০১:৫২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

লোকায়ত দর্শন, লোকায়ত দর্শনের উৎপত্তি ও ভিত্তি কী? লোকায়ত দার্শনিক কারা?

অধ্যাপক ড. প্রদীপ কুমার রায়
  • প্রকাশ: ০৯:০৮:৪৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২
  • / ২৬৩৭ বার পড়া হয়েছে

লোকায়ত দর্শন

লোকায়ত দর্শন হলো একটি দার্শনিক ধারণা। সাধারণত ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে ‘লোকায়ত দর্শন’ বলতে ‘জনসাধারণের দর্শন’ বা ‘সাধারণ মানুষের দর্শন’ এবং ‘ইহলৌকিক দর্শন’কে বোঝায়।

লোকেষু আয়তো লোকায়ত-হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই শ্লোকটি ব্যাখ্যা করে বলেন-যা জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে তাই লোকায়ত। সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ প্রমুখ ভারতীয় পণ্ডিতগণ লোকায়ত দর্শনকে এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন। ভারতীয় দর্শনের প্রাচীন অধ্যাত্মবাদীরা বিশেষ করে শংকরাচার্য, মাধবাচার্য, গুণরত্ন প্রমুখ এই মত সমর্থন করেন। অতি সম্প্রতি দেবীপ্রসাদ চট্টেপাধ্যায় মার্কসবাদী দর্শনের আলোকে লোকায়ত দর্শনকে বিচার ও মূল্যায়ন করে বলেন যে, লোকায়ত বলতে ঋজু ও মুক্তচিন্তার অধিকারী একটি সুসংহত দর্শন বোঝায়। তাঁর মতে, লোকায়ত বলতে শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যে পরিব্যাপ্ত দর্শনই নয়-এই দর্শনে ‘দেহাতিরিক্ত আত্মা ও পরলোক’ নিছক কল্পনামাত্র- পুরুষার্থ হচ্ছে শুধু অর্থ ও কাম-অর্থাৎ, ইহলৌকিকতাই হচ্ছে প্রধান। ভারতীয় দর্শনের চার্বাকপন্থীরা এই মত সমর্থন করে বলে তারাও লোকায়ত নামে সবিশেষ পরিচিত। সুতরাং, লোকায়ত মানে সাধারণ জনগণের দর্শন, লোকায়ত মানে বস্ত্তবাদী দর্শন, লোকায়ত মানে চার্বাক দর্শন।

চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন হলো ভারতীয় দর্শনের একটি বস্তুবাদী শাখা। লোকায়ত বা চার্বাক দর্শন অধ্যাত্মবাদবিরোধী নিরীশ্বরবাদী ও বস্তুবাদী দর্শন। সাধারণভাবে গুরু বৃহস্পতিকে এই দর্শনশাস্ত্রের প্রবর্তক হিসাবে মনে করা হয়। এই দর্শন কোনো প্রকার প্রত্যাদেশে বিশ্বাসী নয়, ‘প্রমাণই এ দর্শন অনুসারে যথার্থ জ্ঞানের উৎস। পারলৌকিক নয়, ইহজাগতিক সুখ ভোগই মানুষের একমাত্র কাম্য বলে চার্বাকরা মনে করত। চার্বাক দর্শনের প্রভাব বুদ্ধের সময় ও প্রাক-বুদ্ধ যুগে উপস্থিত ছিল বলে অনেকে মনে করে থাকেন।

লোকায়ত দর্শনের উৎপত্তি

লোকায়ত বা চার্বাক দর্শনের উৎপত্তিকাল নিয়ে ভারততত্ত্ববিদদের মধ্যে মতপার্থক্য লক্ষ করা যায়। তবে একথা সবাই স্বীকার করেন, লোকায়ত দর্শনের উৎপত্তি মহাকাব্য যুগের, অর্থাৎ, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যে। অনেকে আবার লোকায়ত দর্শনকে জৈন ও বুদ্ধধর্মের পূর্ববর্তী, অর্থাৎ, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতক বলে উল্লেখ করেন। লোকায়ত দর্শনের উৎপত্তি নিয়ে মতভেদ থাকলেও বৃহস্পতিকে সর্বজনীনভাবে লোকায়ত দর্শনের আদি প্রবর্তক হিসেবে গণ্য করা হয়। এ কারণে কেউ কেউ লোকায়ত দর্শনকে ‘বার্হস্পত্য দর্শন’ নামেও অভিহিত করেন।

