০৭:৩৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

রিভিউ: চতুরঙ্গ— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি অনবদ্য উপন্যাস

নাজনীন বেগম
  • প্রকাশ: ১১:০০:২৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৪ জুলাই ২০২২
  • / ১৬১৭১ বার পড়া হয়েছে

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অনন্ত জীবন, চিরজীবী মানবাত্মা ও প্রকৃতির চিরন্তন সৌন্দর্যের কবি। মৃত্যুকে তিনি দেখেছেন মহাজীবনের যতি হিসেবে। জীবন-মৃত্যু ও জগৎ-সংসার তাঁর নিকট প্রতিভাত হয় এক অখন্ড রূপে।

‘চতুরঙ্গ’ হলো সাধু ভাষায় রচিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। এই শ্রেষ্ঠতম উপন্যাসটি সাধুভাষায় লিখিত রবীন্দ্রনাথের সর্বশেষ উপন্যাস। চতুরঙ্গ উপন্যাসের মোট চারটি অঙ্গে লিখিত, যথা— জ্যাঠামশাই, শচীশ, দামিনী এবং শ্রীবিলাস। উপন্যাসটি ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হয়। ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের বর্ণনাকারী শ্রীবিলাস নামে এক যুবক।

চতুরঙ্গ উপন্যাস ও সংশ্লিষ্ট কিছু কথা

সর্বভারতীয় আধ্যাত্ম দর্শন থেকে চিরায়ত বাঙালীবোধ এবং এই বাঙালিবোধের সঙ্গে অনবচ্ছেদ ধারায় সংযুক্ত বিশ্বপরিসরের আধুনিকতার জয়মাল্য সব মিলিয়ে বাংলা সাহিত্যে ‘গোরা’ উপন্যাসে যে অবিস্মরণীয় ভাব কল্পনা সেখান থেকে ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের মতো ভিন্ন এক আদর্শিক যাত্রা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়ের আবর্তে এক আধুনিক মনন।

গোরা আর ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাস দুইটির মধ্যে প্রকাশের সময় হিসেবে ফারাক পাঁচ বছরের। সময়টা খুব দীর্ঘ না হলেও নিতান্ত কমও নয়। পরিবর্তিত সময়, চৈতন্যের আসা-যাওয়া সর্বোপরি সমাজ-সংস্কারের হরেক রকম টানপোড়েন সৃজন ক্ষমতায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে এটাই তো স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় হয়নি। উনিশ শতকীয় সমাজের ক্রান্তিলগ্ন থেকে বিশ শতকীয় প্রথম দশক ভারতীয় উপমহাদেশ নব জাগরণীয় বোধের বিপরীতে অনেক বেশি ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অবস্থার দিকে মোড় নেওয়া তৎকালীন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক তার চেয়েও তীব্রতর প্রশাসনিক রদবদলের এক আবশ্যিক অধ্যায়। যার ভাল-মন্দের দুই প্রভাবে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক ভিন্নমাত্রার এক অনিবার্য কাল পর্ব। যে যুগান্তকারী সময়ে চিন্তার ক্ষেত্রেও আসে শুধু বিবর্তনই নয় একেবারে বিপ্লবী মনস্তত্ত্ব। যার সুস্পষ্ট নির্ণায়ক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাস।’

‘প্রবাসী’ পত্রিকায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা তখন নিয়মিত প্রকাশ করা ছিল সে সময়ের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রমানন্দ বাবুর অনুরোধে ‘গোরা’র মতো উপন্যাস লিখতে যাওয়া এবং ‘প্রবাসী’ কাগজে তা ছাপানো ছিল এক ধরনের দায়বদ্ধতা। এরই মধ্যে শুরু হয়ে যায় কাগজের ইতিহাসে আর এক নবসংযোজন ‘সবুজপত্র’। শুধু একটি পত্রিকার নবযাত্রা নয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চৈতন্যেও এক নতুন আহ্বান যা পূর্বের রবীন্দ্রনাথকে একটু আলাদাও করে দেয়। সৃষ্টির জগতে আসে এক অনন্য দুর্বার ক্ষণ, যা রবীন্দ্র মানসের ধারাবাহিকতায় ভিন্নমাত্রায় অভিগমন। সবুজপত্রের সূচনাকালেই পর্যায়ক্রমিক ধারায় প্রকাশ পেতে থাকে ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের মতো যুগান্তকারী উপন্যাস।

চতুরঙ্গ উপন্যাস রচনার পেছনের কথা

১৯১৪ সাল শুধু বঙ্গ কিংবা ভারত উপমহাদেশেই নয় দুনিয়াব্যাপী এক অন্য রকম হাওয়া বদলের পালা। রাবীন্দ্রিক চেতনায় বিশ শতকীয় প্রভাব কি তীব্রভাবে তাকে তাড়িত করে সেটা যেমন তাঁর ব্যক্তিগত জীবন একইভাবে সামাজিক ঘটনাপ্রবাহ স্মরণ করলেই পরিবর্তিত কবিকে চিনতে অনেকটাই সহজ হবে। 

১৯০২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু হয়। স্ত্রীর অকাল প্রয়াণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একেবারেই নিঃসঙ্গ করে দেয়। মাত্র ৩ বছরের ব্যবধানে পিতৃভক্ত রবীন্দ্রনাথ হারান পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথকে ১৯০৫ সালে। যে পিতার আদর্শিক চেতনায় বার বার আলোড়িত হয়েছেন বলে বিদগ্ধজনের অভিমত। আর ১৯০৫ সালের ‘বঙ্গভঙ্গ’কে তো অবিভক্ত বাংলার ওপর এক অযাচিত কর্তন, যা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোনো ভাবেই মানতে পারেননি।

উল্লেখ করার প্রয়োজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সিংহভাগ দেশাত্মবোধক সঙ্গীত এই সময়েই রচিত। শুধু তাই নয়, জীবনিকার প্রভাত কুমার বলেন, ১৮৯০ সালে লালন-বাউলের তীর্থ ভূমি শিলাইদহে কবি অবস্থান করেন প্রায়ই দশ বছর কিন্তু সে সময় বাউলের কোন সুর তাঁর সঙ্গীতে ঝঙ্কৃত হয়নি। বাণীসমৃদ্ধ গানে বাউল সুর সংযুক্ত করেছেন ১৯০৫ সাল থেকেই। এ ছাড়াও স্বদেশী আন্দোলন, সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা যা সাম্প্রদায়িক বীজ বপনে ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখে। ১৯১১ সালে বঙ্গ ব্যবচ্ছেদকে আবারও একীভূত করা। 

১৯১৩ সাল তো এক অনন্য মঙ্গলযোগে অবিভক্ত বাংলা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ল। ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মতো অজেয় সম্মানে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বজয়। যা শুধু ভারত উপমহাদেশই নয় পুরো এশিয়ায় প্রথম এই বিরল মর্যাদায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অভিষিক্ত হলেন। আর ১৯১৪ সালে বেজে উঠল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা। এই সব ধারাবাহিক আর্থ-সামাজিক অবয়বের তীক্ষ্ণবাণ বিদ্ধ হলো ঔপন্যাসিকে সৃজন চৈতন্যেই শুধু নয় যুক্তিনিষ্ঠ মননশীলতায়ও।

এমন মনোজাগতিক দোলাচলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখতে বসলেন ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাস, যেটি এক অসাধারণ বিপ্লব আর বিদ্রোহের সহগমনে ভিন্ন মাত্রার কল্পকাহিনী, যা তাঁর সামগ্রিক সৃষ্টি বৈচিত্র্যের ব্যতিক্রমী বোধকে স্পষ্ট করে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

গোরা বনাম চতুরঙ্গ

‘গোরা’ থেকে ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের ভাবনা ও রচনাকালের তফাত পাঁচ বছরেরও কম। ১৩১৬ এর ফাল্গুন মাসে ‘গোরা’ উপন্যাসটি প্রকাশ শেষ হয় ‘প্রবাসী’তে; ১৩২১-এর অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুন অবধি ‘সবুজপত্র’তে প্রকাশিত হয়েছিল ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাস। 

ইতিহাসের দিককোণ হতেও ‘গোরা’র পরবর্তী জীবনকথাই সন্নিবেশিত হয়েছে ‘চতুরঙ্গ’। তবু ‘গোরা’ থেকে ‘চতুরঙ্গ’ অবধি চলার পথে বাঙালি জীবন-চৈতন্য উনিশ শতকীয় সীমানা পেরিয়ে বিশ শতকীয় প্রবণতার জটিল আবর্তে প্রবেশ করে বসে আছে। সে যেমনই হোক, ‘গোরা’তে উত্থান পতনের বন্ধুর সেই নবজাগরণিক অভ্যুদয়ের তুঙ্গবিন্দু ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের অবক্ষয়ী অবতরণের আত্মত্রাণ সন্ধানের, মর্মান্তিক উত্তালতা।’ যার অবশ্যম্ভাবী দিকনির্দেশনা মাত্র পাঁচ বছর আগে লেখা গোরার বিষয়বস্তু, চরিত্রবিন্যাস, ঘটনার গতি নির্ণয় থেকে শুরু করে কাহিনীর চূড়ান্ত পর্যায় বিবেচনায় ‘চতুরঙ্গ’ একেবারে অন্য ধাঁচের, বিকল্প ধারার এক নব সংযোজন। সেই অনমনীয় তাড়না থেকে গোরা, কৃষ্ণদয়াল, পরেশবাবু, বিনয় কিংবা সুচরিতা, ললিতা আর আনন্দময়ীর জায়গায় জগমোহন, শচীশ, শ্রীবিলাস কিংবা দামিনীর মতো অন্য রকম চরিত্র সৃষ্টি অভাবনীয় এক যুগ পরিকল্পনা। দামিনীর আভাস আমরা ললিতার মধ্যে পেলেও তার ঔদ্ধত্য আর দাপট একেবারে দেশকালের সীমানার বাইরে। এ ছাড়াও কৃষ্ণদয়ালের সঙ্গে জগমোহন কিংবা বিনয়, গোরার সঙ্গে শচীশ কিংবা শ্রীবিলাসের ফারাক বিস্তর। কারণ রবীন্দ্রনাথ নিজেই। 

