১২:৩৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

নাটক রিভিউ: জমিদার দর্পণ

ইনামুল করিম
  • প্রকাশ: ০৩:০১:৪৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২১
  • / ১২৬২৯ বার পড়া হয়েছে

জমিদার দর্পণ নাটক ১৮৭৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়

মীর মশাররফ হোসেন রচিত ‘জমিদার দর্পণ’ নাটকের আলোচনা করতে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মন্তব্য করেন, “বঙ্গ দর্শনের জন্মাবধি এই পত্র প্রজার হিতৈষী এবং প্রজার হিত কামনা আমরা কখনো ত্যাগ করিব না। কিন্তু আমরা পাবনা জিলার প্রজাদিগের আচরণ শুনিয়া বিরক্ত ও বিষদযুক্ত হইয়াছি। জ্বলন্ত অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেওয়া নিষ্প্রয়োজন। আমরা পরামর্শ দিই যে, গ্রন্থাকারের এসময়ে এ গ্রন্থ বিক্রয় ও বিতরণ বন্ধ করা কর্তব্য।”

বঙ্কিমচন্দ্রের বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, ‘জমিদার দর্পণ’ নাটকটি ঐ সময়ে সাধারণ প্রজাদের মানসিকতায় প্রভাব ফেলেছিল। এ প্রভাবের ফলে প্রজারা জমিদারদের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেচিল। প্রজাদের মানসিকতায় প্রভাব ফেলার কারণ কী?

কারণ হলো ‘জমিদার দর্পণ’ এর বক্তব্যে তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা প্রস্ফুটিত হয়েছে। বস্তুত ‘জমিদার দর্পণ’ বৃটিশ শাসক শ্রেণি কর্তৃক প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত তথা জমিদারি ব্যবস্থার বাস্তবতাকে ধারণ করেছে।

একজন সাহিত্যিক তার সৃজনশীল ক্রিয়ায় সমকালীন বাস্তবতাকে এড়িয়ে যেতে পারেন না। সেটা ‘জমিদার দর্পণ’ এ প্রস্ফুটিত। এ নাটকের মাধ্যমে মীর মশাররফ হোসেন তার সমাজ মনস্কতার সবুজ ফসল উৎপাদন করেছে। এখানে তিনি সমকালীন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতক বাস্তবতা পুনঃনির্মাণ তথা এর ভাষ্য নির্মাণ করেছেন।

‘জমিদার দর্পন’ জমিদার ও প্রজা শ্রেণির এক অবিকল চিত্র

ভারতীয় উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক বৃটিশ শাসক শ্রেণির প্রতিনিধি লর্ড কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফল জমিদারি ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার দুটি কেন্দ্রীয় চরিত্র জমিদার ও প্রজা। এ ব্যবস্থা জমিদার যেমন নিজেকে জমিদারীর মালিক মনে করতেন তেমনি প্রজাকেও মনে করতেন তার নিজস্ব সম্পদ। শুধু প্রজা নয়, নারীদেরকেও মনে করা হতো জমিদারের সম্পদ।

জমিদার শ্রেণির প্রজা সাধারণ ও নারীদের উপর শোষণ ও নির্মাতনের বস্তুনিষ্ঠ ধারাভাষ্য ‘জমিদার দর্পণ’। জমিদার শ্রেণির শোষণ ও নির্যাতনের স্বরূপ উন্মোচনে নিজস্ব অভিজ্ঞতালব্ধ এক সত্য ঘটনার ভিত্তিতে মীর মশাররফ হোসেন এই নাটক রচনা করেন। নাটকের সূত্র ধরের বক্তব্যে এই সত্য ঘটনার ইঙ্গিত রয়েছে। 

‘জমিদার দর্পণ’ নাটক যে নক্সাটি এঁকেছে তার কিছুই সাজানো নয়, অবিকল ছবি তুলেছে। কার্যত ‘জমিদার দর্পণ’ উনিশ শতকের কৃষক শ্রেণির জীবনধারার উপর ভিত্তি করে রচিত ঐ শতাব্দের একটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম।

তিন অঙ্কে বিভক্ত ‘জমিদার দর্পণ’ নাটকটি প্রতিটি অঙ্কে রয়েছে তিনটি করে দৃশ্য। জমিদার দর্পণ নাটকের লেখক মীর মশাররফ হোসেন এই নাটকের সূচনায় প্রস্তাবনা এবং সমাপ্তিতে রয়েছে উপসংহার নামে দুটি দৃশ্য রেখেছেন। অর্থাৎ নাটকটি মোট এগারোটি দৃশ্যের সমন্বয়ে গঠিত। এর কাহিনি সরল, এক রৈখিক ও উদ্দেশ্যমূলক। জমিদারি প্রথা ও জমিদার শ্রেণির স্বরূপ উন্মোচনই এ নাটকের মৌল উদ্দেশ্য। পাশাপাশি সেখানে রয়েছে বৃটিশ শাসনের প্রহসনমূলক বিচার ব্যবস্থার চিত্র। কার্যত বৃটিশ শাসক শ্রেণির হাতে সৃষ্ট জমিদার শ্রেণির চরিত্র এ নাটকের প্রস্ফুটিত:- সূত্র (ক্ষণকাল নিস্তব্ধ) আচ্ছা মফস্বলে একরকম জানোয়ার আছে জানেন। তারা কেউ শহরে বাস করে, শহরে কুকুর, কিন্তু মফস্বলে ঠাকুর। শহরে তাদের কেউ চেনেনা। মফস্বলে দোহাই ফেরে। শহরে কেউ কেউ জানে যে, এ জানোয়ার বড় শান্ত, বড় ধীর, বড় ন¤্র, হিংসা নেই, দ্বেষ নেই, মনে দ্বিধা নেই, মাছ মাংস ছোঁয়না কিন্তু মফস্বলে শ্যাল, কুকুর, গরু পর্যন্ত পার পায়না। বলবো কি জানোয়াররা আপন আপন বনে গিয়ে একবারে বাঘ হয়ে বসে।—এর আবার দুই দল

নট- দল আবার কেমন?

