ইসমে আজম: মনোবাসনা পূরণের শ্রেষ্ঠতম অবলম্বন
- প্রকাশ: ১০:৪৩:১০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৫ নভেম্বর ২০২২
- / ১৫৪৭ বার পড়া হয়েছে
‘ইসম’ শব্দের অর্থ হলো নাম। আর ‘আজম’ শব্দের অর্থ হলো মহান। মহান আল্লাহর মর্যাদাসম্পন্ন নামগুলোকেই ‘ইসমে আজম’ বলা হয়। আল্লাহর অসংখ্য গুণবাচক নাম রয়েছে। এগুলোকে একত্রে ‘আল আসমাউল হুসনা’ বলা হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর আল্লাহর জন্য রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম। অতএব তোমরা তাকে সেই সব নামেই ডাকো।’ (সুরা আরাফ : ১৮০)। আল্লাহ তায়ালার গুণবাচক নামের সংখ্যা অসংখ্য। হাদিসে আল্লাহর ৯৯টি নামের কথা বলা হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালার নিরানব্বই- এক কম একশ’টি নাম রয়েছে। যে ব্যক্তি এ নামগুলো মুখস্থ করবে, সে জান্নাতে যাবে। (বোখারি : ২৭৩৬, ৭৩৯২; মুসলিম : ২৬৭৭)।
মূলত আল্লাহতায়ালার যে নামগুলোর মাধ্যমে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও বড়ত্ব সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত হয়, সে নামগুলোই হলো ইসমে আজম। ইসমে আজমের মাধ্যমে দোয়া করলে আল্লাহতায়ালা কবুল করেন, বান্দার যে কোনো কিছুর চাওয়া আল্লাহতায়ালা পূরণ করেন এবং যে কোনো বিপদাপদ দূরীভূত করেন। ইসমে আজম বারবার স্মরণ করলে আত্মা প্রশান্ত হয়, মানসিক বিষণ্নতা দূরীভূত হয় এবং সওয়াব লাভ করা যায়। এমনকি এই ইসম স্মরণ করলে অনেক অসাধ্য সাধন হয়। আল্লাহতায়ালার ওই নামগুলোর মধ্যে কোনটি ইসমে আজম সে সম্পর্কে কয়েকটি হাদিসে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা রয়েছে। ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ুতি (রহ.) তার রচিত ‘আদণ্ডদুররুল মুনাজ্জাম ফিল ইসমিল আজম’ নামক গ্রন্থে ইসমে আজমের ব্যাপারে ২০টি মতামত উল্লেখ করেছেন। সুনানে ইবনে মাজাহতে বর্ণিত হয়েছে, কাসিম (রহ.) বলেন, আল্লাহর ইসমে আজম হলো যার মাধ্যমে দোয়া করলে তা কবুল হয়, তা তিনটি সুরায় রয়েছে। সুরা বাকারা, সুরা আল ইমরান ও সুরা তাহা। (ইবনে মাজাহ : ৩৮৫৬)।
অপর বর্ণনায় রয়েছে, তিনি বলেন, ইসমে আজম তিন সুরার নিম্নোক্ত তিনটি আয়াতে আছে। তা হলো- ১. সুরা বাকারার ২৫৫ নং আয়াত তথা আয়াতুল কুরসিতে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোনো সত্যিকার মাবুদ নেই। তিনি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী, ২. সুরা আলে ইমরানের প্রথম দুই আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, আলিফ, লাম, মিম। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোনো সত্যিকার মাবুদ নেই। তিনি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী, ৩. সুরা ত্বহার ১১১ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, চিরঞ্জীব চিরস্থায়ীর সম্মুখে সবাই হবে অধোমুখী। (আল মুসতাদরাক আলা সহীহায়ন, ১/৫০৬)।
ইসমে আজমের ফজিলত
আল্লাহর গুণবাচক নামগুলোর মাধ্যমে তার পরিচয় ও ক্ষমতার প্রকাশ ঘটে। মানুষ আল্লাহর নানা গুণাবলি সম্পর্কে জানতে পারে। তা মানুষকে উত্তম চরিত্রবান হতে অনুপ্রাণিত করে। প্রিয় নবীজি (সা.) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামরা আল্লাহতায়ালার বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব জ্ঞাপক নামগুলোর মাধ্যমে আল্লাহতায়ালাকে ডাকতেন। ইমাম আবু জাফর তাবারি (রহ.) ও আবুল হাসান আশআরী (রহ.) বলেন, আল্লাহতায়ালার প্রতিটি গুণবাচক নামই ইসমে আজমের অন্তর্ভুক্ত। একদা প্রিয় নবীজি (সা.) একজন লোকের কাছ দিয়ে গেলেন। সে বলছিল- ‘ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকরাম’ অর্থাৎ, হে মহিমাময় ও মহানুভব।
নবীজি (সা.) বললেন, এসব শব্দ দিয়ে দোয়া করার দরুন তোমার জন্য আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্যতার দরজা খুলে গেছে। এখন তুমি যা ইচ্ছা তার কাছে চেয়ে নাও। (কানযুল উম্মাল- পৃ:১/২৯২)। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে বসা ছিলাম, তখন এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছিল। যখন সে রুকুণ্ডসিজদা এবং তাশাহ্হুদ পড়ে দোয়া করতে শুরু করল তখন সে তার দোয়াতে বলল, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা বিআন্না লাকাল হামদা লা-ইলা-হা ইল্লা আনতাল মান্নানু বাদী’উস সামা-ওয়া-তি ওয়াল আরদি, ইয়া-যাল জালালি ওয়াল ইকরাম ইয়া-হাইয়ু ইয়া-কইয়ুম ইন্নি আসআআলুকা।’ ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করছি এই ওয়াসিলায় যে, সব প্রশংসা তোমারই, তুমি ব্যতীত কোনো সত্য উপাস্য নেই। তুমি পরম অনুগ্রহদাতা, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা। হে মহিমাময় এবং মহানুভব, হে চিরঞ্জীব অবিনশ্বর! আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করছি।’ (নাসাঈ : ১৩০০, তিরমিজি : ৩৫৪৪)। হজরত আবদুল্লাহ ইবন বুরায়দা (রহ.) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে এরূপ দোয়া করতে শোনেন, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা বিআন্নি আশহাদু আন্নাকা আনতাল্লাহ, লা-ইলাহা ইল্লা আনতা, আল আহাদুস সামাদ, আল্লাজি লাম ইয়ালিদ ওয়া লাম ইউলাদ ওয়ালাম ইয়া কুল্লাহু কুফুওয়ান আহাদ।’ ‘ইয়া আল্লাহ্?!