যেমন উপন্যাস চতুরঙ্গ

‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসটি শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের সৃজন ভাণ্ডারে নয় একেবারে বাংলা সাহিত্যে সমকালীন উপন্যাস বলয়েরও এক জোরালো আবেদন। জাত, ধর্ম আর বর্ণের উর্ধে উঠে মানবিক অধিকার, সর্বমানুষের কল্যাণ সাধনে যে কোন হিতকর কর্মযজ্ঞে নিজেকে উৎসর্গ করা তার চেয়েও বেশি সময়ের দাবিতে নারী চৈতন্যের এক অসামান্য স্বাধীনচেতার বৈপ্লবিক মনোজাগতিক নবধারা। 

‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে মানবিক মূল্যবোধকে মর্যাদা দিতে গিয়ে অমানবিক ঘটনা প্রবাহও নির্ণায়কের ভূমিকায় উপস্থাপিত হয়েছে। ফলে মানুষ আর অমানুষের ফারাক প্রবলভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। এমন শৈল্পিক সুতীব্র আঁচড় তিনি আর কোন সৃজনদ্যোতনায় এঁকেছেন কিনা গবেষণার দাবি রাখে।

মনুষ্যত্বের সূক্ষ্ম আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভবগুলো তাঁকে যেমন নমনীয় করেছে একইভাবে মানবতার অসম্মান আর মানুষের অপমানকে তীক্ষ্ম শব্দচয়নে শাণিতও করেছেন। প্রসঙ্গত ভূদেব চৌধুরীর বক্তব্য উল্লেখ্য— ‘চতুরঙ্গ’ বাংলা উপন্যাসের এক নতুন রূপান্তরের দিক চিহ্ন’ বাঙালীর ইতিহাসে বুঝি জীবনান্তরের দিশারি দলিলও।

বিশ শতকের প্রথম দশকের রবীন্দ্রনাথ আর দ্বিতীয় দশকের রবীন্দ্রনাথ এক নন। চিন্তায়, মননে, সৃজনশীলতায়, বস্তুনিষ্ঠ আলোচনায়, অনেক আর্থ-সামাজিক ঘটনার দ্রষ্টা এবং অংশীদার রবীন্দ্রনাথ অনেকটাই যুগের অগ্রগামী চিন্তার সফল নায়ক। আর তাই ‘চতুরঙ্গ’ তার আগের কিংবা পরের অনেক উপন্যাস থেকে আলাদাই শুধু নয় ভিন্ন মতাদর্শের দাবিদারও। সঙ্গতকারণে নারী চিন্তায়ও আসে সময়কে অতিক্রম করার এক বলিষ্ঠ প্রত্যয়। যার স্পষ্ট প্রকাশ দামিনীর মতো চরিত্র সৃষ্টির সাহসী চিন্তায়।

উনিশ শতকীয় চিন্তায় নবকিরণের আলোই উদ্ভিাসিত হয়নি সমাজ আর জীবন দর্শনেও আসে সময়ের যৌক্তিক আবেদন। যার ভিত্তি তৈরি হয় দ্বারকানাথ থেকে রামমোহন পরবর্তী ধারায় বিদ্যাসাগর এমনকি দেবেন্দ্রনাথও সেই নির্ভীক পথচলায় সহগামী হতে পেরেছিলেন। রক্ষণশীল হিন্দুত্ববাদের আচার নিষ্ঠতাকে বর্জন করে ব্রাহ্ম ধর্মের উদার মানবিকতায় নিজেকে নিবেদন করা মহর্ষির অবিস্মরণীয় কীর্তি। সাহিত্যের আঙিনায়ও আসে পরিশুদ্ধ সময়োপযোগী এক নবতর আহ্বান। যার বার্তা সর্ববাঙালীর দ্বারে পৌঁছে দিলেন অবিভক্ত বাংলার দুই মহানায়ক— বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং মাইকেল মধুসূদন দত্ত। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বজনীনতার মানবিক দর্শন সেই চলমান ধারাকে কতখানি সমৃদ্ধ করেছিল তা উজ্জ্বল হয়ে আছে তার সৃষ্টিসম্ভারের বিচিত্র গতি প্রবাহে। যা শুধু ঐতিহাসিকই নয়, সর্ববাঙালীর নতুন সমাজ আর জীবন গড়ার এক অভিনব ভাবসম্পদও। নবতর সবুজপত্রে প্রকাশ পাওয়া ‘চতুরঙ্গ’র কাহিনি বিন্যাস আগের উপন্যাসগুলোর চাইতে একটু অন্য রকম। 

জ্যাঠা মশাই, শচীশ, দামিনী কিংবা শ্রীবিলাস-এর নামে আলাদা করে চারটি গল্পে সবুজপত্রে ধারাবাহিক প্রকাশ পেতে থাকে। যা আরও একটি অন্য রকম আয়োজনও বটে। প্রতিটি অধ্যায় রচিত হয় শ্রীবিলাসের জবানীতে। প্রথম আলেখ্য শুরু হয় ‘জ্যাঠামশায়’ দিয়ে। তবে শচীশই এই পর্বের কৃতী পুরুষ। তার চলন বলনে মেধা ও মননের এক অনির্বাণ দ্যুতি। যে আলোর বিকীরণ অন্তরের মর্মমূলে স্নিগ্ধতার প্রলেপ ছুঁইয়ে দেয়। সেভাবেই প্রায়ই সমবয়সী শ্রীবিলাসের শচীশের কাছে আসা। উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক শচীশ বিজ্ঞানসম্মত যৌক্তিক আলোচনায় ভাবের চাইতে বস্তুকেই আমলে নিতে চায়। এ ছাড়া গৌরবর্ণ শচীশ বিশ্ব সাহিত্যের আঙিনায় নিজের নিঃশব্দ পদচারণায় কৃতী শিক্ষকদের নজর কাড়তেও সক্ষম হয়। যা অন্য ছাত্রদের কাছে ঈর্ষণীয়ও বটে। গল্পের ধারাবাহিকতায় শচীশের আবাল্য জীবন প্রবাহও উঠে আসতে সময় লাগেনি। আর এখান থেকেই জ্যাঠামশায়ের আখ্যান শুরু।

শচীশের জ্যাঠা জগমোহন একজন মানবিক, জনদরদী, অর্থ-বিত্তের প্রতি নির্মোহ অনবদ্য এক ব্যক্তিত্ব। জাত পাতের ধার ধারেন না, অনন্ত এক বিশ্বনিয়ন্তার প্রতি বিশেষ কোন আগ্রহও নেই। নিজের আদর্শবোধ থেকে ভাবতে পারেন মানুষই মানুষের শেষ কথা। ধর্ম, বর্ণ, কিংবা ঈশ্বর সেখানে অযাচিত। সমাজ সংসারই উপাস্য, মানুষই সবশক্তির উৎসই শুধু নয় প্রেরণাও বটে। সুতরাং মানুষের প্রতি গভীর মমতায় আর দায়বদ্ধতায় অন্য সব পারজাগতিক চিন্তা তার কাছে মূল্যহীন। সর্বমানুষের দ্বারে নিজেকে সমর্পণ করার মধ্যেই সমস্ত ধর্ম, বন্দনা এবং জাগতিক ধ্যান-ধারণা আবর্তিত। মনুষ্যত্বের অপমান, মানবতার অসম্মান কোনভাবেই সর্বশক্তিমানের বিধান হতে পারে না— এ যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজেরই ছায়া।

সাহিত্যেজুড়ে মানবতার জয়গান গেয়েছেন বিশ্বাস অবিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে। পরম বিশ্বাসীর সঙ্গে জগমোহনের তর্ক চলত প্রায়ই। তিনি অত্যন্ত যুক্তিসম্মত উপায়ে ঈশ্বরের ব্যাপারে তাঁর মত ব্যক্ত করতেন— ঈশ্বর যদি থাকেন তবে আমার বুদ্ধি তাঁরই দেয়া, সে বুদ্ধি বলিতেছে যে, ঈশ্বর নাই; অতএব, ঈশ্বর বলিতেছেন যে ঈশ্বর নাই। প্রচলিত ধর্মাচ্ছন্ন প্রথার বিরুদ্ধে এমন নির্ভীক মানসচেতনা সত্যিই অভাবনীয় এক নতুন জীবনবোধ।