সূত্র- যেমন হিন্দু আর মুসলমান।

নট- ঠিক বলেছেন। ঐ দলের এক জানোয়ার যে কি কুকা- করেছিল, সেকথা মনে হলে এখনও পিলে চমকে ওঠে। এখনও চক্ষে জল এসে পড়ে। উ: কি ভয়ানক।” (প্রস্তাবনা) বস্তুত এরকম এক জানোয়ার জমিদার হায়ওয়ান আলীর কার্যকলাপ নিয়ে ‘জমিদার দর্পণ’ গড়ে উঠেছে। কোশলপুর গ্রামের জমিদার হায়ওয়ান আলীর প্রজা নির্যাতন, শোষণ এবং তার লাম্পট্য উচ্ছৃঙ্খলতা এ নাটকের মূল বিষয়বস্তু। হায়ওয়ান আলীর জমিদারির অন্তর্গত নিরীহ দরিদ্র কৃষক আবু মোল্লা। তার যুবতী স্ত্রী নূরুন্নাহারের শরীরের উপর ভোগ করার জন্য প্রথমে কৃষ্ণমনির মাধ্যমে তার নিকট প্রস্তাব পাঠানো হয়। কিন্তু নুরুন্নাহার জমিদারের অনৈতিক ও অবৈধ  প্রস্তাব প্রত্যাখান করে। এত হায়ওয়ান আলী ক্ষিপ্ত হয়ে আবু মোল্লাকে ধরিয়ে আনে ও জমিদার বাড়িতে আটকে রাখে। স্বামীকে মুক্ত করতে গেলে নূরুন্নাহারকে স্বামীর মুক্তির বিনিময়ে জমিদারের শয্যাসঙ্গী হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু নূরুন্নাহার তাতে রাজী হয়নি। পলে পেয়াদা দিয়ে নূরুন্নাহারকে ধরিয়ে আনা হয়। নূরুন্নাহারের উপর শুরু হয় কামুক হায়ওয়ান আলীর যৌন নির্যাতন। অন্তঃসত্ত্বা নূরুন্নাহারের উপর জমিদারের মাত্রাতিরিক্ত যৌন নির্যাতনের কারণে মৃত্যু ঘটে। বন্দী থাকারা কারণে আবু মোল্লা তার স্ত্রীর উপর যৌন নির্যাতন ও এর পরিণতি সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেনি।

জমিদারের কারাগার থেকে মুক্তি পাবার পর আবু মোল্লা জমিদার বাড়ির নিকটস্থ এক বাগানে নূরুন্নাহারের মৃতদেহের সন্ধান পায়। আবু মোল্লা জমিদার হায়ওয়ান আলীর বিরুদ্ধে মামলা করে। জমিদারের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা পেয়ে মামলার সাক্ষী ও ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার আদালতে মিথ্যা সাক্ষী দেয়। আদালত হায়ওয়ান আলীকে বেকসুর খালাস দেয়। মামলা করার কারণে হায়ওয়ান আলী আবু মোল্লার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়।

বাস্তবতা হলো, জমিদাররা তাদের জমিদারীকে যেমন তাদের ব্যক্তিগত বা নিজস্ব সম্পত্তি মনে করতো তেমনি তাদের অধীনস্থ প্রজা ও তাদের সুন্দরী স্ত্রী ও মেয়ে সন্তানদেরকেও তাদের নিজস্ব সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করতো। আবু মোল্লা ও তার স্ত্রীর প্রতি জমিদার হায়ওয়ান আলীর আচরণ এ বাস্তবতাকে প্রস্ফুটিত করেছে। তৎকালীন হায়ওয়ান আলীরা মনে করতো তাদের জমিদারির অধীনস্থ যুবতী নারীরা তাদের নিজস্ব ভোগের সম্পদ। তাই তাদেরকে ভোগ করাটা জমিদারের অধিকার হিসেবেই বিবেচিত হতো।

‘জমিদার দর্পণ’ নাটকের বিষয়বস্তু উপস্থাপনে নাটকীয় দ্বন্দ্ব সৃষ্টিতে মনন, যুক্তি উপেক্ষা করা হয়েছে। এখানে নাটকটির বক্তব্যে প্রাধান্য পেয়েছে- জমিদার হায়ওয়ান আলীর প্রজা শোষণ-নিপীড়ন ও যৌন শোষণ। ফলে সক্রিয় রয়েছে উদ্দেশ্যমূলক প্রবণতা।

এ নাটকে জমিদার ও প্রজা এই দুই শ্রেণির দ্বন্দ্ব তথা শোষক ও শোষিতের দ্বন্দ্ব প্রস্ফুটিত হয়েছে। তৎকালীন বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে এ দ্বন্দ্ব উপস্থাপিত হয়েছে। এখানে বাস্তবতা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতার বিশ্লেষণ নেই। জমিদার হায়ওয়ান আলী ও তার সহচররা জমিদারী ব্যবস্থার শোষক শ্রেণিল প্রতিনিধি, বিপরীতে আবু মোল্লা, নূরুন্নাহার প্রমুখ শোষিত প্রজা শ্রেণির কণ্ঠস্বর। এই দুই বিপরীত শ্রেণির চরিত্রের পরস্পর দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের মধ্য দিয়ে নাটকের কাহিনি বিকশিত হয়েছে।

চরিত্রসমূহ স্বকীয় কাঠামোতে প্রস্ফুটিত। এই নাটকটিতে দুই বিপরীতপমুখী শ্রেণির দ্বন্দ্বে ট্র্যাজেডি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ঘটনা প্রবাহের একমুখী ধাবমানতা এবং সংবাদধর্মী সংলাপের কারণে সেই সম্ভাবনা বিকাশ লাভ করতে পারেনি। কার্যত নাটকটির ঘটনাপ্রবাহে একের পর এক অত্যাচারের চিত্র উপস্থাপনের মাধ্যমে নাটকটিকে মেলোড্রামায় পরিণত করা হয়েছে। নাটকটির কোনো চরিত্রের মধ্যেই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বিকশিত হয়নি প্রজার উপর জমিদারের নির্যাতন ও যৌন শোষণ এখানে শোক ও করুণার সৃষ্টি করেছে সত্য কিন্তু সেটা ট্র্যাজিক পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেনি। বস্তুত ‘জমিদার দর্পণ’ নাটকটিতে ট্র্যাজেডির গভীরতা অনুপস্থিত। 

‘জমিদার দর্পন’ নাটকের চরিত্র

নাটকটির কেন্দ্রীয় চরিত্র কোশলপুরে জমিদার হায়ওয়ান আলী। নাটকে প্রস্ফুটিত তার চরিত্র কার্যাবলী জমিদার শ্রেণির যথার্থ প্রতিনিধি।

নাটকের বিভিন্ন চরিত্রের সংলাপে হায়ওয়ান আলীর শোষণ-শাসন, নির্যাতন-নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতা প্রস্ফুটিত:-

জামাল- দেখুন আমরা চাকর, হুকুম কল্লে আর অদুল কত্তে পারিনে। এ কাজটা বড়ই অন্যায় হোচ্ছে। মোল্লার স্ত্রী গর্ভবতী, তারপর এই জাকরান। এ কাজটা বড় অন্যায় হচ্ছে। কি করি? এর অধীনে থেকে একেবারে সর্বনাশ হবে। এর তো দিগ-বিদ্বিগ জ্ঞান কিছুই নাই, ন্যায় হোক, অন্যায় হোক একটা করে বসেন, যেভাব দেখতে পাচ্ছি, এত আমাদের জাতকুল থাকাই ভার। আজ আবু মোল্লার যে দশা হলো, কোনদিন বা আমাদের ওরূপ ঘটে”।  (দ্বিতীয় অঙ্ক: তৃতীয় গর্ভাঙ্ক)

মোক্তার– মফস্বলের প্রজার হর্তাকর্তা মালিক জমিদার। তাদের আদালত ফৌজদারীতেই নিষ্পত্তি করিয়া থাকে। প্রজার পরস্পর বিবাদ নিষ্পত্তি হক বা না হক আপন নজরের টাকা হলেই হলো। প্রজারা শাসনভয়ে মুখে কথা নাই। জমিদার যা বলেন কোন মতেই তার অবাধ্যি হতে পারে না। জমীদারের অজানিতে কোন মতেই প্রজা বিচারের প্রার্থনায় আদালত আশ্রয় করিলে তখন জমিদার একেবারে অগ্নিমূর্তি হইয়া তার ভিটেমাটি একেবারে জ্বালিয়ে ছারখার করিয়া দেন।” (তৃতীয় অঙ্ক: দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক)

