০৬:০৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

ইসলামের প্রথম শক্তিপরীক্ষা বদরযুদ্ধ

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
  • প্রকাশ: ১০:৩৫:৫০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৯ এপ্রিল ২০২৩
  • / ৫৯৩ বার পড়া হয়েছে

১৭ রমজান ঐতিহাসিক বদর দিবস। হিজরি ২য় সালে বদরযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল মক্কার কুরাইশ বাহিনী ও মদিনার নবপ্রতিষ্ঠিত ইসলামি রাষ্ট্রের মধ্যে। এ যুদ্ধ ছিল ভাগ্যনির্ধারণী ও ইতিহাসের মোড় পরিবর্তনকারী। কুরাইশ বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল ৯৫০ এবং মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ৩১৩ জন। অসম যুদ্ধে প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসিম সাহসিকতা ও রণকৌশল এবং আল্লাহর সাহায্যে বিশাল কুরাইশ বাহিনীর ওপর বিজয় লাভ করেন। মক্কার বড়ো বড়ো নেতাসহ কুরাইশ বাহিনীর ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন বন্দি হয়। যাদের মধ্যে প্রধানতম ছিল আবু জাহেল।

মুসলমানদের পক্ষে শহিদ হন ৬ জন মুহাজির ও ৮ জন আনসার, মোট ১৪ জন। কোরআন মজিদের বিভিন্ন আয়াতে এ যুদ্ধের খুঁটিনাটি বিষয় তন্নতন্ন করে পর্যালোচনা করা হয়েছে। যেসব সুরা ও আয়াতে বদরযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, তা যদি একত্র করা হয়, তার কলেবর ত্রিশপারা কোরআনের প্রায় আধাপারা হবে। যা প্রমাণ করে এ যুদ্ধ সাধারণ কোনো ঘটনা ছিল না। মুসলমানদের জাতীয় বিশ্বাস ও চেতনায় বদরযুদ্ধের শিক্ষা ও চেতনা জাগরুক রাখার জন্য আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে যুদ্ধের প্রতিটি বিষয় নিখুঁতভাবে রেকর্ড রেখেছেন। এ যুদ্ধে ৩০০ হাজার ফেরেশতা কাফেরদের ওপর হামলায় অংশ নিয়েছেন বলে কোরআন মজিদে উল্লেখ আছে। কাজেই বদরযুদ্ধ ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং এর চেতনা ইসলাম ও মুসলমানদের অস্তিত্বের নিয়ামক।

মহানবি (সা.) ১৩ বছর ইসলাম প্রচার করেন জন্মভূমি মক্কায়। এ সময় এমন কোনো নির্যাতন ছিল না, কুরাইশ মুশরিকরা মুসলামদের ওপর যার পরীক্ষা চালায়নি। অবশেষে অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে মহানবি (সা.) ও তার অনুসারী মুসলমানরা দেশত্যাগ করে মদিনায় চলে আসেন। মদিনায় গিয়ে মহানবি স্থানীয় ইহুদিদের সঙ্গে একটি রাষ্ট্রীয় ঘোষণাপত্র স্বাক্ষর করে ইসলামি রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন। ইতিহাসে এ দেশত্যাগ হিজরত ও দেশত্যাগীরা মুহাজির এবং মদিনার মুসলমানরা আনসার নামে পরিচিত।

হিজরতের পর যে কোনো সময় মক্কার মুশরিকরা সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে মদিনার ছোট্ট ইসলামি রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দেয়ার আশংকা বিদ্যমান ছিল। মহানবি সংবাদ পান যে, মক্কার কুরাইশদের একটি কাফেলা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে মদিনার পাশ দিয়ে সিরিয়ায় যাবে। শত্রুর অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড মজবুত হতে দেয়া মানে নিজের অস্তিত্বকে দুর্বল করা। কাজেই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন কুরাইশ কাফেলাকে সিরিয়া যাওয়ার পথে বাধা দেবেন।

