০৮:৪১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

রিভিউ⚊ ‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ (স্পয়লার-ফ্রি)

পিয়েল রায় পার্থ
  • প্রকাশ: ০৩:৪৫:৩৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ নভেম্বর ২০২১
  • / ১২১৯ বার পড়া হয়েছে

‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ উপন্যাস পড়াকালীন গাঢ় কুয়াশা যেন পর্যালোচককে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছিল। | ছবি: ভূমিপ্রকাশ


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

কোনো এপিক ফ্যান্টাসি বইয়ে লেখক যখন নিজের কাল্পনিক দুনিয়ার বর্ণনা দিয়ে থাকে; সেই বর্ণনার অবলম্বন হিসেবে বেশ কয়েকটি প্রয়োজনীয় নির্ঘণ্ট থাকে। সম্পূর্ণ নতুন কাল্পনিক দুনিয়া তৈরির মোক্ষম ও সূক্ষ্ম একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে— রক্ষা করা। এখন কী রক্ষা করা আর কার থেকে রক্ষা করা; সেই আলোচনা না-হয় বইয়ের ভেতরের জগতের জন্য তোলা থাক। 

ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং, ম্যাজিক সিস্টেম, দুর্বোধ্য ষড়যন্ত্র ও রাজনৈতিক কৌশলের মতো দিকগুলো নিয়ে মূলত এপিক ফ্যান্টাসি লেখা হয়। লেখক এই সব অনুক্রমণিকা পুরো গল্পের বাঁকে বাঁকে ঢুকিয়ে দিয়ে একইসাথে বেদনাদায়ক ও উত্তম স্বাদযুক্ত আবেগের সৃষ্টি করে। সেই সৃষ্টি পাঠক মনে একটা সময়— অজানা এক বিদ্রোহের উৎপত্তি ঘটিয়ে থাকে। ‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ তেমনই এক উপন্যাস; যেখানে পাঠক স্বাদযুক্ত উপাদান, ব্যর্থতার নিদর্শন, বন্ধুত্বের বন্ধন ও ত্যাগের মহিমার আলোকচ্ছটা প্রতিফলিত হয়ে— অনুধাবন করে পুরো সময় জুড়ে। মোহগ্রস্ত সেই দুনিয়ায় নিজেকে তখন বইয়ের কোনো এক পার্শ্বচরিত্র অথবা প্রত্যক্ষদর্শী রূপে বিচার করতে বেশ ভালো লাগে। 

‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ উপন্যাস লেখা হয়েছে বিশাল এক জগতকে কেন্দ্র করে। অথবা সহজ করে বললে, ‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ সেই জগতের একটি অংশ। স্যান্ডারসনের এই জগতকে বলা হয়— কজমেয়ার। মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে, কজমেয়ার মূলত কী? ছোট্ট করে বললে— ব্রান্ডন স্যান্ডারসনের বেশিভাগ চলমান সিরিজগুলো এই কজমেয়ার জগতের অন্তর্ভুক্ত। এই কজমেয়ার সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা বা বিস্তারিত পেতে ঢুঁ মারতে হবে স্যান্ডারসনের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার, রেফারেন্স টেক্সট ও ওয়েবসাইটে। 

এখন আসা যাক ‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ উপন্যাস নিয়ে। চিরাচরিত ফ্যান্টাসির পথ বদলে দেওয়া এই সিরিজের জন্ম ২০০৬ সালের ১৭ জুলাই। কী আছে এই মিস্টবর্ন সিরিজে? স্পয়লার ব্যতীত সংক্ষেপে সেটা আলোচনা করা যাক। 

‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ বইয়ের মূল স্তম্ভ হচ্ছে ফাইনাল এম্পায়ার রাজ্য। যে রাজ্য শাসন করে লর্ড রুলার। শাসনের পারিপার্শ্বিক দিকসমূহ দেখাশোনার দায়িত্ব আছে স্টিল মিনিস্ট্রি। এই মিনিস্ট্রি আবার অবলিগেটর ও ইনকুইজিটর নামে দুই দলে বিভক্ত। অবলিগেটররা সাধারণ মানুষ হলেও প্রতিপত্তির দিক থেকে খুবই ক্ষমতাবান। তাদের কাজ হচ্ছে ব্যাবসাবাণিজ্য, কর আদায়, অভিজাত বংশের বিবাহের ঘটকালি, লর্ড রুলারের নিয়ম-নীতি প্রচার করা। অভিজাত ও স্কা-দের নিয়ন্ত্রণও এদের হাতে। অন্যদিকে ইনকুইজিটররা হচ্ছে ভয়ানক ও পিশাচ জাতীয় জীব। মূলত আইন রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে এরা কাজ করে। যদিও ফাইনাল এম্পায়ারে আলাদাভাবে সেনাবাহিনী রয়েছে।

