০৯:৫১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ২২ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

লাইলাতুল মেরাজ বা শবে মি’রাজের রজনী এক বিশেষ তাৎপর্যময় ও মহিমান্বিত রজনী

মোস্তাক আহ্‌মাদ
  • প্রকাশ: ১০:৫৯:২৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ মার্চ ২০২১
  • / ২৪০২ বার পড়া হয়েছে

মসজিদে নববি, মদিনা


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

ইসলামের ইতিহাস অনুযায়ী মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নবুওয়াত প্রকাশের একাদশ বৎসরের রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে প্রথমে কাবা শরিফ থেকে জেরুজালেমে অবস্থিত বায়তুল মুকাদ্দাস বা মসজিদুল আকসায় গমন করেন। সেখানে তিনি সকল নবীদের জামায়াতে ইমামতি করেন। অতঃপর তিনি বোরাক নামক বিশেষ বাহনে আসীন হয়ে উর্ধ্বলোকে গমন করেন। অতঃপর রফরফ নামক বাহনে চড়ে তিনি সিদরাতুল মুনতাহায় যান এবং সিদরাতুল মুনতাহা থেকে আরশে মুয়াল্লার লা-মাকানে গিয়ে মহান আল্লাহর সাক্ষাত লাভ করেন।

পবিত্র মি’রাজের ঘটনা ঘটেছিল বিশ্বনবীর নবুয়ত প্রকাশের ১১ বৎসর ৫ মাস ১৫ দিনের মাথায়। অর্থাৎ প্রকাশ্য নবুয়তের ২৩ বৎসরের দায়িত্ব পালনের মাঝামাঝি সময়ে। সে সময় হুযুর (সা.)-এর বয়স হয়েছিল ৫১ বৎসর ৫ মাস ১৫ দিন। সন ছিল নবুয়তের দ্বাদশ সাল। তিনটি পর্যায়ে মি’রাজকে ভাগ করা হয়েছে। মক্কাশরিফ থেকে বায়তুল মোকাদ্দাস পর্যন্ত মি’রাজের অংশকে বলা হয় আল ইস্রা বা রাত্রি ভ্রমণ। বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে সিদরাতুল মুন্তাহা পর্যন্ত অংশকে বলা হয় মি’রাজ। সিদ্রাতুল মুন্তাহা থেকে আরশ ও লা-মাকান পর্যন্ত অংশকে বলা হয় পূর্ণ মি’রাজ। কিন্তু সাধারণভাবে পূর্ণ ভ্রমণকেই এক নামে মি’রাজ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। কুরআন, হাদিসে মোতাওয়াতির এবং খবরে ওয়াহেদ দ্বারা যথাক্রমে এই তিনটি পর্যায়ের মি’রাজ প্রমাণিত।

মসজিদে নববি, মদিনা
মসজিদে নববি, মদিনা। ছবি: Sulthan Auliya

বিশ্বনবী (সা.)-এর মি’রাজের দলিল ভিত্তিক পূর্ণ বিবরণ

এই মি’রাজের মাধ্যমে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সচক্ষে আল্লাহর দীদার লাভ করার দ্বারা সূরতে হাক্কীর সুস্পষ্ট দলিল বিশ্ববাসীর সম্মুখে উপস্থিত করেছেন। বিশ্বের সকল জ্ঞানী ও ভাবুকশ্রেণির জন্য এতে নিদর্শন রয়েছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উর্ধ্বজগতের মু’যিজা সমূহের মধ্যে মি’রাজ গমন একটি বিস্ময়কর মু’যিজা। এজন্যই মি’রাজের বর্ণনায় সুরা বনি ইস্রাইলের আয়াতের শুরুতেই আল্লাহ পাক ‘সোব্হানাল্লাহ্’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন— যা কেবল আশ্চর্যজনক ঘটনার ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। স্বশরীরে মি’রাজ গমনের প্রমাণ স্বরূপ কুরআনের ‘বিআব্দিহী’ শব্দটি তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, ‘আবদুন’ শব্দটি দ্বারা রূহ ও দেহের সমষ্টিকে বুঝান হয়েছে। তদুপরি- বোরাক প্রেরণ ও বোরাক কর্তৃক নবী করিম (সা.)-কে বহন করে নিয়ে যাওয়ার মধ্যেও স্বশরীরে মি’রাজ গমনের প্রমাণ পাওয়া যায়।

সর্বোপরি-স্বপ্নে বা রূহানীভাবে মি’রাজের দাবী করা হলে কোরাইশদের মধ্যে এত হৈ চৈ হতোনা। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সকল ইমামগণই স্বশরীরে মি’রাজ গমনের পক্ষে জোরালো মত প্রকাশসহ দলিল পেশ করছেন। এছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ের ওলামায়ে কেরামগণ এ কথা স্বীকার করেছেন।

মি’রাজের ঘটনাটি নবীজীর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, এর সাথে গতির সম্পর্ক এবং সময় ও স্থানের সঙ্কোচনের তত্ত্ব জড়িত রয়েছে। সূর্যের আলোর গতি সেকেণ্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। পৃথিবীতে সূর্যের আলো পৌঁছতে লাগে আট মিনিট বিশ সেকেণ্ড। এ হিসেবে পৃথিবী হতে সূর্যের দূরত্ব নয় কোটি তিরিশ লক্ষ মাইল। অথচ নবী করিম (সা.) মুহূর্তের মধ্যে চন্দ্র, সূর্য, সিদ্রাতুল মুন্তাহা, আরশ-কুরছি ভ্রমণ করে লা-মাকানে আল্লাহর দীদার লাভ করে নব্বই হাজার কালাম করে পুনরায় মক্কা শরিফে ফিরে আসেন। এসে দেখেন, বিছানা এখনও গরম রয়েছে। এর চেয়ে আশ্চর্য আর কি হতে পারে? নবী করিম (সা.)-এর নূরের গতি কত ছিল, এ থেকেই অনুমান করা যায় তাঁর গুরুত্ব ও মর্যাদা কত বেশি ছিল। কেননা, তিনি ছিলেন নূর। যাওয়ার সময় বোরাক ছিল কিন্তু ফেরার সময় বোরাক ছিল না। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন থেকে যায় তিনি একাকী অথবা বিশেষভাবে ফিরে এসেছেন। এ সবই তাঁর একক মর্যাদা বা হাকীকতের অংশবিশেষ।

—রুহুল বয়ান

মি’রাজের মধ্যে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—অন্যান্য নবীগণের সমস্ত মু’যিজা নবী করিম (সা.)-এর মধ্যে একত্রিত হয়েছিল। হযরত মুসা (আ.) তূর পর্বতে আল্লাহর সাথে কালাম করেছেন। হযরত ঈসা (আ.) স্বশরীরে আকাশে অবস্থান করছেন এবং হযরত ইদ্রিছ (আ.) স্বশরীরে বেহেস্তে অবস্থান করছেন। তাঁদের চেয়েও উন্নত মাকামে ও উচ্চমর্যাদায় আল্লাহপাক নবী করিম (সা.)-কে নিয়ে সবার উপরে মর্যাদা প্রদান করেছেন। মুসা (আ.) নিজে গিয়েছিলেন তূর পর্বতে। কিন্তু আমাদের প্রিয়নবী (সা.)-কে আল্লাহ্ তায়ালা দাওয়াত করে বোরাকে চড়িয়ে ফেরেস্তাদের মিছিলসহকারে প্রথমে বায়তুল মোকাদ্দাসে নিয়েছিলেন। সেখানে সব নবীগণকে স্বশরীরে উপস্থিত করে হুযুর করিম (সা.)-এর মোক্তাদী বানিয়েছিলেন। সেদিনই সমস্ত নবীগণের ইমাম হয়ে নবী করিম (সা.) ‘নবীগণেরও নবী’ রূপে বাস্তবে প্রমাণিত হয়েছিলেন। সেদিন সমস্ত নবীগণ অষ্ট অঙ্গ (দুই হাত, দুই পা, দুই হাঁটু, নাক ও কপাল) দিয়ে স্বশরীরে নামায আদায় করেছিলেন। সমস্ত নবীগণ যে স্বশরীরে জীবিত, তারই বাস্তব প্রমাণ মিলেছিল মি’রাজের রাত্রে। সমস্ত নবীগণ আপন আপন রাওযায় জীবিত আছেন।

—আল-হাদিস

মি’রাজের রাত্রে নবী করিম (সা.)-কে প্রথম সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিলো জিব্রাইল, মিকাইল ও ইস্রাফিল ফেরেস্তাসহ তাঁদের অধীনে সত্তর হাজার ফেরেস্তা দ্বারা দ্বিতীয় সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিল বাইতুল মোকাদ্দাসে নবীগণের (আ.) দ্বারা। তৃতীয় সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিল আকাশের ফেরেস্তা, হুর ও নবীগণের দ্বারা এবং চতুর্থ ও শেষ সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। সিদ্রাতুল মুন্তাহা এবং আরশ মোয়াল্লা অতিক্রম করার পর স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা একশত বার সম্বর্ধনামূলক বাক্য আদ্নু মিন্নি ইয়া মুহাম্মদ (সা.) অর্থাৎ ‘হে প্রিয় বন্ধু মুহাম্মদ, আপনি আমার অতি নিকটে আসুন’ একথা বলে নবী করিম (সা.)-কে সম্মানিত করেছিলেন। পবিত্র কুরআন মজিদে ছুম্মা দানা ফাতাদাল্লা এর উল্লেখই তার ইঙ্গিতবহ বলে ‘তাফসীরে মুগ্নী’ ও ‘মিরছাদুল ইবাদ’ নামক গ্রন্থদ্বয়ের বরাত দিয়ে ‘রিয়াজুন্নাছেহীন’ কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে। উক্ত কিতাবখানা সাত শত বৎসর পূর্বে ফারসি ভাষায় লিখিত।

মি’রাজের প্রথম পর্যায়

রজব চাঁদের ২৬ দিবাগত রাত অর্থাৎ ২৭ তারিখ সোমবার পূর্ব রাত্রের শেষাংশে প্রিয়নবী (সা.) রায়তুল্লায় অবস্থিত বিবি উম্মেহানী (রা.)-এর ঘরে অবস্থান করছিলেন। বিবি উম্মেহানী (রা.) ছিলেন আবু তালেবের কন্যা এবং নবী করিম (সা.)-এর দুধবোন। উক্ত গৃহটি ছিল বর্তমান হেরেম শরিফের ভিতরে পশ্চিম দিকে। হযরত জিব্রাইল (আ.) ঘরের ছাদ দিয়ে প্রবেশ করে নূরের পাখা দিয়ে, অন্য রেওয়াত মোতাবেক-গণ্ডদেশ দিয়ে নবী করিম (সা.)-এর কদম মোবারকের তালুতে স্পর্শ করতেই হুযুরের তন্দ্রা টুটে যায়। জিব্রাইল (আ.) আল্লাহর পক্ষ হতে দাওয়াত জানালেন এবং প্রিয় নবীজীর সাথে দিদার লাভের জন্য মহান আল্লাহর মনোবাসনার কথা জানালেন। অন্যদিকে নিকটেই বোরাক দণ্ডায়মান ছিল। বোরাকের আকৃতি ছিল অদ্ভুত ধরনের। গাধার চেয়ে উঁচু খচ্চরের চেয়ে নিচু, মুখমণ্ডল মানুষের চেহারাসদৃশ, পা উটের পায়ের মত এবং পিঠের কেশর ঘোড়ার মত।

—রুহুল বয়ান-সুরা বনি ইস্রাইল

মূলত বোরাক ছিল বেহেস্তী বাহন—যার গতি ছিল দৃষ্টি সীমান্তে মাত্র এক কদম। নবী করিম (সা.) বোরাকে সওয়ার হওয়ার চেষ্টা করতেই বোরাক নড়াচড়া শুরু করলো। জিব্রাইল (আ.) বললেন—‘তোমার পিঠে সৃষ্টির সেরা মহামানব সওয়ার হচ্ছেন, সুতরাং তুমি স্থির হয়ে যাও।’ বোরাক বললো, ‘কাল হাশরের দিনে নবী করিম (সা.) আমার জন্য আল্লাহর দরবারে শাফাআত করবেন বলে ওয়াদা করলে আমি স্থির হবো।’ নবী করিম (সা.) ওয়াদা করলেন। বোরাক স্থির হলো। তিনি বোরাকে সওয়ার হলেন। জিব্রাইল (আ.) সামনে লাগাম ধরে, মিকাইল (আ.) রিকাব ধরে এবং ইস্রাফিল (আ.) পিছনে পিছনে অগ্রসর হলেন। পিছনে সত্তর হাজার ফেরেস্তার মিছিল। এ যেন দুল্হার সাথে বরযাত্রী। প্রকৃতপক্ষে নবী করিম (সা.) ছিলেন আরশের দুল্হা।

—তাফসীরে রুহুল বয়ান

মক্কাশরিফ থেকে রওনা দিয়ে পথিমধ্যে মদিনার রওযা মোবারকের স্থানে গিয়ে বোরাক থামলো। জিব্রাইলের ইশারায় তথায় তিনি দু’রাকাত নামায আদায় করলেন। এভাবে ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মস্থান বাইতুল লাহাম এবং মাদ্ইয়ান নামক স্থানে হযরত শুয়াইব (আ.)-এর গৃহের কাছে বোরাক থেকে নেমে নবী করিম (সা.) দু’রাকাত করে নামায আদায় করলেন। এজন্যই বরকতময় স্থানে নামায আদায় করা সুন্নত। এই শিক্ষাই এখানে রয়েছে। নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন, আমি বোরাক থেকে দেখতে পেলাম, হযরত মুসা (আ.) তাঁর মাযারে (জর্দানে) দাঁড়িয়ে নামায পড়ছেন।

অতঃপর জিব্রাইল (আ.) বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদের সামনে বোরাক থামালেন। সমস্ত নবীগণ পূর্ব হতেই সেখানে স্বশরীরে উপস্থিত ছিলেন। জিব্রাইল (আ.) বোরাককে রশি দিয়ে বায়তুল মোকাদ্দাসের ছাখ্রা নামক পবিত্র পাথরের সাথে বাঁধলেন এবং আযান দিলেন। সমস্ত নবীগণ (আ.) নামাযের জন্য দাঁড়ালেন। হযরত জিব্রাইল (আ.) নবী করিম (সা.)-এর ইমামতিতে সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরাম ও সত্তর হাজার ফেরেস্তাকে নিয়ে দু’রাকাত নামায আদায় করলেন। তখনও কিন্তু নামায ফরয হয়নি। প্রশ্ন জাগে, নামাযের আদেশ নাযিল হওয়ার পূর্বে হুযুর (সা.) কিভাবে ইমামতি করলেন? এতে বুঝা গেল, তিনি নামাযের নিয়ম কানুন পূর্বেই জানতেন। নামাযের তা’লীম তিনি পূর্বেই পেয়েছিলেন, তানযীল বা নাযিল হয়েছে পরে। আজকে প্রমাণিত হলো, নবী করিম (সা.) হলেন ইমামুল মোরছালীন ও নবীউল আম্বিয়া (আ.)।

বিশ্বনবী (সা.)-এর ইমামতিতে নামায শেষে আয়োজিত সংক্ষিপ্ত সভায় নবীগণ নিজেদের পরিচয় দিয়ে বক্তব্য পেশ করলেন। সর্বশেষ সভাপতি (মীর মজলিস) হিসাবে ভাষণ রাখলেন নবীগণের নবী, বিশ্বজাহানের রতমত রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত মুহাম্মাদ (সা.)। তাঁর ভাষণে আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা করে তিনি বললেন—‘আল্লাহ পাক আমাকে আদম সন্তানদের মধ্যে সর্দার, আখেরী নবী ও রাহমাতুল্লিল আলামীন বানিয়ে প্রেরণ করেছেন।’

[এখানে একটি আক্বিদার প্রশ্ন জড়িত আছে। তা হলো, আম্বিয়ায়ে কেরামগণের মধ্যে তিনজন ব্যতীত আর সকলেই ইতিপূর্বে ইনতিকাল করেছেন এবং তাঁদের রওযা মোবারকও বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত।

