মঙ্গলবার, অক্টোবর ৩, ২০২৩

মেনোপজ ও আর্লি মেনোপজ কী? মেনোপজের কারণ, লক্ষণ ও ঝুঁকি কী কী?

মেনোপজের সময় আকস্মিকভাবে আগুনের হল্কার মতন শরীরে গরম অনুভূত হওয়া, রাতের বেলায় ঘাম হওয়া, ঘুম না হওয়া, দুশ্চিন্তা হওয়া, মনমরা ভাব এবং যৌনতায় বা মিলনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলার ঘটনা অতি সাধারণ।

For all latest articles, follow on Google News

মেনোপজ (Menopause) নারীর শরীরে তা আরও নানাবিধ প্রভাব তৈরি করে। মেনোপজ একটি স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া। সাধারণত ৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সে নারীদের পিরিয়ড বন্ধ হয়ে আসার ঘটনা ঘটে। তবে, অপারেশন করে কোনো নারী যদি তার দুটো ওভারি অথবা জরায়ু ফেলে দেয় তাহলেও পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যায়। নারীদের মেনোপজ হওয়ার গড় বয়স ৫১ বছর।

মেনোপজ কী?

মাসিক বা  ঋতুস্রাব নারী দেহের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর ঋতুচক্র স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়, একেই মেনোপজ বলে। মেনোপজের জন্য বয়সসীমা আনুমানিক ৪৫ থেকে ৫৫ বছর। যদি কারো ১২ মাসের বেশি সময় ধরে ঋতুস্রাব/মাসিক বন্ধ থাকে তাহলেই ধরে নিতে হবে এটি মেনোপজ। মেনোপজে নারীর ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বকোষ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় নারীদেহে বিভিন্ন প্রজননের হরমোন কমে যায় এবং তার নানানরকমের প্রভাব পড়ে নারীদের শরীরে। 

মেনোপজের সময় আকস্মিকভাবে আগুনের হল্কার মতন শরীরে গরম অনুভূত হওয়া, রাতের বেলায় ঘাম হওয়া, ঘুম না হওয়া, দুশ্চিন্তা হওয়া, মনমরা ভাব এবং যৌনতায় বা মিলনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলার ঘটনা অতি সাধারণ।
মেনোপজের সময় আকস্মিকভাবে আগুনের হল্কার মতন শরীরে গরম অনুভূত হওয়া, রাতের বেলায় ঘাম হওয়া, ঘুম না হওয়া, দুশ্চিন্তা হওয়া, মনমরা ভাব এবং যৌনতায় বা মিলনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলার ঘটনা অতি সাধারণ।

মেনোপজ: শরীরের এই বদলের পেছনে কারণ কী?

নারীদের শরীরে মেনোপজ হওয়ার পেছনে মূল কারণ ইস্ট্রোজেন নামের একটি হরমোন। এই হরমোন নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য চক্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারীদের ওভারি বা ডিম্বাশয়ে প্রতিমাসে যে ডিম্ব উৎপাদন হয় এবং সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য নারীর শরীর যেভাবে প্রস্তুত হয় তার পেছনেও রয়েছে এই হরমোনের ভূমিকা। নারীদের শরীরে এই পরিবর্তনের মূল কারণ ইস্ট্রোজেন নামের একটি হরমোন।

কিন্তু বয়স হতে থাকলে নারীদের শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের উৎপাদন কমে যেতে থাকে। এই হরমোনই প্রজননের পুরো প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। তাই বয়স হতে থাকলে নারীদের ডিম্বাশয়ে ডিম্বের পরিমাণও কমতে থাকে। পিরিয়ডের পরিমাণ কমতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় জন্ম দেওয়ার প্রক্রিয়াও বন্ধ হয়ে যায়।

হরমোনে বদলে মেনোপজ হলে নারীর শরীরে এর কী প্রভাব পড়ে?

