০৩:৩৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিল্পের বাস্তবতা: বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যত সম্ভাবনা

মাছুম বিল্লাহ
  • প্রকাশ: ০৮:১০:০০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২২ মার্চ ২০২১
  • / ৫১১৮ বার পড়া হয়েছে

বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিল্পের বাস্তবতা: বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যত সম্ভাবনা; দহন সিয়াম আহমেদ ও পূজা

ভূমিকা

চলচ্চিত্র শিল্প যে কোন  দেশের শিল্প-সংস্কৃতি বিকাশের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। সুস্থধারার শিল্পগুণসমৃদ্ধ ও  মানসম্মত চলচ্চিত্র যেমন দেশের অর্থনৈতিক বিকাশে ভূমিকা রাখে তেমনি দেশকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করে । শুধু তাই নয়, বর্তমান যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয় থেকে ফিরিয়ে আনতে সুষ্ঠুধারার চলচ্চিত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কেননা চলচ্চিত্র যেমন একটি সর্বজন গ্রহনযোগ্য শক্তিশালী বিনোদন মাধ্যম তেমনি ভালো চলচ্চিত্র মানুষের সুকামার বৃত্তিগুলোকে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে। শিক্ষামুলক চলচ্চিত্র চরিত্র গঠনেও  রাখতে পারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। তাই দেশে মানসম্মত ও রুচিসম্মত  চলচ্চিত্র নির্মিত  হলে ক্রমশ ভালো সিনেমা দেখার দর্শকও তৈরি হবে। চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালকসহ সিনেমা শিল্পের সাথে জড়িত সব কলাকুশলী আর্থিক লাভবান হবেন। ২০১৯ সালের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ৫৮টি দেশের ২১৮টি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়েছে। এর মধ্যে পূর্নদৈর্ঘ চলচ্চিত্র ১২২টি, স্বল্পদৈর্ঘ ও স্বাধীন চলচ্চিত্রের সংখ্যা ৯৬টি। ১৯৯২সালে প্রথম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল। উৎসবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তার শুভেচছা বক্তব্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সব মানবিক অনুভূতি উঠে আসে। একটি ভালো চলচ্চিত্র একজন মানুষ ও সমাজকে বদলে দিতে পারে। মানুষের জন্য কাজ করতেও অনুপ্রাণিত করে। সাহিত্যনির্ভর যেসব চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে  সারা বিশ্বে সেগুলোতে যোগ হয়েছে ভিন্নতর একটি মাত্রা। এটি ঠিক যে চলচ্চিত্র এমন একটি মাধ্যম যা সংগ্রহ ও সমন্বয় করে নেয় শিল্প সাহিত্যের প্রায় সব শাখাই। বাস্তব জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক সংকট ও টানাপোড়েন ভুলে দু-আড়াই ঘন্টার জন্য হাসি-কান্না আর নাটকীয়তায় পূর্ণ নাচে-গানে ভরপুর ছায়াছবি খেঁটেখাওয়া মানুষকে আমাদের পাশাপাশি এক ধরনের জীবনশক্তিও দান করে থাকে। স্বাভাবিক সুস্থ চিত্তবিনোদনের অভাবে একজন মানুষ মনোবৈকল্যের শিকার হতে পারে বলে আধুনিক মনোবিজ্ঞান সতর্ক করে দিয়েছে। Contemporary research has also revealed more profound aspects to film’s impact on society. In a 2005 paper by S C Noah Uhrig (University of Essex, UK) entitled, Cinema is Good for You: The Effects of Cinema Attendance on Self-Reported Anxiety or Depression and ‘Happiness’” the author describes how, “The narrative and representational aspects of film make it a wholly unique form of art. Moreover, the collective experience of film as art renders it a wholly distinct leisure activity.

বাংলাদেশের সিনেমা শিল্পের ইতিহাস ও বৈশিষ্টসমূহ

বাংলাদেশে প্রধানত তিন ধরনের চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। যেমন- (ক) বাণিজ্যিক ছবি (খ) আর্ট ও (গ) বিকল্প ক্যাটাগরির চলচ্চিত্র । বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের মোটামুটি পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং ২০০০ এর বেশি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে এই ইন্ডাসিট্র থেকে। (২)। ‘গেরিলা’ ছবিটির পরিচালক নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। তিনি নিজে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং সফল নাট্যব্যক্তিত্ব। তাঁর ‘গেরিলা’ ছবিটি ২০১১ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ মোট ছয়টি পুরুস্কার জিতে নেয়। এই ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের সবটুকু উঠে না এলেও যুদ্ধকালীন রণাঙ্গনের কিছু দৃশ্য এবং পাক-হানাদার বাহিনীর নির্মমতা যেভাবে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশে নির্মিত অন্য কোন চলচ্চিত্রে তা খুব কম দেখা গেছে। পাক-সেনাসদস্যের ভূমিকায় শতাব্দী ওয়াদুদ যেমন ভালো অভিনয় করেছেন তেমনি তিনি জিতে নিয়েছেন শ্রেষ্ঠ খলনায়কের পুরুস্কার। নায়িকার ভূমিকায় জয়া আহসান পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর সম্মান।

এক সময় নায়িকার বৃষ্টিভেজা গান ছাড়া ছবির কথা ভাবাই যেত না। এফডিসিতে সারাবছরই বর্ষাকাল লেগে থাকত। প্রাকৃতিক বৃষ্টির আশায় বসে থাকতেন না কোন নির্মাতা। নায়িকার বৃষ্টিভেজা শরীরের ছবি ছাপা হতো পত্রিকার পাতায়ও। ঢাকার সিনেমায় বৃষ্টি নিয়ে প্রথম ধামাকা ‘রঙ্গিলা’ ছবির ‘হৈ হৈ রঙ্গিলা রঙ্গিলারে রিম ঝিম রিম ঝিম বরষায় মন নিলারে’। বৃষ্টির গানের ট্রেন্ডসেটার’ রঙ্গিলা’। রাজ্জাক-কবরীর সেই গানে যে বঙ্গদেশের দর্শক মাতাল হলো, তা চলল তিন দশক। এরপর নির্মাতারা সুযোগ পেলেই এফডিসিতে বর্ষা নামিয়েছেন। পৌষ মাসের শীতেও এফডিসিতে বৃষ্টির গানের শুটিং হয়েছে অজস্র। কৃত্রিম বৃষ্টিতে ভিজে অনেক  নায়িকার সর্দি লেগে যেত। সেখানে দেখা যায় ঢালিউডের কোন নায়িকাই নির্মাতাদের বৃষ্টিপ্রীতি থেকে রেহাই পাননি। পাওয়ার কথাও নয়। বৃষ্টি ততদিনে ঢাকাই সিনেমার মোস্ট পাওয়ারফুল তারকা। নায়িকা ছবিতে যেই থাকুন, বৃষ্টিভেজা গান না থাকলে চলবে না। দর্শক হলে যাবে না। অতএব পাতলা শাড়ি আনো। আঁটশাটচ করে নায়িকাকে পরাও। তারপর হোসপাইপ ছেড়ে দিয়ে বসে থাক। নৃত্য পরিচালকদের তখন নাওয়া-খাওয়া মাথায়  বৃষ্টির গানের জন্য আলাদা কম্পেজিশন চাই, সব নির্মাতারা একগানে দর্শককে মাত করে দিতে হবে। বারবার যেন এই গানের টানে দর্শক সিনেমা হলে ফিরে আসে। ঢালিউডে বৃষ্টির গান আর তার সঙ্গে নারীদেহের নিবিড় ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে সত্তর দশকের সাড়াজাগানো ‘দি রেইন’ ছবিতে অলিভিয়ার দুর্দান্ত পারফরমেন্সের পর ‘দি রেইন’ দেখার পর নির্মাতারা জানালেন পর্দায় নায়ক-নায়িকার তোলপাড় রোমান্টিকতা না হলেও চলে। তবে বৃষ্টিভেজা গানে তাদের আকর্ষনটা ষোলো আনা পাওয়া চাই। ‘দি রেইন’ হিট হওয়ার পর অলিভিয়া আবির্ভূত হলেন ঢাকাই সিনেমার আবেদনের দেবীরূপে। নরম গরম ছবির এই বৃষ্টিভেজা রাতে চলে যেওনা। এমনভাবে দর্শক-হৃদয়ে কম্পন তুলা নতুন আবেদনমীয় আসন পলকেই পাল্টে চলে গেল অঞ্জুর কাছে। নিয়মিত বৃষ্টিভেজা হতে লাগলেন অঞ্জু।

ঢাকার সিনেমায় বৃষ্টি নিয়ে প্রথম ধামাকা ‘রঙ্গিলা’ ছবির ‘হৈ হৈ রঙ্গিলা রঙ্গিলারে রিম ঝিম রিম ঝিম বরষায় মন নিলারে’
ঢাকার সিনেমায় বৃষ্টি নিয়ে প্রথম ধামাকা ‘রঙ্গিলা’ ছবির ‘হৈ হৈ রঙ্গিলা রঙ্গিলারে রিম ঝিম রিম ঝিম বরষায় মন নিলারে’

ষাট-সত্তরের দশকে বাংলা সিনেমার কী এক সুবর্ণ সময় ছিল। ঢাকার গুলিস্তান হলে বাংলা আর ওপর তলার নাজে ইংরেজি সিনেমা দেখার মধুর স্মৃতি এখন অনেকেরই হৃদয়পটে আঁকা আছে। সেকালে চলচ্চিত্র শিল্পের কারিগরি মান তেমন উন্নত না হলেও সুস্থ ধারার অনেক ছায়াছবি নির্মিত হয়েছে। প্রয়াত জহির রায়হান এবং আলমগীর কবীর বেশ কিছু ক্লাসিক্যাল ছবি তৈরি করে দেশে বিদেশে সম্মান কুড়িয়েছেন, জয় করেছেন দর্শক হৃদয়। রাজ্জাক, হাসান ইমাম, আনোয়ার হোসেন, কবরী, সূচন্দা, ববিতার মতো শিল্পীরা অভিনয় প্রতিভার কম স্বাক্ষর রাখেননি। সত্যজিৎ রায়ও ববিতাকে দিয়ে ‘অশনি সংকেত’-এর মতো ছায়াছবি বানাতে সাহস করেছিলেন। এসব ছায়াছবি, অভিনেতা-অভিনেত্রীর কথা এ দেশের দর্শক আজো ভোলেনি। এরপর কেটে গেছে অনেক সময়। বর্তমান সময়ের ‘মাটির ময়না’, ‘জয়যাত্রার’ মতো ছবি এদেশে তৈরি হয়েছে। তানভীর মোকাম্মেল, মোরশেদুল ইসলামের মতো বেশ কজন শর্টফিল্ম নির্মাতা তাদের কর্মে দেশে বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছেন, সম্মান কুড়িয়েছেন। বিশেষ শৈল্পিক গুণের অধিকারী অকালপ্রয়াত চলচ্চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ তো বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এক নতুন ধারার স্বাক্ষর রেখে গেছেন।

‘জীবন থেকে নেয়া ’(১৯৭০), ‘হীরক রাজার দেশে’ (১৯৮০) বা সম্প্রতি তৈরি ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ (২০১২) প্রভৃতি ছবিতে যেভাবে রূপকধর্মী কাহিনীর মাধ্যমে রাজনৈতিক সমালোচনা তুলে ধরা হয়েছে, তেমন বুদ্ধিদীপ্ত চেষ্টাও বাংলাদেশের চিন্তাশীল ছবির জগতে চোখে পড়ে না ফলে আমাদের দেশে বাণিজ্যিক লাভ নিশ্চিত করবে এমন বিনোদননির্ভর ছবি তৈরির আগ্রহ আমরা বেশি দেখতে পাচিছ। আর প্রচারও যখন আকর্ষণীয় হয় তখন এমন ছবি দেখতে যায় বহু মানুষ। কিন্তু মূলত বিনোদন প্রদানের কারণে এই ধরনের চলচ্চিত্র দর্শকের সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারেনা বরং এমন চলচ্চিত্র সমাজে বিদ্যমান অন্যায়ের প্রতি প্রতিবাদ করতে সচেতন হওয়ার প্রয়েজানীয়তা থেকে দর্শকদের মনোযোগ সরিয়ে দেয় হালকা বিনোদনের দিকে।

বক্তব্য আর নির্মানশৈলির দিক দিয়ে চিন্তাশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্রের কথা বলতে হলে আলমগীর কবিরের ‘ধীরে বহে মেঘনা’ (১৯৭৩) আর রূপালী সৈকতে (১৯৭৮), মসিহউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলীর ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ (১৯৭৯), তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ (২০০২) এবং হাতেগোনা আর কয়েকটি চলচ্চিত্রের নামই কেবল উল্লেখ করা যায়।আশির দশকে এদেশে স্বল্পদৈর্ঘের বক্তব্যধর্মী ছবি তৈরির একটি চর্চা শুরু হয়েছিল। কিন্তু ফ্রান্স, ব্রাজিল, ভারত, আর্জেন্টিনা, ইরান, জার্মানি, জাপান, কিউবা প্রভৃতি দেশে যেভাবে বিনোদনধর্মী ছবির বাঁধাধরা পদ্ধতি সম্পূর্ন প্রত্যখ্যান করে প্রথাবিরোধী নতুন ধারার পূর্ন্যদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নির্মান শুরু হয়েছিল সেভাবে নতুন চলচ্চিত্রের আন্দোলন বাংলাদেশে আমরা দেখতে পাইনি।

একসময় ঢাকার সিনেমা হলগুলোতে দর্শকরা দেখেছেন পশ্চিমে তৈরি হওয়া বিভিন্ন ক্ল্যাসিক ছবি। ক্লার্ক গেবল, অ্যালেক গিনেস, গ্রগরি পেক, পিটার ও টুল, ওমর শরিফ, অড্রে হেপবার্ন, ডরিস ডে, এলিজাবেথ টেলর প্রমুখ বিখ্যাত চলচ্চিতশিল্পী অভিনীত অনেক উচঁমানের ছবি প্রদর্শিত হয়েছে ঢাকার বিভিন্ন সিনেমা হলে। বিভিন্ন দেশে তৈরি শৈল্পিক কিংবা রাজনৈতিক ছবি সিনেমা হলে দেখানো না হলেও বিভিন্ন চলচ্চিত্র সোসাইটি নিয়মিতভাবে বিশ্বখ্যাত পরিচালক, যেমন জঁ-ল্যুক গদার, লুই বুনুয়েল, আকিরা কুরোশাওয়া, ইংমার বার্গম্যান, সত্যজিৎ রায় প্রমুখের চলচ্চিত্র বা কোন নির্দিষ্ট দেশের প্রথাবিরোধী ছবির প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হতো। এমন প্রদর্শন নব্বই দশকেও নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হত ঢাকায়।

আশির দশক। বাংলা ছবির ব্যবসার স্বর্ণযুগ। ছবির মান গাছে উঠে গেছে। ফোক-ফ্যান্টাসি-সামাজিক-অসামাজিক নানা ধরনের ছবি হচ্ছে। পাল্লা দিয়ে ব্যবসা করছে সব ছবি। নায়িকার শরীর দেখাতে নির্মাতারা আধা-পাগল। সরসারি শরীর দেখানেয় ঝক্কি আছে। সমালোনার তোপে পড়তে হয়। তাই, বৃষ্টির গানের অজুহাতে নায়িকার শরীরের সমস্ত বাঁক দেখানো চলত। রোজিনা, দিতি, চম্পা জিনাত বৃষ্টির গানে সবাই তাদের সেরা পারফরমেন্সটাই দেখিয়েছেন। কে কার চেয়ে এগিয়ে যাবেন এই প্রতিযোগতিায়! সিনেমা নির্মাতাদের নিজেদেরকে প্রশ্ন করতে হবে, ‘সেই দিন কি এখনও আছে?’ দর্শক কি বৃষ্টিতে ভেজা নারীদেহ দেখার জন্য সিনেমা হলে যাবে? যাবেনা কারণ হাতের মোবাইল টিপ দিলেই সে এর চেয়েও আকাঙ্ক্ষিত নারীর নগ্নদেহ দেখতে পারে। কাজেই দর্শক কি ধরনের ছবি দেখতে চায় সে নিয়ে কোন গবেষনা কিংবা স্টাডি করা হয়নি যার ওপর ভিত্তি করে ছবি নির্মান করা হবে।

বাংলাদেশে সিনেমার বর্তমান দুর্দশার কারণসমূহ

অধিকাংশ দর্শক চলচ্চিত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ঢাকা শহরের নামি-দামি সিনেমা হলে এখন আর দর্শক সমাগম নেই। বন্ধ হয়ে গেছে অনেক হল। In 1980s and 1990s the quality of films increased but it fell down in an alarming manner. Sex and violence are essentaial elements of mainstream films and which are failed copies of Bollywood. 1990s on an avergage 80 feature films were released in Bangladesh every year. More than a million people viewed picture in 1500 cinema halls.

