০৬:২৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

বই রিভিউ: কমফোর্ট উইমেন- জাপানি সেনাদের বিনোদন ক্যাম্পে কোরিয়ান নারীদের আর্তনাদের চিত্র

মাছুম বিল্লাহ
  • প্রকাশ: ০৮:১০:০০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ মার্চ ২০২১
  • / ৮২৫ বার পড়া হয়েছে

নোরা ওকজা কেলার

নোরা ওকজা কেলার কোরিয়ান আমেরিকান ঔপন্যাসিকের প্রথম উপন্যাস ‘কমফোর্ট উইমেন’ যেখানে বিধৃত হয়েছে নারী ও মেয়েদের কুৎসিত গল্প যেগুলো সংঘটিত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন জাপানি সেনাবাহিনীর যৌনচাহিদা মেটানোর নিমিত্তে তাদের তৈরি তথাকথিত ‘বিনোদন ক্যাম্পে’। যেসব নারীরা এর শিকার হতেন তাদেরকে অবমূল্যায়ন করা হতো শুধুমাত্র তাদের নিজ সমাজেই নয়, তারা নিজেদের চোখেও, নিজেদের কাছেও অপমানিত বোধ করতেন। যুদ্ধের নৃশংসতা এবং একটি প্রজন্মের ওপর তার দীর্ঘস্থায়ী ফলাফল, মা ও মেয়ের অস্বাভাবিক ও বেদনাতুর সম্পর্কের গল্প নিয়ে লেখা এ উপন্যাস।

বেক্কাহ হাওয়াই দ্বীপের তরুণী, তার মা আকিকো পতিতা হিসেবে বিক্রি হয়েছিলেন জাপানি সেনাবাহিনীর বিনোদন ক্যাম্পে। আকিকো তখন কম বয়সী তরুণী। আকিকো নিজের দেহকে জাপানি সেনাবাহিনীর দলিত মথিত করে লুন্ঠন করা থেকে রক্ষা করার জন্য এক বিশেষ প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং সখ্যতা গড়ে তোলেন ভূত-প্রেত জগতের সাথে। ফলে তিনি ভয়ংকর বিভীষিকার মধ্যে টিকে ছিলেন এবং এই বিষয়টি এক আমেরিকান মিশনারির দৃষ্টগোচর হয়, তিনি তাকে বিয়ে করেন এবং সেভাবেই বেক্কাহর জন্ম হয়। আমেরিকান ভদ্রলোক মারা যাওয়ার পর মা ও মেয়ে হাওয়াই দ্বীপের রাজধানী হনলুলুতে বাস করেন। বেক্কাহ সাধারণ জীবনে ফিরে আসার জন্য সংগ্রাম করছেন। আকিকো মাঝে মাঝে চীৎকার করেন, বিলাপ করেন তার মধ্যে বাস করা ভূতপ্রেত তার দ্বারা এগুলো করায়। আন্টি রেনো নামের এক ভদ্রমহিলা আকিকোকো ভাগ্য গণনাকারী হিসেবে স্বীকৃতি দেন ও নিয়োগ দেন।

আকিকো কোরিয়ান এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তার আসল নাম সুন হাইও। তার পূর্নবয়স্কা হয়ে ওঠার আগেই তিনি বাবা-মা হারিয়ে এতিম হন । তার বড় বোনের বিয়ের যৌতুকের জন্য পতিতা হিসেবে তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয় জাপানি সেনাবাহিনীর বিনোদন ক্যাম্পে। জাপানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা সুন্দরী মেয়েদের খুঁজতো। তবে তিনি পূর্ণবয়স্ক না হওয়ায় অন্য এক যৌনদাসীর সাথে তাকে সংযুক্ত করা হয়, তার কক্ষ পরিস্কার করা, পাত্র পরিষ্কার করাসহ ব্যক্তিগত কাজে সাহায্যের জন্য। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাকেও যৌনদাসী হিসেবে কাজ শুরু করতে হয় কারণ ঐ নারীকে সেনাবাহিনী একরাতে হত্যা করে ফেলে, সেই স্থান তাকে অধিকার করতে হয়। তাকে হত্যা করা হয় কারন একরাতে তিনি কোরিয়ান ও জাপানি ভাষায় সৈনিকদের গালি দিচ্ছিলেন, তাদের অভিষাপ দিয়ে বলছিলেন যে, তারা তাদের দেশকে এবং নারীদের দেহকে আক্রমণ করছে। যখন সৈন্যরা তার দেহের ওপর ওঠে তখনও তিনি বলছেন, ‘‘আমি একজন কোরিয়ান, আমি একজন নারী, আমি জীবন্ত, আমার বয়স সতের। তোমাদের মতই আমারও পরিবার ছিল, আমি একটি মেয়ে, আমি একজন বোন।’’ এগুলো বলার পর সূর্যাস্তের আগে মেয়েটিকে তারা বাগানে নিয়ে যায়, তারপর তাকে বিনোদন ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয় লোহার শিকের মধ্যে রোস্ট করার জন্য শুকরের মাংস যেভাবে ঢোকানো হয় তাকে ঠিক সেভাবে করে নিয়ে আসা হলো। বাকী সব যৌনদাসীদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য, তাদেরকে নীরব থাকার জন্য উদাহরণস্বরূপ তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেই রাতে মনে হচ্ছিল হাজার হাজার ব্যাং পুরো ক্যাম্পকে ঘিরে রেখেছে, তারা তাদের গলা খুলে দিয়ে ঐ ক্যাম্পের নারীদের জন্য কাঁদছে, সারারাত যেন তারা ডাকছে ইনডাক, ইনডাক, ইনডাক যা তারা কখনও ভুলে যেতে পারেন না।

কমফোর্ট উইমেন
কমফোর্ট উইমেন বইয়ের প্রচ্ছদ। গুডরিডস

তার পালিয়ে যাওয়ার পরও আকিকো তার পূর্বের নাম গ্রহণ করতে বা তার পূর্ব পরিচিতি জানাতে পারছেনা। তার যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ থেকে তাকে উদ্ধার করে এক আমেরিকান মিশনারি। তাদের বিয়ে এক ধরনের ভালোবাসা এবং গোপন লালসার ওপর প্রতিষ্ঠিত।দুজনের বোঝাপড়া নিয়ে সমস্যা এবং গোপন ঘৃণা তার প্রতি সেই মিশনারির। ক্যাম্পে তার কঠিনভাবে কষ্টকর গর্ভপাতের পরেও আকিকো গর্ভবতী হয়েছেন এবং বেক্কাকে জন্মদিয়েছেন। তার মেয়েকে অর্থাৎ বেক্কাকে তিনি পাগলের মতো ভালোবাসেন যা তাদের দুজনের দুই জগতের দূরত্ব ও ব্যবধানকে আতিক্রম করে নতুন এক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তাদের মাঝে। তিনি তার স্বামীকে ঘৃণা করেন এবং তার মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী মনে করেন।

