বিচ্যুত আচরণ কী এবং বিচ্যুত আচরণের বিভিন্ন তত্ত্ব
- প্রকাশ: ০৭:৪০:৫৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ অগাস্ট ২০২২
- / ৬৯২৫ বার পড়া হয়েছে
ব্যক্তির যে-কোনো আচরণের জন্য সমাজই দায়ী। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় সমাজ মানুষকে ‘সামাজিক’ জীবে পরিণত করে। সবাই সমাজ প্রত্যাশিত আচরণ প্রদর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়। আবার অসামাজিক, বিপথগামী, অপরাধী, বিচ্যুত আচরণকারীও সমাজের সৃষ্টি। কেননা প্রচলিত সামাজিক বিধিবিধানের পরিপন্থী আচরণ সমাজ থেকেই অর্জিত হয়। অর্থাৎ সমাজের বাইরে থেকে যেমন সামাজিক হওয়া যায় না, তেমনি বিচ্যুত আচরণকারী বা অপরাধী হওয়াও সম্ভব নয়।
এখানে যা আছে
বিচ্যুত আচরণ কী?
সাধারণ অর্থে মানুষের যেসব আচরণ সামাজিক মূল্যবোধের পরিপন্থী, সমাজে অসংগতি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তাকে বিচ্যুত আচরণ বলে। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিচ্যুত আচরণকে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়াস পেয়েছেন। সমাজবিজ্ঞানী D. Ross (1972) বলেছেন, বিচ্যুত আচরণ হচ্ছে ঐ সব আচরণ যেগুলো সামাজিক প্রত্যাশাকে নিশ্চিত করতে পারে না
বিচ্যুতির তত্ত্ব (Theory of Deviance)
বিচ্যুত আচরণ সামাজিক পটভূমিতেই তৈরি। এ জন্যই বিচ্যুত আচরণ ব্যাখ্যা-বিশেস্নষণে সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্বের বিকাশ ঘটেছে। বিচ্যুতির প্রধান কয়েকটি তত্ত্ব হচ্ছে—
- সাদারল্যান্ডের পার্থক্যমূলক সম্পৃক্ততা তত্ত্ব
- মার্কসবাদী তত্ত্ব
- এমিল ডুর্খেইমের তত্ত্ব
- ঘরবার্ট কে. মার্টনের তত্ত্ব
সাদারল্যান্ডের পার্থক্যমূলক সম্পৃক্ততা তত্ত্ব (Differential association theory)
পার্থক্যমূলক সম্পৃক্ততা তত্ত্ব কী?
প্রখ্যাত অপরাধবিজ্ঞানী সাদারল্যান্ড (Sutherland) বিচ্যুত আচরণ বা অপরাধপ্রবণতা সম্পর্কে ১৯৩৯ সালে একটি সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তাঁর এ ব্যাখাই অপরাধবিজ্ঞানে ‘পার্থক্যমূলক সম্পৃক্ততা’ (Differential association) নামে পরিচিত। ১৯৪৭ সালে তিনি এ তত্ত্বে কিছু সংশোধনী আনেন। অনেকেই এর বিভিন্ন দিক সম্পর্কে যাচাই-বাছাই, পর্যালোচনা ও সমালোচনা করে চলেছেন। Differential association-এর বাংলা প্রতিশব্দ ‘মিলনভেদ মতবাদ’,
‘বৈষম্যমূলক সহযোগিতা’, ‘বিভিন্নমুখী মেলামেশা’ ইত্যাদি পরিলক্ষতি হয়। বর্তমান গ্রন্থে Differential association-এর বাংলা প্রতিশব্দ ‘পার্থক্যমূলক সম্পৃক্ততা’ ব্যবহার করা হয়েছে।
সাদারল্যান্ডের পার্থক্য সম্পৃক্ততা তত্ত্বের বিবৃতি
সাদারল্যান্ড তাঁর তত্ত্বের বক্তব্যগুলোকে কতিপয় বিবৃতির মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর বিবৃতগুলো এমন সব সামাজিক প্রক্রিয়াকে নির্দেশ করে যেগুলোর মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি অপরাধমূলক আচরণে লিপ্ত হয়। যেমন—
