limited: IFICBDDH
  • Islami Bank Bangladesh Limited: IBBLBDDH
  • Jamuna Bank Limited: JAMUBDDH
  • Janata Bank Limited: JANBBDDH
  • Mercantile Bank Limited: MBLBBDDH
  • Mutual Trust Bank Limited: MTBLBDDH
  • National Bank Limited: NBLBBDDH
  • National Bank of Pakistan (Bangladesh): NBPABDDH
  • National Credit & Commerce Bank: NCCLBDDH
  • One Bank Limited: ONEBBDDH
  • Premier Bank Limited: PRMRBDDH
  • Prime Bank Limited: PRBLBDDH
  • Pubali Bank Limited: PUBABDDH
  • Rupali Bank Limited: RUPBBDDH
  • Shahjalal Islami Bank Limited: SJBLBDDH
  • Social Islami Bank Limited: SOIVBDDH
  • Sonali Bank Limited: BSONBDDH
  • Southeast Bank Limited: SEBDBDDH
  • Standard Bank Limited: SDBLBDDH
  • Standard Chartered Bank (Bangladesh): SCBLBDDX
  • State Bank of India: SBINBDDH
  • The City Bank Limited: CIBLBDDH
  • HSBC (Dhaka): HSBCBDDH
  • Trust Bank Limited: TTBLBDDH
  • United Commercial Bank Limited: UCBLBDDH
  • Uttara Bank Limited: UTBLBDDH
  • Woori Bank (Bangladesh): HVBKBDDH

তথ্যসূত্র

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

আহমেদ মিন্টো

মিন্টো একজন ফ্রিল্যান্স লেখক এবং বিশ্লেষণ'র কন্ট্রিবিউটর।

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

SWIFT: সুইফট কী? সুইফটের ইতিহাস, সুইফট কীভাবে কাজ করে এবং সুইফট কোড কী?

প্রকাশ: ০৯:৩৪:৪০ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২

আন্তঃব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে লেনদেনের ক্ষেত্রে সুইফট একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রায় সকলেই, বিশেষ করে যারা বৈদেশিক লেনদেনের সাথে জড়িত বা জড়িতে ছিলেন তারা এই সুইফট শব্দ এবং সুইফট কোড সম্পর্কে মোটামুটিভাবে পরিচিত। কিন্ত এই সুইফট আসলে কী তা নিয়ে এখানে উল্লেখ করা হলো।

সুইফট কী?

সুইফট (SWIFT)-এর পূর্ণরূপ- সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন (Society for Worldwide International Financial Telecommunication)। বিশ্বব্যাপী ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে আর্থিক লেনদেন করতে এই সুইফট নেটওয়ার্ক ব্যবহার করা হয়। বেলিজিয়ামের ব্রাসেলসে মে ৩,১৯৭৩ খ্রি. তারিখে প্রতিষ্ঠিত হয় সুইফট (SWIFT)।

সুইফট হলো মূলত আন্তঃব্যাংক সংক্রান্ত তাৎক্ষনিক মেসেজিং ব্যবস্থা যা কোনো লেনদেনের ব্যাপারে গ্রাহককে তৎক্ষণাৎ জানিয়ে দেয়। বিশ্বের অধিকাংশ ব্যাংক নিজেদের মধ্যকার বার্তা আদান প্রদানের কাজে সুইফট নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে।

সুইফট নেটওয়ার্ক হলো শুধুই একটি যোগাযোগের মাধ্যম, এর মাধ্যে সরাসরি অর্থ প্রেরণ করা যায় না। সুইফট শুধু অনলাইনে পেমেন্ট অর্ডার প্রেরণ করে। একটি ব্যাংক তাদের সুইফট নেটওয়ার্ক এ সংযুক্ত অন্য একটি ব্যাংককে অর্থ পরিশোধের অনুরোধ পাঠায় এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক সেই আদেশ গ্রহণ করে সে অনুযায়ী কাজ করে।

বিশ্বের ২০০ টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইফটের সদস্য। আর্থিক লেনদেনের ব্যাপারে তথ্য আদান প্রদানের জন্য সুইফটকে একটি নিরাপদ নেটওয়ার্ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বিশ্বব্যাপী খুবই গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ভূমিকা রাখলেও, কোনো দেশের উপর অবরোধ আরোপের আইনি ক্ষমতা নেই এই প্রতিষ্ঠানটির।

কীভাবে সৃষ্টি/প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সুইফট, এর ইতিহাস কী?