আকিকোর মা ক্যাম্পে যাদের সাথে ছিলেন তাদের সবাইকে বলা হয় ‘কমফোর্ট উইমেন’ অর্থাৎ বিনোদন দেওয়া নারী। এটি কঠিন ও নিষ্ঠুর এক ধরনের কৌতুক। তাদেরকে তাদের ঘরের বাইরে আসতে দেওয়া হতো না। আকিকোকে বহুবছর যাবত হাজার হাজার জাপানি সৈনিকদের তার দেহ ভোগ করতে দিতে হয়েছে মনের সম্পূর্ন অনিচ্ছায়। তারা তার সাথে সঙ্গম করার জন্য লাইন দিয়ে থাকতো, একজনের পর একজন তার দেহের ওপর উঠে ধর্ষন করতো। তাদের মধ্যে কেউ কেউ তাকে ভালোও বাসতো, কেউ আবার তাকে আঘাত করতো। কিন্তু সবাই তাকে যৌন অত্যচার করে করে পশুর পর্যায়ে নামিয়ে আনতো। এভাবে সময় যতই গড়িযে যাচ্ছিলো, তার দেহ ধীরে ধীরে দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে পড়ছিল এবং বিষাদগ্রস্ততা তাকে পেয়ে বসে। জীবনের সব আশা, জীবন সব কর্মকান্ড তিনি ভুলে যান।তিনি অনুভব করছেন এবং মনে করছেন যে, আত্মা মারা গেছে। তার দেহখানি শুধু বেঁচে আছে এই নরপশুদের ভোগের জন্য।

বেক্কাহ তার মায়ের গল্প শুনে অবাক হয়ে যায়। জাপানি সেনাবাহিনী কর্তৃক তার মাকে নিষ্ঠুরভাবে ধর্ষণের ফসল হলো তার জন্ম! সে কি! তার মা ভিন্ন একটি দেশে যৌনদাসী ছিলেন, তিনি তার মতো আমেরিকান নন। এটি তার কাছে এক বিরাট আঘাত। তার মায়ের যে মানসিক বৈকল্য সে লক্ষ্য করেছে, তার মায়ের যে উল্টোপাল্টা আচরণ তার পেছনে তাহলে এগুলোই দায়ী, তার দুঃস্বপ্নের ফল। বেঁচে থাকার জন্য আকিকো নিজেকে বিশ্বাস করিয়েছেন যে, তার সাথে অন্য এক জগতের যোগাযোগ রয়েছে। সেই জগত হচেছ ভূত-প্রেতের জগৎ।বেক্কাহ বুঝতে পারছেনা সে কি করবে যখন সে তার মায়ের এই করুন ও নিষ্ঠুর কাহিনী জানতে পারলো।সে তার মাকে ক্ষমা করে দেয় এবং তার সাথে শান্তি স্থাপন করে।

একজন কোরিয়ান হিসেবে আকিকো জানেন যে, একটি জাপানি পরিবারে পালিত কোন শিশুর সাথে ক্রীতদাসের মতোই আচরণ করা হয়। তিনি এ ধরনের কোন পরিবেশ এড়ানোর জন্য চেষ্টা করছিলেন এবং অনেক আগেই তিনি স্বাধীনতা বা মূল্যবোধের অনূভূতি হারিয়ে ফেলেছেন। তাকে যে দেখাশুনা করছিল সে একদিন প্রস্তাব দিল যে, ব্রাডলি নামে আমেরিকান এক যুবকের সাথে তার বিয়ের প্রস্তাব আছে, বিয়ের পর তাকে নিয়ে তিনি আমেরিকায় চলে যাবেন। এতে আকিকো অবশ্য খুব একটা উৎসাহ প্রদর্শন করেননি, তিনি নীরব ছিলেন যা প্রস্তাবকের কাছে সম্মতির লক্ষণ বলে মনে হয়েছিল।অতএব তাদের বিয়ে হলো। বিয়ের পর ব্রাডলি আকিকোকে নিয়ে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে চলে যান এবং সেখানে গিয়ে শীঘ্রই তিনি টের পান যে, আকিকো গর্ভবতী এবং এটি হয়েছে তার ক্যাম্পে থাকাকালীন।

অসুস্ত হলে তিনি বেক্কাহর কাছে প্রকাশ করেন যে, তার বাবার মৃত্যুর জন্য তিনিই দায়ী। তিনি বহু বছর যাবত তার মৃত্যূ কামনা করছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি নিশ্চিত করেন তার মৃত্যু।এতে বেক্কাহ ভয় পেয়ে যায়,বেক্কাহর মনে আছে যে, তার মা হাওয়াইতে এক ক্যাফেটেরিয়ায় কাজ করেন আন্টি রেনো হচ্ছে ক্যাফেটেরিয়ার মালিক যিনি আকিকোকে ভাগ্য গণনাকারী হিসেবে নিয়োগ দেন। আকিকো একজন মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত একজন মানুষ যিনি প্রায় সময়ই তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকেন, অশ্লীল নৃত্য করেন এবং প্রেতাত্মাদের সাথে যোগযোগ রক্ষা করেন। বাবার মৃত্যুর পর বেক্কাহ তার অসুস্থ মায়ের সাথে বিগ আইল্যানেড চলে আসে এবং পরিকল্পনা ছিল যে, কোরিয়ায় ফিরে আসবে যা আর কখনও হয়নি। বেক্কাহ বড় হচেছ এবং আশা করে ছিল যে, তা মা সুস্থ হবেন, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেন। কিন্তু মা তা হলেন না, হলেন অসুস্থ , তার মুত্যু শয্যায় বসে মেয়েকে অনেক গোপন কথা বলেছেন। বলেছেন তাঁর ফেলে আসা জীবনের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি যখন শিশু ছিলেন তখন তার বাবা মা মারা যান। তার বোনের বিয়ের যৌতুকের জন্য তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয় জাপানিদের কাছে। তারপরেই তাকে জাপানিদের বিনোদন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মেয়েদেরকে সেই ক্যাম্পে পতিতা হিসেবে পাঠানো হয় যাদেরকে জাপানি সেনারা ব্যবহার করতো। শিশু বলে প্রথমে আকিকোকে অন্যান্য যৌনদাসীদের কক্ষ পরিষ্কার করতে দেওয়া হয়। এখানকার মেয়েদের সব ধরনের পরিচয় মুছে ফেলা হতো, তাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হতো।যে স্টলে/রুমে থাকতো সেই অনুযায়ী তাদের নাম দেওয়া হতো পূর্বের নাম বাদ দিয়ে। এক নারী এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করায়, কথা বলায় তাকে হত্যা করা হলো অন্যদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য।আকিকোকে তার জায়গায় বসানো হলো।তার নাম ‘সুন হাইও’ থেকে নাম হলো আকিকো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু আগে থেকেই অর্থাৎ ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কমফোর্ট উইমেন কালচার গড়ে তোলে জাপানি সেনাবাহিনী। যেসব কারনে তারা ’কমফোর্ট উইমেন’প্রথা গড়ে তুলেছিলেন সেগুলোকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।

প্রথমত, জাপানি সেনা কর্তৃপক্ষ সেনাদের দ্বারা ধর্ষন বন্ধ করতে চেয়েছিল কারন সেনাদের দ্বারা অবিরত ধর্ষনের ঘটনা ঘটছিল যা বিজিত ও দখলকৃত অঞ্চলগুলোতে জাপানি সেনাবাহিনী সম্পর্কে মারাত্মক নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করছিল। তবে, ধর্ষণের চেয়ে এই প্রথা হচেছ এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত যৌন অত্যাচার, আর এই প্রথা চালূ করার পরেও তাদের দ্বারা ধর্ষণ কমেনি।