আজকাল ভালো ছবি নির্মিত হচ্ছে কম। বরং আজেবাজে কাহিনী নিয়ে তৈরি বাস্তবতা বর্জিত ছবির ভিড়ে ভালো ছবি ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে। শুধু ব্যবসা সফলতার দিক চিন্তা করে নিয়মিত তৈরি হচ্ছে অশ্লীল ছবি। এসব ছবির পোস্টারে ছাপা হয় নায়িকার অশ্লীল দেহভঙ্গী। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসব সিনেমা দেখা যায় না। সস্তা বিনোদন প্রত্যাশী এক শ্রেণির দর্শক এসব সিনেমা দেখেন। তরুণ সমাজকে রুচিহীনতার দিকে ঠেলে দিতে এ ধরনের ছায়াছবি অনেকটা ভূমিকা রাখে। সিনেমা শিল্প যে শুধু বিনোদন মাধ্যম নয় তা যেন বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকারগন ভুলতে বসেছেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র যেন একজন বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হয়েছে।

বর্তমানে অভিনয় শিল্পীরা একে অন্যের সঙ্গে রেষারেষি, ক্ষমতা প্রদর্শনে ব্যস্ত। রাঘব বোয়ালরা তাদের কথার ফুলঝুড়ি আর একে অন্যকে ক্ষমতা প্রদর্শন করছেন। চলচ্চিত্রের এ অস্থিরতায় ইউটিউবে সিনেমা দেখে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলে নিজেদের বোদ্ধা ভাবছেন অনেকে। শিল্পীর সঙ্গে শিল্পীর, নির্মাতার সঙ্গে নির্মাতার, প্রযোজকের সঙ্গ প্রযোজকের নেই কোন আত্মিক সম্পর্ক। দিন দিন বেড়েই চলছে তাদের রেষারেষি। বেড়েই চলছে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ, মামলা-পাল্টা মামলা। শুধু মামলায় থেমে থাকেনি, হামলার ঘটনাও ঘটেছে। ক্ষমতা প্রদর্শন করা নোংরা রাজনীতি বাড়লেও দিনে দিনে কমে যাচ্ছে সিনেমা নির্মানের সংখ্যা। ফলে হলে সিনেমা মুক্তির সংখ্যাও কমে গিয়েছে। অতীতে তাকালে দেখা যায়- এক সপ্তাহে কয়েকটি সিনেমা মুক্তির জন্য প্রস্তত থাকত। সেখান থেকে প্রযোজক সমিতি নির্ধারণ করে দিতেন কোন দুটি সিনেমা মুক্তি পাবে। বর্তমানকালে দু একটা ছবি মাঝেমধ্যে সিনেমা হলের দৃশ্যপট বদলে দেয় বটে, ভালো ব্যবসাও করে কিন্তু ঘুণে ধরা আর ধসে পড়া ব্যবস্থার কারণে প্রযোজক, পরিচালক বা শিল্পিরা লাভবান হচ্ছেন না। কমে গেেছ চলচ্চিত্র, প্রেক্ষাগৃহ, সিনেমা হলের সংখ্যা ১৫০০ থেকে ১৭০ এ নেমে এসেছে। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান, অভিনয়শিল্পী, কলাকুশলীর সংখ্যা। তাই ভালো চলচ্চিত্র হওয়া এখানে কঠিন বলে মনে করেন অনেকে।

বিনোদন প্রাধ্যান্য দিয়ে আমাদের দেশে মূলধারা এবং মূলধারার বাইরেও অনেক ছবি তৈরি হয়েছে। সেইসব ছবির নির্মানপদ্ধতিতে প্রাধান্য পেয়েছে দর্শককে সহজে আকৃষ্ট করা যায় এমন বিনোদনধর্মী ফর্মূলা। এই ধরনের ছবি হয়তো বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়েছে কিন্তু বিনোদন প্রদানের গতানুগতিক প্রথার উপর নির্ভরতার কারণে এই ধরনের ছবি দর্শকদের জন্য নতুন কিছু দেখার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেনি। দর্শককে সমসাময়িক বাস্তবতা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে প্ররোচিত করাও সম্ভব হয়নি। পরিবারের সকল সদস্য একত্রে বসে বাংলা সিনেমা দেখার আয়োজন বহু আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। দর্শক যখন সিনেমা সংকটের কারণে পারিবারিক বিনোদনের জন্য বাংলা নাটকের উপর নির্ভর করা শুরু করেছে, সেটি কিন্তু বেশ কিছুদিন ইতিবাচক ধারায় প্রবাহমান ছিল। বাংলা নাটকের নির্মানশৈলী, গল্প, অভিনেতা-অভিনেত্রীর চমৎকার অভিনয় এবং সার্বিক ব্যবস্থাপনা দর্শকদের বিনোদনের মাধ্যমে হিসেবে আস্থা অর্জন করেছে। সেটিও আবার অনেকটা হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রথাবিরোধী ছবি তৈরির ঝুঁকিও পরিচালক-প্রযোজকরা কম নিচ্ছেন। আবার কখনও কখনও আর্থিক সাফল্য থাকবে না এমন ঝুঁকি নিয়ে যদি ছবি তৈরিও করা হয় চিন্তা থাকে যে, সমসাময়িক কোন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমালোচনার কারণে সেই ছবি সেন্সরের ছাড়পত্র পাবে কিনা, বিতরণ এবং প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট সহযোগিতা থাকবে কিনা ইত্যাদি।

সমাজের বেশিরভাগ মানুষ যদি কেবল বিনোদনধর্মী বিষয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং নানা জটিল সমস্যা নিয়ে ধারালো এবং সুচিচিন্তত প্রশ্ন করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তাহলে কোন গোষ্ঠী প্রকৃতপক্ষে লাভবান হবে? বিকল্প ধারার যে কমসংখ্যক চলচ্চিত্র আমাদের এখানে তৈরি হচ্ছে সেখানেও দেখা যায় ছবির নির্মানশৈলী প্রথাবিরোধী এবং উদ্ভাবনী করে তোলার ক্ষেত্রে যথেষ্ট মনোযোগ নেই। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু নিয়ে নির্মিত কোন চলচ্চিত্রে গতানুগতিক নির্মানপদ্ধতি ব্যবহার করা হলে ছবির বক্তব্য দর্শক-মনে অভিধাত তৈরি করবে না। তাই বিকল্প ধারার পরিচালককে মনে রাখতে হবে বিষযবস্তু পাশাপাশি ছবির নির্মাণশৈলিতেও নান্দনিক নতুনত্ব থাকা জরুরি।

সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে হালকা দিক প্রাধান্য পেলে সমাজে গভীর বক্তব্যধর্মী চলচ্চিত্র, নাটক, সাহিত্য সৃষ্টি হবে না । আমাদের সমাজে চাকচিক্যনির্ভর চলচিচত্রকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা দেখে কখনও কখনও মনে হয় বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে চলচ্চিত্রকে বিনোদনের সমার্থক করে ফেলা হয়েছে। কোন কোন জাতীয় দৈনিকেও দেখা যায় চলচ্চিত্র সম্পর্কিত সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে ’বিনোদন’ শিরোনাম দিয়ে।মনে হচ্ছে চলচ্চিত্র শুধু বিনোদনের জন্যই, এই প্রবণতা দর্শকদের চলচ্চিত্র সম্পর্কে ভুল বার্তা দেয়। বিনোদনধর্মী চলচ্চিত্র একটি আলাদা ধারা কিন্তু সব চলচ্চিত্র অবশ্যই বিনোদনধর্মী নয় আর বিনোদনমূলক উপাদান ছাড়াই বহু পৃথিবীবিখ্যাত চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে।

সিনেমা শিল্পে আশাবাদী হওয়ার জায়গা

‘পোড়ামন টু’ (২০১৮), ‘দহন’ (২০১৮), ‘ফাগুন হাওয়ায়’ (২০১৯)- চলচ্চিত্রগুলোর অভিনেতা সিয়াম আহমেদ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে খুবই আশাবাদী। তিনি মনে করেন, গ্লাসটা অর্ধেক পূর্ন। সম্পূর্ন করতে সবাইকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। তাঁর মতে ১৬ কোটি মানুষের একটা অন্যতম মৌলিক চাহিদা হলো বিনোদন। আর সেখানে চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার আছে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে বিনোদন দেওয়ার সেই সুযোগে ফাঁকা জায়গাটি নিতে হবে, কাজে লাগাতে হবে।

বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিল্পের বাস্তবতা: বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যত সম্ভাবনা
বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিল্পের বাস্তবতা: বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যত সম্ভাবনা; দহন সিনেমাতে সিয়াম আহমেদ ও পূজা। ছবি: জাজ মাল্টিমিডিয়া।

প্রযুক্তি সাধারণ মানুষের হাতে এসেছে। সেই সঙ্গে প্রযুক্তির একটা গণতন্ত্রায়ণ ঘটেছে। বিষয়টিকে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে দেখছেন জাতীয় চলচিচত্র পুরুস্কার পাওয়া ‘খাঁচা’ (২০১৭) ও ‘ঘাসফুল’ (২০১৫) ছবির পরিচালক আকরাম খান। তিনি বলছেন, ‘ফরাসী চলচ্চিত্র আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা জ্যঁ-লুক গদারের উক্তি, সিনেমা যখন কাগজ-কলমের মতো সস্তা হয়ে যাবে, তখন সৎ চলচ্চিত্র বানানোর সুযোগ ও সম্ভাবনা বেড়ে যাবে’। তাই প্রযুক্তির সহজলভ্যতাকে দারূন সম্ভাবনা হিসেবে দেখছেন আকরাম খান। তিনি আরও বলেন, ‘চলচ্চিত্র একাডেমিক জায়গায় চলে আসায় এটি প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছে’। আমাদের চলচ্চিত্র ইন্ডাসিট্র যে প্রতিষ্ঠিত নয়, এটিকেও ইতিবাচকভাবে দেখছেন তিনি। তাঁর মতে, ‘প্রাতিষ্ঠানিক জায়গায় যেহেতু যায়নি, তাই কোন একটা নির্দিষ্ট মতাদর্শিক বা ধারার বদলে বৈচিত্রময় ও নানা জীবনবোধের ছবি নির্মিত হচ্ছে এবং হবে’।

অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরুস্কার পাওয়া নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমনের একটি চরিত্র একবার বলেছিল, ’ যার স্বপ্ন দেখার সাহস নেই, তার বেঁচে থাকার অধিকার নেই।’ কথাটা মনে রেখেই তিনি আশাবাদী। সেই আশা নিয়েই তিনি প্রতিনিয়ত নিজের মাটির গল্প নিজের ভাষায় বলেন। সেই খোঁজেই ’ একটি সুতার জবানবন্দি ‘বানিয়েছেন, ‘অন্যদিন’-এর পেছনে ছুটছেন, ‘শিকলবাহা’র স্ক্রিপ্ট নতুন করে লিখছেন। তবে তিনি বলেন, ‘তরুণ আর মেধাবীদের আরও বেশি করে চলচ্চিত্রে আসতে হবে। যার কিছু হবেনা, সে বানাবে সিনেমা- এই ধারণা থেকে বের হয়ে সিনেমার সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে ভাবতে হবে। সিনেমা একটি জাতির স্মৃতি তৈরি করে। জাতির স্মৃতি রক্ষার দায়িত্ব যেন আমরা যার-তার হাতে তুলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে না রাখি।’

চলচ্চিত্র বিষয়ক শিক্ষক ও গবেষক জাকির হোসেন রাজু বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে আশাবাদী। তিনি বলেন, “চলচ্চিত্র হতে পারে ‘সফট টুলস’। এই সফট পাওয়ার হতে পারে বৈদেশিক কূটনীতির মাধ্যম। যেমন চীনের জনগন ভারতীয় ছবি দেখে। এর মাধ্যমে তারা ভারতকে জানে। আমরা যেমন চীন, কোরিয়া, ইরানের ছবি দেখে দেশগুলো সম্পর্কে জানি, সেই দেশের ইতিহাস আর দেশের মানুষ সম্পর্কে জানি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় এক কোটি প্রবাসী রয়েছেন। তাঁরাও দেশের সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্রের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ  ভূমিকা রাখতে পারেন। আমাদের তথ্য ও প্রযুক্তির সঙ্গে চলচিচত্রের সম্মিলন ঘটিয়ে বড় পরিসরে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে পথ হাঁটতে হবে। আমি মোটেও হতাশ নই। আমার ছাত্ররাই সেই সম্ভাবনার ধারক ও বাহক”। বাংলাদেশের তরুণ নির্মাতারা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব থেকে ফান্ড জোগাড় করছেন। সেসব ছবি আন্তর্জাতিকভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে। আর প্রশংসাও কুড়াচেছ। নিয়মিত যদি এই অনুশীলন চলে, তাহলে একটা পরিবর্তন আসবেই। চলচ্চিত্রকে জাতীয় পর্যায় থেকে বের করে বহুজাতিক ও আন্তর্জাতিক করে তুলতে হবে।

