০১:২১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

নেতৃত্ব কাকে বলে? নেতৃত্বের সংজ্ঞা, ধারণা ও প্রকারভেদ কী?

প্রফেসর এম এ মাননান
  • প্রকাশ: ০৯:৪৯:৩৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ নভেম্বর ২০২১
  • / ৫৩৬৫৭ বার পড়া হয়েছে

নেতা ও নেতৃত্ব | ছবি: কেওবি এজেন্সি on আনস্প্লাশ

একজন নেতার উদ্যোগ, তদারকি, উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা কর্মীদের মধ্যে কর্মস্পৃহা জাগ্রত করে এবং কার্য সম্পাদনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। এ কারণে একটি সংগঠনে নেতৃত্বের গুরুত্ব অপরিসীম। এখানে নেতৃত্ব বা লিডারশিপ কী বা নেতৃত্বের সংজ্ঞা, ধারণা ও নেতৃত্বের প্রকারভেদ সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।

নেতৃত্বের ধারণা ও সংজ্ঞা (Concept and Definition of Leadership) 

ধরা যাক, একটি প্রতিষ্ঠানে সকল উপকরণকে সুসংগঠিত করা হলো, কর্মী নিয়োগ দেওয়া হলো, যন্ত্রপাতির সমাবেশ ঘটানো হলো, অর্থ সংগ্রহ করা হলো। এতে কী উৎপাদন প্রক্রিয়া অগ্রসর হবে? নিশ্চয়ই নয়। উৎপাদন প্রক্রিয়াকে অগ্রসর করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন। নির্দেশনার জন্য প্রয়োজন নেতৃত্ব। নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠানের মানবীয় শ্রম ও যান্ত্রিক শক্তিকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে ধাবিত করে। নেতৃত্ব কর্মীদের মনোবলকে চাঙ্গা করে।

নেতৃত্ব হচ্ছে বিশেষ কোনো লক্ষ্য অর্জনের জন্য অন্যদেরকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাজকে কিংবা তাদের আচরণকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে নিয়ে আসার ক্ষমতাকেই নেতৃত্ব বলা হয়। যে ব্যক্তি কোনো দল বা গোষ্ঠীকে তার মতের দিকে নিয়ে যান বা প্রভাবিত করেন, তাকে নেতা বলে।

নিচে নেতৃত্ব প্রসঙ্গে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির সংজ্ঞা দেওয়া হলো:

  • ভ্যান ফ্লিট (Van Fleet)-এর মতে, “নেতৃত্ব হলো একটি প্রভাব-প্রক্রিয়া যা অন্যদের আচরণ পরিবর্তনে ব্যবহৃত হয়।” (Leadership is an influence process directed at shaping the behavior of others)। 
  • কিথ ডেভিস (Keith Davis) বলেন, “নেতৃত্ব হলো উদ্দেশ্য অর্জনের নিমিত্তে অন্যান্য লোকদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎসাহিত ও সাহায্য করার একটি প্রক্রিয়া” (Leadership is the process of encouraging and helping others to work enthusiastically toward objectives)।
  • আর. ডাব্লিউ. গ্রিফিন (R. W. Griffin)-এর মতে, “অন্যকে প্রভাবিত করার ক্ষমতাকে নেতৃত্ব হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়” (Leadership can be defined as the ability to influence others)।

উপরের আলোচনা থেকে বলা যায়, বিশেষ লক্ষ্য অর্জনের জন্য কতিপয় ব্যক্তি বা দলের কর্মতৎপরতাকে প্রভাবিত করার প্রক্রিয়াই হলো নেতৃত্ব।

নেতৃত্ব বনাম ব্যবস্থাপনা (Leadership Vs Management) 

নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে কতিপয় মিল রয়েছে, আবার অমিলও রয়েছে। নিচের চিত্রে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে যে, ব্যবস্থাপক না হয়েও কেউ নেতা হতে পারে; আবার কেউ নেতা না হয়েও ব্যবস্থাপক হতে পারে। বাস্তবে আমরা দেখি যে, সব নেতা ব্যবস্থাপক নন এবং সব ব্যবস্থাপকও নেতা নন (not all leaders are managers and not all managers are leaders)। প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর একজন ব্যবস্থাপক কতগুলো আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা পেয়ে থাকেন।