সুইফট ১৯৭৩ সালে বেলজিয়ামের ব্রাসেলস এ প্রতিষ্ঠিত হয়, এর সদরদপ্তর লা হাল্পে।। সুইফট এর প্রতিষ্ঠাতা কার্ল রয়টার্স কিল্ড। পরবর্তীতে এটি আর্থিক লেনদেনের জন্য একটি সাধারণ মানদণ্ড, ডাটা প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি ও বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করে যেটি বুরো কর্পোরেশন (Burroughs Corporation) এর তৈরি করা। সুইফট-এর মাধ্যমে সর্ব প্রথম ১৯৭৭ সালে বার্তা বা মেসেজ প্রদান করা হয়।

সুইফট সৃষ্টি হয়েছিল আমেরিকান ও ইউরোপিয়ান ব্যাংকসমূহের উদ্যোগে, যারা চাননি একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান কোনো একক সিস্টেম তৈরি করে কাজ করবে এবং নিজেদের একচেটিয়া ব্যবস্থার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক লেনদেন পরিচালনা করবে।

যৌথভাবে সুইফট নেটওয়ার্কের মালিক বিশ্বের দুই হাজার ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান।

সুইফট নিয়ন্ত্রণ করে কারা?

সুইফটের ব্যবস্থাপনায় আছে একটি খুবই দক্ষ পরিচালনা পরিষদ, এই পরিষদ বা বোর্ডের প্রধান হলেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (Chief Executive Officer) বা সিইও (CEO)। সুইফট পরিচালনা পরিষদের অন্য সদস্যরা কোম্পানির প্রতিদিনের পরিচালনার তথ্য প্রধান নির্বাহীর নিকট রিপোর্ট করে। সুইফটের বর্তমান প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাভিয়ের পেরেজ-তাসো।

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ এবং ব্যাংক অব ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের বড়ো বড়ো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে মিলে বেলজিয়ামের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক অব বেলজিয়াম সুইফটের কাজকর্ম তদারক করে থাকে।

সুইফট হেডকয়ার্টারস, লা হাল্প, বেলজিয়াম

সুইফটের ডেটা সেন্টার (SWIFT Data Centre)

সুইফট সারা বিশ্বের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লেনদেন সংক্রান্ত বার্তা আদান-প্রদানের কার্যক্রম মাত্র তিনটি তথ্য কেন্দ্র বা ডেটা সেন্টারের (Data Centre) মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। সুইফট যে তিনটি ডেটা সেন্টারের মাধ্যমে যোগাযোগের কাজ করে থাকে সেগুলো শতভাগ সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করা হয়।

ডেটা সেন্টারগুলোর একটি যুক্তরাষ্ট্রে, একটি নেদারল্যান্ডস এবং একটি সুইজারল্যান্ডে অবস্থিত। সুইফট তথ্য প্রেরণের জন্য সাবমেরিন কেবল যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যবহার করে থাকে। যখন একটি তথ্য কেন্দ্র তথ্য প্রেরণে ব্যর্থ হয় তখন অন্য একটি কেন্দ্র তথ্য সম্পূর্ণ নেটওয়ার্ক ট্র্যাফিক পরিচালনা করে।

সুইফটের নেটওয়ার্ক কতটা সুরক্ষিত?

প্রায় সকলেই মনে করে থাকতে পারেন যে, সুইফট যেভাবে কাজ করছে তা প্রমাণ করে যে, ব্যাংকিং জগতে এটি খুবই নিরাপদ একটি যোগাযোগের মাধ্যম। কিন্তু নিরাপত্তার বিষয়ে সুইফট এখনো ১০০ ভাগ আস্থা করতে পারেনি, যা ২০১৬ সালের স্পষ্ট হয়। ২০১৬ সালে নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রক্ষিত বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংকের (Bangladesh Bank) $৮১ মিলিয়ন ডলার সুইফট নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে হ্যাকাররা চুরি করে। এই ঘটনার সূত্র ধরে পরবর্তীতে সুইফট স্বীকার করেছে যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ যেভাবে চুরি হয়েছে সেরকম কিছু ঘটনার চেষ্টা পূর্বেও হয়েছে। বাংলাদেশর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে চুরির খবর প্রকাশিত হওয়ার পরপরই জানা যায় যে ভিয়েতনামের একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকেও সুইফট নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে হ্যাকাররা এই ধরনের হামলা চালিয়েছে। উভয় আক্রমণে অননুমোদিত সুইট বার্তা ইস্যু ও প্রেরন করা হয়েছিলো এবং ম্যালওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছিলো

সুইফট নেটওয়ার্ক থেকে কোনো দেশকে কি নিষিদ্ধ করা হয়?

সুইফট নেটওয়ার্কের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পরিচালিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিশ্চিত হয় সুইফটের মাধ্যমে। কোনো বিরোধের ক্ষেত্রে পক্ষ অবলম্বন করার কথা নয় প্রতিষ্ঠানটির। আইনি দিক থেকেও বিশেষ কোনো সদস্য রাষ্ট্রের বিপক্ষে নেতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না সুইফট। কিন্তু, ২০১২ সালে পরমাণু কর্মসূচির কারণে ইরানের ওপর সুইফট নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। সুইফট বলছে, কারো ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ব্যাপারে তাদের কোনো প্রভাব থাকে না, বরং নিষেধাজ্ঞা দেয়ার সিদ্ধান্ত নির্ভর করে কোনো দেশের সরকারের ওপর।

সুইফট থেকে কোনো দেশকে নিষিদ্ধ করার ফল কী হতে পারে?

সুইফট যদি যদি কোনো দেশকে নিষিদ্ধ করে তাহলে ওই দেশের লেনদেন সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয় না কারণ সুইফট লেনদেন করার মাধ্যম নয়। তবে সুইফট যেহেতু সদপ্পপস্য দেশগুলোর ব্যাংকগুলোর মধ্যে স্বচ্ছভাবে খুব দ্রুত যোগাযোগ স্থাপনের সুযোগ করে দেয় সেহেতু লেনদেন বা অর্থ স্থানান্তর খুবই দ্রুত (তাৎক্ষণিকভাবে) সম্পন্ন হয়। লেনদেন যখন দ্রুত হয় তখন বাজারে এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

সুইফট কর্তৃত কোনো সদস্য দেশকে নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য হচ্ছে ওই দেশের কোম্পানিসমূহ যাতে সুইফটের মাধ্যমে স্বাভাবিক সময়ের মতো নির্ঝঞ্ঝাটে এবং তাৎক্ষণিক লেনদেন পরিচালনা করতে না পারে।

নির্ঝঞ্ঝাটে লেনদেন না করতে পারার ফলে ২০১২ সালে ইরান ৩০ শতাংশের মতো আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছিল।

সুতরাং, বলা যায় যে, সুইফট কর্তৃক নিষিদ্ধ হলে লেনদেনে প্রকৃতভাবে বাধাগ্রস্ত না হলেও লেনদেন সম্পন্ন হতে বড্ড বেশি সময় লাগে। কোনো লেনদেন সম্পন্ন হতে যদি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সমত লাগে তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাব দেশের বাজার ও আন্তর্জাতিক বাজারে পড়াটাই স্বাভাবিক।

সুইফট কোড কী? (What is SWIFT Code?)

সুইফট কোড হলো সুইফট কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমোদন প্রাপ্ত এমন একটি কোড যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট দেশ, ব্যাংক এবং ব্যাংকের শাখা সনাক্ত করা হয়। যখন কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিদেশের কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ পাঠায় তখন এই সুইফট কোডের প্রয়োজন হয়। সুইফট কোডকে অনেক সময় ব্যাংক আইডেন্টিফায়ার কোড (Bank Identifier Code) বা বি‌আইসি (BIC) বলে।

