০৩:১৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

কীভাবে লুই পাস্তুর জলাতঙ্কের টিকা আবিষ্কার করেন?

অনির্বাণ জানা
  • প্রকাশ: ০১:৫২:৩২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২২
  • / ৪৪৭০ বার পড়া হয়েছে

লুই পাস্তুর

লুই পাস্তুর জলাতঙ্কের টিকা আবিষ্কার করেন ১৯৮৫ সালে। কিন্তু কীভাবে লুই পাস্তুর এই জলাতঙ্ক রোগের টিকা আবিষ্কার করেন— এই গল্পই সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো এখানে।

৬ই জুলাই, ১৮৮৫ সাল। ফ্রান্সের এক শহর। নয় বছরের একটা বাচ্চা ছেলেকে বিশ্রীভাবে পাগলা কুকুরে কামড়েছে। পাগলা কুকুরের কামড় থেকে জলাতঙ্ক বা ম্যাড ডগ ডিজিস হয়। আর অনেক লোক মারাও যায়। তাই রাস্তার কুকুরকে এড়িয়ে চলে সবাই। ছেলেটির নাম জোসেফ মেইস্টার। জোসেফের মা কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে নিয়ে গেলেন লুই পাস্তুর (Louis Pasteur ForMemRS) নামে একজনের কাছে। লুই পাস্তুর চিকিৎসক ছিলেন না তবে জলাতঙ্কের ঔষধ নিয়ে গবেষণা করছেন তখন। লুই পাস্তুর তখন বয়স্ক এবং কিছুটা অসুস্থও বটে। তাঁর সেরিব্রাল অ্যাটাকে একপাশ পক্ষাঘাত হয়ে পড়ে গিয়েছিল একবার। কিন্তু লোকে বলে তিনি নাকি জলাতঙ্কের ওষুধ নিয়ে গবেষণা করছেন। জোসেফের মায়ের বিশ্বাস ছিল ছেলেকে বাঁচাতে পারলে তিনিই পারবেন।

তিনি লুই পাস্তুর ১৮২২ সালে পূর্ব ফ্রান্সের ডোলেতে জন্মগ্রহণ করেন। পাস্তুর তিনি কলাবিদ্যায় স্নাতক হওয়ার পর বিজ্ঞানে ডিগ্রি পান ১৮৪০ সালে এবং কেমিস্ট্রির প্রফেসর হন স্ট্রসবার্গ ইউনিভার্সিটিতে। লুই পাস্তুর টারটারিক অ্যাসিড নিয়ে কাজ করতে করতে অণুর মিরর ইমেজ আবিষ্কার করে ফেলেন। তাঁর এই আবিষ্কারের ফলে রসায়নের স্টিরিওকেমিস্ট্রি নামের নতুন একটি শাখাই তৈরি হয়ে গেল। কাজ-পাগল এই মানুষটি এবার আবিষ্কার করলেন চিকেন কলেরার ভ্যাকসিন। তার আগেই কিন্তু তিনি পক্ষাঘাতে কিছুটা শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েছেন তিনি। আগে তো অ্যাসোসিয়েট মেম্বার ছিলেনই, ১৮৮২ সালে ফ্রান্সের ‘অ্যাকাডেমিয়া দে মেডিসিন’ তাঁকে ডাক্তারি সংগঠনের সদস্য করে নেয়। 