যে তিনজন নবী জীবিত, তাঁরা হচ্ছেন—হযরত ইদ্রিছ (আ.) বেহেশতে, হযরত ঈসা (আ.) আকাশে এবং হযরত ইলিয়াছ (আ.) স্থলভাগের দায়িত্বে। তবে চার নম্বর হযরত খিযির (আ.) নবী কিনা সে নিয়ে মতভেদ আছে। অনেকের মতে তিনি হচ্ছেন অলি, যিনি জলভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন এবং কেয়ামত পর্যন্ত মওলা আলীর বেলায়েতের বিতরণকারী হিসেবে তিনি নিয়োজিত।

জীবিত ও ইনতিকালপ্রাপ্ত সকল আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ.) বিভিন্ন স্থান থেকে মুহূর্তের মধ্যে কিভাবে স্বশরীরে বায়তুল মোকাদ্দাসে উপস্থিত হলেন? তাফসীরে রুহুল বয়ানে এ প্রশ্নের উত্তর এভাবে দেয়া হয়েছে—‘জীবিত তিনজন নবীকে আল্লাহ তায়ালা স্বশরীরে এবং ইন্তিকালপ্রাপ্ত আম্বিয়ায়ে কেরামগণকে মেছালী শরীরে বায়তুল মোকাদ্দাসে উপস্থিত করেছিলেন।’ কিন্তু অন্যান্য গ্রন্থে স্বশরীরে উপস্থিতির কথা উল্লেখ আছে। কেননা, নবীগণ অষ্ট অঙ্গ দ্বারা সিজদা করেছিলেন। নবীগণ ও অলীগণ মেছালী শরীর ধারণ করে মুহূর্তের মধ্যে আসমান জমিন ভ্রমণ করতে পারেন এবং জীবিত লোকদের মতই সবকিছু শুনতে ও দেখতে পারেন।

—মিরকাত ও তাইছির গ্রন্থ

আধুনিক থিউসোফিতেও (আধ্যাত্মবাদ) একথা স্বীকৃত। ফিজিক্যাল বডি, ইথিক্যাল বডি, কস্যাল বডি, এসট্রাল বডি-ইত্যাদি রূপ ধারণ করা একই দেহের পক্ষে সম্ভব এবং বাস্তব বলেও আধুনিক থিউসোফির বিজ্ঞানীগণ স্বীকার করেছেন। আমরা মুসলমান। আল্লাহর কুদরত ও প্রদত্ত ক্ষমতার উপর আমাদের ঈমান নির্ভরশীল। এ বিষয়ে কবি গোলাম মোস্তফার বিশ্বনবী বইখানায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

মি’রাজের দ্বিতীয় পর্যায়

মি’রাজের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে এবং শেষ হয় সিদ্রাতুল মুন্তাহাতে গিয়ে। প্রথম আকাশে গিয়ে জিব্রাইল (আ.) ডাক দিলেন প্রথম আকাশের ভারপ্রাপ্ত ফেরেস্তাকে এবং দরজা খুলে দিতে বললেন। উক্ত ফেরেস্তা পরিচয় নিয়ে হুযুর (সা.)-এর নাম শুনেই দরজা খুলে দিলেন। প্রথমেই সাক্ষাত হলো হযরত আদম (আ.)-এর সাথে। হুযুর (সা.) তাঁকে ছালাম দিলেন। কেননা ভ্রমণকারীকেই প্রথমে সালাম দিতে হয়। হযরত আদম (আ.) নবীগণের আদি পিতা। তাই তাঁকে দিয়েই প্রথম অভ্যর্থনা শুরু করা হলো। হযরত আদম (আ.)-এর নেতৃত্বে অন্যান্য আম্বিয়ায়ে কেরাম এবং প্রথম আকাশের ফেরেস্তারা উক্ত অভ্যর্থনায় যোগদান করেন। এমনিভাবে দ্বিতীয় আকাশে হযরত ঈসা, হযরত যাকারিয়া ও হযরত ইয়াহ্ইয়া (আ.) এবং অন্যান্য নবী ও ফেরেস্তারা অভ্যর্থনা জানালেন।

হযরত যাকারিয়াও উক্ত অভ্যর্থনায় শরীক ছিলেন। নবী করিম (সা.) তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন—‘যখন আপনাকে করাত দ্বারা দ্বিখণ্ডিত করা হচ্ছিল, তখন আপনার কেমন অনুভব হয়েছিল?’ উত্তরে যাকারিয়া (আ.) বললেন— ‘তখন আল্লাহ তায়ালা আমাকে ডাক দিয়ে বলেছিলেন, আমি তোমার সাথে আছি। এতদশ্রবণে আমি মউতের কষ্ট ভুলে গিয়েছিলাম।’ প্রকৃত আশেকগণের মউতের সময় নবীজীর দিদার নছিব হয়। তাই তাঁদের মউতের কষ্ট অনুভূত হয় না।

—আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া : যাকারিয়া অধ্যায়।

তৃতীয় আকাশে হযরত ইউসুফ (আ.)-এর নেতৃত্বে অন্যান্য নবী ও ফেরেস্তাগণ নবী করিম (সা.)-কে অভ্যর্থনা জানান এবং ছালাম কালাম বিনিময় করেন। চতুর্থ আকাশে হযরত ইদ্রিছ (আ.), পঞ্চম আকাশে হযরত হারুন (আ.) ফেরেস্তাগণসহ অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। ৬ষ্ঠ আকাশে হযরত মুসা (আ.)-এর সাথে সাক্ষাত হয়। তিনি অভ্যর্থনা জানিয়ে বিদায়কালে আশ্চর্য হয়ে বললেন—‘এই যুবক নবী শেষকালে এসেও আমার পূর্বে বেহেস্তে যাবেন এবং তাঁর উম্মতগণ আমার উম্মতের পূর্বে বেহেস্তে প্রবেশ করবে।’ হযরত মুসা (আ.) নবী করিম (সা.) ও তাঁর উম্মতের বিশেষ মর্যাদা দেখে আনন্দাশ্র“র কান্না কেঁদেছিলেন। যেমন মা সন্তানের কোন সুসংবাদ শুনতে পেলে আনন্দে কেঁদে ফেলেন। তাঁর এই আফ্সোস ছিল আনন্দসূচক ও স্বীকৃতিমূলক- বিদ্বেষমূলক নয়, এটাকে ঈর্ষা বলে। গিব্তা বা ঈর্ষা করা শরিয়তে জায়েয কিন্তু হাছাদ বা হিংসা করা জায়েয নয়।

—মিশকাত শরিফ

হযরত মুসা (আ.) সে সময় নবী করিম (সা.)-এর নিকট একটি হাদিসের ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছিলেন। হাদিসটি হলো- নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন— ‘আমার উম্মতের যাহেরি-বাতেনি এলেমসম্পন্ন আলেমগণ বনি ইসরাইলের নবীগণের ন্যায়। এটা শুধুমাত্র এলেম ও আমলের ক্ষেত্রে, নবুয়তের মর্যাদার ক্ষেত্রে নয়।

নবী করিম (সা.) উক্ত হাদিসের যথার্থতা প্রমাণের জন্য রূহানী জগত থেকে ইমাম গাযালী (রা.)-কে হযরত মুসা (আ.)-এর সামনে হাযির করালেন। হযরত মুসা (আ.) বললেন, ‘আপনার নাম কি?’ উত্তরে ইমাম গাযালী (রা.) নিজের নাম, পিতার নাম, দাদার নাম, পরদাদার নামসহ ছয় পুরুষের নাম বললেন। হযরত মুসা (আ.) বললেন, ‘আমি শুধু আপনার নাম জিজ্ঞেস করেছি। আপনি এত দীর্ঘ তালিকা পেশ করলেন কেন?’ ইমাম গাযালী (রা.) আদবের সাথে জবাব দিলেন—‘আড়াই হাজার বৎসর পূর্বে আপনিও তো আল্লাহ তায়ালার ছোট্ট একটি প্রশ্নের দীর্ঘ উত্তর দিয়েছিলেন।’ ইমাম গাযালীর (রা.)-এর এলেম ও প্রজ্ঞা দেখে হযরত মুসা (আ.) মুগ্ধ হয়ে গেলেন এবং হুযুর (সা.)-এর হাদিসখানার তাৎপর্য স্বীকার করে নিলেন।

—রুহুল বয়ান তৃতীয় পারা ২৪৮ পৃষ্ঠা

[এখানে একটি বিষয় তাৎপর্যপূর্ণ। হযরত মুসা (আ.)-এর ইন্তিকালের আড়াই হাজার বৎসর পরে মক্কার জমিনে প্রদত্ত হুযুর (সা.)-এর ভাষণ তিনি শুনতে পেয়েছিলেন, আপন রওযা থেকে। অপরদিকে দুনিয়াতে আসার পূর্বে আলমে আরওয়াহ্ থেকে ইমাম গাযালী (রা.)-এর মত একজন বিজ্ঞ অলী আড়াই হাজার বৎসর পূর্বে তুর পর্বতে ঘটে যাওয়া মুসা (আ.)-এর ঘটনা সম্পর্কেও অবগত ছিলেন। এতে প্রমাণিত হলো—আল্লাহর নবী ও অলীগণকে আল্লাহ তায়ালা বাতেনি প্রজ্ঞা দান করেছেন, যাকে নূরে নযর বা ফিরাছাত বলা হয়। আল্লাহর অলীগণ আল্লাহ প্রদত্ত কাশ্ফ দ্বারা অনেক সময় মানুষের মনের গোপন কথাও বলে দিতে পারেন। ইমাম অবু হানিফা (রা.) কুফার এক মসজিদে জনৈক মুসল্লিকে অযু করতে দেখে বলেছিলেন—

‘তুমি যিনা করে এসেছো।’ লোকটি অবাক হয়ে বললো, ‘আপনি কিভাবে জানলেন?’ ইমাম আবু হানিফা (রা.) বললেন— ‘তোমার অযুর পানির সাথে যিনার গুনাহ্ ঝরে পড়ছিল।’

হাদিসেও অযুর পানির সাথে গুনাহ্ ঝরে পড়ার কথা উল্লেখ আছে। লোকটি ইমাম সাহেবের বাতেনি এলেম দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলো এবং সাথে সাথে ইমাম সাহেবের হাতে তওবা করলো। বড়পীর হযরত গাউছুল আ’যম আবদুল কাদের জিলানী (রা.) বাহজাতুল আসরার কিতাবে বলেন :

অনুবাদ—‘দুনিয়ার নেককার ও বদকার, সকলকেই আমার দৃষ্টিতে পেশ করা হয় লওহে মাহ্ফুযে।’ লওহে মাহ্ফুযে নেককার-বদকার সকলের তালিকা রয়েছে। হযরত বড়পীর (রা.)-এর নযরও দুনিয়া থেকে লওহে মাহ্ফুযে নিবদ্ধ। এজন্যই মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি (রা.) মসনবী শরিফে বলেছেন যার অনুবাদ—‘লওহে মাহ্ফুয অলী-আল্লাহগণের নযরের সামনে। একারণেই তাঁদের দিব্যদৃষ্টি সমস্ত ত্রুটি থেকে মুক্ত।’

অতঃপর হযরত মুসা (আ.) থেকে বিদায় নিয়ে নবী করিম (সা.) জিব্রাইল (আ.)সহ সপ্তম আকাশে গেলেন। সেখানে হযরত ইব্রাহীম (আ.) ফেরেস্তাগণসহ নবী করিম (সা.)-কে অভ্যর্থনা জানালেন। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আমি হযরত ইব্রাহীম (আ.)-কে একটি কুরছিতে বসে বাইতুল মামুর মসজিদের গায়ে হেলান দিয়ে বসা অবস্থায় দেখতে পেয়েছি।’

—রুহুল বয়ান

হযরত ইব্রাহীম (আ.) দুনিয়াতে আল্লাহর ঘর কা’বাশরিফ তৈরি করেছিলেন। তার বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সপ্তাকাশের বাইতুল মামুর মসজিদের মোতাওয়াল্লীর সম্মান দান করেছেন। দীর্ঘ এক হাদিসে এসেছে—বাইতুল মামুরে হুযুর (সা.)-এর সাথে নামায আদায় করেছিলেন সাদা পোশাকধারী একদল উম্মত—যাদের মধ্যে গাউসুল আযম (রা.)ও ছিলেন।

—আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান, ইরফানে শরিয়ত তৃতীয় খণ্ড

আসমানে ভ্রমণের সময়ই নবী করিম (সা.) বেহেস্ত ও দোযখ প্রত্যক্ষ করেন। পরকালে বিভিন্ন পাপের কি রকম শাস্তি হবে, তার কিছু নমুনা তিনি মেছালী ছুরতে প্রত্যক্ষ করেছেন। সুদ, ঘুষ, অত্যাচার, সালাত বর্জন, ইয়াতিমের মাল ভক্ষণ, প্রতিবেশীর উপর যুলুম, স্বামীর অবাধ্যতা, বেপর্দা ও অন্য পুরুষকে নিজের রূপ প্রদর্শন, যিনা, ব্যভিচার ইত্যাদির শাস্তি নবী করিম (সা.) স্বচক্ষে দেখেছেন।

বেহেস্তে হযরত খাদিজা (রা.)-এর জন্য সংরক্ষিত প্রাসাদ, হযরত বেলালের (রা.) পাদুকার আওয়ায—এসব দেখেছেন এবং শুনেছেন। বেহেস্তের চারটি নহরের উৎসস্থল নবী করিম (সা.)-কে দেখান হয়েছে।

বিস্মিল্লাহর চারটি শব্দের শেষ চারটি হরফ মিম, হা, নুন, মিম থেকে চারটি নহর প্রবাহিত হয়ে হাউযে কাউছারে পতিত হতে দেখেছেন। দুধ, পানি, শরবত ও মধু-এই চার প্রকারের পানীয় বেহেস্তবাসীকে পান করানো হবে। যারা ভক্তি ও ঈমানের সাথে প্রত্যেক ভাল কাজ বিস্মিল্লাহ বলে শুরু করবে, তাদের জন্য এই নেয়ামত রাখা হয়েছে।

—তাফসীরে রুহুল বয়ানে বিস্মিল্লাহর ব্যাখ্যায় এর বিস্তরিত বিবরণ দেয়া হয়েছে

সপ্ত আকাশ ভ্রমণের পর জিব্রাইল (আ.) খাদেম হিসাবে বা প্রটোকল হিসাবে নবী করিম (সা.)-কে সিদ্রাতুল মুন্তাহা বা সীমান্তের কুলবৃক্ষের নিকট নিয়ে যান। হাদিসে এসেছে, ‘এ বৃক্ষের পাতা হাতীর কানের মত বড় এবং ফল উহুদ পাহাড়ের ন্যায় বড়। শহীদগণের রূহ মোবারক সবুজ পাখীর সুরতে উক্ত বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করছেন।’ নবী করিম (সা.) স্বচক্ষে তা দর্শন করেছেন। সিদরা বৃক্ষ পৃথিবীর সপ্ত তবক নিচ থেকে চৌদ্দ হাজার বছরের রাস্তার উপরে অবস্থিত। সিদ্রা থেকে আরশের দূরত্ব ছত্রিশ হাজার বৎসরের রাস্তা। সর্বমোট পঞ্চাশ হাজার বৎসরের দূরত্বে আরশে মোয়াল্লা।

—ইবনে আব্বাস

আরশে মোয়াল্লা থেকেই আল্লাহ তায়ালার যাবতীয় নির্দেশ ফিরিস্তাগণের নিকট আসে। হযরত জিব্রাইল (আ.) সিদ্রাতুল মুন্তাহা থেকেই আল্লাহ তায়ালার যাবতীয় নির্দেশ গ্রহণ করে থাকেন। এখানে এসেই জিব্রাঈলের গতি শেষ হয়ে যায়।

মি’রাজের তৃতীয় পর্যায়: সিদ্রা হতে আরশে আজিম পর্যন্ত

সিদ্রাতুল মুন্তাহায় পৌঁছে জিব্রাইল (আ.) নবী করিম (সা.) থেকে বিদায় নিলেন এবং বললেন— ‘সিদ্রাতুল মুন্তাহা থেকে এক আঙ্গুল পরিমাণ এবং অন্য রেওয়াতে চুল পরিমাণ অগ্রসর হলে আমার ছয়শত নূরের পাখা আল্লাহর নূরের তাজাল্লীতে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাবে।’ সোব্হানাল্লাহ!

