১২:৪৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

ইউক্রেন সংকট ও বৈশ্বিক হুমকি

এইচ এম তৌফিকুর রহমান
  • প্রকাশ: ০৮:৫১:১৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৭ মার্চ ২০২২
  • / ১০৫৮ বার পড়া হয়েছে

রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট

পৃথিবীতে বেশিরভাগ মানুষ যুদ্ধ এড়িয়ে চললেও, কিছু মানুষ হয়ে থাকেন যুদ্ধ প্রবণ। কেন এটা হয়ে থাকে তা নিয়ে যুগের পর যুগ ধরে গবেষণা করছেন মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী এবং নৃতাত্ত্বিকগণ। 

মানুষ কেন যুদ্ধে জড়ায় এর কিছু সাইকোলজিক্যাল কারণ আছে। ইভোল্যুশনারি সাইকোলজিস্টদের মতে মানুষের ডিএনএ তে এমন কিছু জিন আছে যেগুলো মানুষের যুদ্ধপ্রবণ হওয়ার জন্য দায়ী। নিজের শক্তি প্রদর্শন, আত্মসন্তুষ্টি যেটাকে ইংরেজিতে বলা হয় (Ego Satisfaction) ইত্যাদি কারণেও মানুষ যুদ্ধে জড়ায়। 

এছাড়াও অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি হল কেউ যখন নিজেকে চরম অনিরাপদ মনে করে ঠিক তখনি সে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেকে রক্ষা করতে। রাশিয়ার ক্ষেত্রেও বিষয়টি অনেকটা এমন ছিল। ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হওয়ার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। রাশিয়ার অভিযোগ ছিল ন্যাটোর মাধ্যমে রাশিয়াকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলছে পশ্চিমা বিশ্ব। যদিও পুর্ব ইউরোপে ন্যাটোর পরিধি না বাড়ানোর কথা ছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের। আর তখন থেকেই রাশিয়া নিজেদের অনিরাপদ ভাবতে শুরু করে। যার ফলশ্রুতিতে পুতিনের আদেশে বিশেষ অভিযান পরিচালিত হয় ইউক্রেনে। আর এখন কিয়েভ এর পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিয়েভকে ঘিরে টহল দিচ্ছে রাশিয়ান সেনাবাহিনী। ঠিক কত মানুষ হতাহত হয়েছেন এব্যাপারে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো সঠিক পরিসংখ্যান দিতে পারছে না। সর্বশেষ রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ আলোচানার যে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ইউক্রেনকে তাতে বলা হয়, “ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য হওয়ার ইচ্ছে পরিত্যাগ করতে হবে। এছাড়াও ইউক্রেনকে বেসামরিকীকরণ এর শর্তও মানতে হবে”। অবশ্য এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখান করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলনস্কি। এছাড়াও তিনি জনগণকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে আহ্বান জানিয়েছেন। এর ফল কি হবে এটা অবশ্য অনেকটাই অনুমেয়। যুক্তরাষ্ট্র সাফ জানিয়ে দিয়েছেন ইউক্রেনে তাঁরা তাদের সেনাবাহিনী পাঠাচ্ছেন না। সেনাবাহিনী না পাঠালেও যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র শক্তিগুলো ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠাচ্ছেন। রাশিয়া চায় ইউক্রেন কখনই ন্যাটোর সদস্য হবে না এই ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে হবে ন্যাটোকে। যার ফলশ্রুতিতে ইউক্রেন যদি ন্যাটোর সদস্য না হয় তাহলে রাশিয়ার জন্য তাঁদের কাছাকাছি  কোনো হুমকি থাকছে না।

যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ইতিমধ্যেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে রাশিয়ার বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তির ওপর। কিন্তু প্রথম কয়েকদিনে সামরিক সহায়তা প্রদানে অস্বীকৃতি জানানোয় জেলনস্কি চরম হতাশা প্রকাশ করেছিলেন। পরে অবশ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহ বাকিরা সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন। রাশিয়া যা করছে সে ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে, “বউকে মেরে ঝিঁ কে শেখানো”। কেননা, এর মাধ্যমে রাশিয়া সারা বিশ্বকে, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বকে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করতে চায়। যেখানে অনেকটাই সফল রাশিয়া। কেননা, সাম্প্রতিক কালের আফগানিস্তান যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র সহসাই  কোনো যুদ্ধে জড়াবেনা এটাই স্বাভাবিক। কেননা, আফগানিস্তান সহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধের ফলে আর্থিক এবং ইমেজ সংকটে আছে আমেরিকা। নতুন  কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে এই সংকট আরো তরান্বিত করতে চায়না বাইডেন প্রশাসন। এছাড়াও করোনার প্রভাবতো আছেই। এমন ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে রাশিয়া বিশ্ব মোড়লের স্থানটি পাকাপোক্ত করতে চায় এই যুদ্ধের মাধ্যমে। 

কতটা প্রভাব পড়বে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের? 

মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার অনেক দেশে বহু বছর যাবত যুদ্ধ চলে আসলেও বিশ্ব এতটা আঁচ অনুভব করেনি, যতটা অনুভব করছে সাম্প্রতিক কালের রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে। এর অন্যতম কারণ রাশিয়ার মত একটি দেশ যুদ্ধে জড়ানোয় টান পড়েছে সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে। অর্থনীতিবিদগণ বলছেন এর প্রভাবে বিশ্বের প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক নয় শতাংশ কমে যেতে পারে। যা সারা বিশ্বের মানুষের জন্যই ভালো কিছু বয়ে আনছেনা এটা হলফ করেই বলা যায়। 

শুধু অর্থনীতি নয় মানুষের জীবনও হুমকির মুখে পড়ছে। বৃহস্পতিবার ভোরে যে হামলা শুরু করেছে রাশিয়া তাতে ঠিক কত মানুষের প্রাণহানি হয়েছে তা সঠিকভাবে বলতে পারছে না আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো। 

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব সারা বিশ্বের ওপর পড়ার অন্যতম কারণ জ্বালানি তেল। 

কেননা, বিশ্বের জ্বালানি তেল রপ্তানিতে রাশিয়া দ্বিতীয়। যার ফলে গত সাত বছরের মধ্যে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১১০ ডলার ছাড়িয়েছে। যা ধনী দেশগুলোর জন্য যতটা না অশনিসংকেত তারচেয়ে বরং বহুগুণে ক্ষতির সংকায় রয়েছে স্বল্প আয়ের দেশগুলো। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এর প্রভাব সার্বিক পরিবহন সেক্টরের ওপর পড়েছে। ফলে খাদ্যপণ্য সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম হু হু করে বাড়ছে। এছাড়াও বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই শেয়ারবাজার দরপতনের মধ্যে পড়েছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। 

তবে এখানে প্রশ্ন উঠছে ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমারা যতটা সরব, ঠিক ততটাই নিরব মধ্যপ্রাচ্যে। যুগের পর যুগ মুসলমানরা,সেখানে মার খেলেও অনেকটা দর্শকের ভূমিকায় তাঁরা। বিশেষ করে ঈসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে। যা তাদের দ্বৈতনীতির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। 

বাংলাদেশের ওপর ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব

বাংলাদেশের প্রধান শক্তি তৈরী পোশাক শিল্প। ইউক্রেন ও রাশিয়া বাংলাদেশের বড় মার্কেট। যুদ্ধের ফলে সেসব দেশের লোকজনের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাবে। যার ফলে পোশাক রপ্তানিও কমে যেতে পারে। এছাড়াও যেসব চুক্তি আগে থেকে রয়েছে সেসব ঠিকঠাক রপ্তানির জন্য পর্যাপ্ত পরিবহন সেবা পাওয়া যাচ্ছেনা। এদিকে যুদ্ধের কারণে বেড়ে গিয়েছে জাহাজের পরিবহন খরচ। এছাড়াও আমাদের দেশের জনগণের ওপর এমনিতেই আগে থেকেই দ্রব্যমূল্যের উচ্চমূল্যের খড়গ রয়েছেই। তাতে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে আমাদের অভ্যন্তরীণ পণ্য পরিবহনে এর প্রভাব পড়ছে। দিনশেষে আরও বেড়ে যাচ্ছে আমাদের দৈনন্দিন খরচ।

এবার আসা যাক আমদানির ওপর কি প্রভাব পড়ছে!

বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল, ভোজ্য তেল এবং গ্যাস আমদানি করে থাকে। এছাড়াও, ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয়ই ভুট্টা ও সূর্যমূখী তেলের বড় সরবরাহকারী। তাঁদের যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশকে এসব পণ্যের জন্য ভিন্ন উৎস খুঁজতে হচ্ছে। যাতে খরচ বেড়ে যাবে বলে আশংকা করছেন ব্যবসায়ীরা। যাতে আমাদের দেশের সার্বিক প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলবে। এছাড়াও নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে বিশ্ব এটা অনুমান করা যাচ্ছে। বড় অর্থনীতির দেশগুলো যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে রাশিয়ার ওপর তাতে ছোট দেশগুলোর চিন্তা মাথায় রাখা হয়নি। হিসাব করা হয়নি কতটা প্রভাব পড়বে তৃতীয় বিশ্বের ওপর। অর্নৈতিক সংকট ছাড়াও বাংলাদেশ একটি কূটনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া মুক্তিযুদ্ধের সময়কার স্মৃতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁদের পাশে চাচ্ছে বাংলাদেশকে। অপরপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র সহ মিত্র দেশগুলো চাচ্ছে বাংলাদেশ যেন রাশিয়ার এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিন্দা জানায় এবং তাঁদের পক্ষালম্বন করে। এ যেন নতুন সংকট, আরেকটি নতুন বিশ্ব যুদ্ধের দামামা। বাংলাদেশকে প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হবে ভেবেচিন্তে। যে-কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল বিবেচনা করে। কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলে, হয়ত যুদ্ধ শেষ হবে কিন্তু কূটনৈতিক প্রভাব পড়বে দীর্ঘমেয়াদিভাবে বাংলাদেশের ওপর। কয়েকদিনের যুদ্ধে এক লাখের বেশি মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। জাতিসংঘ বলছে দীর্ঘায়িত হলে এ যুদ্ধের উদ্বাস্তু সংখ্যা দাঁড়াবে ৫০ লাখের ওপরে। যা কখনোই কাম্য নয়।

তাই যেখানে ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী সেখান থেকে অবশ্যই বিশ্বকে পিছিয়ে আসতে হবে। ইউক্রেন ও রাশিয়াকে নিবৃত করতে হবে এই যুদ্ধ থেকে সঠিক কুটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে। শুধু ইউক্রেন বা রাশিয়া নয়, এই যুদ্ধ যদি আরো দীর্ঘায়িত হয় তাহলে বড়ো ধরনের সংকটে পুরো বিশ্ব।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

এইচ এম তৌফিকুর রহমান

শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

ইউক্রেন সংকট ও বৈশ্বিক হুমকি

প্রকাশ: ০৮:৫১:১৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৭ মার্চ ২০২২

পৃথিবীতে বেশিরভাগ মানুষ যুদ্ধ এড়িয়ে চললেও, কিছু মানুষ হয়ে থাকেন যুদ্ধ প্রবণ। কেন এটা হয়ে থাকে তা নিয়ে যুগের পর যুগ ধরে গবেষণা করছেন মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী এবং নৃতাত্ত্বিকগণ। 

মানুষ কেন যুদ্ধে জড়ায় এর কিছু সাইকোলজিক্যাল কারণ আছে। ইভোল্যুশনারি সাইকোলজিস্টদের মতে মানুষের ডিএনএ তে এমন কিছু জিন আছে যেগুলো মানুষের যুদ্ধপ্রবণ হওয়ার জন্য দায়ী। নিজের শক্তি প্রদর্শন, আত্মসন্তুষ্টি যেটাকে ইংরেজিতে বলা হয় (Ego Satisfaction) ইত্যাদি কারণেও মানুষ যুদ্ধে জড়ায়। 