আবু– আমার সর্বনাশ তো হয়েইছে- হায়ওয়ান আলী মোকাদ্দমায় জিতে আমার বাড়ি ঘর ভেঙে চুরে মানেওয়ারন করে ফেলেছে। আমাদের আর দাঁড়াবার লক্ষ্য নাই। (ক্রন্দন) হায় হায়! আমার ধনমান প্রাণ সকলই গেলো, বিষয় সম্পত্তি যাকিছু ছিল সকলই লুটে নিয়েছে। আমার গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে- আমার অন্নবস্ত্র কিছুই নাই।” (উপসংহার)

মোক্তার– হায়ওয়ান আলী যে চরিত্রের লোক তার প্রমাণ এই দেখুন— ইতোপূর্বে— সাহেবজাদা হাকিমের আমলে এক হিন্দু স্ত্রীকে জাবরানে ধরে এনে সতীত্ব হরণ করেন। ঐরকম কুল বালার সতীত্বনাশ করেছেন, ধ্বংস করেছেন, নষ্ট করেছেন, মাথা খেয়েছেন, জাতপাত করেছেন সে আমি বলতে চাইনে। ধর্মাবর্তাব, ওদের নিষ্ঠুরতার বিষয় কত প্রমাণ আছে। প্রধান প্রধান হাকিমের রায়েতে প্রকাশ আছে।” (তৃতীয় অঙ্ক: দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক)

এখানে প্রতিটি সংলাপেই হায়ওয়ান আলীর নির্যাতন-অত্যাচার, যৌন নির্যতন ও লাম্পট্যের রূপটি প্রকাশিত হয়েছে।

ভারত উপমহাদেশে বৃটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর এখানকার ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি আমূল পরিবর্তন আনা হয়। বৃটিশ শাসক শ্রেণি ভূমি রাজস্ব আদায়ের জন্য সরকার ও প্রজার মাঝখানে একটি মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি সৃষ্টি করে। এই শ্রেণিটির নাম জমিদার শ্রেণি। ভূমিরাজস্ব আদায়ের জন্য এদেরকে বিভিন্ন এলাকা চিরস্থায়ীভাবে বন্দোবস্ত দেয়া হয়। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল রাজস্ব আদায়। রাজস্ব আদায়ের জন্য তারা কৃষক-প্রজাদের উপর নানান ধরনের নির্যাতন চালাতো। কারো বাড়িতে একটি গাছ কাটতে হলেও জমিদারের অনুমতি নিতে হতো। এত বুঝা যায় কৃষক-প্রজা শ্রেণি কতটুকু শৃংখলিত ছিল। 

বস্তুত জমিদাররা তাদের জমিদারী এ স্টেটকে নিজস্ব সম্পত্তি মনে করতো। অপরদিকে অনেক জমিদারও জমিদার সন্তানরা ছিলেন লম্পট। প্রজাদের সুন্দরী যুবতীদেরকে ধরে এনে তাদের যৌন লালসা চরিতার্থ করতো। কোনো যুবতী তাদের প্রস্তাবে রাজী না হলে তার উপর চালানো হতো নির্যাতন। কার্যত জমিদার বা জমিদার সন্তানদের যৌন ক্ষুধা মিটানোর জন্য প্রজাদের যুবতী কন্যাদের বা স্ত্রীদের বাধ্য করা হতো। তারা নারীদেরকে পণ্য মনে করতো। তদের ধারণা করতো তাদের জমিদারীর বৃত্তে বসবাসরত নারীরা হলো তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এটা হলো সামন্তবাদী চেতনার বহিঃপ্রকাশ। ‘জমিদার দর্পণ’ নাটকে হায়ওয়ান আলীর কার্যকলাপে যে সেই সামন্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে।

হায়ওয়ান আলী তার সমস্ত কার্যকলাপ খুবই চাতুর্য ও ধূর্ততার সঙ্গে করতো। এসব অনৈতিক কাজের জন্য তার মধ্যে কোনো অনুশোচনা বা পাপবোধের সৃষ্টি হতো না। তার চরিত্রের অধঃপতন এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, সে ন্যূনতম মানবিক বোধশক্তি হরিয়ে ফেলেছিল। সে কারণে দেখা যায়, তার পাশবিক অত্যাচারে আবু মোল্লার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী নূরুন্নাহার মৃত্যুবরণ করলে সে মূঢ় হয়নি। বরং সে এঘটনা ধামাচাপ দেয়ার জন্য নানান কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল। কার্যসিদ্ধির সে উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গকে অর্থ দিয়ে বশে রেখেছিল। নূরুন্নাহারের মৃত্যুর ঘটনা সে এভাবেই চাপা দেয় বা মামলা থেকে বেকসুর খালাস পায়। কারণ অর্থ বলে কথা।

হায়ওয়ান আলীর অত্যাচারে প্রজাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। আবু মোল্লার সাথে তার আচরণ তারই বহিঃপ্রকশ। আবু মোল্লাকে ধরে আনার পর হায়ওয়ান আলীর উক্তি- তুই জানিস আমি তোর সব কর্ত্তে পারি। তোর ভিটা তোর ভিটায় ঘুঘু চরাতে পারি।……তুই ভেবেছিস কি? আমি তোকে মোজা কর্ব্বই কোর্ব্বো। …..হারামজাদা। আমি তোর ঘর বেচবো। তুই যেখান থেকে পারিস টাকা এনে দে। (সর্দ্দারগণের প্রতি) আরে তোরা এখনও ওর মাথায় ইট দিলিনি।” (প্রথম অঙ্ক: তৃতীয় গর্ভাঙ্ক)

শুধু হায়ওয়ান আলীর চরিত্রই প্রস্ফুটিত হয়নি। পাশর্^ চরিত্র হিসেবে উকিল, ডাক্তার, স্থানীয় আদালত প্রভৃতির প্রতিচিত্রও প্রস্ফুটিত। আবু মোল্লার স্ত্রী নূরুন্নাহার হত্যামামলা আদালতে শুরু হলে হায়ওয়ান সম্পর্কে উকিল সাফাই গেয়ে বলছে-” তিনি অতি ধনবান, বিশেষত বিচক্ষণ, ধর্মপরায়ণ, বয়স এ পর্যন্ত ৪০ বৎসর হয় নাই। তারা দ্বারা এমন কাজ হওয়া কখনই সম্ভব হয়না। কেবল মনোবাদ সাধন জন্য এই মিথ্যা নালিশ উপস্থিত হয়েছে। কোন সাক্ষীতেই এমন স্পষ্ট প্রমাণ দেয় নাই, যে আমার মক্কেল নূরুন্নাহার আওরতকে জবরান বলৎকার করেছেন; আর সেই বলৎকারে তার প্রাণ বিয়োগ হয়েছে। ফরিয়াদী আবু মোল্লাহ বড় ফেরেরবাজ।” (তৃতীয় অঙ্ক: দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক)

আবু মোল্লার আত্মীয় ও প্রতিবেশী জীতু মোল্লা এলাকার মোল্লা। সে চারবার হজ্ব করেছে। আদালতে তার সাক্ষ্য-

ব্যরি: মোল্লার জরু কি রকম মরেছে তুমি তার কিছু জান?

