১০:২৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

শাম্ব: মহাভারতের অভিশপ্ত কৃষ্ণপুত্র এবং তার ঔপন্যাসিক রূপান্তর

অধ্যাপক ড. মো. খোরশেদ আলম
  • প্রকাশ: ১০:৩২:৫৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ ডিসেম্বর ২০২১
  • / ৭৯২১ বার পড়া হয়েছে

কালকূট কর্তৃক রচিত উপন্যাস 'শাম্ব'-এর প্রচ্ছদ।

উপন্যাস আধুনিক জীবনের শিল্পিত বয়ান। তার মধ্যে অতিবাস্তব উপাদান থাকতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ যে-কোনো আধিদৈবিক ঘটনাকে অবিশ্বাস করে। পক্ষান্তরে সে নির্মাণ করতে চায় এক বাস্তব বিশ্ব। অন্যদিকে পৌরাণিকতা স্বয়ংসিদ্ধ এক প্রত্নরূপ। মহাকাব্যের যে-কোনো চরিত্রই অতিপল্লবিত কাহিনি-আক্রান্ত। মানুষ এই আধিদৈবিক পৌরাণিকতার মধ্যেই খুঁজতে চেয়েছে জীবনের রূপ। বিশ্বাসী মানুষের চোখে পুরাণ অখণ্ড। কিন্তু আধুনিক মানুষের চোখে পৌরাণিক ঘটনা সবসময় বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবুও পুরাণ যুগে যুগে সৃষ্টিশীল মানুষকে দর্শনের খোরাক এনে দিয়েছে।

‘মহাভারতে’র প্রত্যেকটি চরিত্রই কোনো না কোনোভাবে আধিদৈবিকতা-সিক্ত। তবুও এর অসংখ্য চরিত্রের ভিড়ে কতকগুলো চরিত্র নতুন বোধ ও জীবন-অনুভূতিকে নাড়া না দিয়ে পারে না। পাণ্ডব ও কুরুপক্ষীয় বহু চরিত্রের ভিড়ে অনায়াসেই চেনা যায়― ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু, গান্ধারী, কুন্তী, পঞ্চপাণ্ডব, দ্রৌপদী, ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, দুর্যোধন কিংবা অভিমন্যু, অশ্বত্থামা, বিদুর এঁদের সবাইকে। বেদব্যাস কাহিনিকার। তিনিও এই মহাকাব্যের মধ্যে মধ্যে স্বয়ং উপস্থিত। আত্মীয় পক্ষ-প্রতিপক্ষই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কুশীলব। স্বয়ং কৃষ্ণ তাকে ঘোষণা করছেন ধর্মযুদ্ধ বলে। কুরু-পাণ্ডব উভয়পক্ষের নীতি-দুর্নীতি ন্যায়-অন্যায় শক্তি সামর্থে্যর বহু ফিরিস্তি দান করেছেন বেদব্যাস। যদিও তিনি ধর্মত কৃষ্ণের মানসজাত মহিমাকে উচ্চে তুলে ধরেছেন। পাণ্ডবরা সেখানে নীতির ধ্বজাধারী অমিতবীর যোদ্ধা। আর্য-অনার্য ভাবমিশ্রিত সন্তান ব্যাসের হৃদয়ে তবু লুকিয়ে থাকে কৌরবপক্ষীয় কোনো কোনো চরিত্রকে দীপ্তি দানের প্রচেষ্টা। ভীষ্ম, গান্ধারী, বিদুর, কর্ণ যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। অন্যদিকে মহাভারতে কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ-সমাপ্তি এবং পাণ্ডব পক্ষের সিংহাসনারোহণ ঘটে।

বাসুদেব নন্দন কৃষ্ণ যাদবশ্রেষ্ঠ। তিনি কেবল নরপতি নন, কালান্তরে ভগবান কৃষ্ণ। যদুবংশে তিনি কখনোই রাজসিংহাসনের অধিকারী ছিলেন না। কিন্তু রাজা না হয়েও তিনি রাজ-অধিক ক্ষমতাধারী। তিনিই পাণ্ডবদের প্রতিষ্ঠা ও মন্ত্রণাদাতা ঈশ্বর—স্বয়ং বিষ্ণুর বরপ্রাপ্ত। অন্য অর্থে তিনিই যুগে যুগে সম্ভবামি সত্য হয়ে ফিরে ফিরে আসেন। কিন্তু এই ঈশ্বর মহিমার কৃষ্ণও খোদ বেদব্যাসের হাতেই যেন বাস্তব হয়ে ওঠেন। কারণ যুগের অনিবার্য প্রবহমানতা আর কালের সত্যই নির্ধারণ করে দেয় তাঁর ভবিতব্য। আত্মীয় হত্যার বিরাট যজ্ঞ কুরুক্ষেত্রেই অভিশপ্ত হয়ে ওঠেন তিনি। কেননা জ্ঞাতিক্ষয়কর যুদ্ধ নিবারণে সমর্থ হয়েও কৃষ্ণ তা করেননি। গান্ধারী তাঁকে অভিশাপ দেন অপঘাতে মৃত্যুর ভবিষ্যতবাণী দিয়ে। এই ভবিষ্যতবাণী আধিদৈবিক হলেও স্বয়ং কৃষ্ণর বাস্তব মৃত্যু যা খুব স্বাভাবিক, একান্তভাবে তা-ই সমস্ত পৌরাণিক বিশ্বাস-খণ্ডনে যথেষ্ট। পরিশ্রান্ত কৃষ্ণের পদতলে একজন ব্যাধের তীর এসে আঘাত করলে তিনি নিহত হন। যিনি মহাবীর অর্জুনের সারথী, যুদ্ধ না করেও বিরাট কৌশলী, সময় সময় ঐশ্বরিক শক্তি ভর করে পাণ্ডবদের জেতানোর যাবতীয় পরিকল্পনাকারী― তার এহেন মৃত্যু, গান্ধারীর অভিশাপ তাঁকে সাধারণ মানুষের স্তরে নামিয়ে আনে। যদুবংশ ধ্বংসের ইঙ্গিতসহ অসংখ্য মৃত্যুর জন্য দায়ী কৃষ্ণ। অভিশাপ-গঞ্জনার এ-আরেক নমুনা নয় কি!

এই যদুবংশ ধ্বংসের নায়কই মহাভারতের ‘মৌষল পর্বে’র শ্রীকৃষ্ণপুত্র শাম্ব। পৌরাণিক অভিধানে উল্লেখ:

একবার বিশ্বামিত্র, কণ্ব ও নারদ মুনি দ্বারকায় গেলে যাদবগণ কুবুদ্ধিবশত: কৃষ্ণপুত্র শাম্বকে পেটে কাপড় বেঁধে গর্ভিনী-বেশে সজ্জিত করে ঋষিদের কাছে নিয়ে গিয়ে বলেন যে, ইনি বভ্রুর স্ত্রী, এঁর কি সন্তান হবে? মুনিরা প্রতারণা ধরতে পেরে ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দেন যে শাম্ব এক লৌহমুষল প্রসব করবে, যদ্দারা যদুবংশ ধ্বংস হবে। পরদিন শাম্ব এক লৌহমুষল প্রসব করেন এবং যাদবগণ সেই মুষলচূর্ণ করে সমুদ্রে নিক্ষেপ করেন।  (পৌরাণিক অভিধান ১৪১২: ১২৪, ৫০৩)

যাদব বংশ একসময় অন্যায় ও পাপে ছেয়ে যায়। এরই ফলস্বরূপ তারা ক্রমশ ধ্বংসমুখি হয়। সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত পুরাণকথিত মুষলচূর্ণ থেকে উৎপন্ন এক রকম তৃণের আঘাতেই যদুবংশ ধ্বংস হয়। শ্রীকৃষ্ণ ও জাম্ববতী-পুত্র শাম্বের এই পরিণতি এক ভয়ংকর অভিশম্পাতের ফল। কিন্তু এই শাম্বকেই ‘শাম্ব পুরাণে’ ব্যক্ত করা হয়েছে ‘বিবস্বান’ বা সূর্য বলে। সে রূপময়, দারুণ সুপুরুষ, দিবসে উদিত উজ্জ্বল আলোকধারা। পুরাণের নানা পল্লবিত কাহিনিতে শাম্ব নানা ভাবেই চিত্রিত। মহাভারতের যুদ্ধে তার পিতা কৃষ্ণ ছিলেন দুর্যোধনের ভিন্ন পক্ষে। কিন্তু শাম্বই পরবর্তীকালে দুর্যোধন কন্যা লক্ষ্মণাকে স্বয়ংবর সভা থেকে হরণ করে। এ-কাজের পর কৌরবরা তাকে বন্দি করে। কিন্তু পিতার বড়ভাই বলরামের খুবই প্রিয়পাত্র ছিল শাম্ব। তিনিই শাম্বকে এদের হাত থেকে মুক্ত করেন। তবে শাম্ব সম্পর্কে সবচেয়ে বড় ঘটনা― মুষলপ্রসব ও যদুবংশ ধ্বংস। কিন্তু এই যদুবংশ ধ্বংসের জন্য দায়ী ব্যক্তিটিকেই কালকূট ভিন্নভাবে রূপায়িত করেন। সেই কাহিনিতে শাম্বের লক্ষ্মণাহরণ বা মুষলপ্রসব নয় বরং প্রাধান্য পায় পাপ ও শাপমুক্তির আখ্যান। পুরাণ-ভাঙা সেই নবকাহিনির নায়ক শাম্বও অভিশপ্ত। কিন্তু পরিণামে পাপ-আত্মোপলব্ধি ও মুক্তিতে অনন্য চরিত্ররূপে প্রতিষ্ঠিত। উল্লেখ্য, কালকূট হলো ভারতীয় সাহিত্যিক সমরেশ বসুর ছদ্মনাম।     

কালকূট ঔপন্যাসিক সত্তার আড়ালে গল্পকথনের এক স্বতন্ত্র কৌশল অবলম্বন করেন। মানুষ, সমাজ, বাস্তবতা, রাজনৈতিক প্রসঙ্গ সেখানে প্রতীকের অন্তরালবর্তী। কালকূট-সাহিত্য মহাভারত ও অন্যান্য ভারত-পুরাণের আলোকে ইতিহাস-দর্শন পরিশ্রুত হয়ে মানব মনের নৈকট্য এবং এর সার্বজনীনতা অন্বেষণকামী হয়ে ওঠে। তাঁর রচনার বিচিত্র চরিত্রে আত্মাহুতি, ভালোবাসা, স্নেহ ও আত্মচেতনাকে তিনি ফুটিয়ে তোলেন। বস্তুত আধুনিক নিঃসঙ্গ মানুষকে তার বিদ্রোহ ও যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে তিনি শাপমুক্ত করেন। অন্তর্দ্বন্দ্ব ও দায়িত্ববোধ এখানে চরিত্রের অন্যতম চালিকা শক্তি। বস্তুত তিনি পুরাণ-মোড়কে মানবতাকেই আশ্রয় দেন। পুরাণকথিত ঐতিহাসিক পথ, কিংবদন্তীর অন্বেষণে বিচিত্র আঙ্গিকে মানুষকে জানার ও ধরার চেষ্টা করেন তিনি। তেমনি করেন ঐতিহ্য-অনুসন্ধান এবং পুরাণের নবনির্মিতি।

পৌরাণিক কাহিনি, ইতিহাস ও দর্শনের নানা পথ বেয়ে কালকূট পেতে চান নিগূঢ় জীবনসত্যের সন্ধান। কালকূটের এই পথ-পরিক্রমা গভীরতর দার্শনিক সংকেত-সমৃদ্ধ। ধর্মীয় ব্যাখ্যা থাকলেও গূঢ় ঐতিহাসিক সত্য-সন্ধানে তাঁর অন্বিষ্ট বিষয় আসলে মানুষ এবং মানুষের সমাজ। পুরাণনির্ভর শাম্ব, প্রাচেতস্, যুদ্ধের শেষ সেনাপতি, পৃথা ও অন্তিম প্রণয়—এই পাঁচটি উপন্যাসেই বিধৃত হয়েছে পুরাণ-চেতনা, পুরাণের নতুন ব্যাখ্যা। আবার তার মধ্য দিয়েই তিনি করেন স্বদেশ ও সমাজের সংগ্রামী চরিত্রের স্বরূপ-অন্বেষণ। কালকূট মহাভারতের রচনা থেকে উদ্ধার করেন, ‘ইতিহাসবিদং চক্রে পূণ্যং সত্যবতীসুতঃ’ (কালকূট ১৯৯৬: ১০১৫)।― একথায় বোঝা যায়, মহাভারত একটি ইতিহাস গ্রন্থও। কিন্তু ইতিবৃত্তের অলৌকিকতা থেকে সত্য-সন্ধানই লেখকের উদ্দেশ্য। কালকূট পুরাণকারের সংকেতাচ্ছন্ন ইতিহাসকে এভাবেই দেখার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে: ‘ভারতকাহিনী ভারতেরই বৈদিক অথবা প্রাক-বৈদিক যুগের ভারতীয় ইতিহাস।’ (কালকূট ১৯৯৬: ১০১৫)। পুরাণের নির্মোক খসিয়ে কালকূট যে-সত্যের কাছাকাছি পৌঁছান তাতেই তিনি অনন্য শিল্পস্রষ্টা হয়ে ওঠেন।