ফাইনাল এম্পায়ারে সাধারণ মানুষদের বলা হয় স্কা। এই স্কা-দের মধ্যে প্রায়ই মানুষ অভিজাতদের চাকর, খেতখামার ও কারখানার শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। এরা খুবই শোষিত ও নির্যাতিত। আরেকদল স্কা-কে বলা হয় তস্কর। যাদের আমরা চোর বলে আখ্যায়িত করি। এই তস্করা মূলত অভিজাতদের থেকে চুরি ও বাটপাড়ি করে দিনাতিপাত করে। ধরা পড়লে করুণ পরিণতি ভোগ করে ইনকুইজিটরদের হাতে।

এইবার আসা যাক সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং পার্ট মিস্টবর্ন ও মিস্টিং নিয়ে। মিস্টবর্ন ও মিস্টিং কে বা কারা? যেহেতু এই সিরিজের নাম মিস্টবর্ন তাই এই নিয়ে ছোট্ট করে জেনে নেওয়া যাক—মূলত অবলিগেটর বা অভিজাত কোন বংশের লর্ড ও সাধারণ স্কা নারীর অবৈধ সম্পর্কের ফসল হলো মিস্টবর্ন। সহজ ভাষায় যাদের আমরা জারজ বলে ম্যানশন করি। স্যান্ডারসন এই জারজদের রূপ দিয়েছে মিস্টবর্নে। আবার অনেক অভিজাত সন্তানরাও মিস্টবর্ন বা মিস্টিং হতে পারে। তবে সেটা হতে পারে স্ন্যাপ হওয়ার ফলে অথবা চেষ্টার খাতিরে। কেবল অবৈধ সন্তানরা শুধু মিস্টবর্ন বা মিস্টিং হয় না। তাদেরও এই ক্ষমতা সক্রিয় করতে হলে স্ন্যাপ বা গুরুতর কোনো ধাক্কা খাওয়া লাগে।

এই মিস্টবর্নের মধ্যে রয়েছে এক অলৌকিক ক্ষমতা। যে ক্ষমতা ব্যবহার হয় আটটি মৌলিক ধাতু ও দুইটি উচ্চ ধাতুর কার্যকারিতার মাধ্যেম। কী সেই কার্যকারিতা বা ক্ষমতা তা নিয়ে অনুবাদ বইটির শেষে ধারণা রয়েছে।

এই ধাতুর ব্যবহারকারীকে বলা হয় অ্যালোম্যান্সার। যখন একজন ‘অ্যালোম্যান্সার’ কোনো ধাতুকে কাজে লাগিয়ে শক্তির প্রদর্শন করে থাকে সেটাকে বলা হয় ‘অ্যালোম্যান্সি’।  যারা আটটি ধাতুর কার্যকারিতা আয়ত্ত করে কাজ লাগাতে পারে তারাই মিস্টবর্ন। অন্যদিকে মিস্টিং’রা যে-কোনো একটি ধাতু দিয়ে কার্য সিদ্ধি করতে পছন্দ করে।

“ধাতু ব্যবহার করে এই পুশ বা পুল করে চলাটা মোটেও ওড়ার মতো লাগে না, বরং পতনের অনুভূতির মতো লাগে—শুধু সেটা নিচের দিকে না হয়ে উলটোদিকে। সঠিক ভরবেগ পাওয়ার জন্য একজন অ্যালোম্যান্সারকে খুবই শক্তি দিয়ে পুল করতে হয়, আর সেটাই তাকে সবকিছু ভেঙেচুরে অবিশ্বাস্য গতিতে নিক্ষেপ করে তার অবলম্বনের দিকে।” 

‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ উপন্যাসের বাংলা সস্করণের প্রচ্ছদ করেন জুলিয়ান | ছবি: ভূমিপ্রকাশ
‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ উপন্যাসের বাংলা সস্করণের প্রচ্ছদ করেন জুলিয়ান | ছবি: পিয়েল রায় পার্থ

এই উপন্যাস আবর্তিত হয়েছে দুইজন মিস্টবর্ন ঘিরে। এ ছাড়াও রয়েছে আলোচিত কয়েকজন মিস্টিং। যাদের ভূমিকা এই গল্পে অপূরণীয়। তাদের মধ্যকার সম্পর্ক এবং সকলে একত্রিত হওয়ার সংকল্প নিয়ে রচিত হয়েছে জীবনবোধ ও এক স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের গল্প।

