প্রাচীন মিশরে জাদুবিদ্যার অনেক বেশি প্রচলন ছিল। প্রাচীন মিশরীয়দের বিশ্বাস অনুযায়ী, পুরো বিশ্ব জগত সৃষ্টি যেমন হয়েছে জাদুর সাহায্যে এবং সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে, চলছেও জাদুবলেই। মিসরবিদ (Egyptologist) জেমস হেনরি ব্রেস্টেড (James Henry Breasted) মিশরের জাদুচর্চার ব্যাপারে বলেছিলেন, “জাদু প্রাচীন মিসরীয়দের কাছে ছিল ঘুম আর খাওয়ার মতোই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।” প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করত, জাদুর নিয়ন্ত্রক ওষুধ এবং জাদুবিদ্যার দেবতা হেকা। ‘হেকা’ শব্দের অর্থ ‘জাদু’। অবশ্য হেকার কোনো মন্দির ছিল না। এমনকি তিনি অসাইরিস কিংবা আইসিসের মতো জনপ্রিয়ও ছিলেন না।
প্রাচীন মিশরীয়দের নিকট জাদুবিদ্যা ছিল চিকিৎসা পদ্ধতিরও অংশ। প্রাচীন মিশরীয়রা তাদের চারপাশের শুষ্ক ও ধুলাময় পরিবেশের কারণে শ্বাসকষ্টের মতো বিভিন্ন ধরনের রোগ-বালাই ও শারীরিক সমস্যা দ্বারা জর্জরিত ছিল। এই সকল শারীরিক সমস্যার কারণ হিসেবে তারা দায়ী করত কোনো দেবতার অভিশাপ বা কোনো খারাপ জাদুর প্রভাবকে আর সমাধানের জন্য শরণাপন্ন হতো জাদুবিদ্যার।
প্রাচীন মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিল, হেকা হলো একটি প্রাকৃতিক শক্তি যা সারা বিশ্ব জগতে উপস্থিত ছিল এবং দেবতা আতুম হেকাকে ব্যবহার করেছিলেন বিশ্বের সৃষ্টি এবং উদ্দীপনা তৈরির কাজে। অর্থাৎ সকল দেবতাদের ক্ষমতার পেছনে দায়ী মূলত হেকা। ব্রিটিশ মিশরবিদ রিচার্ড এইচ উইল্কিন্সন (Richard H. Wilkinson) এর মতে, “তিনি অসীম ক্ষমতাধর এক দেবতা হিসেবে বিবেচিত ছিলেন”। রাজকীয় পোশাক পরা হেকার হাতে থাকত লাঠি, যার মাথায় দুটো সাপের মূর্তি, একে অন্যকে জড়িয়ে আছে। আধুনিককালে ওষুধের ক্ষেত্রে যে প্রতীক ব্যবহার করা হয় তা মূলত প্রাচীন মিশরের চিকিৎসার দেবতা এই হেকার চিহ্নকে স্মরণ করে। অবশ্য এটি স্টাফ অব হারমিস (Staff of Hermes) নামেও পরিচিত। স্টাফ অব হার্মিস গ্রিক পুরাণের সাথে সম্পর্কিত।
প্রাচীন মিশরে এক বস্তু থেকে আরেক বস্তুতে রূপান্তরের জাদু ছিল একটি সাধারণ সম্মোহনী ঘটনা। লাঠি এবং সাপের কারসাজিও পরিচিত ছিল বলে ধারণা করা যায়। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতকে সমাধির দেওয়ালে মিশরীয় পুরোহিতদের লাঠির যে ছবি দেখতে পাওয়া যায় সেখানে সর্পদণ্ড দেখা যায়। এমনকি দেবতাদের ছবিতেও এটি দেখা যায়। চতুর্থ ডাইনেস্টির ফারাও খুফুর দরবারে তার সন্তানরা পাঁচটি কাহিনি শুনিয়েছিলেন, সেগুলো ওয়েস্টকার প্যাপিরাস নামে সংরক্ষিত আছে। বার্লিনের মিশরীয় জাদুঘরে সেটি প্রদর্শিত হয়। সেই প্যাপিরাসে চতুর্থ যে গল্পটি আছে তাতে দেদি (Djedi) নামের এক মহাশক্তিমান জাদুকরের কথা উল্লেখ রয়েছে। কথিত আছে, দেদি মানুষের কাটা মুণ্ডু অন্য প্রাণীর ধড়ে বসিয়ে দিতে পারতেন। অর্থাৎ মিশরের জনগণ খুব আশ্চর্যজনক বিভিন্ন ‘জাদু’র সাথে পরিচিত ছিলেন এবং তারা জাদু প্রদর্শনী দেখতেও বেশ পছন্দ করতেন। প্যাপিরাসে এমন জাদুর কথাও উল্লেখ আছে যেখানে ছোটো পরিসরে পানি সরিয়ে রাস্তা হয়ে গেছে।