জীতু: জানবোনা ক্যা? আবুই মারতে মারতে এহবারে খুন করেছে…..।

ব্যারি: হায়ওয়ান আলী কেমন লোক আছে?

জীতু: (তেছকি ছুঁইয়া কপাল চুলকাইয়া মাথা নাড়িয়া) আহ এমন লোক দুনিয়া জাহানে আর নাই। বড় দ্বীনদার, বড় দাতা; মক্কা যাইবার সময় হামারে পঞ্চাশটি ট্যাহা দেয়।

ব্যরি: হায়ওয়ান আলী নূরুন্নাহারকে মারিয়াছে?

জীতু: (দুই গালে হাত দিয়া) তোবা তোবা, সে কি এমন কাজ কর্তে পারে, তা কহনো হবার যায়” (তৃতীয় অঙ্ক: তৃতীয় গর্ভাঙ্ক)

(নাবামলী গায়ে কৌপিন এবং বহির্বাণ পরিধান, সর্বাঙ্গে তিলক ছাপা, হস্তে-গলে তুলসীর মাহদা, কণ্ঠে কুড়জালী, বক্ষে ঝুলি, হরিনাসরুফ করিতে দ্বিতীয় সাক্ষী হরিদাসের প্রবেশ)

ব্যরি: আবু মোল্লার স্ত্রীকে কে খুন করিয়াছে তুমি জানো?

হরি: (মালা টিপিতে টিপিতে) রাধে কৃষ্ণ! আমি কিছুই জানিনা।

ব্যারি: কিছু শুনিয়াছ?

হরি: শুনেছি হুজুর।

ব্যারি: ক্যা শুনা হ্যায়?

হরি: হরিবোল! হরিবোল! হরিবোল! শুনেছি আবু মোল্লাহই মেরে ফেলেছে। উ: কি পাপিষ্ঠ! হরিবোল! হরিবোল!

ব্যারি: আবু মোল্লা কেমন লোক?

হরি: হুজুর সে বড় ফেরেরবাজ। একদিন আমি-

জজ: তুমি কি? ফেরর করিয়াছে?….. তুমি একদিন তুমি কি?

হরি: হুজুর! একদিন আমি ভিক্ষা করতে ওদের বাড়িতে গেছিলুম। ফাঁকি দিয়ে আমার ঝোলা দেখি বলে কেড়ে নিয়ে চালগুলো ঢেলে নিলে। শেষে ঝোলটা পায়ে পড়ে চেয়ে ছিলুম। ও বেটা ফেরে বাজ। ওর জ্বালায় গাঁয়ের লোক জ্বলে মলো। রাধে কৃষ্ণ। রাধে কৃষ্ণ!” (তৃতীয় অঙ্ক: তৃতীয় গর্ভাঙ্ক)

নূরুন্নাহারের লাশের ময়নাতদন্তকারী কর্মকর্তা ডাক্তার কালিং হাম বাইবেল চুম্বন করে বলেন-

I made the post mortem examination of the body of Nooron Nehar, healthy good looking woman, aged about twenty years sent by the officer incharge of Dharmapasha police station. No mark of external violence except on the general, profuse discharge of blood from the said part of the lungs highly congested of digesting away The skin of throat extravasation of blood observed, all other organs  found healthy, In (ত্রস্তভাবে) my opinion the must have dies of sanguineous apoplexy of the brain.” (তৃতীয় অঙ্ক: তৃতীয় গর্ভাঙ্ক)

ডাক্তারের স্ববিরোধী বক্তব্য বাদী পক্ষের উকিলের আপত্তি সত্ত্বেও জজ সাহেব ডাক্তারের বক্তব্য গ্রহণ করেন। আদালতে মামলা খারিজ হয়ে গেল বস্তুত “জমিদার দর্পণ” নাটকটিতে তৎকালীন সমাজ বাস্তবতার চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

দীনবন্ধু মিত্র রচিত ‘নীলদর্পণ’ এবং মীর মশাররফ রচিত ‘জমিদার দর্পণ’ নাটকদ্বয়ের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য

এদেশীয় চাষিদের উপর বিদেশী নীলকরদের নির্যাতনও শোষণের স্বরূপ উন্মোচন করে ১৮৬০ সালে দীনবন্ধু মিত্র লেখেন ‘নীলদর্পণ’ নাটক। এই নাটক প্রকাশের পর ঐ সময়ে দর্পণ নামাঙ্কিত অনেক নাটক লেখা ও প্রকাশিত হয়েছিল। অজ্ঞাতনাম জনৈক লিখিত সাক্ষ্য ‘দর্পণ’ (১৮৭১), গ্রামীণ জীবনের বাস্তবতা নিয়ে প্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের ‘পল্লী দর্পণ, (১৮৭৩), যোগেশ চন্দ্র ঘোষের ‘কেরানী দর্পণ’ (১৮৭৪), দক্ষিণাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘জেল দর্পণ’ (১৮৭৫)। এই দর্পণ ধারার নাটক ‘জমিদার দর্পণ’  প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭৩ সালে।

কার্যত ‘নীল দর্পণ’ এবং ‘জমিদার দর্পণ’ এই নাটকের নামকরণ, বিষয়বস্তু নির্বাচন, ঘটনা সংস্থান, চরিত্র-চিত্র ও মৌল উদ্দেশের মধ্যে সাদৃশ রয়েছে। উভয় নাটকের মৌল উদ্দেশ্য হলো সমাজ কাঠামোতে যে নির্যাতন ও শোষণ রয়েছে তার বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তোলা।

উভয় নাটকের মূল চরিত্র কৃষক বা সাধারণ মানুষ এক নাটকে নীলচাষি এবং অন্যটিতে প্রজা কৃষক। তবে নাটক দুটির মধ্যে মৌল পার্থক্য রয়েছে। আর সেটা হলো নীল দর্পণ নাটকে নীলকর তথা বিদেশী শোষকশ্রেণির শোষণ ও নির্যাতনের প্রতি চিত্র প্রস্ফুটিত। আর ‘জমিদার দর্পণ’ নাটকে দেশীয় পরজীবী জমিদার শ্রেণির চরিত্র ও কার্যাবলী এবং পাশাপাশি বিদেশী শাসনযন্ত্রের বাস্তবতা উন্মোচিত হয়েছে।

Cecero নাটক সম্বন্ধে বলেছেন- “A drama is a copy of life, mirror of  custom, reflection of truth.” ‘জমিদার দর্পণ’ নাটকে এ তিনটিরই যথার্থ প্রতিফলন ঘটেছে। বাস্তবত ‘জমিদার দর্পণ’ জমিদারি ব্যবস্থার বাস্তবতার পুনঃনির্মাণ।

