০১:৫৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

আনন্দমঠ উপন্যাস রিভিউ এবং বঙ্কিম মানস

ইনামুল করিম
  • প্রকাশ: ১২:১১:১২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ নভেম্বর ২০২১
  • / ১০৫৬৫ বার পড়া হয়েছে

আনন্দমঠ লিখেছেন বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ১৮৮২ সালে

ইতিহাস ও উপন্যাস ভিন্ন ভিন্ন গোত্র ও চরিত্রের। এদের বিষয়বস্তু এক হলেও গঠন প্রকৃতি আলাদা। একজন ঔপন্যাসিক তার লেখায় যে মাত্রায় স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেন একজন ইতিহাসবিদ সেটা পারেন না। সে কারণে কেউ ইতিহাস পড়তে গিয়ে উপন্যাসের স্বাদ গ্রহণ করতে আগ্রহী নন। অন্যদিকে উপন্যাস পড়তে গিয়ে ইতিহাসের তথ্যের বাস্তব জমিনে পা রাখতে অনিচ্ছুক। কিন্তু ইতিহাস প্রদত্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে উপন্যাস লেখা যায়। সেখানে ইতিহাসের বাস্তবতাকে সাহিত্যের বাস্তবতায় রূপান্তর করে ইতিহাসের বাস্তবতা পুনঃনির্মিত হয়। এক্ষেত্রে ইতিহাসের তথ্যকে শুধু ব্যবহার করা হয় কিংবা শিল্পের আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করা হয়। কিন্তু ইতিহাসের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে রচিত উপন্যাসে ঐতিহাসিক তথ্যের বিকৃতি ঘটানো কাম্য নয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’ এ কার্যত সেটাই ঘটেছে। সেখানে ঐতিহাসিক বাস্তবতার বিকৃতি ঘটানো হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৮২ সালে ‘আনন্দমঠ’ রচনা করেন।

অন্যদিকে উপন্যাসে ঔপন্যাসিকের মতাদর্শ সক্রিয় থাকে। উপন্যাসের বিষয়বস্তু নির্মাণে এই মতাদর্শ ও বাস্তবতার রাসায়নিক মিশ্রণ ঘটে থাকে। কিন্তু সেই মতাদর্শের প্রতিফলন শিল্পের শর্তকে লঙ্গন করে নয়। অর্থাৎ শৈল্পিকভাবেই লেখকের মতাদর্শ উপন্যাসে উপস্থিত থাকে। লেখক জীবন ও জগতকে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে এবং কোন অবস্থান থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন বাস্তবতাকে বিশ্লেষণ ও উপস্থাপন করেছেন সেটা উপন্যাসে প্রস্ফুটিত হয়। ‘আনন্দমঠ’ এ বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের কোনো মতাদর্শ প্রস্ফুটিত? ‘আনন্দমঠ’ পর্যালোচনায় এ উপপাদ্য প্রস্ফুটিত যে, হিন্দুমন বা হিন্দু জাতীয়তাবাদ এবং মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ‘আনন্দমঠ’ এর মৌল মতাদর্শিক ভিত্তি। একজন লেখকের মতাদর্শ হিসেবে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে লালন করাটা কোনো দোষের বিষয় নয়, কিন্তু সেটা যখন সাম্প্রদায়িকতার রূপ ধারণ করে তখনই সেটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ‘আনন্দমঠ’-এর হিন্দু জাতীয়তাবাদ-এর ক্ষেত্রে এ ঘটনাই ঘটেছে।

আনন্দমঠ লিখেছেন বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ১৮৮২ সালে

‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৮০-১৯৮১ সালে মাসিক ‘বঙ্গ দর্শন’ সাময়িকীতে এবং বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৮৮২ সালে। সে সময় ভারতীয় উপমহাদেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা ছিল বিদ্রোহ ও অস্থিরতায় আক্রান্ত। তৎকালীন বড়লাট লর্ড লিটনের কৃষি সচিব অ্যালান হিউস পর্যন্ত স্বীকার করেছেন যে, ভারত উপমহাদেশের সামগ্রিক বাস্তবতা এক ভয়ঙ্কর অভ্যুত্থানের মুখোমুখি। সমগ্র ভারতবর্ষ ছিল একটা জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। যে-কোনো মুহূর্তে এটা বিস্ফোরিত হতে পারে। দেশের বেশিরভাগ নিম্নবর্গের মানুষ প্রচলিত ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল এবং ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য সশস্ত্র অভ্যুত্থানের বিষয়ে ভাবতে শুরু করেছিল। অনেক স্থানে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। এই সময়ের পরিধিতে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। একটি হলো মনন্তর এবং অপরটি হলো ফকির ও সন্ন্যাস বিদ্রোহ। তৎকালীন সময়ের অগ্নিগর্ভ পরিবেশ ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি লেখা হয়। এখানে ছিয়াত্তরের মনন্তরের প্রেক্ষাপটে সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে উপস্থাপন করা হয়েছে।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ সালে পলাশীযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলার শাসন ক্ষমতা দখল করে। প্রথমে নিজেরা শাসন ক্ষমতা হাতে নেয়নি। প্রথমে তারা পুতুল নবাব মসনদে বসায়। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে রেখে দেয়। ব্রিটিশ বেনিয়া গোষ্ঠী ১৭৬৫ সালের ১২ আগস্ট দিল্লির সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলার দেওয়ানী বা রাজস্ব আদায়ের আনুষ্ঠানিক ফরমান আদায় করেন। এর ফলে এখানে দ্বৈত কর্তৃত্বের সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক ক্ষমতা নবাবের নিকট আর আর্থিক ক্ষমতা বা রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা কোম্পানির হাতে এসে যায়।

কোম্পানি রাজস্ব আদায়ের জন্য প্রচলিত ব্যবস্থা বাতিল করে নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। ঐ সময়ে শাসকরা সমগ্র গ্রাম সমাজের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করত, কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে রাজস্ব নেওয়া হতো না। কিন্তু কোম্পানি রাজস্ব সংগ্রহের ক্ষমতা হাতে পাওয়ার পর ভূমি ও কর ব্যবস্থা সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে ফেলে। তারা গ্রাম সমাজের পরিবর্তে কৃষকের কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে এবং উৎপন্ন ফসলের পরিবর্তে মুদ্রার মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা চালু করে। পাশাপাশি কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করে তার একটি অংশ কোম্পানির কোষাগারে জমা দেওয়ার জন্য নতুন মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির জন্ম দেয়। এদেরকে বলা হতো জমিদার। আবার এই জমিদারদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের আরেকটি নতুন স্তর সৃষ্টি করা হয় তাদেরকে বলা হয় নাজিম। এ প্রসঙ্গে বাংলা ও বিহারের রাজস্ব কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ১৭৭২ সালের ৩ নভেম্বর ইংল্যান্ডে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বোর্ড অব ডাইরেক্টরসকে লেখা এক চিঠিতে বলেন, ‘নাসিমরা জমিদার ও কৃষকদের কাছ থেকে যত বেশি পারে কর আদায় করে নিচ্ছে জমিদাররাও নাসিমদের কাছ থেকে চাষিদের লুণ্ঠন করার অবাধ অধিকার লাভ করেছে। নাসিমরা আবার তাদের সকলের (জমিদার ও কৃষকদের) সর্বস্ব কেড়ে নেয়ার রাজকীয় বিশেষ অধিকারের বলে দেশের ধন-সম্পদ লুট করে সম্পদের অধিকারী হয়েছে।’ (সুপ্রকাশ রায় : ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম।)

