০৯:৩৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

ইতিহাস: লর্ড ওয়েলসলির ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ

জারিন তাসনিম
  • প্রকাশ: ০৪:৫৪:৫৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৭ জানুয়ারি ২০২২
  • / ৫১১৪ বার পড়া হয়েছে

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে গভর্নর লর্ড ওয়েলেসলি ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষা, রাজনৈতিক, সামাজিক, সংস্কৃতি ও সাহিত্য ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়।

কেন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ? 

ফোর্ট উইলিয়ামের ভেতরে ১৮০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, যা ছিল প্রাচ্যবিষয়ক একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের মূল উদ্দেশ্য ছিল নবনিযুক্ত ইউরোপীয় আমলাদের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি সাধনই। সুশিক্ষিত ও কুসংস্কারমুক্ত আমলাতন্ত্রের সহায়তায় কার্যকরভাবে ব্রিটিশ ভারত শাসনের এক পরিকল্পনা করেন লর্ড ওয়েলেসলি।

তখন পনেরো থেকে সতেরো বছর বয়সী কিশোরদের বিভিন্ন পদে অফিসার হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হতো। এই কিশোর-তরুণদের বেশির ভাগ অফিসার জেলা প্রশাসনে নিয়োগপ্রাপ্ত হতেন, কিন্তু স্থানীয় ইতিহাস, ভাষা ও শাসন-শৈলী সম্পর্কে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ তাদের দেওয়া হতো না। 

লর্ড ওয়েলেসলি উপনিবেশিক প্রশাসনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নবাগত অফিসারদেরকে প্রস্তুত করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও নৈতিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং একটি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন; এ থেকেই লর্ড ওয়েলেসলি ১৮০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ছিল বেসরকারি

ওয়ারেন হেস্টিংস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কলকাতা মাদ্রাসা এবং জোনাথন ডানকান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বেনারস হিন্দু কলেজের মতো লর্ড ওয়েলেসলির প্রতিষ্ঠা করা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ পরিপূর্ণ একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ছিল না। ভারতবর্ষে কর্মরত সকল সরকারি কর্মকর্তাদের নিকট থেকে প্রাপ্ত চাঁদা এবং সরকারি ছাপাখানার আয়ের একটা অনির্ধারিত বরাদ্দ থেকে এ প্রতিষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহের পরিকল্পনা করা হয়।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বিভিন্ন বিভাগ

ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিবেচনায় নিয়ে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বিভিন্ন বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ভারতের প্রধান প্রধান ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে কলেজের বিভাগগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিটি বিভাগে ছিলেন একজন অধ্যাপক ও কয়েকজন সহকারী শিক্ষক। ১৮০৫ সালের মধ্যে কলেজে মোট ১২ টি অনুষদ খোলা হয়। কয়েকটি বিভাগ সম্পর্কে নিচে উল্লেখ করা হলো —

ফারসি বিভাগ

ওই সময় ভারতে আদালতের ভাষা হিসেবে প্রচলিত ফারসি শিক্ষাদানের জন্য কলেজে একটি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ফারসি ভাষা বিভাগের প্রধান ছিলেন সরকারের একজন ফারসি অনুবাদক, তার নাম নেইল বি. এডমনস্টোন।

আরবি বিভাগ

লর্ড ওয়েলেসলি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের আরবি ভাষা শিক্ষাদানের জন্য উইলিয়াম জোনস-এর পরে সর্বোত্তম আরবি ভাষাবিশারদ হিসেবে বিবেচিত লেফটেন্যান্ট জন বেইলিকে নিযুক্ত করেন।

হিদুস্থানি ভাষা বিভাগ

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হিন্দুস্থানি ভাষা বিভাগের দায়িত্ব অর্পণ করা হয় স্বনামধন্য ভারতীয় ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সাহিত্যবিশারদ জন বি. গিলক্রাইস্টের উপর।

সংস্কৃত বিভাগ

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সংস্কৃত বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন বিখ্যাত প্রাচ্যবিশারদ এইচ. টি কোলব্রুক।