‘মহাভারত’কে কালকূট আধুনিক বৈজ্ঞানিক মন নিয়ে বুঝতে চেষ্টা করেছেন। ফলে অতীত গল্পের সঙ্গে যুক্ত হয় আধুনিকতাবোধ। শাম্ব উপন্যাসে শ্রীকৃষ্ণ পুত্র শাম্বের পাপ, অভিশাপ ও প্রায়শ্চিত্তে মানব-মুক্তির আকাঙ্ক্ষা পরিস্ফুট। ‘শাম্ব’ উপন্যাসে ধর্ম ও ইতিহাসের প্রসিদ্ধ মানব কৃষ্ণপুত্র শাম্ব। অভিধানে উল্লিখিত, সে ‘শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী জাম্ববতীর গর্ভজাত অন্যতম পুত্র।’  (পৌরাণিক অভিধান ১৪১২: ৫০৩)। শাম্ব চরিত্র-নির্মিতির মাধ্যমে কালকূট আবিষ্কার করেন প্রাচীন কালের একজন প্রভূত প্রভাবশালী ও ত্যাগী এবং মানবতায় উচ্চকিত সংগ্রামশীল ব্যক্তিকে। সূর্যসাধনার কঠোর নিয়মতান্ত্রিকতার সংযম অনুশীলন করে শাম্ব চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সবলতা অর্জন করে। শাম্বই হলো ভারতপুরাণে প্রথম সূর্যসাধক। শাস্ত্রীয় পূজার নিয়মকানুন সে পালন করেনি, বরং রোগগ্রস্ত দেহের আরোগ্য লাভের জন্য সূর্যসাধনা করেছে। শাম্বপুরাণ-এ সৌরসাধক শাম্ব সম্পর্কে জানা যায়। সূর্য বংশের কুলগুরু বশিষ্টমুনি সূর্যবংশীয় রাজা বৃহদ্বলকে বলেছেন:

কৃষ্ণপুত্র শাম্ব রোগমুক্তির জন্য সূর্যের সহস্র নামের সাধনা করতে করতে কৃষ্ণও দুর্বল হয়ে পড়েছেন। সূর্যদেব তখন শাম্বকে স্বপ্নাদর্শন করিয়ে বলেন, কষ্টসাধ্য সহস্র নামের পরিবর্তে শাম্ব তার একুশটি গোপনীয় পবিত্র ও মঙ্গলদায়ক নামগুলিরই আরাধনা করুক। পরবর্তীকালে সেই একুশ নামই সূর্যস্তবরূপে চিহ্নিত হবে। যেমন― বিকর্তন, বিশ্বায়ন, মার্তণ্ড, ভাস্কর, রবি, লোক প্রশাসক, শ্রীমান, লোকচক্ষু, গ্রহেশ্বর, সপ্তাশ্ববহন, গভস্তি হস্ত, ব্রহ্মা, লোকসাক্ষী, তিলোকেশ, কর্তা, হর্তা, তমিস্রহা, তপন, তাপন, শুচি, সর্বদেব। শাম্ব এই একুশ নাম জপ করেই রোগ নিরাময় করেছে। (চক্রবর্তী ১৯৯৫: ৯৪-৯৫)

এই হলো ‘সাম্ব পুরাণ’ কথিত সৌর সাধনার ইতিহাস। ‘সাম্ব পুরাণ’ থেকে গৃহীত এই ‘শাম্ব কাহিনি’ মূলত ঘটনা ও সংকেত দ্বারা সংগৃহীত। উপন্যাস-শিল্প সৃষ্টি-মানসে লেখক আসলে কল্পনা-সূত্রে গেঁথে পুরাণকাহিনির অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন। এক্ষেত্রে তাঁর কাছে শিল্পের ভুমিকাই প্রবল। তিনি প্রত্যক্ষ করেন― সৌর-সাধনার কঠোর অনুশীলনের ভেতর পার্থিব সংগ্রাম-চিত্র। সাহিত্যিক-ঐতিহাসিক অদ্বৈতচর্চার মাধ্যমে কালকূট পাঠককে ইতিহাস ও সাহিত্যের গোধূলি-সন্ধিতে নিয়ে যেতে চান। সেখানে সাহিত্য ও ইতিহাস উভয়েই নির্দিষ্ট সীমারেখায় একে অপরের সঙ্গে যুক্তবেণীবদ্ধ। এ-উদ্দেশ্য নিয়েই মানুষের চিরন্তন রূপ-উদ্ঘাটন করেন তিনি। পুরাণের পাতায় পাতায় ভারত-দর্শন ও ঐতিহাসিকতা অন্বেষণ করেন তিনি মানুষের চরিত্র পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই।

পুরুবংশীয় কৌরবদেব মধ্যে নারদমুনির কথা জানা যায়। পরিভ্রমণের মধ্য দিয়ে যাবতীয় পার্থিব সংবাদ গ্রহণ করে তিনি অশেষ জ্ঞানের অধিকারী হয়েছিলেন। সে-সঙ্গে তাঁর চরিত্রে প্রচণ্ডতা ও কুটিলতাও লক্ষণীয়। এই নারদমুনির কোপানলই শাম্ব জটিলতার মূল কারণ। দ্বারকাপুরীতে নারদমুনির আবির্ভাবে শাম্ব কাহিনির সূত্রপাত। কৃষ্ণসহ বৃষ্ণিগণ যখন মহর্ষির সাদর অভ্যর্থনায় রত তখন পুষ্পবনে সহচরিদের নিয়ে ব্যস্ত ছিল রূপবান শাম্ব। মহর্ষির দিকে সে একবারের বেশি তাকাবার অবকাশ পায়নি। মহর্ষি এতেই রুষ্ট হয়ে শাম্বের সকল অহংকার চূর্ণ করার মনোবাসনা করেন। ষড়যন্ত্র করে পিতা কৃষ্ণকে পুত্রের বিরুদ্ধে দাঁড় করান নারদ। শাম্বর আপন রূপই তার জন্য শত্রু হয়ে ওঠে। গোপবালাদের সঙ্গে শাম্ব পাপকর্মে লিপ্ত বলে কৃষ্ণের কাছে অভিযোগ আনেন নারদ। রৈবতক পর্বত সন্নিকটে ভিন্নপুরুষ প্রবেশ-নিষিদ্ধ প্রমোদ-কাননে ষোলশত গোপীসহ জলক্রীড়ায় মগ্ন কৃষ্ণের কাছে নারদের কূটকৌশলেই শাম্বকে উপস্থিত করা হয়। মুহূর্তেই স্খলিত বসনা রমণীরা রূপবান শাম্বের প্রতি কামনাবিহ্বল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। জাম্ববতী, সত্যভামা ও রুক্মিণী ছাড়া আর সব নারীই শাম্বের প্রতি কামাসক্ত; এটি প্রত্যক্ষ করে কৃষ্ণ অস্থির ক্রোধে ফেটে পড়েন। তিনি মহর্ষির ষড়যন্ত্রের কূটচক্র-ফাঁদে ধরা দেন। নির্দোষ পুত্রের প্রতি তাঁর চরম রোষ উপস্থিত হয়। রোষ ও ঈর্ষায় প্রজ্জ্বলিত কৃষ্ণ অভিশাপ বর্ষণ করেন― ‘তোমার এই রমণীমোহন রূপ নিপাত যাক। কুষ্ঠরোগের কুশ্রীতা তোমাকে গ্রাস করুক।’ (কালকূট ১৪২২: ৪৪)। এমনকি তিনি শাম্বের প্রতি মোহগ্রস্ত এবং কামবিহ্বলদৃষ্টির রমণীদের প্রতিও কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, ধিক্কারের সুরে উচ্চারণ করেন― 

‘তোমরা আমার রক্ষিত হয়েও অতি নিকৃষ্ট আচরণ করেছ। অতিপ্রমত্তা হয়ে তোমরা যেমন পণ্যাঙ্গনাদের ন্যায় ব্যবহার করেছ, আমার মৃত্যুর পরে, তোমরা তস্করদের দ্বারা লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত হবে।’ (কালকূট ১৪২২: ৪৪)

শাম্ব আসলে ভাগ্যচক্র-পীড়িত মানবাত্মার প্রতীক। সূর্যতপস্বী শাম্ব তপস্যা ও আত্ম-অন্বেষণে মহামানব হতে চেয়েছিল। কিন্তু নিয়তির অভিশাপকে অতিক্রম করতে পারেনি। ‘মিথ অব সিসিফাসে’র প্রসঙ্গ এখানে অনিবার্য। তবু মানবজীবনের প্রকৃত সংগ্রাম বিপুল দুঃখ ও অভিশাপেরই বিরুদ্ধে। মর্ত্যে অমরাবতী কখনোই সৃষ্টি করা সম্ভব নয়, তবু এই অসম্ভব প্রয়াসের মধ্যেই মানুষের শ্রেয়বোধ জাগ্রত হয়। শাম্ব উপন্যাস তাই শাম্বেরই আত্মোপলব্ধির ইতিহাস। এখানে কালকূট পুরাণ ও চলমান সমাজের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করেন। তিনি দেখান, শাম্ব বিনা দোষেই মহর্ষির দ্বারা শাপগ্রস্ত। সে স্বেচ্ছায় ঋষিকে অপমান করেনি। কিন্তু নেমেসিসের নির্মম অভিশাপ নেমে আসে তার জীবনে। মহর্ষিকে একবার দেখতে পেয়েও তার প্রতি কী আচরণ করা উচিত সে বুঝে উঠতে পারে না। কারণ তখন প্রণয়লীলায় সে মগ্ন।

কালকূট কর্তৃক রচিত উপন্যাস 'শাম্ব'।
কালকূট কর্তৃক রচিত উপন্যাস ‘শাম্ব’-এর প্রচ্ছদ।

তবে পুরাণ-বর্ণিত নারদের প্রতি শাম্বের অবজ্ঞাকে কালকূট প্রাধান্য দেননি। বরং মানবিক দুর্বলতার বিষয়টিকেই প্রধান করে তুলেছেন। শাম্ব ‘সবসময় মহাত্মা নারদের অবজ্ঞা করতেন’ মূলের এ-বাক্যটিকে সচেতন প্রয়াস হিসেবে চিহ্নিত করতে তিনি সংযোজন করেন:

‘শাম্ব আচরণবিধি জানেন না, এমন না, তবু ভুলে গেলেন।’ (কালকূট ১৯৯৬: ৯৮১)

শাম্বের ব্যক্তিগত সম্পর্ক, গৃহত্যাগ করে মিত্রবন-গমনপথে তার সঙ্গে বিভিন্ন ব্যক্তির (পুজারিণী ধীবর মাঝি ঋষিতুল্য ব্যক্তি) সাক্ষাৎ সম্পূর্ণ ঔপন্যাসিক কল্পনা। কিন্তু পুরাণ-কাহিনির অলৌকিকতা পরিপূর্ণরূপে বর্জন করা এ-ধরনের উপন্যাসে সবসময় সম্ভব নয়। যেমন: মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধুতে’ও তা সম্ভব হয়নি। চরিত্রসমূহের নাম এবং কারবালা যুদ্ধের নানা তথ্য লেখককে অবিকৃত রাখতে হয়েছিল। এজিদ-হৃদয়ের রক্তক্ষরণজনিত যন্ত্রণাটুকুর আশ্রয় নিয়েই ঔপন্যাসিক সেখানে কল্পনার রঙ চড়িয়েছেন। এখানেই তিনি সার্থক। নিয়তির নায়ক শাম্ব পিতা কৃষ্ণকর্তৃক যে ব্যাধিগ্রস্ত হওয়ার অভিশাপ পান সেটি পূর্বঘোষিত। কৃষ্ণ তাকে জানান জন্মলগ্ন থেকেই কুষ্ঠরোগের মতো কুৎসিত ব্যাধি শাম্বের ভাগ্যলিপি। নিয়তির এই চরম নির্দেশনাকে অমোঘ মেনেই দুর্ভাগ্য থেকে উত্তরণের পথ-সন্ধান করতে হয়েছে তাকে। দুর্ভাগ্যের জন্য নিয়তি নির্দেশিত অভিশাপের কথা জেনেও শাম্ব অগ্রসর হয় মুক্তি-অন্বেষণে; এখানেই সে সংগ্রামশীল অথচ ‘মিথ অব সিসিফাসে’ আক্রান্ত মানবসত্তা। শাম্বের মুখে উচ্চারিত হয়:

আমার ভাগ্যের এই অমোঘ অনিবার্য পরিণতি জেনেও আমি নিশ্চেষ্ট থাকবো না। প্রয়োজন হলে মুক্তির জন্য আমি এই সসাগরা পৃথিবী, দেবলোকে, অন্তরীক্ষে সর্বত্র যাবো। (কালকূট ১৯৯৬: ৯৯৩)

নারদ প্রভাবে শ্রীকৃষ্ণের অভিশাপ দণ্ডে দণ্ডিত হলেও শাম্ব ভেঙে পড়েনি। সে বিশ্বাস হারায়নি আত্মশক্তিতে বরং নারদের কাছে মেনে নিয়েছে তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা। ব্যাধি-আক্রান্ত শাম্ব মিত্রবনের উদ্দেশ্যে গমন করে। নারদ নির্দেশেই সে রোগমুক্তির যন্ত্রণা-জর্জর ক্লেশময় পথ-পরিক্রমায় অংশ নেয়। চন্দ্রভাগা নদী তীরে উপস্থিত হয়ে শাম্ব দেখে জীবনের প্রতি বিশ্বাসহীন কুষ্ঠরোগীর দলকে। সমাজ-সংসার বহিষ্কৃত এ-সমস্ত মানুষ যদৃচ্ছ জীবন কাটায়। অবাধ যৌনাচারের মধ্য দিয়ে এরা সন্তান উৎপাদনও করে। একদিন আরোগ্যের আশা নিয়েই এরা মিত্রবনে এসেছিল। কিন্তু ব্যাধিতে ভুগে তাদের জীবন নষ্ট হয়ে গেছে। এজন্যই শাম্ব-র মনে হয়:

এদের কোন আশা নেই, অতএব, কোনো বিশ্বাসও নেই। অথচ এরা অবিশ্বাসী ছিল না, তাহলে এখানে আসতো না। (কালকূট ১৯৯৬: ১০০০)