২০০ লোকসহ যুল-উশাইরা নামক স্থান পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে জানতে পারেন, কয়েক দিন আগেই কুরাইশ কাফেলা সেই স্থান অতিক্রম করে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে চলে গেছে। তিনি এবার সিদ্ধান্ত নিলেন ফেরার পথে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বাধীন কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলাকে আটক করবেন। ৩১৩ জন সঙ্গী নিয়ে তিনি ৮ রমজান বদর প্রান্তরের উদ্দেশ্যে রওনা হন এবং ১৭ রমজান এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আবু সুফিয়ান মুসলমানদের বাধার আশংকা আঁচ করে মক্কায় খবর পাঠিয়েছিল, বাণিজ্য কাফেলা মুসলমানদের আক্রমণের শিকার হবে। কাজেই সাহায্যের জন্য তোমরা এগিয়ে এসো। সবার পুঁজি ও অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত থাকায় বলতে গেলে মক্কার সবাই সশস্ত্র প্রস্তুতি নিয়ে রওনা দিলো।

বিচক্ষণ আবু সুফিয়ান প্রধান সড়ক পাশ কেটে সমুদ্র উপকূলের পথ ধরে কেটে পড়ে। পথে মক্কা থেকে আগত সশস্ত্র বাহিনীর সাক্ষাৎ হলে সে প্রস্তাব দেয়, যেহেতু বাণিজ্য কাফেলা নিরাপদে চলে এসেছে চলো মক্কায় ফিরে যাই। কিন্তু কুরাইশ নেতা আবু জেহেল বলল, বদর প্রান্তরে তিন দিন আনন্দফূর্তি না করে আমরা মক্কায় ফিরব না।

মহানবি (সা.) আসন্ন যুদ্ধের ব্যাপারে মুসলমানদের মতামত চাইলেন। মুহাজিরদের পক্ষে মিকদাদ ইবনে আমর নবিজির যে কোনো আদেশ শিরোধার্য করার ঘোষণা দিয়ে বললেন, আমরা বনি ইসলাইলের মতো বলব না যে, ‘তুমি আর তোমার খোদা গিয়ে যুদ্ধ করো; আমরা এখানে বসে থাকব।’

মদিনাবাসী আনসারদের মতামত জানতে চাইলে সাআদ ইবনে মুয়াজ (আ.) আবেগময় ভাষায় বললেন, যদি আপনি বিশাল সাগর পাড়ি দিতে বলেন, জান দেব, তবুও আপনার আদেশ পালনে পিছপা হব না। তার বক্তৃতা শুনে নবিজি খুব খুশি হলেন এবং যুদ্ধ প্রস্তুতিতে মনোযোগ দিলেন।

বদর প্রান্তরের পানির কুপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একটি গর্ত করে তাতে পানি ভর্তি করা হল, যাতে যুদ্ধাকালীন পানির সংকট না হয়। নবিজির জন্য একটি ছাউনী তৈরি করা হল। গোয়েন্দ তৎপরতায় মুসলমানদের হাতে দুজন কুরাইশ বালক পাকড়াও হয়। তারা জানায় যে, টিলার ওপারে কুরাইশ বাহিনী সমবেত হয়েছে। নবিজি তাদের সংখ্যা কত জানতে চাইলে বালকরা বলল, আমাদের জানা নেই। নবিজি প্রতি বেলা খাবারের জন্য কয়টি উট জবাই করে জানতে চাইলে বলল, এক বেলায় ৯টি আরেক বেলায় ১০টি। নবিজি বললেন, তাদের সংখ্যা ৯০০ থেকে ১০০০-এর মাঝামাঝি।

নবিজি (সা.) রণাঙ্গনে মুসলামানদের ব্যুহ রচনা ও সৈন্য মোতায়েনের কাজসম্পন্ন করার পর ছাইনীতে গিয়ে নামাজ পড়লেন। তারপর আল্লাহর সাহায্যের জন্য দুহাত তুলে ফরিয়াদ জানাতে লাগলেন। প্রভু হে! মুসলমানদের এই ক্ষুদ্রদল যদি আজ নিশ্চিহ্ণ হয়ে যায় পৃৃথিবীর বুকে তোমার ইবাদতের জন্য কেউ অবশিষ্ট থাকবে না। পেছনে দাঁড়িয়ে আবু বকর সিদ্দিক (রা.) আমিন আমিন বলছিলেন। নবিজি কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন, তোমরা সুসংবাদ নাও, আল্লাহর সাহায্য আসন্ন।