যে গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম— জলাতঙ্ক তখন হাজার হাজার প্রাণ নিয়ে নিচ্ছে। আর মৃত্যুও বড়ো যন্ত্রণাদায়ক সে রোগে। জল খেতে গেলেও মাংসপেশিগুলোর সংকোচন হয়। রোগী ছটফট করতে করতে মারা যায়। লুই পাস্তুরের আগ্রহ জাগলো ১৮৮০ সালে, যখন এক পশু চিকিৎসক দুটো র্যাবিস রোগাক্রান্ত কুকুরের লালার নমুনা তাঁকে পাঠালেন। সেই পশু চিকিৎসক কুকুর দুটোকে বাঁচাতে পারেননি। তাঁর আবেদন ছিল আক্রান্ত কুকুরদের জন্য যদি কোনো ওষুধ আবিষ্কার করতে পারেন এই স্বনামধন্য বৈজ্ঞানিক। কিন্তু সময়টা বড়ো মারাত্মক ছিল। তখনকার দিনে লাইসাভাইরাস (Lyssavirus) যে র‍্যাবডোভাইরাস (Rhabdovirus) থেকে জলাতঙ্ক রোগ হয়, সেটা দেখার জন্য উপযুক্ত মাইক্রোস্কোপই ছিল না। লাইসাভাইরাস লম্বায় ০.০০০২ মিমি। তার ওপর ভাইরাসটি জীবন্ত টিস্যু ছাড়া বংশবৃদ্ধি করে না। গবেষণার জন্য পাস্তুরকে মোটামুটি একটা চিড়িয়াখানা বানিয়ে ফেলতে হয়েছিল। সেখানে কুকুর, বাঁদর, খরগোশ- কিনা ছিল! আরো একটা মুশকিলের কথা হলো, আক্রান্ত হবার কয়েকদিন থেকে কয়েকমাস পর পর্যন্ত উপসর্গ দেখা দিতে পারে। ফলে কোন প্রাণী জীবাণু বহন করছে সেটা জানার উপায় ছিল না। ফলে পাস্তুর ও তাঁর সহকারী এমিল রাউ, নিজেরাই যেকোনো মুহূর্তে র্যাবিস আক্রান্ত হয়ে যেতে পারতেন। পাস্তুরের মাথায় ছিল ভ্যাক্সিন তৈরি করার পরিকল্পনা।

সুতরাং, ভাইরাসটাকে যতটা পারা যায় দুর্বল করে নেবার চিন্তাভাবনা তিনি করে নিয়েছিলেন। 

পাস্তুর ও রাউয়ের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনাও ছিল। কারণ, জলাতঙ্কে ভোগা খরগোশের মৃত্যুর সাথে সাথে তার স্পাইনাল কর্ড তাঁরা কাটাছেঁড়া করতেন। অসাবধানে কোনোভাবে নিজের আঙুলে ছুরির খোঁচা লাগলে জলাতঙ্কে মৃত্যু অবধারিত ছিল। স্পাইনাল কর্ডটি নিয়ে প্রথমে পটাসিয়াম হাইড্রক্সাইড দেওয়া ফ্লাস্কে রেখে দেওয়া হতো। পটাসিয়াম হাইড্রক্সাইড জিনিসটাকে শুকনো রাখতো এবং পচনের হাত থেকে রক্ষাও করতো।

প্রথমে পাস্তুর সেটি ১৪ দিন রেখে সেটি জীবিত পশুর ওপর পরীক্ষা করতেন। ১৪ দিন পুরনো হওয়ার ফলে স্পাইনাল কর্ডের ভাইরাসগুলোও দুর্বল হয়ে যেতো। তারপর দেখতেন এই রস কোনো পশুকে জলাতঙ্ক থেকে রক্ষা করতে পারে কিনা। এইভাবে তেরো, বারো, এগারো দিন করে কমাতে কমাতে একেবারে সদ্য কাটা স্পাইনাল কর্ড থেকে রস বার করে ইঞ্জেকশন দিলেন একটি পশুকে। তারপর তার দেহে র‍্যাবিস ভাইরাস ঢুকিয়ে দিলেন। পশুটি বেঁচে গেল। পরীক্ষা সফল।

কিন্তু মানুষের জন্য ভ্যাকসিন কি কাজ করবে? মানুষের ওপর ব্যবহারের উপযুক্ত ভ্যাক্সিনও তৈরি করে ফেললেন। পাস্তুর ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে অনুরোধ রাখলেন, যাতে আক্রান্ত অপরাধীদের ওপর তাঁর ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে পারেন। কেউ পাত্তাই দিল না। এমনকী ব্রাজিলের সম্রাটও তাঁর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেন।