হরমোন বদলের ফলে সৃষ্ট মেনোপজ নারীর শরীরে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। মেনোপজের পর শরীর অদ্ভুত সব আচরণ শুরু করে। অবশ্য পরিবর্তনটা দেখা যায় মেনোপজ শুরু হবার আরও আগে থেকেই। এই স্তরটিকে তাই বলা হয় প্রি-মেনোপজ।

মেনোপজের সময় আকস্মিকভাবে আগুনের হল্কার মতন শরীরে গরম অনুভূত হওয়া, রাতের বেলায় ঘাম হওয়া, ঘুম না হওয়া, দুশ্চিন্তা হওয়া, মনমরা ভাব এবং যৌনতায় বা মিলনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলার ঘটনা অতি সাধারণ। এছাড়া মূত্রথলিতে সমস্যা এবং যোনিপথ শুষ্ক হয়ে যাওয়ার ঘটনাও খুব স্বাভাবিক।

আর ইস্ট্রোজেন হরমোনের উৎপাদন যখন শরীরে একেবার বন্ধ হয়ে যায় এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়ে নারীদের হাড় ও হৃদপিণ্ডের উপরে। তবে যদি থেরাপির মাধ্যমে এই হরমোন প্রতিস্থাপন করা যায় এবং শরীরে এই ইস্ট্রোজেন হরমোনের পরিমাণ ঠিক রাখা যায় তাহলে শরীরে এর নেতিবাচক প্রভাব কিছু কমানো সম্ভব।

মেনোপজ হলে কেন অতিরিক্ত গরম লাগে?

ইস্ট্রোজেন হরমোনের অভাবে এরকম অনুভূতি হয়। এটি মানুষের ব্রেইন বা মস্তিষ্কের সাথে সম্পৃক্ত। সাধারণত তাপমাত্রার পরিবর্তন হলে শরীর সেটির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়। কিন্তু যখন ইস্ট্রোজেন হরমোন কমে যায়, মানবদেহের থার্মোস্টেট বা তাপমাত্রা বোধের বিষয়টি এলোমেলো বা দুর্বল হয়ে যায়। ফলে, অনেক সময় মস্তিষ্ক মনে করে শরীরে অতিমাত্রায় গরম লাগছে। ইস্ট্রোজেন হরমোনের কারণে মানুষের মুড বা মেজাজের উপরেও প্রভাব পড়ে। এই হরমোনের পরিমাণ কমে গেলে দুশ্চিন্তা বাড়তে পারে ও মনমরা ভাব হতে পারে।

এছাড়া ইস্ট্রোজেন হরমোনের অভাব ত্বকের উপরও প্রভাব ফেলে। ত্বক শুষ্ক হয়ে যায় এবং মনে হয় যেন ত্বকের নিচে পোকা-মাকড় হাঁটাহাঁটি করছে। ইস্ট্রোজেন হরমোনের সাথে অন্য আরও হরমোন সম্পৃক্ত। যেমন প্রোজেস্টেরোন ও টেস্টোস্টেরোন। তবে, ইস্ট্রোজেন হরমোনের মতন এগুলোর প্রভাব এতোটা তীব্র নয়। 

মেনোপজের লক্ষণ কী?

কেউ মেনোপজের উপসর্গে ভুগছে কিনা সেটি জানার জন্য রক্ত পরীক্ষা করা যেতে পারে। তবে, সবসময় যে পরীক্ষার ফল খুব নির্ভুল হবে এমন নয়। তবে, কোনও ডাক্তারের সাথে আলাপ করে একজন নারী যে সব লক্ষণগুলো তার শরীরে দেখছেন সেগুলো জানানো যেতে পারে। মেনোপজের পর ইস্ট্রোজেন হরমোন শরীরে আর পুনরুৎপাদন হয় না। ফলে, মেনোপজের পর ইস্ট্রোজেন হরমোনের অভাব নিয়েই জীবনের বাকিটা সময় কাটাতে হয়।