আমি তোমার কাচে প্রার্থনা করছি এবং আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, তুমিই আল্লাহ? এবং তুমি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তুমি একক এবং অমুখাপেক্ষী যার কোনো সন্তান নেই এবং যিনি কারও সন্তান নন, যার সমকক্ষ কেউই নেই।’ তখন তিনি বলেন, তুমিই আল্লাহ?র কাছে তাঁর নাম ধরে প্রার্থনা করেছ, যখন এরূপে কেউ চাইলে তখন আল্লাহ? তা প্রদান করেন এবং এরূপে দোয়া করলে তিনি তা কবুল করে থাকেন। (আবু দাউদ : ১৪৯৩)। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) বলেন, (ইসমে আজমের) যতগুলো বর্ণিত হাদিস রয়েছে তন্মধ্যে এটি সবচেয়ে বিশুদ্ধ। একাধিক সহিহ হাদিসে এসেছে, ইসমে আজম হলো- ‘আল্লা-হুম্মা ইন্নি আস-আলুকা বি-আন্না লাকাল হা’মদু লা-ইলা-হা ইল্লা-আনতা ওয়াহ’দাকা লা-শারীকা লাকাল মান্না-ন, ইয়া বাদীআ’স্ সামা-ওয়া-তি ওয়াল-আরদ্বি, ইয়া যাল জালা-লি ওয়াল-ইকরা-ম। ইয়া হা’ইয়্যু ইয়া ক্বাইয়্যুম, ইন্নি আসআলুকাল্ জান্নাতা ওয়া আউ’যু বিকা মিনান্না-র।’ ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করি কারণ, সব প্রশংসা আপনার জন্য, শুধু আপনি ছাড়া আর কোনো সত্য ইলাহ নেই, আপনার কোনো শরিক নেই, আপনি সীমাহীন অনুগ্রহকারী। হে আসমান ও জমিনের অভিনব স্রষ্টা! হে মহিমাময় ও মহানুভব! হে চিরঞ্জীব, হে চিরস্থায়ী-সর্বসত্তার ধারক! আমি আপনার কাছে জান্নাত চাই এবং জাহান্নাম থেকে আশ্রয় চাই।
আসমা বিনতে ইয়াযীদ (রা.) সূত্রে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেছেন, ইসমে আজম এ দুটি আয়াতে রয়েছে- (এক) তোমাদের ইলাহ একমাত্র ইলাহ, তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি অতি দয়ালু মেহেরবান (সুরা আল-বাক্বারাহ : ১৬৩)। (দুই) সুরা আলে ইমরানের প্রথমাংশ, আলিফ-লামণ্ডমিম, তিনিই সেই আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী। (আবু দাউদণ্ড১৪৯৬)। ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) বলেন, আমি ইমাম আবু হানিফা (রহ.) থেকে শুনেছি, আল্লাহতায়ালার ইসমে আজম হলো, ‘আল্লাহ’ (জাল্লাজালালুহু)। কেননা, এটি তাঁর সত্তাগত নাম। কোরআন মজিদে এই নামটিই ২ হাজার ৬৯৭ বার এসেছে। আসমাউল হুসনার মধ্যে তাঁর অন্য কোনো নাম এত বেশি উল্লেখ হয়নি।
হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) বলেন, ‘ইসমে আজম’ হলো ‘আল্লাহ’ (জাল্লাজালালুহু)। তবে শর্ত হলো, তা পূর্ণ একাগ্রতা ও এখলাসের সঙ্গে বলতে হবে।’ (মিরকাতুল মাফাতিহ : ১/৬)।
হজরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহতায়ালার নামগুলোর মধ্যে ইসমে আজম হলো ‘আল্লাহ’ (জাল্লাজালালুহু)। কেননা, আল্লাহতায়ালা কী বলেছেন তা আপনি শুনেননি? তিনি বলেন, ‘তিনিই আল্লাহ, যিনি ব্যতীত কোনো (সত্য) উপাস্য নেই, তিনি অদৃশ্য এবং দৃশ্যের পরিজ্ঞাতা, তিনিই অতি দয়াময়, পরম দয়ালু।’ (সুরা হাশর : ২২)।