সাদিয়া খালিদ বলেন, ‘বাংলাদেশে চলচ্চিত্র অঙ্গনের একটা সম্ভাবনার জোয়ার চলছে। আমাদের দেশে এখন এমন অনেক উদীয়মান চলচ্চিত্র নির্মাতা আছেন, যারা নিজেদের কাজ দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে যাচ্ছেন’। মাহাদী হাসানের ছবি ‘স্যান্ড সিটি’ কানের লা ফেব্রিকে গিয়েছে। ভবিষ্যতে আমাদের ছবি ‘বি থ্রি’ তে (কান, ভেনিস ও বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব) অংশ নেবে। ‘কমলা রকেট’ ছবির পরিচালক নূর ইমরান জানিয়েছেন, তাঁর ছবিটি লগ্নি করা অর্থের দ্বিগুণ ব্যবসা করেছে। আমাদের তরুন নারী নির্মাতাদের মধ্যে তাসমিয়াহ আফরিন, সেজুতি টুসিদের কাজে শৈল্পিক রুচির ছাপ দেখা যায়। এই পথচল অব্যাহত থাকলে আমাদেরও নিয়মিত ভালো ছবি হবে।’

বেলায়েত হোসেন মামুন নির্মতা লেখক, সংগঠক ও ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ঘুরে দাঁড়াবে, কারণ বাংলাদেশের মানুষ চলচ্চিত্র ভালোবাসে। অন্য যে কোন দেশের মানুষের চেয়ে বেশি সময় ধরে চলচ্চিত্র দেখেন বাংলাদেশের মানুষ, আর এটিই প্রথম ও প্রধান কারণ। তার মতে, চলচ্চিত্রশিক্ষার সংকট আমাদের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল। আগামী দিনে এই সমস্যারও সমাধান হবে। অনেক তরুন দেশে ও বিদেশে চলচ্চিত্রবিদ্যায় প্রশিক্ষিত হচ্ছেন। তাঁদের কাজের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মানপ্রক্রিয়ার বদল ঘটবে। তাঁরাই সৃজনশীল কাজের পরিসর তৈরি করবেন। তা ছাড়া দেশে  চলচ্চিত্রের আধুনিক হল বা সিনেপ্লেক্স হচ্ছে। বিষয়টিকে অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন তিনি। তিনি আরও বলেন, নতুন পরিবেশে দেশের মানুষ আবার হলমুখী হবেন। এই পরিবর্তন হয়তো খুব দ্রুত হবেনা, তবে হবে।

চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখক বিধান রিবেরুর মতো সমাজে যখন কোন সংকট তৈরি হয়, তখন সমাধানও তার ভেতরেই নিহিত থাকে। তরুণেরা এই সংকট নিয়ে ভাবছেন, আর সেখান থেকেই উত্তরণের উপায় বের হয়ে আসছে। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিল্ম স্কুল হচ্ছে, সেখানে ফিল্ম ক্লাব, গোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে। তারা চলচ্চিত্রের চর্চা করছেন। দল বেঁধে স্বল্পদৈর্ঘ চলচ্চিত্র বানাচেছ। ক্যামেরা না থাকলে মোবাইলেই বানাচেছ । নিয়মিত বিদেশে ছবি যাচেছ। পুরুষ্কারও নিয়ে আসছেন। সময় লাগবে সিনমার সংকট কাটাতে। তবে, কেটে যাবে।”

সিনেমা শিল্পের উন্নয়নে কি কি পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে

“But film is not just a driver of economic growth, it is an opportunity to bring real prestige to a nation, film not only provides income-generating opportunities, but it also enables social development by providing a safe, creative space for new voices and ideas.”

বাংলাদেশের কিছু ছবি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হচ্ছে। কুড়িয়ে আনছে সম্মান। দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের নায়ক-নায়িকা, ছবির কলাকুশলীরা হচ্ছেন পুরস্কৃত, সংবর্ধিত। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের বর্তমান অবস্থার উত্তরণের লক্ষ্যে সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র নির্মানে সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগী হওয়া জরুরি।  প্রয়াত জহির রায়হান ও আলমগীর কবীরের মতো চলচ্চিত্রকার চলচ্চিত্র নির্মানে যে ধারা শুরু করেছিলেন তার পথ ধরে বর্তমান চলচ্চিত্র নির্মাতাদের এগিয়ে যেতে হবে। অশ্লীল ছায়াছবি নির্মান ও ভিডিও পাইরেসি বন্ধ করতে সবার একাত্ম হতে হবে। শিল্পমান সম্পন্ন সুস্থধারার ছায়াছবি তৈরি করতে শিল্প-সাহিত্য সংশ্লিষ্টদের হতে হবে অঙ্গীকারবন্ধ। দেশের শিশু কিশোরদের চরিত্র গঠনের লক্ষ্যে শিক্ষামূলক শিশুতোষ ছায়াছবি নির্মানে তৎপর হতে হবে। চলচ্চিত্র যে শিল্প-সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান বলিষ্ঠ মাধ্যম তা ছায়াছবি নির্মানের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হবে। এফডিসি ও ফিল্ম সেন্সর বোর্ডকে এ ব্যাপারে নিতে হবে বিশেষ দায়িত্বশীল ভূমিকা। সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র নির্মানে সরকারি সহযোগিতা ও পূষ্ঠপোষকতা বিশেষ জরুরি। এ ক্ষেত্রে  সরকারের পর্যাপ্ত অনুদান প্রদান এবং চলচ্চিত্র প্রদর্শনের সময় প্রেক্ষাগৃহের টিকিট থেকে বিনোদন কর মওকুফ করার ব্যবস্থা নিতে হবে।

সকল ধরনের বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে। সংস্কৃতি চর্চার পথ উন্মুক্ত করতে হবে। পথনাটক, মঞ্চনাটক, কবিতা আবৃত্তি, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, জারিগান, সারিগান, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, নৌকা বাইচ, ঘোড়দৌড় সহ অঞ্চলভেদে হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতির উপাদানগুলো পুনরুদ্ধার ও জাগরুক করার প্রশ্নে সকল সচেতন মানুষকে একত্রিত হয়ে ঐক্যবদ্ধ পচেষ্টার মাধ্যমে কাজ করে যেতে হবে। যদি আমাদের সংস্কৃতিক উপাদানগুলো সচল ও অনুশীলন করতে পারি তাহলে সমাজ থেকে নানা অনাচার, অবিচার, অন্ধকার, নৈরাজ্য, গুজব দূর হওয়ার পাশাপাশি আলোকিত সমাজ বির্নিমান সম্ভবপর হবে।

অশ্লীল অভিনেতা-অভিনেত্রিদের দাপটে একট সময়ে সিনেমা শিল্পে দীর্ঘদিন ধরে রাজত্ব করা শিল্পীদের চাহিদা কমে যাওয়ায় বর্তমান পরিস্থিতিতে চলচ্চিত্রে তেমন জনপ্রিয় শিল্পীদের আর দেখাা যায় না। কেননা একটা পরিস্থিতিতে অশ্লীল সিনেমার জয়জয়কার ছিল, তবে অশ্লীলতা সাময়িক, কিন্তু মানসম্পন্ন সিনেমার চাহিদা চিরকাল থাকে। চটক, চাকচিক্য আর জৌলুসকে প্রাধান্য দিয়ে ছবি তৈরি করা হলে তা হয়তো ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জন করবে, কিন্তু এমন ফর্মূলা-নির্ভর ছবির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সুপরিচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে না কারণ চলচ্চিত্র একটি শিল্পমাধ্যম যেখানে নির্মাতা নিজের সৃষ্টিশীলতা ব্যবহার করে শক্তিশালী চলচ্চিত্র-ভাষার মাধ্যমে বিভিন্ন অর্থ নির্মান করেন। ভালো চলচ্চিত্রের মূল্যায়ণে সারা বিশ্বে এই দৃষ্টিভঙ্গিকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। আমাদের দেশে চিন্তা সমৃদ্ধ চলচ্চিত্রের প্রসার নিশ্চিত করার প্রতি যদি নির্মাতা, দর্শক, গণমাধ্যম, সর্বোপরি রাষ্ট্রের আগ্রহ তৈরি না হয় তাহলে কখনও তা উঁচু শৈল্পিক মান অর্জন করবেনা। চলচ্চিত্রকে সে ক্ষেত্রে কেবল বিনোদন যোগানোর  মাধ্যম হিসেবেই বিবেচনা করা হবে। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দর্শককে সমাজ সচেতন করে তোলার দায়িত্বটি হবে অবহেলিত।যে মনস্বাত্তিক , সামাজিক এবং রাজনৈতিক সমস্যার জন্য আমাদের দেশে চিন্তা সমৃদ্ধ চলচ্চিত্রের প্রতি বহু মানুষের আগ্রহ তৈরি হচ্ছেনা সেই সমস্যাগুলি দূর করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি-ভালো চলচ্চিত্র এবং উঁচুমানের সাংস্কৃতিক পরিবেশ টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনেই।

বাংলাদেশে এমন বক্তব্যধর্মী, সমাজসচেতন, চিন্তাশীল চলচ্চিত্র কি যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নির্মিত হয়? এই ধরনের ছবি তৈরির প্রতি এদেশের পরিচালকদের এবং দেখার দর্শকদের আগ্রই বা কেমন? এখানে এমন ছবি কি সহজে নির্মান করা সম্ভব? বক্তব্যের গভীরতা এবং নির্মাণশৈলীর নান্দনিকতা, এই দুই দিক থেকে আমাদের দেশের বিকল্প এবং স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্র কতোটা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পেরেছে তা বোঝার জন্য এই প্রশ্নগুলো বিশ্লেষণ করতে হবে। কেউ প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে আধুনিক কিংবা গ্ল্যামার-সর্বস্ব বিনোদনধর্মী ছবিকেই ভালো ছবি বলে মনে করতে পারেন। কিন্তু দামি প্রযুক্তি ব্যবহার করলেই কোন ছবির মান বেড়ে যাবে এমন মনে করা যক্তিহীন। কারণ প্রযুক্তির চাকচিক্য এবং হালকা বিনোদন কখনও মানুষের চিন্তার গভীরতা বৃদ্ধি করে না। যে ছবি নিছক বিনোদনের মধ্যে মানুষকে মজিয়ে রাখার পরিবর্তে সমাজসচেতন বক্তব্য তুলে ধরে, যে ছবির নির্মাণশৈলী উদ্ভাবনী সেই ছবি মানুষের মনের মুক্তি ঘটাতে পারে তা যত স্বল্প বাজেটের হোক না কেন। কোন ছবিতে বেশিরভাগ সময় বিনোদন প্রাধান্য দিয়ে কখনও অল্পকটি সচেতন সংলাপ অন্তুভূক্ত করলে তা সেই ছবিকে সমাজসচেতন চলচ্চিত্র করে তুলবেনা। কোন জরুরি সমাজিক সমস্যা টিকে থাকার কারণ সম্পর্কে দর্শককে সজাগ করতে হলে নিশ্চিত করতে হবে যেন ছবিতে উপস্থাপিত বিষয় দর্শকমনে অস্থিরতা আর দুশ্চিন্তা তৈরি করতে পারে। পাশাপাশি মূলত যাদের জন্য সমাজে বিভিন্ন সমস্যা টিকে থাকছে অঙ্গুলি নির্দেশ করতে হবে সেই ক্ষমতাশীলদের প্রতি।

বিদেশী ভালো চলচ্চিত্র থেকে শিক্ষা নিতে হবে। যেমন- ‘কাফারনা হুম’ আরবি ভাষার ১২৬মিনিটের চলচ্চিত্র । লেবানিজ পরিচালক ও অভিনেত্রী নাদিনে লাবাকি চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য লিখেছেন এবং পরিচালনা করেছেন।চলচ্চিত্রে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন সিরিয়ার শরণার্থী শিশু অভিনেতা জায়ন আল রাফিয়া।সিনেমাটি শুরু হয় জেলখানায় বন্দি বার বছর বয়সী  বালক জাইনকে দেখানোর মধ্য দিয়ে। বার বছর বয়সটা অবস্য জেলখানার চিকিৎসকদের অনুমান।তার প্রকৃত জন্মতারিখ কেউ জানেনা।কারণ তার বাবা মা এতই দরিদ্র ছিলেন, অর্থের অভাবে তার জন্মের রেজিস্ট্রেশন করাতে পারেননি। আর তার ভাইবোনের সংখ্যাও এত বেশি যে, কার জন্ম কত সালে হয়েছে বাবা-মায়ের পক্ষে তা মনে রাখা সম্ভব হয়নি। জাইনকে যখন আদালতে হাজির করা হয়, তখন বিচারকের সঙ্গে তার কথোপথনের মাধ্যমে জানা যায়, কিছুদিন আগে এক ব্যক্তিকে ছুরিকাঘাতে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে তার পাঁচ বছরের কারাদন্ড হয়েছে।বিচারক যখন জাইনের কাছে জানতে চান, কী কারণে তাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে তা সে জানে কিনা। তখন বিন্দুমাত্র অনুতপ্তের বহিঃপ্রকাশ না ঘটিয়ে দৃঢ় কন্ঠে জাইন উত্তর দেয়, ‘এক কুত্তার বাচ্চাকে হত্যাচেষ্টার কারণে আমাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।’পাঁচ বছর কারাভোগের পর জাইন আবার আদালতে হাজির হয়েছে। তবে এবার তার আদালতে আসার কারণ ভিন্ন। এবার সে নিজেই পাল্টা মামলা দায়ের করতে চায় তার বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে।তার বাবা-মায়ের উপস্থিতিতেই আদালতে বৃদ্ধ বিচারক তাকে জিজ্ঞেস করেন, কেন সে তার বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে মামলা করতে চায়। জাইন উত্তর দেয়, ‘আমাকে জন্ম দেওয়ার জন্য, আমাকে জন্ম দেওয়ার অপরাধে’।

‘কাফারনা হুম’ বর্তমান ইসরাইলের প্রাচীন একটি শহরের নাম। বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী যে শহরটিকে যিশু খ্রিস্ট ‘অভিশপ্ত নরক’-এ পরিণত করেছিলেন। কালের বিবর্তনে শব্দটি ‘বিশৃংখলা’ শব্দের সমার্থকে রুপান্তরিত হয়েছে। ফ্ল্যাশব্যাকে যখন বৈরুতের একটি ঘিঞ্জি বস্তিতে জাইন এবং তার পরিবারের জীবনযাপনের চিত্র উঠে আসতে থাকে, তখনই দর্শকদের কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠে আসলেই তাদের জীবন, তাদের বাসস্থান অভিশপ্ত নরকের মতোই। জাইনের বয়স বার বছর হলেও তাকে দেখতে আরও ছোট মনে হয়। কিন্তু তার ঘাড়ে এস পড়া রাজ্যের দায়িত্ব তাকে পরিণত বয়সী এক টসবগে যুবকের মতোই দায়িত্বশীল করে তুলেছে। দারিদ্রের কষাঘাত তেকে বাঁচতে প্রতিদিন সকালে তাকে ভাইবোনদের নিয়ে কাজে বেরিয়ে পড়তে হয়। বাড়িওয়ালার দোকানে মালপত্র আনা নেয়া করা, রাস্তায় শরবত বিক্রি করা, এমনকি অবৈধভাবে ড্রাগ পাচার করাসহ এমন কোন কাজে নেই যা জাইনকে করতে হয়না।আর কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাকে আগলে রাখতে হয় তার ছোট ভাইবোনদের।বিশেষ করে তার আদরের ছোটবোন সাহারকে।যাকে বাড়িওয়ালার ছেলে আসাদ প্রায়ই জালাতনের চেস্টা করে।