এছাড়াও অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি হল কেউ যখন নিজেকে চরম অনিরাপদ মনে করে ঠিক তখনি সে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেকে রক্ষা করতে। রাশিয়ার ক্ষেত্রেও বিষয়টি অনেকটা এমন ছিল। ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হওয়ার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। রাশিয়ার অভিযোগ ছিল ন্যাটোর মাধ্যমে রাশিয়াকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলছে পশ্চিমা বিশ্ব। যদিও পুর্ব ইউরোপে ন্যাটোর পরিধি না বাড়ানোর কথা ছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের। আর তখন থেকেই রাশিয়া নিজেদের অনিরাপদ ভাবতে শুরু করে। যার ফলশ্রুতিতে পুতিনের আদেশে বিশেষ অভিযান পরিচালিত হয় ইউক্রেনে। আর এখন কিয়েভ এর পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিয়েভকে ঘিরে টহল দিচ্ছে রাশিয়ান সেনাবাহিনী। ঠিক কত মানুষ হতাহত হয়েছেন এব্যাপারে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো সঠিক পরিসংখ্যান দিতে পারছে না। সর্বশেষ রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ আলোচানার যে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ইউক্রেনকে তাতে বলা হয়, “ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য হওয়ার ইচ্ছে পরিত্যাগ করতে হবে। এছাড়াও ইউক্রেনকে বেসামরিকীকরণ এর শর্তও মানতে হবে”। অবশ্য এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখান করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলনস্কি। এছাড়াও তিনি জনগণকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে আহ্বান জানিয়েছেন। এর ফল কি হবে এটা অবশ্য অনেকটাই অনুমেয়। যুক্তরাষ্ট্র সাফ জানিয়ে দিয়েছেন ইউক্রেনে তাঁরা তাদের সেনাবাহিনী পাঠাচ্ছেন না। সেনাবাহিনী না পাঠালেও যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র শক্তিগুলো ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠাচ্ছেন। রাশিয়া চায় ইউক্রেন কখনই ন্যাটোর সদস্য হবে না এই ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে হবে ন্যাটোকে। যার ফলশ্রুতিতে ইউক্রেন যদি ন্যাটোর সদস্য না হয় তাহলে রাশিয়ার জন্য তাঁদের কাছাকাছি  কোনো হুমকি থাকছে না।

যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ইতিমধ্যেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে রাশিয়ার বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তির ওপর। কিন্তু প্রথম কয়েকদিনে সামরিক সহায়তা প্রদানে অস্বীকৃতি জানানোয় জেলনস্কি চরম হতাশা প্রকাশ করেছিলেন। পরে অবশ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহ বাকিরা সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন। রাশিয়া যা করছে সে ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে, “বউকে মেরে ঝিঁ কে শেখানো”। কেননা, এর মাধ্যমে রাশিয়া সারা বিশ্বকে, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বকে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করতে চায়। যেখানে অনেকটাই সফল রাশিয়া। কেননা, সাম্প্রতিক কালের আফগানিস্তান যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র সহসাই  কোনো যুদ্ধে জড়াবেনা এটাই স্বাভাবিক। কেননা, আফগানিস্তান সহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধের ফলে আর্থিক এবং ইমেজ সংকটে আছে আমেরিকা। নতুন  কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে এই সংকট আরো তরান্বিত করতে চায়না বাইডেন প্রশাসন। এছাড়াও করোনার প্রভাবতো আছেই। এমন ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে রাশিয়া বিশ্ব মোড়লের স্থানটি পাকাপোক্ত করতে চায় এই যুদ্ধের মাধ্যমে। 

কতটা প্রভাব পড়বে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের? 

মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার অনেক দেশে বহু বছর যাবত যুদ্ধ চলে আসলেও বিশ্ব এতটা আঁচ অনুভব করেনি, যতটা অনুভব করছে সাম্প্রতিক কালের রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে। এর অন্যতম কারণ রাশিয়ার মত একটি দেশ যুদ্ধে জড়ানোয় টান পড়েছে সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে। অর্থনীতিবিদগণ বলছেন এর প্রভাবে বিশ্বের প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক নয় শতাংশ কমে যেতে পারে। যা সারা বিশ্বের মানুষের জন্যই ভালো কিছু বয়ে আনছেনা এটা হলফ করেই বলা যায়। 

শুধু অর্থনীতি নয় মানুষের জীবনও হুমকির মুখে পড়ছে। বৃহস্পতিবার ভোরে যে হামলা শুরু করেছে রাশিয়া তাতে ঠিক কত মানুষের প্রাণহানি হয়েছে তা সঠিকভাবে বলতে পারছে না আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো। 

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব সারা বিশ্বের ওপর পড়ার অন্যতম কারণ জ্বালানি তেল। 

কেননা, বিশ্বের জ্বালানি তেল রপ্তানিতে রাশিয়া দ্বিতীয়। যার ফলে গত সাত বছরের মধ্যে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১১০ ডলার ছাড়িয়েছে। যা ধনী দেশগুলোর জন্য যতটা না অশনিসংকেত তারচেয়ে বরং বহুগুণে ক্ষতির সংকায় রয়েছে স্বল্প আয়ের দেশগুলো। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এর প্রভাব সার্বিক পরিবহন সেক্টরের ওপর পড়েছে। ফলে খাদ্যপণ্য সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম হু হু করে বাড়ছে। এছাড়াও বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই শেয়ারবাজার দরপতনের মধ্যে পড়েছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। 