সমকালীন অঙ্গন ছিল বিশ শতকীয় ধর্মীয় উন্মাদনায়ই নয় সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের এক কলুষিত অধ্যায় ও। এই অনধিগম্যকাল পর্বকে অতিক্রম করা শুধু বিস্ময়েরই নয় এক অসম্ভব সাহসী চিন্তার বিপ্লবী মনস্তত্ত্ব। যা শুধু বিশ্বজয়ী, অসাধারণ সৃজন ক্ষমতায় যৌক্তিক আলোচকের বস্তু নিষ্ঠতার জীবনবাদী দর্শন। যে চেতনা মানবতাকে শীর্ষে নিয়ে যায় অন্য সব কিছুকে বাদ দিয়ে। সাংঘর্ষিক পথপরিক্রমার এমন দুঃসময়ে বাস্তব জীবনের তাড়নায় সব মানুষের পূজা করতে গিয়ে সৃষ্টি কর্তাকে জনবান্ধব করে দেয়া সেও এক অনির্বাণ দীপ্তি। 

সময়টা কবি নিজেই নির্দেশ করেছেন যে বছর কলকাতায় প্লেগ মহামারীর আকারই ধারণ করে না অসংখ্য লোকক্ষয়ের কষ্টদায়ক অধ্যায়কেও উন্মোচিত করে— উনিশ শতকের ক্রান্তিলগ্ন (১৮৯৮ সাল)। জগমোহন যতদিন বেঁচে ছিলেন মনুষ্যত্বের প্রতি অবিচল নিষ্ঠতার কোন ব্যত্যয় ঘটতে দেখা যায়নি। যদিও তার এই অবিশ্বাসকে পুঁজি করে সহোদর হরিমোহন তাকে পিতৃদত্ত সমস্ত সহায় সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে। তবে জ্যাঠামশাই সব চাইতে বড় ঐশ্বর্য তার পাশেই পেয়েছিলেন ভাইয়ের কনিষ্ঠ সন্তান শচীশকে। সে দায়ভাগও পোহাতে হয়েছে। 

জগমোহনকে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা মোকাবেলা করে। তবু শচীশ এবং জ্যাঠামশায়কে কোনভাবে থামানো যায়নি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে স্থির থেকে অনমনীয় নিষ্ঠায় মানুষ আর মানবতাকে অর্ঘ্য দিতে কাউকেই বেগ পেতে হয়নি। ঠাণ্ডা লড়াই, নীরব বিদ্রোহ, নিঃশব্দ কর্মযজ্ঞ সব সময়ই তাদের নির্ভীকতার স্বচ্ছপথে চালিত করেছে। অতি বাল্যকাল থেকে শচীশ জ্যাঠামশায়ের নেওটা ছিল। কিশোর শচীশ সেই দৃঢ়পথ থেকে কখনও সরে দাঁড়ায়নি। আর উদীয়মান তরুণ ও পূর্ণ যুবক শচীশ জগমোহনের আদলে নিজের আদর্শিক বোধই শুধু নয় প্রয়োজনীয় কর্মপ্রবাহকেও নির্ণায়কের ভূমিকায় জীবনের সঙ্গে একীভূত করেছে। সেটা একেবারে জ্যাঠামশায়ের মৃত্যু অবধি। জগমোহনের অনন্তযাত্রায় শচীশের জীবনে বিপরীত স্রোত অনিবার্যভাবে বয়ে যায় সমাজ সংস্কারের হরেক রকম টানাপোড়েনে।

চারটি গল্পের কথক শ্রীবিলাসের জীবনে কোন অনাবশ্যক ঘটনা প্রবাহের দায়ভাগ সেভাবে না পড়লেও কাহিনীর প্রাসঙ্গিকতায় মনোজগত তীব্রভাবে তাড়িত হয়। আর সেই কারণে শচীশের উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ানো থেকে শুরু করে লীলানন্দ স্বামীর আখড়ায় নিজেকে বলি দেয়া শেষ অবধি আশৈশব লালন করা আদর্শেরও সলিল সমাধি তাকে আহত করে। এই গুরুজীর সরব আর সক্রিয় উপস্থিতি গল্পের মোড়কে অভিনব এবং নাটকীয়তার পর্যায়ে নিয়ে যায়। শচীশ যে কোন কালে কোন সন্ন্যাসীর আখড়ায় ভিড়তে পারে তার অতীত জীবন সেটা প্রমাণ করে না। মানুষ বিচিত্র, বাস্তব জীবন আরও জটিল। জীবনের পাঁকে পাঁকে হরেক রকম দোলাচল মানুষকে কোন স্থির অভিব্যক্তিতে তিথু হতে দেয় না।

লীলানন্দ স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাতই শুধু নয় এতদিনের গড়া জীবনবোধের অবিচলিত নিষ্ঠারও চরম পরিণতি হয়। ভক্তিতে, অর্ঘ্যে, পূজায় স্বামীজির জীবনবিচ্ছিন্ন তথাকথিত আধ্যাত্মিকতায় শচীশের নিঃশর্ত নিবেদন শ্রীবিলাসকে হতভম্ব আর বিস্ময়ে তাক লাগিয়ে দেয়। চিরচেনা বন্ধুটি মুহূর্তে অচেনা ব্যক্তিতে পরিণত হয়। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শচীশের নির্মোহ আবেগ আরচিত্তকে কখনও অর্থ-বিত্ত কিংবা কাম-লালসার মধ্যে সমর্পিত হতে দেননি। শচীশ এক অদৃশ্য সর্বশক্তিমান বিধাতাকে নিজের অন্তর্নিহিত শক্তি আর ভক্তি দিয়ে কখনও মানতে পারেনি। বরঞ্চ জগমোহনকে দেবতার আসনে বসিয়ে হৃদয় নিঃসৃত অর্ঘ্য উজাড় করে দিয়েছিল। জ্যাঠামশাইকে শ্রদ্ধার আর নিবেদনে প্রতিনিয়তই সর্বোত্তম জ্ঞানে জীবনের শ্রেষ্ঠ মানুষের জায়গায় অভিষিক্ত করেছিল। সে স্থানে লীলানন্দ স্বামীকে বসানো কি অতখানি সহজ? যা কাহিনির গতি নির্ণয়ে অত্যন্ত সাবলীলভাবে শচীশকে পাঠকের সামনে হাজির করে। একদিন যেমন নাস্তিক শচীশকে চিনতে কষ্ট হতো আজ তেমনি গুরুজীর আস্তানায় তার সঙ্গে লীলায় মত্ত শচীশকে বোঝা আরও দুর্বোধ্য হয়ে উঠল।

‘চতুরঙ্গ’ গল্পের মোড় ঘুরল অন্যদিকে— এক সময় জগমোহনের পরার্থপরতা, সর্বসাধারণের সঙ্গে একাত্মতা সর্বোপরি অসহায়, অসুস্থ, হতদরিদ্র মানুষের প্রতি নিবিড় মমতায় যে মহামানবকে পাঠক প্রত্যক্ষ করল তার জায়গায় লীলানন্দ স্বামীর মতো ভক্তদের মাতোয়ারা করা সাধু-সন্ন্যাসীকে কিভাবে শচীশ তার সর্বস্ব নিবেদন করল সেটা শ্রীবিলাসের কাছে বরাবরই রহস্যে আবৃত ছিল। তাকে আবিষ্কার করা দুঃসাধ্য ছিল না কিন্তু কি এক অজানা কারণে গল্পের কথক তা উহ্যই রাখলেন। কলকাতায় গুরুজীর একজন নিবেদিত ভক্ত ছিল। শিবতোষ নামের এই শিষ্যটি স্ত্রীর কল্যাণে শ্বশুর প্রদত্ত অনেক সম্পত্তির মালিক হন।

মৃত্যুর পূর্বে শিবতোষ স্ত্রীসহ পুরো সম্পদ গুরুজীর পায়ে নিবেদন করে যায়। স্ত্রী দামিনী হলো পুরো গল্পের আকর্ষণীয় এবং ঘটনাবহুল চরিত্র। এমন বলিষ্ঠ আর আত্মপ্রত্যয়ী নারী রবীন্দ্র সাহিত্যে খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন। নবজাগরণ, উপমহাদেশীয় বিচিত্র ঘটনা, নোবেল প্রাপ্তি, বিশ্বপরিসরে যুদ্ধের উন্মত্ততা এসব নানাবিধ অবস্থার আবর্তে পড়া বিশ শতকের অবিভক্ত বাংলা তথা ভারত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তার ক্ষেত্র করে প্রসারিত, উন্মুক্ত এবং প্রচলিত সংস্কার বিরুদ্ধ। যেমন জগমোহন, শচীশ এবং শ্রীবিলাসের নতুন জীবন দর্শন আরও তীব্রভাবে দামিনীর চারিত্রীক নির্ভীকতা, ব্যক্তিত্বের অনমনীয়তা, সিদ্ধান্তের অবিচলতা, প্রথাসিদ্ধ সমাজকে দাপটের সঙ্গে অতিক্রম করার দৃঢ় মনোশক্তি সব মিলিয়ে ব্যতিক্রমী মাত্রা যোগ হয়। দামিনীর মতো সাধারণ নারীর মধ্যে অসাধারণ সত্তা আর দীপ্তির বিকাশ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গভীর চিন্তার দুর্জয় সাহসের এক অনবদ্য সৃষ্টি। সমাজ প্রচলিত নিয়মশৃঙ্খলার বিপরীতে বিধবা নিঃসঙ্গ এক নারীর স্বাতন্ত্রীক চৈতন্য, প্রথাকে ভেঙ্গে ফেলার নির্ভীক মানসিকতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিপ্লবী মননের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য।