স্থানীয় ভাষা বিভাগ

বাংলা এবং ভারতের অনেক ভাষা বিশেষজ্ঞ ও ধর্মপ্রচারক উইলিয়াম কেরীকে স্থানীয় ভাষা বিভাগের প্রধান নিয়োগ করা হয়।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রতিটি বিভাগেই কয়েকজন করে পন্ডিত ও মুন্সি ছিলেন; কলেজ কর্মচারীদের মধ্যে তাঁরাই ছিলেন দেশীয়। কলেজের কর্মচারীদের বেতন স্কেলে সমতা বিধান করা হয়নি। একই পদে নিয়োগপ্রাপ্ত দেশীয় শিক্ষক ও কর্মচারীদের চেয়ে ইউরোপীয়রা দ্বিগুন বেতন পেতেন।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে গবেষণা ও প্রকাশনা

শ্রীরামপুর প্রেস ও এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল-এর সহযোগিতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে গবেষণা ও প্রকাশনার কাজ শুরু হয়। কলেজের বাঙালি শিক্ষকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত ছিলেন রামরাম বসু, তারিণীচরণ মিত্র ও মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার। এ সকল পন্ডিতের সাহায্যে কলেজের অধ্যাপকগণ বাংলা ভাষার মান উন্নয়ন ও বাংলা গদ্য রীতির প্রবর্তনের কাজে সফল পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিচালনা করেন।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের উৎসাহ ও সহযোগিতায় মুদ্রণ প্রযুক্তি ও বাংলায় গ্রন্থ প্রকাশনা শুরু হয় এবং জ্ঞান চর্চার কয়েকটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়।

১৮০১ সালে সুবিখ্যাত  শ্রীরামপুর মিশন প্রেস, পরের বছর হিন্দুস্তানি প্রেস, ১৮০৫ সালে ফারসি ছাপাখানা এবং ১৮০৭ সালে সংস্কৃত ছাপাখানার যাত্রা শুরু হয়। এ ছাপাখানাগুলিই ছিল বাংলায় বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের প্রথম বহিঃপ্রকাশ। এ ধরনের দ্রুত পরিবর্তনের গোটা কৃতিত্বই ছিল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের; মোটকথা, কলেজটি দ্রুত ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ হয়ে উঠছিল।

যেভাবে হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলজের বিলোপসাধন

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সাফল্য অর্জন সত্ত্বেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোর্ট অব ডিরেক্টর্স (পরিচালকসভা) পদ্ধতিগত কারণে এই প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন প্রদান করেনি। এ প্রসঙ্গে কোর্ট অব ডিরেক্টরস-এর যুক্তি ছিল যে, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য পরিচালকসভার পূর্ব অনুমোদন নেওয়া হয়নি।

পরিচালকসভা ওয়েলেসলিকে এ মর্মে অবহিত করেন যে, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের মতো একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অচিরেই ইংল্যান্ডে স্থাপন করা হবে।

তবে বাস্তব অবস্থার নিরিখে অবশ্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকে দেশীয় ভাষা শিক্ষাদানের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হয়।

পরবর্তীতে গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক শিক্ষা ও প্রশাসনের ক্ষেত্রে প্রাচ্যবাদী পথ বর্জন করতে সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। তিনি দেশীয় বা ভারতবর্ষের নিজস্ব ভাষায় বই লেখা ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে কলেজের উদ্যোগে গৃহীত প্রকল্পগুলির জন্য তহবিল প্রদানে অস্বীকৃতি জানান।

১৮৩০ সালে উইলিয়াম বেন্টিংক ইংরেজি ভাষাকে জনশিক্ষার মাধ্যম করে তাঁর শিক্ষানীতি ঘোষণা করেন। ১৮৩০ সালেই বেন্টিংক  ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপকদের পদগুলি বিলোপ করেন এবং ১৮৩১ সালে কলেজ কাউন্সিলও বিলোপ করা হয়। তবে বেন্টিংক কলেজের নামফলকটি অক্ষুণ্ণ রাখেন এবং কয়েকজন দেশীয় পন্ডিতকে তাদের পদে বহাল রেখে আমলাদের ব্যক্তিগত শিক্ষক হিসেবে কাজ করার অনুমতি দেন। লর্ড ডালহৌসির সরকার ১৮৫৪ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ আনুষ্ঠানিকভাবে বিলোপ করে।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

জারিন তাসনিম

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং স্বাধীন লেখক।

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

ইতিহাস: লর্ড ওয়েলসলির ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ

প্রকাশ: ০৪:৫৪:৫৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৭ জানুয়ারি ২০২২

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে গভর্নর লর্ড ওয়েলেসলি ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষা, রাজনৈতিক, সামাজিক, সংস্কৃতি ও সাহিত্য ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়।

কেন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ? 