মেনোপজের লক্ষণ কী

প্রতিটি নারীর মেনোপজের অভিজ্ঞতা আলাদা। তবে এর লক্ষণগুলো গুরুতর হতে পারে যদি মেনোপজ হঠাৎ বা অল্প সময়ের মধ্যে ঘটে। ক্যান্সার, হিস্টেরেক্টমি (জরায়ু ফেলে দেওয়ার অপারেশন), ধূমপানের ইতিহাস ডিম্বাশয়ের জন্য ক্ষতিকর যার ফলে, লক্ষণগুলোর তীব্রতা এবং সময়কাল বৃদ্ধি করে।

মেনোপজের লক্ষণ কী

মেনোপজের সময় নারীর পরিবর্তনগুলো একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম এবং সব লক্ষণ সবার প্রকাশ নাও পেতে পারে। লক্ষণগুলো হলো:

  • যৌন অনুভূতি বা ইচ্ছা না হওয়া
  • যোনিপথ শুষ্ক হয়ে যাওয়া
  • প্রস্রাবে নিয়ন্ত্রণ না থাকা
  • প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া এবং মূত্রনালির সংক্রমণ (ইউটিআই)
  • ঘুমের সমস্যা হওয়া
  • মাথাব্যথা
  • হঠাৎ গরম লাগা
  • রাতে ঘাম হওয়া 
  • ত্বক, মুখ এবং চোখ শুষ্ক হয়ে যাওয়া
  • কালশিটে বা কোমল স্তন
  • বুক ধড়ফড়ানি
  • পেশি ভর হ্রাস
  • হাড়ের ভর হ্রাস
  • গিরায় গিরায় ব্যথা বা শক্ত হয়ে যাওয়া
  • চুল পাতলা হওয়া
  • মুখ, ঘাড়, বুক এবং পিঠের ওপরের অংশে চুল বৃদ্ধি পাওয়া
  • বিষণ্ণতা
  • উদ্বেগ
  • মেজাজি হয়ে যাওয়া
  • মনোনিবেশ করতে অসুবিধা
  • কিছু মনে না থাকা বা স্মৃতি সমস্যা

বেশিরভাগ নারীদের ক্ষেত্রে জীবনের সর্বশেষ মাসিকের প্রায় চার বছর আগে থেকেই মেনোপজের লক্ষণগুলো শুরু হয়। একজন নারীর শেষ মাসিকের প্রায় চার বছর পর পর্যন্ত লক্ষণগুলো প্রায়ই চলতে থাকে।

সময়ের আগেই মেনোপজ বা আর্লি মেনোপজ কী?

পিরিয়ড বন্ধ হওয়ার বয়সে পৌঁছানোর আগেই মেনোপজকে বলে  আর্লি মেনোপজ। সব নারীর জীবনে মেনোপজ বা ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়মমাফিক নাও আসতে পারে।  সাধারণত ৪৫ বছর বয়সের আগে, আনুমানিক ৪০ বছরের দিকে আর্লি  মেনোপজ হয়। আপনার ডিম্বাশয়ের ক্ষতি করে বা ইস্ট্রোজেন উৎপাদন বন্ধ করে এমন যে-কোনো কিছু প্রাথমিক মেনোপজের কারণ হতে পারে।

বেশিরভাগ নারীদের ক্ষেত্রে জীবনের সর্বশেষ মাসিকের প্রায় চার বছর আগে থেকেই মেনোপজের লক্ষণগুলো শুরু হয়।
বেশিরভাগ নারীদের ক্ষেত্রে জীবনের সর্বশেষ মাসিকের প্রায় চার বছর আগে থেকেই মেনোপজের লক্ষণগুলো শুরু হয়।

আর্লি মেনোপজের লক্ষণগুলো কী কী?