চতুরঙ্গ উপন্যাসের দামিনী চরিত্র

‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের দুই নারী চরিত্র— ননিবালা এবং মূল শিকড়ে গাঁথা দামিনী। ননিবালা সাধারণ, স্বাভাবিক নারী। আর দামিনী সেই তুলনায় বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের এক অবিচলিত শক্তি। প্রচলিত প্রথা বিদ্বেষী এক বিক্ষুব্ধ নারী যাকে কোন সমাজ সংস্কারের নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ করা যায় না। গতানুগতিক সামাজিক রক্ষণশীলতাকে দাপটের সঙ্গে অস্বীকার করে নিজের স্বাধীন সত্তাকে প্রবল উদ্যোমে জিইয়ে রাখা দামিনী নতুন দিগন্তের এক প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা। বৈধব্য সমাজের প্রাচীনতম বিধির এক নিষ্ঠুর প্রথা। যে প্রথার শিকার ননিবালা। পরিণতিতে অবৈধ মাতৃত্বের অভিশাপ। শেষ অবধি আত্মহননের পথে অনন্ত যাত্রা। নারীর মাঙ্গলিক রূপের আধার ননিবালা লেখকের সৃষ্টি কল্পনায় হয়ে ওঠে শুদ্ধ এক প্রতিমা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়— ‘নিতান্ত কচি মুখ, অল্প বয়স, সে মুখে কলঙ্কের কোন চিহ্ন পড়ে নাই। ফুলের উপর ধুলা লাগিলেও যেমন তার আন্তরিক সূচিতা দূর হয় না। তেমনি এই শিরীষ ফুলের মতো মেয়েটির ভেতরকার পবিত্রতার লাবণ্য তো ঘোচে নাই।’ নারী সৌন্দর্যের পূজারী রবীন্দ্রনাথ নারীর শুভমূর্তির ব্যত্যয় ঘটাতে চাননি। ঘটনার টানাপোড়েনে নারী লাঞ্ছিত হয়, ধিকৃত হয়, সমাজ পরিত্যক্ত হয়। কিন্তু তিনি তার সৃজনশীল দ্যোতনায় ও মানবিক মূল্যবোধে যতখানি সম্ভব নারী জাতির অসম্মান কিংবা অমর্যাদা কখনও করেননি।

অদমনীয় দামিনীকে রবীন্দ্রনাথ যে সযত্ন পরশ আর আন্তরিক সৌন্দর্যে মূর্ত করে তোলেন সেখানেও আমরা স্বাধীনচেতা, অধিকার সচেতন, সঙ্কল্পবদ্ধ নারীর প্রতি তাঁর সংবেদনশীল অনুভূতির স্পষ্ট প্রকাশ প্রত্যক্ষ করি। দামিনীর দৃঢ় ব্যক্তিত্ব, সঙ্কল্পে অবিচলতা, প্রতিবাদী চেতনা ঔপন্যাসিক শৈল্পিক তুলিতে আরও উজ্জ্বল হয়, প্রাণবন্ত হয়, নতুন কিরণ ছড়ায়। তিনি বলেন— ‘দামিনী যেন শ্রাবণের মেঘের ভেতরকার দামিনী। বাহিরে সে পুঞ্জ পুঞ্জ যৌবনে পূর্ণ; অন্তরে চঞ্চল আগুন ঝিকমিক করিয়া উঠিতেছে।’ স্বামীর বর্তমানে আশ্রম গুরুকে উপেক্ষা করা, ধর্মাশ্রিত সমাজের কোন বিধিনিষেধকে তোয়াক্কা না করা দামিনীর স্বভাবজাত। সে শুধু বিদ্রোহীই নয়, একেবারে বিপ্লবী। ঠাণ্ডা মাথায়, ধীরস্থিরভাবে পুরুষ শাসিত সমাজের কঠোর শাসন-শোষণকে দর্পভরে অস্বীকার করে। মেয়ে হলেও মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকার তারও আছে। নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছে, আশা-আকাক্সক্ষা প্রকাশের স্বাধীনতা থাকাও বাঞ্ছনীয়। স্বামীর মৃত্যুর পর সেও পারিবারিক সম্পত্তি আশ্রম গুরুর কাছে সমর্পিত হয়। 

বিধবা দামিনী হয়ে ওঠে আরও জেদী, তেজী। নিজেকে বাঁচাতে চারপাশে যে দুর্ভেদ্য দুর্গ গড়ে তোলে সেখানে কোন পুরুষেরই প্রবেশের অধিকার ছিল না। স্বামী শিবতোষ আমৃত্যু দামিনীকে না নিজের প্রতি না গুরুর প্রতি পূজায়, নিবেদনে আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়। অদম্য দামিনীকে কোনভাবেই বশ করা যায় না। বিদ্রোহী দামিনী বৈধব্যের কোন জ্বালা সইতে পারে না। তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোন সর্বনাশকে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি; বিপথগামীও হয়নি। যদিও অশুভ হাতছানি ছিল পদে পদে। স্বামীজির কোন উপদেশ, নির্দেশ, বিধিনিষেধ অকারণে, অপ্রয়োজনে কখনও মানেনি।

দুঃসাহসী, নির্ভীক, স্বাধীনচেতা দামিনী শচীশকেই ভালবেসে সবকিছু সমর্পণ করতে চায়। শচীশের উপেক্ষা, অবহেলায়ও সে দমে যায়নি। এমন অজেয় দামিনীকে গুরুজীও জয় করতে ব্যর্থ হয়। শচীশ-দামিনীর টানাপোড়েনে মাঝপথে উপস্থিত হয় শ্রীবিলাস। শেষ পর্যন্ত শ্রীবিলাসই দামিনীর চাওয়া-পাওয়া, আশা-আনন্দের একমাত্র সঙ্গী হয়। আরাধ্য দেবতা শচীশকে না পেয়ে শ্রীবিলাসের নির্মোহ ভালবাসার কাছে নিজেকে নিবেদন করে। এ ব্যাপারে প্রচলিত সমাজ তাদের পথ রোধ করতে পারেনি। দামিনীর স্রষ্টাই তাকে এমন দাপটী, অহঙ্কারী, দুর্দমনীয় করে গড়ে তোলে। সমাজবহির্ভূত বিধবার এমন প্রেম নারী স্বাধীনতার উজ্জ্বল দীপ্তি। শুধু তাই নয় প্রেমের এমন নির্মল ও নির্মোহ আবেগ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টি সম্ভারের এক অমূল্য সম্পদ।

সমাজের কঠিন সংস্কারের বিরুদ্ধে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধে উদ্বুদ্ধ দামিনী তার চারপাশে বিদ্রোহের যে বহ্নিশিখা প্রজ্বলিত করে সেখানে তাকে দাহ হতে হয়নি। বরং সেই জ্বলন্ত শিখার আলো তাকে বাঁচার পথ দেখায় এবং সে নিজের মতো করে বাঁচেও। দামিনীর এই স্বাধীন পথ চলা অত সহজ আর নির্বিঘ্নে ছিল না। প্রতিপক্ষ শক্তির জোর ছিল অনেক বেশি। সমাজ তাকে বলি দেয়ার জন্যও তৈরি ছিল। শ্রীবিলাসের একটি উক্ত স্মরণ করলেই বোঝা যাবে প্রচলিত সামাজিক সংস্কার কতখানি নির্মম আর নিষ্ঠুর ছিল। শাস্ত্রে নাকি স্ত্রী পশুবলি নিষেধ আছে। আর সভ্য মানুষের সমাজে সেই স্ত্রীলোকরাই যুগে যুগে বলির শিকার হয়েছে। আপন ইচ্ছেয়, শ্রীবিলাসের সম্মতিতে তাকে বিয়ে করাও দামিনীর উদ্দীপ্ত শিখার অম্লান দ্যুতি। এখানেও দামিনী নবযুগের একজন সাহসী পথিক।

সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে, আত্মীয়স্বজনের বন্ধন ছিন্ন করে শ্রীবিলাসের সঙ্গে নতুন জীবন শুরু করা দামিনী আপন বৈশিষ্ট্য, দীপ্ত মনোবল আর স্বাতন্ত্রিক বোধে অপ্রতিরোধ্য থাকে।

শেষকথা

‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসজুড়ে ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আধুনিক মনন, সময়কে ধরার দীপ্ত চেতনা তার চেয়েও বেশি পিছিয়ে পড়া নারীকে আলোকিত পথে নিয়ে আসা পরিবর্তিত ধারার নতুন সংযোজন। চারটি প্রধান চরিত্রে আছে সামাজিক অভিশাপ থেকে শুধু নিজেকে মুক্ত করা নয় পারিপার্শ্বিক বলয়কে ও গতানুগতিক অপসংস্কার থেকে সুচিন্তিত এবং নির্ভীক বোধে বের করে আনাও। সেই শৈল্পিক শৈলীতে নির্মিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই যুগান্তকারী এবং ভিন্নমাত্রার উপন্যাস ‘চতুরঙ্গ’। সময়ের যৌক্তিক আহ্বান, নারীচেতনায় সুদূরপ্রসারী বলিষ্ঠ প্রত্যয় সর্বোপরি প্রথাসিদ্ধ সমাজের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের উদ্দীপ্ত বোধ ‘চতুরঙ্গ’  উপন্যাসের সারবার্তা।

সম্পাদনায়— মু. মিজানুর রহমান মিজান

শেয়ার করুন

One thought on “রিভিউ: চতুরঙ্গ— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি অনবদ্য উপন্যাস

  1. এটিকে কেন নিবন্ধ বলা হচ্ছে তাই ভাবছি। চমৎকার বিশ্লেষণ। ভাষার মন্ত্রজালে রবীন্দ্রনাথ যেমন পাঠককে চতুরঙ্গে বন্দি করেছেন ঠিক তেমনই নিবন্ধকারের ভাষা ও বিশ্লেষণের জাদুজালে পাঠককে অবরুদ্ধ করে দিয়েছেন।