একদিন সাহারকে তার বাবা-মা জোর করে বাড়িওয়ালার ছেলে আসাদের সাথে বিয়ে দেয়, তখন থেকেই জাইনের জীবন মুল্যহীন হয়ে পড়ে। বাড়িঘর ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে সে।এলোমেলাভাবে ঘোরার পর এক অ্যমিউজমেন্ট পার্কে গিয়ে সে অশ্রয় খুঁজে পায় এক ইথিওপিয়ান নারী রাহিলের কাছে। পরিচয়পত্রহীন অবৈধ অভিবাসাী রাহিল তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায় তার বিবাহবর্হিভূত শিশুপুত্র ইউনেসকে দেখাশুনার জন্য কারণ ইউনেসকে কর্মস্থলে নিয়ে যাওয়া তার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ন। রাহিলের বাসায় ইউনেসের বন্ধুত্বপূর্ন দিন অতিবাহিত হতে থাকে। কিন্তু কয়দিন পর রাহিত যখন নিখোঁজ হয়, তখন ইউনেসকে নিয়ে জাইন অথৈ সাগরে পড়ে যায়। ইউনেসকে নিয়ে জাইন বৈরুতের পথে পথে ঘুরতে থাকে রাহিলের খোঁজে।চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাসগুলোর চরিত্রের মতো বিশাল এক শহরের রস্তায় রাস্তায় নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে এগিয়ে যেতে থাকে জাইনের জীবন।চলচ্চিত্রের শেষের দিকে একটা পর্যায গিয়ে জাইন ঘরে ফিরে যেতে বাধ্য হয় তখন আমরা জানতে পারি জাইন চলচ্চিত্রের শুরুতে কাকে হত্যা চেষ্টা করেছিল  এবং কেনই বা সে তার বাবামায়ের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।দীর্ঘ পাঁচ বছর সময় নিয়ে নির্মিত এ চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্যের জন্য গবেষণা করার স্বার্থে নাদিনে লাবাকি এবং তার দলকে বার বার  ঘুরে বেড়াতে হয়েছে লেবাননের বস্তিগুলোয় এবং অবৈধ অভিভাসীদের ডিটেনশন সেন্টারগুলোতে। বাস্তব ও উপযোগী চরিত্র বাছাইয়ের নিমিত্তে। এই ছবিতে নারীদেহের সেই খেলা নেই, অথচ সফল ছবি।

বর্তমান বিশ্বমানচিত্রের আলোচিত ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু রোহিঙ্গা। মিয়ানমারে গণহত্যা আর ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। তাদের শরণার্থী শিবিরের অভ্যন্তরীন জীবন-সংগ্রাম ও তাদের জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার আকুতিকে ধারণ করে পরিচালক প্রসূন রহমান নির্মান করেছিলেন পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘জন্মভূমি’। এবার একই ইসু্যূ নিয়ে নির্মান করেছেন একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। ৮৪ মিনিট ব্যাপ্তির এই চলচ্চিত্রটির নাম ‘নিগ্রহকার’ বা ‘Long period of Persecution’. এ দুটো ছবির মধ্যে সামঞ্জস্য রয়েছে কিন্তু চরিত্র নির্বাচন ও কাহিনী নির্মানে কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এ ধরনের সিনেমা দেশে ও বিদেশে দর্শকদের দৃষ্টি কাড়বে। সিনেমা হতে হবে সময়োপযোগী।

গুপী বাঘা প্রোডাকশন্স লিমিটেডের একজন কর্ণধার ও নির্মাতা আরিফুর রহমান বুসান এশিয়ান ফিল্ম স্কুল থেকে প্রযোজনা ও পরিচালনা বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। প্রযোজনা করেছেন আন্তর্জাতিক পুরুস্কারপ্রাপ্ত একাধিক চলচ্চিত্র। তিনি প্রচলিত বাণিজ্যিক ছবি নিয়ে কোন আশা দেখেন না। ইন্টারনেটের এই যুগে মানুষের বিনোদনের মাধ্যম অনেক বেড়ে গেছে। তাই মানুষকে হলমুখী করতে হল সংস্কারের কোন বিকল্প নেই। কেবল নতুন প্রজেক্টর লাগালেই চলবে না, সিট ঠিক করতে হবে, ফুডিকোট থাকতে হবে, অনলাইন টিকেটং ব্যবস্থা থাকতে হবে।  স্বাধীন গল্পনির্ভর ছবি যেমন- মাটির প্রজার দেশে, লাইফ ফর্ম ঢাকা, জলালালের গল্প, আন্ডারকনস্ট্রাকশন, খাঁচা বা টেলিভিশন-এর মতো চলচ্চিত্র চালাতে হবে। নামমাত্র নয়, সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে।

উপসংহার

চলচ্চিত্রের দায়িত্ব কি দর্শককে শুধুই বিনোদন যোগানো? কাহিনীতে বিনোদনের প্রাধান্য না থাকলে কি চলচ্চিত্রের বক্তব্যের প্রতি দর্শককের কোন আগ্রহ তৈরি হবে না? প্রশ্ন দুটির উত্তর সচেতন মানুষের অজানা নয়। বিশ্বচলচ্চিত্রের ইতিহাসে যে পরিচালকরা খ্যাতমান তাঁরা চলচ্চিত্রকে মুনাফা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করে চটক আর চাকচিক্য-সর্বস্ব বিনোদনধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেননি বরং তারা এমন ছবির গতানুগতিক ফর্মূলা প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের ছবিতে প্রকাশ করেছেন সমাজসচেতন বক্তব্য এবং তাদের ছবির নির্মানশৈলী হয়ে উঠেছে প্রথাবিরোধী, নান্দনিকভাবে আকর্ষনীয় উদাহরণ হিসেব উল্লেখ করা যায় ভারতীয় চিন্তাশীল চলচ্চিত্রের কথা। ভারতে জনপ্রিয় বিনোদনধর্মী ছবি তৈরি হচ্ছে নিয়মিতভাবে কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলচ্চিত্রবোদ্ধা এবং সচেতন দর্শকদের কাছে ভারতে চলচ্চিত্র সুপরিচিত এবং তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছিল সত্যজিৎ রায়ের ছবির মাধ্যমে যিনি কখনও অর্থিক মুনাফা অর্জনের জন্য নিজের ছবিতে বিনোদনধর্মী উপাদান ব্যবহার করেননি। এই বিখ্যাত পরিচালকের কোন ছবিতেই কাজ করার সুযোগ পাননি বাংলা ছবির অত্যন্ত জনপ্রিয় সুচিত্রা সেন সত্তর-আশির দশকে হিন্দি ছবির সবচেয়ে বিখ্যাত নায়ক অমিতাভ বচ্চন কেবল সত্যজিৎ রায়ের ’ ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ (১৯৭৭) ছবির কিছু দৃশ্যে নেপথ্যে কন্ঠ দিতে পেরেছিেেলন। সুচিত্রা সেন-অমিতাভ বচচন বাংলা ছবির অন্য দুই গুরুত্বপূর্ণ পরিচালক, ঋতিক ঘটক আর মৃণাল সেনের কোন ছবিতেও অভিনয় করার সুযোপ পাননি। মৃণাল সেনের হিন্দি ভাষার ছবি ’ ভুবন সোম’ (১৯৬৭) এর মাধ্যমে ভারতে বাণিজ্যিক ছবি থেকে ভিন্ন সমাজসচেতন নতুন ধারার চলচ্চিত্র তৈরির আলোড়ন শুরু হয়েছিল। সেই ছবিতেও অমিতাভ বচচন কেবল একটি দৃশ্যে কন্ঠ দিয়েছিলেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালি পরিচালকরা তাদের বাংলা-হিন্দি কোন ছবিতেই অমিতাভ বচচনের মতো দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেতাকে কোন চরিত্রে অভিনয়ের জন্য নির্বাচন করেননি।

বোঝা যায় এই পরিচালকরা এবং বিশ্বের অন্য দেশের গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রকাররা তাদের ছবিতে জাঁকজমক বা জৌলুস প্রয়োজনীয় মনে করেননি বরং তাদের লক্ষ্য ছিল ব্যক্তিজীবন এবং সমাজের জটিল দিকগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে দর্শককে গভীরভাবে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করা। এই ধরনের চিন্তাসমৃদ্ধ চলচ্চিত্র মানুষের সামাজিক এবং রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করেছে। দর্শকরা ছবিতে দেখতে পেয়েছেন সৃষ্টিশীল ক্যামেরার কাজ এবং সম্পাদনার মাধ্যমে তৈরি নতুন ধরনের চলচ্চিত্রের ভাষা  যা চলচ্চিত্রের শৈল্পিক মান বাড়িয়েছে। এমন ছবি চলচ্চিত্রের ইতিহাসেও গুরুত্ব পুর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছে। কারণ আর্থিক লাভ নিশ্চিত করার জন্য বহু দর্শককে কেবল হালকা বিনোদন দিয়ে আকৃষ্ট করার গতানুগতিক ফর্মুলা এই চলচ্চিত্রকার ব্যবহার করেননি। এই ধরনের ছবিতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির জৌলুস নেই, গ্লামারের চটকও এখানে অপ্রয়োজনীয় । কিন্তু এখানে দেখায় যায় পরিচালকের ভাবনার গভীরতা , সামাজিক সমস্যার সাহসী সমালোচনা। শৈল্পিক দিক দিয়ে এমন ছবি হয়ে উঠে সুষমাময়। এই ধরনের চলচ্চিত্র তৈরি হয় মূলধারার ছবির পরিসরের বাইরে।

লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির ১০৮৯ সালে আলবেনিয়ায় ভ্রমণের পর ’বলকান থেকে বাল্টিক: বিরুদ্ধ স্রোতের যাত্রী’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। এই বইয়ে তিনি জানিয়েছেন তখন আলবেনিয়ায় লোকসংখ্যা ছিল ৩২লক্ষ। অথচ সেখানে কেবল পাবলিক লাইব্রেরির সংখ্যই ছিল সতের শ। এর বাইরে ছিল স্কুল-কলেজ-বশ্বিবিদ্যালয়ের লাইব্রেরি আর ন্যাশনাল লাইব্রেরি। রাজধানী টিরানায় শাহরিয়ার কবির ঘুরে বেড়ানোর সময় দেখেছিলেন এমন কোন পাড়া নেই যেখানে বইয়ের দোকান বা পাঠাগার নেই। আর দেড় কোটি মানুষের ঢাকা শহরে অজিজ সুপার মার্কেট আর নিউ মার্কেট আর অন্যান্য অল্প কিছু জায়গায় হাতেগোনা কয়েকটি বইয়ের দোকান আর লাইব্রেরি দেখা যায়। অথচ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে প্রতি বছরই তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন শপিং মল আর ফাস্ট ফুডের দোকান। যদি এখানে পোশাক, প্রসাধনী সামগ্রী আর ফাস্ট ফুডের দোকানের ভিড়ে চিন্তাশীল বইয়ের দোকান হারিয়ে যেতে থাকে আমরা কী করে আশা করব মানুষের ভাবনার গভীরতা পক্ষান্তরে উঁচুমানের সংস্কৃতি টিকে থাকবে এই সমাজে?

চিন্তাশীল চলচ্চিত্র তৈরি হওয়া সমাজের জন্যই জুরুরি কারণ এমন ছবির বাস্তবধর্মী বিষয়বস্থু আর সৃষ্টিশীল নির্মন শৈলি দর্শককে উপস্থাপিত বিষয় সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে।অন্যদিকে গতানুগতিক বাণিজ্যিক ছবির হালকা আর স্থুল বিনোদন দর্শকের চিন্তা স্বাভাবিকভাবে করে তোলে অগভীর। কেবলই হালকা বিনোদনের অভ্যস্ত দর্শকের পক্ষে সমাজের বিভিন্ন জটিল সমস্যা অনুধাবনের এবং তা নিয়ে সচেতনভাবে ভাবার সক্ষমতা বা আগ্রহ থাকবে তা আশা করা যায়না। বিনোদনের প্রতি আসক্ত  দর্শক নিজ দেশের ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজের নানা জরুরি দিকে নিয়ে চিন্তা করা আর প্রয়োজনীয় মনে করেন না কারণ সেইসব দিকের আলোচনা বিনোদন যোগায় না। আজ যদি আমরা দেখি বতর্মান প্রজন্ম আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস এবং বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত সামাজিক আন্দোলন, অন্যায় টিকিয়ে রাখা ব্যবস্থার প্রতি দেশের প্রগতিশীল ছাত্রদের প্রতিবাদ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার অনেক দিকই জানেনা এব তরুণদের মধ্যে দেখা যাচেছ অগভীর আর অন্ধ চিন্তা তাহলে বুঝতে হবে সমাজে চিন্তাশীল সংস্কৃতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই ধারণাই স্পস্ট হবে যে, বিদ্যমান সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিবেশে চিন্তার গভীরতা বাড়ায় এমন সাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্রের কদর নেই।

সদ্যপ্রয়াত বিখ্যাত পোলিশ চলচ্চিত্রকার আন্দজে ভাইদা বলেছিলেন, পোল্যান্ডে সমাজসচেতন , প্রথাবিরোধী কোন চলচ্চিত্র বিনোদনধর্মী ছবির মতোই বাণিজ্যিক সাফল্য পায়। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনের নতুন ছবির প্রতিও পশ্চিম বাংলায় বহু দর্শকের আগ্রহ ছিল। কিউবায় বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে একের পর এক উঁচুমানের বক্তব্যধর্মী ছবি নির্মানের মাধ্যমে সাধারণ দর্শককে চিন্তাশীল ছবির প্রতি অনুরক্ত করে তোলা হয়েছিল। ব্রাজিলে চলচ্চিত্রকার গ্রবার রোশার নেতৃত্বে তরুণ পরিচালকরা ষাটের দশকে গতানুগতিকতামুক্ত নির্মানপদ্ধতি ব্যবহার করে বহু ছবি নির্মানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্রাজিলিয় ছবির প্রতি বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। ০৮ডিসেম্বর ২০১৯ প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু আর্ন্তজাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে তথ্য মন্ত্রণালয় আয়োজিত ’ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরুস্কার ২০১৭ ও ২০১৮’ প্রদান অনুষ্ঠানে যথার্থই বলেন, “বাংলাদেশে মেধাবী লোকজন রয়েছে এবং মেধার বিবেচনায় তারা অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে। মানসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণে এই মেধাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। আমাদের চলচ্চিত্রের প্রতি অন্যান্য দেশকে আকর্ষণ করাতে আরও ভালো করতে হবে।”