শাম্ব এই হতাশ ব্যাধিগ্রস্তদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে চান। তিনি কঠিন সাধনার পথে আরোগ্য লাভের অনুসন্ধান তাদেরকে দিতে চান। অথচ স্বীয় অভিশাপের অমোঘতা সম্পর্কে তার দ্বিধা নেই― ‘অভিশাপ জিজ্ঞাসার অতীত। এ অমোঘ এবং অনিবার্য। এ ভাগ্যের পরিহাস না, নির্দেশ।’ (কালকূট ১৯৯৬: ৯৯৩)। এ-নির্দেশে অঙ্গীভূত হয়েই শাম্ব অতিক্রম করে বহু দুর্গম পথ, সহ্য করে তথাকথিত সুস্থ মানুষের অকারণ কটূভাষ অথবা কারুণ্য, জয় করে আধিভৌতিক তথা আধিদৈবিক বিপদের ভয়। ‘শাপমোচনেই তোমার জীবনের মোক্ষলাভ। …আমার কেন এমন দুর্ভাগ্য হল, অপরের কেন হলো না, এইরূপ প্রশ্ন বাতুলতা মাত্র।…কেননা জরা আছে, ব্যাধি আছে, মৃত্যু ঘটে এইসব নিয়ে মানুষ বিলাপ করে, শোকাকুল হয়। অথচ এসব আক্রমণের থেকে কারুরই রেহাই নেই।…ব্যক্তির দুর্ভাগ্যের জন্য তাকে একাকী সংগ্রাম করতে হয়।’ (কালকূট: ৯৯৮)। শাম্ব স্বীয় চেষ্টায় মুক্তি লাভের পথ অনুসন্ধান করেছে। ঋষির মুখে শুনেছে সূর্যদেবের আরাধনার কথা। সে সূর্যালোকের দ্বাদশ স্থান পরিভ্রমণ করে কেবল একার নয়, সকলের রোগমুক্তি চায়। মিত্রবনের রোগজীর্ণ বিশ্বাসহীন সমাজকে দেখে শাম্বের মনে হয়― ‘এদের মুক্তির কি কোনো উপায় নেই? তাঁর নিজের মুক্তিরই বা কি উপায়।’ (কালকূট ১৯৯৬: ১০০১)

শাম্বের সংগ্রাম একক দুর্ভাগ্যের জন্য নয়। এখানে ব্যক্তির পাপ মূলত সমাজেরই পাপ। তাই ব্যক্তির দুর্ভাগ্যের দায় নিতে হয় সমাজের সকলকেই। আত্মানুসন্ধানে প্রবৃত্ত মানুষ যখনই তার ব্যক্তিসত্তার গভীরে যেতে চায়, অন্বেষণ করে মুক্তির, তখনই সে ব্যক্তিসত্তাকে সমাজের ব্যাপক অংশে বিধৃত দেখতে পায়। তাই যে-কোনো সৎ-সাধনার পশ্চাতে থাকে যথার্থ সমাজবোধ। লক্ষণীয় যে, ‘শাম্ব পুরাণে’ শাম্ব সূর্যকে প্রসন্ন করে মুক্তি পেয়েছিল ব্যাধি থেকে এককভাবে। কিন্তু এ-উপন্যাসে সচেতনভাবে কালকূট শাম্বের সাধনাকে একাকিত্বের সাধনায় অভিষিক্ত না করে সমাজবোধের সঙ্গে যুক্ত করেন। পুরাণে শাম্বের সাধনা আত্মকেন্দ্রিক, কালকূটের সাধনা আত্মবোধের সঙ্গে জড়িত হয়েও সমাজবোধে উৎসারিত। কিন্তু অবিশ্বাসী হতাশাগ্রস্ত কুষ্ঠ রোগীর দল শাম্বের কথায় আস্থাশীল হয়নি। একজন বিদ্রূপ করে ওঠে:

কিন্তু ও যে কী সব বিশ্বাস-ফিশ্বাসের কথা বলছে। ওসবতো মিথ্যা, ছলনা। শাম্ব তখন বলে, যার বিশ্বাস হারায় তার সবই হারিয়ে যায়। (কালকূট ১৯৯৬: ১০০৭)

তারা মনে করে তাদের সবই হারিয়ে গেছে। তাদের আর কোনো কিছুতেই বিশ্বাস নেই। শাম্ব উত্তরে বলে:

আমার সঙ্গে তোমাদের এই প্রভেদের কথাই বলছিলাম। আমি বিশ্বাস করি, আমার পাপই আমাকে বিনাশ করতে উদ্যত হয়েছে, আর একমাত্র মুক্তির উপায় দুষ্কর প্রায়শ্চিত্ত। এই আমার বিশ্বাস। (কালকূট ১৯৯৬: ১০০৭)

শাম্ব উপলব্ধি করে তার অতীত জীবন এখন আর স্মৃতি ছাড়া কিছুই নয়। জীবনের সুখ ও বিলাস তাকে স্পর্শক্ষম নয়। আর এজন্যই প্রতিশ্রুতিশীল লক্ষ্য ছাড়া কোনো কিছুই তাকে বিচলিত করে না। তবে সকলের দুর্ভাগ্যকে এক করে নিয়েও তাঁর চলার পথ স্বতন্ত্র। ঋষিবাক্য অনুসরণ করে সে পৃথক অন্ন ও আশ্রয় গ্রহণ করে, অবাধ শৃঙ্গারে উন্মত্ত হয় না। এটা আত্মাকে অন্যভাবে আবিষ্কার করারই একটা উপায়। তার সত্তাকে সে সমাজের বৃহৎ অংশে ছড়িয়ে থাকতে দেখে। ঐ-সব হতভাগ্য কুষ্ঠরোগীরা তো তারই সত্তাকে বহন করে চলে। আত্মোপলব্ধির পথ তো এই। শাম্ব চরিত্রের এ-হেন পরিবর্তনে আমরা আরও একবার বুঝতে পারি পুরাণ-চর্চার উদ্দেশ্য কালকূটের নেই বরং পুরাণের মুকুরে আত্মদর্শনই তাঁর অন্বিষ্ট।

কুষ্ঠরোগী জীবনের প্রতি চরম অবিশ্বাসী মানুষদের যদৃচ্ছ যৌনবাসনাকে অস্বীকার করেই শাম্ব তার প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হয়েছিল। তার কর্মপথে সূর্যমন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থের প্রয়োজন পড়লে সে দ্বারকায় যায়। পত্নী লক্ষণা কান্নায় ভেঙে পড়ে শাম্বকে পূর্বের মতোই স্বামীরূপে পেতে চায়। কিন্তু সেই রাজপুত্রের বেশ ও বিলাসবহুল জীবন তখন তার নয়। তাই সে বলে:

নিতান্ত অর্থের প্রয়োজনেই আমি এখানে এসেছিলাম। আমার অতীত জীবন আর কখনোই ফিরে আসবে না। তোমার যদি ইচ্ছা হয়, তবে যে-কোনো সময়ে পঞ্চনদীর দেশে, চন্দ্রভাগার তীরে মিত্রবনে ফিরে এসো। সেখানেই তোমার যদি বাস করতে ইচ্ছে হয়, বাস করো। আরও শোনো লক্ষণা, জীবন কখনো এক স্থানে দাঁড়িয়ে থাকে না। তা সতত সঞ্চরমান, পরিবর্তনশীল। তুমি তপোবনে গেলে, রৈবতকের এই হর্ম্যতলের বিলাসকক্ষের জীবন পাবে না। তোমার স্বামীকেও পূর্বের ন্যায় পাবে না। (কালকূট ১৯৯৬: ১০১১)

শাম্ব চরিত্রে বিশ্বাসের এই পরিবর্তন মূলত আধুনিক মানুষেরই বোধ।

নীলাক্ষী শাম্বের জীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত। জীবনের সুন্দর রূপে অনাস্থা ও ভোগ-উন্মত্ত নীলাক্ষী শাম্ব-স্পর্শে মানস-পরিবর্তন করে। ভোগ-সম্ভোগের জীবন থেকে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়। মানবতার জন্য ত্যাগের মহিমায় অভিষিক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে সে হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। মিত্রবনে উপস্থিত হয়ে প্রথমাবস্থায় শাম্বকে খাদ্য দানের পেছনে ছিল তার যৌন সম্ভোগকামনা। তার কামনার পেছনে নিজের প্রতি দুঃখবোধও ছিল। কিন্তু তার জন্য শাম্ব সমব্যথী হলেও মুক্তি-পথে যথেচ্ছা যৌনাচারকে বাধা প্রদান করে। তার প্রত্যাখ্যানের প্রতিক্রিয়ায় নীলাক্ষীর রোষ ও অভিশাপ বর্ষিত হয়। কিন্তু পরিবর্তনশীলতার ছোঁয়ায় সে নতুন মানুষি-সত্তায় জেগে ওঠে। পরে নীলাক্ষীর সাহায্যেই সত্তর জন কুষ্ঠরোগীকে নিয়ে আরোগ্য লাভের মুক্তিপথে শুরু হয় শাম্বের যাত্রা। ‘দ্বাদশ স্থানে ও নদ নদীতে স্নান করে, দ্বাদশ মাস পরে তিনি যখন আবার চন্দ্রভাগাকূলে অস্তাচলমান স্থানে ফিরে এলেন তখন তাঁকে বাদ দিয়ে চৌদ্দজন মাত্র জীবিত।’(কালকূট ১৯৯৬: ১০০৯)। এই চৌদ্দ জন আজ নিজেদের যথার্থ অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে। কালকূট দেখান মৃত্যুময় অসারতা অতিক্রম করে কুষ্ঠরোগীরা অনিবার্য মৃত্যুকে পেছনে ফেলে চলমান জীবনের প্রতি লড়াই অব্যাহত রেখেছে। লক্ষ্যে পৌঁছান সবার পক্ষে সম্ভব হয়ত নয় কিন্তু জীবন-প্রবাহকে তারা অস্বীকার করে না। নীলাক্ষীও শাম্বের জীবনে জড়িত হয়ে নিজস্ব লক্ষ্য নির্বাচন করেছে। বিবর্তনের পথ ধরে কামতাড়িতা এক নারীই অবশেষে প্রেমময়ী সত্তায় উত্তীর্ণ হয়।

দ্বাদশ বর্ষশেষে ‘মূলস্থান মিত্রবন’, ‘কালপ্রিয় কালনাথ ক্ষেত্র’ ও উদয়াচলের সমুদ্রতীরের ‘কোণবল্লভ ক্ষেত্রে’ তিনটি মন্দির নির্মিত হয়। দীর্ঘদিনের সাধনায় অস্তাচলমান স্থানে পর্যায়ক্রমে অবস্থান করে শাম্ব কুষ্ঠরোগ মুক্ত হয়ে পূর্বরূপ ফিরে পায়। নীলাক্ষীও পরিণত হয় মন্দির গাত্রে অঙ্কিত অপ্সরারূপী নারীসত্তায়। একসময়ের কুৎসিত কামতাড়িতা অবিশ্বাসী এক নারী নীলাক্ষীর দৃষ্টিতে তখন নেমে আসে প্রেমমুগ্ধ দৈব দৃষ্টি। শাম্বের রূপে মুগ্ধ হয়ে সে তাকে ‘বিবস্বান’ অর্থাৎ সূর্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে চায়। তথাপি লেখক নীলাক্ষীকে দেবী বলতে নারাজ। মানবীসত্তায় উত্তীর্ণ হয়ে নীলাক্ষী বলে:

আমি এই সমুদ্র ও চন্দ্রভাগা তীরের মধ্যবর্তী স্থলেই থাকতে চাই। বৃষ্ণিরত্ন, আমি আজীবন কোণাদিত্যের পূজা করবো, কিন্তু আমি নিতান্ত প্রস্তরের অপ্সরা মূর্তি নই। আমি মানুষ, তুমি আমার মহামৈত্র। তোমার দর্শনের আশায় আমার প্রাণ ব্যাকুলিত হবে। বৎসরান্তে একবার দেখা দেবে তো? (কালকূট ১৯৯৬: ১০১২)

এই নীলাক্ষী প্রথম দিন মিত্রবনে শাম্ব-দর্শনে ছিল শরীরী কামনায় বিহ্বল। কুষ্ঠ-আক্রান্ত জরাগ্রস্ততায় দৈহিক কামনা-সুখ পেতে ব্যাগ্র সে। কারণ তখনও পর্যন্ত শুধু শরীর নয়, মনও তার মৃত।

এখন শুধু শরীরের ভেতরেই সময় আছে। যেমন জিভ দিয়ে খাবারের স্বাদ পাই। হয়তো মরার আগ পর্যন্ত এই সাড়ই থাকবে। এই সুখটুকু তুমি আমাকে কেন দেবে না? (কালকূট ১৯৯৬: ১০০২)

ভোগবাসনার সে-ই নীলাক্ষী পরিবর্তিত হয়। জীবনের নতুন দার্শনিক উপলব্ধিতে হয় সমাসীন। নীলাক্ষীর মধ্যে সাধনা শেষে আসে ত্যাগের মহিমা, সত্যিকারের প্রেমাচ্ছন্নতা। যে-‘কোণাদিত্য ক্ষেত্রে’ নীলাক্ষী অবস্থান করেছে তার নাম দেওয়া হলো মৈত্রেয় বন। কারণ শাম্ব উপলব্ধি করেছে নীলাক্ষীর মতো প্রকৃত বন্ধুর সাহায্যে মুক্তিপথ-অন্বেষণ সম্ভব। শাম্ব মিত্রবনে মগ ব্রাহ্মণদের প্রতিষ্ঠা করেছে। ব্যাধিগ্রস্তদের চিকিৎসা-ব্যবস্থা করেছে। শাকদ্বীপের ব্রাহ্মণদের সে এখানে এনেছে। অভিশাপ কী, ব্যাধি কী তা সে উপলব্ধি করেছে; ঐশ্বর্যপূর্ণ দ্বারকায় আর ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে তার নেই। মহর্ষি নারদের শেষ আশীর্বাদ:

হে সর্বদেবমান্য, সর্বভূতমান্য, সর্বশ্রুতিমান্য হে শাম্বাদিত্য! আপনি সন্তুষ্ট হোন, আমার পূজা গ্রহণ করুন। … হ্যাঁ আজ থেকে এই বিগ্রহের আর এক নাম শাম্বাদিত্য। এই নামেই তিনি এখানে পূজিত হবেন। (কালকূট ১৯৯৬: ১০১৩)