- বিচ্যুত আচরণ হচ্ছে সামাজিক শিক্ষার ফল বা অর্জিত আচরণ;
- সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ার ফলে বিচ্যুত আচরণ আয়ত্ত হয়;
- মানুষ নিজ দল থেকেই বেশিরভাগ বিচ্যুত আচরণ শিক্ষা করে;
- বিচ্যুত আচরণের কৌশল রপ্ত করে;
- বিচ্যুত আচরণ প্রদর্শনের প্রস্তুতি গ্রহণ করে;
- বিদ্যমান আইনের অপব্যাখ্যা বিচ্যুত আচরণকে উৎসাহিত করে;
- আইন অমান্য করার জন্য ব্যক্তিকে উৎসাহিত করা হয়;
- বিচ্যুতি শুধু অনুকরণ নয়, শিক্ষণের বিশেষ কৌশল হিসেবে চিহ্নিত;
- বিচ্যুতি হচ্ছে অপরাধমূলক আচরণ;
- ঘটমান সংখ্যা এবং এর হার (Frequency): ব্যক্তি বিচ্যুত আচরণকারী এবং সদাচরণকারীর সংস্পর্শে আসার মাত্রা বা হার (Frequency) কম বা বেশি হতে পারে। মেলামেশার হার কোন ধরনের ব্যক্তির সাথে কতটা তা তার আচরণের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। আবার উলিস্নখিত দু’ধরনের ব্যক্তিবর্গের সাথে কোনো মানুষ কতটা সময়ব্যাপী (duration) এবং কতখানি আন্তরিকতার (Intensity) সাথে মেলামেশা করে সেটিও তার আচরণের উপর গভীর রেখাপাত করে।
পার্থক্য সম্পৃক্ততামূলক তত্ত্বের সমালোচনা
সাদারল্যান্ডের পার্থক্যমূলক সম্পৃক্ততা তত্ত্বটির সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম হলেও এটি সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। অনেকের মতে তত্ত্বটির মূল বিবৃতি বা বক্তব্যসমূহ সুস্পষ্ট নয়। তিনি তাঁর প্রস্তাবনাগুলো এমনভাবে তুলে ধরেছেন যেখানে বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশেস্নষণ প্রদান করা হয় নি। ফলে তিনি যা বলতে চেয়েছেন তা স্পষ্ট হয়নি। সাদারল্যান্ড তাঁর তত্ত্বে বলেছেন, বিচ্যুত আচরণকারী মানুষের সাথে মেলামেশার ফলেই বিচ্যুত আচরণ বা অপরাধের শিক্ষা পায়। কিন্তু সমাজে এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে যে অপরাধীর সাথে মেলামেশা সত্ত্বেও অনেকে অপরাধী হয় না, আবার সদাচরণ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে মেলামেশা সত্ত্বেও ব্যক্তি বিচ্যুত আচরণকারীতে পরিণত হয়।
মার্কসীয় তত্ত্ব (Marxist theory)
মার্কসবাদী তত্ত্বে বিচ্যুত আচরণকে মানুষের একটি অন্যতম স্বাভাবিক আচরণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ শ্রেণির তাত্ত্বিকদের মতে এটি ব্যক্তিগত বা সামাজিক ব্যাধির ফল নয়। মানুষের বিচিত্র চরিত্রের একটি বিশেষ বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে বিপথগমন (Deviance)। সামাজিক প্রয়োজনেই বিপথগমনকে অপরাধ (crime) হিসেবে গণ্য করা হয়।
অনেকেই মনে করেন, বর্তমান সমাজের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোর কাজই হচ্ছে বিচ্যুত আচরণকে অপরাধরূপে চিহ্নিত করা। তাঁদের মতে, এমন সমাজের চিন্তা করা যেতে পারে যেখানে বিচ্যুত আচরণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার কোনো বাস্তব প্রয়োজন নেই। কোনো ক্ষমতা বা শক্তিই বিচ্যুত আচরণকে ‘অপরাধ’ হিসেবে চিহ্নিত করবে না। এ ধরনের নতুন সমাজের চিন্তা-চেতনাই উলিস্নখিত লেখকত্রয়কে মার্কসবাদী তত্ত্বে আগ্রহী করে তোলে।