দ্বিতীয় কারণ ছিল, সেনাসদস্য ও সেনাকর্মকর্তাদের মনে প্রশান্তি নিয়ে আসা। কঠিন যুদ্ধের সময় সেনা কর্তৃপক্ষ ভেবেছিল যে, সেনাদের মনোরঞ্জন , বিনোদনে ও মনকে আনন্দ দেওয়ার জন্য নারী সম্ভোগ প্রয়োজন। সেনাসদস্য ও সেনা কর্মকর্তারা যদি নিজেদের সেনা ছাউনিতে ও ক্যাম্পে নারী ভোগ করতে পারে তাহলে তারা মনোযোগ দিয়ে যুদ্ধ করতে পারবে এবং যুদ্ধক্ষেত্র সহজে ছাড়তে চাবেনা। অনেকদিন যুদ্ধক্ষেত্রে থাকতে চাবে। কমফোর্ট উইমেন প্রথা গড়ে তোলার আর একটি কারণ ছিল যৌনবাহিত রোগ বেশিদুর না ছড়ানোর জন্য। উল্টোপাল্টা ও অবাধ যৌনচার যে বিভিন্ন যৌনরোগের কারন তাতে সন্দেহ নেই। তারা অনেকে আক্রান্তও হয়েছিলো। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তা বেশিদূর ছড়াতে দিতে চায়নি, নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছে নির্দিস্ট এরিয়াতে। এর আর একটি কারণ ছিল, সামরিক তথ্য গোপান রাখার ব্যবস্থা করা ও গুপ্তচরবৃত্তিকে রোধ করা। সেনারা বাইরে যাবেনা, বাইর থেকে কেউ আসা যাওয়া করবে না। জাপানি নারীরা ক্যাম্পে আটকা থাকবে, তাহলে গুপ্তচরবৃত্তি সহসা ঘটবে না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি সেনারা আক্রান্ত অঞ্চরে খাবার, জ্বালানী, অন্যান্য দ্রব্যের সাথে নারীদেরও লুট করে নিয়ে আসতো এবং তাদের র্ধষন করতো। অধিকৃত কোরিয়া ও চীনে তার এসব ঘটনা ঘটাতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে নারীব্যবসায়ী দালালরাও তাদের ব্যবসা কোরিয়ার দিকে নিয়ে আসে। তারা বিভিন্ন ছল-ছাতুরীর মাধ্যমে কোরিয়ার সব বয়সী নারীদের ‘কমফোর্ট উইমেনে’ রূপান্তারিত করে মূলত জাপানি সেনাদের মনোরঞ্জনের জন্য। ‘কমফোর্ট উইমেন’ প্রথার মাধ্যমে ৮০০০০ থেকে ২০০০০০ নারীদের আটকে রাখা হয়েছিল, তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশই কোরিয়ান নারী। কোন কোন সূত্রে এই সংখ্যা ৪১০০০০ পর্যন্ত পৌঁছেছিল।আবার কোন কোন কমফোর্ট স্টেশনের ম্যানেজার খুব চালাক ছিল, তারা কেউ কেউ করে এখাকার নারীদের বনভোজনে নিয়ে যেত, মাঝে মাঝে খেলাধুলা করতে দিত যাতে অন্যরা বুঝে যে, তারা বিনোদন ক্যাম্পে বেশ অভিজাত জীবন যাপন করছে।

কমফোর্ট উইমেন দলে থাকা বিভিন্ন নারী বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। এক নারী বলেন, “একজন সেনা হিসেবে থাকা এবং যুদ্ধে মারা যাওয়া কমফোর্ট উউমেন হিসেবে বেঁচে থাকার চেয়ে ঢের উত্তম।’’ কারণ একজন কমফোর্ট উউমেনকে সারা জীবন শরীরিক, মানসিক ও সামাজিক যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়।

অন্য এক নারী বলেছেন, তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ক্যাম্পে। কিছুক্ষন পর তাকে এক অফিসারের রুমে নিয়ে যাওয়া হয়, যে রুম শুধুমাত্র একটি পর্দা দিয়ে অন্য রুম থেকে আলাদা করা হয়েছে। অফিসার তাকে ন্যাংটা হয়ে যেতে বললো। সে উলঙ্গ হতে রাজী হয়নি বলে তাকে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে উলঙ্গ করে ফেলা হলো। তারপর শুরু হলো ধর্ষন।” আর এক নারী বলেছেন, ‘মাউন্ট ইয়াংম ওপর জাপানি সোনরা থাকতো। তাদের মধ্যে দুই তিনজন প্রতিদিন তার বাসায় ঢুকে ধর্ষন করতো। তার পালানোর কোন পথ ছিলনা যাদিও অসহ্য যন্ত্রনায় তার সময় কাটতোম। মাঝে মাঝে পাহাড়ের ওপরে নিয়ে তাকে ধর্ষণ করতো।

কেউ কেউ বলছে ধর্ষণ করার পর তাদের যৌনাঙ্গ ছিড়ে গেছে প্রচন্ড যন্ত্রণায় কাতরাচেছ। ডাক্তার এসে ঔষধ দিয়ে বলেছেন যে, সাত দিনের মধ্যে সেড়ে যাবে। কিন্তু অবাক কান্ড তার পর পরই আবার সেনারা এসে তাকে ধর্ষন শুরু করেছে, তীব্র যন্ত্রনায় চিৎকার করে আর না করার জন্য যতই অনুরোধ করে ওরা তাকে শারীরিক শাস্তি দিতে থাকে, পেটাতে থাকে। বুভুক্ষু পশুর দল এভাবেই তাদের যৌনকামনা মেটাতো। এটি সব যুদ্ধেরই অচিচেছদ্য অংশ। তাই ইদানিং জাপানি সরকার ‘কমফোর্ট উইমেন’ কালচার যে, তাদের সৃষ্টি তা স্বীকার করছেনা। সরকারের কোন সম্মতি ছিলনা কিন্তু যুদ্ধ ও যৌন ক্ষুথার্ত সেনাবাহিনীর ক্ষুধা মেটানোর যে এই পথই খোলা থাকে তা যুদ্ধ ঘোষণা করা সরকারগুলো কেন যেন এড়িয়ে যেতে চায়।

কোন কোন নারী বলেছেন, ষাট বছর পার হয়ে যাওয়ার পরেও তাদেও যৌনাঙ্গে তারা যন্ত্রণা অনুভব করে। অনেকেই তাই ছাড়া পাওয়ার পরেও আর বিয়ে করেনি। এক মেয়ে বলেছে তাকে ক্যাম্পে নিয়ে এক যন্ত্র দিয়ে তার দু পা ফাঁক করা হয়েছে কিন্তু কম বয়সী বলে যৌনাঙ্গে পুরুষাঙ্গ ঢুকাতে না পের ক্যাম্প প্রধান তাকে সর্বক্ষণই পেটাতো, শারীরিক শাস্তি দিত। যখন তার বয়স বেড়ে গেল, কিছুদিন পর যখন ঢোকাতে পারতো তখন সে পেটানো তেকে বেচে গেছে ঠিকই কিন্তু যৌনাঙ্গের ওপর অসহ্য চাপ কারন একের পর এক পশু এসে তাদের বীর্য ঢালতো । যুদ্ভের পর ’বিনোদন ক্যাম্পে’ আটকে থাকা অনেক নারী তাদের নিজেদের বাড়িতেও ফিরে যায়নি ঘৃণা, ক্ষোভ, লজ্জা আর অপমানে। এভাবে নিজ জন্মভূমিতে অনেকেই ফেরত যায়নি, অনেকে আত্মহত্যা করেছে। ৪১০০০০ পর্যন্ত নারীদেরকে তারা ১২৫টি বিনোদন ক্যাম্পে আটকে রেখেছিল। জানা যায যে, জাপানি সেনারা প্রতি ৭০ জনের জন্য একজন করে যৌনদাসী চেয়েছিল তাদের সরকারের কাছে। বর্তমানে বেঁচে থাকা ৯০ বছর বয়সী এ নারী বলেন,‘‘ আমি তাদেরকে আনন্দ দিতে চাইনি। তারা জোরপূর্বক আমার দেহকে ভোগ করেছে, আমাকে অত্যাচার করেছে যা আমি কোনদিন ভুলব না।’’