শেয়ার করুন

One thought on “নাটক রিভিউ: জমিদার দর্পণ

  1. এত্ত সুন্দর সংক্ষেপণ ও বিশ্লেষণের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ।

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

নাটক রিভিউ: জমিদার দর্পণ

প্রকাশ: ০৩:০১:৪৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২১

মীর মশাররফ হোসেন রচিত ‘জমিদার দর্পণ’ নাটকের আলোচনা করতে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মন্তব্য করেন, “বঙ্গ দর্শনের জন্মাবধি এই পত্র প্রজার হিতৈষী এবং প্রজার হিত কামনা আমরা কখনো ত্যাগ করিব না। কিন্তু আমরা পাবনা জিলার প্রজাদিগের আচরণ শুনিয়া বিরক্ত ও বিষদযুক্ত হইয়াছি। জ্বলন্ত অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেওয়া নিষ্প্রয়োজন। আমরা পরামর্শ দিই যে, গ্রন্থাকারের এসময়ে এ গ্রন্থ বিক্রয় ও বিতরণ বন্ধ করা কর্তব্য।”

বঙ্কিমচন্দ্রের বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, ‘জমিদার দর্পণ’ নাটকটি ঐ সময়ে সাধারণ প্রজাদের মানসিকতায় প্রভাব ফেলেছিল। এ প্রভাবের ফলে প্রজারা জমিদারদের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেচিল। প্রজাদের মানসিকতায় প্রভাব ফেলার কারণ কী?

কারণ হলো ‘জমিদার দর্পণ’ এর বক্তব্যে তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা প্রস্ফুটিত হয়েছে। বস্তুত ‘জমিদার দর্পণ’ বৃটিশ শাসক শ্রেণি কর্তৃক প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত তথা জমিদারি ব্যবস্থার বাস্তবতাকে ধারণ করেছে।

একজন সাহিত্যিক তার সৃজনশীল ক্রিয়ায় সমকালীন বাস্তবতাকে এড়িয়ে যেতে পারেন না। সেটা ‘জমিদার দর্পণ’ এ প্রস্ফুটিত। এ নাটকের মাধ্যমে মীর মশাররফ হোসেন তার সমাজ মনস্কতার সবুজ ফসল উৎপাদন করেছে। এখানে তিনি সমকালীন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতক বাস্তবতা পুনঃনির্মাণ তথা এর ভাষ্য নির্মাণ করেছেন।

‘জমিদার দর্পন’ জমিদার ও প্রজা শ্রেণির এক অবিকল চিত্র

ভারতীয় উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক বৃটিশ শাসক শ্রেণির প্রতিনিধি লর্ড কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফল জমিদারি ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার দুটি কেন্দ্রীয় চরিত্র জমিদার ও প্রজা। এ ব্যবস্থা জমিদার যেমন নিজেকে জমিদারীর মালিক মনে করতেন তেমনি প্রজাকেও মনে করতেন তার নিজস্ব সম্পদ। শুধু প্রজা নয়, নারীদেরকেও মনে করা হতো জমিদারের সম্পদ।

জমিদার শ্রেণির প্রজা সাধারণ ও নারীদের উপর শোষণ ও নির্মাতনের বস্তুনিষ্ঠ ধারাভাষ্য ‘জমিদার দর্পণ’। জমিদার শ্রেণির শোষণ ও নির্যাতনের স্বরূপ উন্মোচনে নিজস্ব অভিজ্ঞতালব্ধ এক সত্য ঘটনার ভিত্তিতে মীর মশাররফ হোসেন এই নাটক রচনা করেন। নাটকের সূত্র ধরের বক্তব্যে এই সত্য ঘটনার ইঙ্গিত রয়েছে। 

‘জমিদার দর্পণ’ নাটক যে নক্সাটি এঁকেছে তার কিছুই সাজানো নয়, অবিকল ছবি তুলেছে। কার্যত ‘জমিদার দর্পণ’ উনিশ শতকের কৃষক শ্রেণির জীবনধারার উপর ভিত্তি করে রচিত ঐ শতাব্দের একটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম।

তিন অঙ্কে বিভক্ত ‘জমিদার দর্পণ’ নাটকটি প্রতিটি অঙ্কে রয়েছে তিনটি করে দৃশ্য। জমিদার দর্পণ নাটকের লেখক মীর মশাররফ হোসেন এই নাটকের সূচনায় প্রস্তাবনা এবং সমাপ্তিতে রয়েছে উপসংহার নামে দুটি দৃশ্য রেখেছেন। অর্থাৎ নাটকটি মোট এগারোটি দৃশ্যের সমন্বয়ে গঠিত। এর কাহিনি সরল, এক রৈখিক ও উদ্দেশ্যমূলক। জমিদারি প্রথা ও জমিদার শ্রেণির স্বরূপ উন্মোচনই এ নাটকের মৌল উদ্দেশ্য। পাশাপাশি সেখানে রয়েছে বৃটিশ শাসনের প্রহসনমূলক বিচার ব্যবস্থার চিত্র। কার্যত বৃটিশ শাসক শ্রেণির হাতে সৃষ্ট জমিদার শ্রেণির চরিত্র এ নাটকের প্রস্ফুটিত:- সূত্র (ক্ষণকাল নিস্তব্ধ) আচ্ছা মফস্বলে একরকম জানোয়ার আছে জানেন। তারা কেউ শহরে বাস করে, শহরে কুকুর, কিন্তু মফস্বলে ঠাকুর। শহরে তাদের কেউ চেনেনা। মফস্বলে দোহাই ফেরে। শহরে কেউ কেউ জানে যে, এ জানোয়ার বড় শান্ত, বড় ধীর, বড় ন¤্র, হিংসা নেই, দ্বেষ নেই, মনে দ্বিধা নেই, মাছ মাংস ছোঁয়না কিন্তু মফস্বলে শ্যাল, কুকুর, গরু পর্যন্ত পার পায়না। বলবো কি জানোয়াররা আপন আপন বনে গিয়ে একবারে বাঘ হয়ে বসে।—এর আবার দুই দল

নট- দল আবার কেমন?