সাংগঠনিক ক্ষমতার বলে একজন ব্যবস্থাপক তার অধীনস্ত কর্মীদেরকে পরিচালিত করতে পারেন, নির্দেশ দিতে পারেন। এক্ষেত্রে তিনি শুধুই ব্যবস্থাপক, নেতা নন। কিন্তু তিনি যদি অধীনস্তদের সংগঠিত করে তাদেরকে বিভিন্ন কৌশলে কাজে উদ্যমী করে তুলতে পারেন, তখন তিনি তাদের নেতাও বটে। 

প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনায় নেতৃত্বের গুরুত্ব (Importance of Leadership in Organizational Management)

সাংগঠনিক ক্ষমতার বলে একজন ব্যবস্থাপক অধিনস্তকে নির্দেশ দিয়ে কার্য সম্পদান করতে পারে। তবে ব্যবস্থাপক নেতৃত্বের গুণাবলির অধিকারী হলোে ঐ নির্দেশনার পাশাপাশি কর্মীকে প্রভাবিত করে কাজের উপযোগিতা বাড়াতে পারেন। নেতৃত্বহীন সংগঠন দাঁড়বিহীন নৌকার মত।

একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় নেতৃত্বের ভূমিকা নিচে আলোচনা করা হলো: 

  1. দলীয় চেতনা বৃদ্ধি (Enhancing team spirit): নেতার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দলীয় সদস্যরা ঐক্যবদ্ধ হয় এবং সকলে প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য অর্জনে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করে। 
  2. মনোবল বৃদ্ধি (Increase of morale): নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মীদের মনোবল বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। নেতা কর্মীদের মনমানসিকতা অনুধাবন করতে পারেন এবং তাঁদেরকে কাজের প্রতি একাগ্র হতে অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম হন। 
  3. সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ (Proper control): নেতৃত্বের সাথে নিয়ন্ত্রণ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ কাজের সঠিক নিয়ন্ত্রণ ব্যতীত কোন প্রতিষ্ঠান তার উদ্দেশ্য অর্জন করতে পারে না। 
  4. শৃংখলা প্রতিষ্ঠা (Establishing discipline): নেতা প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের হতাশা, অপ্রাপ্তি আর বিশৃঙ্খলা দূর করেন। ফলে সংগঠনে শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত হয়। 
  5. পরিবর্তন মোকাবেলা (Facing Changes): বর্তমান তীব্র প্রতিযোগিতার জগতে ব্যবসার ধরন প্রতিনিয়ত পরিবর্তীত হচ্ছে। ফলে প্রতিষ্ঠানের নিয়মকানুন এবং পদ্ধতিতেও পরিবর্তন হয়। সুষ্ঠু ও যোগ্য নেতৃত্ব কর্মীদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে পরিবর্তনশীল অবস্থা মোকাবেলা করতে সক্ষম করে। 
  6. কার্যকর সমন্বয়সাধন (Effective coordination): নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত বিভিন্ন ব্যক্তি এবং বিভিন্নমুখী কাজের মধ্যে ঐকতান সৃষ্টি করে। সঠিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ব্যক্তি ও তাদের কাজের মধ্যে সংহতি বিধান করে কার্যকর সমন্বয়সাধনে সহায়তা করে।
  7. কর্তৃত্ব প্রয়োগে সহায়তা (Aid to applying authority): নেতৃত্বের বলেই নেতা তার কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা অন্যের উপর প্রয়োগ করতে পারেন এবং কাকে দিয়ে কোন কাজ, কীভাবে সম্পাদন করা হবে তা নির্ধারণ করে দেন। 
  8. শ্রমিক-ব্যবস্থাপনা সম্পর্কের উন্নয়ন (Improvement of labour-management relationship): নেতৃত্ব কর্মীদেরকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কার্য সম্পাদনের দিক-নির্দেশনা প্রদান করে। ফলে কর্মীরা দক্ষতার সাথে সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট হয়। এতে কর্মী ও ব্যবস্থাপক উভয়েই সন্তুষ্ট থাকেন এবং পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে। 

নেতৃত্বের প্রকারভেদ (Concept of Leadership)

নেতাকে স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে বিভিন্ন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। এর ফলে তার আচার-আচরণ, ক্ষমতা, ব্যক্তিত্ব, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদিও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। 