আর্লি মেনোপজের সাধারণ কিছু লক্ষণ হলো—

  • খুব বেশি পরিমাণে রক্ত যাওয়া
  • পিরিয়ড ছাড়াই কাপড়ে ছোপ ছোপ রক্ত
  • পিরিয়ড এক সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হওয়া
  • দুটি পিরিয়ডের মধ্যে দীর্ঘ সময় বিরতি

এছাড়াও, মেনোপজের অন্যান্য সাধারণ লক্ষণ যেমন মেজাজ পরিবর্তন, যৌন আকাঙ্ক্ষায় পরিবর্তন, যোনিতে শুষ্কতা, ঘুমের সমস্যা, হঠাৎ গরম লাগা, রাতের ঘাম, প্রস্রাবের নিয়ন্ত্রণ হারানোর মতো আরো বেশ কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা প্রয়োজন।

আর্লি মেনোপজ কি অন্যান্য রোগের ঝুকি তৈরি করে?

স্বাভাবিক সময়ের দশ বছর আগে যদি মেনোপজ শুরু হয় তবে সেটি অবশ্যই চিন্তার বিষয়। এটি অকাল বন্ধ্যাত্বের কারণ হতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় যেহেতু ইস্ট্রোজেন হরমোনটি কমে যায়, ফলে শরীরে নানাবিধ সমস্যা দানা বাঁধে এবং সেগুলো বাড়তে থাকে। তার মধ্যে রয়েছে:

  • অপ্রয়োজনীয় কোলেস্টরল বেড়ে যাওয়া
  • হৃদরোগ
  • হাড় ক্ষয় এবং অস্টিওপরোসিস
  • বিষণ্ণতা
  • ডিমেনশিয়া
  • অকাল মৃত্যু

মেনোপজ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কি কিছু আছে?

বহু গাইনোকোলজিস্ট ও মেনোপজ বিশেষজ্ঞ প্রায়ই বলেন যে, মেনোপজ নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হবার কিছু নেই। মেনোপজের লক্ষণ দেখা দিলে ডাক্তারের সাথে আলাপ করলে এই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে। মেনোপজের ক্ষেত্রে হরমোন প্রতিস্থাপন থেরাপিকে একটি কার্যকর উপায় হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তবে, এই নিয়ে বিতর্কও রয়েছে। কারণ হরমোন প্রতিস্থাপনের বেশ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে।

মনে রাখবেন, মেনোপজের পর আপনি স্রেফ প্রজননক্ষমতা হারাবেন– তার মানে জীবনের গতি স্তব্ধ হয়ে যাওয়া নয় কিন্তু! তাই  নিজের খেয়াল রাখুন, পেটে, কোমরে চর্বি জমতে দেবেন না, এতে অন্য নানা জটিলতা এড়ানো সম্ভব।

মেনোপজ হলে নারীদের যে দিকে নজর রাখা উচিত

মেনোপজ হলে যদি নিচের বিষয়গুলো নারীরা খেয়াল করেন তাহলে সুস্বাস্থ্য পাওয়া সম্ভব।

  • ব্যালেন্সড ডায়েট বা ভারসাম্যপূর্ণ খাবার খাওয়া। চর্বিযুক্ত খাবার না খাওয়া। হৃৎপিণ্ড ও হাড়কে সুরক্ষা দিতে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া।
  • দুশ্চিন্তা, চাপ ও হৃদরোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে নিয়মিত কিছু ব্যায়াম করা।
  • হার্টের অসুখ ও হঠাৎ গরম লাগা কমাতে ধূমপান ও অ্যালকোহল পান বন্ধ করা।

বাংলাদেশ বা ভারতের মতো দেশগুলোতে মেনোপজকে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে ভাবা হয় না,  যেটি একটি ভুল ধারণা। এটি নারীদের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এসময় নারী শরীরে অনেক জটিলতাও দেখা দিতে পারে। তাই লজ্জা ভেঙে, নিজের এবং পরিবারের খাতিরেই এসব লক্ষণ দেখা গেলে গাইনি ডাক্তারের পরামর্শ নিন। এরকম নানা জটিলতা এড়াতে নারীর শরীর এবং বিশেষ করে আমাদের মায়েদের-মেয়েদের প্রজনন স্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ রাখা প্রয়োজন।

কৃতজ্ঞতা

  • বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগ
  • বিবিসি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

এ বিষয়ের আরও নিবন্ধ