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

মাছুম বিল্লাহ

শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক এবং প্রেসিডেন্ট: ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)। সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর- ভাব বাংলাদেশ এবং শিক্ষা বিশেষজ্ঞ -ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি। ইমেইল: [email protected]

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিল্পের বাস্তবতা: বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যত সম্ভাবনা

প্রকাশ: ০৮:১০:০০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২২ মার্চ ২০২১

ভূমিকা

চলচ্চিত্র শিল্প যে কোন  দেশের শিল্প-সংস্কৃতি বিকাশের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। সুস্থধারার শিল্পগুণসমৃদ্ধ ও  মানসম্মত চলচ্চিত্র যেমন দেশের অর্থনৈতিক বিকাশে ভূমিকা রাখে তেমনি দেশকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করে । শুধু তাই নয়, বর্তমান যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয় থেকে ফিরিয়ে আনতে সুষ্ঠুধারার চলচ্চিত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কেননা চলচ্চিত্র যেমন একটি সর্বজন গ্রহনযোগ্য শক্তিশালী বিনোদন মাধ্যম তেমনি ভালো চলচ্চিত্র মানুষের সুকামার বৃত্তিগুলোকে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে। শিক্ষামুলক চলচ্চিত্র চরিত্র গঠনেও  রাখতে পারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। তাই দেশে মানসম্মত ও রুচিসম্মত  চলচ্চিত্র নির্মিত  হলে ক্রমশ ভালো সিনেমা দেখার দর্শকও তৈরি হবে। চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালকসহ সিনেমা শিল্পের সাথে জড়িত সব কলাকুশলী আর্থিক লাভবান হবেন। ২০১৯ সালের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ৫৮টি দেশের ২১৮টি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়েছে। এর মধ্যে পূর্নদৈর্ঘ চলচ্চিত্র ১২২টি, স্বল্পদৈর্ঘ ও স্বাধীন চলচ্চিত্রের সংখ্যা ৯৬টি। ১৯৯২সালে প্রথম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল। উৎসবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তার শুভেচছা বক্তব্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সব মানবিক অনুভূতি উঠে আসে। একটি ভালো চলচ্চিত্র একজন মানুষ ও সমাজকে বদলে দিতে পারে। মানুষের জন্য কাজ করতেও অনুপ্রাণিত করে। সাহিত্যনির্ভর যেসব চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে  সারা বিশ্বে সেগুলোতে যোগ হয়েছে ভিন্নতর একটি মাত্রা। এটি ঠিক যে চলচ্চিত্র এমন একটি মাধ্যম যা সংগ্রহ ও সমন্বয় করে নেয় শিল্প সাহিত্যের প্রায় সব শাখাই। বাস্তব জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক সংকট ও টানাপোড়েন ভুলে দু-আড়াই ঘন্টার জন্য হাসি-কান্না আর নাটকীয়তায় পূর্ণ নাচে-গানে ভরপুর ছায়াছবি খেঁটেখাওয়া মানুষকে আমাদের পাশাপাশি এক ধরনের জীবনশক্তিও দান করে থাকে। স্বাভাবিক সুস্থ চিত্তবিনোদনের অভাবে একজন মানুষ মনোবৈকল্যের শিকার হতে পারে বলে আধুনিক মনোবিজ্ঞান সতর্ক করে দিয়েছে। Contemporary research has also revealed more profound aspects to film’s impact on society. In a 2005 paper by S C Noah Uhrig (University of Essex, UK) entitled, Cinema is Good for You: The Effects of Cinema Attendance on Self-Reported Anxiety or Depression and ‘Happiness’” the author describes how, “The narrative and representational aspects of film make it a wholly unique form of art. Moreover, the collective experience of film as art renders it a wholly distinct leisure activity.

বাংলাদেশের সিনেমা শিল্পের ইতিহাস ও বৈশিষ্টসমূহ

বাংলাদেশে প্রধানত তিন ধরনের চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। যেমন- (ক) বাণিজ্যিক ছবি (খ) আর্ট ও (গ) বিকল্প ক্যাটাগরির চলচ্চিত্র । বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের মোটামুটি পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং ২০০০ এর বেশি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে এই ইন্ডাসিট্র থেকে। (২)। ‘গেরিলা’ ছবিটির পরিচালক নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। তিনি নিজে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং সফল নাট্যব্যক্তিত্ব। তাঁর ‘গেরিলা’ ছবিটি ২০১১ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ মোট ছয়টি পুরুস্কার জিতে নেয়। এই ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের সবটুকু উঠে না এলেও যুদ্ধকালীন রণাঙ্গনের কিছু দৃশ্য এবং পাক-হানাদার বাহিনীর নির্মমতা যেভাবে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশে নির্মিত অন্য কোন চলচ্চিত্রে তা খুব কম দেখা গেছে। পাক-সেনাসদস্যের ভূমিকায় শতাব্দী ওয়াদুদ যেমন ভালো অভিনয় করেছেন তেমনি তিনি জিতে নিয়েছেন শ্রেষ্ঠ খলনায়কের পুরুস্কার। নায়িকার ভূমিকায় জয়া আহসান পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর সম্মান।

এক সময় নায়িকার বৃষ্টিভেজা গান ছাড়া ছবির কথা ভাবাই যেত না। এফডিসিতে সারাবছরই বর্ষাকাল লেগে থাকত। প্রাকৃতিক বৃষ্টির আশায় বসে থাকতেন না কোন নির্মাতা। নায়িকার বৃষ্টিভেজা শরীরের ছবি ছাপা হতো পত্রিকার পাতায়ও। ঢাকার সিনেমায় বৃষ্টি নিয়ে প্রথম ধামাকা ‘রঙ্গিলা’ ছবির ‘হৈ হৈ রঙ্গিলা রঙ্গিলারে রিম ঝিম রিম ঝিম বরষায় মন নিলারে’। বৃষ্টির গানের ট্রেন্ডসেটার’ রঙ্গিলা’। রাজ্জাক-কবরীর সেই গানে যে বঙ্গদেশের দর্শক মাতাল হলো, তা চলল তিন দশক। এরপর নির্মাতারা সুযোগ পেলেই এফডিসিতে বর্ষা নামিয়েছেন। পৌষ মাসের শীতেও এফডিসিতে বৃষ্টির গানের শুটিং হয়েছে অজস্র। কৃত্রিম বৃষ্টিতে ভিজে অনেক  নায়িকার সর্দি লেগে যেত। সেখানে দেখা যায় ঢালিউডের কোন নায়িকাই নির্মাতাদের বৃষ্টিপ্রীতি থেকে রেহাই পাননি। পাওয়ার কথাও নয়। বৃষ্টি ততদিনে ঢাকাই সিনেমার মোস্ট পাওয়ারফুল তারকা। নায়িকা ছবিতে যেই থাকুন, বৃষ্টিভেজা গান না থাকলে চলবে না। দর্শক হলে যাবে না। অতএব পাতলা শাড়ি আনো। আঁটশাটচ করে নায়িকাকে পরাও। তারপর হোসপাইপ ছেড়ে দিয়ে বসে থাক। নৃত্য পরিচালকদের তখন নাওয়া-খাওয়া মাথায়  বৃষ্টির গানের জন্য আলাদা কম্পেজিশন চাই, সব নির্মাতারা একগানে দর্শককে মাত করে দিতে হবে। বারবার যেন এই গানের টানে দর্শক সিনেমা হলে ফিরে আসে। ঢালিউডে বৃষ্টির গান আর তার সঙ্গে নারীদেহের নিবিড় ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে সত্তর দশকের সাড়াজাগানো ‘দি রেইন’ ছবিতে অলিভিয়ার দুর্দান্ত পারফরমেন্সের পর ‘দি রেইন’ দেখার পর নির্মাতারা জানালেন পর্দায় নায়ক-নায়িকার তোলপাড় রোমান্টিকতা না হলেও চলে। তবে বৃষ্টিভেজা গানে তাদের আকর্ষনটা ষোলো আনা পাওয়া চাই। ‘দি রেইন’ হিট হওয়ার পর অলিভিয়া আবির্ভূত হলেন ঢাকাই সিনেমার আবেদনের দেবীরূপে। নরম গরম ছবির এই বৃষ্টিভেজা রাতে চলে যেওনা। এমনভাবে দর্শক-হৃদয়ে কম্পন তুলা নতুন আবেদনমীয় আসন পলকেই পাল্টে চলে গেল অঞ্জুর কাছে। নিয়মিত বৃষ্টিভেজা হতে লাগলেন অঞ্জু।

ঢাকার সিনেমায় বৃষ্টি নিয়ে প্রথম ধামাকা ‘রঙ্গিলা’ ছবির ‘হৈ হৈ রঙ্গিলা রঙ্গিলারে রিম ঝিম রিম ঝিম বরষায় মন নিলারে’
ঢাকার সিনেমায় বৃষ্টি নিয়ে প্রথম ধামাকা ‘রঙ্গিলা’ ছবির ‘হৈ হৈ রঙ্গিলা রঙ্গিলারে রিম ঝিম রিম ঝিম বরষায় মন নিলারে’

ষাট-সত্তরের দশকে বাংলা সিনেমার কী এক সুবর্ণ সময় ছিল। ঢাকার গুলিস্তান হলে বাংলা আর ওপর তলার নাজে ইংরেজি সিনেমা দেখার মধুর স্মৃতি এখন অনেকেরই হৃদয়পটে আঁকা আছে। সেকালে চলচ্চিত্র শিল্পের কারিগরি মান তেমন উন্নত না হলেও সুস্থ ধারার অনেক ছায়াছবি নির্মিত হয়েছে। প্রয়াত জহির রায়হান এবং আলমগীর কবীর বেশ কিছু ক্লাসিক্যাল ছবি তৈরি করে দেশে বিদেশে সম্মান কুড়িয়েছেন, জয় করেছেন দর্শক হৃদয়। রাজ্জাক, হাসান ইমাম, আনোয়ার হোসেন, কবরী, সূচন্দা, ববিতার মতো শিল্পীরা অভিনয় প্রতিভার কম স্বাক্ষর রাখেননি। সত্যজিৎ রায়ও ববিতাকে দিয়ে ‘অশনি সংকেত’-এর মতো ছায়াছবি বানাতে সাহস করেছিলেন। এসব ছায়াছবি, অভিনেতা-অভিনেত্রীর কথা এ দেশের দর্শক আজো ভোলেনি। এরপর কেটে গেছে অনেক সময়। বর্তমান সময়ের ‘মাটির ময়না’, ‘জয়যাত্রার’ মতো ছবি এদেশে তৈরি হয়েছে। তানভীর মোকাম্মেল, মোরশেদুল ইসলামের মতো বেশ কজন শর্টফিল্ম নির্মাতা তাদের কর্মে দেশে বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছেন, সম্মান কুড়িয়েছেন। বিশেষ শৈল্পিক গুণের অধিকারী অকালপ্রয়াত চলচ্চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ তো বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এক নতুন ধারার স্বাক্ষর রেখে গেছেন।

‘জীবন থেকে নেয়া ’(১৯৭০), ‘হীরক রাজার দেশে’ (১৯৮০) বা সম্প্রতি তৈরি ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ (২০১২) প্রভৃতি ছবিতে যেভাবে রূপকধর্মী কাহিনীর মাধ্যমে রাজনৈতিক সমালোচনা তুলে ধরা হয়েছে, তেমন বুদ্ধিদীপ্ত চেষ্টাও বাংলাদেশের চিন্তাশীল ছবির জগতে চোখে পড়ে না ফলে আমাদের দেশে বাণিজ্যিক লাভ নিশ্চিত করবে এমন বিনোদননির্ভর ছবি তৈরির আগ্রহ আমরা বেশি দেখতে পাচিছ। আর প্রচারও যখন আকর্ষণীয় হয় তখন এমন ছবি দেখতে যায় বহু মানুষ। কিন্তু মূলত বিনোদন প্রদানের কারণে এই ধরনের চলচ্চিত্র দর্শকের সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারেনা বরং এমন চলচ্চিত্র সমাজে বিদ্যমান অন্যায়ের প্রতি প্রতিবাদ করতে সচেতন হওয়ার প্রয়েজানীয়তা থেকে দর্শকদের মনোযোগ সরিয়ে দেয় হালকা বিনোদনের দিকে।

বক্তব্য আর নির্মানশৈলির দিক দিয়ে চিন্তাশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্রের কথা বলতে হলে আলমগীর কবিরের ‘ধীরে বহে মেঘনা’ (১৯৭৩) আর রূপালী সৈকতে (১৯৭৮), মসিহউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলীর ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ (১৯৭৯), তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ (২০০২) এবং হাতেগোনা আর কয়েকটি চলচ্চিত্রের নামই কেবল উল্লেখ করা যায়।আশির দশকে এদেশে স্বল্পদৈর্ঘের বক্তব্যধর্মী ছবি তৈরির একটি চর্চা শুরু হয়েছিল। কিন্তু ফ্রান্স, ব্রাজিল, ভারত, আর্জেন্টিনা, ইরান, জার্মানি, জাপান, কিউবা প্রভৃতি দেশে যেভাবে বিনোদনধর্মী ছবির বাঁধাধরা পদ্ধতি সম্পূর্ন প্রত্যখ্যান করে প্রথাবিরোধী নতুন ধারার পূর্ন্যদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নির্মান শুরু হয়েছিল সেভাবে নতুন চলচ্চিত্রের আন্দোলন বাংলাদেশে আমরা দেখতে পাইনি।

একসময় ঢাকার সিনেমা হলগুলোতে দর্শকরা দেখেছেন পশ্চিমে তৈরি হওয়া বিভিন্ন ক্ল্যাসিক ছবি। ক্লার্ক গেবল, অ্যালেক গিনেস, গ্রগরি পেক, পিটার ও টুল, ওমর শরিফ, অড্রে হেপবার্ন, ডরিস ডে, এলিজাবেথ টেলর প্রমুখ বিখ্যাত চলচ্চিতশিল্পী অভিনীত অনেক উচঁমানের ছবি প্রদর্শিত হয়েছে ঢাকার বিভিন্ন সিনেমা হলে। বিভিন্ন দেশে তৈরি শৈল্পিক কিংবা রাজনৈতিক ছবি সিনেমা হলে দেখানো না হলেও বিভিন্ন চলচ্চিত্র সোসাইটি নিয়মিতভাবে বিশ্বখ্যাত পরিচালক, যেমন জঁ-ল্যুক গদার, লুই বুনুয়েল, আকিরা কুরোশাওয়া, ইংমার বার্গম্যান, সত্যজিৎ রায় প্রমুখের চলচ্চিত্র বা কোন নির্দিষ্ট দেশের প্রথাবিরোধী ছবির প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হতো। এমন প্রদর্শন নব্বই দশকেও নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হত ঢাকায়।

আশির দশক। বাংলা ছবির ব্যবসার স্বর্ণযুগ। ছবির মান গাছে উঠে গেছে। ফোক-ফ্যান্টাসি-সামাজিক-অসামাজিক নানা ধরনের ছবি হচ্ছে। পাল্লা দিয়ে ব্যবসা করছে সব ছবি। নায়িকার শরীর দেখাতে নির্মাতারা আধা-পাগল। সরসারি শরীর দেখানেয় ঝক্কি আছে। সমালোনার তোপে পড়তে হয়। তাই, বৃষ্টির গানের অজুহাতে নায়িকার শরীরের সমস্ত বাঁক দেখানো চলত। রোজিনা, দিতি, চম্পা জিনাত বৃষ্টির গানে সবাই তাদের সেরা পারফরমেন্সটাই দেখিয়েছেন। কে কার চেয়ে এগিয়ে যাবেন এই প্রতিযোগতিায়! সিনেমা নির্মাতাদের নিজেদেরকে প্রশ্ন করতে হবে, ‘সেই দিন কি এখনও আছে?’ দর্শক কি বৃষ্টিতে ভেজা নারীদেহ দেখার জন্য সিনেমা হলে যাবে? যাবেনা কারণ হাতের মোবাইল টিপ দিলেই সে এর চেয়েও আকাঙ্ক্ষিত নারীর নগ্নদেহ দেখতে পারে। কাজেই দর্শক কি ধরনের ছবি দেখতে চায় সে নিয়ে কোন গবেষনা কিংবা স্টাডি করা হয়নি যার ওপর ভিত্তি করে ছবি নির্মান করা হবে।

বাংলাদেশে সিনেমার বর্তমান দুর্দশার কারণসমূহ

অধিকাংশ দর্শক চলচ্চিত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ঢাকা শহরের নামি-দামি সিনেমা হলে এখন আর দর্শক সমাগম নেই। বন্ধ হয়ে গেছে অনেক হল। In 1980s and 1990s the quality of films increased but it fell down in an alarming manner. Sex and violence are essentaial elements of mainstream films and which are failed copies of Bollywood. 1990s on an avergage 80 feature films were released in Bangladesh every year. More than a million people viewed picture in 1500 cinema halls.