আরও একটি জাতি এই উপন্যাসে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে, তারা হচ্ছে—ফেরুকেমিস্ট। এই নিয়ে বিস্তারিত কাহিনি পাবেন উপন্যাসে। যা খুবই চমকপ্রদ ও ভাবনারও বটে। 

আখ্যান

রাতে রাজত্ব করে কুয়াশা…

পুরো বিশ্বই লর্ড রুলারের করায়ত্তে।

প্রায় হাজার বছর ধরে বর্ষিত হচ্ছে ছাই, ফুটছে না কোনো ফুল।

প্রায় হাজার বছর ধরে স্কা-রা লর্ড রুলারের ভয়ে বাস করছে ক্রীতদাসের মতো জঘন্য জীবন। হাজার বছর ধরে, ঈশ্বরের মতোই সবার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে সর্বময় ক্ষমতা আর সীমাহীন আতঙ্ক ছড়িয়ে শাসন করে যাচ্ছে লর্ড রুলার। যার বিরুদ্ধে করা প্রতিটা বিদ্রোহই ব্যর্থ হয়েছে শোচনীয়ভাবে।

কিন্তু তারপরেও বেঁচে থাকে আশা।

এক নতুন ধরনের প্রতিরোধের পরিকল্পনা করা হয়; যেটা নির্ভর করছে এক প্রতিভাবান তস্করের ধূর্ততা আর একজন আপাত অসম্ভাব্য নায়িকার দুঃসাহসের ওপরে, যে কি না রাস্তার এক স্কা-কিশোরী, যাকে একজন মিস্টবর্নের ক্ষমতা “অ্যালোম্যান্সি” শিখে হতে হবে দক্ষ।

কী হবে যদি দৈববাণীতে বলা নায়ক ব্যর্থ হয় ডার্ক লর্ডকে হারাতে? উত্তর পাওয়া যাবে মিস্টবর্ন ট্রিলজিতে, অবাক বিস্ময়ে ভরা এক উপাখ্যান; যা বদলে দিয়েছে চিরাচরিত ফ্যান্টাসির পথ। আর যার সূচনা এই সাড়া জাগানো বই দিয়ে।

মিস্টবর্ন ১ পাঠ প্রতিক্রিয়া ও পর্যালোচনা

‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ উপন্যাস পড়ার সময়ে গাঢ় কুয়াশা যেন আমাকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছিল। সেই কুয়াশার মধ্যে খুলে যাওয়া এক পোর্টালে আমিও চলে গিয়েছি লর্ড রুলারের বিরুদ্ধে স্কা বিদ্রোহের কেন্দ্রস্থল ফাইনাল এম্পায়ারে। দিনের আকাশ থেকে অনবরত পড়তে থাকা ছাই, সেই ছাইয়ে রাস্তার পাশে জমে থাকা স্তুপ, মাথা নিচু করে কাজ করে যাওয়া ক্লান্ত স্কা আর রাতের আঁধারে  অভিজাতদের লালসার শিকারে পরিণত হওয়া নিরুপায় কোনো স্কা নারী—এই যেন আমাদের সমাজের অতি চেনা পরিচিত রূপ। সার্ভাইভার অব হাটসিন খ্যাত কেলিসিয়ের, ধূর্ত তস্কর ভিন, দার্শনিক হ্যাম, বিজ্ঞ ডকসন, চুপচাপ আর রুক্ষ মেজাজের ক্লাবস, দক্ষ মার্শ—এরা যেন অতি পরিচিত কেউ। দর্শন, শাস্ত্র, রাজনীতি, ষড়যন্ত্র এবং সবশেষে যুদ্ধ; পরিকল্পনা গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও ব্যর্থতার শূন্যস্থান পূরণে লেখা ‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ উপন্যাস যেন অদ্ভুত এক মোহগ্রস্ত জগৎ। 