ব্রিটিশ বেনিয়া গোষ্ঠী বেশি পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের জন্য রাজস্বের হার বৃদ্ধি করে। খাজনার টাকা যোগাড় করতে গিয়ে কৃষক তার উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এই সুযোগে ইংরেজ ব্যবসায়ীরা কম দামে চাল ক্রয় করে মজুত করতে থাকে। পরে সুযোগ খুঁজে সেই চাল বেশি দামে বিক্রয় করত। কিন্তু চড়াদামে চাল কেনা সম্ভব ছিল না। ফলে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ১১৭৬ সালে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হন বাংলা-বিবাহের জনগণ। এ দুর্ভিক্ষ ছিয়াত্তরের মনন্তর নামে খ্যাত। তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এর হিসাব অনুযায়ী দুর্ভিক্ষের কারণে এক কোটি পঞ্চাশ লাখ লোক মারা গিয়েছিল। এই দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে ইংরেজ লেখক ইয়ং হাসবেন্ড লিখেছেন— “তাদের (ইংরেজ বণিকদের) মুনাফা শিকারের পরবর্তী উপায় হলো চাল কিনে গুদামজাত করে রাখা। তারা নিশ্চিত ছিল যে, জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য এই দ্রব্যটির জন্য তারা যে দাম চাইবে, তাই তারা পাবে।… দেশে যা কিছু খাদ্য ছিল তা (ইংরেজ বণিকদের) একচেটিয়া দখলে চলে গেল। খাদ্যের পরিমাণ যত কমতে লাগল, ততোই দাম বাড়তে লাগল। শ্রমজীবী দরিদ্র জনগণের চির দুঃসময় জীবনের ওপর পতিত হলো এই পুঞ্জিভূত দুর্যোগের প্রথম আঘাত।

ছিয়াত্তরের মন্বন্তর সম্পর্কে উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন— ‘১৭৬৯ সালের শীতকালে বাংলায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। যার জের দুই পুরুষ ধরে চলে।১৭৭০ সালের গ্রীষ্মকালজুড়ে গণমড়ক অব্যাহত থাকে। কৃষকরা গবাদিপশু বিক্রি করে দেয়। বিক্রি করে কৃষি কাজের যন্ত্রপাতি, তারা বীজ ধান খেয়ে ফেলে, নিজেদের ছেলেমেয়েদের তারা বিক্রি করতে থাকে এবং তারপরও তার কোন ক্রেতা পাওয়া যায় না। তারা গাছের পাতা, ক্ষেতের ঘাস খেতে থাকে এবং ১৭৭০ সালের জুন মাসে দরবারের আবাসিক প্রতিনিধি শব ভক্ষণের সত্যতা স্বীকার করেন। সরকারি সমীক্ষা অনুযায়ী ১৭৭০ সালের মে মাস শেষ হবার আগেই জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ বিনষ্ট হয়। জুন মাসে মৃত্যু সংখ্যা হিসাব করে দেখা হয় যে, কৃষকসহ খাজনা প্রদানকারী জনসাধারণের অধিকাংশ ক্ষুধারজ্বালায় ধ্বংস হবে। বর্ষাকালে (জুলাই হতে অক্টোবর) জনশূন্যতা এতো প্রকট হয়ে উঠে যে, আতঙ্কগ্রস্ত সরকার পরিচালক সভার কাছে বিনষ্ট কৃষক ও ক্ষুদে উৎপাদকের (কারিগর) সংখ্যা সম্বন্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করে। (অসীম চট্টপাধ্যায় কর্তৃক এ্যানালগ অব রুরাল বেঙ্গল এর বঙ্গানুবাদ)।

এই দুর্ভিক্ষের সময়েও কিন্তু কোম্পানির রাজস্ব আয় কমেনি বরং বেড়েছে। বাংলা ও বিহারের তৎকালীন গবর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭১ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডাইরেক্টরদের কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠান। এতে তিনি উল্লেখ করেন যে, ‘প্রদেশের সমগ্র লোকসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের মৃত্যু এবং তার ফলে চাষের চরম অবনতি সত্ত্বেও ১৭৭১ সালের নীট রাজস্ব আদায় এমনকি ১৭৬৮ সালের রাজস্বের  চেয়ে বেশি হয়েছে।’ (পূর্বোক্ত, পরিশিষ্ট)।

এ থেকে অনুধাবন করা যায় কোম্পানির কর্মচারীরা কৃষক ও সাধারণ মানুষের উপর কী পরিমাণ নির্যাতন চালিয়েছে। শুধু কৃষক শ্রেণি নয়, তাতীসহ অন্যান্য শ্রেণির মানুষের উপর তাদের নির্যাতন ফিরাউনী নির্যাতনকে হার মানায়। কার্যত এ সময়ে কৃষকদের সাথে কারিগরদের একটি অংশ স্থায়ী বেকারে পরিণত হয়। অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে বনজঙ্গলে পালিয়ে যায়। রেজিনাল্ড রেনল্ডস এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন— ‘ঐ সময়ের মধ্যে ঢাকার বিখ্যাত মসলিনের এক তৃতীয়াংশ কারিগর ইংরেজ বণিকদের শোষণ-পীড়ণে অস্থির হয়ে বনে-জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিল।’ (শহিবস ইন ইন্ডিয়া)

এ বাস্তবতা এ দেশের সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়েছিল। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল তৎকালীন সময়ে ঘটে যাওয়া কৃষক বিদ্রোহে। এ বিদ্রোহ সন্ন্যাস ও ফকির বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

বৃঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ এ উপস্থাপিত সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ছিল কার্যত বাংলা ও বিহারের কৃষকদেরই বিদ্রোহ। বিহার ও বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ১৭৬৩ সাল থেকে প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এই বিদ্রোহ ছিল। একটি কেন্দ্রীভূত একক নেতৃত্ব, সংগঠন ও বাহিনীর উপর ভিত্তি করে পরিকল্পনা মাফিক এই বিদ্রোহ সংঘটিত হয়নি। বহু কেন্দ্রিক নেতৃত্ব ও সংগঠনের অধীনে এ বিদ্রোহ চলেছিল। এই বিদ্রোহের মূল শত্রু ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ব্যাপক গ্রামীণ কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষ বিভিন্নভাবে এ বিদ্রোহকে সহযোগিতা ও সমর্থন করেছিল। বাস্তবত এই বিদ্রোহী দলে ছিল মোঘল সাম্রাজ্যের বেকার ও ক্ষুধার্ত সৈন্যগণ, গৃহ ও ভূমিহারা কৃষক ও তাঁতিশ্রেণি এবং সন্ন্যাসী ও ফকির বাহিনী। তারা বিদ্রোহ করেছিলেন কৃষক ও তাঁতী হিসেবে কোম্পানির শোষণ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য এবং ফকির ও সন্ন্যাসী হিসেবে ধর্মানুষ্ঠান ও প্রচলিত অধিকারের উপর বিদেশী বেনিয়া শাসকদের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে। এই বিদ্রোহীরা সাধারণ সম্পত্তি লুট ও তাদের উপর যাতে অত্যাচার না হয় সেদিকে কঠোর দৃষ্টি রেখেছিলেন।

এই বিদ্রোহীরা কোন রকম সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াননি। অথচ ‘আনন্দমঠ’ ও উপস্থাপিত সন্ন্যাসী বিদ্রোহ বাস্তবতার বিকৃত ঘটনাপ্রবাহ। এই উপন্যাসে অষ্টাদশ শতাব্দীর ব্রিটিশ বিরোধী একটি ব্যাপক ও মহান গণঅভ্যুত্থানকে চিত্রিত করা হয়েছে ব্রিটিশ সমর্থক একটি হিন্দু সাম্প্রদায়িক অভ্যুত্থান হিসেবে। ‘আনন্দমঠ’ এর সন্তানেরা বিদ্রোহ করেছিল মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে। 