আজকাল ভালো ছবি নির্মিত হচ্ছে কম। বরং আজেবাজে কাহিনী নিয়ে তৈরি বাস্তবতা বর্জিত ছবির ভিড়ে ভালো ছবি ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে। শুধু ব্যবসা সফলতার দিক চিন্তা করে নিয়মিত তৈরি হচ্ছে অশ্লীল ছবি। এসব ছবির পোস্টারে ছাপা হয় নায়িকার অশ্লীল দেহভঙ্গী। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসব সিনেমা দেখা যায় না। সস্তা বিনোদন প্রত্যাশী এক শ্রেণির দর্শক এসব সিনেমা দেখেন। তরুণ সমাজকে রুচিহীনতার দিকে ঠেলে দিতে এ ধরনের ছায়াছবি অনেকটা ভূমিকা রাখে। সিনেমা শিল্প যে শুধু বিনোদন মাধ্যম নয় তা যেন বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকারগন ভুলতে বসেছেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র যেন একজন বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হয়েছে।

বর্তমানে অভিনয় শিল্পীরা একে অন্যের সঙ্গে রেষারেষি, ক্ষমতা প্রদর্শনে ব্যস্ত। রাঘব বোয়ালরা তাদের কথার ফুলঝুড়ি আর একে অন্যকে ক্ষমতা প্রদর্শন করছেন। চলচ্চিত্রের এ অস্থিরতায় ইউটিউবে সিনেমা দেখে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলে নিজেদের বোদ্ধা ভাবছেন অনেকে। শিল্পীর সঙ্গে শিল্পীর, নির্মাতার সঙ্গে নির্মাতার, প্রযোজকের সঙ্গ প্রযোজকের নেই কোন আত্মিক সম্পর্ক। দিন দিন বেড়েই চলছে তাদের রেষারেষি। বেড়েই চলছে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ, মামলা-পাল্টা মামলা। শুধু মামলায় থেমে থাকেনি, হামলার ঘটনাও ঘটেছে। ক্ষমতা প্রদর্শন করা নোংরা রাজনীতি বাড়লেও দিনে দিনে কমে যাচ্ছে সিনেমা নির্মানের সংখ্যা। ফলে হলে সিনেমা মুক্তির সংখ্যাও কমে গিয়েছে। অতীতে তাকালে দেখা যায়- এক সপ্তাহে কয়েকটি সিনেমা মুক্তির জন্য প্রস্তত থাকত। সেখান থেকে প্রযোজক সমিতি নির্ধারণ করে দিতেন কোন দুটি সিনেমা মুক্তি পাবে। বর্তমানকালে দু একটা ছবি মাঝেমধ্যে সিনেমা হলের দৃশ্যপট বদলে দেয় বটে, ভালো ব্যবসাও করে কিন্তু ঘুণে ধরা আর ধসে পড়া ব্যবস্থার কারণে প্রযোজক, পরিচালক বা শিল্পিরা লাভবান হচ্ছেন না। কমে গেেছ চলচ্চিত্র, প্রেক্ষাগৃহ, সিনেমা হলের সংখ্যা ১৫০০ থেকে ১৭০ এ নেমে এসেছে। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান, অভিনয়শিল্পী, কলাকুশলীর সংখ্যা। তাই ভালো চলচ্চিত্র হওয়া এখানে কঠিন বলে মনে করেন অনেকে।

বিনোদন প্রাধ্যান্য দিয়ে আমাদের দেশে মূলধারা এবং মূলধারার বাইরেও অনেক ছবি তৈরি হয়েছে। সেইসব ছবির নির্মানপদ্ধতিতে প্রাধান্য পেয়েছে দর্শককে সহজে আকৃষ্ট করা যায় এমন বিনোদনধর্মী ফর্মূলা। এই ধরনের ছবি হয়তো বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়েছে কিন্তু বিনোদন প্রদানের গতানুগতিক প্রথার উপর নির্ভরতার কারণে এই ধরনের ছবি দর্শকদের জন্য নতুন কিছু দেখার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেনি। দর্শককে সমসাময়িক বাস্তবতা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে প্ররোচিত করাও সম্ভব হয়নি। পরিবারের সকল সদস্য একত্রে বসে বাংলা সিনেমা দেখার আয়োজন বহু আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। দর্শক যখন সিনেমা সংকটের কারণে পারিবারিক বিনোদনের জন্য বাংলা নাটকের উপর নির্ভর করা শুরু করেছে, সেটি কিন্তু বেশ কিছুদিন ইতিবাচক ধারায় প্রবাহমান ছিল। বাংলা নাটকের নির্মানশৈলী, গল্প, অভিনেতা-অভিনেত্রীর চমৎকার অভিনয় এবং সার্বিক ব্যবস্থাপনা দর্শকদের বিনোদনের মাধ্যমে হিসেবে আস্থা অর্জন করেছে। সেটিও আবার অনেকটা হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রথাবিরোধী ছবি তৈরির ঝুঁকিও পরিচালক-প্রযোজকরা কম নিচ্ছেন। আবার কখনও কখনও আর্থিক সাফল্য থাকবে না এমন ঝুঁকি নিয়ে যদি ছবি তৈরিও করা হয় চিন্তা থাকে যে, সমসাময়িক কোন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমালোচনার কারণে সেই ছবি সেন্সরের ছাড়পত্র পাবে কিনা, বিতরণ এবং প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট সহযোগিতা থাকবে কিনা ইত্যাদি।

সমাজের বেশিরভাগ মানুষ যদি কেবল বিনোদনধর্মী বিষয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং নানা জটিল সমস্যা নিয়ে ধারালো এবং সুচিচিন্তত প্রশ্ন করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তাহলে কোন গোষ্ঠী প্রকৃতপক্ষে লাভবান হবে? বিকল্প ধারার যে কমসংখ্যক চলচ্চিত্র আমাদের এখানে তৈরি হচ্ছে সেখানেও দেখা যায় ছবির নির্মানশৈলী প্রথাবিরোধী এবং উদ্ভাবনী করে তোলার ক্ষেত্রে যথেষ্ট মনোযোগ নেই। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু নিয়ে নির্মিত কোন চলচ্চিত্রে গতানুগতিক নির্মানপদ্ধতি ব্যবহার করা হলে ছবির বক্তব্য দর্শক-মনে অভিধাত তৈরি করবে না। তাই বিকল্প ধারার পরিচালককে মনে রাখতে হবে বিষযবস্তু পাশাপাশি ছবির নির্মাণশৈলিতেও নান্দনিক নতুনত্ব থাকা জরুরি।

সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে হালকা দিক প্রাধান্য পেলে সমাজে গভীর বক্তব্যধর্মী চলচ্চিত্র, নাটক, সাহিত্য সৃষ্টি হবে না । আমাদের সমাজে চাকচিক্যনির্ভর চলচিচত্রকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা দেখে কখনও কখনও মনে হয় বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে চলচ্চিত্রকে বিনোদনের সমার্থক করে ফেলা হয়েছে। কোন কোন জাতীয় দৈনিকেও দেখা যায় চলচ্চিত্র সম্পর্কিত সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে ’বিনোদন’ শিরোনাম দিয়ে।মনে হচ্ছে চলচ্চিত্র শুধু বিনোদনের জন্যই, এই প্রবণতা দর্শকদের চলচ্চিত্র সম্পর্কে ভুল বার্তা দেয়। বিনোদনধর্মী চলচ্চিত্র একটি আলাদা ধারা কিন্তু সব চলচ্চিত্র অবশ্যই বিনোদনধর্মী নয় আর বিনোদনমূলক উপাদান ছাড়াই বহু পৃথিবীবিখ্যাত চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে।

সিনেমা শিল্পে আশাবাদী হওয়ার জায়গা

‘পোড়ামন টু’ (২০১৮), ‘দহন’ (২০১৮), ‘ফাগুন হাওয়ায়’ (২০১৯)- চলচ্চিত্রগুলোর অভিনেতা সিয়াম আহমেদ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে খুবই আশাবাদী। তিনি মনে করেন, গ্লাসটা অর্ধেক পূর্ন। সম্পূর্ন করতে সবাইকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। তাঁর মতে ১৬ কোটি মানুষের একটা অন্যতম মৌলিক চাহিদা হলো বিনোদন। আর সেখানে চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার আছে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে বিনোদন দেওয়ার সেই সুযোগে ফাঁকা জায়গাটি নিতে হবে, কাজে লাগাতে হবে।

বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিল্পের বাস্তবতা: বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যত সম্ভাবনা
বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিল্পের বাস্তবতা: বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যত সম্ভাবনা; দহন সিনেমাতে সিয়াম আহমেদ ও পূজা। ছবি: জাজ মাল্টিমিডিয়া।

প্রযুক্তি সাধারণ মানুষের হাতে এসেছে। সেই সঙ্গে প্রযুক্তির একটা গণতন্ত্রায়ণ ঘটেছে। বিষয়টিকে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে দেখছেন জাতীয় চলচিচত্র পুরুস্কার পাওয়া ‘খাঁচা’ (২০১৭) ও ‘ঘাসফুল’ (২০১৫) ছবির পরিচালক আকরাম খান। তিনি বলছেন, ‘ফরাসী চলচ্চিত্র আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা জ্যঁ-লুক গদারের উক্তি, সিনেমা যখন কাগজ-কলমের মতো সস্তা হয়ে যাবে, তখন সৎ চলচ্চিত্র বানানোর সুযোগ ও সম্ভাবনা বেড়ে যাবে’। তাই প্রযুক্তির সহজলভ্যতাকে দারূন সম্ভাবনা হিসেবে দেখছেন আকরাম খান। তিনি আরও বলেন, ‘চলচ্চিত্র একাডেমিক জায়গায় চলে আসায় এটি প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছে’। আমাদের চলচ্চিত্র ইন্ডাসিট্র যে প্রতিষ্ঠিত নয়, এটিকেও ইতিবাচকভাবে দেখছেন তিনি। তাঁর মতে, ‘প্রাতিষ্ঠানিক জায়গায় যেহেতু যায়নি, তাই কোন একটা নির্দিষ্ট মতাদর্শিক বা ধারার বদলে বৈচিত্রময় ও নানা জীবনবোধের ছবি নির্মিত হচ্ছে এবং হবে’।

অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরুস্কার পাওয়া নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমনের একটি চরিত্র একবার বলেছিল, ’ যার স্বপ্ন দেখার সাহস নেই, তার বেঁচে থাকার অধিকার নেই।’ কথাটা মনে রেখেই তিনি আশাবাদী। সেই আশা নিয়েই তিনি প্রতিনিয়ত নিজের মাটির গল্প নিজের ভাষায় বলেন। সেই খোঁজেই ’ একটি সুতার জবানবন্দি ‘বানিয়েছেন, ‘অন্যদিন’-এর পেছনে ছুটছেন, ‘শিকলবাহা’র স্ক্রিপ্ট নতুন করে লিখছেন। তবে তিনি বলেন, ‘তরুণ আর মেধাবীদের আরও বেশি করে চলচ্চিত্রে আসতে হবে। যার কিছু হবেনা, সে বানাবে সিনেমা- এই ধারণা থেকে বের হয়ে সিনেমার সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে ভাবতে হবে। সিনেমা একটি জাতির স্মৃতি তৈরি করে। জাতির স্মৃতি রক্ষার দায়িত্ব যেন আমরা যার-তার হাতে তুলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে না রাখি।’

চলচ্চিত্র বিষয়ক শিক্ষক ও গবেষক জাকির হোসেন রাজু বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে আশাবাদী। তিনি বলেন, “চলচ্চিত্র হতে পারে ‘সফট টুলস’। এই সফট পাওয়ার হতে পারে বৈদেশিক কূটনীতির মাধ্যম। যেমন চীনের জনগন ভারতীয় ছবি দেখে। এর মাধ্যমে তারা ভারতকে জানে। আমরা যেমন চীন, কোরিয়া, ইরানের ছবি দেখে দেশগুলো সম্পর্কে জানি, সেই দেশের ইতিহাস আর দেশের মানুষ সম্পর্কে জানি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় এক কোটি প্রবাসী রয়েছেন। তাঁরাও দেশের সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্রের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ  ভূমিকা রাখতে পারেন। আমাদের তথ্য ও প্রযুক্তির সঙ্গে চলচিচত্রের সম্মিলন ঘটিয়ে বড় পরিসরে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে পথ হাঁটতে হবে। আমি মোটেও হতাশ নই। আমার ছাত্ররাই সেই সম্ভাবনার ধারক ও বাহক”। বাংলাদেশের তরুণ নির্মাতারা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব থেকে ফান্ড জোগাড় করছেন। সেসব ছবি আন্তর্জাতিকভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে। আর প্রশংসাও কুড়াচেছ। নিয়মিত যদি এই অনুশীলন চলে, তাহলে একটা পরিবর্তন আসবেই। চলচ্চিত্রকে জাতীয় পর্যায় থেকে বের করে বহুজাতিক ও আন্তর্জাতিক করে তুলতে হবে।