এবার সাধারণ মানুষের কাছে অনুরোধ রাখলেন তিনি। দু’জন এলেন। কিন্তু প্রথম দুটো পরীক্ষাই অসফল। একজন বৃদ্ধ মানুষ, তাকে শুধু একটা ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছিল আর এক যুবতী— যার রোগটা বড়ো বেশি ছড়িয়ে গিয়েছিল। তারপর সেইদিন। জোসেফ মেইস্টারের মা প্রায় পাগলের মতো তার ছেলেকে পাস্তুরের কাছে এনেছিল। অ্যাসিস্ট্যান্ট এমিল রাউ তো জোসেফকে টিকা দেবার ঘোর বিরোধী। আগের দু’জন রোগীই যে মারা গেছে।

কিন্তু পাস্তুর ঠিক করে নিলেন হিসাব অনুযায়ী তেরোটি ইঞ্জেকশনই তিনি বাচ্চাটিকে দেবেন। জোসেফ বেঁচে গেল। উৎসাহিত হয়ে একজন মেষপালককে এরপর ইঞ্জেকশন দিলেন। বেচারাকে বিশ্রীভাবে কুকুরে কামড়েছিল। সে-ও বেঁচে গেল। তারপর বেশ কয়েকজন। পাস্তুর অফিসিয়ালি খবরটিকে প্রকাশ করলেন। চারদিকে হইহই পড়ে গেল। সেই বছরেই ডিসেম্বর মাসে আমেরিকার নিউজার্সি থেকে চারটি বালককে তাঁর কাছে চিকিৎসার জন্য আনা হয়। তাদের জলাতঙ্ক হয় না। ১৮৮৬ সালে পাস্তুর জানালেন, তিনি সঠিকভাবে ৩৫০ জনকে র‍্যাবিস ভ্যাকসিন দিয়েছেন, তার মধ্যে মারা গেছে মাত্র একজন। সারাবিশ্বে ভ্যাকসিন সেন্টার তৈরি হতে লাগলো।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organisation – WHO)-র হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর এই ভ্যাকসিন তিন লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচায়। লুই পাস্তুরের এই আবিষ্কার চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক মাইলফলক হয়ে রয়েছে।

শেয়ার করুন

One thought on “কীভাবে লুই পাস্তুর জলাতঙ্কের টিকা আবিষ্কার করেন?

  1. বিশ্ব আপনার সকাশে ঋণী হয়ে থাকল। যেখানেই থাকুন, স্রষ্টা যেন আপনাকে ভালো রাখেন।

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

অনির্বাণ জানা

ভারতীয় চিকিৎসক

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

কীভাবে লুই পাস্তুর জলাতঙ্কের টিকা আবিষ্কার করেন?

প্রকাশ: ০১:৫২:৩২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২২

লুই পাস্তুর জলাতঙ্কের টিকা আবিষ্কার করেন ১৯৮৫ সালে। কিন্তু কীভাবে লুই পাস্তুর এই জলাতঙ্ক রোগের টিকা আবিষ্কার করেন— এই গল্পই সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো এখানে।

৬ই জুলাই, ১৮৮৫ সাল। ফ্রান্সের এক শহর। নয় বছরের একটা বাচ্চা ছেলেকে বিশ্রীভাবে পাগলা কুকুরে কামড়েছে। পাগলা কুকুরের কামড় থেকে জলাতঙ্ক বা ম্যাড ডগ ডিজিস হয়। আর অনেক লোক মারাও যায়। তাই রাস্তার কুকুরকে এড়িয়ে চলে সবাই। ছেলেটির নাম জোসেফ মেইস্টার। জোসেফের মা কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে নিয়ে গেলেন লুই পাস্তুর (Louis Pasteur ForMemRS) নামে একজনের কাছে। লুই পাস্তুর চিকিৎসক ছিলেন না তবে জলাতঙ্কের ঔষধ নিয়ে গবেষণা করছেন তখন। লুই পাস্তুর তখন বয়স্ক এবং কিছুটা অসুস্থও বটে। তাঁর সেরিব্রাল অ্যাটাকে একপাশ পক্ষাঘাত হয়ে পড়ে গিয়েছিল একবার। কিন্তু লোকে বলে তিনি নাকি জলাতঙ্কের ওষুধ নিয়ে গবেষণা করছেন। জোসেফের মায়ের বিশ্বাস ছিল ছেলেকে বাঁচাতে পারলে তিনিই পারবেন।