সূত্র- যেমন হিন্দু আর মুসলমান।

নট- ঠিক বলেছেন। ঐ দলের এক জানোয়ার যে কি কুকা- করেছিল, সেকথা মনে হলে এখনও পিলে চমকে ওঠে। এখনও চক্ষে জল এসে পড়ে। উ: কি ভয়ানক।” (প্রস্তাবনা) বস্তুত এরকম এক জানোয়ার জমিদার হায়ওয়ান আলীর কার্যকলাপ নিয়ে ‘জমিদার দর্পণ’ গড়ে উঠেছে। কোশলপুর গ্রামের জমিদার হায়ওয়ান আলীর প্রজা নির্যাতন, শোষণ এবং তার লাম্পট্য উচ্ছৃঙ্খলতা এ নাটকের মূল বিষয়বস্তু। হায়ওয়ান আলীর জমিদারির অন্তর্গত নিরীহ দরিদ্র কৃষক আবু মোল্লা। তার যুবতী স্ত্রী নূরুন্নাহারের শরীরের উপর ভোগ করার জন্য প্রথমে কৃষ্ণমনির মাধ্যমে তার নিকট প্রস্তাব পাঠানো হয়। কিন্তু নুরুন্নাহার জমিদারের অনৈতিক ও অবৈধ  প্রস্তাব প্রত্যাখান করে। এত হায়ওয়ান আলী ক্ষিপ্ত হয়ে আবু মোল্লাকে ধরিয়ে আনে ও জমিদার বাড়িতে আটকে রাখে। স্বামীকে মুক্ত করতে গেলে নূরুন্নাহারকে স্বামীর মুক্তির বিনিময়ে জমিদারের শয্যাসঙ্গী হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু নূরুন্নাহার তাতে রাজী হয়নি। পলে পেয়াদা দিয়ে নূরুন্নাহারকে ধরিয়ে আনা হয়। নূরুন্নাহারের উপর শুরু হয় কামুক হায়ওয়ান আলীর যৌন নির্যাতন। অন্তঃসত্ত্বা নূরুন্নাহারের উপর জমিদারের মাত্রাতিরিক্ত যৌন নির্যাতনের কারণে মৃত্যু ঘটে। বন্দী থাকারা কারণে আবু মোল্লা তার স্ত্রীর উপর যৌন নির্যাতন ও এর পরিণতি সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেনি।

জমিদারের কারাগার থেকে মুক্তি পাবার পর আবু মোল্লা জমিদার বাড়ির নিকটস্থ এক বাগানে নূরুন্নাহারের মৃতদেহের সন্ধান পায়। আবু মোল্লা জমিদার হায়ওয়ান আলীর বিরুদ্ধে মামলা করে। জমিদারের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা পেয়ে মামলার সাক্ষী ও ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার আদালতে মিথ্যা সাক্ষী দেয়। আদালত হায়ওয়ান আলীকে বেকসুর খালাস দেয়। মামলা করার কারণে হায়ওয়ান আলী আবু মোল্লার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়।

বাস্তবতা হলো, জমিদাররা তাদের জমিদারীকে যেমন তাদের ব্যক্তিগত বা নিজস্ব সম্পত্তি মনে করতো তেমনি তাদের অধীনস্থ প্রজা ও তাদের সুন্দরী স্ত্রী ও মেয়ে সন্তানদেরকেও তাদের নিজস্ব সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করতো। আবু মোল্লা ও তার স্ত্রীর প্রতি জমিদার হায়ওয়ান আলীর আচরণ এ বাস্তবতাকে প্রস্ফুটিত করেছে। তৎকালীন হায়ওয়ান আলীরা মনে করতো তাদের জমিদারির অধীনস্থ যুবতী নারীরা তাদের নিজস্ব ভোগের সম্পদ। তাই তাদেরকে ভোগ করাটা জমিদারের অধিকার হিসেবেই বিবেচিত হতো।

‘জমিদার দর্পণ’ নাটকের বিষয়বস্তু উপস্থাপনে নাটকীয় দ্বন্দ্ব সৃষ্টিতে মনন, যুক্তি উপেক্ষা করা হয়েছে। এখানে নাটকটির বক্তব্যে প্রাধান্য পেয়েছে- জমিদার হায়ওয়ান আলীর প্রজা শোষণ-নিপীড়ন ও যৌন শোষণ। ফলে সক্রিয় রয়েছে উদ্দেশ্যমূলক প্রবণতা।

এ নাটকে জমিদার ও প্রজা এই দুই শ্রেণির দ্বন্দ্ব তথা শোষক ও শোষিতের দ্বন্দ্ব প্রস্ফুটিত হয়েছে। তৎকালীন বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে এ দ্বন্দ্ব উপস্থাপিত হয়েছে। এখানে বাস্তবতা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতার বিশ্লেষণ নেই। জমিদার হায়ওয়ান আলী ও তার সহচররা জমিদারী ব্যবস্থার শোষক শ্রেণিল প্রতিনিধি, বিপরীতে আবু মোল্লা, নূরুন্নাহার প্রমুখ শোষিত প্রজা শ্রেণির কণ্ঠস্বর। এই দুই বিপরীত শ্রেণির চরিত্রের পরস্পর দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের মধ্য দিয়ে নাটকের কাহিনি বিকশিত হয়েছে।

চরিত্রসমূহ স্বকীয় কাঠামোতে প্রস্ফুটিত। এই নাটকটিতে দুই বিপরীতপমুখী শ্রেণির দ্বন্দ্বে ট্র্যাজেডি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ঘটনা প্রবাহের একমুখী ধাবমানতা এবং সংবাদধর্মী সংলাপের কারণে সেই সম্ভাবনা বিকাশ লাভ করতে পারেনি। কার্যত নাটকটির ঘটনাপ্রবাহে একের পর এক অত্যাচারের চিত্র উপস্থাপনের মাধ্যমে নাটকটিকে মেলোড্রামায় পরিণত করা হয়েছে। নাটকটির কোনো চরিত্রের মধ্যেই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বিকশিত হয়নি প্রজার উপর জমিদারের নির্যাতন ও যৌন শোষণ এখানে শোক ও করুণার সৃষ্টি করেছে সত্য কিন্তু সেটা ট্র্যাজিক পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেনি। বস্তুত ‘জমিদার দর্পণ’ নাটকটিতে ট্র্যাজেডির গভীরতা অনুপস্থিত। 

‘জমিদার দর্পন’ নাটকের চরিত্র

নাটকটির কেন্দ্রীয় চরিত্র কোশলপুরে জমিদার হায়ওয়ান আলী। নাটকে প্রস্ফুটিত তার চরিত্র কার্যাবলী জমিদার শ্রেণির যথার্থ প্রতিনিধি।

নাটকের বিভিন্ন চরিত্রের সংলাপে হায়ওয়ান আলীর শোষণ-শাসন, নির্যাতন-নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতা প্রস্ফুটিত:-

জামাল- দেখুন আমরা চাকর, হুকুম কল্লে আর অদুল কত্তে পারিনে। এ কাজটা বড়ই অন্যায় হোচ্ছে। মোল্লার স্ত্রী গর্ভবতী, তারপর এই জাকরান। এ কাজটা বড় অন্যায় হচ্ছে। কি করি? এর অধীনে থেকে একেবারে সর্বনাশ হবে। এর তো দিগ-বিদ্বিগ জ্ঞান কিছুই নাই, ন্যায় হোক, অন্যায় হোক একটা করে বসেন, যেভাব দেখতে পাচ্ছি, এত আমাদের জাতকুল থাকাই ভার। আজ আবু মোল্লার যে দশা হলো, কোনদিন বা আমাদের ওরূপ ঘটে”।  (দ্বিতীয় অঙ্ক: তৃতীয় গর্ভাঙ্ক)

মোক্তার– মফস্বলের প্রজার হর্তাকর্তা মালিক জমিদার। তাদের আদালত ফৌজদারীতেই নিষ্পত্তি করিয়া থাকে। প্রজার পরস্পর বিবাদ নিষ্পত্তি হক বা না হক আপন নজরের টাকা হলেই হলো। প্রজারা শাসনভয়ে মুখে কথা নাই। জমিদার যা বলেন কোন মতেই তার অবাধ্যি হতে পারে না। জমীদারের অজানিতে কোন মতেই প্রজা বিচারের প্রার্থনায় আদালত আশ্রয় করিলে তখন জমিদার একেবারে অগ্নিমূর্তি হইয়া তার ভিটেমাটি একেবারে জ্বালিয়ে ছারখার করিয়া দেন।” (তৃতীয় অঙ্ক: দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক)