ফোর্ট উইলিয়ামের ভেতরে ১৮০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, যা ছিল প্রাচ্যবিষয়ক একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের মূল উদ্দেশ্য ছিল নবনিযুক্ত ইউরোপীয় আমলাদের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি সাধনই। সুশিক্ষিত ও কুসংস্কারমুক্ত আমলাতন্ত্রের সহায়তায় কার্যকরভাবে ব্রিটিশ ভারত শাসনের এক পরিকল্পনা করেন লর্ড ওয়েলেসলি।

তখন পনেরো থেকে সতেরো বছর বয়সী কিশোরদের বিভিন্ন পদে অফিসার হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হতো। এই কিশোর-তরুণদের বেশির ভাগ অফিসার জেলা প্রশাসনে নিয়োগপ্রাপ্ত হতেন, কিন্তু স্থানীয় ইতিহাস, ভাষা ও শাসন-শৈলী সম্পর্কে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ তাদের দেওয়া হতো না। 

লর্ড ওয়েলেসলি উপনিবেশিক প্রশাসনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নবাগত অফিসারদেরকে প্রস্তুত করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও নৈতিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং একটি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন; এ থেকেই লর্ড ওয়েলেসলি ১৮০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ছিল বেসরকারি

ওয়ারেন হেস্টিংস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কলকাতা মাদ্রাসা এবং জোনাথন ডানকান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বেনারস হিন্দু কলেজের মতো লর্ড ওয়েলেসলির প্রতিষ্ঠা করা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ পরিপূর্ণ একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ছিল না। ভারতবর্ষে কর্মরত সকল সরকারি কর্মকর্তাদের নিকট থেকে প্রাপ্ত চাঁদা এবং সরকারি ছাপাখানার আয়ের একটা অনির্ধারিত বরাদ্দ থেকে এ প্রতিষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহের পরিকল্পনা করা হয়।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বিভিন্ন বিভাগ

ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিবেচনায় নিয়ে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বিভিন্ন বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ভারতের প্রধান প্রধান ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে কলেজের বিভাগগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিটি বিভাগে ছিলেন একজন অধ্যাপক ও কয়েকজন সহকারী শিক্ষক। ১৮০৫ সালের মধ্যে কলেজে মোট ১২ টি অনুষদ খোলা হয়। কয়েকটি বিভাগ সম্পর্কে নিচে উল্লেখ করা হলো —

ফারসি বিভাগ

ওই সময় ভারতে আদালতের ভাষা হিসেবে প্রচলিত ফারসি শিক্ষাদানের জন্য কলেজে একটি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ফারসি ভাষা বিভাগের প্রধান ছিলেন সরকারের একজন ফারসি অনুবাদক, তার নাম নেইল বি. এডমনস্টোন।

আরবি বিভাগ

লর্ড ওয়েলেসলি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের আরবি ভাষা শিক্ষাদানের জন্য উইলিয়াম জোনস-এর পরে সর্বোত্তম আরবি ভাষাবিশারদ হিসেবে বিবেচিত লেফটেন্যান্ট জন বেইলিকে নিযুক্ত করেন।

হিদুস্থানি ভাষা বিভাগ

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হিন্দুস্থানি ভাষা বিভাগের দায়িত্ব অর্পণ করা হয় স্বনামধন্য ভারতীয় ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সাহিত্যবিশারদ জন বি. গিলক্রাইস্টের উপর।

সংস্কৃত বিভাগ

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সংস্কৃত বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন বিখ্যাত প্রাচ্যবিশারদ এইচ. টি কোলব্রুক।