 যুদ্ধ শেষে সুন হাইও পিয়ং ইয়ংএ চলে আসেন, সেখানে সে আমেরিকান মিশনারিকে বিয়ে করেন যিনি তার অভিষপ্ত জাপানি নামটিই জানেন, জানতেন না তার আসল নাম। তাকে নিয়ে আমেরিকায় চলে যান এবং একটি কন্যাসন্তব প্রসব করেন আকিকো। মিশনারি স্বামী মারা যাওয়ার পর আকিকো হাওয়াই দ্বীপে আটকা পড়েন, হাতে কোন অর্থ নেই আছে পাঁচ বছরের কন্যা বেক্কাহ।

বেক্কাহ তার মায়ের অভিষপ্ত ও মানসিক বৈকল্যে ভরা শিশুকাল সম্পর্কে জানেনা। তবে সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অকিকোর ভয়ংকর ও বিরক্তিকর বাধন থেকে মুক্তি পাওয়ার। আকিকোর মৃত্যুর পর যখন বেক্কার বয়স ৩০এর মতো তখন সে মায়ের জীবনের গোপন অধ্যায় জানতে পারে। এভাবে এক কোরিয়ান নারীর মনস্তাত্তিক জটিলতা এবং আমেরিকায় জন্ম নেয়া কন্যার সাথে মায়ের যে, অদ্ভুত সম্পর্ক তার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে উপন্যাসটিতে। আকিকোর ২০ বছরের যৌনদাসত্বের জীবন যেখানে প্রতিদিন এক ডজন জাপানি তাকে ধর্ষন করতো , পাঠক এটি ছাড়াও কোরিয়া থেকে হাওয়াই ভ্রমণ করেন উপন্যাসটি পাঠের মাধ্যমে। এটি পড়ার সময় পাঠকের বিরক্তি ধরে শুধু মৃত্যু আর বিভীষিকাময় পরিস্থিতির বর্ণনা পড়তে পড়তে।

বেক্কার বাবা অর্থাৎ আমেরিকান মিশনারি মারা যান ৫ বছর বয়সে, তারও ৫ বছর পর যখন তার মৃত্যুাবার্ষিকী পালন করা হচিছলে তার প্রিয় খাবার শ্রিম্প (চিংড়ি মাছ) দিয়ে প্রসাদ তৈরি করে, আকিকো তখন তার মেয়ের কাছে প্রকাশ করেন যে, তিনিই তার বাবাকে হত্য করেছেন। এই কথা শুনে বেক্কাহ শুনে অবাক হয় এবং ভয়ও পায়। সেও তার মায়ের প্রতি বিরক্ত তার অস্বাভাবিক আচরণের জন্য এবং অবচেতন মনে তার মৃত্যুও চাচ্ছিলো। আকিকোর অস্বাভাবিক আচরণের কিছু চিত্র হচেছ–

আকিকো ছোট্ট মেয়েকে সতর্ক করে দেন এই বলে যে, সাজা হচেছ মৃত্যুর সংবাদবাহক। মধ্যরাতে শিশু যখন চিৎকার করে কেঁদে ওঠে, তখন সাজা তার পেছনে আছে এই বলে ভয় দেখাতেন। আর তখন তিনি একটি জবাই করা মুরগী খপ করে আকড়ে ধরে মেয়ের রাতের পোশাক ছিড়েঁ ফেলতেন সেই পোশাকের টুকরো দিয়ে জবাই করা মুরগীটিকে আবৃত করে ফেলেন এবং পরক্ষণেই রক্তমাখা সেগুলো দরজা দিয়ে বাইরে ফেলে দেন ক্ষুধার্ত শয়তানদের বোকা বানানোর জন্য।বেক্কা যখন বড়হ য় তখন তার কাছে তার মায়ের অদ্ভুত বিশ্বাস ও আচরণগুলোকে বিভ্রান্তিকর মনে হতো। তার মা রেড ডিস্যাস্টার বলে যা বুঝাতেন তার সাথে বেক্কা মিল খুঁজে পায় তার স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের ক্লাসে ব্যাকটেরিয়ার কথা জেনে। ব্যাকটেরিয়া আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ায় অথচ আমরা তাদের দেখতে পাইনা, অদৃশ্য ব্যাকটেরিয়া।তার মা সম্ভবত সেগুলোকেই রেড ডিসঅ্যাস্টার বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। অ্যাপার্টমেন্টের লাল বস্তুগুলো পুড়িয়ে ফেলা আকিকোর কাছে বেক্কার হাত ধুয়ে ফেলার মতো মনে হতো। আকিকোর এই অস্বাভাবিক আচরণ স্থানীয় পানশালার মালিকের দৃষ্টি এড়ায়নি। তিনি এটিকে অর্থনৈতিকভাবে কাজে লাগালেন। তিনি এটি আকিকোর দ্বৈবশক্তির অধিকারী বলে স্বীকৃতি দিলেন।তাই তাকে স্পিরিচুয়াল উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিলেন এবং দূর দুরান্ত থেকে মানুষ তার কাছে উপদেশ নেয়ার জন্য ভীড় জমাতো।

যুদ্ধ মানব সভ্যতার জন্য এক বিরাট অভিষাপ। যুদ্ধ মানে ধ্বংস। এই ধবংস শুধু ধন সম্পদ ধ্বংস নয়, এটি মানবতার চরম পরাজয়। মানবজাতি কেন এই ধ্বংস ডেকে আনে? আজকের সভ্য জাপান তার অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েছে। হিরোসীমা ও নাগাসাকীতে অ্যাটম বোমা নিক্ষেপের পর যে ধ্বংসস্তুপ তৈরি হয়েছিল, তার পর থেকেই জাপান তার আগ্রাসী ভূমিকা থেকে সরে এসে দেশ গড়ার, শিক্ষা ও জ্ঞান বিজ্ঞানে এগিয়ে যাওয়ার শপথ গ্রহন করে।কিন্তু জাপানি সেনাকর্তৃক লক্ষ লক্ষ কোরিয়ান ও চীনা নারীদের যে যৌনদাসী হিসেবে ‘কমফোর্ট ক্যাম্প’ আটকে রেখে দিনের পর দিন বছরের পর বছর অমানবিক নির্যতন করা হতো তারই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে’ নোরা ওকজা কেলারে’র উপন্যাস’ কমফোর্ট উইমেন’এ।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