সাদিয়া খালিদ বলেন, ‘বাংলাদেশে চলচ্চিত্র অঙ্গনের একটা সম্ভাবনার জোয়ার চলছে। আমাদের দেশে এখন এমন অনেক উদীয়মান চলচ্চিত্র নির্মাতা আছেন, যারা নিজেদের কাজ দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে যাচ্ছেন’। মাহাদী হাসানের ছবি ‘স্যান্ড সিটি’ কানের লা ফেব্রিকে গিয়েছে। ভবিষ্যতে আমাদের ছবি ‘বি থ্রি’ তে (কান, ভেনিস ও বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব) অংশ নেবে। ‘কমলা রকেট’ ছবির পরিচালক নূর ইমরান জানিয়েছেন, তাঁর ছবিটি লগ্নি করা অর্থের দ্বিগুণ ব্যবসা করেছে। আমাদের তরুন নারী নির্মাতাদের মধ্যে তাসমিয়াহ আফরিন, সেজুতি টুসিদের কাজে শৈল্পিক রুচির ছাপ দেখা যায়। এই পথচল অব্যাহত থাকলে আমাদেরও নিয়মিত ভালো ছবি হবে।’

বেলায়েত হোসেন মামুন নির্মতা লেখক, সংগঠক ও ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ঘুরে দাঁড়াবে, কারণ বাংলাদেশের মানুষ চলচ্চিত্র ভালোবাসে। অন্য যে কোন দেশের মানুষের চেয়ে বেশি সময় ধরে চলচ্চিত্র দেখেন বাংলাদেশের মানুষ, আর এটিই প্রথম ও প্রধান কারণ। তার মতে, চলচ্চিত্রশিক্ষার সংকট আমাদের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল। আগামী দিনে এই সমস্যারও সমাধান হবে। অনেক তরুন দেশে ও বিদেশে চলচ্চিত্রবিদ্যায় প্রশিক্ষিত হচ্ছেন। তাঁদের কাজের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মানপ্রক্রিয়ার বদল ঘটবে। তাঁরাই সৃজনশীল কাজের পরিসর তৈরি করবেন। তা ছাড়া দেশে  চলচ্চিত্রের আধুনিক হল বা সিনেপ্লেক্স হচ্ছে। বিষয়টিকে অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন তিনি। তিনি আরও বলেন, নতুন পরিবেশে দেশের মানুষ আবার হলমুখী হবেন। এই পরিবর্তন হয়তো খুব দ্রুত হবেনা, তবে হবে।

চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখক বিধান রিবেরুর মতো সমাজে যখন কোন সংকট তৈরি হয়, তখন সমাধানও তার ভেতরেই নিহিত থাকে। তরুণেরা এই সংকট নিয়ে ভাবছেন, আর সেখান থেকেই উত্তরণের উপায় বের হয়ে আসছে। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিল্ম স্কুল হচ্ছে, সেখানে ফিল্ম ক্লাব, গোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে। তারা চলচ্চিত্রের চর্চা করছেন। দল বেঁধে স্বল্পদৈর্ঘ চলচ্চিত্র বানাচেছ। ক্যামেরা না থাকলে মোবাইলেই বানাচেছ । নিয়মিত বিদেশে ছবি যাচেছ। পুরুষ্কারও নিয়ে আসছেন। সময় লাগবে সিনমার সংকট কাটাতে। তবে, কেটে যাবে।”

সিনেমা শিল্পের উন্নয়নে কি কি পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে

“But film is not just a driver of economic growth, it is an opportunity to bring real prestige to a nation, film not only provides income-generating opportunities, but it also enables social development by providing a safe, creative space for new voices and ideas.”

বাংলাদেশের কিছু ছবি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হচ্ছে। কুড়িয়ে আনছে সম্মান। দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের নায়ক-নায়িকা, ছবির কলাকুশলীরা হচ্ছেন পুরস্কৃত, সংবর্ধিত। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের বর্তমান অবস্থার উত্তরণের লক্ষ্যে সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র নির্মানে সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগী হওয়া জরুরি।  প্রয়াত জহির রায়হান ও আলমগীর কবীরের মতো চলচ্চিত্রকার চলচ্চিত্র নির্মানে যে ধারা শুরু করেছিলেন তার পথ ধরে বর্তমান চলচ্চিত্র নির্মাতাদের এগিয়ে যেতে হবে। অশ্লীল ছায়াছবি নির্মান ও ভিডিও পাইরেসি বন্ধ করতে সবার একাত্ম হতে হবে। শিল্পমান সম্পন্ন সুস্থধারার ছায়াছবি তৈরি করতে শিল্প-সাহিত্য সংশ্লিষ্টদের হতে হবে অঙ্গীকারবন্ধ। দেশের শিশু কিশোরদের চরিত্র গঠনের লক্ষ্যে শিক্ষামূলক শিশুতোষ ছায়াছবি নির্মানে তৎপর হতে হবে। চলচ্চিত্র যে শিল্প-সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান বলিষ্ঠ মাধ্যম তা ছায়াছবি নির্মানের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হবে। এফডিসি ও ফিল্ম সেন্সর বোর্ডকে এ ব্যাপারে নিতে হবে বিশেষ দায়িত্বশীল ভূমিকা। সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র নির্মানে সরকারি সহযোগিতা ও পূষ্ঠপোষকতা বিশেষ জরুরি। এ ক্ষেত্রে  সরকারের পর্যাপ্ত অনুদান প্রদান এবং চলচ্চিত্র প্রদর্শনের সময় প্রেক্ষাগৃহের টিকিট থেকে বিনোদন কর মওকুফ করার ব্যবস্থা নিতে হবে।

সকল ধরনের বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে। সংস্কৃতি চর্চার পথ উন্মুক্ত করতে হবে। পথনাটক, মঞ্চনাটক, কবিতা আবৃত্তি, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, জারিগান, সারিগান, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, নৌকা বাইচ, ঘোড়দৌড় সহ অঞ্চলভেদে হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতির উপাদানগুলো পুনরুদ্ধার ও জাগরুক করার প্রশ্নে সকল সচেতন মানুষকে একত্রিত হয়ে ঐক্যবদ্ধ পচেষ্টার মাধ্যমে কাজ করে যেতে হবে। যদি আমাদের সংস্কৃতিক উপাদানগুলো সচল ও অনুশীলন করতে পারি তাহলে সমাজ থেকে নানা অনাচার, অবিচার, অন্ধকার, নৈরাজ্য, গুজব দূর হওয়ার পাশাপাশি আলোকিত সমাজ বির্নিমান সম্ভবপর হবে।

অশ্লীল অভিনেতা-অভিনেত্রিদের দাপটে একট সময়ে সিনেমা শিল্পে দীর্ঘদিন ধরে রাজত্ব করা শিল্পীদের চাহিদা কমে যাওয়ায় বর্তমান পরিস্থিতিতে চলচ্চিত্রে তেমন জনপ্রিয় শিল্পীদের আর দেখাা যায় না। কেননা একটা পরিস্থিতিতে অশ্লীল সিনেমার জয়জয়কার ছিল, তবে অশ্লীলতা সাময়িক, কিন্তু মানসম্পন্ন সিনেমার চাহিদা চিরকাল থাকে। চটক, চাকচিক্য আর জৌলুসকে প্রাধান্য দিয়ে ছবি তৈরি করা হলে তা হয়তো ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জন করবে, কিন্তু এমন ফর্মূলা-নির্ভর ছবির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সুপরিচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে না কারণ চলচ্চিত্র একটি শিল্পমাধ্যম যেখানে নির্মাতা নিজের সৃষ্টিশীলতা ব্যবহার করে শক্তিশালী চলচ্চিত্র-ভাষার মাধ্যমে বিভিন্ন অর্থ নির্মান করেন। ভালো চলচ্চিত্রের মূল্যায়ণে সারা বিশ্বে এই দৃষ্টিভঙ্গিকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। আমাদের দেশে চিন্তা সমৃদ্ধ চলচ্চিত্রের প্রসার নিশ্চিত করার প্রতি যদি নির্মাতা, দর্শক, গণমাধ্যম, সর্বোপরি রাষ্ট্রের আগ্রহ তৈরি না হয় তাহলে কখনও তা উঁচু শৈল্পিক মান অর্জন করবেনা। চলচ্চিত্রকে সে ক্ষেত্রে কেবল বিনোদন যোগানোর  মাধ্যম হিসেবেই বিবেচনা করা হবে। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দর্শককে সমাজ সচেতন করে তোলার দায়িত্বটি হবে অবহেলিত।যে মনস্বাত্তিক , সামাজিক এবং রাজনৈতিক সমস্যার জন্য আমাদের দেশে চিন্তা সমৃদ্ধ চলচ্চিত্রের প্রতি বহু মানুষের আগ্রহ তৈরি হচ্ছেনা সেই সমস্যাগুলি দূর করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি-ভালো চলচ্চিত্র এবং উঁচুমানের সাংস্কৃতিক পরিবেশ টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনেই।

বাংলাদেশে এমন বক্তব্যধর্মী, সমাজসচেতন, চিন্তাশীল চলচ্চিত্র কি যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নির্মিত হয়? এই ধরনের ছবি তৈরির প্রতি এদেশের পরিচালকদের এবং দেখার দর্শকদের আগ্রই বা কেমন? এখানে এমন ছবি কি সহজে নির্মান করা সম্ভব? বক্তব্যের গভীরতা এবং নির্মাণশৈলীর নান্দনিকতা, এই দুই দিক থেকে আমাদের দেশের বিকল্প এবং স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্র কতোটা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পেরেছে তা বোঝার জন্য এই প্রশ্নগুলো বিশ্লেষণ করতে হবে। কেউ প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে আধুনিক কিংবা গ্ল্যামার-সর্বস্ব বিনোদনধর্মী ছবিকেই ভালো ছবি বলে মনে করতে পারেন। কিন্তু দামি প্রযুক্তি ব্যবহার করলেই কোন ছবির মান বেড়ে যাবে এমন মনে করা যক্তিহীন। কারণ প্রযুক্তির চাকচিক্য এবং হালকা বিনোদন কখনও মানুষের চিন্তার গভীরতা বৃদ্ধি করে না। যে ছবি নিছক বিনোদনের মধ্যে মানুষকে মজিয়ে রাখার পরিবর্তে সমাজসচেতন বক্তব্য তুলে ধরে, যে ছবির নির্মাণশৈলী উদ্ভাবনী সেই ছবি মানুষের মনের মুক্তি ঘটাতে পারে তা যত স্বল্প বাজেটের হোক না কেন। কোন ছবিতে বেশিরভাগ সময় বিনোদন প্রাধান্য দিয়ে কখনও অল্পকটি সচেতন সংলাপ অন্তুভূক্ত করলে তা সেই ছবিকে সমাজসচেতন চলচ্চিত্র করে তুলবেনা। কোন জরুরি সমাজিক সমস্যা টিকে থাকার কারণ সম্পর্কে দর্শককে সজাগ করতে হলে নিশ্চিত করতে হবে যেন ছবিতে উপস্থাপিত বিষয় দর্শকমনে অস্থিরতা আর দুশ্চিন্তা তৈরি করতে পারে। পাশাপাশি মূলত যাদের জন্য সমাজে বিভিন্ন সমস্যা টিকে থাকছে অঙ্গুলি নির্দেশ করতে হবে সেই ক্ষমতাশীলদের প্রতি।

বিদেশী ভালো চলচ্চিত্র থেকে শিক্ষা নিতে হবে। যেমন- ‘কাফারনা হুম’ আরবি ভাষার ১২৬মিনিটের চলচ্চিত্র । লেবানিজ পরিচালক ও অভিনেত্রী নাদিনে লাবাকি চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য লিখেছেন এবং পরিচালনা করেছেন।চলচ্চিত্রে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন সিরিয়ার শরণার্থী শিশু অভিনেতা জায়ন আল রাফিয়া।সিনেমাটি শুরু হয় জেলখানায় বন্দি বার বছর বয়সী  বালক জাইনকে দেখানোর মধ্য দিয়ে। বার বছর বয়সটা অবস্য জেলখানার চিকিৎসকদের অনুমান।তার প্রকৃত জন্মতারিখ কেউ জানেনা।কারণ তার বাবা মা এতই দরিদ্র ছিলেন, অর্থের অভাবে তার জন্মের রেজিস্ট্রেশন করাতে পারেননি। আর তার ভাইবোনের সংখ্যাও এত বেশি যে, কার জন্ম কত সালে হয়েছে বাবা-মায়ের পক্ষে তা মনে রাখা সম্ভব হয়নি। জাইনকে যখন আদালতে হাজির করা হয়, তখন বিচারকের সঙ্গে তার কথোপথনের মাধ্যমে জানা যায়, কিছুদিন আগে এক ব্যক্তিকে ছুরিকাঘাতে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে তার পাঁচ বছরের কারাদন্ড হয়েছে।বিচারক যখন জাইনের কাছে জানতে চান, কী কারণে তাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে তা সে জানে কিনা। তখন বিন্দুমাত্র অনুতপ্তের বহিঃপ্রকাশ না ঘটিয়ে দৃঢ় কন্ঠে জাইন উত্তর দেয়, ‘এক কুত্তার বাচ্চাকে হত্যাচেষ্টার কারণে আমাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।’পাঁচ বছর কারাভোগের পর জাইন আবার আদালতে হাজির হয়েছে। তবে এবার তার আদালতে আসার কারণ ভিন্ন। এবার সে নিজেই পাল্টা মামলা দায়ের করতে চায় তার বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে।তার বাবা-মায়ের উপস্থিতিতেই আদালতে বৃদ্ধ বিচারক তাকে জিজ্ঞেস করেন, কেন সে তার বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে মামলা করতে চায়। জাইন উত্তর দেয়, ‘আমাকে জন্ম দেওয়ার জন্য, আমাকে জন্ম দেওয়ার অপরাধে’।

‘কাফারনা হুম’ বর্তমান ইসরাইলের প্রাচীন একটি শহরের নাম। বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী যে শহরটিকে যিশু খ্রিস্ট ‘অভিশপ্ত নরক’-এ পরিণত করেছিলেন। কালের বিবর্তনে শব্দটি ‘বিশৃংখলা’ শব্দের সমার্থকে রুপান্তরিত হয়েছে। ফ্ল্যাশব্যাকে যখন বৈরুতের একটি ঘিঞ্জি বস্তিতে জাইন এবং তার পরিবারের জীবনযাপনের চিত্র উঠে আসতে থাকে, তখনই দর্শকদের কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠে আসলেই তাদের জীবন, তাদের বাসস্থান অভিশপ্ত নরকের মতোই। জাইনের বয়স বার বছর হলেও তাকে দেখতে আরও ছোট মনে হয়। কিন্তু তার ঘাড়ে এস পড়া রাজ্যের দায়িত্ব তাকে পরিণত বয়সী এক টসবগে যুবকের মতোই দায়িত্বশীল করে তুলেছে। দারিদ্রের কষাঘাত তেকে বাঁচতে প্রতিদিন সকালে তাকে ভাইবোনদের নিয়ে কাজে বেরিয়ে পড়তে হয়। বাড়িওয়ালার দোকানে মালপত্র আনা নেয়া করা, রাস্তায় শরবত বিক্রি করা, এমনকি অবৈধভাবে ড্রাগ পাচার করাসহ এমন কোন কাজে নেই যা জাইনকে করতে হয়না।আর কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাকে আগলে রাখতে হয় তার ছোট ভাইবোনদের।বিশেষ করে তার আদরের ছোটবোন সাহারকে।যাকে বাড়িওয়ালার ছেলে আসাদ প্রায়ই জালাতনের চেস্টা করে।