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

নাজনীন বেগম

নাজনীন বেগম একজন সিনিয়র সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক। মূলত সমাজতত্ত্বের ছাত্রী হলেও সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় নিজেকে পুরোপুরি যুক্ত রেখেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন শেষে দৈনিক পূর্বকোণের মাধ্যমে সাংবাদিকতায় অভিষেক। পরবর্তীতে দীর্ঘকাল ধরে দৈনিক জনকণ্ঠে অপরাজিতা পাতার বিভাগীয় সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। প্রবল রবীন্দ্র অনুরাগী নাজনীন বেগম ২০১৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএস থেকে অধ্যাপক ড. স্বরোচিষ সরকারের অধীনে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ দেশী-বিদেশী জার্ণালে প্রকাশিত হয়েছে। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন।

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

রিভিউ: চতুরঙ্গ— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি অনবদ্য উপন্যাস

প্রকাশ: ১১:০০:২৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৪ জুলাই ২০২২

‘চতুরঙ্গ’ হলো সাধু ভাষায় রচিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। এই শ্রেষ্ঠতম উপন্যাসটি সাধুভাষায় লিখিত রবীন্দ্রনাথের সর্বশেষ উপন্যাস। চতুরঙ্গ উপন্যাসের মোট চারটি অঙ্গে লিখিত, যথা— জ্যাঠামশাই, শচীশ, দামিনী এবং শ্রীবিলাস। উপন্যাসটি ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হয়। ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের বর্ণনাকারী শ্রীবিলাস নামে এক যুবক।

চতুরঙ্গ উপন্যাস ও সংশ্লিষ্ট কিছু কথা

সর্বভারতীয় আধ্যাত্ম দর্শন থেকে চিরায়ত বাঙালীবোধ এবং এই বাঙালিবোধের সঙ্গে অনবচ্ছেদ ধারায় সংযুক্ত বিশ্বপরিসরের আধুনিকতার জয়মাল্য সব মিলিয়ে বাংলা সাহিত্যে ‘গোরা’ উপন্যাসে যে অবিস্মরণীয় ভাব কল্পনা সেখান থেকে ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের মতো ভিন্ন এক আদর্শিক যাত্রা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়ের আবর্তে এক আধুনিক মনন।

গোরা আর ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাস দুইটির মধ্যে প্রকাশের সময় হিসেবে ফারাক পাঁচ বছরের। সময়টা খুব দীর্ঘ না হলেও নিতান্ত কমও নয়। পরিবর্তিত সময়, চৈতন্যের আসা-যাওয়া সর্বোপরি সমাজ-সংস্কারের হরেক রকম টানপোড়েন সৃজন ক্ষমতায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে এটাই তো স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় হয়নি। উনিশ শতকীয় সমাজের ক্রান্তিলগ্ন থেকে বিশ শতকীয় প্রথম দশক ভারতীয় উপমহাদেশ নব জাগরণীয় বোধের বিপরীতে অনেক বেশি ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অবস্থার দিকে মোড় নেওয়া তৎকালীন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক তার চেয়েও তীব্রতর প্রশাসনিক রদবদলের এক আবশ্যিক অধ্যায়। যার ভাল-মন্দের দুই প্রভাবে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক ভিন্নমাত্রার এক অনিবার্য কাল পর্ব। যে যুগান্তকারী সময়ে চিন্তার ক্ষেত্রেও আসে শুধু বিবর্তনই নয় একেবারে বিপ্লবী মনস্তত্ত্ব। যার সুস্পষ্ট নির্ণায়ক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাস।’

‘প্রবাসী’ পত্রিকায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা তখন নিয়মিত প্রকাশ করা ছিল সে সময়ের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রমানন্দ বাবুর অনুরোধে ‘গোরা’র মতো উপন্যাস লিখতে যাওয়া এবং ‘প্রবাসী’ কাগজে তা ছাপানো ছিল এক ধরনের দায়বদ্ধতা। এরই মধ্যে শুরু হয়ে যায় কাগজের ইতিহাসে আর এক নবসংযোজন ‘সবুজপত্র’। শুধু একটি পত্রিকার নবযাত্রা নয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চৈতন্যেও এক নতুন আহ্বান যা পূর্বের রবীন্দ্রনাথকে একটু আলাদাও করে দেয়। সৃষ্টির জগতে আসে এক অনন্য দুর্বার ক্ষণ, যা রবীন্দ্র মানসের ধারাবাহিকতায় ভিন্নমাত্রায় অভিগমন। সবুজপত্রের সূচনাকালেই পর্যায়ক্রমিক ধারায় প্রকাশ পেতে থাকে ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের মতো যুগান্তকারী উপন্যাস।

চতুরঙ্গ উপন্যাস রচনার পেছনের কথা

১৯১৪ সাল শুধু বঙ্গ কিংবা ভারত উপমহাদেশেই নয় দুনিয়াব্যাপী এক অন্য রকম হাওয়া বদলের পালা। রাবীন্দ্রিক চেতনায় বিশ শতকীয় প্রভাব কি তীব্রভাবে তাকে তাড়িত করে সেটা যেমন তাঁর ব্যক্তিগত জীবন একইভাবে সামাজিক ঘটনাপ্রবাহ স্মরণ করলেই পরিবর্তিত কবিকে চিনতে অনেকটাই সহজ হবে। 

১৯০২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু হয়। স্ত্রীর অকাল প্রয়াণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একেবারেই নিঃসঙ্গ করে দেয়। মাত্র ৩ বছরের ব্যবধানে পিতৃভক্ত রবীন্দ্রনাথ হারান পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথকে ১৯০৫ সালে। যে পিতার আদর্শিক চেতনায় বার বার আলোড়িত হয়েছেন বলে বিদগ্ধজনের অভিমত। আর ১৯০৫ সালের ‘বঙ্গভঙ্গ’কে তো অবিভক্ত বাংলার ওপর এক অযাচিত কর্তন, যা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোনো ভাবেই মানতে পারেননি।

উল্লেখ করার প্রয়োজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সিংহভাগ দেশাত্মবোধক সঙ্গীত এই সময়েই রচিত। শুধু তাই নয়, জীবনিকার প্রভাত কুমার বলেন, ১৮৯০ সালে লালন-বাউলের তীর্থ ভূমি শিলাইদহে কবি অবস্থান করেন প্রায়ই দশ বছর কিন্তু সে সময় বাউলের কোন সুর তাঁর সঙ্গীতে ঝঙ্কৃত হয়নি। বাণীসমৃদ্ধ গানে বাউল সুর সংযুক্ত করেছেন ১৯০৫ সাল থেকেই। এ ছাড়াও স্বদেশী আন্দোলন, সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা যা সাম্প্রদায়িক বীজ বপনে ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখে। ১৯১১ সালে বঙ্গ ব্যবচ্ছেদকে আবারও একীভূত করা। 

১৯১৩ সাল তো এক অনন্য মঙ্গলযোগে অবিভক্ত বাংলা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ল। ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মতো অজেয় সম্মানে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বজয়। যা শুধু ভারত উপমহাদেশই নয় পুরো এশিয়ায় প্রথম এই বিরল মর্যাদায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অভিষিক্ত হলেন। আর ১৯১৪ সালে বেজে উঠল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা। এই সব ধারাবাহিক আর্থ-সামাজিক অবয়বের তীক্ষ্ণবাণ বিদ্ধ হলো ঔপন্যাসিকে সৃজন চৈতন্যেই শুধু নয় যুক্তিনিষ্ঠ মননশীলতায়ও।

এমন মনোজাগতিক দোলাচলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখতে বসলেন ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাস, যেটি এক অসাধারণ বিপ্লব আর বিদ্রোহের সহগমনে ভিন্ন মাত্রার কল্পকাহিনী, যা তাঁর সামগ্রিক সৃষ্টি বৈচিত্র্যের ব্যতিক্রমী বোধকে স্পষ্ট করে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

গোরা বনাম চতুরঙ্গ

‘গোরা’ থেকে ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের ভাবনা ও রচনাকালের তফাত পাঁচ বছরেরও কম। ১৩১৬ এর ফাল্গুন মাসে ‘গোরা’ উপন্যাসটি প্রকাশ শেষ হয় ‘প্রবাসী’তে; ১৩২১-এর অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুন অবধি ‘সবুজপত্র’তে প্রকাশিত হয়েছিল ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাস। 