মাছুম বিল্লাহ

শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক এবং প্রেসিডেন্ট: ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)। সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর- ভাব বাংলাদেশ এবং শিক্ষা বিশেষজ্ঞ -ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি। ইমেইল: [email protected]

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

বই রিভিউ: কমফোর্ট উইমেন- জাপানি সেনাদের বিনোদন ক্যাম্পে কোরিয়ান নারীদের আর্তনাদের চিত্র

প্রকাশ: ০৮:১০:০০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ মার্চ ২০২১

নোরা ওকজা কেলার কোরিয়ান আমেরিকান ঔপন্যাসিকের প্রথম উপন্যাস ‘কমফোর্ট উইমেন’ যেখানে বিধৃত হয়েছে নারী ও মেয়েদের কুৎসিত গল্প যেগুলো সংঘটিত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন জাপানি সেনাবাহিনীর যৌনচাহিদা মেটানোর নিমিত্তে তাদের তৈরি তথাকথিত ‘বিনোদন ক্যাম্পে’। যেসব নারীরা এর শিকার হতেন তাদেরকে অবমূল্যায়ন করা হতো শুধুমাত্র তাদের নিজ সমাজেই নয়, তারা নিজেদের চোখেও, নিজেদের কাছেও অপমানিত বোধ করতেন। যুদ্ধের নৃশংসতা এবং একটি প্রজন্মের ওপর তার দীর্ঘস্থায়ী ফলাফল, মা ও মেয়ের অস্বাভাবিক ও বেদনাতুর সম্পর্কের গল্প নিয়ে লেখা এ উপন্যাস।

বেক্কাহ হাওয়াই দ্বীপের তরুণী, তার মা আকিকো পতিতা হিসেবে বিক্রি হয়েছিলেন জাপানি সেনাবাহিনীর বিনোদন ক্যাম্পে। আকিকো তখন কম বয়সী তরুণী। আকিকো নিজের দেহকে জাপানি সেনাবাহিনীর দলিত মথিত করে লুন্ঠন করা থেকে রক্ষা করার জন্য এক বিশেষ প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং সখ্যতা গড়ে তোলেন ভূত-প্রেত জগতের সাথে। ফলে তিনি ভয়ংকর বিভীষিকার মধ্যে টিকে ছিলেন এবং এই বিষয়টি এক আমেরিকান মিশনারির দৃষ্টগোচর হয়, তিনি তাকে বিয়ে করেন এবং সেভাবেই বেক্কাহর জন্ম হয়। আমেরিকান ভদ্রলোক মারা যাওয়ার পর মা ও মেয়ে হাওয়াই দ্বীপের রাজধানী হনলুলুতে বাস করেন। বেক্কাহ সাধারণ জীবনে ফিরে আসার জন্য সংগ্রাম করছেন। আকিকো মাঝে মাঝে চীৎকার করেন, বিলাপ করেন তার মধ্যে বাস করা ভূতপ্রেত তার দ্বারা এগুলো করায়। আন্টি রেনো নামের এক ভদ্রমহিলা আকিকোকো ভাগ্য গণনাকারী হিসেবে স্বীকৃতি দেন ও নিয়োগ দেন।

আকিকো কোরিয়ান এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তার আসল নাম সুন হাইও। তার পূর্নবয়স্কা হয়ে ওঠার আগেই তিনি বাবা-মা হারিয়ে এতিম হন । তার বড় বোনের বিয়ের যৌতুকের জন্য পতিতা হিসেবে তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয় জাপানি সেনাবাহিনীর বিনোদন ক্যাম্পে। জাপানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা সুন্দরী মেয়েদের খুঁজতো। তবে তিনি পূর্ণবয়স্ক না হওয়ায় অন্য এক যৌনদাসীর সাথে তাকে সংযুক্ত করা হয়, তার কক্ষ পরিস্কার করা, পাত্র পরিষ্কার করাসহ ব্যক্তিগত কাজে সাহায্যের জন্য। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাকেও যৌনদাসী হিসেবে কাজ শুরু করতে হয় কারণ ঐ নারীকে সেনাবাহিনী একরাতে হত্যা করে ফেলে, সেই স্থান তাকে অধিকার করতে হয়। তাকে হত্যা করা হয় কারন একরাতে তিনি কোরিয়ান ও জাপানি ভাষায় সৈনিকদের গালি দিচ্ছিলেন, তাদের অভিষাপ দিয়ে বলছিলেন যে, তারা তাদের দেশকে এবং নারীদের দেহকে আক্রমণ করছে। যখন সৈন্যরা তার দেহের ওপর ওঠে তখনও তিনি বলছেন, ‘‘আমি একজন কোরিয়ান, আমি একজন নারী, আমি জীবন্ত, আমার বয়স সতের। তোমাদের মতই আমারও পরিবার ছিল, আমি একটি মেয়ে, আমি একজন বোন।’’ এগুলো বলার পর সূর্যাস্তের আগে মেয়েটিকে তারা বাগানে নিয়ে যায়, তারপর তাকে বিনোদন ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয় লোহার শিকের মধ্যে রোস্ট করার জন্য শুকরের মাংস যেভাবে ঢোকানো হয় তাকে ঠিক সেভাবে করে নিয়ে আসা হলো। বাকী সব যৌনদাসীদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য, তাদেরকে নীরব থাকার জন্য উদাহরণস্বরূপ তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেই রাতে মনে হচ্ছিল হাজার হাজার ব্যাং পুরো ক্যাম্পকে ঘিরে রেখেছে, তারা তাদের গলা খুলে দিয়ে ঐ ক্যাম্পের নারীদের জন্য কাঁদছে, সারারাত যেন তারা ডাকছে ইনডাক, ইনডাক, ইনডাক যা তারা কখনও ভুলে যেতে পারেন না।

কমফোর্ট উইমেন
কমফোর্ট উইমেন বইয়ের প্রচ্ছদ। গুডরিডস

তার পালিয়ে যাওয়ার পরও আকিকো তার পূর্বের নাম গ্রহণ করতে বা তার পূর্ব পরিচিতি জানাতে পারছেনা। তার যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ থেকে তাকে উদ্ধার করে এক আমেরিকান মিশনারি। তাদের বিয়ে এক ধরনের ভালোবাসা এবং গোপন লালসার ওপর প্রতিষ্ঠিত।দুজনের বোঝাপড়া নিয়ে সমস্যা এবং গোপন ঘৃণা তার প্রতি সেই মিশনারির। ক্যাম্পে তার কঠিনভাবে কষ্টকর গর্ভপাতের পরেও আকিকো গর্ভবতী হয়েছেন এবং বেক্কাকে জন্মদিয়েছেন। তার মেয়েকে অর্থাৎ বেক্কাকে তিনি পাগলের মতো ভালোবাসেন যা তাদের দুজনের দুই জগতের দূরত্ব ও ব্যবধানকে আতিক্রম করে নতুন এক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তাদের মাঝে। তিনি তার স্বামীকে ঘৃণা করেন এবং তার মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী মনে করেন।