তিনি লুই পাস্তুর ১৮২২ সালে পূর্ব ফ্রান্সের ডোলেতে জন্মগ্রহণ করেন। পাস্তুর তিনি কলাবিদ্যায় স্নাতক হওয়ার পর বিজ্ঞানে ডিগ্রি পান ১৮৪০ সালে এবং কেমিস্ট্রির প্রফেসর হন স্ট্রসবার্গ ইউনিভার্সিটিতে। লুই পাস্তুর টারটারিক অ্যাসিড নিয়ে কাজ করতে করতে অণুর মিরর ইমেজ আবিষ্কার করে ফেলেন। তাঁর এই আবিষ্কারের ফলে রসায়নের স্টিরিওকেমিস্ট্রি নামের নতুন একটি শাখাই তৈরি হয়ে গেল। কাজ-পাগল এই মানুষটি এবার আবিষ্কার করলেন চিকেন কলেরার ভ্যাকসিন। তার আগেই কিন্তু তিনি পক্ষাঘাতে কিছুটা শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েছেন তিনি। আগে তো অ্যাসোসিয়েট মেম্বার ছিলেনই, ১৮৮২ সালে ফ্রান্সের ‘অ্যাকাডেমিয়া দে মেডিসিন’ তাঁকে ডাক্তারি সংগঠনের সদস্য করে নেয়। 

যে গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম— জলাতঙ্ক তখন হাজার হাজার প্রাণ নিয়ে নিচ্ছে। আর মৃত্যুও বড়ো যন্ত্রণাদায়ক সে রোগে। জল খেতে গেলেও মাংসপেশিগুলোর সংকোচন হয়। রোগী ছটফট করতে করতে মারা যায়। লুই পাস্তুরের আগ্রহ জাগলো ১৮৮০ সালে, যখন এক পশু চিকিৎসক দুটো র্যাবিস রোগাক্রান্ত কুকুরের লালার নমুনা তাঁকে পাঠালেন। সেই পশু চিকিৎসক কুকুর দুটোকে বাঁচাতে পারেননি। তাঁর আবেদন ছিল আক্রান্ত কুকুরদের জন্য যদি কোনো ওষুধ আবিষ্কার করতে পারেন এই স্বনামধন্য বৈজ্ঞানিক। কিন্তু সময়টা বড়ো মারাত্মক ছিল। তখনকার দিনে লাইসাভাইরাস (Lyssavirus) যে র‍্যাবডোভাইরাস (Rhabdovirus) থেকে জলাতঙ্ক রোগ হয়, সেটা দেখার জন্য উপযুক্ত মাইক্রোস্কোপই ছিল না। লাইসাভাইরাস লম্বায় ০.০০০২ মিমি। তার ওপর ভাইরাসটি জীবন্ত টিস্যু ছাড়া বংশবৃদ্ধি করে না। গবেষণার জন্য পাস্তুরকে মোটামুটি একটা চিড়িয়াখানা বানিয়ে ফেলতে হয়েছিল। সেখানে কুকুর, বাঁদর, খরগোশ- কিনা ছিল! আরো একটা মুশকিলের কথা হলো, আক্রান্ত হবার কয়েকদিন থেকে কয়েকমাস পর পর্যন্ত উপসর্গ দেখা দিতে পারে। ফলে কোন প্রাণী জীবাণু বহন করছে সেটা জানার উপায় ছিল না। ফলে পাস্তুর ও তাঁর সহকারী এমিল রাউ, নিজেরাই যেকোনো মুহূর্তে র্যাবিস আক্রান্ত হয়ে যেতে পারতেন। পাস্তুরের মাথায় ছিল ভ্যাক্সিন তৈরি করার পরিকল্পনা।

সুতরাং, ভাইরাসটাকে যতটা পারা যায় দুর্বল করে নেবার চিন্তাভাবনা তিনি করে নিয়েছিলেন। 