তাদের মৌল আদর্শ ও উদ্দেশ্য ছিল সনাতন ধর্ম তথা হিন্দু ধর্ম প্রতিষ্ঠা। তারা মুসলিম শাসকদেও বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পাশাপাশি অবাধে লুটতরাজ ও সাধারণ মানুষের উপর বিশেষ করে মুসলমানদের উপর নির্যাতন চালাতো। তারা মুসলমানদের মসজিদ ভেঙ্গে সেখানে গড়তে চেয়েছে হিন্দুদের দেবতা রাধা মাধবের মন্দির। ভগবান বিদ্বেষী মুসলমানদের নিধন করা ছিল তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য। মুসলিম রাজত্ব উচ্ছেদ করে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা করা ছিল তাদের মৌল অঙ্গীকার। কার্যত টিশ রাজভক্ত বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক মতাদর্শ হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধারণা ‘আনন্দমঠ’ এ প্রস্ফুটিত। এ উপন্যাসের শেষ পরিচ্ছদে বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ‘সত্যানন্দ ঠাকুর রণক্ষেত্র হইতে কাহাকে কিছু না বলিয়া আনন্দমঠে চলিয়া আসিলেন। সেখানে গভীর রাতে বিষ্ণু মণ্ডপে বসিয়া ধ্যানে প্রবৃত্ত। এমত সময়ে সেই চিকিৎসক সেখানে আসিয়া দেখা দিলেন। দেখিয়া সত্যানন্দ উঠিয়া প্রণাম করিলেন।’ চিকিৎসক বলিলেন, ‘সত্যানন্দ আজ মাঘী পূর্ণিমা।’

“সত্য— চলুন আমি পস্তুত। কিন্তু হে মহাত্মন এক সন্দেহভাজন করুন। আমি যে মুহূর্তে যুদ্ধে জয় করিয়া সনাতন ধর্ম নিষ্কণ্টক করিলাম সেই সময়ে আমার প্রতি এ প্রত্যাখ্যানের আদেশ কেন হইল?

সিদি আসিয়াছিলেন তিনি বললেন, ‘তোমার কার্য সিদ্ধ হইয়াছে। মুসলমান রাজ্য ধ্বংস হইয়াছে। আর তোমার এখন কোন কার্য নাই। অনর্থক প্রাণী হত্যার প্রয়োজন নাই। 

সত্য। মুসলমান রাজ্য ধ্বংস হইয়াছে। হিন্দু রাজ্য স্থাপিত হয় নাই— এখনও কলিকাতায় ইংরেজ প্রবল।

তিনি। হিন্দু রাজ্য এখন স্থাপিত হইবে না। তুমি থাকিলে অনর্থক নরহত্যা হইবে। অতএব চল।

শুনিয়া সত্যানন্দ তীব্র মর্মপীড়ায় কাতর হইলেন। বলিলেন হে প্রভু! যদি হিন্দু স্থাপিত হইবে না, তবে কে রাজা হইবে? আবারও কি মুসলমান রাজা হইবে?’

তিনি বলিলেন, ‘না এখন ইংরেজ রাজা হইবে।’… চিকিৎসক বলিলেন ইংরেজ রাজা না হইলে সনাতন ধর্মের পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা নাই।…

…সত্যানন্দ বলিলেন, ‘হে মহাত্মন, যদি ইংরেজকে রাজা করাই অভিপ্রায়, যদি এ সময়ে ইংরেজ রাজ্যই দেশের পক্ষে মঙ্গলকর তবে আমাদিগকে এই নৃশংস যুদ্ধ কার্যে কেন নিযুক্ত করিয়াছিলেন?’

মহাপুরুষ বলিলেন, ‘ইংরেজ এক্ষণে বণিক, অর্থ সংগ্রহের মন, রাজ্য শাসনের ভার লইতে চাহে না। এই সন্তান বিদ্রোহের কারণে তারা রাজ্য শাসনের ভার লইতে বাধ্য হইবে, কেননা রাজ্য শাসন ব্যতিত অর্থ সংগ্রহ হইবে না। ইংরেজ রাজ্য অভিষিক্ত হইবে বলিয়াই সন্তান বিদ্রোহ উপস্থিত হইয়াছে।’…

সুমিত সরকারের মতে ‘যে সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে ঘিরে আনন্দমঠ রচিত তার মূল লক্ষ্য ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। অথচ বঙ্কিম সচেতনভাবে তার মনোযোগ নিবন্ধ রেখেছেন মুর্শিদা নবাবের কুকীর্তিগুলোর ওপর, সিতি তখন কার্যত ব্রিটিশদের ক্রীড়নকে পরিণত। বঙ্কিম নিশ্চয় একই সঙ্গে ঘটা ফকির বিদ্রোহের খবরও রাখতেন। কিন্তু যে বিদ্রোহকে অবজ্ঞা করেছেন।’ (মডার্ন টাইমস, ২০১৫)। বস্তুত আনন্দমঠ এ ইতিহাসের তথ্যবিকৃতি বিস্তৃত।

অন্যদিকে ঐ সময়ে হিন্দু শিক্ষিত শ্রেণির একটি অংশের মানসিকতায় ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও বৈজ্ঞানিক চেতনার প্রভাবের কারণে প্রাচীন শাস্ত্রীয় অনুশাসন এবং হিন্দুধর্মের গোঁড়ামি ও রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে একটি আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। এই সংস্কারবাদী আন্দোলনের প্রিপ্রতীপ স্রোতে তে নব্য হিন্দু পুনরুত্থানবাদী আন্দোলনের লক্ষ্য হয়ে উঠে। এই হিন্দু পুনরুত্থানবাদী আন্দোলনের স্রোতে প্রবাহিত আনন্দ মাঠ এখানে রয়েছে ধর্মীয় রক্ষণশীলতা ও সাম্প্রদায়িকতা।

‘কমিউনালিজম অ্যান্ড কমিউনাল ভায়োলেন্স’ বইয়ে আসগার আলী ইঞ্জিনিয়ার মন্তব্য করেছেন ‘আর্থ-সামাজিক বা রাজনৈতিক ইহজাগতিক দাবিসমূহ নিছক কোন বিশেষ ধর্মমতে বিশ্ববাসী হওয়ার জন্য যখন সেই ধর্মীয় সম্প্রদায় উত্থাপন করতে থাকে তখনই তা সাম্প্রদায়িকতার মূল বিন্দু হয়ে উঠে। এর অভিব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের বা বহুবিচিত্র হতে পারে। কিন্তু বিচার্য হলো, ইহজাগতিক দাবিসমূহকে ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ভাষায় আবরিত করে উত্থাপন করা হচ্ছে কিনা। সাম্প্রদায়িকতার কেন্দ্রে ইহজাগতিকা, কিন্তু এর বহিরাবরণ ধর্মীয় আর এই বহিরাবরণ প্রায়শ আমাদের প্রতারিত করে। ‘আনন্দমঠ’ এই উপপাদ্যই প্রস্ফুটিত। আনন্দমঠ-এর সন্তানেরা একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় কিন্তু সেটা হিন্দু রাষ্ট্র কিন্তু সে রাষ্ট্রে মুসলমানদের কোনো ঠাঁই নেই। হিন্দু জাতীয়তাবাদই এখানে বক্তব্য। আনন্দমঠ-এর প্রথম খন্ডের দশম পরিচ্ছদে ভবানন্দ বলেন এ নেশাকোর নেড়েদের না তাড়াইলে আর কি হিন্দুর হিন্দুয়ানী থাকে?’ সত্যানন্দের বক্তব্য হলো কেবলমাত্র মুসলমানরা ভগবান বিদ্বেষী বলিয়া তাদের সবংশে নিপাত করিতে চাই।’ (দ্বিতীয় খন্ড, চতুর্থ পরিচ্ছদ)। আর সে কারণে সন্তান সম্প্রদায় গ্রামে গ্রামে চর পাঠাইতে লাগিল। চর গ্রামে গিয়া সেখানে হিন্দু দেখে বলেন, ভাই বিষ্ণু পূজা করবি? এই বলিয়া ২০/২৫ জন জড়ো করিয়া, মুসলমানের গ্রামে আসিয়া পড়িয়া মুসলমানদের ঘরে আগুন দেয়। মুসলমানরা প্রাণ রক্ষায় ব্যতিব্যস্ত হয়। সন্তানেরা তাদের সর্বস্ব লুট করিয়া নতুন বিষ্ণু ভক্তদিগকে বিতরণ করে। লুটের ভাগ পাইয়া গ্রাম্য লোকে প্রীত হইলে বিষ্ণু মন্দিরে আসিয়া বিগ্রহের পাদস্পর্শ করাইয়া তাহাদিগকে সন্তান করে। লোকে দেখিল, সন্তানত্বে বিলক্ষণ লাভ আছে।’ (প্রথম পরিচ্ছেদ, তৃতীয় খন্ড) সন্তানদের অনুপ্রেরণায় গ্রাম্য লোকের মুসলমান দেখিলেই তাড়াইয়া মারিতে যায়। কেহ কেহ সেই রাত্রে দলবদ্ধ হইয়া মুসলমান দিগের পাড়ায় গিয়ে তাহাদের ঘরে আগুন দিয়া সর্বস্ব লুটিয়া লইতে লাগিল।’ (প্রথম পরিচ্ছেদ, চতুর্থ খন্ড)