যেখানে নূরের ফেরেস্তা জিব্রাইল (আ.) জ্বলে যায়, সেখানে আমাদের প্রিয়নবী (সা.) স্বশরীরে স্বচ্ছন্দে সামনে অগ্রসরমান। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি—‘তিনি আল্লাহর যাতী নূরের জ্যোতি হতে পয়দা হয়েছেন।’ বুঝা গেল- তিনি মাটি নন। মাটি হলে তলায় জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে যেতেন। জিব্রাইল (আ.) আমাদের নবীজীর (সা.) নূরের সামান্যতম অংশের তাজাল্লী দিয়ে সৃষ্টি। যেখানে জিব্রাইলের গতি শেষ, সেখান থেকে আমাদের নবীজীর (সা.) যাত্রা শুরু।

তাই হাকিকতে মুহাম্মদী (সা.) সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে হলে হযরত জিব্রাইল (আ.) নবীজীকে কেমন দেখেছিলেন। জিব্রাইলও বলতে পারবেন না, তার পরের ঘটনা কি ঘটেছিল। ফিরতি পথে হুযুর (সা.)-এর স্বরূপ কেমন ছিল—তা জানতে হবে মুসা (আ.)-এর কাছে। সেদিন তিনি প্রকৃতপক্ষে কাকে দেখেছিলেন? বিদায়ের সময় জিব্রাইল (আ.) নবী করিম (সা.)-এর কাছে একটি আরয পেশ করেছিলেন—‘আল্লাহ যেন হাশরের দিনে জিব্রাইলকে পুলছিরাতের উপর তার ছয়শত নূরের পাখা বিছিয়ে দেয়ার অনুমতি দান করেন।’ উম্মতে মুহাম্মদী যেন উক্ত পাখার উপর দিয়ে পুলসিরাত পার হয়ে যেতে পারে।

নবী করিম (সা.) আল্লাহর দরবারে জিব্রাইলের এই ফরিয়াদ পেশ করলে আল্লাহ তায়ালা ছাহাবায়ে কেরাম ও আহ্লে মহব্বতের লোকদের জন্য তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। আল্লাহ্ পাক বলেছিলেন— ‘জিব্রাইলের পাখার ওপর দিয়ে পুলছিরাত অতিক্রম করার আরজি মঞ্জুর করা হলো, আপনার সাহাবী এবং আশেকানদের জন্য। যারা আপনাকে এবং আপনার পরিজনকে অধিক মহব্বত করবে তারা এবং আপনার সাহাবাদ্বয় এই দুই শ্রেণির লোক জিব্রাইলের পাখার উপর দিয়ে পুলছিরাত পার হয়ে যাবে।’

—মাওয়াহেব লাদুন্নিয়া।

জিব্রাইল (আ.) থেকে বিদায় হওয়ার পর রফরফ নামে এক বাহন এসে নবী করিম (সা.)-কে আরশে আযিমে পৌঁছিয়ে দেয়। এ পথে নবী করিম (সা.) সত্তরটি নূরের পর্দা ভেদ করেন। এক এক পর্দার ঘনত্ব ছিল পাঁচশত বৎসরের রাস্তা। এ হিসাবে ৩৬ হাজার বৎসরের রাস্তা অতিক্রম করে নবী করিম (সা.) আরশে মোয়াল্লায় পৌঁছলেন। এ পথে যখন তিনি একাকীত্ব অনুভব করছিলেন, তখন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর আওয়ায শুনতে পেয়ে শান্ত হয়েছিলেন। আর একটি আওয়াজও তিনি শুনতে পেয়েছিলেন : ‘হে প্রিয় মুহাম্মদ (সা.), আপনি একটু থামুন, আপনার রব সালাত পাঠ করছেন।’ আল্লাহর সাথে দীদারের সময় নবী করিম (সা.) এ দু’টি বিষয়ের রহস্য জানতে চাইলেন। আল্লাহ তায়ালা বললেন, ‘আমার সালাত অর্থ আপনার উপর দরূদ পাঠ করা। আর আবু বকরের সুরতে এক ফেরেস্তা সৃষ্টি করে আবু বকরের আওয়াজ নকল করা হয়েছিল, যেন আপনি শান্ত হন।’

মহিউদ্দিন ইবনে আরবী (রা.)-এর তাফসীরে বলা হয়েছে, হযরত আবু বকর সিদ্দিকই (রা.) রূহানীভাবে ফিরিস্তার সূরতে তথায় উপস্থিত ছিলেন। এটা ছিল তাঁর কারামত। কেননা তিনি ছিলেন রাসুলে পাকের নিত্যসঙ্গী। তিনি দুনিয়াতে, মাযারে, হাশরের ময়দানে এবং জান্নাতেও নবী করিম (সা.)-এর সঙ্গী থাকবেন। সুতরাং মি’রাজে রূহানীভাবে উপস্থিত থাকা খুবই স্বাভাবিক।

—দেখুন : ইরফানে শরিয়ত

আরশে পৌঁছার পর লাওহে মাহফুয অবলোকনকালে নবী করিম (সা.) দেখতে পেলেন, তথায় শেষ বাক্যটি লেখা ছিল এরূপ :

ক্বাদ সাবাকাত রাহমাতি আলা গাজাবী

অর্থ—‘আমার গযবের উপর আমার রহমত প্রাধান্য বিস্তার করে রয়েছে।’

উক্ত হাদিসে কুদসীর মধ্যে উম্মতের জন্য একটি গোপন ইশারা নিহিত রয়েছে। তা হলো- কিছু শাস্তি ভোগ করার পর সমস্ত হকপন্থী উম্মতই আল্লাহর রহমতে নাজাত পাবে। অর্থাৎ নবী করিম (সা.)-এর যেসব উম্মতের উপর গোনাহের কারণে গযব উপস্থিত হবে বিশ্বনবী রহমাতুল্লিল আলামীনের রহমত দ্বারা সেই গযব দূরীভূত হবে। কিন্তু নূরনবী (সা.) আরশের মাঝে এই লেখা দেখে বুঝতে পারলেন যে, তিনি শুধু উম্মতের জন্যই রহমত নন বরং সমস্ত সৃষ্টিকুলের জন্য রহমত। তাই তিনি আরশকে জিজ্ঞেস করলেন—‘আমি সমগ্র জাহানের জন্য রহমত, তোমার জন্য কিরূপে রহমত যা স্বয়ং আল্লাহর সিংহাসন?’ আরশ তখন আরয করলো, ‘আল্লাহ তায়ালা যখন আমার মধ্যে কলেমার প্রথম অংশ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ লিখলেন, তখন আল্লাহর জালালী শানে আমার মধ্যে কম্পন সৃষ্টি হয়েছিল। মনে হয়েছিল যেন আমি টুক্রো টুকরো হয়ে যাব। তারপর যখন তার পার্শ্বে আপনার জামালী নামের অংশটুকু, ‘মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ’ লিখে দিলেন, তখন আমার কম্পন বন্ধ হয়ে গেল সুতরাং আপনি আমার জন্য বিরাট রহমত।’

—শানে হাবীব

বিশ্বনবী (সা.)-এর মি’রাজের দ্বিতীয় অংশ

লা মাকানের উদ্দেশ্যে রওনা

আরশ মোয়াল্লা হতে এবার লা-মাকানের দিকে-অজানার পথে রওনা দিলেন নবী করিম (সা.)- যেখানে স্থান, কাল বলতে কিছুই নেই। সমগ্র সৃষ্টিগতই তখন নবীজীর কদমের নিচে। আসমান, জমিন, চন্দ্র-সূর্য, আরশ কুর্ছি সবকিছু, এমনকি- আলমে খালক (সৃষ্টি জগত) ও আলমে আমর (নির্দেশ জগত) সবকিছুই তখন নবী করিম (সা.)-এর পদতলে রয়ে গেল। তিনি সমস্ত কিছু অতিক্রম করে আল্লাহর এত নিকটবর্তী হলেন যে, দুই ধনুকের চার মাথার ব্যবধান বা তার চেয়েও কম ব্যবধান রয়ে গেল। এটা রহস্য জগত। এ অবস্থাকে মুতাশাবিহাত বা দুর্বোধ্য অবস্থা বলা হয়। কুরআন মজিদে এই মাকামকে (ক্বাবা কাওছাইন) বলা হয়েছে। শারিরীক সান্নিধ্য এখানে উদ্দেশ্য নয় বরং তার চেয়েও আরও ঘনিষ্ঠ। আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্য ও ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য বুঝানো।

তাফসীরে রুহুল বয়ান তৃতীয় পারা প্রথম আয়াতের তাফসীর বর্ণনা করা হয়েছে যে, ‘নবী করিম (সা.)-এর নূরানী সুরতের বহিঃপ্রকাশ হয়েছিল সে সময়। তাঁর বাশারিয়াত সে সময় উন্নত হতে হতে নূরে ওয়াহ্দানিয়াতের মধ্যে মিশে গিয়েছিল’ যেমন মিশে যায় পানিতে চিনি। এই মাকামকে তাসাওউফের ভাষায় ‘ফানা’ বলা হয়। রুহুল বয়ানের এবারতটুকুর অনুবাদ পাঠকদের জন্য উদ্ধৃত করা হল।

অনুবাদ—‘নবী করিম (সা.) লাইলাতুল মি’রাজে কোন স্থানে বা সৃষ্টি জগতে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। কেননা, তখন তিনি তাঁর জড় অস্তিত্বের অন্ধকার ভেদ করে ফানা হয়ে আল্লাহর নূরের অস্তিত্বে অস্তিত্ববান হয়েছিলেন। এ কারণেই কুরআন মজিদে (সুরা মায়েদা-১৫ আয়াত) আল্লাহ তায়ালা তাঁকে ‘নূর’ বলে আখ্যায়িত করে এরশাদ করেছেন, ‘হে জগতবাসী! তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ হতে প্রথমে এক মহান নূর ও পরে একটি স্পষ্ট কিতাব এসেছে।’

বুঝা গেল—তিনি দুনিয়াতে আগমনকালেই নূর ছিলেন—মাটি নয়। যারা মাটি বলে, তারা ভ্রান্ত। (তাফসীরে রূহুল বয়ান পৃষ্ঠা ৩৯৫ তৃতীয় পারা ১ম আয়াত)। উক্ত আয়াতের পূর্ণ বিকাশ হয়েছিল ‘ক্বাবা কাওছাইন’ মাকামে।

আল্লাহর সাথে কালাম

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাথে নবী করিম (সা.)-এর কি কি কথোপকথন হয়েছিল, তা কুরআনে গোপন রাখা হয়েছে। শুধু ইরশাদ হয়েছে—‘ফা-আওহা ইলা আব্দিহী মা আওহা’

অর্থ—‘যা গোপনে বলার—আল্লাহ তায়ালা তা আপন প্রিয় বান্দার কাছে গোপনেই বলে দিয়েছেন।’ নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন উতিতুল উলুমা উমিরতু বেকিতমানি বা‘আদ্বিহা

অর্থ—‘আমাকে অনেক প্রকারের গুপ্ত-সুপ্ত এলেম দান করা হয়েছে এবং সাথে সাথে ঐ এলেমের কোন কোন বিষয় গোপন রাখতেও আমাকে নির্দেশ করা হয়েছে।’

কাসাসুল আম্বিয়া নামক উর্দ্দূ কিতাবে নব্বই হাজার কালামের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তন্মধ্যে ত্রিশ হাজার কালাম হাদিসের আকারে সকলের জন্য এবং ত্রিশ হাজার কালাম খাছ খাছ লোকদের নিকট প্রকাশ করার জন্য এবং অবশিষ্ট ত্রিশ হাজার সম্পূর্ণ নিজের কাছে গোপন রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন।

—তাফসীরে ছাভী দেখুন; সুরা নিসা : ১১৩ আয়াত

তাফসীরে রুহুল বয়ানে বর্ণনা করা হয়েছে যে, নবী করিম (সা.) এক পর্যায়ে আল্লাহর দরবারে আরয করেছিলেন—‘আমার উম্মতকে সর্বশেষে এবং কিয়ামতের নিকটবর্তী করে কেন পাঠান হলো এবং তাদের হায়াত পূর্বের তুলনায় কম রাখা হলো কেন?’ উত্তরে আল্লাহ তায়ালা বলেছিলেন, ‘আপনার উম্মতগণ যেন গুনাহ্ করার সময় কম পায়, সেজন্য তাদের হায়াত সংকীর্ণ করেছি এবং আপনার উম্মত যেন কম সময় কবরে থাকে—তাই তাদেরকে কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে সর্বশেষে প্রেরণ করেছি।’ সুব্হানাল্লাহ! এই সময়ের সদ্ব্যবহার করা প্রত্যেক জ্ঞানী লোকেরই উচিত। নবীজীর উম্মত হওয়ার কারণেই আমাদেরকে এ সুযোগ দেয়া হয়েছে।

প্রত্যক্ষ দর্শন

আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছার পর প্রথমে নবী করিম (সা.) আল্লাহর প্রশংসা করলেন এভাবে ‘আত্তাহিয়্যাতু লিল্লাহি ওয়াস্সালাওয়াতু ওয়াত্তইয়্যেবাতু’

অর্থ—‘আমার জবান, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও ধন-সম্পদ দ্বারা যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য হাদিয়া স্বরূপ পেশ করছি।’

এর উত্তরে আল্লাহ তায়ালা নবীজীকে ছালাম দিয়ে বললেন—‘আস্সালামু আলাইকা আইয়্যুহান্নাবিউ ওয়া রহ্মাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু’

অর্থ—‘হে আমার প্রিয় নবী, আপনার প্রতি আমার ছালাম, রহমত ও বরকতসমূহ বর্ষিত হোক।’ উক্ত ছালামের জবাবে নবী করিম (সা.) আরয করলেন—‘আস্সালামু আলাইনা ওয়া‘আলা ইবাদিল্লাহিস স্বলিহীন।’

অর্থ—‘হে আল্লাহ! তোমার ছালাম এবং আমি আমার গুনাহ্গার উম্মতের উপর এবং তোমার অন্যান্য নেককার বান্দাদের উপরও বর্ষিত হোক!’

আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের এই ছালাম বিনিময়ের কৌশলপূর্ণ উক্তি ও ভালবাসার নমুনা এবং উম্মতের প্রতি নবীজীর স্নেহ মমতা দেখে ও শুনে জিব্রাইল (আ.)সহ আকাশের মোকাররাবীন ফেরেস্তাগণ সমস্বরে বলে উঠলেন—‘আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আব্দুহু ওয়া রাসূলুহু’

অর্থ—‘আমি (প্রত্যেকে) সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই এবং আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.) আল্লাহর অতি প্রিয় বান্দা এবং তাঁর প্রিয় রাসুল।’

‘আল্লাহর কাছে তিনি প্রিয় বান্দা কিন্তু বিশ্ব জগতের কাছে তিনি প্রিয় রাসুল।’ কি যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক এখানে বর্ণনা করা হয়েছে- তা কেবল মহাজ্ঞানীরাই অনুধাবন করতে পারবেন।

আল্লাহ তায়ালা নিজের ও হাবীবের মধ্যে ভাব বিনিময়ের এই তাশাহুদ আমাদের নামাযের একটি ওয়াজিব অংশ করে দিয়েছেন। এর প্রতিটি শব্দ নামাযের বৈঠকে ওয়াজিব করে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালার দরবারে নবী করিম (সা.) যেভাবে সম্মোধনমূলক তাহিয়্যাত পাঠ করেছিলেন এবং আল্লাহ তায়ালাও যেভাবে সম্বোধন করে নবীজীকে ছালাম দিয়েছিলেন, অনুররূপভাবেই তাশাহ্দু পড়ার সময় প্রত্যেক মুছল্লিকে আল্লাহকে সম্বোধন করে তাহিয়্যাত অংশটুকু পাঠ করতে হবে এবং নবী করিম (সা.)-কেও সম্বোধন করে ছালাম পেশ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে ফতোয়া শামীর এবারত এর হুবহু অনুবাদ—

অর্থ—‘আল্লাহর তাহিয়্যাত এবং রাসুলের প্রতি ছালাম পাঠকালীন সময়ে খেতাব বা সম্বোধন করতে হবে। শুধু মি’রাজের ঘটনা বর্ণনা করা উদ্দেশ্য নয়।’

—ফতোয়ায়ে শামী, ফতোয়ায়ে আলমগীরী ও বাহারে শরীয়ত দ্রষ্টব্য

যেহেতু মুমিনদের জন্য নামায মি’রাজ স্বরূপ সুতরাং মি’রাজের মতই আল্লাহ ও রাসুলকে সম্বোধন করতে হবে। সম্বোধন করা হয় হাযির নাযির ব্যক্তিকে। সুতরাং নবীজী হাযির ও নাযির।

—ইমাম গাযালীর ইহ্ইয়া

উম্মতের জন্য মাগফিরাতের সুপারিশ

রিয়াজুন্নাছেহীন কিতাবে তাফসীরে মুগনী ও মিরছাদুল ইবাদ নামক দুটি গ্রন্থের সূত্রে বর্ণিত আছে—নবী করিম (সা.)-কে আল্লাহ তায়ালা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি আমার কাছে কি প্রার্থনা করেন?’ নবী করিম (সা.) বললেন—‘হে আল্লাহ! আপনি রাব্বুল আলামীন, আর আমাকে বানিয়েছেন রাহমাতুল্লিল আলামীন। আমার উম্মত বেশুমার গুনাহগার মুযনেবীন। আমার খাতিরে আমার গুনাহগার উম্মতকে মাফ করে দিন।’ আল্লাহ তায়ালা বললেন—‘আপনার খাতিরে আপনার উম্মতের মধ্য হতে সত্তর হাজারকে ক্ষমা করার প্রতিশ্র“তি দিচ্ছি।’ এরপর আর কি প্রার্থনা আছে? নবী করিম (সা.) পুনরায় গুনাহগার উম্মতের কথা উল্লেখ করলেন। এভাবে ৭০০ (সাতশত) বার প্রার্থনা করলেন। প্রত্যেকবার সত্তর হাজার করে গুনাহগার উম্মতের ক্ষমার কথা ঘোষণা করলেন পাক পরওযারদেগার। এভাবে চার কোটি নব্বই লক্ষ উম্মতকে ঐ দিন ক্ষমার আওতায় আনা হলো।

নবী করিম (সা.) উম্মতের মায়ায় আবারও আরয পেশ করলেন। আল্লাহ তায়ালা এবার বললেন—‘এখন আপনি ও আমি একা। হাশরের ময়দানে ফেরেস্তা, আম্বিয়া, আউলিয়া ও হাশরবাসীদের সবার সামনে অবশিষ্টকে ক্ষমা করবো। আপনি চাইবেন—আমি দেবো। সবাই সাক্ষী থাকবে এবং আপনার মর্তবা তখন সকলেই উপলব্ধি করবে।’ সোব্হানাল্লাহ! এমন শাহী দরবারে গিয়েও নবী করিম (সা.) নিজের ও পরিবারের জন্য কিছুই না চেয়ে শুধু গুনাহগার উম্মতের নাজাত প্রার্থনা করেছেন। সত্যিই তিনি ঈমানদারদের জন্য রাউফ ও রাহীম। সুরা তওবার শেষাংশ এরশাদ হয়েছে : বিলমু’মেনিনা রাউফুর রাহীম।

অর্র্থাৎ—‘নবী করিম (সা.) মোমেনদের জন্য স্নেহময় ও দয়াশীল।’ এই স্নেহ ও দয়ার বহিঃপ্রকাশ হয়েছিল মি’রাজের রাত্রিতে এবং ভবিষ্যতে হবে হাশরের ময়দানে। যখন আল্লাহর ভয়ে কেউ সুপারিশের জন্য অগ্রসর হবে না- তখন নবী করিম (সা.) হতাশ হাশরবাসীদেরকে অভয় দিয়ে বলবেন, ‘আনা-লাহা, তোমাদের শাফাআতের জন্য আমি আছি’—সুব্হানাল্লাহ!

—বোখারী ও মুসলিম

মি’রাজ হতে ষষ্ঠ আকাশে প্রত্যাবর্তন ও পুনঃগমন

অনেক নায ও নেয়াযের কথার পর আল্লাহ তায়ালা উম্মতে মুহাম্মদীর উপর দিনে রাত্রে ৫ ওয়াক্ত নামায এবং একমাস রোজা ফরয করলেন নবী করিম (সা.)-কে বিদায় দিলেন। নবী করিম (সা.) যখন ৬ষ্ঠ আকাশে আসলেন, তখন মুসা (আ.)-এর সাথে সাক্ষাত হলো। সিদ্রাতুল মুন্তাহাতে জিব্রাইল (আ.), কিংবা সপ্তম আকাশে হযরত ইব্রাহীম (আ.), কিংবা অন্য কোন আকাশে অন্যান্য নবীগণের সাথে সাক্ষাতের উল্লেখ কোন হাদিসগ্রন্থে দেখা যায় না। শুধু মুসা (আ.)- এর উল্লেখ রয়েছে।

—বোখারী মুসলিম, মিশকাত প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থ

নামায পাঁচ ওয়াক্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার হেকমত তাফসীরে রুহুল বয়ান, ইতকান, বেদায়া নেহায়া—প্রভৃতি গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। ফজর নামায হযরত আদম (আ.) আদায় করতেন। যোহরের নামায হযরত ইব্রাহীম (আ.) আদায় করতেন, আসরের নামায হযরত ইউনুছ (আ.) আদায় করতেন, মাগরিবের নামায হযরত ঈসা (আ.) আদায় করতেন এবং এশার নামায হযরত মুসা (আ.) আদায় করতেন।

এভাবে আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করে পাঁচজন পয়গাম্বরের পাঁচ ওয়াক্ত নামায একত্রিত করে উম্মতে মুহাম্মদীকে দান করলেন। সুতরাং নামাযের ইবাদতটি নবীগণের স্মৃতি বহনকারীও বটে।

[মূলত প্রত্যেক ইবাদতের মধ্যেই, এমনকি প্রত্যেক তসবিহ্-এর মধ্যেও কোন না কোন নবী, অলী অথবা ফেরেস্তার ইবাদতের স্মৃতি বিজড়িত আছে। যেমন—হজ্বের মধ্যে হযরত ইব্রাহীম, কোরবানীর মধ্যে হযরত ইসমাইল (আ.), সাঈ-এর মধ্যে বিবি হাজেরা এবং আরাফাতে অবস্থানের মধ্যে হযরত আদম (আ.)-এর স্মৃতি জড়িত। নামাযের মধ্যে কিয়াম, রুকু, সিজদা, তছবিহ্ ইত্যাদি ফেরেস্তাদের ইবাদতের স্মৃতি—যা নবী করিম (সা.) মি’রাজে প্রত্যক্ষ করে এসেছেন। নবী করিম (সা.) প্রথমে নিজে আমল করেছেন। পরে আমাদেরকে হুকুম করেছেন—হুযুর (সা.)-কে দেখে দেখে অনুসরণ করার জন্য। সুতরাং নবী করিম (সা.)-এর অনুকরণ ও অনুসরণের নামই ইবাদত—যার মধ্যে রয়েছে অন্যদের স্মৃতি বিজড়িত।

—জালালুদ্দীন সূয়ুতি কৃত শরহে সুদূর

এখন প্রশ্ন হল লা মাকান থেকে আল্লাহর দরবারে বিশ্বনবী (সা.)-এর যাতায়াত বা দুনিয়াতে ফেরত আসার ক্ষেত্রে রফরফ বা বোরাক ব্যবহারের উল্লেখ হাদিসের কিতাবে সরাসরি পাওয়া যায় না। তাফসীরে রুহুল মাআনিতে বলা হয়েছে : যেভাবে বোরাকে করে নবী করিম (সা.) মি’রাজ গমন করেছেন, সেভাবেই আবার ফেরত এসেছেন। এটাই স্বাভাবিক ধারণা। তাফসীরে রুহুল বয়ান তাফসীরে রুহুল মাআনিরও পূর্বে রচিত- তাই এর মতামত অধিক শক্তিশালী। উক্ত তাফসীরে রুহুল বয়ানের গ্রন্থকার সুরা নাজম-এর প্রথম তিনটি আয়াত-এর ব্যাখ্যায় বলেছেন : ওয়ান্নাজমি + ইজা হাওয়া + মা দল্লা সাহিবুকুম ওয়ামা গাওয়া +

অনুবাদ—‘নিম্নগামী তারকার শপথ! তোমাদের সাথী মুহাম্মদ (সা.) কখনও পথ ভুলেননি বা পথভ্রষ্ট হননি এবং টেরা বাঁকাও হননি।’

তাফসীরকারক বলেন, উক্ত আয়াত মি’রাজের ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত। সাধারণ অর্থে অস্তমিত তারকা হলেও ইমাম জাফর সাদেক (রা.)-এর মতে ‘নাজম দ্বারা উক্ত আয়াতে নবী করিম (সা.) কেই বুঝা হয়েছে। কেননা হুযুর (সা.)-এর এক হাজার নামের মধ্যে আন-নাজম একটি নাম। আর হাওয়া অর্থ নিম্নগামী। তাহলে আয়াতের অর্থ দাঁড়ায়—‘আল্লাহর দরবার থেকে নিম্নগামী তারকা মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)-এর শপথ!’ আর ‘পথ ভুলেননি বা টেরা বাঁকা হননি’- এই মন্তব্যের অর্থ: ‘যে পথে তিনি এসেছিলেন, সেপথেই ফিরত গিয়েছেন।’

বোরাক বা রফরফের মাধ্যমে প্রত্যাবর্তন করলে একথার প্রয়োজন হতো না। কেননা, তখন তো বোরাক বা রফরফই তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতো। সুতরাং নবী করিম (সা.) মি’রাজ থেকে আসাকালীন সময়ে আল্লাহর কুদরতে একা একা যাতায়াত করেছেন— এটাই সুস্পষ্ট। কেননা, তিনি তো নূর। নূর ও আলো সব কিছু ভেদ করে সোজা গতিতে ধাবিত হয়, এটাই বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত। শুধু বাইতুল মোকাদ্দাসে এসে বোরাকে আরোহণ করে তিনি মক্কায় পৌঁছেন। ৭০০ বৎসর পূর্বের ফারসী গ্রন্থ ‘রিয়াযুন নাসিহীন’-এ ইমাম জা’ফর সাদেক (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে—‘মি’রাজ’ হতে ফিরে আসার পথে রফরফ, বোরাক বা ফিরিস্তা -কিছুই সাথে ছিল না।’

—তাফসীরে ইবনে আব্বাস রুহুল বয়ান- সুরা আন নাজম

অন্য কথা হল, নবী রাসুলগণ! ইন্তিকালের আড়াই হাজার বৎসর পরও স্বশরীরে উপস্থিত থাকতে পারেন। যেমন মুসা (আ.) ও বিশ্বনবী (সা.)-এর সাক্ষাত।

তাফসীরে সাভীতে উল্লেখ আছে, হজরত মুসা আ. তূর পর্বতে আল্লাহর দীদার চেয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এমনকি আল্লাহর যে তাজাল্লী তূর পর্বতে আপতিত হয়েছিল—মুসা (আ.) ঐ তাজাল্লীতে বেঁহুশ হওয়ার কারণে তাও দর্শন করতে পারেননি। কিন্তু মি’রাজের রাত্রিতে নবী করিম (সা.) আল্লাহর সান্নিধ্যে ফানা হয়ে আল্লাহর যে তাজাল্লী নিয়ে এসেছিলেন—তা দেখে হযরত মুসা (আ.)-এর তূর পর্বতের সেই সাধ পুনরায় জেগে ওঠে। তাই তিনি বার বার আল্লাহর তাজাল্লী দর্শনের জন্যই রাসুলে করিম (সা.)-এর চেহারা মোবারকের দিকে দৃষ্টি দিয়েছিলেন। আর মহান আল্লাহও তাঁর অপূরণীয় মনের বাসনাকে পূরণের ব্যবস্থা হিসেবে বিশ্বনবীর সাথে তাঁর সাক্ষাত করিয়ে দেন। সুব্হানাল্লাহ!

তাফসীরে সাভী ২য় খণ্ড ৪১৯ পৃ.

আ’লা হযরত শাহ আহ্মদ রেযা (রা.) বলেন—

অনুবাদ—‘মুছা (আ.) সেদিন কাকে দেখেছিলেন এবং তাঁর মাধ্যমে কার প্রতিচ্ছবি দেখেছিলেন—তা মুসা (আ.) কেই জিজ্ঞেস করো। তিনি নূরে মুহাম্মদ (সা.) কে দর্শনের মাধ্যমে স্বয়ং আল্লাহর নূরের তাজাল্লিই প্রত্যক্ষভাবে দর্শন করেছিলেন। দিব্যদৃষ্টি সম্পন্ন লোকদের দিব্য জ্ঞানের উপর শত সহস্র ছালাম।’

—হাদায়েকে বখশিষ—আ’লা হযরত।

বিশ্বখ্যাত মাওলানা, সুফিকুল শিরোমণি আল্লামা জালালুদ্দীন রুমি (রা.) বলেছেন—

‘মুস্তফা আয়নায়ে মিল্লে খোদাস্ত,

মুন আকাছ দর ওয়ায় হামা খোয়ে খোদাস্ত।’

—মসনবী শরীফ

অর্থ—নবী মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন আল্লাহর নূরানী তাজাল্লী দর্শনের আয়না স্বরূপ। ঐ আয়নাতেই আল্লাহর পবিত্র যাতের সবকিছু প্রতিবিম্বিত ও প্রতিফলিত হয়।

পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি হযরত আল্লামা শরফুদ্দিন বুসরী (র.)-কে যিনি হাবীব পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শানে তাঁর প্রশংসাগীতি কাছিদায়ে বুরদা রচনা করে দীর্ঘদিনের পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থা প্যারালাইসিস রোগ থেকে মুক্তিলাভ করেছিলেন। হাবীব পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শানে কাছিদায়ে বুরদার কিছু অংশ—

আলহামদু লিল্লাহি মুনশিয়েল খাল্কি মিন আদামি

ছুম্মাস্ সালাতু আলাল মুখতারি ফীল কাদামি

মাওলায়া, সাল্লি ওয়া সাল্লিম দায়িমান আবাদা

আলা হাবীবিকা খায়রিল খালকি কুল্লিহিমি

—কাছিদায় বুরদা

খোদার সৃষ্টি জগতও জানে না তাদের সৃষ্টির মূল উৎসের রহস্য সন্ধান। এমনকি—ফেরেশতাকুল শিরোমণি হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালামও হাকিকতে মুহাম্মদী সম্পর্কে পূর্ণ অবগত ছিলেন না। তিনি শুধু একটি তারকাকে বাহাত্তর হাজার বার উদিত হতে দেখেছেন—সত্তর হাজার বছর পর পর। আর সত্তর হাজার বছর পর পর ডুবন্ত অবস্থায় বাহাত্তর হাজার বার দেখতেই পাননি। অংকের হিসাবে পাঁচশত চার কোটি বছর উদিত অবস্থায় ঐ তারকার যাহেরি সুরত মাত্র দেখেছিলেন হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম।

বাতেনিরূপে ঐ তারকা অনুরূপ পাঁচশত চার কোটি বছর অবস্থান করছিলেন। যাহেরি ও বাতেনি অবস্থায় মোট এক হাজার আট কোটি বৎসর নবী করীম (সা.) নূরানি চতুর্থ হিজাবে বিদ্যমান ছিলেন। কিন্তু জিবরাইল (আ.) ঐ বাতেনি সুরতের বিষয়ে সম্যক অবগত ছিলেন না। হযরত আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণিত হাদিস মোতাবেক নবী করিম রাউফুর রাহীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিবরাইল আলাইহিস সালামকে ঐ তারকার তথ্য জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি ছিলাম ঐ তারকা।’

—সীরাতে হলবিয়া ১ম খণ্ড ৩০ পৃষ্ঠা ও রুহুলবয়ান সুরা তৌবা ১২৮ আয়াত

সুতরাং এই হাকিকতে মুহাম্মদীর অর্ধেক বাতেনি অংশ বা বাতেনি রূপ সম্পর্কে জিবরাইলেরও প্রকৃত অবস্থা জানা ছিল না।

পবিত্র মি’রাজ রজনীতে মহান রাব্বুল আলামীনের দীদার লাভ করে যখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরতি পথে একাকী ষষ্ঠ আকাশে নেমে আসলেন, তখন হযরত মুসা আলাইহিস সাল্লামের সাথে তাঁর সাক্ষাতের মর্ম ছিল আল্লাহর নূরের তাজাল্লি দর্শন।