কুরাইশ পক্ষে মল্লযুদ্ধের জন্য রণাঙ্গনে আসল ওতবা ইবনে রাবিয়া, তার ভাই শায়বা ইবনে রাবিয়া ও ছেলে ওলীদ ইবনে ওতবা। নবিজি আপন চাচা হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব, আলী ইবনে আবু তালিব ও ওবায়দা ইবনে হারেসকে ওই তিনজনের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য পাঠালেন।

হামজা ও আলী (রা.) শায়বা ও ওয়ালীদকে হত্যা করলেন। তবে ওতবার আঘাতে বয়স্ক ওবায়দা মাটিতে পড়ে গেলেন। পরে হামজা ও আলী এসে ওতবাকে হত্যা করলেন এবং ওবায়দাকে শিবিরে নিয়ে আসলেন। এরপর শুরু হল ঘোরতর যুদ্ধ। প্রচণ্ড যুদ্ধ চলাকালে তিনটি প্রবল ঝড় বয়ে গেল। তা ছিল ফেরেশতাদের অবতরণ ও আক্রমণ। আনসারী আফরার অল্প বয়েসি দুই ছেলের টার্গেট ছিল মুশরিক নেতা আবু জেহেলকে হত্যা করবে। তারা অশ্বারোহী দীর্ঘদেহী আবু জেহেলের রানের উপর আঘাত করল। আবু জেহেল মুহূর্তে ধরাশায়ী হয়ে কাতরাতে থাকে।

যুদ্ধ শেষ হলে নবিজি নিহত কাফেরদের লাশ একটি গর্তে পুতে দেন। আর মুসলামান শহিদদের কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করেন।

বদরযুদ্ধের শাশ্বত পয়গাম, মুসলমানরা যদি একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, সংখ্যা ও অস্ত্রশক্তি বড়ো কথা নয়, দুনিয়ার যে-কোনো শক্তিধর তাগুতের ওপর তাদের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। ইসলামের দীর্ঘ ইতিহাসে এই সত্য বারবার প্রমাণিত হয়েছে।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

ইসলামের প্রথম শক্তিপরীক্ষা বদরযুদ্ধ

প্রকাশ: ১০:৩৫:৫০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৯ এপ্রিল ২০২৩

১৭ রমজান ঐতিহাসিক বদর দিবস। হিজরি ২য় সালে বদরযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল মক্কার কুরাইশ বাহিনী ও মদিনার নবপ্রতিষ্ঠিত ইসলামি রাষ্ট্রের মধ্যে। এ যুদ্ধ ছিল ভাগ্যনির্ধারণী ও ইতিহাসের মোড় পরিবর্তনকারী। কুরাইশ বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল ৯৫০ এবং মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ৩১৩ জন। অসম যুদ্ধে প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসিম সাহসিকতা ও রণকৌশল এবং আল্লাহর সাহায্যে বিশাল কুরাইশ বাহিনীর ওপর বিজয় লাভ করেন। মক্কার বড়ো বড়ো নেতাসহ কুরাইশ বাহিনীর ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন বন্দি হয়। যাদের মধ্যে প্রধানতম ছিল আবু জাহেল।

মুসলমানদের পক্ষে শহিদ হন ৬ জন মুহাজির ও ৮ জন আনসার, মোট ১৪ জন। কোরআন মজিদের বিভিন্ন আয়াতে এ যুদ্ধের খুঁটিনাটি বিষয় তন্নতন্ন করে পর্যালোচনা করা হয়েছে। যেসব সুরা ও আয়াতে বদরযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, তা যদি একত্র করা হয়, তার কলেবর ত্রিশপারা কোরআনের প্রায় আধাপারা হবে। যা প্রমাণ করে এ যুদ্ধ সাধারণ কোনো ঘটনা ছিল না। মুসলমানদের জাতীয় বিশ্বাস ও চেতনায় বদরযুদ্ধের শিক্ষা ও চেতনা জাগরুক রাখার জন্য আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে যুদ্ধের প্রতিটি বিষয় নিখুঁতভাবে রেকর্ড রেখেছেন। এ যুদ্ধে ৩০০ হাজার ফেরেশতা কাফেরদের ওপর হামলায় অংশ নিয়েছেন বলে কোরআন মজিদে উল্লেখ আছে। কাজেই বদরযুদ্ধ ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং এর চেতনা ইসলাম ও মুসলমানদের অস্তিত্বের নিয়ামক।

