০৬:৪৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

প্রিন্স ফিলিপ, ডিউক অব এডিনবরা কে? তাঁর সংক্ষিপ পরিচিতি

মু. মিজানুর রহমান মিজান
  • প্রকাশ: ০৫:৪৮:৩৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১০ এপ্রিল ২০২১
  • / ৯৭০ বার পড়া হয়েছে

প্রিন্স ফিলিপ, ডিউক অব এডিনবরা কে?

এপ্রিল ৯, ২০২১, শুক্রবার। এই দিন সকালে বাকিংহ্যাম প্যালেসের উইন্ডসর ক্যাসেলে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে পরপারে যাত্রা করেছেন ডিউক অব এডিনবরা, যার আসল নাম হলো প্রিন্স ফিলিপ। দুনিয়াজুড়ে প্রিন্স ফিলিপকে যুক্তরাজ্যের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্বামী হিসেবেই বেশি পরিচিত। ডিউক অব এডিনবরা খেতাব পাওয়া ফিলিপ বেঁচে ছিলেন নিরানব্বই বছর। যুক্তরাজ্যের রাজপরিবারের বরাত দিয়ে ফিলিপের মৃত্যুসংবাদটি প্রকাশ করে বিবিসি, সিএনএন, টেলিগ্রাফসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।

প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যু নিয়ে রাজপরিবার:

বাকিংহ্যাম প্যালেস থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, “মহামান্য রানি গভীর দুঃখের সাথে তাঁর প্রিয়তম স্বামী মহামান্য প্রিন্স ফিলিপ, ডিউক অব এডিনবরা, এর মৃত্যুর সংবাদ জানিয়েছেন।” এই বিবৃতিতে আরও জানানো হয় যে, প্রিন্স ফিলিপ এইদিন সকালে উইন্ডসর ক্যাসেলে শান্তির সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেছেন।”

প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যুতে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের বিবৃতি:

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী মিস্টার বরিস জনসন ডিউক অব এডিনবরা মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। ডাউনিং স্ট্রিটে তাঁর শোক প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, তিনি (প্রিন্স ফিলিপ) রাজপরিবার ও রাজতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে অনেক সহায়তা করেছেন যাতে এটি আমাদের জাতীয় জীবনের ভারসাম্য এবং সুখের জন্য অনিন্দ্যরূপে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকে থাকে। বরিস জনসন ফিলিপের অবদান প্রসঙ্গে বলার পূর্বে স্বীকার করেছেন, প্রিন্স ফিলিপ অসংখ্য তরুণকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। প্রিন্স ফিলিপ, ডিউক অব এডিনবরা, ছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি নিজের দেশ অর্থাৎ যুক্তরাজ্য, কমনওয়েলথ এবং সারা বিশ্বের ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন।

প্রিন্স ফিলিপ কে, তাঁর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:

ফিলিপ, জন্ম নাম প্রিন্স ফিলিপ অব গ্রিস অ্যান্ড ডেনমার্ক, গ্রিক ও ড্যানিস রাজপরিবারে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের ১০ তারিখ ডেনমার্কের করফু দ্বীপে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর বাবা প্রিন্স অ্যান্ড্রু অব ডেনমার্ক এবং মায়ের নাম প্রিন্সেস অ্যালাইস অব ব্যাটেনবার্গ। গ্রিক সিংহাসন আমলে নিলে তিনি সেখানে আরোহণ করার ক্রমে ছিলেন ষষ্ঠ স্থানে। ফিলিপের দাদা প্রথম জর্জ অব গ্রিস ছিলেন গ্রিকরাজা যাকে হত্যার পর সিংহাসনে আরোহণ করেন ফিলিপের চাচা কনস্ট্যানটাইন গ্রিকরাজা হিসেবে আবির্ভুত হন।

রানি এলিজাবেথের মতোই প্রিন্স ফিলিপের জন্ম ইউরোপের একটি রয়্যাল-ফ্যামিলিতে হলেও তাঁর বয়স যখন মাত্র আঠারো মাস, তখন তাঁর পরিবারকে নির্বাসিত করা হয়।