কার্যত ‘আনন্দমঠ’-এর সন্তানদের উপরোক্ত বক্তব্যসমূহের মধ্যদিয়ে বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ এবং মুসলিম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক মানসিকতা সূর্যালোকিত। ‘আনন্দমঠ’-এর সন্তানেরা মুসলমানদের পরাজিত করে দেশকে মুক্ত করে। যদিও ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠিত হয়। কারণ বঙ্কিমের মতে অধীনতার জোয়াল ব্রিটিশরা চাপায়নি, চাপিয়েছে মুসলমানরাই। বস্তুত তৎকালীন রক্ষণশীল উচ্চবর্ণের বাঙালি হিন্দুরা মনে করত তাদের প্রধান শত্রু দখলকারী ব্রিটিশরা নয়, মুসলমানরাই। তাই মুসলমানদের বিতারণ করা সন্তানদের দায়িত্ব। এই হিন্দুমনই ‘আনন্দমঠ’-এর মতাদর্শগত ভিত্তি।

‘আনন্দমঠ’ এ অঙ্কিত সন্ন্যাসী তথা সন্তানেরা মাতৃভূমি ছাড়া আর কাউকে মা বলে স্বীকার করে না। সমকালীন ভারত বর্ষের দুরাবস্থা বোঝানোর জন্য বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দেবী কালীর এক মৌলিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে দেবী কালী হলেন ভারতবর্ষের মর্যাদাহানির প্রতীক। ভবিষ্যৎ ভারতের মহত্বের বা গৌরবের উপলব্ধি হিসেবে বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায় দেবী দুর্গার ব্যাখ্যা করেন এই বলে যে, মাতৃভূমি দেবী দুর্গা বলে তখনই প্রতিভাত হবেন যখন তাঁর সমস্ত সন্তান তাকে মা বলে সম্বোধন করবে। এভাবে দেশ ও জাতীয়তাবাদের সাথে ধর্মের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। ‘আনন্দমঠ’-এর আর একটি সমস্যা হলো এর স্ববিরোধী বক্তব্য। এই উপন্যাসের প্রথম সংস্করণে বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের সৃষ্ট সন্তান সম্প্রদায় ব্রিটিশ বিরোধী যুদ্ধে সক্রিয় ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় সংস্করণে বিদ্রোহের নল ঘুরে যায়। সেখানে মুসলিম শাসন বিরোধী হিসেবে সন্তানেরা আবির্ভূত হয়। ‘আনন্দ মঠ’-এর তৃতীয় সংস্করণের আগে বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায় কোথাও বলেননি যে, ব্রিটিশ শাসন বিদ্রোহ এর মূল বক্তব্য নয়। শিশির কুমার দাশের মতে বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায় সরকারি কর্মচারী হওয়ায় anartisd in chains ছিলেন। ফলে সরকারি বিধি রক্ষার্থে উপন্যাসের বক্তব্যে এ ধরনের পরিবর্তন আসে। এটা যদি সত্যি হয় তা হলে এ ঘটনা বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের লেখক সত্ত্বার চারিত্রিক দৃঢ়তা প্রশ্নবিদ্ধ।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দুবাবু শ্রেণির মধ্যে যে, তথাকথিত নবজাগরণের ঢেউ আসে তার অন্যতম ফসল বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়। ঐ সময়ের হিন্দুবাবু শ্রেণির নবজাগরণের সমস্ত প্রধান নায়কেরা ছিলেন ব্রিটিশ শাসনের ভক্ত। কারণ ঐ সময়ের যে জমিদার ও মধ্যবিত্ত বাবু শ্রেণি নবজাগরণের নেতৃত্বে ছিলেন তাদের আর্থিক উন্নয়নের ভিত্তি ছিল জমিদার হিসেবে বা মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে কৃষক প্রজাদের উপর শোষণ এবং ব্রিটিশদের অধীনে চাকরি ও তাদের সাথে ব্যবসা। আর এসবের মৌল ভিত্তি ছিল ব্রিটিশ শাসন। সে কারণে বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায় ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আনুগত্য শিথিল করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ব্রিটিশ শাসনের প্রতি বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের আনুগত্য শুধু ‘আনন্দমঠ’ এ নয়  তার অন্যান্য লেখায়ও বর্তমান “ইংরেজ ভারতের পরমোপকারী।” (ভারতবর্ষ পরাধীন কেন?) ইংরেজ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিলোপের বিরোধিতা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “যেদিন ইংরেজদের অমঙ্গলাকাঙ্খী হইব, সমাজের অমঙ্গলাকাঙ্খী হইব সেই দিন এই পরামর্শ দিব।”  অর্থাৎ ইংরেজদের মঙ্গল চান বলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিলোপ চান না।

অন্যদিকে ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের উপক্রমনিকায় লেখা হয়েছে— “সমাজ বিপ্লব সব সময় আত্মপীড়ন মাত্র। ‘বিদ্রোহীরা আত্মঘাতী।’ অথচ ‘আনন্দমঠ’-এর সন্তানেরা বিদ্রোহ করেছে। কি অদ্ভুত স্ববিরোধিতা।

আনন্দমঠ লিখেছেন বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ১৮৮২ সালে

‘আনন্দ মঠ’ উপন্যাসে দেখা যায় ‘মায়ের সন্তানেরা’ মুসলিম শাসকের বিরোধিতার পাশাপাশি ব্রিটিশ শাসনেরও বিরোধিতা করেছে। তারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করেছে। এ প্রসঙ্গে উপন্যাসে মন্তব্য করা হয়েছে  ইংরেজ যে ভারতের উদ্ধার সাধনের জন্য আসিয়াছিল, সন্তানরা তাহা বুঝে নাই।’ কিন্তু বিদ্রোহ মতাদর্শগত নেতা সত্যানন্দের গুরু এসে তাদের ভুল ভাঙিয়েছে এবং তার যথার্থ অর্থে সচেতন হয়ে ইংরেজ বিরোধিতা হতে নিবৃত্ত হয়েছে। অর্থাৎ বিদ্রোহের সন্তানেরা তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন নন।

‘আনন্দমঠ’-এ যে সন্তানদের কার্যক্রম উপস্থাপন করা হয়েছে তার সঙ্গে ইতিহাসের সন্ন্যাসীদের কোনো মিল পাওয়া দুস্কর। সন্ন্যাসীদের যে জীবনধারা, আদর্শ, চরিত্র ও স্বদেশ প্রেমের বর্ণনা দেয়া হয়েছে তারও কোনো বাস্তবভিত্তি নেই। উপন্যাসটি লেখার সময় যদি ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহের প্রতি দৃষ্টি রাখা হতো তাহলে কাহিনীর পটভূমি বীরভূম না হয়ে উত্তরবঙ্গ বা পূর্ববঙ্গ হতো। কারণ সেখানেই বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছিল।

এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ‘আনন্দমঠ’ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে মন্তব্য করেছে The general mortal of the Ananda Math, then is that British rule and British education are to be accepted as the only alternative to mussulman oppression.” 