শাম্ব মানবিক সংগ্রামে উত্তীর্ণ হয়ে এভাবেই উপন্যাসে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। আসলে ‘শাম্ব’ উপন্যাসে প্রতীকী উপস্থাপনার মাধ্যমে কুষ্ঠরোগের অসারতাকে লেখক বর্তমান সমাজ-ব্যবস্থা ব্যাখ্যায় ব্যবহার করেন। কুষ্ঠরোগ দেহকে অসাড় করে দেয়। এই অসাড়তা তো এ-যুগেরই অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আত্মোপলব্ধি ও বিশ্বাসের অভাবে, যুগ-মানুষকে কালকূট দেখেছেন পঙ্গু হয়ে যেতে, অসাড় অস্তিত্ব বহন করতে। কুষ্ঠরোগ কেবল মানুষের দেহে নয়, মনে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠী আজ জীবনের মূল্যবোধ হারিয়ে নীতিভ্রষ্টতায় পতিত। সুখ-সম্ভোগ, বিলাস-ব্যসন আর আত্মবিস্মৃতির মধ্যে কোথাও তাদের জীবনের তাৎপর্য নেই। এই চরিত্রহীন মানুষের সামগ্রিক উত্থান ও সমষ্টিগত উন্নয়নের কথাই কালকূট বলেছেন। এখানেই পুরাণের সঙ্গে যুক্ত হয় আধুনিক বোধ। শাম্ব যখন নীলাক্ষীকে প্রশ্ন করে, ‘নীলাক্ষী তোমার চোখের এই মুগ্ধতা কীসের?’ উত্তরে নীলাক্ষী বলেছে― ‘মানুষের’।

কৃষ্ণের পুত্র শাম্ব (সাম্ব)
কৃষ্ণের পুত্র শাম্ব (সাম্ব)

কালকূটও এখানে মানুষ ও তার জীবন-সংগ্রামকে তুলে ধরেন। সমাজ ও মানুষ-দর্শনে সামষ্টিক এ-চেতনা শাম্ব চরিত্রে পূর্ণতা এনে দিয়েছে। নতুন জীবনের সূচনা শুধু তাই শাম্বের অবদান নয়, এ-তার কৃত্যও। ইনডিভিজুয়্যালিজম ও কালেকটিভিজম-এর অপরূপ মেলবন্ধনের কল্পকাহিনি ভারত-পুরাণের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। কালকূটই তার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে আমাদের দৃষ্টি ফেরালেন। (ভট্টাচার্য ২০০৮: ৬৯)। তাই দ্বারকাবতীর ভোগবাসনা তুচ্ছ করে মানুষের সেবায় নিয়োজিত হয় শাম্ব। মহর্ষি নারদ সূর্যদেবকে পূজাঞ্জলি দিয়ে তাকে ‘শাম্বাদিত্য’ নামে সম্বোধন করলে― ‘শাম্বের সারা শরীর শিহরিত হল।’ (কালকূট ১৯৯৬: ১০১৩)। এখানে সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি― মনুষ্যত্বের সাধনায় আজ দেবতাও গৌরবান্বিত। শাম্বের নামে চিহ্নিত হয়ে সূর্য বা ‘আদিত্য’ই তার ধ্যান হলো তখন। ফলে মানুষ কালকূটের কাছে দেবতার চেয়েও হয়ে উঠল মহীয়ান। কারণ কেবল মানুষেরই আছে অবিরাম জীবনপ্রবাহ, সংগ্রামশীলতা ও আত্মদর্শনের মহিমা।

‘শাম্ব’ উপন্যাসে লেখক মহাভারত-কাহিনির অংশবিশেষে শাম্বের মতো একজন সংগ্রামী নেতার অন্বেষণ করেন। তাঁর প্রাচেতস্ (১৯৮৪) নামক একটি উপন্যাসের নায়ক প্রাচেতস্ও একইভাবে ব্যক্তিচরিত্রের পরিবর্তনের মাধ্যমে মনুষ্যত্ব-স্ফূরণকে প্রাধান্য দেয়। অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি, কুষ্ঠরোগ থেকে আরোগ্য প্রাপ্তি শাম্ব উপন্যাসে আধুনিক ব্যাধিগ্রস্ত জীবন থেকে রক্ষার পাওয়ার প্রতীক; এ-প্রতীকের আড়াল ভেঙে প্রাতেচস্ সরাসরি জীবনজিজ্ঞাসা-পূর্ণ:

আমার ভেতরে এখনও তুষারহিম অন্ধকারের স্তব্ধতা, অথচ তা কাঁপছে, এবং এর মধ্যে আমি একটি আনন্দধ্বনির তাল শুনতে পাচ্ছি। কি ঘটতে চলেছে আমি তা জানিনা। কেবল যে দুঃখ আমাকে বিকৃত ও মরণের ফাঁদে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, সেই দুঃখকে আমি অমৃতের স্বাদ পেতে চাই। আমি শুনেছি, দুঃখই মানুষকে মহৎ করে অথচ মহৎ আমি হতে চাইনি। পূর্ণ মানবতা আমার সাধনা। মহৎ হওয়ার থেকে মানবের পূর্ণতাই কঠিন, যা দুঃখকে গ্লানির অন্ধকার থেকে বের করে নিয়ে আসে, তাকে অমৃতের স্বাদে ভরিয়ে নিতে চায়। (কালকূট ১৯৯৬: ১২৯৭)

পাপ-গ্লানি ও আত্মোপলব্ধির আখ্যান শাম্বের সঙ্গে তুলনা করা যায় প্রাচেতস্-এর। প্রাচেতস্ মহাকাব্যের ইতিবৃত্তীয় আঙ্গিকে তমসা তীরের রামায়ণ রচয়িতা বাল্মীকির অন্বেষণ। কালকূট আধুনিক কালের প্রেক্ষিতে পৌরাণিকতার সংযোজন করেননি; বরং পৌরাণিকতার ঐতিহ্যিক দর্পণেই তিনি আধুনিক মানুষের যন্ত্রণা, চিরকালীন মানুষ, তাদের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের উত্তরাধিকারকে অন্বেষণ করেছেন। ইতিহাসের আঙ্গিনায় প্রাচেতসের অভিজ্ঞতার ব্যাপ্তি তার আত্মোপলব্ধির পথকে প্রশস্ত করে। রামচন্দ্রের কালে তাঁরই সমবয়সী রামায়ণ রচয়িতা প্রাচেতসকে লেখক চরিত্র ও ঘটনার নিরিখে আধুনিক জীবন-অন্বিষ্ট করে তোলেন। কালকূটের বড় কৃতিত্ব এই যে, তিনি হিন্দু পুরাণের এক অতি প্রচলিত কাহিনির নায়কের আত্ম-উদ্বোধনকে আধুনিক মননের অস্তিত্বের আর্তির সঙ্গে একাত্ম করতে পেরেছেন। হত্যা-লুণ্ঠন-কামচরিতার্থতা-পাপ ও অন্যায়ের পর প্রাচেতসের যন্ত্রণা ব্যক্তিমানুষের একাকিত্বের যন্ত্রণা। আর্ত এক অস্তিত্বের আকাঙ্ক্ষাই তার মনকে রাজার আজ্ঞাবহ সৈনাপত্য গ্রহণে বাধা প্রদান করে। এ-বিশাল বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী, কর্ম ও ফলভোগও তাই তার একার; এ-অনুভব তাকে ভীষণভাবে তাড়িত করে। সংসারের নগ্ন বাস্তবকে প্রত্যক্ষ করে তার অন্তরে শূন্যতার অনুভূতি জাগে:

তাহলে সারা জীবন ধরে আমি কি করে আসছি? কোন অন্ধকারে আমি আছি? সংসারের সব সুখের স্বপ্ন আমার ভেঙ্গে গিয়েছে।…আমি যে একা, একা।…পাপের এই একলা জীবনটা নিয়ে আমি কি করবো? কেমন করে এর থেকে মুক্তি পাবো। (কালকূট ১৯৯৬: ১২৯০)

জীবনের মুক্তি-আকাঙ্ক্ষায় নব পথ-উন্মেষণে প্রাচেতস্ কোনো সরল সমীকরণ চায় না। কিম্পুরুষবর্ষ নারদ মুনির কাছে ‘উপবাসী ক্লান্ত রক্তাক্ত’ পায়ে ছুটেও তাই তার সমাধান আসে না। সঙ্গীরাও এক সময়ের হননমত্ত প্রাচেতসের উপলব্ধি ও দুঃখের স্রোতধারা আবিষ্কারে ব্যর্থ হয়। বুদ্ধের মতই সে মানবতার আর্ত-চিৎকার শুনতে পায়। সে-কান্না এখন গগনবিস্তারী; প্রকৃতিতেও তা পরিব্যাপ্ত:

এই প্রকৃতি কি কাঁদছে? দূর থেকে যে ঝর্ণার শব্দ আসছে― ঐ শুনতে পাচ্ছো, কুলকুল শব্দ সে শব্দেও কান্নার আভাস। (কালকূট ১৯৯৬: ১২৮৪)

পৌরাণিক প্রাচেতসকে কালকূট কিছুটা নিজের মতো করে তৈরি করেন। পুরাণে যে-অস্তিত্বের যন্ত্রণা নেই তিনি তা যুক্ত করে মনুষ্যত্ব ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় প্রাচেতসের অন্তর্জগতকে শতধাদীর্ণ করেন। আর তাই নারদ মুনি তার জীবনে নিমিত্ত মাত্র হয়ে উপস্থিত; কর্ম-পরিধি প্রাচেতসের স্বকীয়। নারদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়:

আমি নিমিত্ত মাত্র। তোমার মধ্যে শক্তি না থাকলে তোমার এ জগৎ আলোকিত হত না। একাই তুমি আলোকিত করেছো, কারণ তোমার মধ্যে সত্যের বোধ জাগ্রত হয়েছে। (কালকূট ১৯৯৬: ১২৯২)

অজস্র নারকীয় শোণিতপাতের পর তীব্র দুঃখ-দহনে আত্মসমীক্ষার এক মহালোকে উপনীত হয়েছে প্রাচেতস্। এরই নাম আত্ম-উদ্বোধন, ঋষিরা তাকেই ‘তপোবন’ বলে। সংসারে মানুষের প্রত্যাখ্যান, প্রিয়তমা স্ত্রীর প্রবঞ্চনা, পাপবোধের পুনর্জাগরণ তার জীবনে এনে দেয় ‘মহতী দুঃখে’র স্বাদ। আত্ম-উন্মোচনের পথে প্রাচেতস্ একাকী অন্তরে প্রকৃত-সত্তার তাৎপর্য খুঁজে ফিরেছে। একেই অস্তিত্ববাদীদের *Authentic existence বলে। জীবনের প্রতি অসীম বিশ্বাস আর সীমাহীন প্রতীক্ষায়ও তাই তাকে মুষড়ে পড়তে দেখা যায় না। বিশ্ব প্রকৃতির তাৎপর্য অনুধাবন করতে করতেই সে অব্যাহত যাত্রাপথিকে রূপান্তরিত হয়। দুঃখের অন্ধকারে জীবনের আলোকতীর্থ খুঁজে ফেরাই এখন তার সাধনা। শাম্ব চরিত্রের সঙ্গে এই প্রাচেতস্ সঙ্গত কারণেই প্রাসঙ্গিক।

কালকূট পৌরাণিক-ঐতিহাসিক চরিত্রকে শরীরী প্রত্যক্ষতায় ধরতে গিয়ে তাদের বহিরাবরণ থেকে বের করে আনেন শাশ্বত মানবের ছবি। এসব চরিত্র-নির্মাণে লেখক-কল্পনার চেয়ে বাস্তবের যোগ বেশি। উপন্যাস-কলাকৌশলেও সেসব রচনা বাস্তবতা-অধ্যুষিত রস-জগতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষমতা রাখে। লেখকের আপন উপলব্ধিতে, তাঁরই সৃষ্ট চরিত্রের অন্তর্দেশে যে-অতৃপ্তি, অশান্তি, দিশাহীনতা ও কষ্টের সংবাদ পাই― তাতে আছে নিরন্তর আত্ম-আবিষ্কার। ব্যক্তির অস্তিত্বকে সার্থকতায় দেখতে চাওয়ার এই যে ক্লান্তিহীন প্রয়াস তা লেখকের আত্মোপলব্ধিরই আর্তি। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ, তাদের জীবনবোধ, জীবন-সংগ্রাম, দ্রোহ এবং যন্ত্রণায় ক্লিন্ন-ক্লিষ্ট মানুষের চিত্রাঙ্কন তাঁর অনন্য শিল্পিত ভাষ্য। ‘শাম্ব’ উপন্যাসের কৃষ্ণপুত্র সামষ্টিক মানবের স্বতঃস্ফূর্ত গতির সঙ্গে মিশে যায়। প্রকৃতপক্ষে কালকূটের সযত্নচর্চা ও শিল্পিতায় শাম্ব চরিত্র পৌরাণিকতার খোলস ভেঙে পরিপূর্ণ আধুনিক মানুষের রূপান্তর।

*Authentic existence: “Existentialism” philosophy emphasizes on the ‘existence’ of individual human. After projecting the drawbacks of ‘artificial’ way of life, this philosophy then tries to give guidance as to how humans can live an æauthentic way of life” and so can make their existence ‘authentic’. This ‘guidance’ is something like that a person should reject every sort of objective values and standards. Truth relating to different aspects of life is to be found in pure personal experience of individual, which is subjective. 

