সামাজিক স্তরবিন্যাস সম্পর্কিত মতবাদ
- প্রকাশ: ০৫:৫০:১৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৯ জানুয়ারি ২০২২
- / ৬৫৩৭ বার পড়া হয়েছে
সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানীরা সকল সমাজে স্তরবিন্যাসের উপস্থিতি লক্ষ করেছেন। তাঁদের মতে, আদিম সমাজেও কমবেশি স্তরবিন্যাস ছিল। তবে আদিম সমাজে স্তরবিন্যাসের ধরন ছিল খুব সাধারণ প্রকৃতির। নারী ও পুরুষের মধ্যে, বয়স্ক ও কমবয়সীদের মধ্যে, বিবাহিত ও অবিবাহিতদের মধ্যে সামান্য ভিন্নতা লক্ষণীয়। বিভিন্ন সমাজের একেক রকমের মূল্যবোধের উপর নির্ভর করে ভিন্ন ভিন্ন পদ-মর্যাদার বিষয়টা গড়ে উঠতো ও তার চর্চা করা হতো। মুলত অভিজ্ঞতা, ধর্মীয় জ্ঞান, শিকারে দক্ষতা, বিনিময়ে বা বাণিজ্যে দক্ষতা, সৌন্দর্য্য, দৈহিক গড়ন, নেতৃত্বের ক্ষমতা ইত্যাদির উপর নির্ভর করে একেক সমাজে একেকভাবে স্তরবিন্যাসের সৃষ্টি হয়। কিন্তু এই সামাজিক স্তরবিন্যাস সার্বজনীন কিনা কিংবা এটা সৃষ্টির কারণই বা কী এমন প্রশ্নে সমাজবিজ্ঞানীরা ভিন্নভাবে উত্তর খুঁজেছেন। সমাজে স্তরবিন্যাস কতখানি গুরুত্ব বহন করে এমন বিষয়েও তারা নানা মত পোষণ করেন। এখানে আমরা এমন কিছু দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরব।
ক্রিয়াবাদী দৃষ্টিভঙ্গি
ক্রিয়াবাদীরা মনে করেন সমাজে অনেকটা মানবদেহের মত। মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন আলাদা আলাদা কাজ করে থাকে এবং এর মাধ্যমে সমগ্র মানবদেহে ভারসাম্য তৈরি হয়। ঠিক তেমনি সমাজের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো যদি নিজ নিজ ক্রিয়াগুলো করে তাহলে সমগ্র সমাজে শৃংখলা বজায় থাকবে ও সুষ্ঠুভাবে চলবে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ক্রিয়াবাদী সমাজবিজ্ঞানী কিংসলি ডেভিস এবং উইলবার্ট মুর মনে করেন, সমাজে স্তরবিন্যাসের দরকার রয়েছে। সমাজ অবশ্যই তার সদস্যদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন পদমর্যাদা ভাগ করে দেবে। সমাজের সদস্যরা মেধা ও যোগ্যতা অনুসারেই পুরস্কার, গুরুত্ব, সম্মান ও সামাজিক মর্যাদা ভোগ করবে।
ডেভিস এবং মুর মনে করেন, স্তরবিন্যাস সর্বজনীন এবং সমাজে অসমতার দরকারও রয়েছে। অসমতা আছে বলেই মানুষ এক অবস্থান থেকে আরো উন্নততর অবস্থান তৈরীর চেষ্টা চালায়, তার সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে সচেষ্ট হয়। এর বিপরীতে সমালোচকেরা বলেছেন, মানুষের মধ্যে পদমর্যাদার পরিবর্তন আনতে, উৎসাহ যোগানোর উদ্দেশ্যে অসমতার সৃষ্টি করা হয়েছে এমন যুক্তি যথার্থ নয়। মানুষ তার ব্যক্তিগত সুখের আশায় আত্ম-সন্তুষ্টির জন্য, ব্যক্তিগত মূল্যবোধ থেকেও তার পদমর্যাদা বাড়াতে আগ্রহী হতে পারে। এসব তাড়না থেকেও সে নিরন্তর কাজ করার উৎসাহ পেতে পারে। ক্রিয়াবাদীরা সমালোচনা স্বীকার করেই মনে করেন, সমাজের উচিত যে ধরনের কাজে অধিক পরিশ্রম হয়, দীর্ঘ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয় এমনকি বিপদজনক ধরনের যেসব কাজ রয়েছে সেসব কাজের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখা। এর ফলে মানুষ এ ধরনের কাজে নিযুক্ত হতে উৎসাহ বোধ করবে।
ক্রিয়াবাদীদের বিশ্লেষণ সন্তোষজনক বলে মনে হয় না। এছাড়া যেসব পদমর্যাদা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে মানুষ তা ভোগ করে। যেমন: দাস, সামন্তপ্রভু, প্রচুর পুঁজির মালিকানা— এ ধরনের জীবনব্যাপি অসমতার কারণ কী তার কোনোসন্তোষজনক উত্তর ক্রিয়াবাদীরা দিতে পারেননি।
দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি
কার্ল মার্কসের লেখনী দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির মূলভিত্তি রচনা করেছে। মার্কসের বিশ্লেষণে ইতিহাস হলো শোষক ও শোষিতের মধ্যেকার নিরন্তর সংগ্রামের বাস্তবতা। এই দ্বন্দ্ব তথা সংগ্রাম একটা সময় এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে যখন সমাজ সম্পূর্ণ শ্রেণিহীন সমাজে রূপান্তরিত হবে। এই সংগ্রাম কেবল তখনই থামবে। স্তরবিন্যাসের ব্যাখ্যায় তিনি মনে করেন, সমাজে কেবল দুটি প্রধান শ্রেণিই বিরাজ করছে। এর একটি হলো বুর্জোয়া— যারা সমাজের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটাকেনিয়ন্ত্রণ করছে ও একচ্ছত্র পুঁজির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে এবং অপরটি প্রলেতারিয়েতÑযারা নিরন্তন শোষিত হয়ে চলেছে। বুর্জোয়া হলো সম্পদের মালিক শ্রেণি অন্যদিকে প্রলেতারিয়েত হলো শ্রমিক শ্রেণি । মার্কস কখনোই মনে করেননি যে, স্তরবিন্যাস অনিবার্য ও সর্বজনীন। তাঁর মতে, স্তরবিন্যাস হলো সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থার অনিবার্য পরিণতি।
মার্কসের মতোই সমসাময়িক দ্বান্দ্বিক তাত্ত্বিকেরা মনে করেন যে, সমাজের সীমিত সম্পদ নিয়ে মানুষ তার সম্পদ, পদমর্যাদা ও ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত। মার্কস শ্রেণিদ্বন্দ্বের কথা বলেছেন। পক্ষান্তরে, তাঁর অনুসারীরা তথা দ্বান্দ্বিক তাত্ত্বিকেরা জেন্ডার, নৃগোষ্ঠীগত, বয়স ও অন্যান্য প্রেক্ষিতে পারস্পরিক দ্বন্দ্বের কথা বলেছেন। এর অর্থ হলো সমাজের সর্বস্তরে সম্পদ, পদমর্যাদা ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব তথা লড়াই চলছে— এর একদিকে রয়েছে সুবিধাভোগী শেণি আর বিপরীতে আছে সুবিধাবঞ্চিত তথা শোষিত শেণি। শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত এ দ্বন্দ্ব চলতেই থাকবে।
ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী রাফ ড্যারেনডর্ফ (Ralf Dahrendorf) মার্কসীয় ব্যাখ্যাকে সময়োপযোগী করে আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায় তা দেখিয়েছেন। ড্যারেনডর্ফের মতে, সামাজিক শ্রেণি বলতে এমন কিছু মানুষের সমষ্টি বোঝায় যারা একই ধরনের সম্পর্ক বজায় রেখে চলে। আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীকে উল্লেখ করাতে গিয়ে তিনি দেখিয়েছেন এখানে কেবল পুঁজিপতি বুর্জোয়াই নয় বরং এখানে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক, আইন প্রণেতা, বিচারিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ, সরকারি আমলাগণ এমন অনেকেই আছেন। সুতরাং ক্ষমতাশালী সংখ্যা ও পদমর্যাদাগত অনেকেগুলো ধাপ তৈরি হয়েছে আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজে।
দ্বান্দ্বিক তাত্ত্বিকেরা মনে করেন, আধুনিক ক্ষমতাশালীরা সমাজে কোনো বিশৃংখলা চায় না বরং চায় সমাজ যেন খুব শৃংখলাবদ্ধ ও সুষ্ঠুভাবে চলে যাতে করে তারা নিজেরা তাদের উচ্চ পদমর্যাদা, সুযোগ সংস্কার নিশ্চিন্তে ও নিষ্কন্টকভাবে উপভোগ করতে পারে। তাদের সম্পদ, পদমর্যাদা ও ক্ষমতাকে তারা যে কোন মূল্যে নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষা করতে চায় এবং সে কারণেই তারা যে কোন ধরনের সামাজিক দ্বন্দ্বকে কৌশলে অথবা কঠোর হাতে দমন করতে চায়।