মহানবি (সা.) ১৩ বছর ইসলাম প্রচার করেন জন্মভূমি মক্কায়। এ সময় এমন কোনো নির্যাতন ছিল না, কুরাইশ মুশরিকরা মুসলামদের ওপর যার পরীক্ষা চালায়নি। অবশেষে অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে মহানবি (সা.) ও তার অনুসারী মুসলমানরা দেশত্যাগ করে মদিনায় চলে আসেন। মদিনায় গিয়ে মহানবি স্থানীয় ইহুদিদের সঙ্গে একটি রাষ্ট্রীয় ঘোষণাপত্র স্বাক্ষর করে ইসলামি রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন। ইতিহাসে এ দেশত্যাগ হিজরত ও দেশত্যাগীরা মুহাজির এবং মদিনার মুসলমানরা আনসার নামে পরিচিত।

হিজরতের পর যে কোনো সময় মক্কার মুশরিকরা সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে মদিনার ছোট্ট ইসলামি রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দেয়ার আশংকা বিদ্যমান ছিল। মহানবি সংবাদ পান যে, মক্কার কুরাইশদের একটি কাফেলা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে মদিনার পাশ দিয়ে সিরিয়ায় যাবে। শত্রুর অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড মজবুত হতে দেয়া মানে নিজের অস্তিত্বকে দুর্বল করা। কাজেই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন কুরাইশ কাফেলাকে সিরিয়া যাওয়ার পথে বাধা দেবেন।

২০০ লোকসহ যুল-উশাইরা নামক স্থান পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে জানতে পারেন, কয়েক দিন আগেই কুরাইশ কাফেলা সেই স্থান অতিক্রম করে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে চলে গেছে। তিনি এবার সিদ্ধান্ত নিলেন ফেরার পথে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বাধীন কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলাকে আটক করবেন। ৩১৩ জন সঙ্গী নিয়ে তিনি ৮ রমজান বদর প্রান্তরের উদ্দেশ্যে রওনা হন এবং ১৭ রমজান এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আবু সুফিয়ান মুসলমানদের বাধার আশংকা আঁচ করে মক্কায় খবর পাঠিয়েছিল, বাণিজ্য কাফেলা মুসলমানদের আক্রমণের শিকার হবে। কাজেই সাহায্যের জন্য তোমরা এগিয়ে এসো। সবার পুঁজি ও অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত থাকায় বলতে গেলে মক্কার সবাই সশস্ত্র প্রস্তুতি নিয়ে রওনা দিলো।

বিচক্ষণ আবু সুফিয়ান প্রধান সড়ক পাশ কেটে সমুদ্র উপকূলের পথ ধরে কেটে পড়ে। পথে মক্কা থেকে আগত সশস্ত্র বাহিনীর সাক্ষাৎ হলে সে প্রস্তাব দেয়, যেহেতু বাণিজ্য কাফেলা নিরাপদে চলে এসেছে চলো মক্কায় ফিরে যাই। কিন্তু কুরাইশ নেতা আবু জেহেল বলল, বদর প্রান্তরে তিন দিন আনন্দফূর্তি না করে আমরা মক্কায় ফিরব না।

মহানবি (সা.) আসন্ন যুদ্ধের ব্যাপারে মুসলমানদের মতামত চাইলেন। মুহাজিরদের পক্ষে মিকদাদ ইবনে আমর নবিজির যে কোনো আদেশ শিরোধার্য করার ঘোষণা দিয়ে বললেন, আমরা বনি ইসলাইলের মতো বলব না যে, ‘তুমি আর তোমার খোদা গিয়ে যুদ্ধ করো; আমরা এখানে বসে থাকব।’