সাত বছর বয়সে ফিলিপকে যুক্তরাজ্যের চিম স্কুলে ভর্তি করানো হয়। এই সময়ে সে তাঁর দাদি ভিক্টরিয়া মাউন্টব্যাটেনের সাথে কেনসিংটন প্রাসাদে থাকতেন। এই সময়টিতে তিনি তাঁর বাবা এবং মায়ের সঙ্গ খুব একটা পাননি। কারণ মা সিজোনোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে একটি অ্যাসাইলামে ছিলেন আর বাবা তাঁর বাসস্থান পরিবর্তন করেছিল। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবেন কি না সেটিই নিশ্চিত ছিল না কারণ তখন তাঁর পরিবার আর্থিকভাবে সবল সাথানে তখন ছিল না। তবে সেখানে ফিলিপের জন্য আশির্বাদ হয়ে আসে তাঁর চার বোনের বিয়ে। ফিলিপের চার বোনের বিয়ে হয় জার্মান যুবরাজদের সাথে এবং তাঁরা জার্মানিতে চলে যান। ১৯৩৩ সালে ফিলিপও চলে যান জার্মানিতে। ফিলিপও জার্মানিতে ‘শিউল স্কুলস সালেম’ নামে একটি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এই বিদ্যালয়ের মালিকানা ছিল তাঁর এক ভগ্নিপতির যার কারণে এখানে পড়তে কোনো রকম ফিয়ের প্রয়োজন ছিল না। ফিলিপ এরপরে পড়াশোনা করেন ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্থিত আমেরিকান বিদ্যালয় ‘দ্য এলমস’। তিনি ছিলেন এই বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা নেওয়াদের মধ্যে প্রথম। ‘দ্য এলমস’ এর পরিচালক ম্যাকজান্নাত তাকে বলেছিলেন, “know it all smarty person, but always remarkably polite”. স্কটল্যান্ডের গর্ডনস্টোন স্কুল থেকে পড়াশোনা শেষ করে তিনি যোগ দেন যুক্তরাজ্যের ডার্টমাউথে অবস্থিত রয়্যাল নেভাল কলেজে। সেখান থেকে ১৯৩৯ সালের শুরুর দিকে ক্যাডেট হিসেবে মাত্র একটি টার্ম শেষ করে ফিরে যান গ্রিসে এবং মায়ের সাথে অ্যাথেন্সে থাকা শুরু করেন। তবে এই থাকাটা এক মাসের বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এই বিরতির পর ব্রিটেনে ফিরে রয়্যাল নেভিতে পুনরায় প্রশিক্ষণ শুরু করেন। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪০ সালে সাফল্যের সাথে ফিলিপ সবচেয়ে সেরা ক্যাডেটের তকমা নিয়ে কোর্স সমাপ্ত করেন। সেরা ক্যাডেটের পুরষ্কার হিসেবে তাকে সেখানের রয়্যাল নেভিতে চাকরি দেওয়া হয়। তাকে যে পদে চাকরি দেওয়া হয় সেটি ছিল পদক্রম হিসেবে সবচেয়ে নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, একে বলা হয় ‘মিডশিপম্যান’। বলাই বাহুল্য, এই সময়ে যে দ্বিতীয় বিশ্ব চলছিল তাতে যে ব্রিটেনের হয়ে লড়েছিল যদিও তাঁর ভহ্নিপতিরা জার্মানি হওয়ায় তাঁরা ছিলেন বিরোধী দলে।

ফিলিপ প্রথম দিকে ভারত মহাসাগরে দায়িত্ব পালন করলেও তাকে ভূমধ্যসাগরে স্থানান্তর করা হয় এবং পরের বছর, ১৯৪১, সাব-লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি পান। ১৯৪২ সালে সবচেয়ে কম বয়সী হিসেবে রয়্যাল নেভির লেফটেন্যান্ট হন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২১। এরপর ধীরেধীরে তিনি উপরের দিকেই উঠেছেন।