ফাইনাল এম্পায়ার ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং গঠন করা হয়েছে অতি দক্ষতার সাহায্যে। লেখক যে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে নারাজ, তা ওনার বিস্তারিত বর্ণনার মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। খুবই ধীরে, একেবারে কোনো তাড়াহুড়ো ছাড়া পুরো উপন্যাস লেখা হয়েছে। যা একজন ফ্যান্টাসি পাঠক হিসেবে যথাযথ লেগেছে। এই ধীর ও বিস্তারিত বর্ণনার কারণে গল্পের আবহের সাথে মিশে যেতে পেরেছি গভীরভাবে। সূক্ষ্ম কথোপকথন, ম্যাজিক বা অ্যালোম্যান্সি টার্ম বর্ণনা, ইউনিক অ্যাকশন সিকোয়েন্স, গভীর দর্শন, অভিজাতদের চালচলন, স্কা-দের চিন্তাভাবনা, ইনকুইজিটরদের নৃশংসতা-সহ তাত্ত্বিক বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা অনেক সহজ ও সাবলীল লেগেছে। ধৈর্য ও অপেক্ষার মিশ্রণে যদি পুরো উপন্যাস শেষ করা যায়, তাহলে তপ্ত হৃদয়ে এক অন্যরকম প্রশান্তির আবির্ভাব ঘটবে। পুরো উপন্যাসে বুঁদ হয়ে থাকতেও অন্যরকম এক অনুভূতি হচ্ছিল; যেন এই যাত্রা আমার, এই ফাইনাল এম্পায়ারে আমার বসবাস আর বিদ্রোহীরা আমার আপনজন। 

‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ উপন্যাস পড়ার সময়ে গাঢ় কুয়াশা যেন পর্যালোচককে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছিল। | ছবি: ভূমিপ্রকাশ
‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ উপন্যাস পড়ার সময়ে গাঢ় কুয়াশা যেন পর্যালোচককে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছিল। | ছবি: ভূমিপ্রকাশ

স্যান্ডারসন দাদা যে, এই উপন্যাস পড়ার মাধ্যেম আপনাকেও  ‘সুদ’ করে ফেলবে— এই গ্যারান্টি অন্তত দিতে পারি। বাই দ্য ওয়ে, সুদ একটি অ্যালোম্যান্সি। ‘পিতল’ ধাতু পোড়ানোর মাধ্যমে তৈরি হয়। যা আপনার আবেগকে করে দিবে শান্ত। আর ‘সুদ’ যারা করে তাদের বলে ‘সুদার’ (অ্যালোম্যান্স্যার)। 

দ্য ফাইনাল এম্পায়ার গল্পের সূত্রপাত

গল্পের সূত্রপাত লর্ড ট্রেস্টিংয়ের কেল্লা থেকে। যেখানে ফাইনাল এম্পায়ার সম্পর্কে স্বল্প বর্ণনা উঠে আসে ট্রেস্টিং ও আগত অবলিগেটরের কথোপকথন ও দৃশ্যায়নের মাধ্যমে। গল্পের হিরো কেলিসিয়েরের আগমন, কারণ ও কার্য সম্পাদনের মাধ্যমে শুরু হয় এই যাত্রা। এর পরের কাহিনি ঘুরে যায় লুথাডেল শহরের দিকে। যেই শহরে বসবাস লর্ড রুলার-সহ বিভিন্ন অভিজাত পরিবার, শোষিত ও নির্যাতিত স্কা-দের নিয়ে। বাকিটা নিজ দায়িত্ব শুরু করুন… ইহা এক লম্বা যাত্রা হতে যাচ্ছে।

গল্প বুনট

স্যান্ডারসনের গল্পের বুননের প্রশংসা যত বেশি করব তা-ও কম পড়ে যাবে। এত অদ্ভুত সুন্দর গোছানো প্লট খুব কম লেখকের উপন্যাসে দেখা যায়। ফ্যান্টাসিতে ঠিক যেইরকম প্লট একজন পাঠক আশা করবে, ঠিক সেই রকমের উপাদান দিয়ে সাজানো এই উপন্যাসের প্লট। নিখুঁত ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং, সহজ লেখনশৈলী, বিস্তারিত প্রাঞ্জল বর্ণনা, পারফেক্ট চরিত্রায়ন এবং মানানসই সমাপ্তি। 

এত এত কারসাজি চরিত্রদের নিয়ে, গভীর মনস্তত্ত্বত ও হার্ড ম্যাজিক সিস্টেমের সহজ বর্ণনা যেন অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে এই উপন্যাসকে। এই বই পুরো মাখন অথবা বলা যায় পারফেক্ট ডেজার্ট। যদি আপনি পুরো খাবার আয়েশ করে শেষ করতে পারেন তবেই সুস্বাদু ডেজার্টের মর্ম বুঝবেন। 

অনেকটা ‘কাঁসা’ পোড়ানোর মতো। যা করলে শরীরে আলাদা এক শক্তির আভাস পাওয়া যায়। এই বই শেষ করে সেইরকম অনুভূতি ঘিরে ধরবে বলে মনে করি। এই কাঁসা পোড়ানোর প্রক্রিয়া গ্রহণকারীকে বলা হয় ‘পিউটার‌আর্ম বা থাগ’।