শেয়ার করুন

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

আনন্দমঠ উপন্যাস রিভিউ এবং বঙ্কিম মানস

প্রকাশ: ১২:১১:১২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ নভেম্বর ২০২১

ইতিহাস ও উপন্যাস ভিন্ন ভিন্ন গোত্র ও চরিত্রের। এদের বিষয়বস্তু এক হলেও গঠন প্রকৃতি আলাদা। একজন ঔপন্যাসিক তার লেখায় যে মাত্রায় স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেন একজন ইতিহাসবিদ সেটা পারেন না। সে কারণে কেউ ইতিহাস পড়তে গিয়ে উপন্যাসের স্বাদ গ্রহণ করতে আগ্রহী নন। অন্যদিকে উপন্যাস পড়তে গিয়ে ইতিহাসের তথ্যের বাস্তব জমিনে পা রাখতে অনিচ্ছুক। কিন্তু ইতিহাস প্রদত্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে উপন্যাস লেখা যায়। সেখানে ইতিহাসের বাস্তবতাকে সাহিত্যের বাস্তবতায় রূপান্তর করে ইতিহাসের বাস্তবতা পুনঃনির্মিত হয়। এক্ষেত্রে ইতিহাসের তথ্যকে শুধু ব্যবহার করা হয় কিংবা শিল্পের আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করা হয়। কিন্তু ইতিহাসের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে রচিত উপন্যাসে ঐতিহাসিক তথ্যের বিকৃতি ঘটানো কাম্য নয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’ এ কার্যত সেটাই ঘটেছে। সেখানে ঐতিহাসিক বাস্তবতার বিকৃতি ঘটানো হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৮২ সালে ‘আনন্দমঠ’ রচনা করেন।

অন্যদিকে উপন্যাসে ঔপন্যাসিকের মতাদর্শ সক্রিয় থাকে। উপন্যাসের বিষয়বস্তু নির্মাণে এই মতাদর্শ ও বাস্তবতার রাসায়নিক মিশ্রণ ঘটে থাকে। কিন্তু সেই মতাদর্শের প্রতিফলন শিল্পের শর্তকে লঙ্গন করে নয়। অর্থাৎ শৈল্পিকভাবেই লেখকের মতাদর্শ উপন্যাসে উপস্থিত থাকে। লেখক জীবন ও জগতকে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে এবং কোন অবস্থান থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন বাস্তবতাকে বিশ্লেষণ ও উপস্থাপন করেছেন সেটা উপন্যাসে প্রস্ফুটিত হয়। ‘আনন্দমঠ’ এ বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের কোনো মতাদর্শ প্রস্ফুটিত? ‘আনন্দমঠ’ পর্যালোচনায় এ উপপাদ্য প্রস্ফুটিত যে, হিন্দুমন বা হিন্দু জাতীয়তাবাদ এবং মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ‘আনন্দমঠ’ এর মৌল মতাদর্শিক ভিত্তি। একজন লেখকের মতাদর্শ হিসেবে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে লালন করাটা কোনো দোষের বিষয় নয়, কিন্তু সেটা যখন সাম্প্রদায়িকতার রূপ ধারণ করে তখনই সেটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ‘আনন্দমঠ’-এর হিন্দু জাতীয়তাবাদ-এর ক্ষেত্রে এ ঘটনাই ঘটেছে।

আনন্দমঠ লিখেছেন বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ১৮৮২ সালে

‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৮০-১৯৮১ সালে মাসিক ‘বঙ্গ দর্শন’ সাময়িকীতে এবং বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৮৮২ সালে। সে সময় ভারতীয় উপমহাদেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা ছিল বিদ্রোহ ও অস্থিরতায় আক্রান্ত। তৎকালীন বড়লাট লর্ড লিটনের কৃষি সচিব অ্যালান হিউস পর্যন্ত স্বীকার করেছেন যে, ভারত উপমহাদেশের সামগ্রিক বাস্তবতা এক ভয়ঙ্কর অভ্যুত্থানের মুখোমুখি। সমগ্র ভারতবর্ষ ছিল একটা জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। যে-কোনো মুহূর্তে এটা বিস্ফোরিত হতে পারে। দেশের বেশিরভাগ নিম্নবর্গের মানুষ প্রচলিত ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল এবং ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য সশস্ত্র অভ্যুত্থানের বিষয়ে ভাবতে শুরু করেছিল। অনেক স্থানে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। এই সময়ের পরিধিতে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। একটি হলো মনন্তর এবং অপরটি হলো ফকির ও সন্ন্যাস বিদ্রোহ। তৎকালীন সময়ের অগ্নিগর্ভ পরিবেশ ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি লেখা হয়। এখানে ছিয়াত্তরের মনন্তরের প্রেক্ষাপটে সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে উপস্থাপন করা হয়েছে।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ সালে পলাশীযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলার শাসন ক্ষমতা দখল করে। প্রথমে নিজেরা শাসন ক্ষমতা হাতে নেয়নি। প্রথমে তারা পুতুল নবাব মসনদে বসায়। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে রেখে দেয়। ব্রিটিশ বেনিয়া গোষ্ঠী ১৭৬৫ সালের ১২ আগস্ট দিল্লির সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলার দেওয়ানী বা রাজস্ব আদায়ের আনুষ্ঠানিক ফরমান আদায় করেন। এর ফলে এখানে দ্বৈত কর্তৃত্বের সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক ক্ষমতা নবাবের নিকট আর আর্থিক ক্ষমতা বা রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা কোম্পানির হাতে এসে যায়।

কোম্পানি রাজস্ব আদায়ের জন্য প্রচলিত ব্যবস্থা বাতিল করে নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। ঐ সময়ে শাসকরা সমগ্র গ্রাম সমাজের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করত, কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে রাজস্ব নেওয়া হতো না। কিন্তু কোম্পানি রাজস্ব সংগ্রহের ক্ষমতা হাতে পাওয়ার পর ভূমি ও কর ব্যবস্থা সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে ফেলে। তারা গ্রাম সমাজের পরিবর্তে কৃষকের কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে এবং উৎপন্ন ফসলের পরিবর্তে মুদ্রার মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা চালু করে। পাশাপাশি কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করে তার একটি অংশ কোম্পানির কোষাগারে জমা দেওয়ার জন্য নতুন মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির জন্ম দেয়। এদেরকে বলা হতো জমিদার। আবার এই জমিদারদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের আরেকটি নতুন স্তর সৃষ্টি করা হয় তাদেরকে বলা হয় নাজিম। এ প্রসঙ্গে বাংলা ও বিহারের রাজস্ব কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ১৭৭২ সালের ৩ নভেম্বর ইংল্যান্ডে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বোর্ড অব ডাইরেক্টরসকে লেখা এক চিঠিতে বলেন, ‘নাসিমরা জমিদার ও কৃষকদের কাছ থেকে যত বেশি পারে কর আদায় করে নিচ্ছে জমিদাররাও নাসিমদের কাছ থেকে চাষিদের লুণ্ঠন করার অবাধ অধিকার লাভ করেছে। নাসিমরা আবার তাদের সকলের (জমিদার ও কৃষকদের) সর্বস্ব কেড়ে নেয়ার রাজকীয় বিশেষ অধিকারের বলে দেশের ধন-সম্পদ লুট করে সম্পদের অধিকারী হয়েছে।’ (সুপ্রকাশ রায় : ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম।)