আজ পর্যন্ত লোকায়ত দর্শনের মূলগ্রন্থের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এর কারণ প্রসঙ্গে পণ্ডিতগণ লোকায়তদের মূলগ্রন্থের বিলুপ্তির কথা উল্লেখ করেন। তাদের মতে, রামায়ণ, মহাভারত, জৈন ও বৌদ্ধধর্ম গ্রন্থে লোকায়ত দর্শনের তথা জড়বাদী দর্শনের কিছু কিছু উক্তি লক্ষ করা যায়। আবার কোনো কোনো দার্শনিক সম্প্রদায় লোকায়ত দর্শনকে ‘পূর্বপক্ষ’ হিসেবে গ্রহণ করে এই মত খন্ডন করার চেষ্টা করেছেন। তাই অনেকে আবার লোকায়ত দর্শনকে ‘পূর্বপক্ষ’-এর দর্শন হিসেবেও উল্লেখ করে।

লোকায়ত দর্শনের গ্রন্থ

১৯৪০ সালে ভারতের বরোদা ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউট থেকে সুখলালজি ও পারিখ কর্তৃক সম্পাদিত জয়রাশি ভট্ট রচিত তত্ত্বোপপ্লবসিংহ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটি সুধী মহলে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ, দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী প্রমুখ গ্রন্থটিকে লোকায়ত দর্শনের একমাত্র অবিলুপ্ত গ্রন্থ হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁদের মতে, এই গ্রন্থে লোকায়ত মতের বস্ত্তবাদী ভাবধারা সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়সহ অনেকেই এই মতের বিরোধিতা করে বলেন, এই গ্রন্থের মূলবক্তব্য ‘কাল্পনিক’ এবং এর ‘প্রবণতা’ চরমভাববাদের প্রতি। ‘‘… তত্ত্বোপপ্লবসিংহর শুরুতেই বস্ত্তবাদের অসারতা উল্লিখিত।’’ কিন্তু ভারতীয় দর্শন বিশারদ কমলশীল, জয়ন্তভট্ট, গুণরত্ন, মাধবাচার্য প্রমুখ লোকায়ত দর্শনকে বস্ত্তবাদ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন।

লোকায়ত দর্শনের সম্প্রদায়

দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনের ৩ টি সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করেন: বৈতন্ডিক সম্প্রদায়, ধূর্ত সম্প্রদায়, এবং সুশিক্ষিত সম্প্রদায়।

লোকায়ত দর্শনের দার্শনিকতত্ত্ব তাদের জ্ঞানতত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের মতে, ‘প্রত্যক্ষমেকৈবম্ প্রমাণম্’- অর্থাৎ প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ; তারা কোনো প্রকার অনুমানকে প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করে না, আগম বা শব্দ তাদের কাছে প্রমাণ নয়; বেদবাক্য, শ্রুতিবাক্য ইত্যাদি কোনো অবস্থাতেই নির্ভরযোগ্য নয়। ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের অভিজ্ঞতা থেকে সকল জ্ঞান ও ধারণা সৃষ্টি হয়। লোকায়ত দর্শন তাই অভিজ্ঞতাবাদী ও জড়বাদী। তাঁদের মতে, প্রত্যক্ষ হচ্ছে মন ও পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত অপরোক্ষ অনুভূতি। সুতরাং, প্রত্যক্ষই সব প্রমাণের মূল প্রমাণ।

লোকায়ত দর্শনের ভিত্তি কী?