লেখনশৈলী

মোলায়েম। সহজ ও আকৃষ্ট করার মতো। এই উপন্যাসে লেখনশৈলীর বেশ কয়েকটি টার্ম রয়েছে। ম্যাজিক সিস্টেম ব্যবহার করে অনুশীলন ও ফাইটিং সিকোয়েন্স, আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে আলাপচারিতা, লেখকের নিজস্ব দর্শন ও বর্ণনা, চরিত্রের আলাদা মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়াকলাপ—সব মিলিয়ে অনেক মিশ্র প্রক্রিয়া থাকার পরেও কোথাও কমতি দেখা যায়নি। অথবা বলা যায়, অহেতুক বা অস্বাস্থ্যকর কোনো বাক্য ঢুকিয়ে গল্পের রেশ কমিয়ে দেয়নি। পুরো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কয়েকটা রেখায় ভাগ হয়ে গেলেও, লেখনশৈলী নির্দিষ্ট রেখার মধ্যে থেকে গিয়েছে। বিচ্যুতি কোনোভাবে ঘটেনি। 

অনেকটা ‘লোহা’ পুড়িয়ে আশেপাশের ধাতুকে টেনে আনার মতোই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা উজ্জ্বল রেখার মধ্যে থেকে নির্দিষ্ট রেখায় কনভার্ট করে নিজের দিকে পুল করার প্রক্রিয়া। এই ধাতু প্রয়োগকারী বা মিস্টিংকে বলে ‘লার্চার’৷ 

বর্ণনাশৈলী

পারিপার্শ্বিক মোহনীয় বর্ণনা, সেটা বাইরের দুর্দশাগ্রস্থ পরিবেশ হোক কিংবা অভিজাতদের আয়োজন করা বল-এর ভেতরকার পরিবেশ। দিনের ছাই পড়া শুকনো রাস্তা অথবা রাতের কুয়াশা ঢাকা ভেজা পথ। সবই যেন এই পৃথিবীর কোন এক দেশের। অথবা নিকটবর্তী কোনো এলাকার পরিচিত  স্থানের গল্প। দৃশ্যায়ন দর্শনে লেখক কোনো কমতি রাখেননি, বিস্তারিত আর প্রাঞ্জল লেখার এই গুণ সত্যি চমকে দেয়। 

একজন লেখকের সার্থকতা ঠিক এইখানে। যে নিজের জগতে অনায়াসে আপনার মনকে বিচরণ করিয়ে দিতে পারে। ঠিক যেন জেগে থেকে স্বপ্ন দেখার মতো। অতুলনীয়। এই বর্ণনাশৈলী আবেগকে উথলে দেয়। ঠিক যেমন করে একজন রায়টার (অ্যালোম্যান্সার) ‘দস্তা’ পুড়িয়ে অন্য কারও আবেগকে উচ্ছলিত করে থাকে। 

চরিত্রায়ন

প্লটের পাশাপাশি পুরো উপন্যাসের চরিত্রের বৃষ্টি নেমেছে। তবে এই বৃষ্টি; একটা সময় ছাই হয়ে উড়ে গিয়েছে। প্রয়োজনীয়, কম প্রয়োজনীয়-সহ বেশ কয়েকটি নির্দিষ্ট চরিত্র আছে পুরো উপন্যাস জুড়ে। অপ্রয়োজনীয় তেমন কাউকে মনে হয়নি। চাইলেও ‘স্টিল’ পুড়িয়ে কাউকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার মতো না। এই স্টিল পোড়ানো অ্যালোম্যান্সারকে বলা হয় ‘কয়েনশট’। আর এই ধাতু; অন্যান্য আট মৌলিক ধাতু থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণও বটে।

যাহোক, ধাতুর আলাপের সাথে এমনিতে চরিত্রদের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সেইদিক থেকে ব্যাখা দেওয়া। চরিত্র নিয়ে আলাদাভাবে বলতে গেলে, প্রথম সারিতে কেলিসিয়ের ও ভিনের নামের অকপটে আসবে। দুজনের কেরামতি ও কারিশমা ভালোই প্রভাব ফেলেছে পুরো ফাইনাল এম্পায়ারে। প্রিয় চরিত্র কে এই নিয়ে বাক-বিতণ্ডা করতে চাই না। তবে এইটুকু নির্দ্বিধায় বলতে পারি, প্রত্যেকটি চরিত্র মনে দাগ টেনে দিয়েছে। 