নিচে নেতৃত্বের প্রকারভেদ আলোচনা করা হলো: 

আনুষ্ঠানিকতাভিত্তিক নেতৃত্ব 

আনুষ্ঠানিকতার ভিত্তিতে নেতৃত্বকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়: 

১. আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব (Formal leadership)

আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব আনুষ্ঠানিক কাঠামো থেকে সৃষ্ট। প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত বৈধ ক্ষমতার বলে একজন ব্যক্তি অধস্তনদের নেতা হিসেবে গণ্য হন। একটি কলেজের অধ্যক্ষ এ ধরনের নেতৃত্বের উদাহরণ। অনেকটা পদাধিকার বলে এ ধরনের নেতার জন্ম হয়। 

২. অনানুষ্ঠানিক নেতৃত্ব (Informal leadership)

আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের বাইরেও যে নেতৃত্ব গড়ে উঠে তাকে অনানুষ্ঠানিক নেতৃত্ব বলা হয়ে থাকে। অনানুষ্ঠানিক নেতাদের কোনো বিধিবদ্ধ ক্ষমতা থাকে না। তারা তাদের ব্যক্তিত্ব দ্বারা মানুষকে প্রভাবিত করেন।

কোনো গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য যোগ্য নেতৃত্ব বা লিডারশিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ
কোনো গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য যোগ্য নেতৃত্ব বা লিডারশিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ | August de Richelieu/Pexels

ক্ষমতাভিত্তিক নেতৃত্ব 

নেতার ক্ষমতা প্রয়োগের ভিত্তিতে নেতৃত্বকে চার ভাগে ভাগ করা যায়: 

১. স্বৈরতান্ত্রিক বা স্বেচ্ছাচারী নেতৃত্ব (Autocratic Leadership)

নেতা যখন অনুসারীদের সাথে স্বেচ্ছাচারমূলক আচরণ করেন তখন তার নেতৃত্বকে স্বেচ্ছাচারী নেতৃত্ব বলে। স্বেচ্ছাচারী নেতা ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করে রাখেন, সিদ্ধান্তগ্রহণে কর্মীদের অংশ নেওয়ার সুযোগ দেন না বরং নিজের সিদ্ধান্ত তাদের উপর চাপিয়ে দেন। নেতার ইচ্ছানুসারে কাজ না করা হলোে কর্মীদের শাস্তির ভয় দেখান কিংবা চাকরিচ্যুত করেন। তবে এরূপ নেতৃত্বের প্রধান সুবিধা হলো, এতে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। 

২. অংশগ্রহণমূলক নেতৃত্ব (Participative Leadership)

যে ধরনের নেতৃত্বে কর্মীদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, তাকে গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব বা অংশগ্রহণমূলক নেতৃত্ব বলে। এরূপ নেতৃত্বের সুবিধা হলোো, কর্মীরা সন্তুষ্ট থাকে এবং কাজের প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়ে। তবে সিদ্ধান্তগ্রহণ বিলম্বিত হয়। 

৩. অবাধ বা লাগামহীন নেতৃত্ব (Free-rein leadership/laissez-faire leadership)

যে নেতৃত্বে নেতা বা ব্যবস্থাপক নিজের ক্ষমতা নিচের স্তরের বিশ্বস্ত কর্মীদের স্ব-স্ব কাজে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে দেন, তাকে অবাধ নেতৃত্ব বলে। একে মুক্ত নেতৃত্বও বলা হয়। এক্ষেত্রে নেতা ক্ষমতা ও দায়িত্ব পরিহার করে চলেন, কর্মীদেরকেই তাদের সমস্যা সামাল দেবার পরামর্শ দেন এবং সিদ্ধান্তগ্রহণে নেতা তেমন ভূমিকা গ্রহণ করেন না। কর্মীদলের যোগ্যতার উপর অবাধ নেতৃত্বের সাফল্য নির্ভর করে। সুষ্ঠু সমন্বয়ের অভাব ঘটলে এ ধরনের নেতৃত্বে বিভিন্ন বিভাগের কাজের মধ্যে বিশৃংখলা দেখা দেবার সম্ভাবনা থাকে। 

৪. পিতৃসুলভ নেতৃত্ব (Paternalistic leadership)