বিষয়:

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

মোস্তাক আহ্‌মাদ

চার শতাধিক গ্রন্থের লেখক ও গবেষক।

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

লাইলাতুল মেরাজ বা শবে মি’রাজের রজনী এক বিশেষ তাৎপর্যময় ও মহিমান্বিত রজনী

প্রকাশ: ১০:৫৯:২৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ মার্চ ২০২১

ইসলামের ইতিহাস অনুযায়ী মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নবুওয়াত প্রকাশের একাদশ বৎসরের রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে প্রথমে কাবা শরিফ থেকে জেরুজালেমে অবস্থিত বায়তুল মুকাদ্দাস বা মসজিদুল আকসায় গমন করেন। সেখানে তিনি সকল নবীদের জামায়াতে ইমামতি করেন। অতঃপর তিনি বোরাক নামক বিশেষ বাহনে আসীন হয়ে উর্ধ্বলোকে গমন করেন। অতঃপর রফরফ নামক বাহনে চড়ে তিনি সিদরাতুল মুনতাহায় যান এবং সিদরাতুল মুনতাহা থেকে আরশে মুয়াল্লার লা-মাকানে গিয়ে মহান আল্লাহর সাক্ষাত লাভ করেন।

পবিত্র মি’রাজের ঘটনা ঘটেছিল বিশ্বনবীর নবুয়ত প্রকাশের ১১ বৎসর ৫ মাস ১৫ দিনের মাথায়। অর্থাৎ প্রকাশ্য নবুয়তের ২৩ বৎসরের দায়িত্ব পালনের মাঝামাঝি সময়ে। সে সময় হুযুর (সা.)-এর বয়স হয়েছিল ৫১ বৎসর ৫ মাস ১৫ দিন। সন ছিল নবুয়তের দ্বাদশ সাল। তিনটি পর্যায়ে মি’রাজকে ভাগ করা হয়েছে। মক্কাশরিফ থেকে বায়তুল মোকাদ্দাস পর্যন্ত মি’রাজের অংশকে বলা হয় আল ইস্রা বা রাত্রি ভ্রমণ। বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে সিদরাতুল মুন্তাহা পর্যন্ত অংশকে বলা হয় মি’রাজ। সিদ্রাতুল মুন্তাহা থেকে আরশ ও লা-মাকান পর্যন্ত অংশকে বলা হয় পূর্ণ মি’রাজ। কিন্তু সাধারণভাবে পূর্ণ ভ্রমণকেই এক নামে মি’রাজ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। কুরআন, হাদিসে মোতাওয়াতির এবং খবরে ওয়াহেদ দ্বারা যথাক্রমে এই তিনটি পর্যায়ের মি’রাজ প্রমাণিত।

মসজিদে নববি, মদিনা
মসজিদে নববি, মদিনা। ছবি: Sulthan Auliya

বিশ্বনবী (সা.)-এর মি’রাজের দলিল ভিত্তিক পূর্ণ বিবরণ

এই মি’রাজের মাধ্যমে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সচক্ষে আল্লাহর দীদার লাভ করার দ্বারা সূরতে হাক্কীর সুস্পষ্ট দলিল বিশ্ববাসীর সম্মুখে উপস্থিত করেছেন। বিশ্বের সকল জ্ঞানী ও ভাবুকশ্রেণির জন্য এতে নিদর্শন রয়েছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উর্ধ্বজগতের মু’যিজা সমূহের মধ্যে মি’রাজ গমন একটি বিস্ময়কর মু’যিজা। এজন্যই মি’রাজের বর্ণনায় সুরা বনি ইস্রাইলের আয়াতের শুরুতেই আল্লাহ পাক ‘সোব্হানাল্লাহ্’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন— যা কেবল আশ্চর্যজনক ঘটনার ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। স্বশরীরে মি’রাজ গমনের প্রমাণ স্বরূপ কুরআনের ‘বিআব্দিহী’ শব্দটি তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, ‘আবদুন’ শব্দটি দ্বারা রূহ ও দেহের সমষ্টিকে বুঝান হয়েছে। তদুপরি- বোরাক প্রেরণ ও বোরাক কর্তৃক নবী করিম (সা.)-কে বহন করে নিয়ে যাওয়ার মধ্যেও স্বশরীরে মি’রাজ গমনের প্রমাণ পাওয়া যায়।

সর্বোপরি-স্বপ্নে বা রূহানীভাবে মি’রাজের দাবী করা হলে কোরাইশদের মধ্যে এত হৈ চৈ হতোনা। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সকল ইমামগণই স্বশরীরে মি’রাজ গমনের পক্ষে জোরালো মত প্রকাশসহ দলিল পেশ করছেন। এছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ের ওলামায়ে কেরামগণ এ কথা স্বীকার করেছেন।

মি’রাজের ঘটনাটি নবীজীর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, এর সাথে গতির সম্পর্ক এবং সময় ও স্থানের সঙ্কোচনের তত্ত্ব জড়িত রয়েছে। সূর্যের আলোর গতি সেকেণ্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। পৃথিবীতে সূর্যের আলো পৌঁছতে লাগে আট মিনিট বিশ সেকেণ্ড। এ হিসেবে পৃথিবী হতে সূর্যের দূরত্ব নয় কোটি তিরিশ লক্ষ মাইল। অথচ নবী করিম (সা.) মুহূর্তের মধ্যে চন্দ্র, সূর্য, সিদ্রাতুল মুন্তাহা, আরশ-কুরছি ভ্রমণ করে লা-মাকানে আল্লাহর দীদার লাভ করে নব্বই হাজার কালাম করে পুনরায় মক্কা শরিফে ফিরে আসেন। এসে দেখেন, বিছানা এখনও গরম রয়েছে। এর চেয়ে আশ্চর্য আর কি হতে পারে? নবী করিম (সা.)-এর নূরের গতি কত ছিল, এ থেকেই অনুমান করা যায় তাঁর গুরুত্ব ও মর্যাদা কত বেশি ছিল। কেননা, তিনি ছিলেন নূর। যাওয়ার সময় বোরাক ছিল কিন্তু ফেরার সময় বোরাক ছিল না। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন থেকে যায় তিনি একাকী অথবা বিশেষভাবে ফিরে এসেছেন। এ সবই তাঁর একক মর্যাদা বা হাকীকতের অংশবিশেষ।

—রুহুল বয়ান

মি’রাজের মধ্যে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—অন্যান্য নবীগণের সমস্ত মু’যিজা নবী করিম (সা.)-এর মধ্যে একত্রিত হয়েছিল। হযরত মুসা (আ.) তূর পর্বতে আল্লাহর সাথে কালাম করেছেন। হযরত ঈসা (আ.) স্বশরীরে আকাশে অবস্থান করছেন এবং হযরত ইদ্রিছ (আ.) স্বশরীরে বেহেস্তে অবস্থান করছেন। তাঁদের চেয়েও উন্নত মাকামে ও উচ্চমর্যাদায় আল্লাহপাক নবী করিম (সা.)-কে নিয়ে সবার উপরে মর্যাদা প্রদান করেছেন। মুসা (আ.) নিজে গিয়েছিলেন তূর পর্বতে। কিন্তু আমাদের প্রিয়নবী (সা.)-কে আল্লাহ্ তায়ালা দাওয়াত করে বোরাকে চড়িয়ে ফেরেস্তাদের মিছিলসহকারে প্রথমে বায়তুল মোকাদ্দাসে নিয়েছিলেন। সেখানে সব নবীগণকে স্বশরীরে উপস্থিত করে হুযুর করিম (সা.)-এর মোক্তাদী বানিয়েছিলেন। সেদিনই সমস্ত নবীগণের ইমাম হয়ে নবী করিম (সা.) ‘নবীগণেরও নবী’ রূপে বাস্তবে প্রমাণিত হয়েছিলেন। সেদিন সমস্ত নবীগণ অষ্ট অঙ্গ (দুই হাত, দুই পা, দুই হাঁটু, নাক ও কপাল) দিয়ে স্বশরীরে নামায আদায় করেছিলেন। সমস্ত নবীগণ যে স্বশরীরে জীবিত, তারই বাস্তব প্রমাণ মিলেছিল মি’রাজের রাত্রে। সমস্ত নবীগণ আপন আপন রাওযায় জীবিত আছেন।

—আল-হাদিস

মি’রাজের রাত্রে নবী করিম (সা.)-কে প্রথম সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিলো জিব্রাইল, মিকাইল ও ইস্রাফিল ফেরেস্তাসহ তাঁদের অধীনে সত্তর হাজার ফেরেস্তা দ্বারা দ্বিতীয় সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিল বাইতুল মোকাদ্দাসে নবীগণের (আ.) দ্বারা। তৃতীয় সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিল আকাশের ফেরেস্তা, হুর ও নবীগণের দ্বারা এবং চতুর্থ ও শেষ সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। সিদ্রাতুল মুন্তাহা এবং আরশ মোয়াল্লা অতিক্রম করার পর স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা একশত বার সম্বর্ধনামূলক বাক্য আদ্নু মিন্নি ইয়া মুহাম্মদ (সা.) অর্থাৎ ‘হে প্রিয় বন্ধু মুহাম্মদ, আপনি আমার অতি নিকটে আসুন’ একথা বলে নবী করিম (সা.)-কে সম্মানিত করেছিলেন। পবিত্র কুরআন মজিদে ছুম্মা দানা ফাতাদাল্লা এর উল্লেখই তার ইঙ্গিতবহ বলে ‘তাফসীরে মুগ্নী’ ও ‘মিরছাদুল ইবাদ’ নামক গ্রন্থদ্বয়ের বরাত দিয়ে ‘রিয়াজুন্নাছেহীন’ কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে। উক্ত কিতাবখানা সাত শত বৎসর পূর্বে ফারসি ভাষায় লিখিত।

মি’রাজের প্রথম পর্যায়

রজব চাঁদের ২৬ দিবাগত রাত অর্থাৎ ২৭ তারিখ সোমবার পূর্ব রাত্রের শেষাংশে প্রিয়নবী (সা.) রায়তুল্লায় অবস্থিত বিবি উম্মেহানী (রা.)-এর ঘরে অবস্থান করছিলেন। বিবি উম্মেহানী (রা.) ছিলেন আবু তালেবের কন্যা এবং নবী করিম (সা.)-এর দুধবোন। উক্ত গৃহটি ছিল বর্তমান হেরেম শরিফের ভিতরে পশ্চিম দিকে। হযরত জিব্রাইল (আ.) ঘরের ছাদ দিয়ে প্রবেশ করে নূরের পাখা দিয়ে, অন্য রেওয়াত মোতাবেক-গণ্ডদেশ দিয়ে নবী করিম (সা.)-এর কদম মোবারকের তালুতে স্পর্শ করতেই হুযুরের তন্দ্রা টুটে যায়। জিব্রাইল (আ.) আল্লাহর পক্ষ হতে দাওয়াত জানালেন এবং প্রিয় নবীজীর সাথে দিদার লাভের জন্য মহান আল্লাহর মনোবাসনার কথা জানালেন। অন্যদিকে নিকটেই বোরাক দণ্ডায়মান ছিল। বোরাকের আকৃতি ছিল অদ্ভুত ধরনের। গাধার চেয়ে উঁচু খচ্চরের চেয়ে নিচু, মুখমণ্ডল মানুষের চেহারাসদৃশ, পা উটের পায়ের মত এবং পিঠের কেশর ঘোড়ার মত।

—রুহুল বয়ান-সুরা বনি ইস্রাইল

মূলত বোরাক ছিল বেহেস্তী বাহন—যার গতি ছিল দৃষ্টি সীমান্তে মাত্র এক কদম। নবী করিম (সা.) বোরাকে সওয়ার হওয়ার চেষ্টা করতেই বোরাক নড়াচড়া শুরু করলো। জিব্রাইল (আ.) বললেন—‘তোমার পিঠে সৃষ্টির সেরা মহামানব সওয়ার হচ্ছেন, সুতরাং তুমি স্থির হয়ে যাও।’ বোরাক বললো, ‘কাল হাশরের দিনে নবী করিম (সা.) আমার জন্য আল্লাহর দরবারে শাফাআত করবেন বলে ওয়াদা করলে আমি স্থির হবো।’ নবী করিম (সা.) ওয়াদা করলেন। বোরাক স্থির হলো। তিনি বোরাকে সওয়ার হলেন। জিব্রাইল (আ.) সামনে লাগাম ধরে, মিকাইল (আ.) রিকাব ধরে এবং ইস্রাফিল (আ.) পিছনে পিছনে অগ্রসর হলেন। পিছনে সত্তর হাজার ফেরেস্তার মিছিল। এ যেন দুল্হার সাথে বরযাত্রী। প্রকৃতপক্ষে নবী করিম (সা.) ছিলেন আরশের দুল্হা।

—তাফসীরে রুহুল বয়ান

মক্কাশরিফ থেকে রওনা দিয়ে পথিমধ্যে মদিনার রওযা মোবারকের স্থানে গিয়ে বোরাক থামলো। জিব্রাইলের ইশারায় তথায় তিনি দু’রাকাত নামায আদায় করলেন। এভাবে ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মস্থান বাইতুল লাহাম এবং মাদ্ইয়ান নামক স্থানে হযরত শুয়াইব (আ.)-এর গৃহের কাছে বোরাক থেকে নেমে নবী করিম (সা.) দু’রাকাত করে নামায আদায় করলেন। এজন্যই বরকতময় স্থানে নামায আদায় করা সুন্নত। এই শিক্ষাই এখানে রয়েছে। নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন, আমি বোরাক থেকে দেখতে পেলাম, হযরত মুসা (আ.) তাঁর মাযারে (জর্দানে) দাঁড়িয়ে নামায পড়ছেন।

অতঃপর জিব্রাইল (আ.) বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদের সামনে বোরাক থামালেন। সমস্ত নবীগণ পূর্ব হতেই সেখানে স্বশরীরে উপস্থিত ছিলেন। জিব্রাইল (আ.) বোরাককে রশি দিয়ে বায়তুল মোকাদ্দাসের ছাখ্রা নামক পবিত্র পাথরের সাথে বাঁধলেন এবং আযান দিলেন। সমস্ত নবীগণ (আ.) নামাযের জন্য দাঁড়ালেন। হযরত জিব্রাইল (আ.) নবী করিম (সা.)-এর ইমামতিতে সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরাম ও সত্তর হাজার ফেরেস্তাকে নিয়ে দু’রাকাত নামায আদায় করলেন। তখনও কিন্তু নামায ফরয হয়নি। প্রশ্ন জাগে, নামাযের আদেশ নাযিল হওয়ার পূর্বে হুযুর (সা.) কিভাবে ইমামতি করলেন? এতে বুঝা গেল, তিনি নামাযের নিয়ম কানুন পূর্বেই জানতেন। নামাযের তা’লীম তিনি পূর্বেই পেয়েছিলেন, তানযীল বা নাযিল হয়েছে পরে। আজকে প্রমাণিত হলো, নবী করিম (সা.) হলেন ইমামুল মোরছালীন ও নবীউল আম্বিয়া (আ.)।

বিশ্বনবী (সা.)-এর ইমামতিতে নামায শেষে আয়োজিত সংক্ষিপ্ত সভায় নবীগণ নিজেদের পরিচয় দিয়ে বক্তব্য পেশ করলেন। সর্বশেষ সভাপতি (মীর মজলিস) হিসাবে ভাষণ রাখলেন নবীগণের নবী, বিশ্বজাহানের রতমত রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত মুহাম্মাদ (সা.)। তাঁর ভাষণে আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা করে তিনি বললেন—‘আল্লাহ পাক আমাকে আদম সন্তানদের মধ্যে সর্দার, আখেরী নবী ও রাহমাতুল্লিল আলামীন বানিয়ে প্রেরণ করেছেন।’

[এখানে একটি আক্বিদার প্রশ্ন জড়িত আছে। তা হলো, আম্বিয়ায়ে কেরামগণের মধ্যে তিনজন ব্যতীত আর সকলেই ইতিপূর্বে ইনতিকাল করেছেন এবং তাঁদের রওযা মোবারকও বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত।