সুইফট কোড ৮ টি বর্ণ অথবা ১১টি ক্যারেক্টার নিয়ে গঠিত। যখন ৮ বর্ণের কোড দেওয়া হয়, তখন প্রথম চার বর্ণকে প্রাথমিক ব্যাংক বা অফিস বোঝায়। এর পরের দুই বর্ণ দিয়ে দেশ ও শেষের দুই বর্ণ দিয়ে স্থান নির্দিষ্ট শহরকে নির্দেশ করে। তবে যখন ১১ টি ক্যারেক্টার দেওয়া হয় তখন ৮ টি বর্ণের সাথে অতিরিক্ত ৩ টি বর্ণ বা অঙ্ক (Letter or Digit) দিয়ে নির্দিষ্ট শাখাকে বোঝানো হয়। ব্যাংকিং লেনদেন্র জন্য এই অতরিক্ত ৩ লেটার বা ডিজিট হলো ঐচ্ছিক, কেউ যদি শেষের এই ৩ ক্যারেক্টার ব্যবহার করতে না চায় তাহলেও কোনো রকম সমস্যা হবে না।

  • উদাহরণ ১—

৮ বর্ণের সুইফট কোড: ABBLBDDH

এখানে, ABBL হলো ব্যাংকের নাম— AB Bank Limited; BD দিয়ে নির্দেশ করে বাংলাদেশ; DH হলো ঢাকা শহর।

  • উদাহরণ ২—

১১ ক্যারেক্টারের সুইফট কোড:

এখানে DBBL দিয়ে ডাচ-বাংলা ব্যাংক; BD দিয়ে বাংলাদেশ; DH দিয়ে ঢাকা শহর; শেষের 114 দিয়ে ঢাকার মহাখালী ব্রাঞ্চকে বোঝানো হয়েছে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকের সুইফট কোড (SWIFT Codes for Several Bangladeshi Banks)

  • AB Bank Limited: ABBLBDDH
  • Agrani Bank Limited: JANBBDDH
  • Al-Arafah Islami Bank Limited: ALARBDDH
  • Bangladesh Commerce Bank Limited: BCBLBDDH
  • Bangladesh Krishi Bank: BKBABDDH
  • Bank Al-Falah Limited (Bangladesh): ALFHBDDH
  • Bank Asia Limited: BALBBDDH
  • BASIC Bank Limited: BKSIBDDH
  • BRAC Bank Limited: BRAKBDDHCitibank N.A (Bangladesh): CITIBDDX
  • Commercial Bank of Ceylon Limited: CCEYBDDH
  • Dhaka Bank Limited: DHBLBDDH
  • Dutch-Bangla Bank Limited: DBBLBDDH
  • Eastern Bank Limited: EBLDBDDH
  • EXIM Bank Limited: EXBKBDDH
  • First Security Islami Bank Limited: FSEBBDDH
  • Habib Bank Ltd. (Bangladesh): HABBBDDH
  • ICB Islamic Bank Limited: BBSHBDDH
  • IFIC Bank Limited: IFICBDDH
  • Islami Bank Bangladesh Limited: IBBLBDDH
  • Jamuna Bank Limited: JAMUBDDH
  • Janata Bank Limited: JANBBDDH
  • Mercantile Bank Limited: MBLBBDDH
  • Mutual Trust Bank Limited: MTBLBDDH
  • National Bank Limited: NBLBBDDH
  • National Bank of Pakistan (Bangladesh): NBPABDDH
  • National Credit & Commerce Bank: NCCLBDDH
  • One Bank Limited: ONEBBDDH
  • Premier Bank Limited: PRMRBDDH
  • Prime Bank Limited: PRBLBDDH
  • Pubali Bank Limited: PUBABDDH
  • Rupali Bank Limited: RUPBBDDH
  • Shahjalal Islami Bank Limited: SJBLBDDH
  • Social Islami Bank Limited: SOIVBDDH
  • Sonali Bank Limited: BSONBDDH
  • Southeast Bank Limited: SEBDBDDH
  • Standard Bank Limited: SDBLBDDH
  • Standard Chartered Bank (Bangladesh): SCBLBDDX
  • State Bank of India: SBINBDDH
  • The City Bank Limited: CIBLBDDH
  • HSBC (Dhaka): HSBCBDDH
  • Trust Bank Limited: TTBLBDDH
  • United Commercial Bank Limited: UCBLBDDH
  • Uttara Bank Limited: UTBLBDDH
  • Woori Bank (Bangladesh): HVBKBDDH

তথ্যসূত্র