আবু– আমার সর্বনাশ তো হয়েইছে- হায়ওয়ান আলী মোকাদ্দমায় জিতে আমার বাড়ি ঘর ভেঙে চুরে মানেওয়ারন করে ফেলেছে। আমাদের আর দাঁড়াবার লক্ষ্য নাই। (ক্রন্দন) হায় হায়! আমার ধনমান প্রাণ সকলই গেলো, বিষয় সম্পত্তি যাকিছু ছিল সকলই লুটে নিয়েছে। আমার গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে- আমার অন্নবস্ত্র কিছুই নাই।” (উপসংহার)

মোক্তার– হায়ওয়ান আলী যে চরিত্রের লোক তার প্রমাণ এই দেখুন— ইতোপূর্বে— সাহেবজাদা হাকিমের আমলে এক হিন্দু স্ত্রীকে জাবরানে ধরে এনে সতীত্ব হরণ করেন। ঐরকম কুল বালার সতীত্বনাশ করেছেন, ধ্বংস করেছেন, নষ্ট করেছেন, মাথা খেয়েছেন, জাতপাত করেছেন সে আমি বলতে চাইনে। ধর্মাবর্তাব, ওদের নিষ্ঠুরতার বিষয় কত প্রমাণ আছে। প্রধান প্রধান হাকিমের রায়েতে প্রকাশ আছে।” (তৃতীয় অঙ্ক: দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক)

এখানে প্রতিটি সংলাপেই হায়ওয়ান আলীর নির্যাতন-অত্যাচার, যৌন নির্যতন ও লাম্পট্যের রূপটি প্রকাশিত হয়েছে।

ভারত উপমহাদেশে বৃটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর এখানকার ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি আমূল পরিবর্তন আনা হয়। বৃটিশ শাসক শ্রেণি ভূমি রাজস্ব আদায়ের জন্য সরকার ও প্রজার মাঝখানে একটি মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি সৃষ্টি করে। এই শ্রেণিটির নাম জমিদার শ্রেণি। ভূমিরাজস্ব আদায়ের জন্য এদেরকে বিভিন্ন এলাকা চিরস্থায়ীভাবে বন্দোবস্ত দেয়া হয়। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল রাজস্ব আদায়। রাজস্ব আদায়ের জন্য তারা কৃষক-প্রজাদের উপর নানান ধরনের নির্যাতন চালাতো। কারো বাড়িতে একটি গাছ কাটতে হলেও জমিদারের অনুমতি নিতে হতো। এত বুঝা যায় কৃষক-প্রজা শ্রেণি কতটুকু শৃংখলিত ছিল। 

বস্তুত জমিদাররা তাদের জমিদারী এ স্টেটকে নিজস্ব সম্পত্তি মনে করতো। অপরদিকে অনেক জমিদারও জমিদার সন্তানরা ছিলেন লম্পট। প্রজাদের সুন্দরী যুবতীদেরকে ধরে এনে তাদের যৌন লালসা চরিতার্থ করতো। কোনো যুবতী তাদের প্রস্তাবে রাজী না হলে তার উপর চালানো হতো নির্যাতন। কার্যত জমিদার বা জমিদার সন্তানদের যৌন ক্ষুধা মিটানোর জন্য প্রজাদের যুবতী কন্যাদের বা স্ত্রীদের বাধ্য করা হতো। তারা নারীদেরকে পণ্য মনে করতো। তদের ধারণা করতো তাদের জমিদারীর বৃত্তে বসবাসরত নারীরা হলো তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এটা হলো সামন্তবাদী চেতনার বহিঃপ্রকাশ। ‘জমিদার দর্পণ’ নাটকে হায়ওয়ান আলীর কার্যকলাপে যে সেই সামন্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে।

হায়ওয়ান আলী তার সমস্ত কার্যকলাপ খুবই চাতুর্য ও ধূর্ততার সঙ্গে করতো। এসব অনৈতিক কাজের জন্য তার মধ্যে কোনো অনুশোচনা বা পাপবোধের সৃষ্টি হতো না। তার চরিত্রের অধঃপতন এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, সে ন্যূনতম মানবিক বোধশক্তি হরিয়ে ফেলেছিল। সে কারণে দেখা যায়, তার পাশবিক অত্যাচারে আবু মোল্লার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী নূরুন্নাহার মৃত্যুবরণ করলে সে মূঢ় হয়নি। বরং সে এঘটনা ধামাচাপ দেয়ার জন্য নানান কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল। কার্যসিদ্ধির সে উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গকে অর্থ দিয়ে বশে রেখেছিল। নূরুন্নাহারের মৃত্যুর ঘটনা সে এভাবেই চাপা দেয় বা মামলা থেকে বেকসুর খালাস পায়। কারণ অর্থ বলে কথা।

হায়ওয়ান আলীর অত্যাচারে প্রজাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। আবু মোল্লার সাথে তার আচরণ তারই বহিঃপ্রকশ। আবু মোল্লাকে ধরে আনার পর হায়ওয়ান আলীর উক্তি- তুই জানিস আমি তোর সব কর্ত্তে পারি। তোর ভিটা তোর ভিটায় ঘুঘু চরাতে পারি।……তুই ভেবেছিস কি? আমি তোকে মোজা কর্ব্বই কোর্ব্বো। …..হারামজাদা। আমি তোর ঘর বেচবো। তুই যেখান থেকে পারিস টাকা এনে দে। (সর্দ্দারগণের প্রতি) আরে তোরা এখনও ওর মাথায় ইট দিলিনি।” (প্রথম অঙ্ক: তৃতীয় গর্ভাঙ্ক)

শুধু হায়ওয়ান আলীর চরিত্রই প্রস্ফুটিত হয়নি। পাশর্^ চরিত্র হিসেবে উকিল, ডাক্তার, স্থানীয় আদালত প্রভৃতির প্রতিচিত্রও প্রস্ফুটিত। আবু মোল্লার স্ত্রী নূরুন্নাহার হত্যামামলা আদালতে শুরু হলে হায়ওয়ান সম্পর্কে উকিল সাফাই গেয়ে বলছে-” তিনি অতি ধনবান, বিশেষত বিচক্ষণ, ধর্মপরায়ণ, বয়স এ পর্যন্ত ৪০ বৎসর হয় নাই। তারা দ্বারা এমন কাজ হওয়া কখনই সম্ভব হয়না। কেবল মনোবাদ সাধন জন্য এই মিথ্যা নালিশ উপস্থিত হয়েছে। কোন সাক্ষীতেই এমন স্পষ্ট প্রমাণ দেয় নাই, যে আমার মক্কেল নূরুন্নাহার আওরতকে জবরান বলৎকার করেছেন; আর সেই বলৎকারে তার প্রাণ বিয়োগ হয়েছে। ফরিয়াদী আবু মোল্লাহ বড় ফেরেরবাজ।” (তৃতীয় অঙ্ক: দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক)

আবু মোল্লার আত্মীয় ও প্রতিবেশী জীতু মোল্লা এলাকার মোল্লা। সে চারবার হজ্ব করেছে। আদালতে তার সাক্ষ্য-

ব্যরি: মোল্লার জরু কি রকম মরেছে তুমি তার কিছু জান?