১৯৩৯ সালে রাজা ষষ্ঠ জর্ম এবং রানি এলিজাবেধ ডার্টমাউথে নেভাল কলেজ পরিদর্শনে যান। এই সফরে সঙ্গে ছিলেন দ্বিতীয় এলিজাবেধ এবং তাঁর ছোটো বোন মার্গারেট। সেই সময় দ্বিতীয় এলিজাবেথ ও মার্গারেটকে সঙ্গ দেওয়ার দায়িত্ব বা তাঁদের দেখে রাখার কিংবা আরও পরিষ্কারভাবে বললে বলতে হয় নিরাপত্তার দায়িত্ব পড়েছিল ফিলিপের ওপর। এখান থেকেই দ্বিতীয় এলিজাবেথ ফিলিপের প্রেমে পড়েন। তবে এ প্রেমের কথা রানি দ্বিতীয় এলিজবেথ সে সময় গোপন রাখেননি। ১৩ বছরের কিশোরী প্রকাশ করে দিলেন প্রিন্স ফিলিপের প্রতি তাঁর ভালোবাসার কথা।  দ্বিতীয় এলিজাবেথ ও প্রিন্স ফিলিপের ১৯৩৯ সালের আগেও দুই বার সাক্ষাৎ হয়েছিল- ১৯৩৪ ও ১৯৩৭ সালে।

১৯৪৬ সালে প্রিন্স ফিলিপ রাজা ষষ্ঠ জর্জের কাছে দ্বিতীয় এলিজাবেথকে বিয়ে করার আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং রাজা সেটা মেনে নেন। তবে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও এক বছর কারণ তখনও দ্বিতীয় এলিজাবেথের একুশ বছর পুরণ হয়নি।

প্রিন্স ফিলিপ ও দ্বিতীয় এলিজাবেথের বিয়ের পুর্বে একটি ঝামেলা বেঁধে যায়। অবশ্য এ ঝামেলা বেঁধে যাওয়াটাও খুবই স্বাভাবিক ছিল। প্রথমত, প্রিন্স ফিলিপ ব্রিটেনের ছিলেন না; দ্বিতীয়ত, তাঁর আত্মীয়রা অর্থাৎ ভগ্নিপতিরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ছিল বিরোধী দলে; তৃতীয়ত, প্রিন্স ফিলিপ রাজপরিবারের সন্তান হলেও তিনি ছিলেন সে পরিবার থেকে বিতারিত। রাজপরিবার থেকে কেউ কেউ ফিলিপকে গালমন্দও করেন তখন। তবে ব্রিটেনের রাজপরিবারের সবার আগ্রহে এই বিয়েটি সম্পন্ন হয়। এর আগে প্রিন্স ফিলিপকে তাঁর গ্রিক ও ড্যানিশ রাজউপাধি ছাড়তে হয়েছে এবং দাদির টাইটেল ‘মাউন্টব্যাটেন’ গ্রহণ করতে হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে বাগদান সম্পন্ন করা হয় জুলাই ১০, ১৯৪৭ খ্রি. এবং বিয়ে সম্পন্ন হয় নভেম্বর ২০, ১৯৪৭ খ্রি.। এই বিয়েতে অভিনন্দন জানিয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে দশ হাজারেরও বেশি টেলিগ্রাম পান এই নয়া দম্পতি। এরপর প্রিন্স ফিলিপ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দ্বিতীয় এলিজাবেথের পাশেই ছিলেন। একসঙ্গে অতিবাহিত করেছেন ৭৩ টি বছর।

বিয়ের পর ১৯৫২ সালে তিনি যে রাজদায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তা থেকে অবসর নেন ২০১৭ সালের ২ অগাস্ট। অবসরের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ছিয়ানব্বই বছর। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সাথে প্রিন্স ফিলিপের প্ল্যাটিনাম বিবাহবার্ষিকি পালিত হয় নভেম্বর ২০, ২০১৭ তারিখে যা ছিল ব্রিটিশ রাজপরিবারে ছিল প্রথম কোনো অভিজ্ঞতা। এর আগেও কখনোই ৭০তম বিবাহবার্ষিকি এই পরিবারে পালিত হয়নি।

প্রিন্স ফিলিপ রাজপরিবার ও রাজ্যের জন্য যা করেছেন তাঁর প্রশংসা সবাই করেন। তবে তাঁর একটি বড়ো রকমের বদঅভ্যেস ছিল। সেটি হলো- তিনি বেফাঁস মন্তব্য করার বেশ পটু ছিলেন। বা বিভিন্ন সময় এমন এমন কিছু কথা বলে ফেলতেন যা ব্রিটিশ রাজপরিবারকে সমালোচনায় ফেলে দিত। আবার বাবা হিসেবেও তিনি খুব কড়া স্বভাবের ছিলেন সন্তানদের কাছে।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