লোকায়তদের জ্ঞানতত্ত্ব অর্থাৎ প্রত্যক্ষণতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই তাঁদের অধিবিদ্যকতত্ত্ব গড়ে উঠেছে। তাঁরা সকল প্রকার অধ্যাত্মবাদ খন্ডন করে, পরাতাত্ত্বিক সমস্যার জড়বাদী ব্যাখ্যা প্রদান করে। তাই তারা অধ্যাত্মবাদের তীব্র সমালোচনা করে। প্রত্যক্ষ-উর্ধ্ব কোনো কিছু যেমন, ঈশ্বর, দেহাতিরিক্ত আত্মা, স্বর্গ, নরক, পরলোক ইত্যাদি বিশ্বাসযোগ্য নয়, একমাত্র জড়বস্ত্তই সত্য। ভারতীয় দর্শনের পঞ্চভূততত্ত্বের, অর্থাৎ, আকাশ, বায়ু, অগ্নি, অপ ও ক্ষিতির বিপরীতে ভূতচতুষ্টয় মতবাদ প্রদান করে। তাঁদের মতে, বায়ু, অগ্নি, অপ ও ক্ষিতি-এই চারটি ভূত বা জড় পদার্থ মূল উপাদান; এগুলো স্বাভাবিকভাবেই স্বস্ব গুণ অর্জন করে এবং এই চারটি জড় পদার্থ থেকে ‘স্বভাব নিয়মে’ জগতের উৎপত্তি হয়েছে। তাই জগৎ ঈশ্বরের সৃষ্টি নয়।

লোকায়ত দার্শনিকদের পরিচয় বা কারা লোকায়ত দার্শনিক

লোকায়ত দার্শনিকরা দেহাত্মবাদী বা ভূতচৈতন্যবাদী নামে পরিচিত। তাঁরা দেহাতিরিক্ত আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করে না। তাদের মতে, চৈতন্যবিশিষ্ট দেহই আত্মা, আত্মা বলে স্বতন্ত্র কিছু নেই, চৈতন্য দেহেরই একটি গুণ, চৈতন্য অতীন্দ্রিয় আধ্যাত্মিক সত্তার গুণ নয়। বায়ু, অগ্নি, অপ ও ক্ষিতি- এই চার ভূতচতুষ্টয় নিয়ে দেহ গঠিত। এই উপাদানসমূহ একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় মিশ্রিত হয়ে যে দেহের সৃষ্টি হয়, সেই দেহেই চৈতন্যরূপ এক নতুন গুণেরও সৃষ্টি হয়। সুতরাং চৈতন্য দেহ থেকেই জাত, দেহকে কেন্দ্র করেই চৈতন্যের জন্ম।

লোকায়ত দর্শনে ধর্ম ও মোক্ষকে নয়, অর্থ ও কামকে পরমপুরুষার্থ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। তাই তারা ভোগসুখবাদী। ‘ভোগ’ অর্থে ‘দৈহিক সুখ-সম্ভোগ’। দেহাতিরিক্ত আত্মা না থাকলে এবং দেহই একমাত্র সত্য হলে ‘আত্মিক’ সুখ বলে কিছু থাকতে পারে না। এজন্য তাদের মতে, ‘‘অঙ্গনালিঙ্গন-জন্য-সুখমেব-পুমর্থতা’’-অর্থাৎ অঙ্গনা-আলিঙ্গ জন্য সুখ সম্ভোগই মানবজীবনের একমাত্র কাম্য পুরুষার্থ। তারা ইন্দ্রিয় সুখ ও বর্তমান সুখকেই বাস্তবসত্য বলে মনে করে। তাদের নৈতিক উপদেশ হচ্ছে ‘‘যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ, ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পীবেৎ’’- অর্থাৎ, যতদিন বাঁচবে ভোগ ও সুখে বেঁচে থাক, প্রয়োজনে ঋণ করেও ঘি খাও

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

অধ্যাপক ড. প্রদীপ কুমার রায়

প্রদীপ রায় ১৯৫২ সালের ২ অক্টোবর মানিকগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক নিবাস টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলার বেকরা গ্রামে। তিনি ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিষয়ে এম.এ. এবং ১৯৮৪ সালে ভারতের পুনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি-এইচ.ডি. ডিগ্রি লাভ করেন। কিছুকাল মানিকগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজে অধ্যাপনা করে ১৯৮৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যােগ দেন। বর্তমানে তিনি এই বিভাগের সুপ্রিনিউমেরারি অধ্যাপক।

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

লোকায়ত দর্শন, লোকায়ত দর্শনের উৎপত্তি ও ভিত্তি কী? লোকায়ত দার্শনিক কারা?