ব্রিটিশ বেনিয়া গোষ্ঠী বেশি পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের জন্য রাজস্বের হার বৃদ্ধি করে। খাজনার টাকা যোগাড় করতে গিয়ে কৃষক তার উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এই সুযোগে ইংরেজ ব্যবসায়ীরা কম দামে চাল ক্রয় করে মজুত করতে থাকে। পরে সুযোগ খুঁজে সেই চাল বেশি দামে বিক্রয় করত। কিন্তু চড়াদামে চাল কেনা সম্ভব ছিল না। ফলে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ১১৭৬ সালে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হন বাংলা-বিবাহের জনগণ। এ দুর্ভিক্ষ ছিয়াত্তরের মনন্তর নামে খ্যাত। তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এর হিসাব অনুযায়ী দুর্ভিক্ষের কারণে এক কোটি পঞ্চাশ লাখ লোক মারা গিয়েছিল। এই দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে ইংরেজ লেখক ইয়ং হাসবেন্ড লিখেছেন— “তাদের (ইংরেজ বণিকদের) মুনাফা শিকারের পরবর্তী উপায় হলো চাল কিনে গুদামজাত করে রাখা। তারা নিশ্চিত ছিল যে, জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য এই দ্রব্যটির জন্য তারা যে দাম চাইবে, তাই তারা পাবে।… দেশে যা কিছু খাদ্য ছিল তা (ইংরেজ বণিকদের) একচেটিয়া দখলে চলে গেল। খাদ্যের পরিমাণ যত কমতে লাগল, ততোই দাম বাড়তে লাগল। শ্রমজীবী দরিদ্র জনগণের চির দুঃসময় জীবনের ওপর পতিত হলো এই পুঞ্জিভূত দুর্যোগের প্রথম আঘাত।

ছিয়াত্তরের মন্বন্তর সম্পর্কে উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন— ‘১৭৬৯ সালের শীতকালে বাংলায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। যার জের দুই পুরুষ ধরে চলে।১৭৭০ সালের গ্রীষ্মকালজুড়ে গণমড়ক অব্যাহত থাকে। কৃষকরা গবাদিপশু বিক্রি করে দেয়। বিক্রি করে কৃষি কাজের যন্ত্রপাতি, তারা বীজ ধান খেয়ে ফেলে, নিজেদের ছেলেমেয়েদের তারা বিক্রি করতে থাকে এবং তারপরও তার কোন ক্রেতা পাওয়া যায় না। তারা গাছের পাতা, ক্ষেতের ঘাস খেতে থাকে এবং ১৭৭০ সালের জুন মাসে দরবারের আবাসিক প্রতিনিধি শব ভক্ষণের সত্যতা স্বীকার করেন। সরকারি সমীক্ষা অনুযায়ী ১৭৭০ সালের মে মাস শেষ হবার আগেই জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ বিনষ্ট হয়। জুন মাসে মৃত্যু সংখ্যা হিসাব করে দেখা হয় যে, কৃষকসহ খাজনা প্রদানকারী জনসাধারণের অধিকাংশ ক্ষুধারজ্বালায় ধ্বংস হবে। বর্ষাকালে (জুলাই হতে অক্টোবর) জনশূন্যতা এতো প্রকট হয়ে উঠে যে, আতঙ্কগ্রস্ত সরকার পরিচালক সভার কাছে বিনষ্ট কৃষক ও ক্ষুদে উৎপাদকের (কারিগর) সংখ্যা সম্বন্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করে। (অসীম চট্টপাধ্যায় কর্তৃক এ্যানালগ অব রুরাল বেঙ্গল এর বঙ্গানুবাদ)।

এই দুর্ভিক্ষের সময়েও কিন্তু কোম্পানির রাজস্ব আয় কমেনি বরং বেড়েছে। বাংলা ও বিহারের তৎকালীন গবর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭১ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডাইরেক্টরদের কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠান। এতে তিনি উল্লেখ করেন যে, ‘প্রদেশের সমগ্র লোকসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের মৃত্যু এবং তার ফলে চাষের চরম অবনতি সত্ত্বেও ১৭৭১ সালের নীট রাজস্ব আদায় এমনকি ১৭৬৮ সালের রাজস্বের  চেয়ে বেশি হয়েছে।’ (পূর্বোক্ত, পরিশিষ্ট)।

এ থেকে অনুধাবন করা যায় কোম্পানির কর্মচারীরা কৃষক ও সাধারণ মানুষের উপর কী পরিমাণ নির্যাতন চালিয়েছে। শুধু কৃষক শ্রেণি নয়, তাতীসহ অন্যান্য শ্রেণির মানুষের উপর তাদের নির্যাতন ফিরাউনী নির্যাতনকে হার মানায়। কার্যত এ সময়ে কৃষকদের সাথে কারিগরদের একটি অংশ স্থায়ী বেকারে পরিণত হয়। অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে বনজঙ্গলে পালিয়ে যায়। রেজিনাল্ড রেনল্ডস এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন— ‘ঐ সময়ের মধ্যে ঢাকার বিখ্যাত মসলিনের এক তৃতীয়াংশ কারিগর ইংরেজ বণিকদের শোষণ-পীড়ণে অস্থির হয়ে বনে-জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিল।’ (শহিবস ইন ইন্ডিয়া)

এ বাস্তবতা এ দেশের সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়েছিল। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল তৎকালীন সময়ে ঘটে যাওয়া কৃষক বিদ্রোহে। এ বিদ্রোহ সন্ন্যাস ও ফকির বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

বৃঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ এ উপস্থাপিত সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ছিল কার্যত বাংলা ও বিহারের কৃষকদেরই বিদ্রোহ। বিহার ও বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ১৭৬৩ সাল থেকে প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এই বিদ্রোহ ছিল। একটি কেন্দ্রীভূত একক নেতৃত্ব, সংগঠন ও বাহিনীর উপর ভিত্তি করে পরিকল্পনা মাফিক এই বিদ্রোহ সংঘটিত হয়নি। বহু কেন্দ্রিক নেতৃত্ব ও সংগঠনের অধীনে এ বিদ্রোহ চলেছিল। এই বিদ্রোহের মূল শত্রু ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ব্যাপক গ্রামীণ কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষ বিভিন্নভাবে এ বিদ্রোহকে সহযোগিতা ও সমর্থন করেছিল। বাস্তবত এই বিদ্রোহী দলে ছিল মোঘল সাম্রাজ্যের বেকার ও ক্ষুধার্ত সৈন্যগণ, গৃহ ও ভূমিহারা কৃষক ও তাঁতিশ্রেণি এবং সন্ন্যাসী ও ফকির বাহিনী। তারা বিদ্রোহ করেছিলেন কৃষক ও তাঁতী হিসেবে কোম্পানির শোষণ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য এবং ফকির ও সন্ন্যাসী হিসেবে ধর্মানুষ্ঠান ও প্রচলিত অধিকারের উপর বিদেশী বেনিয়া শাসকদের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে। এই বিদ্রোহীরা সাধারণ সম্পত্তি লুট ও তাদের উপর যাতে অত্যাচার না হয় সেদিকে কঠোর দৃষ্টি রেখেছিলেন।

এই বিদ্রোহীরা কোন রকম সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াননি। অথচ ‘আনন্দমঠ’ ও উপস্থাপিত সন্ন্যাসী বিদ্রোহ বাস্তবতার বিকৃত ঘটনাপ্রবাহ। এই উপন্যাসে অষ্টাদশ শতাব্দীর ব্রিটিশ বিরোধী একটি ব্যাপক ও মহান গণঅভ্যুত্থানকে চিত্রিত করা হয়েছে ব্রিটিশ সমর্থক একটি হিন্দু সাম্প্রদায়িক অভ্যুত্থান হিসেবে। ‘আনন্দমঠ’ এর সন্তানেরা বিদ্রোহ করেছিল মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে। 