তথ্যসূত্র

  • কালকূট (১৯৯৬), প্রাচেতস্, কালকূট রচনা সমগ্র (ড. নিতাই বসু সম্পাদিত), তৃতীয় খণ্ড, মৌসুমী প্রকাশনী, কলকাতা।
  • কালকূট (১৯৯৬), শাম্ব, কালকূট রচনা সমগ্র, পূর্বোক্ত।
  • শাম্ব (১৪২২), আনন্দ, কলকাতা।
  • চক্রবর্তী, শম্ভুনাথ (১৯৯৫), জাতীয় ইতিবৃত্ত ও কালকূট, সাহিত্যায়ন, কলকাতা।
  • ভট্টাচার্য, স্নেহাশিস (২০০৮), ‘মন চল যাই ভ্রমণে’, কালকূট: অন্তহীন অন্বেষণ, পত্রলেখা, কলকাতা।
  • সরকার, সুধীরচন্দ্র (১৪১২), ‘মহাভারত― মৌষল, বিষ্ণুপুরাণ’ পৌরাণিক অভিধান (সঙ্কলক: সুধীরচন্দ্র সরকার), নবম সংস্করণ, কলকাতা।
  • Existentialism’s ‘Authentic Existence’ and ‘Moral Individualism’: http://www.sikhphilosophy.net/interfaith-dialogues/14483-existentialisms-authentic-existence

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

অধ্যাপক ড. মো. খোরশেদ আলম

জনাব খোরশেদ আলম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একজন অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন ধরণের গল্প ও প্রবন্ধ লিখে থাকেন। তিনি একজন গবেষক ও সাহিত্য সমালোচক হিসেবেও পরিচিত।

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

শাম্ব: মহাভারতের অভিশপ্ত কৃষ্ণপুত্র এবং তার ঔপন্যাসিক রূপান্তর

প্রকাশ: ১০:৩২:৫৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ ডিসেম্বর ২০২১

উপন্যাস আধুনিক জীবনের শিল্পিত বয়ান। তার মধ্যে অতিবাস্তব উপাদান থাকতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ যে-কোনো আধিদৈবিক ঘটনাকে অবিশ্বাস করে। পক্ষান্তরে সে নির্মাণ করতে চায় এক বাস্তব বিশ্ব। অন্যদিকে পৌরাণিকতা স্বয়ংসিদ্ধ এক প্রত্নরূপ। মহাকাব্যের যে-কোনো চরিত্রই অতিপল্লবিত কাহিনি-আক্রান্ত। মানুষ এই আধিদৈবিক পৌরাণিকতার মধ্যেই খুঁজতে চেয়েছে জীবনের রূপ। বিশ্বাসী মানুষের চোখে পুরাণ অখণ্ড। কিন্তু আধুনিক মানুষের চোখে পৌরাণিক ঘটনা সবসময় বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবুও পুরাণ যুগে যুগে সৃষ্টিশীল মানুষকে দর্শনের খোরাক এনে দিয়েছে।

‘মহাভারতে’র প্রত্যেকটি চরিত্রই কোনো না কোনোভাবে আধিদৈবিকতা-সিক্ত। তবুও এর অসংখ্য চরিত্রের ভিড়ে কতকগুলো চরিত্র নতুন বোধ ও জীবন-অনুভূতিকে নাড়া না দিয়ে পারে না। পাণ্ডব ও কুরুপক্ষীয় বহু চরিত্রের ভিড়ে অনায়াসেই চেনা যায়― ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু, গান্ধারী, কুন্তী, পঞ্চপাণ্ডব, দ্রৌপদী, ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, দুর্যোধন কিংবা অভিমন্যু, অশ্বত্থামা, বিদুর এঁদের সবাইকে। বেদব্যাস কাহিনিকার। তিনিও এই মহাকাব্যের মধ্যে মধ্যে স্বয়ং উপস্থিত। আত্মীয় পক্ষ-প্রতিপক্ষই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কুশীলব। স্বয়ং কৃষ্ণ তাকে ঘোষণা করছেন ধর্মযুদ্ধ বলে। কুরু-পাণ্ডব উভয়পক্ষের নীতি-দুর্নীতি ন্যায়-অন্যায় শক্তি সামর্থে্যর বহু ফিরিস্তি দান করেছেন বেদব্যাস। যদিও তিনি ধর্মত কৃষ্ণের মানসজাত মহিমাকে উচ্চে তুলে ধরেছেন। পাণ্ডবরা সেখানে নীতির ধ্বজাধারী অমিতবীর যোদ্ধা। আর্য-অনার্য ভাবমিশ্রিত সন্তান ব্যাসের হৃদয়ে তবু লুকিয়ে থাকে কৌরবপক্ষীয় কোনো কোনো চরিত্রকে দীপ্তি দানের প্রচেষ্টা। ভীষ্ম, গান্ধারী, বিদুর, কর্ণ যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। অন্যদিকে মহাভারতে কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ-সমাপ্তি এবং পাণ্ডব পক্ষের সিংহাসনারোহণ ঘটে।

বাসুদেব নন্দন কৃষ্ণ যাদবশ্রেষ্ঠ। তিনি কেবল নরপতি নন, কালান্তরে ভগবান কৃষ্ণ। যদুবংশে তিনি কখনোই রাজসিংহাসনের অধিকারী ছিলেন না। কিন্তু রাজা না হয়েও তিনি রাজ-অধিক ক্ষমতাধারী। তিনিই পাণ্ডবদের প্রতিষ্ঠা ও মন্ত্রণাদাতা ঈশ্বর—স্বয়ং বিষ্ণুর বরপ্রাপ্ত। অন্য অর্থে তিনিই যুগে যুগে সম্ভবামি সত্য হয়ে ফিরে ফিরে আসেন। কিন্তু এই ঈশ্বর মহিমার কৃষ্ণও খোদ বেদব্যাসের হাতেই যেন বাস্তব হয়ে ওঠেন। কারণ যুগের অনিবার্য প্রবহমানতা আর কালের সত্যই নির্ধারণ করে দেয় তাঁর ভবিতব্য। আত্মীয় হত্যার বিরাট যজ্ঞ কুরুক্ষেত্রেই অভিশপ্ত হয়ে ওঠেন তিনি। কেননা জ্ঞাতিক্ষয়কর যুদ্ধ নিবারণে সমর্থ হয়েও কৃষ্ণ তা করেননি। গান্ধারী তাঁকে অভিশাপ দেন অপঘাতে মৃত্যুর ভবিষ্যতবাণী দিয়ে। এই ভবিষ্যতবাণী আধিদৈবিক হলেও স্বয়ং কৃষ্ণর বাস্তব মৃত্যু যা খুব স্বাভাবিক, একান্তভাবে তা-ই সমস্ত পৌরাণিক বিশ্বাস-খণ্ডনে যথেষ্ট। পরিশ্রান্ত কৃষ্ণের পদতলে একজন ব্যাধের তীর এসে আঘাত করলে তিনি নিহত হন। যিনি মহাবীর অর্জুনের সারথী, যুদ্ধ না করেও বিরাট কৌশলী, সময় সময় ঐশ্বরিক শক্তি ভর করে পাণ্ডবদের জেতানোর যাবতীয় পরিকল্পনাকারী― তার এহেন মৃত্যু, গান্ধারীর অভিশাপ তাঁকে সাধারণ মানুষের স্তরে নামিয়ে আনে। যদুবংশ ধ্বংসের ইঙ্গিতসহ অসংখ্য মৃত্যুর জন্য দায়ী কৃষ্ণ। অভিশাপ-গঞ্জনার এ-আরেক নমুনা নয় কি!

এই যদুবংশ ধ্বংসের নায়কই মহাভারতের ‘মৌষল পর্বে’র শ্রীকৃষ্ণপুত্র শাম্ব। পৌরাণিক অভিধানে উল্লেখ:

একবার বিশ্বামিত্র, কণ্ব ও নারদ মুনি দ্বারকায় গেলে যাদবগণ কুবুদ্ধিবশত: কৃষ্ণপুত্র শাম্বকে পেটে কাপড় বেঁধে গর্ভিনী-বেশে সজ্জিত করে ঋষিদের কাছে নিয়ে গিয়ে বলেন যে, ইনি বভ্রুর স্ত্রী, এঁর কি সন্তান হবে? মুনিরা প্রতারণা ধরতে পেরে ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দেন যে শাম্ব এক লৌহমুষল প্রসব করবে, যদ্দারা যদুবংশ ধ্বংস হবে। পরদিন শাম্ব এক লৌহমুষল প্রসব করেন এবং যাদবগণ সেই মুষলচূর্ণ করে সমুদ্রে নিক্ষেপ করেন।  (পৌরাণিক অভিধান ১৪১২: ১২৪, ৫০৩)

যাদব বংশ একসময় অন্যায় ও পাপে ছেয়ে যায়। এরই ফলস্বরূপ তারা ক্রমশ ধ্বংসমুখি হয়। সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত পুরাণকথিত মুষলচূর্ণ থেকে উৎপন্ন এক রকম তৃণের আঘাতেই যদুবংশ ধ্বংস হয়। শ্রীকৃষ্ণ ও জাম্ববতী-পুত্র শাম্বের এই পরিণতি এক ভয়ংকর অভিশম্পাতের ফল। কিন্তু এই শাম্বকেই ‘শাম্ব পুরাণে’ ব্যক্ত করা হয়েছে ‘বিবস্বান’ বা সূর্য বলে। সে রূপময়, দারুণ সুপুরুষ, দিবসে উদিত উজ্জ্বল আলোকধারা। পুরাণের নানা পল্লবিত কাহিনিতে শাম্ব নানা ভাবেই চিত্রিত। মহাভারতের যুদ্ধে তার পিতা কৃষ্ণ ছিলেন দুর্যোধনের ভিন্ন পক্ষে। কিন্তু শাম্বই পরবর্তীকালে দুর্যোধন কন্যা লক্ষ্মণাকে স্বয়ংবর সভা থেকে হরণ করে। এ-কাজের পর কৌরবরা তাকে বন্দি করে। কিন্তু পিতার বড়ভাই বলরামের খুবই প্রিয়পাত্র ছিল শাম্ব। তিনিই শাম্বকে এদের হাত থেকে মুক্ত করেন। তবে শাম্ব সম্পর্কে সবচেয়ে বড় ঘটনা― মুষলপ্রসব ও যদুবংশ ধ্বংস। কিন্তু এই যদুবংশ ধ্বংসের জন্য দায়ী ব্যক্তিটিকেই কালকূট ভিন্নভাবে রূপায়িত করেন। সেই কাহিনিতে শাম্বের লক্ষ্মণাহরণ বা মুষলপ্রসব নয় বরং প্রাধান্য পায় পাপ ও শাপমুক্তির আখ্যান। পুরাণ-ভাঙা সেই নবকাহিনির নায়ক শাম্বও অভিশপ্ত। কিন্তু পরিণামে পাপ-আত্মোপলব্ধি ও মুক্তিতে অনন্য চরিত্ররূপে প্রতিষ্ঠিত। উল্লেখ্য, কালকূট হলো ভারতীয় সাহিত্যিক সমরেশ বসুর ছদ্মনাম।     

কালকূট ঔপন্যাসিক সত্তার আড়ালে গল্পকথনের এক স্বতন্ত্র কৌশল অবলম্বন করেন। মানুষ, সমাজ, বাস্তবতা, রাজনৈতিক প্রসঙ্গ সেখানে প্রতীকের অন্তরালবর্তী। কালকূট-সাহিত্য মহাভারত ও অন্যান্য ভারত-পুরাণের আলোকে ইতিহাস-দর্শন পরিশ্রুত হয়ে মানব মনের নৈকট্য এবং এর সার্বজনীনতা অন্বেষণকামী হয়ে ওঠে। তাঁর রচনার বিচিত্র চরিত্রে আত্মাহুতি, ভালোবাসা, স্নেহ ও আত্মচেতনাকে তিনি ফুটিয়ে তোলেন। বস্তুত আধুনিক নিঃসঙ্গ মানুষকে তার বিদ্রোহ ও যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে তিনি শাপমুক্ত করেন। অন্তর্দ্বন্দ্ব ও দায়িত্ববোধ এখানে চরিত্রের অন্যতম চালিকা শক্তি। বস্তুত তিনি পুরাণ-মোড়কে মানবতাকেই আশ্রয় দেন। পুরাণকথিত ঐতিহাসিক পথ, কিংবদন্তীর অন্বেষণে বিচিত্র আঙ্গিকে মানুষকে জানার ও ধরার চেষ্টা করেন তিনি। তেমনি করেন ঐতিহ্য-অনুসন্ধান এবং পুরাণের নবনির্মিতি।

পৌরাণিক কাহিনি, ইতিহাস ও দর্শনের নানা পথ বেয়ে কালকূট পেতে চান নিগূঢ় জীবনসত্যের সন্ধান। কালকূটের এই পথ-পরিক্রমা গভীরতর দার্শনিক সংকেত-সমৃদ্ধ। ধর্মীয় ব্যাখ্যা থাকলেও গূঢ় ঐতিহাসিক সত্য-সন্ধানে তাঁর অন্বিষ্ট বিষয় আসলে মানুষ এবং মানুষের সমাজ। পুরাণনির্ভর শাম্ব, প্রাচেতস্, যুদ্ধের শেষ সেনাপতি, পৃথা ও অন্তিম প্রণয়—এই পাঁচটি উপন্যাসেই বিধৃত হয়েছে পুরাণ-চেতনা, পুরাণের নতুন ব্যাখ্যা। আবার তার মধ্য দিয়েই তিনি করেন স্বদেশ ও সমাজের সংগ্রামী চরিত্রের স্বরূপ-অন্বেষণ। কালকূট মহাভারতের রচনা থেকে উদ্ধার করেন, ‘ইতিহাসবিদং চক্রে পূণ্যং সত্যবতীসুতঃ’ (কালকূট ১৯৯৬: ১০১৫)।― একথায় বোঝা যায়, মহাভারত একটি ইতিহাস গ্রন্থও। কিন্তু ইতিবৃত্তের অলৌকিকতা থেকে সত্য-সন্ধানই লেখকের উদ্দেশ্য। কালকূট পুরাণকারের সংকেতাচ্ছন্ন ইতিহাসকে এভাবেই দেখার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে: ‘ভারতকাহিনী ভারতেরই বৈদিক অথবা প্রাক-বৈদিক যুগের ভারতীয় ইতিহাস।’ (কালকূট ১৯৯৬: ১০১৫)। পুরাণের নির্মোক খসিয়ে কালকূট যে-সত্যের কাছাকাছি পৌঁছান তাতেই তিনি অনন্য শিল্পস্রষ্টা হয়ে ওঠেন।