ক্ষমতাবানদের পদমর্যাদা বজায় রাখা ও তা দীর্ঘ সময় ধরে যাতে লালিত পালিত হয় তার একটা উপায় হলো Dominant Ideology (ডমিন্যান্ট আইডিওলজি)। ‘Dominant Ideology’ হলো এমন সব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য তথা বিশ্বাস ও আচার অনুষ্ঠানের সমাহার যা কিনা সমাজের ক্ষমতাবানদের ক্ষমতার চর্চা টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। যেসব রাজা-বাদশারা তাদের রাজসভায় সভাকবি রাখতেন যার কাজই হতো রাজার গুণকীর্তন করে কাব্য রচনা করা। দ্বান্দ্বিক তাত্ত্বিকদের যুক্তি হলো ক্ষমতাবানকে গুরুত্ব দিয়ে আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজেও নাটক, কবিতা ইত্যাদি নানা সাহিত্য রচিত হয় যেগুলোর মূল লক্ষ্য হলো জনগণের মনে শাসক সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করা যাতে জনগণ তাদের সমীহ করে এবং কখনো বিরোধিতা না করে। ধর্ম, শিক্ষা ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে ক্ষমতাবানরা ‘Dominant Ideology’ প্রচার করে ও জনমতের উপর ক্ষমতাবানদের সম্পর্কে ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। অর্থাৎ ক্ষমতাবানরা কেবল সম্পদ ও পদমর্যাদাই নিয়ন্ত্রণ করে না, তারা মানুষের বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান তথা সংস্কৃতিকেও নিয়ন্ত্রণ করে। এখানেই শেষ নয়। সমাজের ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে যদি জনগণের কোনো অংশে কোনো প্রকারে আন্দোলনের আশঙ্কা দেখা দেয় তাহলে ক্ষমতাবানরা নানা পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব স্থানীয়দেরকে তাদের অধীন করে ফেলে এবং আন্দোলনের সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দেয়। শ্রমিক কল্যাণের নামে কিছু সাধারণ আইনের প্রয়োগ করে (যেমন— ন্যূনতম শ্রম মজুরী নির্ধারণ, চিকিৎসা সুবিধা, উৎসব ভাতা ইত্যাদি) তারা শ্রমিকদের আন্দোলনকে নিরুৎসাহিত করে। তবে দ্বান্দ্বিক তাত্ত্বিকেরা মনে করে এ ধরনের আশা দেখিয়ে শ্রমিকদেরকে চিরদিন দমিয়ে রাখা যাবে না। শোষিতরা একদিন জেগে উঠবে, দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবে এবং সমতাভিত্তিক সমাজের দাবী জোরালো হবে। যতদিন শোষিতরা দাবী না তুলছে ততদিন ক্ষমতাবানরা সম্পদ, পদমর্যাদা ও ক্ষমতার উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ চালিয়ে যেতে থাকবে।
সারসংক্ষেপ
বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন রকমের মূল্যবোধের উপর নির্ভর করে ভিন্ন ভিন্ন পদ-মর্যাদার বিষয়টির ভিত্তিতে সামাজিক স্তরবিন্যাস গড়ে উঠছে। ক্রিয়াবাদীরা মনে করেন, সমাজে স্তরবিন্যাসের দরকার রয়েছে। সমাজ অবশ্যই তার সদস্যদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন পদমর্যাদা ভাগ করে দেবে। দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি মনে করে, সামাজিক স্তরায়ন হলো শাসক ও শোষিতের মধ্যেকার নিরন্তর সংগ্রামের বাস্তবতা। এই দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম একটা সময় এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে যখন সমাজ সম্পূর্ণ শ্রেণিহীন সমাজে রূপান্তরিত হবে।
হুসাইন, ই., সাত্তার, মো. আ., রিপন, আ. রা. মু., সরকার, ম. (২০১৭). সমাজবিজ্ঞান: ১ম পত্র. বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়