আকিকোর মা ক্যাম্পে যাদের সাথে ছিলেন তাদের সবাইকে বলা হয় ‘কমফোর্ট উইমেন’ অর্থাৎ বিনোদন দেওয়া নারী। এটি কঠিন ও নিষ্ঠুর এক ধরনের কৌতুক। তাদেরকে তাদের ঘরের বাইরে আসতে দেওয়া হতো না। আকিকোকে বহুবছর যাবত হাজার হাজার জাপানি সৈনিকদের তার দেহ ভোগ করতে দিতে হয়েছে মনের সম্পূর্ন অনিচ্ছায়। তারা তার সাথে সঙ্গম করার জন্য লাইন দিয়ে থাকতো, একজনের পর একজন তার দেহের ওপর উঠে ধর্ষন করতো। তাদের মধ্যে কেউ কেউ তাকে ভালোও বাসতো, কেউ আবার তাকে আঘাত করতো। কিন্তু সবাই তাকে যৌন অত্যচার করে করে পশুর পর্যায়ে নামিয়ে আনতো। এভাবে সময় যতই গড়িযে যাচ্ছিলো, তার দেহ ধীরে ধীরে দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে পড়ছিল এবং বিষাদগ্রস্ততা তাকে পেয়ে বসে। জীবনের সব আশা, জীবন সব কর্মকান্ড তিনি ভুলে যান।তিনি অনুভব করছেন এবং মনে করছেন যে, আত্মা মারা গেছে। তার দেহখানি শুধু বেঁচে আছে এই নরপশুদের ভোগের জন্য।

বেক্কাহ তার মায়ের গল্প শুনে অবাক হয়ে যায়। জাপানি সেনাবাহিনী কর্তৃক তার মাকে নিষ্ঠুরভাবে ধর্ষণের ফসল হলো তার জন্ম! সে কি! তার মা ভিন্ন একটি দেশে যৌনদাসী ছিলেন, তিনি তার মতো আমেরিকান নন। এটি তার কাছে এক বিরাট আঘাত। তার মায়ের যে মানসিক বৈকল্য সে লক্ষ্য করেছে, তার মায়ের যে উল্টোপাল্টা আচরণ তার পেছনে তাহলে এগুলোই দায়ী, তার দুঃস্বপ্নের ফল। বেঁচে থাকার জন্য আকিকো নিজেকে বিশ্বাস করিয়েছেন যে, তার সাথে অন্য এক জগতের যোগাযোগ রয়েছে। সেই জগত হচেছ ভূত-প্রেতের জগৎ।বেক্কাহ বুঝতে পারছেনা সে কি করবে যখন সে তার মায়ের এই করুন ও নিষ্ঠুর কাহিনী জানতে পারলো।সে তার মাকে ক্ষমা করে দেয় এবং তার সাথে শান্তি স্থাপন করে।

একজন কোরিয়ান হিসেবে আকিকো জানেন যে, একটি জাপানি পরিবারে পালিত কোন শিশুর সাথে ক্রীতদাসের মতোই আচরণ করা হয়। তিনি এ ধরনের কোন পরিবেশ এড়ানোর জন্য চেষ্টা করছিলেন এবং অনেক আগেই তিনি স্বাধীনতা বা মূল্যবোধের অনূভূতি হারিয়ে ফেলেছেন। তাকে যে দেখাশুনা করছিল সে একদিন প্রস্তাব দিল যে, ব্রাডলি নামে আমেরিকান এক যুবকের সাথে তার বিয়ের প্রস্তাব আছে, বিয়ের পর তাকে নিয়ে তিনি আমেরিকায় চলে যাবেন। এতে আকিকো অবশ্য খুব একটা উৎসাহ প্রদর্শন করেননি, তিনি নীরব ছিলেন যা প্রস্তাবকের কাছে সম্মতির লক্ষণ বলে মনে হয়েছিল।অতএব তাদের বিয়ে হলো। বিয়ের পর ব্রাডলি আকিকোকে নিয়ে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে চলে যান এবং সেখানে গিয়ে শীঘ্রই তিনি টের পান যে, আকিকো গর্ভবতী এবং এটি হয়েছে তার ক্যাম্পে থাকাকালীন।

অসুস্ত হলে তিনি বেক্কাহর কাছে প্রকাশ করেন যে, তার বাবার মৃত্যুর জন্য তিনিই দায়ী। তিনি বহু বছর যাবত তার মৃত্যূ কামনা করছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি নিশ্চিত করেন তার মৃত্যু।এতে বেক্কাহ ভয় পেয়ে যায়,বেক্কাহর মনে আছে যে, তার মা হাওয়াইতে এক ক্যাফেটেরিয়ায় কাজ করেন আন্টি রেনো হচ্ছে ক্যাফেটেরিয়ার মালিক যিনি আকিকোকে ভাগ্য গণনাকারী হিসেবে নিয়োগ দেন। আকিকো একজন মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত একজন মানুষ যিনি প্রায় সময়ই তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকেন, অশ্লীল নৃত্য করেন এবং প্রেতাত্মাদের সাথে যোগযোগ রক্ষা করেন। বাবার মৃত্যুর পর বেক্কাহ তার অসুস্থ মায়ের সাথে বিগ আইল্যানেড চলে আসে এবং পরিকল্পনা ছিল যে, কোরিয়ায় ফিরে আসবে যা আর কখনও হয়নি। বেক্কাহ বড় হচেছ এবং আশা করে ছিল যে, তা মা সুস্থ হবেন, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেন। কিন্তু মা তা হলেন না, হলেন অসুস্থ , তার মুত্যু শয্যায় বসে মেয়েকে অনেক গোপন কথা বলেছেন। বলেছেন তাঁর ফেলে আসা জীবনের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি যখন শিশু ছিলেন তখন তার বাবা মা মারা যান। তার বোনের বিয়ের যৌতুকের জন্য তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয় জাপানিদের কাছে। তারপরেই তাকে জাপানিদের বিনোদন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মেয়েদেরকে সেই ক্যাম্পে পতিতা হিসেবে পাঠানো হয় যাদেরকে জাপানি সেনারা ব্যবহার করতো। শিশু বলে প্রথমে আকিকোকে অন্যান্য যৌনদাসীদের কক্ষ পরিষ্কার করতে দেওয়া হয়। এখানকার মেয়েদের সব ধরনের পরিচয় মুছে ফেলা হতো, তাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হতো।যে স্টলে/রুমে থাকতো সেই অনুযায়ী তাদের নাম দেওয়া হতো পূর্বের নাম বাদ দিয়ে। এক নারী এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করায়, কথা বলায় তাকে হত্যা করা হলো অন্যদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য।আকিকোকে তার জায়গায় বসানো হলো।তার নাম ‘সুন হাইও’ থেকে নাম হলো আকিকো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু আগে থেকেই অর্থাৎ ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কমফোর্ট উইমেন কালচার গড়ে তোলে জাপানি সেনাবাহিনী। যেসব কারনে তারা ’কমফোর্ট উইমেন’প্রথা গড়ে তুলেছিলেন সেগুলোকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।

প্রথমত, জাপানি সেনা কর্তৃপক্ষ সেনাদের দ্বারা ধর্ষন বন্ধ করতে চেয়েছিল কারন সেনাদের দ্বারা অবিরত ধর্ষনের ঘটনা ঘটছিল যা বিজিত ও দখলকৃত অঞ্চলগুলোতে জাপানি সেনাবাহিনী সম্পর্কে মারাত্মক নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করছিল। তবে, ধর্ষণের চেয়ে এই প্রথা হচেছ এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত যৌন অত্যাচার, আর এই প্রথা চালূ করার পরেও তাদের দ্বারা ধর্ষণ কমেনি।