পিতৃসুলভ নেতৃত্বে নেতা কর্মীদের সাথে পিতৃসুলভ আচরণ করেন। এক্ষেত্রে নেতা কর্মীদেরকে স্নেহের ডোরে আবদ্ধ করেন। এ নেতৃত্ব কখনো কখনো সুফল বয়ে আনলেও কর্মীদের সৃষ্টিশীলতায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। 

প্রেষণাভিত্তিক নেতৃত্ব

প্রেষণাভিত্তিক নেতৃত্ব প্রেষণাভিত্তিক নেতৃত্ব দুই ধরনের: 

১. ইতিবাচক নেতৃত্ব (Positive Leadership)

যে ধরনের নেতৃত্বে নেতা কর্মীদেরকে পুরস্কৃত করার মাধ্যমে উৎসাহিত করেন, তাকে ইতিবাচক নেতৃত্ব বলা হয়। ভাল কাজের স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে ও পুরস্কার প্রদানের ফলে কর্মীরা তাদের কার্যে অধিক মনোনিবেশ করে। 

২. নেতিবাচক নেতৃত্ব (Negative Leadership)

নেতিবাচক নেতৃত্ব কর্মীদেরকে ভয়-ভীতি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে কাজ করানোর চেষ্টা করে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে অবহেলা বা কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি হলোে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। এ জাতীয় নেতৃত্বে কর্মীরা কর্ম সম্পাদনে অধিক সাবধানী হয়ে থাকে

সারসংক্ষেপ

নেতৃত্ব হচ্ছে বিশেষ কোনো লক্ষ্য অর্জনের জন্য অন্যদেরকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা। নির্দেশনা ব্যবস্থাপনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এটি বাস্তবায়ন সম্পর্কিত কাজ। নির্দেশনা একটি চলমান ও সার্বক্ষণিক কাজ। নির্দেশনা সবসময়ই জনশক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইতিবাচক নেতৃত্ব হচ্ছে সে ধরনের নেতৃত্ব যে ক্ষেত্রে নেতা কর্মীদেরকে উত্তম কার্য সম্পাদনের জন্য পুরস্কৃত করার মাধ্যমে উৎসাহিত করে থাকেন।

(বিশ্লেষণ টিম কর্তৃক সম্পাদিত)

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

নেতৃত্ব কাকে বলে? নেতৃত্বের সংজ্ঞা, ধারণা ও প্রকারভেদ কী?

প্রকাশ: ০৯:৪৯:৩৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ নভেম্বর ২০২১

একজন নেতার উদ্যোগ, তদারকি, উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা কর্মীদের মধ্যে কর্মস্পৃহা জাগ্রত করে এবং কার্য সম্পাদনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। এ কারণে একটি সংগঠনে নেতৃত্বের গুরুত্ব অপরিসীম। এখানে নেতৃত্ব বা লিডারশিপ কী বা নেতৃত্বের সংজ্ঞা, ধারণা ও নেতৃত্বের প্রকারভেদ সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।

নেতৃত্বের ধারণা ও সংজ্ঞা (Concept and Definition of Leadership) 

ধরা যাক, একটি প্রতিষ্ঠানে সকল উপকরণকে সুসংগঠিত করা হলো, কর্মী নিয়োগ দেওয়া হলো, যন্ত্রপাতির সমাবেশ ঘটানো হলো, অর্থ সংগ্রহ করা হলো। এতে কী উৎপাদন প্রক্রিয়া অগ্রসর হবে? নিশ্চয়ই নয়। উৎপাদন প্রক্রিয়াকে অগ্রসর করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন। নির্দেশনার জন্য প্রয়োজন নেতৃত্ব। নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠানের মানবীয় শ্রম ও যান্ত্রিক শক্তিকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে ধাবিত করে। নেতৃত্ব কর্মীদের মনোবলকে চাঙ্গা করে।

নেতৃত্ব হচ্ছে বিশেষ কোনো লক্ষ্য অর্জনের জন্য অন্যদেরকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাজকে কিংবা তাদের আচরণকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে নিয়ে আসার ক্ষমতাকেই নেতৃত্ব বলা হয়। যে ব্যক্তি কোনো দল বা গোষ্ঠীকে তার মতের দিকে নিয়ে যান বা প্রভাবিত করেন, তাকে নেতা বলে।