‘মহাভারত’কে কালকূট আধুনিক বৈজ্ঞানিক মন নিয়ে বুঝতে চেষ্টা করেছেন। ফলে অতীত গল্পের সঙ্গে যুক্ত হয় আধুনিকতাবোধ। শাম্ব উপন্যাসে শ্রীকৃষ্ণ পুত্র শাম্বের পাপ, অভিশাপ ও প্রায়শ্চিত্তে মানব-মুক্তির আকাঙ্ক্ষা পরিস্ফুট। ‘শাম্ব’ উপন্যাসে ধর্ম ও ইতিহাসের প্রসিদ্ধ মানব কৃষ্ণপুত্র শাম্ব। অভিধানে উল্লিখিত, সে ‘শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী জাম্ববতীর গর্ভজাত অন্যতম পুত্র।’  (পৌরাণিক অভিধান ১৪১২: ৫০৩)। শাম্ব চরিত্র-নির্মিতির মাধ্যমে কালকূট আবিষ্কার করেন প্রাচীন কালের একজন প্রভূত প্রভাবশালী ও ত্যাগী এবং মানবতায় উচ্চকিত সংগ্রামশীল ব্যক্তিকে। সূর্যসাধনার কঠোর নিয়মতান্ত্রিকতার সংযম অনুশীলন করে শাম্ব চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সবলতা অর্জন করে। শাম্বই হলো ভারতপুরাণে প্রথম সূর্যসাধক। শাস্ত্রীয় পূজার নিয়মকানুন সে পালন করেনি, বরং রোগগ্রস্ত দেহের আরোগ্য লাভের জন্য সূর্যসাধনা করেছে। শাম্বপুরাণ-এ সৌরসাধক শাম্ব সম্পর্কে জানা যায়। সূর্য বংশের কুলগুরু বশিষ্টমুনি সূর্যবংশীয় রাজা বৃহদ্বলকে বলেছেন:

কৃষ্ণপুত্র শাম্ব রোগমুক্তির জন্য সূর্যের সহস্র নামের সাধনা করতে করতে কৃষ্ণও দুর্বল হয়ে পড়েছেন। সূর্যদেব তখন শাম্বকে স্বপ্নাদর্শন করিয়ে বলেন, কষ্টসাধ্য সহস্র নামের পরিবর্তে শাম্ব তার একুশটি গোপনীয় পবিত্র ও মঙ্গলদায়ক নামগুলিরই আরাধনা করুক। পরবর্তীকালে সেই একুশ নামই সূর্যস্তবরূপে চিহ্নিত হবে। যেমন― বিকর্তন, বিশ্বায়ন, মার্তণ্ড, ভাস্কর, রবি, লোক প্রশাসক, শ্রীমান, লোকচক্ষু, গ্রহেশ্বর, সপ্তাশ্ববহন, গভস্তি হস্ত, ব্রহ্মা, লোকসাক্ষী, তিলোকেশ, কর্তা, হর্তা, তমিস্রহা, তপন, তাপন, শুচি, সর্বদেব। শাম্ব এই একুশ নাম জপ করেই রোগ নিরাময় করেছে। (চক্রবর্তী ১৯৯৫: ৯৪-৯৫)

এই হলো ‘সাম্ব পুরাণ’ কথিত সৌর সাধনার ইতিহাস। ‘সাম্ব পুরাণ’ থেকে গৃহীত এই ‘শাম্ব কাহিনি’ মূলত ঘটনা ও সংকেত দ্বারা সংগৃহীত। উপন্যাস-শিল্প সৃষ্টি-মানসে লেখক আসলে কল্পনা-সূত্রে গেঁথে পুরাণকাহিনির অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন। এক্ষেত্রে তাঁর কাছে শিল্পের ভুমিকাই প্রবল। তিনি প্রত্যক্ষ করেন― সৌর-সাধনার কঠোর অনুশীলনের ভেতর পার্থিব সংগ্রাম-চিত্র। সাহিত্যিক-ঐতিহাসিক অদ্বৈতচর্চার মাধ্যমে কালকূট পাঠককে ইতিহাস ও সাহিত্যের গোধূলি-সন্ধিতে নিয়ে যেতে চান। সেখানে সাহিত্য ও ইতিহাস উভয়েই নির্দিষ্ট সীমারেখায় একে অপরের সঙ্গে যুক্তবেণীবদ্ধ। এ-উদ্দেশ্য নিয়েই মানুষের চিরন্তন রূপ-উদ্ঘাটন করেন তিনি। পুরাণের পাতায় পাতায় ভারত-দর্শন ও ঐতিহাসিকতা অন্বেষণ করেন তিনি মানুষের চরিত্র পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই।

পুরুবংশীয় কৌরবদেব মধ্যে নারদমুনির কথা জানা যায়। পরিভ্রমণের মধ্য দিয়ে যাবতীয় পার্থিব সংবাদ গ্রহণ করে তিনি অশেষ জ্ঞানের অধিকারী হয়েছিলেন। সে-সঙ্গে তাঁর চরিত্রে প্রচণ্ডতা ও কুটিলতাও লক্ষণীয়। এই নারদমুনির কোপানলই শাম্ব জটিলতার মূল কারণ। দ্বারকাপুরীতে নারদমুনির আবির্ভাবে শাম্ব কাহিনির সূত্রপাত। কৃষ্ণসহ বৃষ্ণিগণ যখন মহর্ষির সাদর অভ্যর্থনায় রত তখন পুষ্পবনে সহচরিদের নিয়ে ব্যস্ত ছিল রূপবান শাম্ব। মহর্ষির দিকে সে একবারের বেশি তাকাবার অবকাশ পায়নি। মহর্ষি এতেই রুষ্ট হয়ে শাম্বের সকল অহংকার চূর্ণ করার মনোবাসনা করেন। ষড়যন্ত্র করে পিতা কৃষ্ণকে পুত্রের বিরুদ্ধে দাঁড় করান নারদ। শাম্বর আপন রূপই তার জন্য শত্রু হয়ে ওঠে। গোপবালাদের সঙ্গে শাম্ব পাপকর্মে লিপ্ত বলে কৃষ্ণের কাছে অভিযোগ আনেন নারদ। রৈবতক পর্বত সন্নিকটে ভিন্নপুরুষ প্রবেশ-নিষিদ্ধ প্রমোদ-কাননে ষোলশত গোপীসহ জলক্রীড়ায় মগ্ন কৃষ্ণের কাছে নারদের কূটকৌশলেই শাম্বকে উপস্থিত করা হয়। মুহূর্তেই স্খলিত বসনা রমণীরা রূপবান শাম্বের প্রতি কামনাবিহ্বল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। জাম্ববতী, সত্যভামা ও রুক্মিণী ছাড়া আর সব নারীই শাম্বের প্রতি কামাসক্ত; এটি প্রত্যক্ষ করে কৃষ্ণ অস্থির ক্রোধে ফেটে পড়েন। তিনি মহর্ষির ষড়যন্ত্রের কূটচক্র-ফাঁদে ধরা দেন। নির্দোষ পুত্রের প্রতি তাঁর চরম রোষ উপস্থিত হয়। রোষ ও ঈর্ষায় প্রজ্জ্বলিত কৃষ্ণ অভিশাপ বর্ষণ করেন― ‘তোমার এই রমণীমোহন রূপ নিপাত যাক। কুষ্ঠরোগের কুশ্রীতা তোমাকে গ্রাস করুক।’ (কালকূট ১৪২২: ৪৪)। এমনকি তিনি শাম্বের প্রতি মোহগ্রস্ত এবং কামবিহ্বলদৃষ্টির রমণীদের প্রতিও কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, ধিক্কারের সুরে উচ্চারণ করেন― 

‘তোমরা আমার রক্ষিত হয়েও অতি নিকৃষ্ট আচরণ করেছ। অতিপ্রমত্তা হয়ে তোমরা যেমন পণ্যাঙ্গনাদের ন্যায় ব্যবহার করেছ, আমার মৃত্যুর পরে, তোমরা তস্করদের দ্বারা লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত হবে।’ (কালকূট ১৪২২: ৪৪)

শাম্ব আসলে ভাগ্যচক্র-পীড়িত মানবাত্মার প্রতীক। সূর্যতপস্বী শাম্ব তপস্যা ও আত্ম-অন্বেষণে মহামানব হতে চেয়েছিল। কিন্তু নিয়তির অভিশাপকে অতিক্রম করতে পারেনি। ‘মিথ অব সিসিফাসে’র প্রসঙ্গ এখানে অনিবার্য। তবু মানবজীবনের প্রকৃত সংগ্রাম বিপুল দুঃখ ও অভিশাপেরই বিরুদ্ধে। মর্ত্যে অমরাবতী কখনোই সৃষ্টি করা সম্ভব নয়, তবু এই অসম্ভব প্রয়াসের মধ্যেই মানুষের শ্রেয়বোধ জাগ্রত হয়। শাম্ব উপন্যাস তাই শাম্বেরই আত্মোপলব্ধির ইতিহাস। এখানে কালকূট পুরাণ ও চলমান সমাজের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করেন। তিনি দেখান, শাম্ব বিনা দোষেই মহর্ষির দ্বারা শাপগ্রস্ত। সে স্বেচ্ছায় ঋষিকে অপমান করেনি। কিন্তু নেমেসিসের নির্মম অভিশাপ নেমে আসে তার জীবনে। মহর্ষিকে একবার দেখতে পেয়েও তার প্রতি কী আচরণ করা উচিত সে বুঝে উঠতে পারে না। কারণ তখন প্রণয়লীলায় সে মগ্ন।

কালকূট কর্তৃক রচিত উপন্যাস 'শাম্ব'।
কালকূট কর্তৃক রচিত উপন্যাস ‘শাম্ব’-এর প্রচ্ছদ।

তবে পুরাণ-বর্ণিত নারদের প্রতি শাম্বের অবজ্ঞাকে কালকূট প্রাধান্য দেননি। বরং মানবিক দুর্বলতার বিষয়টিকেই প্রধান করে তুলেছেন। শাম্ব ‘সবসময় মহাত্মা নারদের অবজ্ঞা করতেন’ মূলের এ-বাক্যটিকে সচেতন প্রয়াস হিসেবে চিহ্নিত করতে তিনি সংযোজন করেন:

‘শাম্ব আচরণবিধি জানেন না, এমন না, তবু ভুলে গেলেন।’ (কালকূট ১৯৯৬: ৯৮১)

শাম্বের ব্যক্তিগত সম্পর্ক, গৃহত্যাগ করে মিত্রবন-গমনপথে তার সঙ্গে বিভিন্ন ব্যক্তির (পুজারিণী ধীবর মাঝি ঋষিতুল্য ব্যক্তি) সাক্ষাৎ সম্পূর্ণ ঔপন্যাসিক কল্পনা। কিন্তু পুরাণ-কাহিনির অলৌকিকতা পরিপূর্ণরূপে বর্জন করা এ-ধরনের উপন্যাসে সবসময় সম্ভব নয়। যেমন: মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধুতে’ও তা সম্ভব হয়নি। চরিত্রসমূহের নাম এবং কারবালা যুদ্ধের নানা তথ্য লেখককে অবিকৃত রাখতে হয়েছিল। এজিদ-হৃদয়ের রক্তক্ষরণজনিত যন্ত্রণাটুকুর আশ্রয় নিয়েই ঔপন্যাসিক সেখানে কল্পনার রঙ চড়িয়েছেন। এখানেই তিনি সার্থক। নিয়তির নায়ক শাম্ব পিতা কৃষ্ণকর্তৃক যে ব্যাধিগ্রস্ত হওয়ার অভিশাপ পান সেটি পূর্বঘোষিত। কৃষ্ণ তাকে জানান জন্মলগ্ন থেকেই কুষ্ঠরোগের মতো কুৎসিত ব্যাধি শাম্বের ভাগ্যলিপি। নিয়তির এই চরম নির্দেশনাকে অমোঘ মেনেই দুর্ভাগ্য থেকে উত্তরণের পথ-সন্ধান করতে হয়েছে তাকে। দুর্ভাগ্যের জন্য নিয়তি নির্দেশিত অভিশাপের কথা জেনেও শাম্ব অগ্রসর হয় মুক্তি-অন্বেষণে; এখানেই সে সংগ্রামশীল অথচ ‘মিথ অব সিসিফাসে’ আক্রান্ত মানবসত্তা। শাম্বের মুখে উচ্চারিত হয়:

আমার ভাগ্যের এই অমোঘ অনিবার্য পরিণতি জেনেও আমি নিশ্চেষ্ট থাকবো না। প্রয়োজন হলে মুক্তির জন্য আমি এই সসাগরা পৃথিবী, দেবলোকে, অন্তরীক্ষে সর্বত্র যাবো। (কালকূট ১৯৯৬: ৯৯৩)

নারদ প্রভাবে শ্রীকৃষ্ণের অভিশাপ দণ্ডে দণ্ডিত হলেও শাম্ব ভেঙে পড়েনি। সে বিশ্বাস হারায়নি আত্মশক্তিতে বরং নারদের কাছে মেনে নিয়েছে তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা। ব্যাধি-আক্রান্ত শাম্ব মিত্রবনের উদ্দেশ্যে গমন করে। নারদ নির্দেশেই সে রোগমুক্তির যন্ত্রণা-জর্জর ক্লেশময় পথ-পরিক্রমায় অংশ নেয়। চন্দ্রভাগা নদী তীরে উপস্থিত হয়ে শাম্ব দেখে জীবনের প্রতি বিশ্বাসহীন কুষ্ঠরোগীর দলকে। সমাজ-সংসার বহিষ্কৃত এ-সমস্ত মানুষ যদৃচ্ছ জীবন কাটায়। অবাধ যৌনাচারের মধ্য দিয়ে এরা সন্তান উৎপাদনও করে। একদিন আরোগ্যের আশা নিয়েই এরা মিত্রবনে এসেছিল। কিন্তু ব্যাধিতে ভুগে তাদের জীবন নষ্ট হয়ে গেছে। এজন্যই শাম্ব-র মনে হয়:

এদের কোন আশা নেই, অতএব, কোনো বিশ্বাসও নেই। অথচ এরা অবিশ্বাসী ছিল না, তাহলে এখানে আসতো না। (কালকূট ১৯৯৬: ১০০০)