অবসান

একটি উপন্যাসকে যদি স্বয়ংসম্পূর্ণ ট্যাগ দিতে হয় তাহলে সমাপ্তি এই ক্ষেত্রে ভালোই প্রভাব ফেলে। তবে এই উপন্যাসের ক্ষেত্রে পূর্ণতার সব কয়টি মার্ক অন্তত আমার থেকে পাবে। অনুবাদে ৭৪২ পৃষ্ঠা শেষ করার পর, নিজের রুচিকে তৃপ্ত করার মতো ❛মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার❜ একটা দুর্দান্ত কাহিনি বটে। স্ট্যান্ড অ্যালোন হিসেবে এই বইয়ে আলাদা ভূমিকা রেখেছে। বলা যায়, পূর্ণতা প্রদান করে শুরুটা মাত্র হয়েছে। নতুন আরেকটি অধ্যায়ের শুরু… যা ‘টিন’ পুড়িয়ে ইন্দ্রিয়কে উদীপ্ত করার মতোই। আর এই কাজ করতে পারে শুধুমাত্র একজন ‘টিন‌আই’ (অ্যালোম্যান্স্যার)।

খুচরা আলাপ

উদাহরণস্বরূপ ছয়টা ধাতুর রূপরেখা টানার চেষ্টা করলাম। বাকি মৌলিক দুই ধাতু আর উচ্চ দুই ধাতু এবং বিশেষ এক ধাতুর চমক এখনও দেওয়া হয়ে ওঠেনি। চেয়েছি রিভিউতে ম্যাজিক সিস্টেম বা অ্যালোম্যান্সির ব্যবহার নিয়ে দুয়েকটা ধারণা দিতে। সত্য বলতে পুরো মিস্টবর্নের এই হার্ড ম্যাজিক বা অ্যালোম্যান্সি প্রক্রিয়া অসাধারণ লেগেছে। ধাতু দিয়ে ম্যাজিক; ভাবা যায় তা-ও পেটের ভেতর পুড়িয়ে!

যাহোক, সব জট আমি খুলে দিলে অনেক না পড়া পাঠকদের হয়তো কিছুই খোলার থাকবে না! ওয়েট, এই কথা পুরোপুরি মিথ্যা। আদতে আমি এই বইয়ের মূল কাহিনির সারাংশ শুধু বলেছি কিন্তু কার্যপরম্পরা নিয়ে কিছুই বলেনি। সাসপেন্স আর টুইস্ট তো বহুত পড়ের কথা। ওইসব নিয়ে লিখতে গেলে, লেখা আর থামবে না। তাই শুধু বলব, একজন সহিষ্ণু পাঠক হলেই তবে বইটি হাতে তুলে নিন। নাহয় পরবর্তীতে ১০০ পৃষ্ঠা পড়ে গাঁইগুঁই শুরু করে দিবেন। আমি যদি বলি পুরো বইয়ের ৬০০ পৃষ্ঠা প্লট বিল্ডাপ আর অ্যালোম্যান্সি নিয়ে ধারণা দিয়ে গিয়েছে তাহলে কি বিরক্ত হবেন? হয়েও লাভ নেই, ফ্যান্টাসি বইয়ের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এইটা। 

তাই ঠান্ডা মাথায়, সময় নিয়ে বইটি নিয়ে বসুন। এর পরে হারিয়ে যান ফাইনাল এম্পায়ারের জগতে একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে। 

‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ উপন্যাসের লেখক ও অনুবাদক নিয়ে কিছু কথা

ব্রান্ডন স্যান্ডারসন নিয়ে কোনো কথা হবে না। বস একজনই। আর সর্বদা ওয়ান পিস হয়ে থাকবেন। চিরাচরিত ফ্যান্টাসির পথ বদলে দেওয়া এক বিস্ময়কর কারিগর; যার লেখার মুগ্ধতায় নির্বাক হওয়ার প্রতিক্রিয়া শুধু মানায়।

অনুবাদক অসীম পিয়াস দাদাকে নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। মূল বই পড়লাম না অনুবাদ টের পাইনি। অবশ্য পেতে দেননি বলা যায়। না হয় হাতে গোনা ৩ দিনের কম সময়ে এই দানবাকৃতির বই শেষ করা অসম্ভব বলা যায়। পিয়াস দাদার কাছ থেকে আরও ফ্যান্টাসি বইয়ের অনুবাদ প্রত্যাশা করছি। আশা করছি দ্রুত পেয়ে যাব। এই দারুণ অনুবাদ কর্মকে কোনোভাবে ‘তামা’ পুড়িয়ে লুকিয়ে রাখা সম্ভব না। যতই সে দক্ষ ‘স্মোকার’ হোক। আমরা পাঠকরা ঠিকই ‘ব্রোঞ্জ’ পুড়িয়ে সেটার সন্ধান বের করে ফেলব, একেকজন ‘সিকার’ হয়। 