যে তিনজন নবী জীবিত, তাঁরা হচ্ছেন—হযরত ইদ্রিছ (আ.) বেহেশতে, হযরত ঈসা (আ.) আকাশে এবং হযরত ইলিয়াছ (আ.) স্থলভাগের দায়িত্বে। তবে চার নম্বর হযরত খিযির (আ.) নবী কিনা সে নিয়ে মতভেদ আছে। অনেকের মতে তিনি হচ্ছেন অলি, যিনি জলভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন এবং কেয়ামত পর্যন্ত মওলা আলীর বেলায়েতের বিতরণকারী হিসেবে তিনি নিয়োজিত।

জীবিত ও ইনতিকালপ্রাপ্ত সকল আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ.) বিভিন্ন স্থান থেকে মুহূর্তের মধ্যে কিভাবে স্বশরীরে বায়তুল মোকাদ্দাসে উপস্থিত হলেন? তাফসীরে রুহুল বয়ানে এ প্রশ্নের উত্তর এভাবে দেয়া হয়েছে—‘জীবিত তিনজন নবীকে আল্লাহ তায়ালা স্বশরীরে এবং ইন্তিকালপ্রাপ্ত আম্বিয়ায়ে কেরামগণকে মেছালী শরীরে বায়তুল মোকাদ্দাসে উপস্থিত করেছিলেন।’ কিন্তু অন্যান্য গ্রন্থে স্বশরীরে উপস্থিতির কথা উল্লেখ আছে। কেননা, নবীগণ অষ্ট অঙ্গ দ্বারা সিজদা করেছিলেন। নবীগণ ও অলীগণ মেছালী শরীর ধারণ করে মুহূর্তের মধ্যে আসমান জমিন ভ্রমণ করতে পারেন এবং জীবিত লোকদের মতই সবকিছু শুনতে ও দেখতে পারেন।

—মিরকাত ও তাইছির গ্রন্থ

আধুনিক থিউসোফিতেও (আধ্যাত্মবাদ) একথা স্বীকৃত। ফিজিক্যাল বডি, ইথিক্যাল বডি, কস্যাল বডি, এসট্রাল বডি-ইত্যাদি রূপ ধারণ করা একই দেহের পক্ষে সম্ভব এবং বাস্তব বলেও আধুনিক থিউসোফির বিজ্ঞানীগণ স্বীকার করেছেন। আমরা মুসলমান। আল্লাহর কুদরত ও প্রদত্ত ক্ষমতার উপর আমাদের ঈমান নির্ভরশীল। এ বিষয়ে কবি গোলাম মোস্তফার বিশ্বনবী বইখানায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

মি’রাজের দ্বিতীয় পর্যায়

মি’রাজের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে এবং শেষ হয় সিদ্রাতুল মুন্তাহাতে গিয়ে। প্রথম আকাশে গিয়ে জিব্রাইল (আ.) ডাক দিলেন প্রথম আকাশের ভারপ্রাপ্ত ফেরেস্তাকে এবং দরজা খুলে দিতে বললেন। উক্ত ফেরেস্তা পরিচয় নিয়ে হুযুর (সা.)-এর নাম শুনেই দরজা খুলে দিলেন। প্রথমেই সাক্ষাত হলো হযরত আদম (আ.)-এর সাথে। হুযুর (সা.) তাঁকে ছালাম দিলেন। কেননা ভ্রমণকারীকেই প্রথমে সালাম দিতে হয়। হযরত আদম (আ.) নবীগণের আদি পিতা। তাই তাঁকে দিয়েই প্রথম অভ্যর্থনা শুরু করা হলো। হযরত আদম (আ.)-এর নেতৃত্বে অন্যান্য আম্বিয়ায়ে কেরাম এবং প্রথম আকাশের ফেরেস্তারা উক্ত অভ্যর্থনায় যোগদান করেন। এমনিভাবে দ্বিতীয় আকাশে হযরত ঈসা, হযরত যাকারিয়া ও হযরত ইয়াহ্ইয়া (আ.) এবং অন্যান্য নবী ও ফেরেস্তারা অভ্যর্থনা জানালেন।

হযরত যাকারিয়াও উক্ত অভ্যর্থনায় শরীক ছিলেন। নবী করিম (সা.) তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন—‘যখন আপনাকে করাত দ্বারা দ্বিখণ্ডিত করা হচ্ছিল, তখন আপনার কেমন অনুভব হয়েছিল?’ উত্তরে যাকারিয়া (আ.) বললেন— ‘তখন আল্লাহ তায়ালা আমাকে ডাক দিয়ে বলেছিলেন, আমি তোমার সাথে আছি। এতদশ্রবণে আমি মউতের কষ্ট ভুলে গিয়েছিলাম।’ প্রকৃত আশেকগণের মউতের সময় নবীজীর দিদার নছিব হয়। তাই তাঁদের মউতের কষ্ট অনুভূত হয় না।

—আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া : যাকারিয়া অধ্যায়।

তৃতীয় আকাশে হযরত ইউসুফ (আ.)-এর নেতৃত্বে অন্যান্য নবী ও ফেরেস্তাগণ নবী করিম (সা.)-কে অভ্যর্থনা জানান এবং ছালাম কালাম বিনিময় করেন। চতুর্থ আকাশে হযরত ইদ্রিছ (আ.), পঞ্চম আকাশে হযরত হারুন (আ.) ফেরেস্তাগণসহ অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। ৬ষ্ঠ আকাশে হযরত মুসা (আ.)-এর সাথে সাক্ষাত হয়। তিনি অভ্যর্থনা জানিয়ে বিদায়কালে আশ্চর্য হয়ে বললেন—‘এই যুবক নবী শেষকালে এসেও আমার পূর্বে বেহেস্তে যাবেন এবং তাঁর উম্মতগণ আমার উম্মতের পূর্বে বেহেস্তে প্রবেশ করবে।’ হযরত মুসা (আ.) নবী করিম (সা.) ও তাঁর উম্মতের বিশেষ মর্যাদা দেখে আনন্দাশ্র“র কান্না কেঁদেছিলেন। যেমন মা সন্তানের কোন সুসংবাদ শুনতে পেলে আনন্দে কেঁদে ফেলেন। তাঁর এই আফ্সোস ছিল আনন্দসূচক ও স্বীকৃতিমূলক- বিদ্বেষমূলক নয়, এটাকে ঈর্ষা বলে। গিব্তা বা ঈর্ষা করা শরিয়তে জায়েয কিন্তু হাছাদ বা হিংসা করা জায়েয নয়।

—মিশকাত শরিফ

হযরত মুসা (আ.) সে সময় নবী করিম (সা.)-এর নিকট একটি হাদিসের ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছিলেন। হাদিসটি হলো- নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন— ‘আমার উম্মতের যাহেরি-বাতেনি এলেমসম্পন্ন আলেমগণ বনি ইসরাইলের নবীগণের ন্যায়। এটা শুধুমাত্র এলেম ও আমলের ক্ষেত্রে, নবুয়তের মর্যাদার ক্ষেত্রে নয়।

নবী করিম (সা.) উক্ত হাদিসের যথার্থতা প্রমাণের জন্য রূহানী জগত থেকে ইমাম গাযালী (রা.)-কে হযরত মুসা (আ.)-এর সামনে হাযির করালেন। হযরত মুসা (আ.) বললেন, ‘আপনার নাম কি?’ উত্তরে ইমাম গাযালী (রা.) নিজের নাম, পিতার নাম, দাদার নাম, পরদাদার নামসহ ছয় পুরুষের নাম বললেন। হযরত মুসা (আ.) বললেন, ‘আমি শুধু আপনার নাম জিজ্ঞেস করেছি। আপনি এত দীর্ঘ তালিকা পেশ করলেন কেন?’ ইমাম গাযালী (রা.) আদবের সাথে জবাব দিলেন—‘আড়াই হাজার বৎসর পূর্বে আপনিও তো আল্লাহ তায়ালার ছোট্ট একটি প্রশ্নের দীর্ঘ উত্তর দিয়েছিলেন।’ ইমাম গাযালীর (রা.)-এর এলেম ও প্রজ্ঞা দেখে হযরত মুসা (আ.) মুগ্ধ হয়ে গেলেন এবং হুযুর (সা.)-এর হাদিসখানার তাৎপর্য স্বীকার করে নিলেন।

—রুহুল বয়ান তৃতীয় পারা ২৪৮ পৃষ্ঠা

[এখানে একটি বিষয় তাৎপর্যপূর্ণ। হযরত মুসা (আ.)-এর ইন্তিকালের আড়াই হাজার বৎসর পরে মক্কার জমিনে প্রদত্ত হুযুর (সা.)-এর ভাষণ তিনি শুনতে পেয়েছিলেন, আপন রওযা থেকে। অপরদিকে দুনিয়াতে আসার পূর্বে আলমে আরওয়াহ্ থেকে ইমাম গাযালী (রা.)-এর মত একজন বিজ্ঞ অলী আড়াই হাজার বৎসর পূর্বে তুর পর্বতে ঘটে যাওয়া মুসা (আ.)-এর ঘটনা সম্পর্কেও অবগত ছিলেন। এতে প্রমাণিত হলো—আল্লাহর নবী ও অলীগণকে আল্লাহ তায়ালা বাতেনি প্রজ্ঞা দান করেছেন, যাকে নূরে নযর বা ফিরাছাত বলা হয়। আল্লাহর অলীগণ আল্লাহ প্রদত্ত কাশ্ফ দ্বারা অনেক সময় মানুষের মনের গোপন কথাও বলে দিতে পারেন। ইমাম অবু হানিফা (রা.) কুফার এক মসজিদে জনৈক মুসল্লিকে অযু করতে দেখে বলেছিলেন—

‘তুমি যিনা করে এসেছো।’ লোকটি অবাক হয়ে বললো, ‘আপনি কিভাবে জানলেন?’ ইমাম আবু হানিফা (রা.) বললেন— ‘তোমার অযুর পানির সাথে যিনার গুনাহ্ ঝরে পড়ছিল।’

হাদিসেও অযুর পানির সাথে গুনাহ্ ঝরে পড়ার কথা উল্লেখ আছে। লোকটি ইমাম সাহেবের বাতেনি এলেম দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলো এবং সাথে সাথে ইমাম সাহেবের হাতে তওবা করলো। বড়পীর হযরত গাউছুল আ’যম আবদুল কাদের জিলানী (রা.) বাহজাতুল আসরার কিতাবে বলেন :

অনুবাদ—‘দুনিয়ার নেককার ও বদকার, সকলকেই আমার দৃষ্টিতে পেশ করা হয় লওহে মাহ্ফুযে।’ লওহে মাহ্ফুযে নেককার-বদকার সকলের তালিকা রয়েছে। হযরত বড়পীর (রা.)-এর নযরও দুনিয়া থেকে লওহে মাহ্ফুযে নিবদ্ধ। এজন্যই মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি (রা.) মসনবী শরিফে বলেছেন যার অনুবাদ—‘লওহে মাহ্ফুয অলী-আল্লাহগণের নযরের সামনে। একারণেই তাঁদের দিব্যদৃষ্টি সমস্ত ত্রুটি থেকে মুক্ত।’

অতঃপর হযরত মুসা (আ.) থেকে বিদায় নিয়ে নবী করিম (সা.) জিব্রাইল (আ.)সহ সপ্তম আকাশে গেলেন। সেখানে হযরত ইব্রাহীম (আ.) ফেরেস্তাগণসহ নবী করিম (সা.)-কে অভ্যর্থনা জানালেন। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আমি হযরত ইব্রাহীম (আ.)-কে একটি কুরছিতে বসে বাইতুল মামুর মসজিদের গায়ে হেলান দিয়ে বসা অবস্থায় দেখতে পেয়েছি।’

—রুহুল বয়ান

হযরত ইব্রাহীম (আ.) দুনিয়াতে আল্লাহর ঘর কা’বাশরিফ তৈরি করেছিলেন। তার বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সপ্তাকাশের বাইতুল মামুর মসজিদের মোতাওয়াল্লীর সম্মান দান করেছেন। দীর্ঘ এক হাদিসে এসেছে—বাইতুল মামুরে হুযুর (সা.)-এর সাথে নামায আদায় করেছিলেন সাদা পোশাকধারী একদল উম্মত—যাদের মধ্যে গাউসুল আযম (রা.)ও ছিলেন।

—আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান, ইরফানে শরিয়ত তৃতীয় খণ্ড

আসমানে ভ্রমণের সময়ই নবী করিম (সা.) বেহেস্ত ও দোযখ প্রত্যক্ষ করেন। পরকালে বিভিন্ন পাপের কি রকম শাস্তি হবে, তার কিছু নমুনা তিনি মেছালী ছুরতে প্রত্যক্ষ করেছেন। সুদ, ঘুষ, অত্যাচার, সালাত বর্জন, ইয়াতিমের মাল ভক্ষণ, প্রতিবেশীর উপর যুলুম, স্বামীর অবাধ্যতা, বেপর্দা ও অন্য পুরুষকে নিজের রূপ প্রদর্শন, যিনা, ব্যভিচার ইত্যাদির শাস্তি নবী করিম (সা.) স্বচক্ষে দেখেছেন।

বেহেস্তে হযরত খাদিজা (রা.)-এর জন্য সংরক্ষিত প্রাসাদ, হযরত বেলালের (রা.) পাদুকার আওয়ায—এসব দেখেছেন এবং শুনেছেন। বেহেস্তের চারটি নহরের উৎসস্থল নবী করিম (সা.)-কে দেখান হয়েছে।

বিস্মিল্লাহর চারটি শব্দের শেষ চারটি হরফ মিম, হা, নুন, মিম থেকে চারটি নহর প্রবাহিত হয়ে হাউযে কাউছারে পতিত হতে দেখেছেন। দুধ, পানি, শরবত ও মধু-এই চার প্রকারের পানীয় বেহেস্তবাসীকে পান করানো হবে। যারা ভক্তি ও ঈমানের সাথে প্রত্যেক ভাল কাজ বিস্মিল্লাহ বলে শুরু করবে, তাদের জন্য এই নেয়ামত রাখা হয়েছে।

—তাফসীরে রুহুল বয়ানে বিস্মিল্লাহর ব্যাখ্যায় এর বিস্তরিত বিবরণ দেয়া হয়েছে

সপ্ত আকাশ ভ্রমণের পর জিব্রাইল (আ.) খাদেম হিসাবে বা প্রটোকল হিসাবে নবী করিম (সা.)-কে সিদ্রাতুল মুন্তাহা বা সীমান্তের কুলবৃক্ষের নিকট নিয়ে যান। হাদিসে এসেছে, ‘এ বৃক্ষের পাতা হাতীর কানের মত বড় এবং ফল উহুদ পাহাড়ের ন্যায় বড়। শহীদগণের রূহ মোবারক সবুজ পাখীর সুরতে উক্ত বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করছেন।’ নবী করিম (সা.) স্বচক্ষে তা দর্শন করেছেন। সিদরা বৃক্ষ পৃথিবীর সপ্ত তবক নিচ থেকে চৌদ্দ হাজার বছরের রাস্তার উপরে অবস্থিত। সিদ্রা থেকে আরশের দূরত্ব ছত্রিশ হাজার বৎসরের রাস্তা। সর্বমোট পঞ্চাশ হাজার বৎসরের দূরত্বে আরশে মোয়াল্লা।

—ইবনে আব্বাস

আরশে মোয়াল্লা থেকেই আল্লাহ তায়ালার যাবতীয় নির্দেশ ফিরিস্তাগণের নিকট আসে। হযরত জিব্রাইল (আ.) সিদ্রাতুল মুন্তাহা থেকেই আল্লাহ তায়ালার যাবতীয় নির্দেশ গ্রহণ করে থাকেন। এখানে এসেই জিব্রাঈলের গতি শেষ হয়ে যায়।

মি’রাজের তৃতীয় পর্যায়: সিদ্রা হতে আরশে আজিম পর্যন্ত

সিদ্রাতুল মুন্তাহায় পৌঁছে জিব্রাইল (আ.) নবী করিম (সা.) থেকে বিদায় নিলেন এবং বললেন— ‘সিদ্রাতুল মুন্তাহা থেকে এক আঙ্গুল পরিমাণ এবং অন্য রেওয়াতে চুল পরিমাণ অগ্রসর হলে আমার ছয়শত নূরের পাখা আল্লাহর নূরের তাজাল্লীতে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাবে।’ সোব্হানাল্লাহ!