শাম্ব এই হতাশ ব্যাধিগ্রস্তদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে চান। তিনি কঠিন সাধনার পথে আরোগ্য লাভের অনুসন্ধান তাদেরকে দিতে চান। অথচ স্বীয় অভিশাপের অমোঘতা সম্পর্কে তার দ্বিধা নেই― ‘অভিশাপ জিজ্ঞাসার অতীত। এ অমোঘ এবং অনিবার্য। এ ভাগ্যের পরিহাস না, নির্দেশ।’ (কালকূট ১৯৯৬: ৯৯৩)। এ-নির্দেশে অঙ্গীভূত হয়েই শাম্ব অতিক্রম করে বহু দুর্গম পথ, সহ্য করে তথাকথিত সুস্থ মানুষের অকারণ কটূভাষ অথবা কারুণ্য, জয় করে আধিভৌতিক তথা আধিদৈবিক বিপদের ভয়। ‘শাপমোচনেই তোমার জীবনের মোক্ষলাভ। …আমার কেন এমন দুর্ভাগ্য হল, অপরের কেন হলো না, এইরূপ প্রশ্ন বাতুলতা মাত্র।…কেননা জরা আছে, ব্যাধি আছে, মৃত্যু ঘটে এইসব নিয়ে মানুষ বিলাপ করে, শোকাকুল হয়। অথচ এসব আক্রমণের থেকে কারুরই রেহাই নেই।…ব্যক্তির দুর্ভাগ্যের জন্য তাকে একাকী সংগ্রাম করতে হয়।’ (কালকূট: ৯৯৮)। শাম্ব স্বীয় চেষ্টায় মুক্তি লাভের পথ অনুসন্ধান করেছে। ঋষির মুখে শুনেছে সূর্যদেবের আরাধনার কথা। সে সূর্যালোকের দ্বাদশ স্থান পরিভ্রমণ করে কেবল একার নয়, সকলের রোগমুক্তি চায়। মিত্রবনের রোগজীর্ণ বিশ্বাসহীন সমাজকে দেখে শাম্বের মনে হয়― ‘এদের মুক্তির কি কোনো উপায় নেই? তাঁর নিজের মুক্তিরই বা কি উপায়।’ (কালকূট ১৯৯৬: ১০০১)

শাম্বের সংগ্রাম একক দুর্ভাগ্যের জন্য নয়। এখানে ব্যক্তির পাপ মূলত সমাজেরই পাপ। তাই ব্যক্তির দুর্ভাগ্যের দায় নিতে হয় সমাজের সকলকেই। আত্মানুসন্ধানে প্রবৃত্ত মানুষ যখনই তার ব্যক্তিসত্তার গভীরে যেতে চায়, অন্বেষণ করে মুক্তির, তখনই সে ব্যক্তিসত্তাকে সমাজের ব্যাপক অংশে বিধৃত দেখতে পায়। তাই যে-কোনো সৎ-সাধনার পশ্চাতে থাকে যথার্থ সমাজবোধ। লক্ষণীয় যে, ‘শাম্ব পুরাণে’ শাম্ব সূর্যকে প্রসন্ন করে মুক্তি পেয়েছিল ব্যাধি থেকে এককভাবে। কিন্তু এ-উপন্যাসে সচেতনভাবে কালকূট শাম্বের সাধনাকে একাকিত্বের সাধনায় অভিষিক্ত না করে সমাজবোধের সঙ্গে যুক্ত করেন। পুরাণে শাম্বের সাধনা আত্মকেন্দ্রিক, কালকূটের সাধনা আত্মবোধের সঙ্গে জড়িত হয়েও সমাজবোধে উৎসারিত। কিন্তু অবিশ্বাসী হতাশাগ্রস্ত কুষ্ঠ রোগীর দল শাম্বের কথায় আস্থাশীল হয়নি। একজন বিদ্রূপ করে ওঠে:

কিন্তু ও যে কী সব বিশ্বাস-ফিশ্বাসের কথা বলছে। ওসবতো মিথ্যা, ছলনা। শাম্ব তখন বলে, যার বিশ্বাস হারায় তার সবই হারিয়ে যায়। (কালকূট ১৯৯৬: ১০০৭)

তারা মনে করে তাদের সবই হারিয়ে গেছে। তাদের আর কোনো কিছুতেই বিশ্বাস নেই। শাম্ব উত্তরে বলে:

আমার সঙ্গে তোমাদের এই প্রভেদের কথাই বলছিলাম। আমি বিশ্বাস করি, আমার পাপই আমাকে বিনাশ করতে উদ্যত হয়েছে, আর একমাত্র মুক্তির উপায় দুষ্কর প্রায়শ্চিত্ত। এই আমার বিশ্বাস। (কালকূট ১৯৯৬: ১০০৭)

শাম্ব উপলব্ধি করে তার অতীত জীবন এখন আর স্মৃতি ছাড়া কিছুই নয়। জীবনের সুখ ও বিলাস তাকে স্পর্শক্ষম নয়। আর এজন্যই প্রতিশ্রুতিশীল লক্ষ্য ছাড়া কোনো কিছুই তাকে বিচলিত করে না। তবে সকলের দুর্ভাগ্যকে এক করে নিয়েও তাঁর চলার পথ স্বতন্ত্র। ঋষিবাক্য অনুসরণ করে সে পৃথক অন্ন ও আশ্রয় গ্রহণ করে, অবাধ শৃঙ্গারে উন্মত্ত হয় না। এটা আত্মাকে অন্যভাবে আবিষ্কার করারই একটা উপায়। তার সত্তাকে সে সমাজের বৃহৎ অংশে ছড়িয়ে থাকতে দেখে। ঐ-সব হতভাগ্য কুষ্ঠরোগীরা তো তারই সত্তাকে বহন করে চলে। আত্মোপলব্ধির পথ তো এই। শাম্ব চরিত্রের এ-হেন পরিবর্তনে আমরা আরও একবার বুঝতে পারি পুরাণ-চর্চার উদ্দেশ্য কালকূটের নেই বরং পুরাণের মুকুরে আত্মদর্শনই তাঁর অন্বিষ্ট।

কুষ্ঠরোগী জীবনের প্রতি চরম অবিশ্বাসী মানুষদের যদৃচ্ছ যৌনবাসনাকে অস্বীকার করেই শাম্ব তার প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হয়েছিল। তার কর্মপথে সূর্যমন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থের প্রয়োজন পড়লে সে দ্বারকায় যায়। পত্নী লক্ষণা কান্নায় ভেঙে পড়ে শাম্বকে পূর্বের মতোই স্বামীরূপে পেতে চায়। কিন্তু সেই রাজপুত্রের বেশ ও বিলাসবহুল জীবন তখন তার নয়। তাই সে বলে:

নিতান্ত অর্থের প্রয়োজনেই আমি এখানে এসেছিলাম। আমার অতীত জীবন আর কখনোই ফিরে আসবে না। তোমার যদি ইচ্ছা হয়, তবে যে-কোনো সময়ে পঞ্চনদীর দেশে, চন্দ্রভাগার তীরে মিত্রবনে ফিরে এসো। সেখানেই তোমার যদি বাস করতে ইচ্ছে হয়, বাস করো। আরও শোনো লক্ষণা, জীবন কখনো এক স্থানে দাঁড়িয়ে থাকে না। তা সতত সঞ্চরমান, পরিবর্তনশীল। তুমি তপোবনে গেলে, রৈবতকের এই হর্ম্যতলের বিলাসকক্ষের জীবন পাবে না। তোমার স্বামীকেও পূর্বের ন্যায় পাবে না। (কালকূট ১৯৯৬: ১০১১)

শাম্ব চরিত্রে বিশ্বাসের এই পরিবর্তন মূলত আধুনিক মানুষেরই বোধ।

নীলাক্ষী শাম্বের জীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত। জীবনের সুন্দর রূপে অনাস্থা ও ভোগ-উন্মত্ত নীলাক্ষী শাম্ব-স্পর্শে মানস-পরিবর্তন করে। ভোগ-সম্ভোগের জীবন থেকে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়। মানবতার জন্য ত্যাগের মহিমায় অভিষিক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে সে হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। মিত্রবনে উপস্থিত হয়ে প্রথমাবস্থায় শাম্বকে খাদ্য দানের পেছনে ছিল তার যৌন সম্ভোগকামনা। তার কামনার পেছনে নিজের প্রতি দুঃখবোধও ছিল। কিন্তু তার জন্য শাম্ব সমব্যথী হলেও মুক্তি-পথে যথেচ্ছা যৌনাচারকে বাধা প্রদান করে। তার প্রত্যাখ্যানের প্রতিক্রিয়ায় নীলাক্ষীর রোষ ও অভিশাপ বর্ষিত হয়। কিন্তু পরিবর্তনশীলতার ছোঁয়ায় সে নতুন মানুষি-সত্তায় জেগে ওঠে। পরে নীলাক্ষীর সাহায্যেই সত্তর জন কুষ্ঠরোগীকে নিয়ে আরোগ্য লাভের মুক্তিপথে শুরু হয় শাম্বের যাত্রা। ‘দ্বাদশ স্থানে ও নদ নদীতে স্নান করে, দ্বাদশ মাস পরে তিনি যখন আবার চন্দ্রভাগাকূলে অস্তাচলমান স্থানে ফিরে এলেন তখন তাঁকে বাদ দিয়ে চৌদ্দজন মাত্র জীবিত।’(কালকূট ১৯৯৬: ১০০৯)। এই চৌদ্দ জন আজ নিজেদের যথার্থ অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে। কালকূট দেখান মৃত্যুময় অসারতা অতিক্রম করে কুষ্ঠরোগীরা অনিবার্য মৃত্যুকে পেছনে ফেলে চলমান জীবনের প্রতি লড়াই অব্যাহত রেখেছে। লক্ষ্যে পৌঁছান সবার পক্ষে সম্ভব হয়ত নয় কিন্তু জীবন-প্রবাহকে তারা অস্বীকার করে না। নীলাক্ষীও শাম্বের জীবনে জড়িত হয়ে নিজস্ব লক্ষ্য নির্বাচন করেছে। বিবর্তনের পথ ধরে কামতাড়িতা এক নারীই অবশেষে প্রেমময়ী সত্তায় উত্তীর্ণ হয়।

দ্বাদশ বর্ষশেষে ‘মূলস্থান মিত্রবন’, ‘কালপ্রিয় কালনাথ ক্ষেত্র’ ও উদয়াচলের সমুদ্রতীরের ‘কোণবল্লভ ক্ষেত্রে’ তিনটি মন্দির নির্মিত হয়। দীর্ঘদিনের সাধনায় অস্তাচলমান স্থানে পর্যায়ক্রমে অবস্থান করে শাম্ব কুষ্ঠরোগ মুক্ত হয়ে পূর্বরূপ ফিরে পায়। নীলাক্ষীও পরিণত হয় মন্দির গাত্রে অঙ্কিত অপ্সরারূপী নারীসত্তায়। একসময়ের কুৎসিত কামতাড়িতা অবিশ্বাসী এক নারী নীলাক্ষীর দৃষ্টিতে তখন নেমে আসে প্রেমমুগ্ধ দৈব দৃষ্টি। শাম্বের রূপে মুগ্ধ হয়ে সে তাকে ‘বিবস্বান’ অর্থাৎ সূর্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে চায়। তথাপি লেখক নীলাক্ষীকে দেবী বলতে নারাজ। মানবীসত্তায় উত্তীর্ণ হয়ে নীলাক্ষী বলে:

আমি এই সমুদ্র ও চন্দ্রভাগা তীরের মধ্যবর্তী স্থলেই থাকতে চাই। বৃষ্ণিরত্ন, আমি আজীবন কোণাদিত্যের পূজা করবো, কিন্তু আমি নিতান্ত প্রস্তরের অপ্সরা মূর্তি নই। আমি মানুষ, তুমি আমার মহামৈত্র। তোমার দর্শনের আশায় আমার প্রাণ ব্যাকুলিত হবে। বৎসরান্তে একবার দেখা দেবে তো? (কালকূট ১৯৯৬: ১০১২)

এই নীলাক্ষী প্রথম দিন মিত্রবনে শাম্ব-দর্শনে ছিল শরীরী কামনায় বিহ্বল। কুষ্ঠ-আক্রান্ত জরাগ্রস্ততায় দৈহিক কামনা-সুখ পেতে ব্যাগ্র সে। কারণ তখনও পর্যন্ত শুধু শরীর নয়, মনও তার মৃত।

এখন শুধু শরীরের ভেতরেই সময় আছে। যেমন জিভ দিয়ে খাবারের স্বাদ পাই। হয়তো মরার আগ পর্যন্ত এই সাড়ই থাকবে। এই সুখটুকু তুমি আমাকে কেন দেবে না? (কালকূট ১৯৯৬: ১০০২)

ভোগবাসনার সে-ই নীলাক্ষী পরিবর্তিত হয়। জীবনের নতুন দার্শনিক উপলব্ধিতে হয় সমাসীন। নীলাক্ষীর মধ্যে সাধনা শেষে আসে ত্যাগের মহিমা, সত্যিকারের প্রেমাচ্ছন্নতা। যে-‘কোণাদিত্য ক্ষেত্রে’ নীলাক্ষী অবস্থান করেছে তার নাম দেওয়া হলো মৈত্রেয় বন। কারণ শাম্ব উপলব্ধি করেছে নীলাক্ষীর মতো প্রকৃত বন্ধুর সাহায্যে মুক্তিপথ-অন্বেষণ সম্ভব। শাম্ব মিত্রবনে মগ ব্রাহ্মণদের প্রতিষ্ঠা করেছে। ব্যাধিগ্রস্তদের চিকিৎসা-ব্যবস্থা করেছে। শাকদ্বীপের ব্রাহ্মণদের সে এখানে এনেছে। অভিশাপ কী, ব্যাধি কী তা সে উপলব্ধি করেছে; ঐশ্বর্যপূর্ণ দ্বারকায় আর ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে তার নেই। মহর্ষি নারদের শেষ আশীর্বাদ:

হে সর্বদেবমান্য, সর্বভূতমান্য, সর্বশ্রুতিমান্য হে শাম্বাদিত্য! আপনি সন্তুষ্ট হোন, আমার পূজা গ্রহণ করুন। … হ্যাঁ আজ থেকে এই বিগ্রহের আর এক নাম শাম্বাদিত্য। এই নামেই তিনি এখানে পূজিত হবেন। (কালকূট ১৯৯৬: ১০১৩)