একদিন সাহারকে তার বাবা-মা জোর করে বাড়িওয়ালার ছেলে আসাদের সাথে বিয়ে দেয়, তখন থেকেই জাইনের জীবন মুল্যহীন হয়ে পড়ে। বাড়িঘর ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে সে।এলোমেলাভাবে ঘোরার পর এক অ্যমিউজমেন্ট পার্কে গিয়ে সে অশ্রয় খুঁজে পায় এক ইথিওপিয়ান নারী রাহিলের কাছে। পরিচয়পত্রহীন অবৈধ অভিবাসাী রাহিল তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায় তার বিবাহবর্হিভূত শিশুপুত্র ইউনেসকে দেখাশুনার জন্য কারণ ইউনেসকে কর্মস্থলে নিয়ে যাওয়া তার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ন। রাহিলের বাসায় ইউনেসের বন্ধুত্বপূর্ন দিন অতিবাহিত হতে থাকে। কিন্তু কয়দিন পর রাহিত যখন নিখোঁজ হয়, তখন ইউনেসকে নিয়ে জাইন অথৈ সাগরে পড়ে যায়। ইউনেসকে নিয়ে জাইন বৈরুতের পথে পথে ঘুরতে থাকে রাহিলের খোঁজে।চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাসগুলোর চরিত্রের মতো বিশাল এক শহরের রস্তায় রাস্তায় নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে এগিয়ে যেতে থাকে জাইনের জীবন।চলচ্চিত্রের শেষের দিকে একটা পর্যায গিয়ে জাইন ঘরে ফিরে যেতে বাধ্য হয় তখন আমরা জানতে পারি জাইন চলচ্চিত্রের শুরুতে কাকে হত্যা চেষ্টা করেছিল  এবং কেনই বা সে তার বাবামায়ের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।দীর্ঘ পাঁচ বছর সময় নিয়ে নির্মিত এ চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্যের জন্য গবেষণা করার স্বার্থে নাদিনে লাবাকি এবং তার দলকে বার বার  ঘুরে বেড়াতে হয়েছে লেবাননের বস্তিগুলোয় এবং অবৈধ অভিভাসীদের ডিটেনশন সেন্টারগুলোতে। বাস্তব ও উপযোগী চরিত্র বাছাইয়ের নিমিত্তে। এই ছবিতে নারীদেহের সেই খেলা নেই, অথচ সফল ছবি।

বর্তমান বিশ্বমানচিত্রের আলোচিত ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু রোহিঙ্গা। মিয়ানমারে গণহত্যা আর ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। তাদের শরণার্থী শিবিরের অভ্যন্তরীন জীবন-সংগ্রাম ও তাদের জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার আকুতিকে ধারণ করে পরিচালক প্রসূন রহমান নির্মান করেছিলেন পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘জন্মভূমি’। এবার একই ইসু্যূ নিয়ে নির্মান করেছেন একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। ৮৪ মিনিট ব্যাপ্তির এই চলচ্চিত্রটির নাম ‘নিগ্রহকার’ বা ‘Long period of Persecution’. এ দুটো ছবির মধ্যে সামঞ্জস্য রয়েছে কিন্তু চরিত্র নির্বাচন ও কাহিনী নির্মানে কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এ ধরনের সিনেমা দেশে ও বিদেশে দর্শকদের দৃষ্টি কাড়বে। সিনেমা হতে হবে সময়োপযোগী।

গুপী বাঘা প্রোডাকশন্স লিমিটেডের একজন কর্ণধার ও নির্মাতা আরিফুর রহমান বুসান এশিয়ান ফিল্ম স্কুল থেকে প্রযোজনা ও পরিচালনা বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। প্রযোজনা করেছেন আন্তর্জাতিক পুরুস্কারপ্রাপ্ত একাধিক চলচ্চিত্র। তিনি প্রচলিত বাণিজ্যিক ছবি নিয়ে কোন আশা দেখেন না। ইন্টারনেটের এই যুগে মানুষের বিনোদনের মাধ্যম অনেক বেড়ে গেছে। তাই মানুষকে হলমুখী করতে হল সংস্কারের কোন বিকল্প নেই। কেবল নতুন প্রজেক্টর লাগালেই চলবে না, সিট ঠিক করতে হবে, ফুডিকোট থাকতে হবে, অনলাইন টিকেটং ব্যবস্থা থাকতে হবে।  স্বাধীন গল্পনির্ভর ছবি যেমন- মাটির প্রজার দেশে, লাইফ ফর্ম ঢাকা, জলালালের গল্প, আন্ডারকনস্ট্রাকশন, খাঁচা বা টেলিভিশন-এর মতো চলচ্চিত্র চালাতে হবে। নামমাত্র নয়, সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে।

উপসংহার

চলচ্চিত্রের দায়িত্ব কি দর্শককে শুধুই বিনোদন যোগানো? কাহিনীতে বিনোদনের প্রাধান্য না থাকলে কি চলচ্চিত্রের বক্তব্যের প্রতি দর্শককের কোন আগ্রহ তৈরি হবে না? প্রশ্ন দুটির উত্তর সচেতন মানুষের অজানা নয়। বিশ্বচলচ্চিত্রের ইতিহাসে যে পরিচালকরা খ্যাতমান তাঁরা চলচ্চিত্রকে মুনাফা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করে চটক আর চাকচিক্য-সর্বস্ব বিনোদনধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেননি বরং তারা এমন ছবির গতানুগতিক ফর্মূলা প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের ছবিতে প্রকাশ করেছেন সমাজসচেতন বক্তব্য এবং তাদের ছবির নির্মানশৈলী হয়ে উঠেছে প্রথাবিরোধী, নান্দনিকভাবে আকর্ষনীয় উদাহরণ হিসেব উল্লেখ করা যায় ভারতীয় চিন্তাশীল চলচ্চিত্রের কথা। ভারতে জনপ্রিয় বিনোদনধর্মী ছবি তৈরি হচ্ছে নিয়মিতভাবে কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলচ্চিত্রবোদ্ধা এবং সচেতন দর্শকদের কাছে ভারতে চলচ্চিত্র সুপরিচিত এবং তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছিল সত্যজিৎ রায়ের ছবির মাধ্যমে যিনি কখনও অর্থিক মুনাফা অর্জনের জন্য নিজের ছবিতে বিনোদনধর্মী উপাদান ব্যবহার করেননি। এই বিখ্যাত পরিচালকের কোন ছবিতেই কাজ করার সুযোগ পাননি বাংলা ছবির অত্যন্ত জনপ্রিয় সুচিত্রা সেন সত্তর-আশির দশকে হিন্দি ছবির সবচেয়ে বিখ্যাত নায়ক অমিতাভ বচ্চন কেবল সত্যজিৎ রায়ের ’ ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ (১৯৭৭) ছবির কিছু দৃশ্যে নেপথ্যে কন্ঠ দিতে পেরেছিেেলন। সুচিত্রা সেন-অমিতাভ বচচন বাংলা ছবির অন্য দুই গুরুত্বপূর্ণ পরিচালক, ঋতিক ঘটক আর মৃণাল সেনের কোন ছবিতেও অভিনয় করার সুযোপ পাননি। মৃণাল সেনের হিন্দি ভাষার ছবি ’ ভুবন সোম’ (১৯৬৭) এর মাধ্যমে ভারতে বাণিজ্যিক ছবি থেকে ভিন্ন সমাজসচেতন নতুন ধারার চলচ্চিত্র তৈরির আলোড়ন শুরু হয়েছিল। সেই ছবিতেও অমিতাভ বচচন কেবল একটি দৃশ্যে কন্ঠ দিয়েছিলেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালি পরিচালকরা তাদের বাংলা-হিন্দি কোন ছবিতেই অমিতাভ বচচনের মতো দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেতাকে কোন চরিত্রে অভিনয়ের জন্য নির্বাচন করেননি।

বোঝা যায় এই পরিচালকরা এবং বিশ্বের অন্য দেশের গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রকাররা তাদের ছবিতে জাঁকজমক বা জৌলুস প্রয়োজনীয় মনে করেননি বরং তাদের লক্ষ্য ছিল ব্যক্তিজীবন এবং সমাজের জটিল দিকগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে দর্শককে গভীরভাবে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করা। এই ধরনের চিন্তাসমৃদ্ধ চলচ্চিত্র মানুষের সামাজিক এবং রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করেছে। দর্শকরা ছবিতে দেখতে পেয়েছেন সৃষ্টিশীল ক্যামেরার কাজ এবং সম্পাদনার মাধ্যমে তৈরি নতুন ধরনের চলচ্চিত্রের ভাষা  যা চলচ্চিত্রের শৈল্পিক মান বাড়িয়েছে। এমন ছবি চলচ্চিত্রের ইতিহাসেও গুরুত্ব পুর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছে। কারণ আর্থিক লাভ নিশ্চিত করার জন্য বহু দর্শককে কেবল হালকা বিনোদন দিয়ে আকৃষ্ট করার গতানুগতিক ফর্মুলা এই চলচ্চিত্রকার ব্যবহার করেননি। এই ধরনের ছবিতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির জৌলুস নেই, গ্লামারের চটকও এখানে অপ্রয়োজনীয় । কিন্তু এখানে দেখায় যায় পরিচালকের ভাবনার গভীরতা , সামাজিক সমস্যার সাহসী সমালোচনা। শৈল্পিক দিক দিয়ে এমন ছবি হয়ে উঠে সুষমাময়। এই ধরনের চলচ্চিত্র তৈরি হয় মূলধারার ছবির পরিসরের বাইরে।

লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির ১০৮৯ সালে আলবেনিয়ায় ভ্রমণের পর ’বলকান থেকে বাল্টিক: বিরুদ্ধ স্রোতের যাত্রী’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। এই বইয়ে তিনি জানিয়েছেন তখন আলবেনিয়ায় লোকসংখ্যা ছিল ৩২লক্ষ। অথচ সেখানে কেবল পাবলিক লাইব্রেরির সংখ্যই ছিল সতের শ। এর বাইরে ছিল স্কুল-কলেজ-বশ্বিবিদ্যালয়ের লাইব্রেরি আর ন্যাশনাল লাইব্রেরি। রাজধানী টিরানায় শাহরিয়ার কবির ঘুরে বেড়ানোর সময় দেখেছিলেন এমন কোন পাড়া নেই যেখানে বইয়ের দোকান বা পাঠাগার নেই। আর দেড় কোটি মানুষের ঢাকা শহরে অজিজ সুপার মার্কেট আর নিউ মার্কেট আর অন্যান্য অল্প কিছু জায়গায় হাতেগোনা কয়েকটি বইয়ের দোকান আর লাইব্রেরি দেখা যায়। অথচ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে প্রতি বছরই তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন শপিং মল আর ফাস্ট ফুডের দোকান। যদি এখানে পোশাক, প্রসাধনী সামগ্রী আর ফাস্ট ফুডের দোকানের ভিড়ে চিন্তাশীল বইয়ের দোকান হারিয়ে যেতে থাকে আমরা কী করে আশা করব মানুষের ভাবনার গভীরতা পক্ষান্তরে উঁচুমানের সংস্কৃতি টিকে থাকবে এই সমাজে?

চিন্তাশীল চলচ্চিত্র তৈরি হওয়া সমাজের জন্যই জুরুরি কারণ এমন ছবির বাস্তবধর্মী বিষয়বস্থু আর সৃষ্টিশীল নির্মন শৈলি দর্শককে উপস্থাপিত বিষয় সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে।অন্যদিকে গতানুগতিক বাণিজ্যিক ছবির হালকা আর স্থুল বিনোদন দর্শকের চিন্তা স্বাভাবিকভাবে করে তোলে অগভীর। কেবলই হালকা বিনোদনের অভ্যস্ত দর্শকের পক্ষে সমাজের বিভিন্ন জটিল সমস্যা অনুধাবনের এবং তা নিয়ে সচেতনভাবে ভাবার সক্ষমতা বা আগ্রহ থাকবে তা আশা করা যায়না। বিনোদনের প্রতি আসক্ত  দর্শক নিজ দেশের ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজের নানা জরুরি দিকে নিয়ে চিন্তা করা আর প্রয়োজনীয় মনে করেন না কারণ সেইসব দিকের আলোচনা বিনোদন যোগায় না। আজ যদি আমরা দেখি বতর্মান প্রজন্ম আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস এবং বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত সামাজিক আন্দোলন, অন্যায় টিকিয়ে রাখা ব্যবস্থার প্রতি দেশের প্রগতিশীল ছাত্রদের প্রতিবাদ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার অনেক দিকই জানেনা এব তরুণদের মধ্যে দেখা যাচেছ অগভীর আর অন্ধ চিন্তা তাহলে বুঝতে হবে সমাজে চিন্তাশীল সংস্কৃতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই ধারণাই স্পস্ট হবে যে, বিদ্যমান সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিবেশে চিন্তার গভীরতা বাড়ায় এমন সাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্রের কদর নেই।

সদ্যপ্রয়াত বিখ্যাত পোলিশ চলচ্চিত্রকার আন্দজে ভাইদা বলেছিলেন, পোল্যান্ডে সমাজসচেতন , প্রথাবিরোধী কোন চলচ্চিত্র বিনোদনধর্মী ছবির মতোই বাণিজ্যিক সাফল্য পায়। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনের নতুন ছবির প্রতিও পশ্চিম বাংলায় বহু দর্শকের আগ্রহ ছিল। কিউবায় বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে একের পর এক উঁচুমানের বক্তব্যধর্মী ছবি নির্মানের মাধ্যমে সাধারণ দর্শককে চিন্তাশীল ছবির প্রতি অনুরক্ত করে তোলা হয়েছিল। ব্রাজিলে চলচ্চিত্রকার গ্রবার রোশার নেতৃত্বে তরুণ পরিচালকরা ষাটের দশকে গতানুগতিকতামুক্ত নির্মানপদ্ধতি ব্যবহার করে বহু ছবি নির্মানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্রাজিলিয় ছবির প্রতি বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। ০৮ডিসেম্বর ২০১৯ প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু আর্ন্তজাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে তথ্য মন্ত্রণালয় আয়োজিত ’ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরুস্কার ২০১৭ ও ২০১৮’ প্রদান অনুষ্ঠানে যথার্থই বলেন, “বাংলাদেশে মেধাবী লোকজন রয়েছে এবং মেধার বিবেচনায় তারা অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে। মানসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণে এই মেধাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। আমাদের চলচ্চিত্রের প্রতি অন্যান্য দেশকে আকর্ষণ করাতে আরও ভালো করতে হবে।”