পাস্তুর ও রাউয়ের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনাও ছিল। কারণ, জলাতঙ্কে ভোগা খরগোশের মৃত্যুর সাথে সাথে তার স্পাইনাল কর্ড তাঁরা কাটাছেঁড়া করতেন। অসাবধানে কোনোভাবে নিজের আঙুলে ছুরির খোঁচা লাগলে জলাতঙ্কে মৃত্যু অবধারিত ছিল। স্পাইনাল কর্ডটি নিয়ে প্রথমে পটাসিয়াম হাইড্রক্সাইড দেওয়া ফ্লাস্কে রেখে দেওয়া হতো। পটাসিয়াম হাইড্রক্সাইড জিনিসটাকে শুকনো রাখতো এবং পচনের হাত থেকে রক্ষাও করতো।

প্রথমে পাস্তুর সেটি ১৪ দিন রেখে সেটি জীবিত পশুর ওপর পরীক্ষা করতেন। ১৪ দিন পুরনো হওয়ার ফলে স্পাইনাল কর্ডের ভাইরাসগুলোও দুর্বল হয়ে যেতো। তারপর দেখতেন এই রস কোনো পশুকে জলাতঙ্ক থেকে রক্ষা করতে পারে কিনা। এইভাবে তেরো, বারো, এগারো দিন করে কমাতে কমাতে একেবারে সদ্য কাটা স্পাইনাল কর্ড থেকে রস বার করে ইঞ্জেকশন দিলেন একটি পশুকে। তারপর তার দেহে র‍্যাবিস ভাইরাস ঢুকিয়ে দিলেন। পশুটি বেঁচে গেল। পরীক্ষা সফল।

কিন্তু মানুষের জন্য ভ্যাকসিন কি কাজ করবে? মানুষের ওপর ব্যবহারের উপযুক্ত ভ্যাক্সিনও তৈরি করে ফেললেন। পাস্তুর ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে অনুরোধ রাখলেন, যাতে আক্রান্ত অপরাধীদের ওপর তাঁর ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে পারেন। কেউ পাত্তাই দিল না। এমনকী ব্রাজিলের সম্রাটও তাঁর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেন।

এবার সাধারণ মানুষের কাছে অনুরোধ রাখলেন তিনি। দু’জন এলেন। কিন্তু প্রথম দুটো পরীক্ষাই অসফল। একজন বৃদ্ধ মানুষ, তাকে শুধু একটা ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছিল আর এক যুবতী— যার রোগটা বড়ো বেশি ছড়িয়ে গিয়েছিল। তারপর সেইদিন। জোসেফ মেইস্টারের মা প্রায় পাগলের মতো তার ছেলেকে পাস্তুরের কাছে এনেছিল। অ্যাসিস্ট্যান্ট এমিল রাউ তো জোসেফকে টিকা দেবার ঘোর বিরোধী। আগের দু’জন রোগীই যে মারা গেছে।

কিন্তু পাস্তুর ঠিক করে নিলেন হিসাব অনুযায়ী তেরোটি ইঞ্জেকশনই তিনি বাচ্চাটিকে দেবেন। জোসেফ বেঁচে গেল। উৎসাহিত হয়ে একজন মেষপালককে এরপর ইঞ্জেকশন দিলেন। বেচারাকে বিশ্রীভাবে কুকুরে কামড়েছিল। সে-ও বেঁচে গেল। তারপর বেশ কয়েকজন। পাস্তুর অফিসিয়ালি খবরটিকে প্রকাশ করলেন। চারদিকে হইহই পড়ে গেল। সেই বছরেই ডিসেম্বর মাসে আমেরিকার নিউজার্সি থেকে চারটি বালককে তাঁর কাছে চিকিৎসার জন্য আনা হয়। তাদের জলাতঙ্ক হয় না। ১৮৮৬ সালে পাস্তুর জানালেন, তিনি সঠিকভাবে ৩৫০ জনকে র‍্যাবিস ভ্যাকসিন দিয়েছেন, তার মধ্যে মারা গেছে মাত্র একজন। সারাবিশ্বে ভ্যাকসিন সেন্টার তৈরি হতে লাগলো।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organisation – WHO)-র হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর এই ভ্যাকসিন তিন লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচায়। লুই পাস্তুরের এই আবিষ্কার চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক মাইলফলক হয়ে রয়েছে।