প্রকাশ: ০৯:০৮:৪৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২

লোকায়ত দর্শন হলো একটি দার্শনিক ধারণা। সাধারণত ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে ‘লোকায়ত দর্শন’ বলতে ‘জনসাধারণের দর্শন’ বা ‘সাধারণ মানুষের দর্শন’ এবং ‘ইহলৌকিক দর্শন’কে বোঝায়।

লোকেষু আয়তো লোকায়ত-হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই শ্লোকটি ব্যাখ্যা করে বলেন-যা জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে তাই লোকায়ত। সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ প্রমুখ ভারতীয় পণ্ডিতগণ লোকায়ত দর্শনকে এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন। ভারতীয় দর্শনের প্রাচীন অধ্যাত্মবাদীরা বিশেষ করে শংকরাচার্য, মাধবাচার্য, গুণরত্ন প্রমুখ এই মত সমর্থন করেন। অতি সম্প্রতি দেবীপ্রসাদ চট্টেপাধ্যায় মার্কসবাদী দর্শনের আলোকে লোকায়ত দর্শনকে বিচার ও মূল্যায়ন করে বলেন যে, লোকায়ত বলতে ঋজু ও মুক্তচিন্তার অধিকারী একটি সুসংহত দর্শন বোঝায়। তাঁর মতে, লোকায়ত বলতে শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যে পরিব্যাপ্ত দর্শনই নয়-এই দর্শনে ‘দেহাতিরিক্ত আত্মা ও পরলোক’ নিছক কল্পনামাত্র- পুরুষার্থ হচ্ছে শুধু অর্থ ও কাম-অর্থাৎ, ইহলৌকিকতাই হচ্ছে প্রধান। ভারতীয় দর্শনের চার্বাকপন্থীরা এই মত সমর্থন করে বলে তারাও লোকায়ত নামে সবিশেষ পরিচিত। সুতরাং, লোকায়ত মানে সাধারণ জনগণের দর্শন, লোকায়ত মানে বস্ত্তবাদী দর্শন, লোকায়ত মানে চার্বাক দর্শন।

চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন হলো ভারতীয় দর্শনের একটি বস্তুবাদী শাখা। লোকায়ত বা চার্বাক দর্শন অধ্যাত্মবাদবিরোধী নিরীশ্বরবাদী ও বস্তুবাদী দর্শন। সাধারণভাবে গুরু বৃহস্পতিকে এই দর্শনশাস্ত্রের প্রবর্তক হিসাবে মনে করা হয়। এই দর্শন কোনো প্রকার প্রত্যাদেশে বিশ্বাসী নয়, ‘প্রমাণই এ দর্শন অনুসারে যথার্থ জ্ঞানের উৎস। পারলৌকিক নয়, ইহজাগতিক সুখ ভোগই মানুষের একমাত্র কাম্য বলে চার্বাকরা মনে করত। চার্বাক দর্শনের প্রভাব বুদ্ধের সময় ও প্রাক-বুদ্ধ যুগে উপস্থিত ছিল বলে অনেকে মনে করে থাকেন।