মদিনাবাসী আনসারদের মতামত জানতে চাইলে সাআদ ইবনে মুয়াজ (আ.) আবেগময় ভাষায় বললেন, যদি আপনি বিশাল সাগর পাড়ি দিতে বলেন, জান দেব, তবুও আপনার আদেশ পালনে পিছপা হব না। তার বক্তৃতা শুনে নবিজি খুব খুশি হলেন এবং যুদ্ধ প্রস্তুতিতে মনোযোগ দিলেন।

বদর প্রান্তরের পানির কুপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একটি গর্ত করে তাতে পানি ভর্তি করা হল, যাতে যুদ্ধাকালীন পানির সংকট না হয়। নবিজির জন্য একটি ছাউনী তৈরি করা হল। গোয়েন্দ তৎপরতায় মুসলমানদের হাতে দুজন কুরাইশ বালক পাকড়াও হয়। তারা জানায় যে, টিলার ওপারে কুরাইশ বাহিনী সমবেত হয়েছে। নবিজি তাদের সংখ্যা কত জানতে চাইলে বালকরা বলল, আমাদের জানা নেই। নবিজি প্রতি বেলা খাবারের জন্য কয়টি উট জবাই করে জানতে চাইলে বলল, এক বেলায় ৯টি আরেক বেলায় ১০টি। নবিজি বললেন, তাদের সংখ্যা ৯০০ থেকে ১০০০-এর মাঝামাঝি।

নবিজি (সা.) রণাঙ্গনে মুসলামানদের ব্যুহ রচনা ও সৈন্য মোতায়েনের কাজসম্পন্ন করার পর ছাইনীতে গিয়ে নামাজ পড়লেন। তারপর আল্লাহর সাহায্যের জন্য দুহাত তুলে ফরিয়াদ জানাতে লাগলেন। প্রভু হে! মুসলমানদের এই ক্ষুদ্রদল যদি আজ নিশ্চিহ্ণ হয়ে যায় পৃৃথিবীর বুকে তোমার ইবাদতের জন্য কেউ অবশিষ্ট থাকবে না। পেছনে দাঁড়িয়ে আবু বকর সিদ্দিক (রা.) আমিন আমিন বলছিলেন। নবিজি কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন, তোমরা সুসংবাদ নাও, আল্লাহর সাহায্য আসন্ন।

কুরাইশ পক্ষে মল্লযুদ্ধের জন্য রণাঙ্গনে আসল ওতবা ইবনে রাবিয়া, তার ভাই শায়বা ইবনে রাবিয়া ও ছেলে ওলীদ ইবনে ওতবা। নবিজি আপন চাচা হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব, আলী ইবনে আবু তালিব ও ওবায়দা ইবনে হারেসকে ওই তিনজনের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য পাঠালেন।

হামজা ও আলী (রা.) শায়বা ও ওয়ালীদকে হত্যা করলেন। তবে ওতবার আঘাতে বয়স্ক ওবায়দা মাটিতে পড়ে গেলেন। পরে হামজা ও আলী এসে ওতবাকে হত্যা করলেন এবং ওবায়দাকে শিবিরে নিয়ে আসলেন। এরপর শুরু হল ঘোরতর যুদ্ধ। প্রচণ্ড যুদ্ধ চলাকালে তিনটি প্রবল ঝড় বয়ে গেল। তা ছিল ফেরেশতাদের অবতরণ ও আক্রমণ। আনসারী আফরার অল্প বয়েসি দুই ছেলের টার্গেট ছিল মুশরিক নেতা আবু জেহেলকে হত্যা করবে। তারা অশ্বারোহী দীর্ঘদেহী আবু জেহেলের রানের উপর আঘাত করল। আবু জেহেল মুহূর্তে ধরাশায়ী হয়ে কাতরাতে থাকে।

যুদ্ধ শেষ হলে নবিজি নিহত কাফেরদের লাশ একটি গর্তে পুতে দেন। আর মুসলামান শহিদদের কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করেন।

বদরযুদ্ধের শাশ্বত পয়গাম, মুসলমানরা যদি একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, সংখ্যা ও অস্ত্রশক্তি বড়ো কথা নয়, দুনিয়ার যে-কোনো শক্তিধর তাগুতের ওপর তাদের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। ইসলামের দীর্ঘ ইতিহাসে এই সত্য বারবার প্রমাণিত হয়েছে।