তাদের মৌল আদর্শ ও উদ্দেশ্য ছিল সনাতন ধর্ম তথা হিন্দু ধর্ম প্রতিষ্ঠা। তারা মুসলিম শাসকদেও বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পাশাপাশি অবাধে লুটতরাজ ও সাধারণ মানুষের উপর বিশেষ করে মুসলমানদের উপর নির্যাতন চালাতো। তারা মুসলমানদের মসজিদ ভেঙ্গে সেখানে গড়তে চেয়েছে হিন্দুদের দেবতা রাধা মাধবের মন্দির। ভগবান বিদ্বেষী মুসলমানদের নিধন করা ছিল তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য। মুসলিম রাজত্ব উচ্ছেদ করে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা করা ছিল তাদের মৌল অঙ্গীকার। কার্যত টিশ রাজভক্ত বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক মতাদর্শ হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধারণা ‘আনন্দমঠ’ এ প্রস্ফুটিত। এ উপন্যাসের শেষ পরিচ্ছদে বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ‘সত্যানন্দ ঠাকুর রণক্ষেত্র হইতে কাহাকে কিছু না বলিয়া আনন্দমঠে চলিয়া আসিলেন। সেখানে গভীর রাতে বিষ্ণু মণ্ডপে বসিয়া ধ্যানে প্রবৃত্ত। এমত সময়ে সেই চিকিৎসক সেখানে আসিয়া দেখা দিলেন। দেখিয়া সত্যানন্দ উঠিয়া প্রণাম করিলেন।’ চিকিৎসক বলিলেন, ‘সত্যানন্দ আজ মাঘী পূর্ণিমা।’

“সত্য— চলুন আমি পস্তুত। কিন্তু হে মহাত্মন এক সন্দেহভাজন করুন। আমি যে মুহূর্তে যুদ্ধে জয় করিয়া সনাতন ধর্ম নিষ্কণ্টক করিলাম সেই সময়ে আমার প্রতি এ প্রত্যাখ্যানের আদেশ কেন হইল?

সিদি আসিয়াছিলেন তিনি বললেন, ‘তোমার কার্য সিদ্ধ হইয়াছে। মুসলমান রাজ্য ধ্বংস হইয়াছে। আর তোমার এখন কোন কার্য নাই। অনর্থক প্রাণী হত্যার প্রয়োজন নাই। 

সত্য। মুসলমান রাজ্য ধ্বংস হইয়াছে। হিন্দু রাজ্য স্থাপিত হয় নাই— এখনও কলিকাতায় ইংরেজ প্রবল।

তিনি। হিন্দু রাজ্য এখন স্থাপিত হইবে না। তুমি থাকিলে অনর্থক নরহত্যা হইবে। অতএব চল।

শুনিয়া সত্যানন্দ তীব্র মর্মপীড়ায় কাতর হইলেন। বলিলেন হে প্রভু! যদি হিন্দু স্থাপিত হইবে না, তবে কে রাজা হইবে? আবারও কি মুসলমান রাজা হইবে?’

তিনি বলিলেন, ‘না এখন ইংরেজ রাজা হইবে।’… চিকিৎসক বলিলেন ইংরেজ রাজা না হইলে সনাতন ধর্মের পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা নাই।…

…সত্যানন্দ বলিলেন, ‘হে মহাত্মন, যদি ইংরেজকে রাজা করাই অভিপ্রায়, যদি এ সময়ে ইংরেজ রাজ্যই দেশের পক্ষে মঙ্গলকর তবে আমাদিগকে এই নৃশংস যুদ্ধ কার্যে কেন নিযুক্ত করিয়াছিলেন?’

মহাপুরুষ বলিলেন, ‘ইংরেজ এক্ষণে বণিক, অর্থ সংগ্রহের মন, রাজ্য শাসনের ভার লইতে চাহে না। এই সন্তান বিদ্রোহের কারণে তারা রাজ্য শাসনের ভার লইতে বাধ্য হইবে, কেননা রাজ্য শাসন ব্যতিত অর্থ সংগ্রহ হইবে না। ইংরেজ রাজ্য অভিষিক্ত হইবে বলিয়াই সন্তান বিদ্রোহ উপস্থিত হইয়াছে।’…

সুমিত সরকারের মতে ‘যে সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে ঘিরে আনন্দমঠ রচিত তার মূল লক্ষ্য ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। অথচ বঙ্কিম সচেতনভাবে তার মনোযোগ নিবন্ধ রেখেছেন মুর্শিদা নবাবের কুকীর্তিগুলোর ওপর, সিতি তখন কার্যত ব্রিটিশদের ক্রীড়নকে পরিণত। বঙ্কিম নিশ্চয় একই সঙ্গে ঘটা ফকির বিদ্রোহের খবরও রাখতেন। কিন্তু যে বিদ্রোহকে অবজ্ঞা করেছেন।’ (মডার্ন টাইমস, ২০১৫)। বস্তুত আনন্দমঠ এ ইতিহাসের তথ্যবিকৃতি বিস্তৃত।

অন্যদিকে ঐ সময়ে হিন্দু শিক্ষিত শ্রেণির একটি অংশের মানসিকতায় ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও বৈজ্ঞানিক চেতনার প্রভাবের কারণে প্রাচীন শাস্ত্রীয় অনুশাসন এবং হিন্দুধর্মের গোঁড়ামি ও রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে একটি আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। এই সংস্কারবাদী আন্দোলনের প্রিপ্রতীপ স্রোতে তে নব্য হিন্দু পুনরুত্থানবাদী আন্দোলনের লক্ষ্য হয়ে উঠে। এই হিন্দু পুনরুত্থানবাদী আন্দোলনের স্রোতে প্রবাহিত আনন্দ মাঠ এখানে রয়েছে ধর্মীয় রক্ষণশীলতা ও সাম্প্রদায়িকতা।

‘কমিউনালিজম অ্যান্ড কমিউনাল ভায়োলেন্স’ বইয়ে আসগার আলী ইঞ্জিনিয়ার মন্তব্য করেছেন ‘আর্থ-সামাজিক বা রাজনৈতিক ইহজাগতিক দাবিসমূহ নিছক কোন বিশেষ ধর্মমতে বিশ্ববাসী হওয়ার জন্য যখন সেই ধর্মীয় সম্প্রদায় উত্থাপন করতে থাকে তখনই তা সাম্প্রদায়িকতার মূল বিন্দু হয়ে উঠে। এর অভিব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের বা বহুবিচিত্র হতে পারে। কিন্তু বিচার্য হলো, ইহজাগতিক দাবিসমূহকে ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ভাষায় আবরিত করে উত্থাপন করা হচ্ছে কিনা। সাম্প্রদায়িকতার কেন্দ্রে ইহজাগতিকা, কিন্তু এর বহিরাবরণ ধর্মীয় আর এই বহিরাবরণ প্রায়শ আমাদের প্রতারিত করে। ‘আনন্দমঠ’ এই উপপাদ্যই প্রস্ফুটিত। আনন্দমঠ-এর সন্তানেরা একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় কিন্তু সেটা হিন্দু রাষ্ট্র কিন্তু সে রাষ্ট্রে মুসলমানদের কোনো ঠাঁই নেই। হিন্দু জাতীয়তাবাদই এখানে বক্তব্য। আনন্দমঠ-এর প্রথম খন্ডের দশম পরিচ্ছদে ভবানন্দ বলেন এ নেশাকোর নেড়েদের না তাড়াইলে আর কি হিন্দুর হিন্দুয়ানী থাকে?’ সত্যানন্দের বক্তব্য হলো কেবলমাত্র মুসলমানরা ভগবান বিদ্বেষী বলিয়া তাদের সবংশে নিপাত করিতে চাই।’ (দ্বিতীয় খন্ড, চতুর্থ পরিচ্ছদ)। আর সে কারণে সন্তান সম্প্রদায় গ্রামে গ্রামে চর পাঠাইতে লাগিল। চর গ্রামে গিয়া সেখানে হিন্দু দেখে বলেন, ভাই বিষ্ণু পূজা করবি? এই বলিয়া ২০/২৫ জন জড়ো করিয়া, মুসলমানের গ্রামে আসিয়া পড়িয়া মুসলমানদের ঘরে আগুন দেয়। মুসলমানরা প্রাণ রক্ষায় ব্যতিব্যস্ত হয়। সন্তানেরা তাদের সর্বস্ব লুট করিয়া নতুন বিষ্ণু ভক্তদিগকে বিতরণ করে। লুটের ভাগ পাইয়া গ্রাম্য লোকে প্রীত হইলে বিষ্ণু মন্দিরে আসিয়া বিগ্রহের পাদস্পর্শ করাইয়া তাহাদিগকে সন্তান করে। লোকে দেখিল, সন্তানত্বে বিলক্ষণ লাভ আছে।’ (প্রথম পরিচ্ছেদ, তৃতীয় খন্ড) সন্তানদের অনুপ্রেরণায় গ্রাম্য লোকের মুসলমান দেখিলেই তাড়াইয়া মারিতে যায়। কেহ কেহ সেই রাত্রে দলবদ্ধ হইয়া মুসলমান দিগের পাড়ায় গিয়ে তাহাদের ঘরে আগুন দিয়া সর্বস্ব লুটিয়া লইতে লাগিল।’ (প্রথম পরিচ্ছেদ, চতুর্থ খন্ড)