নিচে নেতৃত্ব প্রসঙ্গে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির সংজ্ঞা দেওয়া হলো:

  • ভ্যান ফ্লিট (Van Fleet)-এর মতে, “নেতৃত্ব হলো একটি প্রভাব-প্রক্রিয়া যা অন্যদের আচরণ পরিবর্তনে ব্যবহৃত হয়।” (Leadership is an influence process directed at shaping the behavior of others)। 
  • কিথ ডেভিস (Keith Davis) বলেন, “নেতৃত্ব হলো উদ্দেশ্য অর্জনের নিমিত্তে অন্যান্য লোকদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎসাহিত ও সাহায্য করার একটি প্রক্রিয়া” (Leadership is the process of encouraging and helping others to work enthusiastically toward objectives)।
  • আর. ডাব্লিউ. গ্রিফিন (R. W. Griffin)-এর মতে, “অন্যকে প্রভাবিত করার ক্ষমতাকে নেতৃত্ব হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়” (Leadership can be defined as the ability to influence others)।

উপরের আলোচনা থেকে বলা যায়, বিশেষ লক্ষ্য অর্জনের জন্য কতিপয় ব্যক্তি বা দলের কর্মতৎপরতাকে প্রভাবিত করার প্রক্রিয়াই হলো নেতৃত্ব।

নেতৃত্ব বনাম ব্যবস্থাপনা (Leadership Vs Management) 

নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে কতিপয় মিল রয়েছে, আবার অমিলও রয়েছে। নিচের চিত্রে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে যে, ব্যবস্থাপক না হয়েও কেউ নেতা হতে পারে; আবার কেউ নেতা না হয়েও ব্যবস্থাপক হতে পারে। বাস্তবে আমরা দেখি যে, সব নেতা ব্যবস্থাপক নন এবং সব ব্যবস্থাপকও নেতা নন (not all leaders are managers and not all managers are leaders)। প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর একজন ব্যবস্থাপক কতগুলো আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা পেয়ে থাকেন।

সাংগঠনিক ক্ষমতার বলে একজন ব্যবস্থাপক তার অধীনস্ত কর্মীদেরকে পরিচালিত করতে পারেন, নির্দেশ দিতে পারেন। এক্ষেত্রে তিনি শুধুই ব্যবস্থাপক, নেতা নন। কিন্তু তিনি যদি অধীনস্তদের সংগঠিত করে তাদেরকে বিভিন্ন কৌশলে কাজে উদ্যমী করে তুলতে পারেন, তখন তিনি তাদের নেতাও বটে। 

প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনায় নেতৃত্বের গুরুত্ব (Importance of Leadership in Organizational Management)

সাংগঠনিক ক্ষমতার বলে একজন ব্যবস্থাপক অধিনস্তকে নির্দেশ দিয়ে কার্য সম্পদান করতে পারে। তবে ব্যবস্থাপক নেতৃত্বের গুণাবলির অধিকারী হলোে ঐ নির্দেশনার পাশাপাশি কর্মীকে প্রভাবিত করে কাজের উপযোগিতা বাড়াতে পারেন। নেতৃত্বহীন সংগঠন দাঁড়বিহীন নৌকার মত।

একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় নেতৃত্বের ভূমিকা নিচে আলোচনা করা হলো: 