নব্য-মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে অপরাধকে স্বাভাবিক লোকের স্বাভাবিক কর্ম বলে বিবেচনা করা হয়। এদের অপরাধীকরণ প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা নেই বললেই চলে। বিপথগমনের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে মানবীয় আচরণের কিছু দিককে সামাজিক প্রয়োজনে অপরাধমূলক বলে আখ্যা দেয়া হয়। তাঁদের মতে, অপরাধ এবং নিরাপরাধ উভয় ধরনের আচরণই স্বাভাবিক। মানুষের কিছু আচরণকে অপরাধীকরণ প্রক্রিয়ায় অপরাধমূলক বলে আখ্যা দেয়াও স্বাভাবিক।
এমিল ডুর্খেইমের তত্ত্ব (Emile Durkheim’s theory)
প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম সরাসরি বিচ্যুতিমূলক আচরণ সম্পর্কে তত্ত্ব প্রদান করেননি। ডুর্খেইম তাঁর লেখা The Division of Labour গ্রন্থে যৌথ প্রতিরূপ (Collective conscience) সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। যৌথ প্রতিরূপের মূল বক্তব্য হচ্ছে, ব্যক্তি সমাজে প্রচলিত রীতিনীতি, আচার-বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও ধর্মীয় বিধান দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। সামাজিক নিয়ন্ত্রণের এসব বাহনের প্রতি সমাজের অধিকাংশ মানুষ শ্রদ্ধাশীল থাকে। মানুষের এ সমষ্টিগত মনোভাবকে যৌথ প্রতিরূপ বলে।
অর্থাৎ সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অভিন্ন বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও আচরণ হচ্ছে ওই সমাজের যৌথ প্রতিরূপ বা সমষ্টিগত চেতনা। সমষ্টিগত চেতনার লংঘন হচ্ছে বিচ্যুতি। যৌথ প্রতিরূপের প্রাতিষ্ঠানিক, বাস্তব ও দৃশ্যমান দৃষ্টান্ত হচ্ছে আইন। কেউ আইন লংঘন করলে সে মূলত যৌথ চেতনার লংঘন করে। ফলে তাকে শাস্তি পেতে হয়। কিন্তু যৌথ চেতনার যেসব রীতিনীতি কেবল সামাজিকভাবে প্রয়োগ করা হয় সেগুলোর লংঘন হচ্ছে বিচ্যুতি। কাউকে গালি দেওয়া
অপরাধ নয়, বিচ্যুত আচরণ। কিন্তু গণপরিবহনে ধূমপান একটা সময় পর্যন্ত বিচ্যুতিমূলক আচরণ ছিল। এ বিষয়ে আইন প্রণয়ন হওয়ার ফলে এখন এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। একই কথা বলা যায় বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রেও। ডুর্খেইমের মতে, সামাজিক সংহতি (Social solidarity) ও সমষ্টিগত চেতনার (Collective conscience) মাধ্যমে নৈরাজ্য এবং বিচ্যুতিমূলক আচরণ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
রবার্ট কে. মার্টনের তত্ত্ব (R. K Marton’s theory)
মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট কে. মার্টন তাঁর Social Theory and Scial Structure (1949) গ্রন্থে অপরাধমূলক আচরণের তত্ত্ব প্রকাশ করেন। সামাজিক কাঠামোর ভেতর থেকেই অপরাধমূলক আচরণের উদ্ভব হয়। কোনো কোনো সামাজিক কাঠামো নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে চিরায়ত (Conforming) আচরণের পরিবর্তে ভিন্নতর কোনো আচরণে (non-conforning) উদ্ধুদ্ধ করে।