ইতিহাসের দিককোণ হতেও ‘গোরা’র পরবর্তী জীবনকথাই সন্নিবেশিত হয়েছে ‘চতুরঙ্গ’। তবু ‘গোরা’ থেকে ‘চতুরঙ্গ’ অবধি চলার পথে বাঙালি জীবন-চৈতন্য উনিশ শতকীয় সীমানা পেরিয়ে বিশ শতকীয় প্রবণতার জটিল আবর্তে প্রবেশ করে বসে আছে। সে যেমনই হোক, ‘গোরা’তে উত্থান পতনের বন্ধুর সেই নবজাগরণিক অভ্যুদয়ের তুঙ্গবিন্দু ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের অবক্ষয়ী অবতরণের আত্মত্রাণ সন্ধানের, মর্মান্তিক উত্তালতা।’ যার অবশ্যম্ভাবী দিকনির্দেশনা মাত্র পাঁচ বছর আগে লেখা গোরার বিষয়বস্তু, চরিত্রবিন্যাস, ঘটনার গতি নির্ণয় থেকে শুরু করে কাহিনীর চূড়ান্ত পর্যায় বিবেচনায় ‘চতুরঙ্গ’ একেবারে অন্য ধাঁচের, বিকল্প ধারার এক নব সংযোজন। সেই অনমনীয় তাড়না থেকে গোরা, কৃষ্ণদয়াল, পরেশবাবু, বিনয় কিংবা সুচরিতা, ললিতা আর আনন্দময়ীর জায়গায় জগমোহন, শচীশ, শ্রীবিলাস কিংবা দামিনীর মতো অন্য রকম চরিত্র সৃষ্টি অভাবনীয় এক যুগ পরিকল্পনা। দামিনীর আভাস আমরা ললিতার মধ্যে পেলেও তার ঔদ্ধত্য আর দাপট একেবারে দেশকালের সীমানার বাইরে। এ ছাড়াও কৃষ্ণদয়ালের সঙ্গে জগমোহন কিংবা বিনয়, গোরার সঙ্গে শচীশ কিংবা শ্রীবিলাসের ফারাক বিস্তর। কারণ রবীন্দ্রনাথ নিজেই। 

যেমন উপন্যাস চতুরঙ্গ

‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসটি শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের সৃজন ভাণ্ডারে নয় একেবারে বাংলা সাহিত্যে সমকালীন উপন্যাস বলয়েরও এক জোরালো আবেদন। জাত, ধর্ম আর বর্ণের উর্ধে উঠে মানবিক অধিকার, সর্বমানুষের কল্যাণ সাধনে যে কোন হিতকর কর্মযজ্ঞে নিজেকে উৎসর্গ করা তার চেয়েও বেশি সময়ের দাবিতে নারী চৈতন্যের এক অসামান্য স্বাধীনচেতার বৈপ্লবিক মনোজাগতিক নবধারা। 

‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে মানবিক মূল্যবোধকে মর্যাদা দিতে গিয়ে অমানবিক ঘটনা প্রবাহও নির্ণায়কের ভূমিকায় উপস্থাপিত হয়েছে। ফলে মানুষ আর অমানুষের ফারাক প্রবলভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। এমন শৈল্পিক সুতীব্র আঁচড় তিনি আর কোন সৃজনদ্যোতনায় এঁকেছেন কিনা গবেষণার দাবি রাখে।

মনুষ্যত্বের সূক্ষ্ম আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভবগুলো তাঁকে যেমন নমনীয় করেছে একইভাবে মানবতার অসম্মান আর মানুষের অপমানকে তীক্ষ্ম শব্দচয়নে শাণিতও করেছেন। প্রসঙ্গত ভূদেব চৌধুরীর বক্তব্য উল্লেখ্য— ‘চতুরঙ্গ’ বাংলা উপন্যাসের এক নতুন রূপান্তরের দিক চিহ্ন’ বাঙালীর ইতিহাসে বুঝি জীবনান্তরের দিশারি দলিলও।

বিশ শতকের প্রথম দশকের রবীন্দ্রনাথ আর দ্বিতীয় দশকের রবীন্দ্রনাথ এক নন। চিন্তায়, মননে, সৃজনশীলতায়, বস্তুনিষ্ঠ আলোচনায়, অনেক আর্থ-সামাজিক ঘটনার দ্রষ্টা এবং অংশীদার রবীন্দ্রনাথ অনেকটাই যুগের অগ্রগামী চিন্তার সফল নায়ক। আর তাই ‘চতুরঙ্গ’ তার আগের কিংবা পরের অনেক উপন্যাস থেকে আলাদাই শুধু নয় ভিন্ন মতাদর্শের দাবিদারও। সঙ্গতকারণে নারী চিন্তায়ও আসে সময়কে অতিক্রম করার এক বলিষ্ঠ প্রত্যয়। যার স্পষ্ট প্রকাশ দামিনীর মতো চরিত্র সৃষ্টির সাহসী চিন্তায়।

উনিশ শতকীয় চিন্তায় নবকিরণের আলোই উদ্ভিাসিত হয়নি সমাজ আর জীবন দর্শনেও আসে সময়ের যৌক্তিক আবেদন। যার ভিত্তি তৈরি হয় দ্বারকানাথ থেকে রামমোহন পরবর্তী ধারায় বিদ্যাসাগর এমনকি দেবেন্দ্রনাথও সেই নির্ভীক পথচলায় সহগামী হতে পেরেছিলেন। রক্ষণশীল হিন্দুত্ববাদের আচার নিষ্ঠতাকে বর্জন করে ব্রাহ্ম ধর্মের উদার মানবিকতায় নিজেকে নিবেদন করা মহর্ষির অবিস্মরণীয় কীর্তি। সাহিত্যের আঙিনায়ও আসে পরিশুদ্ধ সময়োপযোগী এক নবতর আহ্বান। যার বার্তা সর্ববাঙালীর দ্বারে পৌঁছে দিলেন অবিভক্ত বাংলার দুই মহানায়ক— বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং মাইকেল মধুসূদন দত্ত। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বজনীনতার মানবিক দর্শন সেই চলমান ধারাকে কতখানি সমৃদ্ধ করেছিল তা উজ্জ্বল হয়ে আছে তার সৃষ্টিসম্ভারের বিচিত্র গতি প্রবাহে। যা শুধু ঐতিহাসিকই নয়, সর্ববাঙালীর নতুন সমাজ আর জীবন গড়ার এক অভিনব ভাবসম্পদও। নবতর সবুজপত্রে প্রকাশ পাওয়া ‘চতুরঙ্গ’র কাহিনি বিন্যাস আগের উপন্যাসগুলোর চাইতে একটু অন্য রকম। 

জ্যাঠা মশাই, শচীশ, দামিনী কিংবা শ্রীবিলাস-এর নামে আলাদা করে চারটি গল্পে সবুজপত্রে ধারাবাহিক প্রকাশ পেতে থাকে। যা আরও একটি অন্য রকম আয়োজনও বটে। প্রতিটি অধ্যায় রচিত হয় শ্রীবিলাসের জবানীতে। প্রথম আলেখ্য শুরু হয় ‘জ্যাঠামশায়’ দিয়ে। তবে শচীশই এই পর্বের কৃতী পুরুষ। তার চলন বলনে মেধা ও মননের এক অনির্বাণ দ্যুতি। যে আলোর বিকীরণ অন্তরের মর্মমূলে স্নিগ্ধতার প্রলেপ ছুঁইয়ে দেয়। সেভাবেই প্রায়ই সমবয়সী শ্রীবিলাসের শচীশের কাছে আসা। উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক শচীশ বিজ্ঞানসম্মত যৌক্তিক আলোচনায় ভাবের চাইতে বস্তুকেই আমলে নিতে চায়। এ ছাড়া গৌরবর্ণ শচীশ বিশ্ব সাহিত্যের আঙিনায় নিজের নিঃশব্দ পদচারণায় কৃতী শিক্ষকদের নজর কাড়তেও সক্ষম হয়। যা অন্য ছাত্রদের কাছে ঈর্ষণীয়ও বটে। গল্পের ধারাবাহিকতায় শচীশের আবাল্য জীবন প্রবাহও উঠে আসতে সময় লাগেনি। আর এখান থেকেই জ্যাঠামশায়ের আখ্যান শুরু।

শচীশের জ্যাঠা জগমোহন একজন মানবিক, জনদরদী, অর্থ-বিত্তের প্রতি নির্মোহ অনবদ্য এক ব্যক্তিত্ব। জাত পাতের ধার ধারেন না, অনন্ত এক বিশ্বনিয়ন্তার প্রতি বিশেষ কোন আগ্রহও নেই। নিজের আদর্শবোধ থেকে ভাবতে পারেন মানুষই মানুষের শেষ কথা। ধর্ম, বর্ণ, কিংবা ঈশ্বর সেখানে অযাচিত। সমাজ সংসারই উপাস্য, মানুষই সবশক্তির উৎসই শুধু নয় প্রেরণাও বটে। সুতরাং মানুষের প্রতি গভীর মমতায় আর দায়বদ্ধতায় অন্য সব পারজাগতিক চিন্তা তার কাছে মূল্যহীন। সর্বমানুষের দ্বারে নিজেকে সমর্পণ করার মধ্যেই সমস্ত ধর্ম, বন্দনা এবং জাগতিক ধ্যান-ধারণা আবর্তিত। মনুষ্যত্বের অপমান, মানবতার অসম্মান কোনভাবেই সর্বশক্তিমানের বিধান হতে পারে না— এ যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজেরই ছায়া।

সাহিত্যেজুড়ে মানবতার জয়গান গেয়েছেন বিশ্বাস অবিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে। পরম বিশ্বাসীর সঙ্গে জগমোহনের তর্ক চলত প্রায়ই। তিনি অত্যন্ত যুক্তিসম্মত উপায়ে ঈশ্বরের ব্যাপারে তাঁর মত ব্যক্ত করতেন— ঈশ্বর যদি থাকেন তবে আমার বুদ্ধি তাঁরই দেয়া, সে বুদ্ধি বলিতেছে যে, ঈশ্বর নাই; অতএব, ঈশ্বর বলিতেছেন যে ঈশ্বর নাই। প্রচলিত ধর্মাচ্ছন্ন প্রথার বিরুদ্ধে এমন নির্ভীক মানসচেতনা সত্যিই অভাবনীয় এক নতুন জীবনবোধ।