  1. দলীয় চেতনা বৃদ্ধি (Enhancing team spirit): নেতার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দলীয় সদস্যরা ঐক্যবদ্ধ হয় এবং সকলে প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য অর্জনে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করে। 
  2. মনোবল বৃদ্ধি (Increase of morale): নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মীদের মনোবল বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। নেতা কর্মীদের মনমানসিকতা অনুধাবন করতে পারেন এবং তাঁদেরকে কাজের প্রতি একাগ্র হতে অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম হন। 
  3. সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ (Proper control): নেতৃত্বের সাথে নিয়ন্ত্রণ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ কাজের সঠিক নিয়ন্ত্রণ ব্যতীত কোন প্রতিষ্ঠান তার উদ্দেশ্য অর্জন করতে পারে না। 
  4. শৃংখলা প্রতিষ্ঠা (Establishing discipline): নেতা প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের হতাশা, অপ্রাপ্তি আর বিশৃঙ্খলা দূর করেন। ফলে সংগঠনে শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত হয়। 
  5. পরিবর্তন মোকাবেলা (Facing Changes): বর্তমান তীব্র প্রতিযোগিতার জগতে ব্যবসার ধরন প্রতিনিয়ত পরিবর্তীত হচ্ছে। ফলে প্রতিষ্ঠানের নিয়মকানুন এবং পদ্ধতিতেও পরিবর্তন হয়। সুষ্ঠু ও যোগ্য নেতৃত্ব কর্মীদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে পরিবর্তনশীল অবস্থা মোকাবেলা করতে সক্ষম করে। 
  6. কার্যকর সমন্বয়সাধন (Effective coordination): নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত বিভিন্ন ব্যক্তি এবং বিভিন্নমুখী কাজের মধ্যে ঐকতান সৃষ্টি করে। সঠিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ব্যক্তি ও তাদের কাজের মধ্যে সংহতি বিধান করে কার্যকর সমন্বয়সাধনে সহায়তা করে।
  7. কর্তৃত্ব প্রয়োগে সহায়তা (Aid to applying authority): নেতৃত্বের বলেই নেতা তার কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা অন্যের উপর প্রয়োগ করতে পারেন এবং কাকে দিয়ে কোন কাজ, কীভাবে সম্পাদন করা হবে তা নির্ধারণ করে দেন। 
  8. শ্রমিক-ব্যবস্থাপনা সম্পর্কের উন্নয়ন (Improvement of labour-management relationship): নেতৃত্ব কর্মীদেরকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কার্য সম্পাদনের দিক-নির্দেশনা প্রদান করে। ফলে কর্মীরা দক্ষতার সাথে সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট হয়। এতে কর্মী ও ব্যবস্থাপক উভয়েই সন্তুষ্ট থাকেন এবং পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে। 

নেতৃত্বের প্রকারভেদ (Concept of Leadership)

নেতাকে স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে বিভিন্ন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। এর ফলে তার আচার-আচরণ, ক্ষমতা, ব্যক্তিত্ব, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদিও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। 

নিচে নেতৃত্বের প্রকারভেদ আলোচনা করা হলো: 

আনুষ্ঠানিকতাভিত্তিক নেতৃত্ব 

আনুষ্ঠানিকতার ভিত্তিতে নেতৃত্বকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়: 

১. আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব (Formal leadership)

আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব আনুষ্ঠানিক কাঠামো থেকে সৃষ্ট। প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত বৈধ ক্ষমতার বলে একজন ব্যক্তি অধস্তনদের নেতা হিসেবে গণ্য হন। একটি কলেজের অধ্যক্ষ এ ধরনের নেতৃত্বের উদাহরণ। অনেকটা পদাধিকার বলে এ ধরনের নেতার জন্ম হয়। 

২. অনানুষ্ঠানিক নেতৃত্ব (Informal leadership)

আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের বাইরেও যে নেতৃত্ব গড়ে উঠে তাকে অনানুষ্ঠানিক নেতৃত্ব বলা হয়ে থাকে। অনানুষ্ঠানিক নেতাদের কোনো বিধিবদ্ধ ক্ষমতা থাকে না। তারা তাদের ব্যক্তিত্ব দ্বারা মানুষকে প্রভাবিত করেন।

কোনো গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য যোগ্য নেতৃত্ব বা লিডারশিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ
কোনো গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য যোগ্য নেতৃত্ব বা লিডারশিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ | August de Richelieu/Pexels

ক্ষমতাভিত্তিক নেতৃত্ব 

নেতার ক্ষমতা প্রয়োগের ভিত্তিতে নেতৃত্বকে চার ভাগে ভাগ করা যায়: 

১. স্বৈরতান্ত্রিক বা স্বেচ্ছাচারী নেতৃত্ব (Autocratic Leadership)

নেতা যখন অনুসারীদের সাথে স্বেচ্ছাচারমূলক আচরণ করেন তখন তার নেতৃত্বকে স্বেচ্ছাচারী নেতৃত্ব বলে। স্বেচ্ছাচারী নেতা ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করে রাখেন, সিদ্ধান্তগ্রহণে কর্মীদের অংশ নেওয়ার সুযোগ দেন না বরং নিজের সিদ্ধান্ত তাদের উপর চাপিয়ে দেন। নেতার ইচ্ছানুসারে কাজ না করা হলোে কর্মীদের শাস্তির ভয় দেখান কিংবা চাকরিচ্যুত করেন। তবে এরূপ নেতৃত্বের প্রধান সুবিধা হলো, এতে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। 