লোকায়ত দর্শনের উৎপত্তি

লোকায়ত বা চার্বাক দর্শনের উৎপত্তিকাল নিয়ে ভারততত্ত্ববিদদের মধ্যে মতপার্থক্য লক্ষ করা যায়। তবে একথা সবাই স্বীকার করেন, লোকায়ত দর্শনের উৎপত্তি মহাকাব্য যুগের, অর্থাৎ, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যে। অনেকে আবার লোকায়ত দর্শনকে জৈন ও বুদ্ধধর্মের পূর্ববর্তী, অর্থাৎ, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতক বলে উল্লেখ করেন। লোকায়ত দর্শনের উৎপত্তি নিয়ে মতভেদ থাকলেও বৃহস্পতিকে সর্বজনীনভাবে লোকায়ত দর্শনের আদি প্রবর্তক হিসেবে গণ্য করা হয়। এ কারণে কেউ কেউ লোকায়ত দর্শনকে ‘বার্হস্পত্য দর্শন’ নামেও অভিহিত করেন।

আজ পর্যন্ত লোকায়ত দর্শনের মূলগ্রন্থের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এর কারণ প্রসঙ্গে পণ্ডিতগণ লোকায়তদের মূলগ্রন্থের বিলুপ্তির কথা উল্লেখ করেন। তাদের মতে, রামায়ণ, মহাভারত, জৈন ও বৌদ্ধধর্ম গ্রন্থে লোকায়ত দর্শনের তথা জড়বাদী দর্শনের কিছু কিছু উক্তি লক্ষ করা যায়। আবার কোনো কোনো দার্শনিক সম্প্রদায় লোকায়ত দর্শনকে ‘পূর্বপক্ষ’ হিসেবে গ্রহণ করে এই মত খন্ডন করার চেষ্টা করেছেন। তাই অনেকে আবার লোকায়ত দর্শনকে ‘পূর্বপক্ষ’-এর দর্শন হিসেবেও উল্লেখ করে।

লোকায়ত দর্শনের গ্রন্থ

১৯৪০ সালে ভারতের বরোদা ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউট থেকে সুখলালজি ও পারিখ কর্তৃক সম্পাদিত জয়রাশি ভট্ট রচিত তত্ত্বোপপ্লবসিংহ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটি সুধী মহলে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ, দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী প্রমুখ গ্রন্থটিকে লোকায়ত দর্শনের একমাত্র অবিলুপ্ত গ্রন্থ হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁদের মতে, এই গ্রন্থে লোকায়ত মতের বস্ত্তবাদী ভাবধারা সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়সহ অনেকেই এই মতের বিরোধিতা করে বলেন, এই গ্রন্থের মূলবক্তব্য ‘কাল্পনিক’ এবং এর ‘প্রবণতা’ চরমভাববাদের প্রতি। ‘‘… তত্ত্বোপপ্লবসিংহর শুরুতেই বস্ত্তবাদের অসারতা উল্লিখিত।’’ কিন্তু ভারতীয় দর্শন বিশারদ কমলশীল, জয়ন্তভট্ট, গুণরত্ন, মাধবাচার্য প্রমুখ লোকায়ত দর্শনকে বস্ত্তবাদ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন।

লোকায়ত দর্শনের সম্প্রদায়

দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনের ৩ টি সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করেন: বৈতন্ডিক সম্প্রদায়, ধূর্ত সম্প্রদায়, এবং সুশিক্ষিত সম্প্রদায়।

লোকায়ত দর্শনের দার্শনিকতত্ত্ব তাদের জ্ঞানতত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের মতে, ‘প্রত্যক্ষমেকৈবম্ প্রমাণম্’- অর্থাৎ প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ; তারা কোনো প্রকার অনুমানকে প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করে না, আগম বা শব্দ তাদের কাছে প্রমাণ নয়; বেদবাক্য, শ্রুতিবাক্য ইত্যাদি কোনো অবস্থাতেই নির্ভরযোগ্য নয়। ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের অভিজ্ঞতা থেকে সকল জ্ঞান ও ধারণা সৃষ্টি হয়। লোকায়ত দর্শন তাই অভিজ্ঞতাবাদী ও জড়বাদী। তাঁদের মতে, প্রত্যক্ষ হচ্ছে মন ও পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত অপরোক্ষ অনুভূতি। সুতরাং, প্রত্যক্ষই সব প্রমাণের মূল প্রমাণ।

লোকায়ত দর্শনের ভিত্তি কী?