সমকালীন অঙ্গন ছিল বিশ শতকীয় ধর্মীয় উন্মাদনায়ই নয় সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের এক কলুষিত অধ্যায় ও। এই অনধিগম্যকাল পর্বকে অতিক্রম করা শুধু বিস্ময়েরই নয় এক অসম্ভব সাহসী চিন্তার বিপ্লবী মনস্তত্ত্ব। যা শুধু বিশ্বজয়ী, অসাধারণ সৃজন ক্ষমতায় যৌক্তিক আলোচকের বস্তু নিষ্ঠতার জীবনবাদী দর্শন। যে চেতনা মানবতাকে শীর্ষে নিয়ে যায় অন্য সব কিছুকে বাদ দিয়ে। সাংঘর্ষিক পথপরিক্রমার এমন দুঃসময়ে বাস্তব জীবনের তাড়নায় সব মানুষের পূজা করতে গিয়ে সৃষ্টি কর্তাকে জনবান্ধব করে দেয়া সেও এক অনির্বাণ দীপ্তি। 

সময়টা কবি নিজেই নির্দেশ করেছেন যে বছর কলকাতায় প্লেগ মহামারীর আকারই ধারণ করে না অসংখ্য লোকক্ষয়ের কষ্টদায়ক অধ্যায়কেও উন্মোচিত করে— উনিশ শতকের ক্রান্তিলগ্ন (১৮৯৮ সাল)। জগমোহন যতদিন বেঁচে ছিলেন মনুষ্যত্বের প্রতি অবিচল নিষ্ঠতার কোন ব্যত্যয় ঘটতে দেখা যায়নি। যদিও তার এই অবিশ্বাসকে পুঁজি করে সহোদর হরিমোহন তাকে পিতৃদত্ত সমস্ত সহায় সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে। তবে জ্যাঠামশাই সব চাইতে বড় ঐশ্বর্য তার পাশেই পেয়েছিলেন ভাইয়ের কনিষ্ঠ সন্তান শচীশকে। সে দায়ভাগও পোহাতে হয়েছে। 

জগমোহনকে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা মোকাবেলা করে। তবু শচীশ এবং জ্যাঠামশায়কে কোনভাবে থামানো যায়নি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে স্থির থেকে অনমনীয় নিষ্ঠায় মানুষ আর মানবতাকে অর্ঘ্য দিতে কাউকেই বেগ পেতে হয়নি। ঠাণ্ডা লড়াই, নীরব বিদ্রোহ, নিঃশব্দ কর্মযজ্ঞ সব সময়ই তাদের নির্ভীকতার স্বচ্ছপথে চালিত করেছে। অতি বাল্যকাল থেকে শচীশ জ্যাঠামশায়ের নেওটা ছিল। কিশোর শচীশ সেই দৃঢ়পথ থেকে কখনও সরে দাঁড়ায়নি। আর উদীয়মান তরুণ ও পূর্ণ যুবক শচীশ জগমোহনের আদলে নিজের আদর্শিক বোধই শুধু নয় প্রয়োজনীয় কর্মপ্রবাহকেও নির্ণায়কের ভূমিকায় জীবনের সঙ্গে একীভূত করেছে। সেটা একেবারে জ্যাঠামশায়ের মৃত্যু অবধি। জগমোহনের অনন্তযাত্রায় শচীশের জীবনে বিপরীত স্রোত অনিবার্যভাবে বয়ে যায় সমাজ সংস্কারের হরেক রকম টানাপোড়েনে।

চারটি গল্পের কথক শ্রীবিলাসের জীবনে কোন অনাবশ্যক ঘটনা প্রবাহের দায়ভাগ সেভাবে না পড়লেও কাহিনীর প্রাসঙ্গিকতায় মনোজগত তীব্রভাবে তাড়িত হয়। আর সেই কারণে শচীশের উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ানো থেকে শুরু করে লীলানন্দ স্বামীর আখড়ায় নিজেকে বলি দেয়া শেষ অবধি আশৈশব লালন করা আদর্শেরও সলিল সমাধি তাকে আহত করে। এই গুরুজীর সরব আর সক্রিয় উপস্থিতি গল্পের মোড়কে অভিনব এবং নাটকীয়তার পর্যায়ে নিয়ে যায়। শচীশ যে কোন কালে কোন সন্ন্যাসীর আখড়ায় ভিড়তে পারে তার অতীত জীবন সেটা প্রমাণ করে না। মানুষ বিচিত্র, বাস্তব জীবন আরও জটিল। জীবনের পাঁকে পাঁকে হরেক রকম দোলাচল মানুষকে কোন স্থির অভিব্যক্তিতে তিথু হতে দেয় না।

লীলানন্দ স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাতই শুধু নয় এতদিনের গড়া জীবনবোধের অবিচলিত নিষ্ঠারও চরম পরিণতি হয়। ভক্তিতে, অর্ঘ্যে, পূজায় স্বামীজির জীবনবিচ্ছিন্ন তথাকথিত আধ্যাত্মিকতায় শচীশের নিঃশর্ত নিবেদন শ্রীবিলাসকে হতভম্ব আর বিস্ময়ে তাক লাগিয়ে দেয়। চিরচেনা বন্ধুটি মুহূর্তে অচেনা ব্যক্তিতে পরিণত হয়। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শচীশের নির্মোহ আবেগ আরচিত্তকে কখনও অর্থ-বিত্ত কিংবা কাম-লালসার মধ্যে সমর্পিত হতে দেননি। শচীশ এক অদৃশ্য সর্বশক্তিমান বিধাতাকে নিজের অন্তর্নিহিত শক্তি আর ভক্তি দিয়ে কখনও মানতে পারেনি। বরঞ্চ জগমোহনকে দেবতার আসনে বসিয়ে হৃদয় নিঃসৃত অর্ঘ্য উজাড় করে দিয়েছিল। জ্যাঠামশাইকে শ্রদ্ধার আর নিবেদনে প্রতিনিয়তই সর্বোত্তম জ্ঞানে জীবনের শ্রেষ্ঠ মানুষের জায়গায় অভিষিক্ত করেছিল। সে স্থানে লীলানন্দ স্বামীকে বসানো কি অতখানি সহজ? যা কাহিনির গতি নির্ণয়ে অত্যন্ত সাবলীলভাবে শচীশকে পাঠকের সামনে হাজির করে। একদিন যেমন নাস্তিক শচীশকে চিনতে কষ্ট হতো আজ তেমনি গুরুজীর আস্তানায় তার সঙ্গে লীলায় মত্ত শচীশকে বোঝা আরও দুর্বোধ্য হয়ে উঠল।

‘চতুরঙ্গ’ গল্পের মোড় ঘুরল অন্যদিকে— এক সময় জগমোহনের পরার্থপরতা, সর্বসাধারণের সঙ্গে একাত্মতা সর্বোপরি অসহায়, অসুস্থ, হতদরিদ্র মানুষের প্রতি নিবিড় মমতায় যে মহামানবকে পাঠক প্রত্যক্ষ করল তার জায়গায় লীলানন্দ স্বামীর মতো ভক্তদের মাতোয়ারা করা সাধু-সন্ন্যাসীকে কিভাবে শচীশ তার সর্বস্ব নিবেদন করল সেটা শ্রীবিলাসের কাছে বরাবরই রহস্যে আবৃত ছিল। তাকে আবিষ্কার করা দুঃসাধ্য ছিল না কিন্তু কি এক অজানা কারণে গল্পের কথক তা উহ্যই রাখলেন। কলকাতায় গুরুজীর একজন নিবেদিত ভক্ত ছিল। শিবতোষ নামের এই শিষ্যটি স্ত্রীর কল্যাণে শ্বশুর প্রদত্ত অনেক সম্পত্তির মালিক হন।

মৃত্যুর পূর্বে শিবতোষ স্ত্রীসহ পুরো সম্পদ গুরুজীর পায়ে নিবেদন করে যায়। স্ত্রী দামিনী হলো পুরো গল্পের আকর্ষণীয় এবং ঘটনাবহুল চরিত্র। এমন বলিষ্ঠ আর আত্মপ্রত্যয়ী নারী রবীন্দ্র সাহিত্যে খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন। নবজাগরণ, উপমহাদেশীয় বিচিত্র ঘটনা, নোবেল প্রাপ্তি, বিশ্বপরিসরে যুদ্ধের উন্মত্ততা এসব নানাবিধ অবস্থার আবর্তে পড়া বিশ শতকের অবিভক্ত বাংলা তথা ভারত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তার ক্ষেত্র করে প্রসারিত, উন্মুক্ত এবং প্রচলিত সংস্কার বিরুদ্ধ। যেমন জগমোহন, শচীশ এবং শ্রীবিলাসের নতুন জীবন দর্শন আরও তীব্রভাবে দামিনীর চারিত্রীক নির্ভীকতা, ব্যক্তিত্বের অনমনীয়তা, সিদ্ধান্তের অবিচলতা, প্রথাসিদ্ধ সমাজকে দাপটের সঙ্গে অতিক্রম করার দৃঢ় মনোশক্তি সব মিলিয়ে ব্যতিক্রমী মাত্রা যোগ হয়। দামিনীর মতো সাধারণ নারীর মধ্যে অসাধারণ সত্তা আর দীপ্তির বিকাশ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গভীর চিন্তার দুর্জয় সাহসের এক অনবদ্য সৃষ্টি। সমাজ প্রচলিত নিয়মশৃঙ্খলার বিপরীতে বিধবা নিঃসঙ্গ এক নারীর স্বাতন্ত্রীক চৈতন্য, প্রথাকে ভেঙ্গে ফেলার নির্ভীক মানসিকতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিপ্লবী মননের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য।