মু. মিজানুর রহমান মিজান

মু. মিজানুর রহমান মিজান একজন স্বাধীন শিক্ষামূলক লেখক। তিনি শিক্ষা গবেষণায় বেশ আগ্রহী। যৌথভাবে কিছু গবেষণায়ও অংশ নিয়েছেন।

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

প্রিন্স ফিলিপ, ডিউক অব এডিনবরা কে? তাঁর সংক্ষিপ পরিচিতি

প্রকাশ: ০৫:৪৮:৩৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১০ এপ্রিল ২০২১

এপ্রিল ৯, ২০২১, শুক্রবার। এই দিন সকালে বাকিংহ্যাম প্যালেসের উইন্ডসর ক্যাসেলে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে পরপারে যাত্রা করেছেন ডিউক অব এডিনবরা, যার আসল নাম হলো প্রিন্স ফিলিপ। দুনিয়াজুড়ে প্রিন্স ফিলিপকে যুক্তরাজ্যের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্বামী হিসেবেই বেশি পরিচিত। ডিউক অব এডিনবরা খেতাব পাওয়া ফিলিপ বেঁচে ছিলেন নিরানব্বই বছর। যুক্তরাজ্যের রাজপরিবারের বরাত দিয়ে ফিলিপের মৃত্যুসংবাদটি প্রকাশ করে বিবিসি, সিএনএন, টেলিগ্রাফসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।

প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যু নিয়ে রাজপরিবার:

বাকিংহ্যাম প্যালেস থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, “মহামান্য রানি গভীর দুঃখের সাথে তাঁর প্রিয়তম স্বামী মহামান্য প্রিন্স ফিলিপ, ডিউক অব এডিনবরা, এর মৃত্যুর সংবাদ জানিয়েছেন।” এই বিবৃতিতে আরও জানানো হয় যে, প্রিন্স ফিলিপ এইদিন সকালে উইন্ডসর ক্যাসেলে শান্তির সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেছেন।”

প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যুতে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের বিবৃতি:

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী মিস্টার বরিস জনসন ডিউক অব এডিনবরা মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। ডাউনিং স্ট্রিটে তাঁর শোক প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, তিনি (প্রিন্স ফিলিপ) রাজপরিবার ও রাজতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে অনেক সহায়তা করেছেন যাতে এটি আমাদের জাতীয় জীবনের ভারসাম্য এবং সুখের জন্য অনিন্দ্যরূপে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকে থাকে। বরিস জনসন ফিলিপের অবদান প্রসঙ্গে বলার পূর্বে স্বীকার করেছেন, প্রিন্স ফিলিপ অসংখ্য তরুণকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। প্রিন্স ফিলিপ, ডিউক অব এডিনবরা, ছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি নিজের দেশ অর্থাৎ যুক্তরাজ্য, কমনওয়েলথ এবং সারা বিশ্বের ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন।

প্রিন্স ফিলিপ কে, তাঁর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:

ফিলিপ, জন্ম নাম প্রিন্স ফিলিপ অব গ্রিস অ্যান্ড ডেনমার্ক, গ্রিক ও ড্যানিস রাজপরিবারে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের ১০ তারিখ ডেনমার্কের করফু দ্বীপে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর বাবা প্রিন্স অ্যান্ড্রু অব ডেনমার্ক এবং মায়ের নাম প্রিন্সেস অ্যালাইস অব ব্যাটেনবার্গ। গ্রিক সিংহাসন আমলে নিলে তিনি সেখানে আরোহণ করার ক্রমে ছিলেন ষষ্ঠ স্থানে। ফিলিপের দাদা প্রথম জর্জ অব গ্রিস ছিলেন গ্রিকরাজা যাকে হত্যার পর সিংহাসনে আরোহণ করেন ফিলিপের চাচা কনস্ট্যানটাইন গ্রিকরাজা হিসেবে আবির্ভুত হন।

রানি এলিজাবেথের মতোই প্রিন্স ফিলিপের জন্ম ইউরোপের একটি রয়্যাল-ফ্যামিলিতে হলেও তাঁর বয়স যখন মাত্র আঠারো মাস, তখন তাঁর পরিবারকে নির্বাসিত করা হয়।