লোকায়তদের জ্ঞানতত্ত্ব অর্থাৎ প্রত্যক্ষণতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই তাঁদের অধিবিদ্যকতত্ত্ব গড়ে উঠেছে। তাঁরা সকল প্রকার অধ্যাত্মবাদ খন্ডন করে, পরাতাত্ত্বিক সমস্যার জড়বাদী ব্যাখ্যা প্রদান করে। তাই তারা অধ্যাত্মবাদের তীব্র সমালোচনা করে। প্রত্যক্ষ-উর্ধ্ব কোনো কিছু যেমন, ঈশ্বর, দেহাতিরিক্ত আত্মা, স্বর্গ, নরক, পরলোক ইত্যাদি বিশ্বাসযোগ্য নয়, একমাত্র জড়বস্ত্তই সত্য। ভারতীয় দর্শনের পঞ্চভূততত্ত্বের, অর্থাৎ, আকাশ, বায়ু, অগ্নি, অপ ও ক্ষিতির বিপরীতে ভূতচতুষ্টয় মতবাদ প্রদান করে। তাঁদের মতে, বায়ু, অগ্নি, অপ ও ক্ষিতি-এই চারটি ভূত বা জড় পদার্থ মূল উপাদান; এগুলো স্বাভাবিকভাবেই স্বস্ব গুণ অর্জন করে এবং এই চারটি জড় পদার্থ থেকে ‘স্বভাব নিয়মে’ জগতের উৎপত্তি হয়েছে। তাই জগৎ ঈশ্বরের সৃষ্টি নয়।

লোকায়ত দার্শনিকদের পরিচয় বা কারা লোকায়ত দার্শনিক

লোকায়ত দার্শনিকরা দেহাত্মবাদী বা ভূতচৈতন্যবাদী নামে পরিচিত। তাঁরা দেহাতিরিক্ত আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করে না। তাদের মতে, চৈতন্যবিশিষ্ট দেহই আত্মা, আত্মা বলে স্বতন্ত্র কিছু নেই, চৈতন্য দেহেরই একটি গুণ, চৈতন্য অতীন্দ্রিয় আধ্যাত্মিক সত্তার গুণ নয়। বায়ু, অগ্নি, অপ ও ক্ষিতি- এই চার ভূতচতুষ্টয় নিয়ে দেহ গঠিত। এই উপাদানসমূহ একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় মিশ্রিত হয়ে যে দেহের সৃষ্টি হয়, সেই দেহেই চৈতন্যরূপ এক নতুন গুণেরও সৃষ্টি হয়। সুতরাং চৈতন্য দেহ থেকেই জাত, দেহকে কেন্দ্র করেই চৈতন্যের জন্ম।

লোকায়ত দর্শনে ধর্ম ও মোক্ষকে নয়, অর্থ ও কামকে পরমপুরুষার্থ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। তাই তারা ভোগসুখবাদী। ‘ভোগ’ অর্থে ‘দৈহিক সুখ-সম্ভোগ’। দেহাতিরিক্ত আত্মা না থাকলে এবং দেহই একমাত্র সত্য হলে ‘আত্মিক’ সুখ বলে কিছু থাকতে পারে না। এজন্য তাদের মতে, ‘‘অঙ্গনালিঙ্গন-জন্য-সুখমেব-পুমর্থতা’’-অর্থাৎ অঙ্গনা-আলিঙ্গ জন্য সুখ সম্ভোগই মানবজীবনের একমাত্র কাম্য পুরুষার্থ। তারা ইন্দ্রিয় সুখ ও বর্তমান সুখকেই বাস্তবসত্য বলে মনে করে। তাদের নৈতিক উপদেশ হচ্ছে ‘‘যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ, ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পীবেৎ’’- অর্থাৎ, যতদিন বাঁচবে ভোগ ও সুখে বেঁচে থাক, প্রয়োজনে ঋণ করেও ঘি খাও