শাম্ব মানবিক সংগ্রামে উত্তীর্ণ হয়ে এভাবেই উপন্যাসে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। আসলে ‘শাম্ব’ উপন্যাসে প্রতীকী উপস্থাপনার মাধ্যমে কুষ্ঠরোগের অসারতাকে লেখক বর্তমান সমাজ-ব্যবস্থা ব্যাখ্যায় ব্যবহার করেন। কুষ্ঠরোগ দেহকে অসাড় করে দেয়। এই অসাড়তা তো এ-যুগেরই অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আত্মোপলব্ধি ও বিশ্বাসের অভাবে, যুগ-মানুষকে কালকূট দেখেছেন পঙ্গু হয়ে যেতে, অসাড় অস্তিত্ব বহন করতে। কুষ্ঠরোগ কেবল মানুষের দেহে নয়, মনে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠী আজ জীবনের মূল্যবোধ হারিয়ে নীতিভ্রষ্টতায় পতিত। সুখ-সম্ভোগ, বিলাস-ব্যসন আর আত্মবিস্মৃতির মধ্যে কোথাও তাদের জীবনের তাৎপর্য নেই। এই চরিত্রহীন মানুষের সামগ্রিক উত্থান ও সমষ্টিগত উন্নয়নের কথাই কালকূট বলেছেন। এখানেই পুরাণের সঙ্গে যুক্ত হয় আধুনিক বোধ। শাম্ব যখন নীলাক্ষীকে প্রশ্ন করে, ‘নীলাক্ষী তোমার চোখের এই মুগ্ধতা কীসের?’ উত্তরে নীলাক্ষী বলেছে― ‘মানুষের’।

কৃষ্ণের পুত্র শাম্ব (সাম্ব)
কৃষ্ণের পুত্র শাম্ব (সাম্ব)

কালকূটও এখানে মানুষ ও তার জীবন-সংগ্রামকে তুলে ধরেন। সমাজ ও মানুষ-দর্শনে সামষ্টিক এ-চেতনা শাম্ব চরিত্রে পূর্ণতা এনে দিয়েছে। নতুন জীবনের সূচনা শুধু তাই শাম্বের অবদান নয়, এ-তার কৃত্যও। ইনডিভিজুয়্যালিজম ও কালেকটিভিজম-এর অপরূপ মেলবন্ধনের কল্পকাহিনি ভারত-পুরাণের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। কালকূটই তার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে আমাদের দৃষ্টি ফেরালেন। (ভট্টাচার্য ২০০৮: ৬৯)। তাই দ্বারকাবতীর ভোগবাসনা তুচ্ছ করে মানুষের সেবায় নিয়োজিত হয় শাম্ব। মহর্ষি নারদ সূর্যদেবকে পূজাঞ্জলি দিয়ে তাকে ‘শাম্বাদিত্য’ নামে সম্বোধন করলে― ‘শাম্বের সারা শরীর শিহরিত হল।’ (কালকূট ১৯৯৬: ১০১৩)। এখানে সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি― মনুষ্যত্বের সাধনায় আজ দেবতাও গৌরবান্বিত। শাম্বের নামে চিহ্নিত হয়ে সূর্য বা ‘আদিত্য’ই তার ধ্যান হলো তখন। ফলে মানুষ কালকূটের কাছে দেবতার চেয়েও হয়ে উঠল মহীয়ান। কারণ কেবল মানুষেরই আছে অবিরাম জীবনপ্রবাহ, সংগ্রামশীলতা ও আত্মদর্শনের মহিমা।

‘শাম্ব’ উপন্যাসে লেখক মহাভারত-কাহিনির অংশবিশেষে শাম্বের মতো একজন সংগ্রামী নেতার অন্বেষণ করেন। তাঁর প্রাচেতস্ (১৯৮৪) নামক একটি উপন্যাসের নায়ক প্রাচেতস্ও একইভাবে ব্যক্তিচরিত্রের পরিবর্তনের মাধ্যমে মনুষ্যত্ব-স্ফূরণকে প্রাধান্য দেয়। অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি, কুষ্ঠরোগ থেকে আরোগ্য প্রাপ্তি শাম্ব উপন্যাসে আধুনিক ব্যাধিগ্রস্ত জীবন থেকে রক্ষার পাওয়ার প্রতীক; এ-প্রতীকের আড়াল ভেঙে প্রাতেচস্ সরাসরি জীবনজিজ্ঞাসা-পূর্ণ:

আমার ভেতরে এখনও তুষারহিম অন্ধকারের স্তব্ধতা, অথচ তা কাঁপছে, এবং এর মধ্যে আমি একটি আনন্দধ্বনির তাল শুনতে পাচ্ছি। কি ঘটতে চলেছে আমি তা জানিনা। কেবল যে দুঃখ আমাকে বিকৃত ও মরণের ফাঁদে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, সেই দুঃখকে আমি অমৃতের স্বাদ পেতে চাই। আমি শুনেছি, দুঃখই মানুষকে মহৎ করে অথচ মহৎ আমি হতে চাইনি। পূর্ণ মানবতা আমার সাধনা। মহৎ হওয়ার থেকে মানবের পূর্ণতাই কঠিন, যা দুঃখকে গ্লানির অন্ধকার থেকে বের করে নিয়ে আসে, তাকে অমৃতের স্বাদে ভরিয়ে নিতে চায়। (কালকূট ১৯৯৬: ১২৯৭)

পাপ-গ্লানি ও আত্মোপলব্ধির আখ্যান শাম্বের সঙ্গে তুলনা করা যায় প্রাচেতস্-এর। প্রাচেতস্ মহাকাব্যের ইতিবৃত্তীয় আঙ্গিকে তমসা তীরের রামায়ণ রচয়িতা বাল্মীকির অন্বেষণ। কালকূট আধুনিক কালের প্রেক্ষিতে পৌরাণিকতার সংযোজন করেননি; বরং পৌরাণিকতার ঐতিহ্যিক দর্পণেই তিনি আধুনিক মানুষের যন্ত্রণা, চিরকালীন মানুষ, তাদের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের উত্তরাধিকারকে অন্বেষণ করেছেন। ইতিহাসের আঙ্গিনায় প্রাচেতসের অভিজ্ঞতার ব্যাপ্তি তার আত্মোপলব্ধির পথকে প্রশস্ত করে। রামচন্দ্রের কালে তাঁরই সমবয়সী রামায়ণ রচয়িতা প্রাচেতসকে লেখক চরিত্র ও ঘটনার নিরিখে আধুনিক জীবন-অন্বিষ্ট করে তোলেন। কালকূটের বড় কৃতিত্ব এই যে, তিনি হিন্দু পুরাণের এক অতি প্রচলিত কাহিনির নায়কের আত্ম-উদ্বোধনকে আধুনিক মননের অস্তিত্বের আর্তির সঙ্গে একাত্ম করতে পেরেছেন। হত্যা-লুণ্ঠন-কামচরিতার্থতা-পাপ ও অন্যায়ের পর প্রাচেতসের যন্ত্রণা ব্যক্তিমানুষের একাকিত্বের যন্ত্রণা। আর্ত এক অস্তিত্বের আকাঙ্ক্ষাই তার মনকে রাজার আজ্ঞাবহ সৈনাপত্য গ্রহণে বাধা প্রদান করে। এ-বিশাল বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী, কর্ম ও ফলভোগও তাই তার একার; এ-অনুভব তাকে ভীষণভাবে তাড়িত করে। সংসারের নগ্ন বাস্তবকে প্রত্যক্ষ করে তার অন্তরে শূন্যতার অনুভূতি জাগে:

তাহলে সারা জীবন ধরে আমি কি করে আসছি? কোন অন্ধকারে আমি আছি? সংসারের সব সুখের স্বপ্ন আমার ভেঙ্গে গিয়েছে।…আমি যে একা, একা।…পাপের এই একলা জীবনটা নিয়ে আমি কি করবো? কেমন করে এর থেকে মুক্তি পাবো। (কালকূট ১৯৯৬: ১২৯০)

জীবনের মুক্তি-আকাঙ্ক্ষায় নব পথ-উন্মেষণে প্রাচেতস্ কোনো সরল সমীকরণ চায় না। কিম্পুরুষবর্ষ নারদ মুনির কাছে ‘উপবাসী ক্লান্ত রক্তাক্ত’ পায়ে ছুটেও তাই তার সমাধান আসে না। সঙ্গীরাও এক সময়ের হননমত্ত প্রাচেতসের উপলব্ধি ও দুঃখের স্রোতধারা আবিষ্কারে ব্যর্থ হয়। বুদ্ধের মতই সে মানবতার আর্ত-চিৎকার শুনতে পায়। সে-কান্না এখন গগনবিস্তারী; প্রকৃতিতেও তা পরিব্যাপ্ত:

এই প্রকৃতি কি কাঁদছে? দূর থেকে যে ঝর্ণার শব্দ আসছে― ঐ শুনতে পাচ্ছো, কুলকুল শব্দ সে শব্দেও কান্নার আভাস। (কালকূট ১৯৯৬: ১২৮৪)

পৌরাণিক প্রাচেতসকে কালকূট কিছুটা নিজের মতো করে তৈরি করেন। পুরাণে যে-অস্তিত্বের যন্ত্রণা নেই তিনি তা যুক্ত করে মনুষ্যত্ব ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় প্রাচেতসের অন্তর্জগতকে শতধাদীর্ণ করেন। আর তাই নারদ মুনি তার জীবনে নিমিত্ত মাত্র হয়ে উপস্থিত; কর্ম-পরিধি প্রাচেতসের স্বকীয়। নারদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়:

আমি নিমিত্ত মাত্র। তোমার মধ্যে শক্তি না থাকলে তোমার এ জগৎ আলোকিত হত না। একাই তুমি আলোকিত করেছো, কারণ তোমার মধ্যে সত্যের বোধ জাগ্রত হয়েছে। (কালকূট ১৯৯৬: ১২৯২)

অজস্র নারকীয় শোণিতপাতের পর তীব্র দুঃখ-দহনে আত্মসমীক্ষার এক মহালোকে উপনীত হয়েছে প্রাচেতস্। এরই নাম আত্ম-উদ্বোধন, ঋষিরা তাকেই ‘তপোবন’ বলে। সংসারে মানুষের প্রত্যাখ্যান, প্রিয়তমা স্ত্রীর প্রবঞ্চনা, পাপবোধের পুনর্জাগরণ তার জীবনে এনে দেয় ‘মহতী দুঃখে’র স্বাদ। আত্ম-উন্মোচনের পথে প্রাচেতস্ একাকী অন্তরে প্রকৃত-সত্তার তাৎপর্য খুঁজে ফিরেছে। একেই অস্তিত্ববাদীদের *Authentic existence বলে। জীবনের প্রতি অসীম বিশ্বাস আর সীমাহীন প্রতীক্ষায়ও তাই তাকে মুষড়ে পড়তে দেখা যায় না। বিশ্ব প্রকৃতির তাৎপর্য অনুধাবন করতে করতেই সে অব্যাহত যাত্রাপথিকে রূপান্তরিত হয়। দুঃখের অন্ধকারে জীবনের আলোকতীর্থ খুঁজে ফেরাই এখন তার সাধনা। শাম্ব চরিত্রের সঙ্গে এই প্রাচেতস্ সঙ্গত কারণেই প্রাসঙ্গিক।

কালকূট পৌরাণিক-ঐতিহাসিক চরিত্রকে শরীরী প্রত্যক্ষতায় ধরতে গিয়ে তাদের বহিরাবরণ থেকে বের করে আনেন শাশ্বত মানবের ছবি। এসব চরিত্র-নির্মাণে লেখক-কল্পনার চেয়ে বাস্তবের যোগ বেশি। উপন্যাস-কলাকৌশলেও সেসব রচনা বাস্তবতা-অধ্যুষিত রস-জগতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষমতা রাখে। লেখকের আপন উপলব্ধিতে, তাঁরই সৃষ্ট চরিত্রের অন্তর্দেশে যে-অতৃপ্তি, অশান্তি, দিশাহীনতা ও কষ্টের সংবাদ পাই― তাতে আছে নিরন্তর আত্ম-আবিষ্কার। ব্যক্তির অস্তিত্বকে সার্থকতায় দেখতে চাওয়ার এই যে ক্লান্তিহীন প্রয়াস তা লেখকের আত্মোপলব্ধিরই আর্তি। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ, তাদের জীবনবোধ, জীবন-সংগ্রাম, দ্রোহ এবং যন্ত্রণায় ক্লিন্ন-ক্লিষ্ট মানুষের চিত্রাঙ্কন তাঁর অনন্য শিল্পিত ভাষ্য। ‘শাম্ব’ উপন্যাসের কৃষ্ণপুত্র সামষ্টিক মানবের স্বতঃস্ফূর্ত গতির সঙ্গে মিশে যায়। প্রকৃতপক্ষে কালকূটের সযত্নচর্চা ও শিল্পিতায় শাম্ব চরিত্র পৌরাণিকতার খোলস ভেঙে পরিপূর্ণ আধুনিক মানুষের রূপান্তর।

*Authentic existence: “Existentialism” philosophy emphasizes on the ‘existence’ of individual human. After projecting the drawbacks of ‘artificial’ way of life, this philosophy then tries to give guidance as to how humans can live an æauthentic way of life” and so can make their existence ‘authentic’. This ‘guidance’ is something like that a person should reject every sort of objective values and standards. Truth relating to different aspects of life is to be found in pure personal experience of individual, which is subjective. 

তথ্যসূত্র

  • কালকূট (১৯৯৬), প্রাচেতস্, কালকূট রচনা সমগ্র (ড. নিতাই বসু সম্পাদিত), তৃতীয় খণ্ড, মৌসুমী প্রকাশনী, কলকাতা।
  • কালকূট (১৯৯৬), শাম্ব, কালকূট রচনা সমগ্র, পূর্বোক্ত।
  • শাম্ব (১৪২২), আনন্দ, কলকাতা।
  • চক্রবর্তী, শম্ভুনাথ (১৯৯৫), জাতীয় ইতিবৃত্ত ও কালকূট, সাহিত্যায়ন, কলকাতা।
  • ভট্টাচার্য, স্নেহাশিস (২০০৮), ‘মন চল যাই ভ্রমণে’, কালকূট: অন্তহীন অন্বেষণ, পত্রলেখা, কলকাতা।
  • সরকার, সুধীরচন্দ্র (১৪১২), ‘মহাভারত― মৌষল, বিষ্ণুপুরাণ’ পৌরাণিক অভিধান (সঙ্কলক: সুধীরচন্দ্র সরকার), নবম সংস্করণ, কলকাতা।
  • Existentialism’s ‘Authentic Existence’ and ‘Moral Individualism’: http://www.sikhphilosophy.net/interfaith-dialogues/14483-existentialisms-authentic-existence