দ্বিতীয় কারণ ছিল, সেনাসদস্য ও সেনাকর্মকর্তাদের মনে প্রশান্তি নিয়ে আসা। কঠিন যুদ্ধের সময় সেনা কর্তৃপক্ষ ভেবেছিল যে, সেনাদের মনোরঞ্জন , বিনোদনে ও মনকে আনন্দ দেওয়ার জন্য নারী সম্ভোগ প্রয়োজন। সেনাসদস্য ও সেনা কর্মকর্তারা যদি নিজেদের সেনা ছাউনিতে ও ক্যাম্পে নারী ভোগ করতে পারে তাহলে তারা মনোযোগ দিয়ে যুদ্ধ করতে পারবে এবং যুদ্ধক্ষেত্র সহজে ছাড়তে চাবেনা। অনেকদিন যুদ্ধক্ষেত্রে থাকতে চাবে। কমফোর্ট উইমেন প্রথা গড়ে তোলার আর একটি কারণ ছিল যৌনবাহিত রোগ বেশিদুর না ছড়ানোর জন্য। উল্টোপাল্টা ও অবাধ যৌনচার যে বিভিন্ন যৌনরোগের কারন তাতে সন্দেহ নেই। তারা অনেকে আক্রান্তও হয়েছিলো। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তা বেশিদূর ছড়াতে দিতে চায়নি, নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছে নির্দিস্ট এরিয়াতে। এর আর একটি কারণ ছিল, সামরিক তথ্য গোপান রাখার ব্যবস্থা করা ও গুপ্তচরবৃত্তিকে রোধ করা। সেনারা বাইরে যাবেনা, বাইর থেকে কেউ আসা যাওয়া করবে না। জাপানি নারীরা ক্যাম্পে আটকা থাকবে, তাহলে গুপ্তচরবৃত্তি সহসা ঘটবে না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি সেনারা আক্রান্ত অঞ্চরে খাবার, জ্বালানী, অন্যান্য দ্রব্যের সাথে নারীদেরও লুট করে নিয়ে আসতো এবং তাদের র্ধষন করতো। অধিকৃত কোরিয়া ও চীনে তার এসব ঘটনা ঘটাতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে নারীব্যবসায়ী দালালরাও তাদের ব্যবসা কোরিয়ার দিকে নিয়ে আসে। তারা বিভিন্ন ছল-ছাতুরীর মাধ্যমে কোরিয়ার সব বয়সী নারীদের ‘কমফোর্ট উইমেনে’ রূপান্তারিত করে মূলত জাপানি সেনাদের মনোরঞ্জনের জন্য। ‘কমফোর্ট উইমেন’ প্রথার মাধ্যমে ৮০০০০ থেকে ২০০০০০ নারীদের আটকে রাখা হয়েছিল, তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশই কোরিয়ান নারী। কোন কোন সূত্রে এই সংখ্যা ৪১০০০০ পর্যন্ত পৌঁছেছিল।আবার কোন কোন কমফোর্ট স্টেশনের ম্যানেজার খুব চালাক ছিল, তারা কেউ কেউ করে এখাকার নারীদের বনভোজনে নিয়ে যেত, মাঝে মাঝে খেলাধুলা করতে দিত যাতে অন্যরা বুঝে যে, তারা বিনোদন ক্যাম্পে বেশ অভিজাত জীবন যাপন করছে।

কমফোর্ট উইমেন দলে থাকা বিভিন্ন নারী বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। এক নারী বলেন, “একজন সেনা হিসেবে থাকা এবং যুদ্ধে মারা যাওয়া কমফোর্ট উউমেন হিসেবে বেঁচে থাকার চেয়ে ঢের উত্তম।’’ কারণ একজন কমফোর্ট উউমেনকে সারা জীবন শরীরিক, মানসিক ও সামাজিক যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়।

অন্য এক নারী বলেছেন, তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ক্যাম্পে। কিছুক্ষন পর তাকে এক অফিসারের রুমে নিয়ে যাওয়া হয়, যে রুম শুধুমাত্র একটি পর্দা দিয়ে অন্য রুম থেকে আলাদা করা হয়েছে। অফিসার তাকে ন্যাংটা হয়ে যেতে বললো। সে উলঙ্গ হতে রাজী হয়নি বলে তাকে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে উলঙ্গ করে ফেলা হলো। তারপর শুরু হলো ধর্ষন।” আর এক নারী বলেছেন, ‘মাউন্ট ইয়াংম ওপর জাপানি সোনরা থাকতো। তাদের মধ্যে দুই তিনজন প্রতিদিন তার বাসায় ঢুকে ধর্ষন করতো। তার পালানোর কোন পথ ছিলনা যাদিও অসহ্য যন্ত্রনায় তার সময় কাটতোম। মাঝে মাঝে পাহাড়ের ওপরে নিয়ে তাকে ধর্ষণ করতো।

কেউ কেউ বলছে ধর্ষণ করার পর তাদের যৌনাঙ্গ ছিড়ে গেছে প্রচন্ড যন্ত্রণায় কাতরাচেছ। ডাক্তার এসে ঔষধ দিয়ে বলেছেন যে, সাত দিনের মধ্যে সেড়ে যাবে। কিন্তু অবাক কান্ড তার পর পরই আবার সেনারা এসে তাকে ধর্ষন শুরু করেছে, তীব্র যন্ত্রনায় চিৎকার করে আর না করার জন্য যতই অনুরোধ করে ওরা তাকে শারীরিক শাস্তি দিতে থাকে, পেটাতে থাকে। বুভুক্ষু পশুর দল এভাবেই তাদের যৌনকামনা মেটাতো। এটি সব যুদ্ধেরই অচিচেছদ্য অংশ। তাই ইদানিং জাপানি সরকার ‘কমফোর্ট উইমেন’ কালচার যে, তাদের সৃষ্টি তা স্বীকার করছেনা। সরকারের কোন সম্মতি ছিলনা কিন্তু যুদ্ধ ও যৌন ক্ষুথার্ত সেনাবাহিনীর ক্ষুধা মেটানোর যে এই পথই খোলা থাকে তা যুদ্ধ ঘোষণা করা সরকারগুলো কেন যেন এড়িয়ে যেতে চায়।

কোন কোন নারী বলেছেন, ষাট বছর পার হয়ে যাওয়ার পরেও তাদেও যৌনাঙ্গে তারা যন্ত্রণা অনুভব করে। অনেকেই তাই ছাড়া পাওয়ার পরেও আর বিয়ে করেনি। এক মেয়ে বলেছে তাকে ক্যাম্পে নিয়ে এক যন্ত্র দিয়ে তার দু পা ফাঁক করা হয়েছে কিন্তু কম বয়সী বলে যৌনাঙ্গে পুরুষাঙ্গ ঢুকাতে না পের ক্যাম্প প্রধান তাকে সর্বক্ষণই পেটাতো, শারীরিক শাস্তি দিত। যখন তার বয়স বেড়ে গেল, কিছুদিন পর যখন ঢোকাতে পারতো তখন সে পেটানো তেকে বেচে গেছে ঠিকই কিন্তু যৌনাঙ্গের ওপর অসহ্য চাপ কারন একের পর এক পশু এসে তাদের বীর্য ঢালতো । যুদ্ভের পর ’বিনোদন ক্যাম্পে’ আটকে থাকা অনেক নারী তাদের নিজেদের বাড়িতেও ফিরে যায়নি ঘৃণা, ক্ষোভ, লজ্জা আর অপমানে। এভাবে নিজ জন্মভূমিতে অনেকেই ফেরত যায়নি, অনেকে আত্মহত্যা করেছে। ৪১০০০০ পর্যন্ত নারীদেরকে তারা ১২৫টি বিনোদন ক্যাম্পে আটকে রেখেছিল। জানা যায যে, জাপানি সেনারা প্রতি ৭০ জনের জন্য একজন করে যৌনদাসী চেয়েছিল তাদের সরকারের কাছে। বর্তমানে বেঁচে থাকা ৯০ বছর বয়সী এ নারী বলেন,‘‘ আমি তাদেরকে আনন্দ দিতে চাইনি। তারা জোরপূর্বক আমার দেহকে ভোগ করেছে, আমাকে অত্যাচার করেছে যা আমি কোনদিন ভুলব না।’’