মার্টনের মতে, অপরাধমূলক আচরণের মূলে জৈবিক কারণ নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো অধিকতর ক্রিয়াশীল। সমাজে সাফল্য, অর্থবিত্ত, ক্ষমতা ও মর্যাদা অর্জন হচ্ছে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত লক্ষ্য। এগুলো অর্জনে প্রাতিষ্ঠানিক উপায় প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠিত লক্ষ্য ও প্রাতিষ্ঠানিক উপায়ের মধ্যে ব্যবধান তৈরি হলে নৈরাজ্য দেখা দেয়। মার্টন বিষয়টিকে নিম্নরূপভাবে ব্যাখ্যা করেছেন:
- সামঞ্জস্য (Conformity): কোনো সমাজে সাংস্কৃতিক লক্ষ্য ও প্রাতিষ্ঠানিক উপায়ের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকলে ওই সমাজে স্থিতিশীলতা বিরাজ করে। ফলে সমাজে নৈরাজ্য এবং অপরাধ প্রবণতা কম থাকে।
- উদ্ভাবন (Innovation): প্রাতিষ্ঠানিক উপায়কে অস্বীকার করে ব্যাক্তি স্বীকৃত সাংস্কৃতিক লক্ষ্যকে বিকল্প উপায়ে অর্জনে তৎপর হয়। বিকল্প বা উদ্ভাবনী উপায় হিসেবে ব্যক্তি বিচ্যুত আচরণ করতে পারে।
- প্রথানিষ্ঠতা (Ritualism): লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে কোনো কোনো সমাজে প্রাতিষ্ঠানিক উপায় বা নিয়ম-কানুনকে প্রাধান্য দেয়া হয়। কোনোভাবেই নিয়মের বাইরে যাওয়াকে নিরুৎসাহিত করা হয়। প্রথানিষ্ঠতা বিচ্যুত আাপচরণ নিয়ন্ত্রণ করে।
- পশ্চাদপসারণ (Retreatism): লক্ষ্য অর্জনের প্রচ- চাপ থাকে, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক উপায়ে বৈধভাবে তা সম্ভব হয় না। তখন ব্যক্তি লক্ষ্য অর্জনে বেপরোয়া হয়ে উঠে এবং সমাজে বিচ্যুত আচরণ বৃদ্ধি পায়।
- বিদ্রোহ (Rebellion): কোনো সমাজ কাঠামোয় যদি স্বীকৃত লক্ষ্য অর্জনের প্রাতিষ্ঠানিক উপায় কার্যকর না থাকে তখন ব্যক্তি বা বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্রোহের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এর ফলে সমাজে নৈরাজ্য দেখা দেয়। নৈরাজ্যের প্রকৃতি অনুযায়ী সমাজে বিচ্যুত আচরণের মাত্রাও কম-বেশি হতে পারে।
শেষকথা
সমাজ গঠনের শুরু থেকেই সমাজে বিচ্যুত আচরণ ও অপরাধ-প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। সমাজ যত জটিল (Complex) হচ্ছে বিচ্যুত আচরণের শ্রেণি, বৈশিষ্ট্য এবং স্বরূপেও তত বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিচ্যুত আচরণের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে অপরাধবিজ্ঞানে অসংখ্য তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্বগুলো এক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কেননা সামাজিক পরিম-লেই অপরাধীকরণ হয়। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমাজই কিছু মানুষকে অপরাধী করে তোলে। বলা যায়, সমাজের প্রয়োজনে আইন ও বিধিনিষেধের ভিত্তিতে মানুষের কিছু আচরণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।