তবে এখানে প্রশ্ন উঠছে ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমারা যতটা সরব, ঠিক ততটাই নিরব মধ্যপ্রাচ্যে। যুগের পর যুগ মুসলমানরা,সেখানে মার খেলেও অনেকটা দর্শকের ভূমিকায় তাঁরা। বিশেষ করে ঈসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে। যা তাদের দ্বৈতনীতির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। 

বাংলাদেশের ওপর ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব

বাংলাদেশের প্রধান শক্তি তৈরী পোশাক শিল্প। ইউক্রেন ও রাশিয়া বাংলাদেশের বড় মার্কেট। যুদ্ধের ফলে সেসব দেশের লোকজনের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাবে। যার ফলে পোশাক রপ্তানিও কমে যেতে পারে। এছাড়াও যেসব চুক্তি আগে থেকে রয়েছে সেসব ঠিকঠাক রপ্তানির জন্য পর্যাপ্ত পরিবহন সেবা পাওয়া যাচ্ছেনা। এদিকে যুদ্ধের কারণে বেড়ে গিয়েছে জাহাজের পরিবহন খরচ। এছাড়াও আমাদের দেশের জনগণের ওপর এমনিতেই আগে থেকেই দ্রব্যমূল্যের উচ্চমূল্যের খড়গ রয়েছেই। তাতে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে আমাদের অভ্যন্তরীণ পণ্য পরিবহনে এর প্রভাব পড়ছে। দিনশেষে আরও বেড়ে যাচ্ছে আমাদের দৈনন্দিন খরচ।

এবার আসা যাক আমদানির ওপর কি প্রভাব পড়ছে!

বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল, ভোজ্য তেল এবং গ্যাস আমদানি করে থাকে। এছাড়াও, ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয়ই ভুট্টা ও সূর্যমূখী তেলের বড় সরবরাহকারী। তাঁদের যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশকে এসব পণ্যের জন্য ভিন্ন উৎস খুঁজতে হচ্ছে। যাতে খরচ বেড়ে যাবে বলে আশংকা করছেন ব্যবসায়ীরা। যাতে আমাদের দেশের সার্বিক প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলবে। এছাড়াও নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে বিশ্ব এটা অনুমান করা যাচ্ছে। বড় অর্থনীতির দেশগুলো যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে রাশিয়ার ওপর তাতে ছোট দেশগুলোর চিন্তা মাথায় রাখা হয়নি। হিসাব করা হয়নি কতটা প্রভাব পড়বে তৃতীয় বিশ্বের ওপর। অর্নৈতিক সংকট ছাড়াও বাংলাদেশ একটি কূটনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া মুক্তিযুদ্ধের সময়কার স্মৃতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁদের পাশে চাচ্ছে বাংলাদেশকে। অপরপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র সহ মিত্র দেশগুলো চাচ্ছে বাংলাদেশ যেন রাশিয়ার এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিন্দা জানায় এবং তাঁদের পক্ষালম্বন করে। এ যেন নতুন সংকট, আরেকটি নতুন বিশ্ব যুদ্ধের দামামা। বাংলাদেশকে প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হবে ভেবেচিন্তে। যে-কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল বিবেচনা করে। কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলে, হয়ত যুদ্ধ শেষ হবে কিন্তু কূটনৈতিক প্রভাব পড়বে দীর্ঘমেয়াদিভাবে বাংলাদেশের ওপর। কয়েকদিনের যুদ্ধে এক লাখের বেশি মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। জাতিসংঘ বলছে দীর্ঘায়িত হলে এ যুদ্ধের উদ্বাস্তু সংখ্যা দাঁড়াবে ৫০ লাখের ওপরে। যা কখনোই কাম্য নয়।

তাই যেখানে ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী সেখান থেকে অবশ্যই বিশ্বকে পিছিয়ে আসতে হবে। ইউক্রেন ও রাশিয়াকে নিবৃত করতে হবে এই যুদ্ধ থেকে সঠিক কুটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে। শুধু ইউক্রেন বা রাশিয়া নয়, এই যুদ্ধ যদি আরো দীর্ঘায়িত হয় তাহলে বড়ো ধরনের সংকটে পুরো বিশ্ব।