যেখানে নূরের ফেরেস্তা জিব্রাইল (আ.) জ্বলে যায়, সেখানে আমাদের প্রিয়নবী (সা.) স্বশরীরে স্বচ্ছন্দে সামনে অগ্রসরমান। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি—‘তিনি আল্লাহর যাতী নূরের জ্যোতি হতে পয়দা হয়েছেন।’ বুঝা গেল- তিনি মাটি নন। মাটি হলে তলায় জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে যেতেন। জিব্রাইল (আ.) আমাদের নবীজীর (সা.) নূরের সামান্যতম অংশের তাজাল্লী দিয়ে সৃষ্টি। যেখানে জিব্রাইলের গতি শেষ, সেখান থেকে আমাদের নবীজীর (সা.) যাত্রা শুরু।

তাই হাকিকতে মুহাম্মদী (সা.) সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে হলে হযরত জিব্রাইল (আ.) নবীজীকে কেমন দেখেছিলেন। জিব্রাইলও বলতে পারবেন না, তার পরের ঘটনা কি ঘটেছিল। ফিরতি পথে হুযুর (সা.)-এর স্বরূপ কেমন ছিল—তা জানতে হবে মুসা (আ.)-এর কাছে। সেদিন তিনি প্রকৃতপক্ষে কাকে দেখেছিলেন? বিদায়ের সময় জিব্রাইল (আ.) নবী করিম (সা.)-এর কাছে একটি আরয পেশ করেছিলেন—‘আল্লাহ যেন হাশরের দিনে জিব্রাইলকে পুলছিরাতের উপর তার ছয়শত নূরের পাখা বিছিয়ে দেয়ার অনুমতি দান করেন।’ উম্মতে মুহাম্মদী যেন উক্ত পাখার উপর দিয়ে পুলসিরাত পার হয়ে যেতে পারে।

নবী করিম (সা.) আল্লাহর দরবারে জিব্রাইলের এই ফরিয়াদ পেশ করলে আল্লাহ তায়ালা ছাহাবায়ে কেরাম ও আহ্লে মহব্বতের লোকদের জন্য তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। আল্লাহ্ পাক বলেছিলেন— ‘জিব্রাইলের পাখার ওপর দিয়ে পুলছিরাত অতিক্রম করার আরজি মঞ্জুর করা হলো, আপনার সাহাবী এবং আশেকানদের জন্য। যারা আপনাকে এবং আপনার পরিজনকে অধিক মহব্বত করবে তারা এবং আপনার সাহাবাদ্বয় এই দুই শ্রেণির লোক জিব্রাইলের পাখার উপর দিয়ে পুলছিরাত পার হয়ে যাবে।’

—মাওয়াহেব লাদুন্নিয়া।

জিব্রাইল (আ.) থেকে বিদায় হওয়ার পর রফরফ নামে এক বাহন এসে নবী করিম (সা.)-কে আরশে আযিমে পৌঁছিয়ে দেয়। এ পথে নবী করিম (সা.) সত্তরটি নূরের পর্দা ভেদ করেন। এক এক পর্দার ঘনত্ব ছিল পাঁচশত বৎসরের রাস্তা। এ হিসাবে ৩৬ হাজার বৎসরের রাস্তা অতিক্রম করে নবী করিম (সা.) আরশে মোয়াল্লায় পৌঁছলেন। এ পথে যখন তিনি একাকীত্ব অনুভব করছিলেন, তখন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর আওয়ায শুনতে পেয়ে শান্ত হয়েছিলেন। আর একটি আওয়াজও তিনি শুনতে পেয়েছিলেন : ‘হে প্রিয় মুহাম্মদ (সা.), আপনি একটু থামুন, আপনার রব সালাত পাঠ করছেন।’ আল্লাহর সাথে দীদারের সময় নবী করিম (সা.) এ দু’টি বিষয়ের রহস্য জানতে চাইলেন। আল্লাহ তায়ালা বললেন, ‘আমার সালাত অর্থ আপনার উপর দরূদ পাঠ করা। আর আবু বকরের সুরতে এক ফেরেস্তা সৃষ্টি করে আবু বকরের আওয়াজ নকল করা হয়েছিল, যেন আপনি শান্ত হন।’

মহিউদ্দিন ইবনে আরবী (রা.)-এর তাফসীরে বলা হয়েছে, হযরত আবু বকর সিদ্দিকই (রা.) রূহানীভাবে ফিরিস্তার সূরতে তথায় উপস্থিত ছিলেন। এটা ছিল তাঁর কারামত। কেননা তিনি ছিলেন রাসুলে পাকের নিত্যসঙ্গী। তিনি দুনিয়াতে, মাযারে, হাশরের ময়দানে এবং জান্নাতেও নবী করিম (সা.)-এর সঙ্গী থাকবেন। সুতরাং মি’রাজে রূহানীভাবে উপস্থিত থাকা খুবই স্বাভাবিক।

—দেখুন : ইরফানে শরিয়ত

আরশে পৌঁছার পর লাওহে মাহফুয অবলোকনকালে নবী করিম (সা.) দেখতে পেলেন, তথায় শেষ বাক্যটি লেখা ছিল এরূপ :

ক্বাদ সাবাকাত রাহমাতি আলা গাজাবী

অর্থ—‘আমার গযবের উপর আমার রহমত প্রাধান্য বিস্তার করে রয়েছে।’

উক্ত হাদিসে কুদসীর মধ্যে উম্মতের জন্য একটি গোপন ইশারা নিহিত রয়েছে। তা হলো- কিছু শাস্তি ভোগ করার পর সমস্ত হকপন্থী উম্মতই আল্লাহর রহমতে নাজাত পাবে। অর্থাৎ নবী করিম (সা.)-এর যেসব উম্মতের উপর গোনাহের কারণে গযব উপস্থিত হবে বিশ্বনবী রহমাতুল্লিল আলামীনের রহমত দ্বারা সেই গযব দূরীভূত হবে। কিন্তু নূরনবী (সা.) আরশের মাঝে এই লেখা দেখে বুঝতে পারলেন যে, তিনি শুধু উম্মতের জন্যই রহমত নন বরং সমস্ত সৃষ্টিকুলের জন্য রহমত। তাই তিনি আরশকে জিজ্ঞেস করলেন—‘আমি সমগ্র জাহানের জন্য রহমত, তোমার জন্য কিরূপে রহমত যা স্বয়ং আল্লাহর সিংহাসন?’ আরশ তখন আরয করলো, ‘আল্লাহ তায়ালা যখন আমার মধ্যে কলেমার প্রথম অংশ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ লিখলেন, তখন আল্লাহর জালালী শানে আমার মধ্যে কম্পন সৃষ্টি হয়েছিল। মনে হয়েছিল যেন আমি টুক্রো টুকরো হয়ে যাব। তারপর যখন তার পার্শ্বে আপনার জামালী নামের অংশটুকু, ‘মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ’ লিখে দিলেন, তখন আমার কম্পন বন্ধ হয়ে গেল সুতরাং আপনি আমার জন্য বিরাট রহমত।’

—শানে হাবীব

বিশ্বনবী (সা.)-এর মি’রাজের দ্বিতীয় অংশ

লা মাকানের উদ্দেশ্যে রওনা

আরশ মোয়াল্লা হতে এবার লা-মাকানের দিকে-অজানার পথে রওনা দিলেন নবী করিম (সা.)- যেখানে স্থান, কাল বলতে কিছুই নেই। সমগ্র সৃষ্টিগতই তখন নবীজীর কদমের নিচে। আসমান, জমিন, চন্দ্র-সূর্য, আরশ কুর্ছি সবকিছু, এমনকি- আলমে খালক (সৃষ্টি জগত) ও আলমে আমর (নির্দেশ জগত) সবকিছুই তখন নবী করিম (সা.)-এর পদতলে রয়ে গেল। তিনি সমস্ত কিছু অতিক্রম করে আল্লাহর এত নিকটবর্তী হলেন যে, দুই ধনুকের চার মাথার ব্যবধান বা তার চেয়েও কম ব্যবধান রয়ে গেল। এটা রহস্য জগত। এ অবস্থাকে মুতাশাবিহাত বা দুর্বোধ্য অবস্থা বলা হয়। কুরআন মজিদে এই মাকামকে (ক্বাবা কাওছাইন) বলা হয়েছে। শারিরীক সান্নিধ্য এখানে উদ্দেশ্য নয় বরং তার চেয়েও আরও ঘনিষ্ঠ। আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্য ও ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য বুঝানো।

তাফসীরে রুহুল বয়ান তৃতীয় পারা প্রথম আয়াতের তাফসীর বর্ণনা করা হয়েছে যে, ‘নবী করিম (সা.)-এর নূরানী সুরতের বহিঃপ্রকাশ হয়েছিল সে সময়। তাঁর বাশারিয়াত সে সময় উন্নত হতে হতে নূরে ওয়াহ্দানিয়াতের মধ্যে মিশে গিয়েছিল’ যেমন মিশে যায় পানিতে চিনি। এই মাকামকে তাসাওউফের ভাষায় ‘ফানা’ বলা হয়। রুহুল বয়ানের এবারতটুকুর অনুবাদ পাঠকদের জন্য উদ্ধৃত করা হল।

অনুবাদ—‘নবী করিম (সা.) লাইলাতুল মি’রাজে কোন স্থানে বা সৃষ্টি জগতে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। কেননা, তখন তিনি তাঁর জড় অস্তিত্বের অন্ধকার ভেদ করে ফানা হয়ে আল্লাহর নূরের অস্তিত্বে অস্তিত্ববান হয়েছিলেন। এ কারণেই কুরআন মজিদে (সুরা মায়েদা-১৫ আয়াত) আল্লাহ তায়ালা তাঁকে ‘নূর’ বলে আখ্যায়িত করে এরশাদ করেছেন, ‘হে জগতবাসী! তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ হতে প্রথমে এক মহান নূর ও পরে একটি স্পষ্ট কিতাব এসেছে।’

বুঝা গেল—তিনি দুনিয়াতে আগমনকালেই নূর ছিলেন—মাটি নয়। যারা মাটি বলে, তারা ভ্রান্ত। (তাফসীরে রূহুল বয়ান পৃষ্ঠা ৩৯৫ তৃতীয় পারা ১ম আয়াত)। উক্ত আয়াতের পূর্ণ বিকাশ হয়েছিল ‘ক্বাবা কাওছাইন’ মাকামে।

আল্লাহর সাথে কালাম

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাথে নবী করিম (সা.)-এর কি কি কথোপকথন হয়েছিল, তা কুরআনে গোপন রাখা হয়েছে। শুধু ইরশাদ হয়েছে—‘ফা-আওহা ইলা আব্দিহী মা আওহা’

অর্থ—‘যা গোপনে বলার—আল্লাহ তায়ালা তা আপন প্রিয় বান্দার কাছে গোপনেই বলে দিয়েছেন।’ নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন উতিতুল উলুমা উমিরতু বেকিতমানি বা‘আদ্বিহা

অর্থ—‘আমাকে অনেক প্রকারের গুপ্ত-সুপ্ত এলেম দান করা হয়েছে এবং সাথে সাথে ঐ এলেমের কোন কোন বিষয় গোপন রাখতেও আমাকে নির্দেশ করা হয়েছে।’

কাসাসুল আম্বিয়া নামক উর্দ্দূ কিতাবে নব্বই হাজার কালামের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তন্মধ্যে ত্রিশ হাজার কালাম হাদিসের আকারে সকলের জন্য এবং ত্রিশ হাজার কালাম খাছ খাছ লোকদের নিকট প্রকাশ করার জন্য এবং অবশিষ্ট ত্রিশ হাজার সম্পূর্ণ নিজের কাছে গোপন রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন।

—তাফসীরে ছাভী দেখুন; সুরা নিসা : ১১৩ আয়াত

তাফসীরে রুহুল বয়ানে বর্ণনা করা হয়েছে যে, নবী করিম (সা.) এক পর্যায়ে আল্লাহর দরবারে আরয করেছিলেন—‘আমার উম্মতকে সর্বশেষে এবং কিয়ামতের নিকটবর্তী করে কেন পাঠান হলো এবং তাদের হায়াত পূর্বের তুলনায় কম রাখা হলো কেন?’ উত্তরে আল্লাহ তায়ালা বলেছিলেন, ‘আপনার উম্মতগণ যেন গুনাহ্ করার সময় কম পায়, সেজন্য তাদের হায়াত সংকীর্ণ করেছি এবং আপনার উম্মত যেন কম সময় কবরে থাকে—তাই তাদেরকে কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে সর্বশেষে প্রেরণ করেছি।’ সুব্হানাল্লাহ! এই সময়ের সদ্ব্যবহার করা প্রত্যেক জ্ঞানী লোকেরই উচিত। নবীজীর উম্মত হওয়ার কারণেই আমাদেরকে এ সুযোগ দেয়া হয়েছে।

প্রত্যক্ষ দর্শন

আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছার পর প্রথমে নবী করিম (সা.) আল্লাহর প্রশংসা করলেন এভাবে ‘আত্তাহিয়্যাতু লিল্লাহি ওয়াস্সালাওয়াতু ওয়াত্তইয়্যেবাতু’

অর্থ—‘আমার জবান, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও ধন-সম্পদ দ্বারা যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য হাদিয়া স্বরূপ পেশ করছি।’

এর উত্তরে আল্লাহ তায়ালা নবীজীকে ছালাম দিয়ে বললেন—‘আস্সালামু আলাইকা আইয়্যুহান্নাবিউ ওয়া রহ্মাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু’

অর্থ—‘হে আমার প্রিয় নবী, আপনার প্রতি আমার ছালাম, রহমত ও বরকতসমূহ বর্ষিত হোক।’ উক্ত ছালামের জবাবে নবী করিম (সা.) আরয করলেন—‘আস্সালামু আলাইনা ওয়া‘আলা ইবাদিল্লাহিস স্বলিহীন।’

অর্থ—‘হে আল্লাহ! তোমার ছালাম এবং আমি আমার গুনাহ্গার উম্মতের উপর এবং তোমার অন্যান্য নেককার বান্দাদের উপরও বর্ষিত হোক!’

আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের এই ছালাম বিনিময়ের কৌশলপূর্ণ উক্তি ও ভালবাসার নমুনা এবং উম্মতের প্রতি নবীজীর স্নেহ মমতা দেখে ও শুনে জিব্রাইল (আ.)সহ আকাশের মোকাররাবীন ফেরেস্তাগণ সমস্বরে বলে উঠলেন—‘আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আব্দুহু ওয়া রাসূলুহু’

অর্থ—‘আমি (প্রত্যেকে) সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই এবং আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.) আল্লাহর অতি প্রিয় বান্দা এবং তাঁর প্রিয় রাসুল।’

‘আল্লাহর কাছে তিনি প্রিয় বান্দা কিন্তু বিশ্ব জগতের কাছে তিনি প্রিয় রাসুল।’ কি যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক এখানে বর্ণনা করা হয়েছে- তা কেবল মহাজ্ঞানীরাই অনুধাবন করতে পারবেন।

আল্লাহ তায়ালা নিজের ও হাবীবের মধ্যে ভাব বিনিময়ের এই তাশাহুদ আমাদের নামাযের একটি ওয়াজিব অংশ করে দিয়েছেন। এর প্রতিটি শব্দ নামাযের বৈঠকে ওয়াজিব করে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালার দরবারে নবী করিম (সা.) যেভাবে সম্মোধনমূলক তাহিয়্যাত পাঠ করেছিলেন এবং আল্লাহ তায়ালাও যেভাবে সম্বোধন করে নবীজীকে ছালাম দিয়েছিলেন, অনুররূপভাবেই তাশাহ্দু পড়ার সময় প্রত্যেক মুছল্লিকে আল্লাহকে সম্বোধন করে তাহিয়্যাত অংশটুকু পাঠ করতে হবে এবং নবী করিম (সা.)-কেও সম্বোধন করে ছালাম পেশ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে ফতোয়া শামীর এবারত এর হুবহু অনুবাদ—

অর্থ—‘আল্লাহর তাহিয়্যাত এবং রাসুলের প্রতি ছালাম পাঠকালীন সময়ে খেতাব বা সম্বোধন করতে হবে। শুধু মি’রাজের ঘটনা বর্ণনা করা উদ্দেশ্য নয়।’

—ফতোয়ায়ে শামী, ফতোয়ায়ে আলমগীরী ও বাহারে শরীয়ত দ্রষ্টব্য

যেহেতু মুমিনদের জন্য নামায মি’রাজ স্বরূপ সুতরাং মি’রাজের মতই আল্লাহ ও রাসুলকে সম্বোধন করতে হবে। সম্বোধন করা হয় হাযির নাযির ব্যক্তিকে। সুতরাং নবীজী হাযির ও নাযির।

—ইমাম গাযালীর ইহ্ইয়া

উম্মতের জন্য মাগফিরাতের সুপারিশ

রিয়াজুন্নাছেহীন কিতাবে তাফসীরে মুগনী ও মিরছাদুল ইবাদ নামক দুটি গ্রন্থের সূত্রে বর্ণিত আছে—নবী করিম (সা.)-কে আল্লাহ তায়ালা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি আমার কাছে কি প্রার্থনা করেন?’ নবী করিম (সা.) বললেন—‘হে আল্লাহ! আপনি রাব্বুল আলামীন, আর আমাকে বানিয়েছেন রাহমাতুল্লিল আলামীন। আমার উম্মত বেশুমার গুনাহগার মুযনেবীন। আমার খাতিরে আমার গুনাহগার উম্মতকে মাফ করে দিন।’ আল্লাহ তায়ালা বললেন—‘আপনার খাতিরে আপনার উম্মতের মধ্য হতে সত্তর হাজারকে ক্ষমা করার প্রতিশ্র“তি দিচ্ছি।’ এরপর আর কি প্রার্থনা আছে? নবী করিম (সা.) পুনরায় গুনাহগার উম্মতের কথা উল্লেখ করলেন। এভাবে ৭০০ (সাতশত) বার প্রার্থনা করলেন। প্রত্যেকবার সত্তর হাজার করে গুনাহগার উম্মতের ক্ষমার কথা ঘোষণা করলেন পাক পরওযারদেগার। এভাবে চার কোটি নব্বই লক্ষ উম্মতকে ঐ দিন ক্ষমার আওতায় আনা হলো।

নবী করিম (সা.) উম্মতের মায়ায় আবারও আরয পেশ করলেন। আল্লাহ তায়ালা এবার বললেন—‘এখন আপনি ও আমি একা। হাশরের ময়দানে ফেরেস্তা, আম্বিয়া, আউলিয়া ও হাশরবাসীদের সবার সামনে অবশিষ্টকে ক্ষমা করবো। আপনি চাইবেন—আমি দেবো। সবাই সাক্ষী থাকবে এবং আপনার মর্তবা তখন সকলেই উপলব্ধি করবে।’ সোব্হানাল্লাহ! এমন শাহী দরবারে গিয়েও নবী করিম (সা.) নিজের ও পরিবারের জন্য কিছুই না চেয়ে শুধু গুনাহগার উম্মতের নাজাত প্রার্থনা করেছেন। সত্যিই তিনি ঈমানদারদের জন্য রাউফ ও রাহীম। সুরা তওবার শেষাংশ এরশাদ হয়েছে : বিলমু’মেনিনা রাউফুর রাহীম।

অর্র্থাৎ—‘নবী করিম (সা.) মোমেনদের জন্য স্নেহময় ও দয়াশীল।’ এই স্নেহ ও দয়ার বহিঃপ্রকাশ হয়েছিল মি’রাজের রাত্রিতে এবং ভবিষ্যতে হবে হাশরের ময়দানে। যখন আল্লাহর ভয়ে কেউ সুপারিশের জন্য অগ্রসর হবে না- তখন নবী করিম (সা.) হতাশ হাশরবাসীদেরকে অভয় দিয়ে বলবেন, ‘আনা-লাহা, তোমাদের শাফাআতের জন্য আমি আছি’—সুব্হানাল্লাহ!

—বোখারী ও মুসলিম

মি’রাজ হতে ষষ্ঠ আকাশে প্রত্যাবর্তন ও পুনঃগমন

অনেক নায ও নেয়াযের কথার পর আল্লাহ তায়ালা উম্মতে মুহাম্মদীর উপর দিনে রাত্রে ৫ ওয়াক্ত নামায এবং একমাস রোজা ফরয করলেন নবী করিম (সা.)-কে বিদায় দিলেন। নবী করিম (সা.) যখন ৬ষ্ঠ আকাশে আসলেন, তখন মুসা (আ.)-এর সাথে সাক্ষাত হলো। সিদ্রাতুল মুন্তাহাতে জিব্রাইল (আ.), কিংবা সপ্তম আকাশে হযরত ইব্রাহীম (আ.), কিংবা অন্য কোন আকাশে অন্যান্য নবীগণের সাথে সাক্ষাতের উল্লেখ কোন হাদিসগ্রন্থে দেখা যায় না। শুধু মুসা (আ.)- এর উল্লেখ রয়েছে।

—বোখারী মুসলিম, মিশকাত প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থ

নামায পাঁচ ওয়াক্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার হেকমত তাফসীরে রুহুল বয়ান, ইতকান, বেদায়া নেহায়া—প্রভৃতি গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। ফজর নামায হযরত আদম (আ.) আদায় করতেন। যোহরের নামায হযরত ইব্রাহীম (আ.) আদায় করতেন, আসরের নামায হযরত ইউনুছ (আ.) আদায় করতেন, মাগরিবের নামায হযরত ঈসা (আ.) আদায় করতেন এবং এশার নামায হযরত মুসা (আ.) আদায় করতেন।

এভাবে আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করে পাঁচজন পয়গাম্বরের পাঁচ ওয়াক্ত নামায একত্রিত করে উম্মতে মুহাম্মদীকে দান করলেন। সুতরাং নামাযের ইবাদতটি নবীগণের স্মৃতি বহনকারীও বটে।

[মূলত প্রত্যেক ইবাদতের মধ্যেই, এমনকি প্রত্যেক তসবিহ্-এর মধ্যেও কোন না কোন নবী, অলী অথবা ফেরেস্তার ইবাদতের স্মৃতি বিজড়িত আছে। যেমন—হজ্বের মধ্যে হযরত ইব্রাহীম, কোরবানীর মধ্যে হযরত ইসমাইল (আ.), সাঈ-এর মধ্যে বিবি হাজেরা এবং আরাফাতে অবস্থানের মধ্যে হযরত আদম (আ.)-এর স্মৃতি জড়িত। নামাযের মধ্যে কিয়াম, রুকু, সিজদা, তছবিহ্ ইত্যাদি ফেরেস্তাদের ইবাদতের স্মৃতি—যা নবী করিম (সা.) মি’রাজে প্রত্যক্ষ করে এসেছেন। নবী করিম (সা.) প্রথমে নিজে আমল করেছেন। পরে আমাদেরকে হুকুম করেছেন—হুযুর (সা.)-কে দেখে দেখে অনুসরণ করার জন্য। সুতরাং নবী করিম (সা.)-এর অনুকরণ ও অনুসরণের নামই ইবাদত—যার মধ্যে রয়েছে অন্যদের স্মৃতি বিজড়িত।

—জালালুদ্দীন সূয়ুতি কৃত শরহে সুদূর

এখন প্রশ্ন হল লা মাকান থেকে আল্লাহর দরবারে বিশ্বনবী (সা.)-এর যাতায়াত বা দুনিয়াতে ফেরত আসার ক্ষেত্রে রফরফ বা বোরাক ব্যবহারের উল্লেখ হাদিসের কিতাবে সরাসরি পাওয়া যায় না। তাফসীরে রুহুল মাআনিতে বলা হয়েছে : যেভাবে বোরাকে করে নবী করিম (সা.) মি’রাজ গমন করেছেন, সেভাবেই আবার ফেরত এসেছেন। এটাই স্বাভাবিক ধারণা। তাফসীরে রুহুল বয়ান তাফসীরে রুহুল মাআনিরও পূর্বে রচিত- তাই এর মতামত অধিক শক্তিশালী। উক্ত তাফসীরে রুহুল বয়ানের গ্রন্থকার সুরা নাজম-এর প্রথম তিনটি আয়াত-এর ব্যাখ্যায় বলেছেন : ওয়ান্নাজমি + ইজা হাওয়া + মা দল্লা সাহিবুকুম ওয়ামা গাওয়া +

অনুবাদ—‘নিম্নগামী তারকার শপথ! তোমাদের সাথী মুহাম্মদ (সা.) কখনও পথ ভুলেননি বা পথভ্রষ্ট হননি এবং টেরা বাঁকাও হননি।’

তাফসীরকারক বলেন, উক্ত আয়াত মি’রাজের ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত। সাধারণ অর্থে অস্তমিত তারকা হলেও ইমাম জাফর সাদেক (রা.)-এর মতে ‘নাজম দ্বারা উক্ত আয়াতে নবী করিম (সা.) কেই বুঝা হয়েছে। কেননা হুযুর (সা.)-এর এক হাজার নামের মধ্যে আন-নাজম একটি নাম। আর হাওয়া অর্থ নিম্নগামী। তাহলে আয়াতের অর্থ দাঁড়ায়—‘আল্লাহর দরবার থেকে নিম্নগামী তারকা মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)-এর শপথ!’ আর ‘পথ ভুলেননি বা টেরা বাঁকা হননি’- এই মন্তব্যের অর্থ: ‘যে পথে তিনি এসেছিলেন, সেপথেই ফিরত গিয়েছেন।’

বোরাক বা রফরফের মাধ্যমে প্রত্যাবর্তন করলে একথার প্রয়োজন হতো না। কেননা, তখন তো বোরাক বা রফরফই তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতো। সুতরাং নবী করিম (সা.) মি’রাজ থেকে আসাকালীন সময়ে আল্লাহর কুদরতে একা একা যাতায়াত করেছেন— এটাই সুস্পষ্ট। কেননা, তিনি তো নূর। নূর ও আলো সব কিছু ভেদ করে সোজা গতিতে ধাবিত হয়, এটাই বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত। শুধু বাইতুল মোকাদ্দাসে এসে বোরাকে আরোহণ করে তিনি মক্কায় পৌঁছেন। ৭০০ বৎসর পূর্বের ফারসী গ্রন্থ ‘রিয়াযুন নাসিহীন’-এ ইমাম জা’ফর সাদেক (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে—‘মি’রাজ’ হতে ফিরে আসার পথে রফরফ, বোরাক বা ফিরিস্তা -কিছুই সাথে ছিল না।’

—তাফসীরে ইবনে আব্বাস রুহুল বয়ান- সুরা আন নাজম

অন্য কথা হল, নবী রাসুলগণ! ইন্তিকালের আড়াই হাজার বৎসর পরও স্বশরীরে উপস্থিত থাকতে পারেন। যেমন মুসা (আ.) ও বিশ্বনবী (সা.)-এর সাক্ষাত।

তাফসীরে সাভীতে উল্লেখ আছে, হজরত মুসা আ. তূর পর্বতে আল্লাহর দীদার চেয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এমনকি আল্লাহর যে তাজাল্লী তূর পর্বতে আপতিত হয়েছিল—মুসা (আ.) ঐ তাজাল্লীতে বেঁহুশ হওয়ার কারণে তাও দর্শন করতে পারেননি। কিন্তু মি’রাজের রাত্রিতে নবী করিম (সা.) আল্লাহর সান্নিধ্যে ফানা হয়ে আল্লাহর যে তাজাল্লী নিয়ে এসেছিলেন—তা দেখে হযরত মুসা (আ.)-এর তূর পর্বতের সেই সাধ পুনরায় জেগে ওঠে। তাই তিনি বার বার আল্লাহর তাজাল্লী দর্শনের জন্যই রাসুলে করিম (সা.)-এর চেহারা মোবারকের দিকে দৃষ্টি দিয়েছিলেন। আর মহান আল্লাহও তাঁর অপূরণীয় মনের বাসনাকে পূরণের ব্যবস্থা হিসেবে বিশ্বনবীর সাথে তাঁর সাক্ষাত করিয়ে দেন। সুব্হানাল্লাহ!

তাফসীরে সাভী ২য় খণ্ড ৪১৯ পৃ.

আ’লা হযরত শাহ আহ্মদ রেযা (রা.) বলেন—

অনুবাদ—‘মুছা (আ.) সেদিন কাকে দেখেছিলেন এবং তাঁর মাধ্যমে কার প্রতিচ্ছবি দেখেছিলেন—তা মুসা (আ.) কেই জিজ্ঞেস করো। তিনি নূরে মুহাম্মদ (সা.) কে দর্শনের মাধ্যমে স্বয়ং আল্লাহর নূরের তাজাল্লিই প্রত্যক্ষভাবে দর্শন করেছিলেন। দিব্যদৃষ্টি সম্পন্ন লোকদের দিব্য জ্ঞানের উপর শত সহস্র ছালাম।’

—হাদায়েকে বখশিষ—আ’লা হযরত।

বিশ্বখ্যাত মাওলানা, সুফিকুল শিরোমণি আল্লামা জালালুদ্দীন রুমি (রা.) বলেছেন—

‘মুস্তফা আয়নায়ে মিল্লে খোদাস্ত,

মুন আকাছ দর ওয়ায় হামা খোয়ে খোদাস্ত।’

—মসনবী শরীফ

অর্থ—নবী মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন আল্লাহর নূরানী তাজাল্লী দর্শনের আয়না স্বরূপ। ঐ আয়নাতেই আল্লাহর পবিত্র যাতের সবকিছু প্রতিবিম্বিত ও প্রতিফলিত হয়।

পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি হযরত আল্লামা শরফুদ্দিন বুসরী (র.)-কে যিনি হাবীব পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শানে তাঁর প্রশংসাগীতি কাছিদায়ে বুরদা রচনা করে দীর্ঘদিনের পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থা প্যারালাইসিস রোগ থেকে মুক্তিলাভ করেছিলেন। হাবীব পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শানে কাছিদায়ে বুরদার কিছু অংশ—

আলহামদু লিল্লাহি মুনশিয়েল খাল্কি মিন আদামি

ছুম্মাস্ সালাতু আলাল মুখতারি ফীল কাদামি

মাওলায়া, সাল্লি ওয়া সাল্লিম দায়িমান আবাদা

আলা হাবীবিকা খায়রিল খালকি কুল্লিহিমি

—কাছিদায় বুরদা

খোদার সৃষ্টি জগতও জানে না তাদের সৃষ্টির মূল উৎসের রহস্য সন্ধান। এমনকি—ফেরেশতাকুল শিরোমণি হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালামও হাকিকতে মুহাম্মদী সম্পর্কে পূর্ণ অবগত ছিলেন না। তিনি শুধু একটি তারকাকে বাহাত্তর হাজার বার উদিত হতে দেখেছেন—সত্তর হাজার বছর পর পর। আর সত্তর হাজার বছর পর পর ডুবন্ত অবস্থায় বাহাত্তর হাজার বার দেখতেই পাননি। অংকের হিসাবে পাঁচশত চার কোটি বছর উদিত অবস্থায় ঐ তারকার যাহেরি সুরত মাত্র দেখেছিলেন হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম।

বাতেনিরূপে ঐ তারকা অনুরূপ পাঁচশত চার কোটি বছর অবস্থান করছিলেন। যাহেরি ও বাতেনি অবস্থায় মোট এক হাজার আট কোটি বৎসর নবী করীম (সা.) নূরানি চতুর্থ হিজাবে বিদ্যমান ছিলেন। কিন্তু জিবরাইল (আ.) ঐ বাতেনি সুরতের বিষয়ে সম্যক অবগত ছিলেন না। হযরত আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণিত হাদিস মোতাবেক নবী করিম রাউফুর রাহীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিবরাইল আলাইহিস সালামকে ঐ তারকার তথ্য জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি ছিলাম ঐ তারকা।’

—সীরাতে হলবিয়া ১ম খণ্ড ৩০ পৃষ্ঠা ও রুহুলবয়ান সুরা তৌবা ১২৮ আয়াত

সুতরাং এই হাকিকতে মুহাম্মদীর অর্ধেক বাতেনি অংশ বা বাতেনি রূপ সম্পর্কে জিবরাইলেরও প্রকৃত অবস্থা জানা ছিল না।

পবিত্র মি’রাজ রজনীতে মহান রাব্বুল আলামীনের দীদার লাভ করে যখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরতি পথে একাকী ষষ্ঠ আকাশে নেমে আসলেন, তখন হযরত মুসা আলাইহিস সাল্লামের সাথে তাঁর সাক্ষাতের মর্ম ছিল আল্লাহর নূরের তাজাল্লি দর্শন।