সাত বছর বয়সে ফিলিপকে যুক্তরাজ্যের চিম স্কুলে ভর্তি করানো হয়। এই সময়ে সে তাঁর দাদি ভিক্টরিয়া মাউন্টব্যাটেনের সাথে কেনসিংটন প্রাসাদে থাকতেন। এই সময়টিতে তিনি তাঁর বাবা এবং মায়ের সঙ্গ খুব একটা পাননি। কারণ মা সিজোনোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে একটি অ্যাসাইলামে ছিলেন আর বাবা তাঁর বাসস্থান পরিবর্তন করেছিল। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবেন কি না সেটিই নিশ্চিত ছিল না কারণ তখন তাঁর পরিবার আর্থিকভাবে সবল সাথানে তখন ছিল না। তবে সেখানে ফিলিপের জন্য আশির্বাদ হয়ে আসে তাঁর চার বোনের বিয়ে। ফিলিপের চার বোনের বিয়ে হয় জার্মান যুবরাজদের সাথে এবং তাঁরা জার্মানিতে চলে যান। ১৯৩৩ সালে ফিলিপও চলে যান জার্মানিতে। ফিলিপও জার্মানিতে ‘শিউল স্কুলস সালেম’ নামে একটি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এই বিদ্যালয়ের মালিকানা ছিল তাঁর এক ভগ্নিপতির যার কারণে এখানে পড়তে কোনো রকম ফিয়ের প্রয়োজন ছিল না। ফিলিপ এরপরে পড়াশোনা করেন ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্থিত আমেরিকান বিদ্যালয় ‘দ্য এলমস’। তিনি ছিলেন এই বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা নেওয়াদের মধ্যে প্রথম। ‘দ্য এলমস’ এর পরিচালক ম্যাকজান্নাত তাকে বলেছিলেন, “know it all smarty person, but always remarkably polite”. স্কটল্যান্ডের গর্ডনস্টোন স্কুল থেকে পড়াশোনা শেষ করে তিনি যোগ দেন যুক্তরাজ্যের ডার্টমাউথে অবস্থিত রয়্যাল নেভাল কলেজে। সেখান থেকে ১৯৩৯ সালের শুরুর দিকে ক্যাডেট হিসেবে মাত্র একটি টার্ম শেষ করে ফিরে যান গ্রিসে এবং মায়ের সাথে অ্যাথেন্সে থাকা শুরু করেন। তবে এই থাকাটা এক মাসের বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এই বিরতির পর ব্রিটেনে ফিরে রয়্যাল নেভিতে পুনরায় প্রশিক্ষণ শুরু করেন। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪০ সালে সাফল্যের সাথে ফিলিপ সবচেয়ে সেরা ক্যাডেটের তকমা নিয়ে কোর্স সমাপ্ত করেন। সেরা ক্যাডেটের পুরষ্কার হিসেবে তাকে সেখানের রয়্যাল নেভিতে চাকরি দেওয়া হয়। তাকে যে পদে চাকরি দেওয়া হয় সেটি ছিল পদক্রম হিসেবে সবচেয়ে নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, একে বলা হয় ‘মিডশিপম্যান’। বলাই বাহুল্য, এই সময়ে যে দ্বিতীয় বিশ্ব চলছিল তাতে যে ব্রিটেনের হয়ে লড়েছিল যদিও তাঁর ভহ্নিপতিরা জার্মানি হওয়ায় তাঁরা ছিলেন বিরোধী দলে।

ফিলিপ প্রথম দিকে ভারত মহাসাগরে দায়িত্ব পালন করলেও তাকে ভূমধ্যসাগরে স্থানান্তর করা হয় এবং পরের বছর, ১৯৪১, সাব-লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি পান। ১৯৪২ সালে সবচেয়ে কম বয়সী হিসেবে রয়্যাল নেভির লেফটেন্যান্ট হন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২১। এরপর ধীরেধীরে তিনি উপরের দিকেই উঠেছেন।