চতুরঙ্গ উপন্যাসের দামিনী চরিত্র

‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের দুই নারী চরিত্র— ননিবালা এবং মূল শিকড়ে গাঁথা দামিনী। ননিবালা সাধারণ, স্বাভাবিক নারী। আর দামিনী সেই তুলনায় বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের এক অবিচলিত শক্তি। প্রচলিত প্রথা বিদ্বেষী এক বিক্ষুব্ধ নারী যাকে কোন সমাজ সংস্কারের নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ করা যায় না। গতানুগতিক সামাজিক রক্ষণশীলতাকে দাপটের সঙ্গে অস্বীকার করে নিজের স্বাধীন সত্তাকে প্রবল উদ্যোমে জিইয়ে রাখা দামিনী নতুন দিগন্তের এক প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা। বৈধব্য সমাজের প্রাচীনতম বিধির এক নিষ্ঠুর প্রথা। যে প্রথার শিকার ননিবালা। পরিণতিতে অবৈধ মাতৃত্বের অভিশাপ। শেষ অবধি আত্মহননের পথে অনন্ত যাত্রা। নারীর মাঙ্গলিক রূপের আধার ননিবালা লেখকের সৃষ্টি কল্পনায় হয়ে ওঠে শুদ্ধ এক প্রতিমা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়— ‘নিতান্ত কচি মুখ, অল্প বয়স, সে মুখে কলঙ্কের কোন চিহ্ন পড়ে নাই। ফুলের উপর ধুলা লাগিলেও যেমন তার আন্তরিক সূচিতা দূর হয় না। তেমনি এই শিরীষ ফুলের মতো মেয়েটির ভেতরকার পবিত্রতার লাবণ্য তো ঘোচে নাই।’ নারী সৌন্দর্যের পূজারী রবীন্দ্রনাথ নারীর শুভমূর্তির ব্যত্যয় ঘটাতে চাননি। ঘটনার টানাপোড়েনে নারী লাঞ্ছিত হয়, ধিকৃত হয়, সমাজ পরিত্যক্ত হয়। কিন্তু তিনি তার সৃজনশীল দ্যোতনায় ও মানবিক মূল্যবোধে যতখানি সম্ভব নারী জাতির অসম্মান কিংবা অমর্যাদা কখনও করেননি।

অদমনীয় দামিনীকে রবীন্দ্রনাথ যে সযত্ন পরশ আর আন্তরিক সৌন্দর্যে মূর্ত করে তোলেন সেখানেও আমরা স্বাধীনচেতা, অধিকার সচেতন, সঙ্কল্পবদ্ধ নারীর প্রতি তাঁর সংবেদনশীল অনুভূতির স্পষ্ট প্রকাশ প্রত্যক্ষ করি। দামিনীর দৃঢ় ব্যক্তিত্ব, সঙ্কল্পে অবিচলতা, প্রতিবাদী চেতনা ঔপন্যাসিক শৈল্পিক তুলিতে আরও উজ্জ্বল হয়, প্রাণবন্ত হয়, নতুন কিরণ ছড়ায়। তিনি বলেন— ‘দামিনী যেন শ্রাবণের মেঘের ভেতরকার দামিনী। বাহিরে সে পুঞ্জ পুঞ্জ যৌবনে পূর্ণ; অন্তরে চঞ্চল আগুন ঝিকমিক করিয়া উঠিতেছে।’ স্বামীর বর্তমানে আশ্রম গুরুকে উপেক্ষা করা, ধর্মাশ্রিত সমাজের কোন বিধিনিষেধকে তোয়াক্কা না করা দামিনীর স্বভাবজাত। সে শুধু বিদ্রোহীই নয়, একেবারে বিপ্লবী। ঠাণ্ডা মাথায়, ধীরস্থিরভাবে পুরুষ শাসিত সমাজের কঠোর শাসন-শোষণকে দর্পভরে অস্বীকার করে। মেয়ে হলেও মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকার তারও আছে। নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছে, আশা-আকাক্সক্ষা প্রকাশের স্বাধীনতা থাকাও বাঞ্ছনীয়। স্বামীর মৃত্যুর পর সেও পারিবারিক সম্পত্তি আশ্রম গুরুর কাছে সমর্পিত হয়। 

বিধবা দামিনী হয়ে ওঠে আরও জেদী, তেজী। নিজেকে বাঁচাতে চারপাশে যে দুর্ভেদ্য দুর্গ গড়ে তোলে সেখানে কোন পুরুষেরই প্রবেশের অধিকার ছিল না। স্বামী শিবতোষ আমৃত্যু দামিনীকে না নিজের প্রতি না গুরুর প্রতি পূজায়, নিবেদনে আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়। অদম্য দামিনীকে কোনভাবেই বশ করা যায় না। বিদ্রোহী দামিনী বৈধব্যের কোন জ্বালা সইতে পারে না। তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোন সর্বনাশকে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি; বিপথগামীও হয়নি। যদিও অশুভ হাতছানি ছিল পদে পদে। স্বামীজির কোন উপদেশ, নির্দেশ, বিধিনিষেধ অকারণে, অপ্রয়োজনে কখনও মানেনি।

দুঃসাহসী, নির্ভীক, স্বাধীনচেতা দামিনী শচীশকেই ভালবেসে সবকিছু সমর্পণ করতে চায়। শচীশের উপেক্ষা, অবহেলায়ও সে দমে যায়নি। এমন অজেয় দামিনীকে গুরুজীও জয় করতে ব্যর্থ হয়। শচীশ-দামিনীর টানাপোড়েনে মাঝপথে উপস্থিত হয় শ্রীবিলাস। শেষ পর্যন্ত শ্রীবিলাসই দামিনীর চাওয়া-পাওয়া, আশা-আনন্দের একমাত্র সঙ্গী হয়। আরাধ্য দেবতা শচীশকে না পেয়ে শ্রীবিলাসের নির্মোহ ভালবাসার কাছে নিজেকে নিবেদন করে। এ ব্যাপারে প্রচলিত সমাজ তাদের পথ রোধ করতে পারেনি। দামিনীর স্রষ্টাই তাকে এমন দাপটী, অহঙ্কারী, দুর্দমনীয় করে গড়ে তোলে। সমাজবহির্ভূত বিধবার এমন প্রেম নারী স্বাধীনতার উজ্জ্বল দীপ্তি। শুধু তাই নয় প্রেমের এমন নির্মল ও নির্মোহ আবেগ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টি সম্ভারের এক অমূল্য সম্পদ।

সমাজের কঠিন সংস্কারের বিরুদ্ধে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধে উদ্বুদ্ধ দামিনী তার চারপাশে বিদ্রোহের যে বহ্নিশিখা প্রজ্বলিত করে সেখানে তাকে দাহ হতে হয়নি। বরং সেই জ্বলন্ত শিখার আলো তাকে বাঁচার পথ দেখায় এবং সে নিজের মতো করে বাঁচেও। দামিনীর এই স্বাধীন পথ চলা অত সহজ আর নির্বিঘ্নে ছিল না। প্রতিপক্ষ শক্তির জোর ছিল অনেক বেশি। সমাজ তাকে বলি দেয়ার জন্যও তৈরি ছিল। শ্রীবিলাসের একটি উক্ত স্মরণ করলেই বোঝা যাবে প্রচলিত সামাজিক সংস্কার কতখানি নির্মম আর নিষ্ঠুর ছিল। শাস্ত্রে নাকি স্ত্রী পশুবলি নিষেধ আছে। আর সভ্য মানুষের সমাজে সেই স্ত্রীলোকরাই যুগে যুগে বলির শিকার হয়েছে। আপন ইচ্ছেয়, শ্রীবিলাসের সম্মতিতে তাকে বিয়ে করাও দামিনীর উদ্দীপ্ত শিখার অম্লান দ্যুতি। এখানেও দামিনী নবযুগের একজন সাহসী পথিক।

সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে, আত্মীয়স্বজনের বন্ধন ছিন্ন করে শ্রীবিলাসের সঙ্গে নতুন জীবন শুরু করা দামিনী আপন বৈশিষ্ট্য, দীপ্ত মনোবল আর স্বাতন্ত্রিক বোধে অপ্রতিরোধ্য থাকে।

শেষকথা

‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসজুড়ে ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আধুনিক মনন, সময়কে ধরার দীপ্ত চেতনা তার চেয়েও বেশি পিছিয়ে পড়া নারীকে আলোকিত পথে নিয়ে আসা পরিবর্তিত ধারার নতুন সংযোজন। চারটি প্রধান চরিত্রে আছে সামাজিক অভিশাপ থেকে শুধু নিজেকে মুক্ত করা নয় পারিপার্শ্বিক বলয়কে ও গতানুগতিক অপসংস্কার থেকে সুচিন্তিত এবং নির্ভীক বোধে বের করে আনাও। সেই শৈল্পিক শৈলীতে নির্মিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই যুগান্তকারী এবং ভিন্নমাত্রার উপন্যাস ‘চতুরঙ্গ’। সময়ের যৌক্তিক আহ্বান, নারীচেতনায় সুদূরপ্রসারী বলিষ্ঠ প্রত্যয় সর্বোপরি প্রথাসিদ্ধ সমাজের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের উদ্দীপ্ত বোধ ‘চতুরঙ্গ’  উপন্যাসের সারবার্তা।

সম্পাদনায়— মু. মিজানুর রহমান মিজান