দৈনন্দিন কাজে যারা জাদু ব্যবহার করত তাদের মধ্যে সির (Seer) ছিল অন্যতম। সির বলতে সেই সব বিদুষী মহিলাদের বুঝানো হতো যারা ভবিষ্যৎ দেখতে পেতেন এবং অসুস্থ ব্যক্তিকে আরোগ্য দানের মাধ্যম হিসেবে কাজ করতেন। সিরগণ শিশু জন্মদানের সময়ে, কোনো স্বপ্নের অর্থ বের করতে এবং ভেষজ উপায়ে রোগ মুক্তিতে সাহায্য করতেন। যদিও বেশিরভাগ মিশরীয়দের কোনো অক্ষরজ্ঞান ছিল না, তবুও সিরদের মতো কিছু মানুষ বিভিন্ন মন্ত্র পরবর্তীতে ব্যবহারের জন্য মনে রাখতে পারতেন।
প্রাচীন মিশরীয়রা মূলত অমঙ্গলের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যেও জাদুবিদ্যার শরণাপন্ন হতো। তাছাড়াও ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য পূরণের জন্যে তারা এই বিদ্যা ব্যবহার করত। প্রাচীন মিশরের প্রায় সব ধর্মের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানই কোনো না কোনো জাদুবিদ্যা হিসেবে বিবেচিত ছিল।
প্রাচীন মিশরে কোনো ব্যক্তির জন্মের সময় জাদু যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তেমনি মৃত্যুর সময়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সমাধি দেওয়ার সর্বশেষ পর্যায় হিসেবে পুরোহিতগণ একটি অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। সেখানে তারা মমির বিভিন্ন অংশে পর্যায়ক্রমে স্পর্শ করে মন্ত্র পাঠ করতেন, যাতে বিদেহী আত্মা পরকালে যাত্রার সময় শুনতে, গন্ধ পেতে, স্বাদ গ্রহণ করতে এবং কথা বলতে পারে। মমি এবং মমির সাথে দেওয়া জিনিসগুলোর সুরক্ষার জন্য মরদেহের সাথে বিভিন্ন ধরনের মন্ত্র পড়া কবজ দেওয়া হতো । এই ধরনের কবজের মধ্যে শাবতি পুতুল ছিল সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। এই পুতুলগুলো তৈরি হতো চীনামাটি বা কাঠ দিয়ে এবং কখনো কখনো পুতুলটিকে মৃত ব্যক্তির অনুরূপ চেহারা দেওয়া হতো।
এরকম আরো তথ্য নিয়ে প্রকাশ হয়েছে আমার বই জুদাইজম (হিব্রু সভ্যতা থেকে আধুনিক ইসরাইল রাষ্ট্র : ইহুদি জাতির ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব, রাজনীতি এবং অন্যান্য)। বইটি প্রকাশ করেছে ভূমি প্রকাশ।
বইয়ের নাম | জুদাইজম (হিব্রু সভ্যতা থেকে আধুনিক ইসরাইল রাষ্ট্র : ইহুদি জাতির ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব, রাজনীতি এবং অন্যান্য) |
লেখকের নাম | মাশরুর ইশরাক |
প্রকাশক | ভূমি প্রকাশন |