কার্যত ‘আনন্দমঠ’-এর সন্তানদের উপরোক্ত বক্তব্যসমূহের মধ্যদিয়ে বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ এবং মুসলিম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক মানসিকতা সূর্যালোকিত। ‘আনন্দমঠ’-এর সন্তানেরা মুসলমানদের পরাজিত করে দেশকে মুক্ত করে। যদিও ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠিত হয়। কারণ বঙ্কিমের মতে অধীনতার জোয়াল ব্রিটিশরা চাপায়নি, চাপিয়েছে মুসলমানরাই। বস্তুত তৎকালীন রক্ষণশীল উচ্চবর্ণের বাঙালি হিন্দুরা মনে করত তাদের প্রধান শত্রু দখলকারী ব্রিটিশরা নয়, মুসলমানরাই। তাই মুসলমানদের বিতারণ করা সন্তানদের দায়িত্ব। এই হিন্দুমনই ‘আনন্দমঠ’-এর মতাদর্শগত ভিত্তি।

‘আনন্দমঠ’ এ অঙ্কিত সন্ন্যাসী তথা সন্তানেরা মাতৃভূমি ছাড়া আর কাউকে মা বলে স্বীকার করে না। সমকালীন ভারত বর্ষের দুরাবস্থা বোঝানোর জন্য বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দেবী কালীর এক মৌলিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে দেবী কালী হলেন ভারতবর্ষের মর্যাদাহানির প্রতীক। ভবিষ্যৎ ভারতের মহত্বের বা গৌরবের উপলব্ধি হিসেবে বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায় দেবী দুর্গার ব্যাখ্যা করেন এই বলে যে, মাতৃভূমি দেবী দুর্গা বলে তখনই প্রতিভাত হবেন যখন তাঁর সমস্ত সন্তান তাকে মা বলে সম্বোধন করবে। এভাবে দেশ ও জাতীয়তাবাদের সাথে ধর্মের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। ‘আনন্দমঠ’-এর আর একটি সমস্যা হলো এর স্ববিরোধী বক্তব্য। এই উপন্যাসের প্রথম সংস্করণে বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের সৃষ্ট সন্তান সম্প্রদায় ব্রিটিশ বিরোধী যুদ্ধে সক্রিয় ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় সংস্করণে বিদ্রোহের নল ঘুরে যায়। সেখানে মুসলিম শাসন বিরোধী হিসেবে সন্তানেরা আবির্ভূত হয়। ‘আনন্দ মঠ’-এর তৃতীয় সংস্করণের আগে বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায় কোথাও বলেননি যে, ব্রিটিশ শাসন বিদ্রোহ এর মূল বক্তব্য নয়। শিশির কুমার দাশের মতে বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায় সরকারি কর্মচারী হওয়ায় anartisd in chains ছিলেন। ফলে সরকারি বিধি রক্ষার্থে উপন্যাসের বক্তব্যে এ ধরনের পরিবর্তন আসে। এটা যদি সত্যি হয় তা হলে এ ঘটনা বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের লেখক সত্ত্বার চারিত্রিক দৃঢ়তা প্রশ্নবিদ্ধ।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দুবাবু শ্রেণির মধ্যে যে, তথাকথিত নবজাগরণের ঢেউ আসে তার অন্যতম ফসল বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়। ঐ সময়ের হিন্দুবাবু শ্রেণির নবজাগরণের সমস্ত প্রধান নায়কেরা ছিলেন ব্রিটিশ শাসনের ভক্ত। কারণ ঐ সময়ের যে জমিদার ও মধ্যবিত্ত বাবু শ্রেণি নবজাগরণের নেতৃত্বে ছিলেন তাদের আর্থিক উন্নয়নের ভিত্তি ছিল জমিদার হিসেবে বা মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে কৃষক প্রজাদের উপর শোষণ এবং ব্রিটিশদের অধীনে চাকরি ও তাদের সাথে ব্যবসা। আর এসবের মৌল ভিত্তি ছিল ব্রিটিশ শাসন। সে কারণে বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায় ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আনুগত্য শিথিল করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ব্রিটিশ শাসনের প্রতি বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের আনুগত্য শুধু ‘আনন্দমঠ’ এ নয়  তার অন্যান্য লেখায়ও বর্তমান “ইংরেজ ভারতের পরমোপকারী।” (ভারতবর্ষ পরাধীন কেন?) ইংরেজ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিলোপের বিরোধিতা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “যেদিন ইংরেজদের অমঙ্গলাকাঙ্খী হইব, সমাজের অমঙ্গলাকাঙ্খী হইব সেই দিন এই পরামর্শ দিব।”  অর্থাৎ ইংরেজদের মঙ্গল চান বলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিলোপ চান না।

অন্যদিকে ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের উপক্রমনিকায় লেখা হয়েছে— “সমাজ বিপ্লব সব সময় আত্মপীড়ন মাত্র। ‘বিদ্রোহীরা আত্মঘাতী।’ অথচ ‘আনন্দমঠ’-এর সন্তানেরা বিদ্রোহ করেছে। কি অদ্ভুত স্ববিরোধিতা।

আনন্দমঠ লিখেছেন বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ১৮৮২ সালে

‘আনন্দ মঠ’ উপন্যাসে দেখা যায় ‘মায়ের সন্তানেরা’ মুসলিম শাসকের বিরোধিতার পাশাপাশি ব্রিটিশ শাসনেরও বিরোধিতা করেছে। তারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করেছে। এ প্রসঙ্গে উপন্যাসে মন্তব্য করা হয়েছে  ইংরেজ যে ভারতের উদ্ধার সাধনের জন্য আসিয়াছিল, সন্তানরা তাহা বুঝে নাই।’ কিন্তু বিদ্রোহ মতাদর্শগত নেতা সত্যানন্দের গুরু এসে তাদের ভুল ভাঙিয়েছে এবং তার যথার্থ অর্থে সচেতন হয়ে ইংরেজ বিরোধিতা হতে নিবৃত্ত হয়েছে। অর্থাৎ বিদ্রোহের সন্তানেরা তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন নন।

‘আনন্দমঠ’-এ যে সন্তানদের কার্যক্রম উপস্থাপন করা হয়েছে তার সঙ্গে ইতিহাসের সন্ন্যাসীদের কোনো মিল পাওয়া দুস্কর। সন্ন্যাসীদের যে জীবনধারা, আদর্শ, চরিত্র ও স্বদেশ প্রেমের বর্ণনা দেয়া হয়েছে তারও কোনো বাস্তবভিত্তি নেই। উপন্যাসটি লেখার সময় যদি ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহের প্রতি দৃষ্টি রাখা হতো তাহলে কাহিনীর পটভূমি বীরভূম না হয়ে উত্তরবঙ্গ বা পূর্ববঙ্গ হতো। কারণ সেখানেই বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছিল।

এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ‘আনন্দমঠ’ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে মন্তব্য করেছে The general mortal of the Ananda Math, then is that British rule and British education are to be accepted as the only alternative to mussulman oppression.”