 যুদ্ধ শেষে সুন হাইও পিয়ং ইয়ংএ চলে আসেন, সেখানে সে আমেরিকান মিশনারিকে বিয়ে করেন যিনি তার অভিষপ্ত জাপানি নামটিই জানেন, জানতেন না তার আসল নাম। তাকে নিয়ে আমেরিকায় চলে যান এবং একটি কন্যাসন্তব প্রসব করেন আকিকো। মিশনারি স্বামী মারা যাওয়ার পর আকিকো হাওয়াই দ্বীপে আটকা পড়েন, হাতে কোন অর্থ নেই আছে পাঁচ বছরের কন্যা বেক্কাহ।

বেক্কাহ তার মায়ের অভিষপ্ত ও মানসিক বৈকল্যে ভরা শিশুকাল সম্পর্কে জানেনা। তবে সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অকিকোর ভয়ংকর ও বিরক্তিকর বাধন থেকে মুক্তি পাওয়ার। আকিকোর মৃত্যুর পর যখন বেক্কার বয়স ৩০এর মতো তখন সে মায়ের জীবনের গোপন অধ্যায় জানতে পারে। এভাবে এক কোরিয়ান নারীর মনস্তাত্তিক জটিলতা এবং আমেরিকায় জন্ম নেয়া কন্যার সাথে মায়ের যে, অদ্ভুত সম্পর্ক তার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে উপন্যাসটিতে। আকিকোর ২০ বছরের যৌনদাসত্বের জীবন যেখানে প্রতিদিন এক ডজন জাপানি তাকে ধর্ষন করতো , পাঠক এটি ছাড়াও কোরিয়া থেকে হাওয়াই ভ্রমণ করেন উপন্যাসটি পাঠের মাধ্যমে। এটি পড়ার সময় পাঠকের বিরক্তি ধরে শুধু মৃত্যু আর বিভীষিকাময় পরিস্থিতির বর্ণনা পড়তে পড়তে।

বেক্কার বাবা অর্থাৎ আমেরিকান মিশনারি মারা যান ৫ বছর বয়সে, তারও ৫ বছর পর যখন তার মৃত্যুাবার্ষিকী পালন করা হচিছলে তার প্রিয় খাবার শ্রিম্প (চিংড়ি মাছ) দিয়ে প্রসাদ তৈরি করে, আকিকো তখন তার মেয়ের কাছে প্রকাশ করেন যে, তিনিই তার বাবাকে হত্য করেছেন। এই কথা শুনে বেক্কাহ শুনে অবাক হয় এবং ভয়ও পায়। সেও তার মায়ের প্রতি বিরক্ত তার অস্বাভাবিক আচরণের জন্য এবং অবচেতন মনে তার মৃত্যুও চাচ্ছিলো। আকিকোর অস্বাভাবিক আচরণের কিছু চিত্র হচেছ–

আকিকো ছোট্ট মেয়েকে সতর্ক করে দেন এই বলে যে, সাজা হচেছ মৃত্যুর সংবাদবাহক। মধ্যরাতে শিশু যখন চিৎকার করে কেঁদে ওঠে, তখন সাজা তার পেছনে আছে এই বলে ভয় দেখাতেন। আর তখন তিনি একটি জবাই করা মুরগী খপ করে আকড়ে ধরে মেয়ের রাতের পোশাক ছিড়েঁ ফেলতেন সেই পোশাকের টুকরো দিয়ে জবাই করা মুরগীটিকে আবৃত করে ফেলেন এবং পরক্ষণেই রক্তমাখা সেগুলো দরজা দিয়ে বাইরে ফেলে দেন ক্ষুধার্ত শয়তানদের বোকা বানানোর জন্য।বেক্কা যখন বড়হ য় তখন তার কাছে তার মায়ের অদ্ভুত বিশ্বাস ও আচরণগুলোকে বিভ্রান্তিকর মনে হতো। তার মা রেড ডিস্যাস্টার বলে যা বুঝাতেন তার সাথে বেক্কা মিল খুঁজে পায় তার স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের ক্লাসে ব্যাকটেরিয়ার কথা জেনে। ব্যাকটেরিয়া আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ায় অথচ আমরা তাদের দেখতে পাইনা, অদৃশ্য ব্যাকটেরিয়া।তার মা সম্ভবত সেগুলোকেই রেড ডিসঅ্যাস্টার বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। অ্যাপার্টমেন্টের লাল বস্তুগুলো পুড়িয়ে ফেলা আকিকোর কাছে বেক্কার হাত ধুয়ে ফেলার মতো মনে হতো। আকিকোর এই অস্বাভাবিক আচরণ স্থানীয় পানশালার মালিকের দৃষ্টি এড়ায়নি। তিনি এটিকে অর্থনৈতিকভাবে কাজে লাগালেন। তিনি এটি আকিকোর দ্বৈবশক্তির অধিকারী বলে স্বীকৃতি দিলেন।তাই তাকে স্পিরিচুয়াল উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিলেন এবং দূর দুরান্ত থেকে মানুষ তার কাছে উপদেশ নেয়ার জন্য ভীড় জমাতো।

যুদ্ধ মানব সভ্যতার জন্য এক বিরাট অভিষাপ। যুদ্ধ মানে ধ্বংস। এই ধবংস শুধু ধন সম্পদ ধ্বংস নয়, এটি মানবতার চরম পরাজয়। মানবজাতি কেন এই ধ্বংস ডেকে আনে? আজকের সভ্য জাপান তার অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েছে। হিরোসীমা ও নাগাসাকীতে অ্যাটম বোমা নিক্ষেপের পর যে ধ্বংসস্তুপ তৈরি হয়েছিল, তার পর থেকেই জাপান তার আগ্রাসী ভূমিকা থেকে সরে এসে দেশ গড়ার, শিক্ষা ও জ্ঞান বিজ্ঞানে এগিয়ে যাওয়ার শপথ গ্রহন করে।কিন্তু জাপানি সেনাকর্তৃক লক্ষ লক্ষ কোরিয়ান ও চীনা নারীদের যে যৌনদাসী হিসেবে ‘কমফোর্ট ক্যাম্প’ আটকে রেখে দিনের পর দিন বছরের পর বছর অমানবিক নির্যতন করা হতো তারই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে’ নোরা ওকজা কেলারে’র উপন্যাস’ কমফোর্ট উইমেন’এ।