জীতু: জানবোনা ক্যা? আবুই মারতে মারতে এহবারে খুন করেছে…..।

ব্যারি: হায়ওয়ান আলী কেমন লোক আছে?

জীতু: (তেছকি ছুঁইয়া কপাল চুলকাইয়া মাথা নাড়িয়া) আহ এমন লোক দুনিয়া জাহানে আর নাই। বড় দ্বীনদার, বড় দাতা; মক্কা যাইবার সময় হামারে পঞ্চাশটি ট্যাহা দেয়।

ব্যরি: হায়ওয়ান আলী নূরুন্নাহারকে মারিয়াছে?

জীতু: (দুই গালে হাত দিয়া) তোবা তোবা, সে কি এমন কাজ কর্তে পারে, তা কহনো হবার যায়” (তৃতীয় অঙ্ক: তৃতীয় গর্ভাঙ্ক)

(নাবামলী গায়ে কৌপিন এবং বহির্বাণ পরিধান, সর্বাঙ্গে তিলক ছাপা, হস্তে-গলে তুলসীর মাহদা, কণ্ঠে কুড়জালী, বক্ষে ঝুলি, হরিনাসরুফ করিতে দ্বিতীয় সাক্ষী হরিদাসের প্রবেশ)

ব্যরি: আবু মোল্লার স্ত্রীকে কে খুন করিয়াছে তুমি জানো?

হরি: (মালা টিপিতে টিপিতে) রাধে কৃষ্ণ! আমি কিছুই জানিনা।

ব্যারি: কিছু শুনিয়াছ?

হরি: শুনেছি হুজুর।

ব্যারি: ক্যা শুনা হ্যায়?

হরি: হরিবোল! হরিবোল! হরিবোল! শুনেছি আবু মোল্লাহই মেরে ফেলেছে। উ: কি পাপিষ্ঠ! হরিবোল! হরিবোল!

ব্যারি: আবু মোল্লা কেমন লোক?

হরি: হুজুর সে বড় ফেরেরবাজ। একদিন আমি-

জজ: তুমি কি? ফেরর করিয়াছে?….. তুমি একদিন তুমি কি?

হরি: হুজুর! একদিন আমি ভিক্ষা করতে ওদের বাড়িতে গেছিলুম। ফাঁকি দিয়ে আমার ঝোলা দেখি বলে কেড়ে নিয়ে চালগুলো ঢেলে নিলে। শেষে ঝোলটা পায়ে পড়ে চেয়ে ছিলুম। ও বেটা ফেরে বাজ। ওর জ্বালায় গাঁয়ের লোক জ্বলে মলো। রাধে কৃষ্ণ। রাধে কৃষ্ণ!” (তৃতীয় অঙ্ক: তৃতীয় গর্ভাঙ্ক)

নূরুন্নাহারের লাশের ময়নাতদন্তকারী কর্মকর্তা ডাক্তার কালিং হাম বাইবেল চুম্বন করে বলেন-

I made the post mortem examination of the body of Nooron Nehar, healthy good looking woman, aged about twenty years sent by the officer incharge of Dharmapasha police station. No mark of external violence except on the general, profuse discharge of blood from the said part of the lungs highly congested of digesting away The skin of throat extravasation of blood observed, all other organs  found healthy, In (ত্রস্তভাবে) my opinion the must have dies of sanguineous apoplexy of the brain.” (তৃতীয় অঙ্ক: তৃতীয় গর্ভাঙ্ক)

ডাক্তারের স্ববিরোধী বক্তব্য বাদী পক্ষের উকিলের আপত্তি সত্ত্বেও জজ সাহেব ডাক্তারের বক্তব্য গ্রহণ করেন। আদালতে মামলা খারিজ হয়ে গেল বস্তুত “জমিদার দর্পণ” নাটকটিতে তৎকালীন সমাজ বাস্তবতার চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

দীনবন্ধু মিত্র রচিত ‘নীলদর্পণ’ এবং মীর মশাররফ রচিত ‘জমিদার দর্পণ’ নাটকদ্বয়ের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য

এদেশীয় চাষিদের উপর বিদেশী নীলকরদের নির্যাতনও শোষণের স্বরূপ উন্মোচন করে ১৮৬০ সালে দীনবন্ধু মিত্র লেখেন ‘নীলদর্পণ’ নাটক। এই নাটক প্রকাশের পর ঐ সময়ে দর্পণ নামাঙ্কিত অনেক নাটক লেখা ও প্রকাশিত হয়েছিল। অজ্ঞাতনাম জনৈক লিখিত সাক্ষ্য ‘দর্পণ’ (১৮৭১), গ্রামীণ জীবনের বাস্তবতা নিয়ে প্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের ‘পল্লী দর্পণ, (১৮৭৩), যোগেশ চন্দ্র ঘোষের ‘কেরানী দর্পণ’ (১৮৭৪), দক্ষিণাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘জেল দর্পণ’ (১৮৭৫)। এই দর্পণ ধারার নাটক ‘জমিদার দর্পণ’  প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭৩ সালে।

কার্যত ‘নীল দর্পণ’ এবং ‘জমিদার দর্পণ’ এই নাটকের নামকরণ, বিষয়বস্তু নির্বাচন, ঘটনা সংস্থান, চরিত্র-চিত্র ও মৌল উদ্দেশের মধ্যে সাদৃশ রয়েছে। উভয় নাটকের মৌল উদ্দেশ্য হলো সমাজ কাঠামোতে যে নির্যাতন ও শোষণ রয়েছে তার বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তোলা।

উভয় নাটকের মূল চরিত্র কৃষক বা সাধারণ মানুষ এক নাটকে নীলচাষি এবং অন্যটিতে প্রজা কৃষক। তবে নাটক দুটির মধ্যে মৌল পার্থক্য রয়েছে। আর সেটা হলো নীল দর্পণ নাটকে নীলকর তথা বিদেশী শোষকশ্রেণির শোষণ ও নির্যাতনের প্রতি চিত্র প্রস্ফুটিত। আর ‘জমিদার দর্পণ’ নাটকে দেশীয় পরজীবী জমিদার শ্রেণির চরিত্র ও কার্যাবলী এবং পাশাপাশি বিদেশী শাসনযন্ত্রের বাস্তবতা উন্মোচিত হয়েছে।

Cecero নাটক সম্বন্ধে বলেছেন- “A drama is a copy of life, mirror of  custom, reflection of truth.” ‘জমিদার দর্পণ’ নাটকে এ তিনটিরই যথার্থ প্রতিফলন ঘটেছে। বাস্তবত ‘জমিদার দর্পণ’ জমিদারি ব্যবস্থার বাস্তবতার পুনঃনির্মাণ।