স্থানীয় ভাষা বিভাগ

বাংলা এবং ভারতের অনেক ভাষা বিশেষজ্ঞ ও ধর্মপ্রচারক উইলিয়াম কেরীকে স্থানীয় ভাষা বিভাগের প্রধান নিয়োগ করা হয়।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রতিটি বিভাগেই কয়েকজন করে পন্ডিত ও মুন্সি ছিলেন; কলেজ কর্মচারীদের মধ্যে তাঁরাই ছিলেন দেশীয়। কলেজের কর্মচারীদের বেতন স্কেলে সমতা বিধান করা হয়নি। একই পদে নিয়োগপ্রাপ্ত দেশীয় শিক্ষক ও কর্মচারীদের চেয়ে ইউরোপীয়রা দ্বিগুন বেতন পেতেন।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে গবেষণা ও প্রকাশনা

শ্রীরামপুর প্রেস ও এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল-এর সহযোগিতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে গবেষণা ও প্রকাশনার কাজ শুরু হয়। কলেজের বাঙালি শিক্ষকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত ছিলেন রামরাম বসু, তারিণীচরণ মিত্র ও মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার। এ সকল পন্ডিতের সাহায্যে কলেজের অধ্যাপকগণ বাংলা ভাষার মান উন্নয়ন ও বাংলা গদ্য রীতির প্রবর্তনের কাজে সফল পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিচালনা করেন।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের উৎসাহ ও সহযোগিতায় মুদ্রণ প্রযুক্তি ও বাংলায় গ্রন্থ প্রকাশনা শুরু হয় এবং জ্ঞান চর্চার কয়েকটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়।

১৮০১ সালে সুবিখ্যাত  শ্রীরামপুর মিশন প্রেস, পরের বছর হিন্দুস্তানি প্রেস, ১৮০৫ সালে ফারসি ছাপাখানা এবং ১৮০৭ সালে সংস্কৃত ছাপাখানার যাত্রা শুরু হয়। এ ছাপাখানাগুলিই ছিল বাংলায় বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের প্রথম বহিঃপ্রকাশ। এ ধরনের দ্রুত পরিবর্তনের গোটা কৃতিত্বই ছিল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের; মোটকথা, কলেজটি দ্রুত ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ হয়ে উঠছিল।

যেভাবে হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলজের বিলোপসাধন

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সাফল্য অর্জন সত্ত্বেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোর্ট অব ডিরেক্টর্স (পরিচালকসভা) পদ্ধতিগত কারণে এই প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন প্রদান করেনি। এ প্রসঙ্গে কোর্ট অব ডিরেক্টরস-এর যুক্তি ছিল যে, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য পরিচালকসভার পূর্ব অনুমোদন নেওয়া হয়নি।

পরিচালকসভা ওয়েলেসলিকে এ মর্মে অবহিত করেন যে, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের মতো একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অচিরেই ইংল্যান্ডে স্থাপন করা হবে।

তবে বাস্তব অবস্থার নিরিখে অবশ্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকে দেশীয় ভাষা শিক্ষাদানের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হয়।

পরবর্তীতে গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক শিক্ষা ও প্রশাসনের ক্ষেত্রে প্রাচ্যবাদী পথ বর্জন করতে সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। তিনি দেশীয় বা ভারতবর্ষের নিজস্ব ভাষায় বই লেখা ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে কলেজের উদ্যোগে গৃহীত প্রকল্পগুলির জন্য তহবিল প্রদানে অস্বীকৃতি জানান।

১৮৩০ সালে উইলিয়াম বেন্টিংক ইংরেজি ভাষাকে জনশিক্ষার মাধ্যম করে তাঁর শিক্ষানীতি ঘোষণা করেন। ১৮৩০ সালেই বেন্টিংক  ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপকদের পদগুলি বিলোপ করেন এবং ১৮৩১ সালে কলেজ কাউন্সিলও বিলোপ করা হয়। তবে বেন্টিংক কলেজের নামফলকটি অক্ষুণ্ণ রাখেন এবং কয়েকজন দেশীয় পন্ডিতকে তাদের পদে বহাল রেখে আমলাদের ব্যক্তিগত শিক্ষক হিসেবে কাজ করার অনুমতি দেন। লর্ড ডালহৌসির সরকার ১৮৫৪ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ আনুষ্ঠানিকভাবে বিলোপ করে।