২. অংশগ্রহণমূলক নেতৃত্ব (Participative Leadership)

যে ধরনের নেতৃত্বে কর্মীদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, তাকে গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব বা অংশগ্রহণমূলক নেতৃত্ব বলে। এরূপ নেতৃত্বের সুবিধা হলোো, কর্মীরা সন্তুষ্ট থাকে এবং কাজের প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়ে। তবে সিদ্ধান্তগ্রহণ বিলম্বিত হয়। 

৩. অবাধ বা লাগামহীন নেতৃত্ব (Free-rein leadership/laissez-faire leadership)

যে নেতৃত্বে নেতা বা ব্যবস্থাপক নিজের ক্ষমতা নিচের স্তরের বিশ্বস্ত কর্মীদের স্ব-স্ব কাজে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে দেন, তাকে অবাধ নেতৃত্ব বলে। একে মুক্ত নেতৃত্বও বলা হয়। এক্ষেত্রে নেতা ক্ষমতা ও দায়িত্ব পরিহার করে চলেন, কর্মীদেরকেই তাদের সমস্যা সামাল দেবার পরামর্শ দেন এবং সিদ্ধান্তগ্রহণে নেতা তেমন ভূমিকা গ্রহণ করেন না। কর্মীদলের যোগ্যতার উপর অবাধ নেতৃত্বের সাফল্য নির্ভর করে। সুষ্ঠু সমন্বয়ের অভাব ঘটলে এ ধরনের নেতৃত্বে বিভিন্ন বিভাগের কাজের মধ্যে বিশৃংখলা দেখা দেবার সম্ভাবনা থাকে। 

৪. পিতৃসুলভ নেতৃত্ব (Paternalistic leadership)

পিতৃসুলভ নেতৃত্বে নেতা কর্মীদের সাথে পিতৃসুলভ আচরণ করেন। এক্ষেত্রে নেতা কর্মীদেরকে স্নেহের ডোরে আবদ্ধ করেন। এ নেতৃত্ব কখনো কখনো সুফল বয়ে আনলেও কর্মীদের সৃষ্টিশীলতায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। 

প্রেষণাভিত্তিক নেতৃত্ব

প্রেষণাভিত্তিক নেতৃত্ব প্রেষণাভিত্তিক নেতৃত্ব দুই ধরনের: 

১. ইতিবাচক নেতৃত্ব (Positive Leadership)

যে ধরনের নেতৃত্বে নেতা কর্মীদেরকে পুরস্কৃত করার মাধ্যমে উৎসাহিত করেন, তাকে ইতিবাচক নেতৃত্ব বলা হয়। ভাল কাজের স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে ও পুরস্কার প্রদানের ফলে কর্মীরা তাদের কার্যে অধিক মনোনিবেশ করে। 

২. নেতিবাচক নেতৃত্ব (Negative Leadership)

নেতিবাচক নেতৃত্ব কর্মীদেরকে ভয়-ভীতি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে কাজ করানোর চেষ্টা করে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে অবহেলা বা কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি হলোে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। এ জাতীয় নেতৃত্বে কর্মীরা কর্ম সম্পাদনে অধিক সাবধানী হয়ে থাকে

সারসংক্ষেপ

নেতৃত্ব হচ্ছে বিশেষ কোনো লক্ষ্য অর্জনের জন্য অন্যদেরকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা। নির্দেশনা ব্যবস্থাপনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এটি বাস্তবায়ন সম্পর্কিত কাজ। নির্দেশনা একটি চলমান ও সার্বক্ষণিক কাজ। নির্দেশনা সবসময়ই জনশক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইতিবাচক নেতৃত্ব হচ্ছে সে ধরনের নেতৃত্ব যে ক্ষেত্রে নেতা কর্মীদেরকে উত্তম কার্য সম্পাদনের জন্য পুরস্কৃত করার মাধ্যমে উৎসাহিত করে থাকেন।

(বিশ্লেষণ টিম কর্তৃক সম্পাদিত)