১৯৩৯ সালে রাজা ষষ্ঠ জর্ম এবং রানি এলিজাবেধ ডার্টমাউথে নেভাল কলেজ পরিদর্শনে যান। এই সফরে সঙ্গে ছিলেন দ্বিতীয় এলিজাবেধ এবং তাঁর ছোটো বোন মার্গারেট। সেই সময় দ্বিতীয় এলিজাবেথ ও মার্গারেটকে সঙ্গ দেওয়ার দায়িত্ব বা তাঁদের দেখে রাখার কিংবা আরও পরিষ্কারভাবে বললে বলতে হয় নিরাপত্তার দায়িত্ব পড়েছিল ফিলিপের ওপর। এখান থেকেই দ্বিতীয় এলিজাবেথ ফিলিপের প্রেমে পড়েন। তবে এ প্রেমের কথা রানি দ্বিতীয় এলিজবেথ সে সময় গোপন রাখেননি। ১৩ বছরের কিশোরী প্রকাশ করে দিলেন প্রিন্স ফিলিপের প্রতি তাঁর ভালোবাসার কথা।  দ্বিতীয় এলিজাবেথ ও প্রিন্স ফিলিপের ১৯৩৯ সালের আগেও দুই বার সাক্ষাৎ হয়েছিল- ১৯৩৪ ও ১৯৩৭ সালে।

১৯৪৬ সালে প্রিন্স ফিলিপ রাজা ষষ্ঠ জর্জের কাছে দ্বিতীয় এলিজাবেথকে বিয়ে করার আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং রাজা সেটা মেনে নেন। তবে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও এক বছর কারণ তখনও দ্বিতীয় এলিজাবেথের একুশ বছর পুরণ হয়নি।

প্রিন্স ফিলিপ ও দ্বিতীয় এলিজাবেথের বিয়ের পুর্বে একটি ঝামেলা বেঁধে যায়। অবশ্য এ ঝামেলা বেঁধে যাওয়াটাও খুবই স্বাভাবিক ছিল। প্রথমত, প্রিন্স ফিলিপ ব্রিটেনের ছিলেন না; দ্বিতীয়ত, তাঁর আত্মীয়রা অর্থাৎ ভগ্নিপতিরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ছিল বিরোধী দলে; তৃতীয়ত, প্রিন্স ফিলিপ রাজপরিবারের সন্তান হলেও তিনি ছিলেন সে পরিবার থেকে বিতারিত। রাজপরিবার থেকে কেউ কেউ ফিলিপকে গালমন্দও করেন তখন। তবে ব্রিটেনের রাজপরিবারের সবার আগ্রহে এই বিয়েটি সম্পন্ন হয়। এর আগে প্রিন্স ফিলিপকে তাঁর গ্রিক ও ড্যানিশ রাজউপাধি ছাড়তে হয়েছে এবং দাদির টাইটেল ‘মাউন্টব্যাটেন’ গ্রহণ করতে হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে বাগদান সম্পন্ন করা হয় জুলাই ১০, ১৯৪৭ খ্রি. এবং বিয়ে সম্পন্ন হয় নভেম্বর ২০, ১৯৪৭ খ্রি.। এই বিয়েতে অভিনন্দন জানিয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে দশ হাজারেরও বেশি টেলিগ্রাম পান এই নয়া দম্পতি। এরপর প্রিন্স ফিলিপ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দ্বিতীয় এলিজাবেথের পাশেই ছিলেন। একসঙ্গে অতিবাহিত করেছেন ৭৩ টি বছর।

বিয়ের পর ১৯৫২ সালে তিনি যে রাজদায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তা থেকে অবসর নেন ২০১৭ সালের ২ অগাস্ট। অবসরের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ছিয়ানব্বই বছর। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সাথে প্রিন্স ফিলিপের প্ল্যাটিনাম বিবাহবার্ষিকি পালিত হয় নভেম্বর ২০, ২০১৭ তারিখে যা ছিল ব্রিটিশ রাজপরিবারে ছিল প্রথম কোনো অভিজ্ঞতা। এর আগেও কখনোই ৭০তম বিবাহবার্ষিকি এই পরিবারে পালিত হয়নি।

প্রিন্স ফিলিপ রাজপরিবার ও রাজ্যের জন্য যা করেছেন তাঁর প্রশংসা সবাই করেন। তবে তাঁর একটি বড়ো রকমের বদঅভ্যেস ছিল। সেটি হলো- তিনি বেফাঁস মন্তব্য করার বেশ পটু ছিলেন। বা বিভিন্ন সময় এমন এমন কিছু কথা বলে ফেলতেন যা ব্রিটিশ রাজপরিবারকে সমালোচনায় ফেলে দিত। আবার বাবা হিসেবেও তিনি খুব কড়া স্বভাবের ছিলেন সন্তানদের কাছে।