সম্পাদনা ও বানান

সম্পাদনা বেশ ভালো হয়েছে। তার জন্য ফুয়াদ ভাইকে ধন্যবাদ। দুয়েকটা লাইনে শুধু বাক্যের অসামঞ্জস্য দেখা দিয়েছে। তবে সেটা খুবই সামান্য, নবম ধাতুর মতো। এমনকি বানান ভুলও সেইরকম। তবে দ্বিতীয় সংস্করণে চাইলে সেগুলো ঠিকঠাক করে নেওয়া যাবে। 

প্রচ্ছদ, অলংকরণ, নামলিপি

প্রচ্ছদ দারুণ। নামলিপি দুটো, দুইরকম ফিল দিয়েছে। অলংকরণ বা কয়েকটি চিত্র ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত করে যথাস্থানে ব্যবহার করার কারণে চরিত্র পরিচিতি অনেকটা সহজ হয়েছে। 

মলাট, বাঁধাই, পৃষ্ঠা

পুরো বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৭৫২। ৭৪২ পৃষ্ঠায় কাহিনি শেষ, বাকি ১০ পৃষ্ঠায় আনুষাঙ্গিক বিষয়বস্তু দেওয়া। সত্য কথা বলতে, এই বই আরাম করে পড়া শেষ হয়েছে। ঢাউস সাইজ হওয়া সত্ত্বেও শক্ত মলাট ও মজবুত বাঁধাইয়ের কারণে কোনো অসুবিধার সৃষ্টি হয়নি। এক কথায় প্রোডাকশন কোয়ালিটি দারুণ।

‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ উপন্যাস পড়াকালীন গাঢ় কুয়াশা যেন পর্যালোচককে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছিল। | ছবি: ভূমিপ্রকাশ
‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ উপন্যাস পড়াকালীন গাঢ় কুয়াশা যেন পর্যালোচককে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছিল। | ছবি: ভূমিপ্রকাশ
বইয়ের নামমিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার (মিস্টবর্ন #১)
Mistborn: The Final Empire (Mistborn #1)
লেখকব্রান্ডন স্যান্ডারসন (Brandon Sanderson)
অনুবাদকঅসীম পিয়াস
ধরনএপিক ফ্যান্টাসি (উপন্যাস)
প্রকাশ১৭ জুন, ২০০৬ (প্রথম প্রকাশ)
অক্টোবর, ২০২১ (প্রথম বাংলা অনুবাদ প্রকাশ) 
নামলিপি ও প্রচ্ছদজুলিয়ান
বাংলা সংস্করণের প্রকাশকভূমিপ্রকাশ, ঢাকা
মুদ্রিত মূল্য ১০৫০ টাকা মাত্র
পৃষ্ঠা৭৫২

শেয়ার করুন

One thought on “রিভিউ⚊ ‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ (স্পয়লার-ফ্রি)

  1. Excuse me, but from where did you get that red-brown slipcase? Apparently Rokomari does not provide that

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

রিভিউ⚊ ‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ (স্পয়লার-ফ্রি)

প্রকাশ: ০৩:৪৫:৩৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ নভেম্বর ২০২১

কোনো এপিক ফ্যান্টাসি বইয়ে লেখক যখন নিজের কাল্পনিক দুনিয়ার বর্ণনা দিয়ে থাকে; সেই বর্ণনার অবলম্বন হিসেবে বেশ কয়েকটি প্রয়োজনীয় নির্ঘণ্ট থাকে। সম্পূর্ণ নতুন কাল্পনিক দুনিয়া তৈরির মোক্ষম ও সূক্ষ্ম একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে— রক্ষা করা। এখন কী রক্ষা করা আর কার থেকে রক্ষা করা; সেই আলোচনা না-হয় বইয়ের ভেতরের জগতের জন্য তোলা থাক। 

ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং, ম্যাজিক সিস্টেম, দুর্বোধ্য ষড়যন্ত্র ও রাজনৈতিক কৌশলের মতো দিকগুলো নিয়ে মূলত এপিক ফ্যান্টাসি লেখা হয়। লেখক এই সব অনুক্রমণিকা পুরো গল্পের বাঁকে বাঁকে ঢুকিয়ে দিয়ে একইসাথে বেদনাদায়ক ও উত্তম স্বাদযুক্ত আবেগের সৃষ্টি করে। সেই সৃষ্টি পাঠক মনে একটা সময়— অজানা এক বিদ্রোহের উৎপত্তি ঘটিয়ে থাকে। ‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ তেমনই এক উপন্যাস; যেখানে পাঠক স্বাদযুক্ত উপাদান, ব্যর্থতার নিদর্শন, বন্ধুত্বের বন্ধন ও ত্যাগের মহিমার আলোকচ্ছটা প্রতিফলিত হয়ে— অনুধাবন করে পুরো সময় জুড়ে। মোহগ্রস্ত সেই দুনিয়ায় নিজেকে তখন বইয়ের কোনো এক পার্শ্বচরিত্র অথবা প্রত্যক্ষদর্শী রূপে বিচার করতে বেশ ভালো লাগে। 

‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ উপন্যাস লেখা হয়েছে বিশাল এক জগতকে কেন্দ্র করে। অথবা সহজ করে বললে, ‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ সেই জগতের একটি অংশ। স্যান্ডারসনের এই জগতকে বলা হয়— কজমেয়ার। মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে, কজমেয়ার মূলত কী? ছোট্ট করে বললে— ব্রান্ডন স্যান্ডারসনের বেশিভাগ চলমান সিরিজগুলো এই কজমেয়ার জগতের অন্তর্ভুক্ত। এই কজমেয়ার সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা বা বিস্তারিত পেতে ঢুঁ মারতে হবে স্যান্ডারসনের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার, রেফারেন্স টেক্সট ও ওয়েবসাইটে। 

এখন আসা যাক ‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ উপন্যাস নিয়ে। চিরাচরিত ফ্যান্টাসির পথ বদলে দেওয়া এই সিরিজের জন্ম ২০০৬ সালের ১৭ জুলাই। কী আছে এই মিস্টবর্ন সিরিজে? স্পয়লার ব্যতীত সংক্ষেপে সেটা আলোচনা করা যাক। 

‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ বইয়ের মূল স্তম্ভ হচ্ছে ফাইনাল এম্পায়ার রাজ্য। যে রাজ্য শাসন করে লর্ড রুলার। শাসনের পারিপার্শ্বিক দিকসমূহ দেখাশোনার দায়িত্ব আছে স্টিল মিনিস্ট্রি। এই মিনিস্ট্রি আবার অবলিগেটর ও ইনকুইজিটর নামে দুই দলে বিভক্ত। অবলিগেটররা সাধারণ মানুষ হলেও প্রতিপত্তির দিক থেকে খুবই ক্ষমতাবান। তাদের কাজ হচ্ছে ব্যাবসাবাণিজ্য, কর আদায়, অভিজাত বংশের বিবাহের ঘটকালি, লর্ড রুলারের নিয়ম-নীতি প্রচার করা। অভিজাত ও স্কা-দের নিয়ন্ত্রণও এদের হাতে। অন্যদিকে ইনকুইজিটররা হচ্ছে ভয়ানক ও পিশাচ জাতীয় জীব। মূলত আইন রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে এরা কাজ করে। যদিও ফাইনাল এম্পায়ারে আলাদাভাবে সেনাবাহিনী রয়েছে।

ফাইনাল এম্পায়ারে সাধারণ মানুষদের বলা হয় স্কা। এই স্কা-দের মধ্যে প্রায়ই মানুষ অভিজাতদের চাকর, খেতখামার ও কারখানার শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। এরা খুবই শোষিত ও নির্যাতিত। আরেকদল স্কা-কে বলা হয় তস্কর। যাদের আমরা চোর বলে আখ্যায়িত করি। এই তস্করা মূলত অভিজাতদের থেকে চুরি ও বাটপাড়ি করে দিনাতিপাত করে। ধরা পড়লে করুণ পরিণতি ভোগ করে ইনকুইজিটরদের হাতে।

এইবার আসা যাক সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং পার্ট মিস্টবর্ন ও মিস্টিং নিয়ে। মিস্টবর্ন ও মিস্টিং কে বা কারা? যেহেতু এই সিরিজের নাম মিস্টবর্ন তাই এই নিয়ে ছোট্ট করে জেনে নেওয়া যাক—মূলত অবলিগেটর বা অভিজাত কোন বংশের লর্ড ও সাধারণ স্কা নারীর অবৈধ সম্পর্কের ফসল হলো মিস্টবর্ন। সহজ ভাষায় যাদের আমরা জারজ বলে ম্যানশন করি। স্যান্ডারসন এই জারজদের রূপ দিয়েছে মিস্টবর্নে। আবার অনেক অভিজাত সন্তানরাও মিস্টবর্ন বা মিস্টিং হতে পারে। তবে সেটা হতে পারে স্ন্যাপ হওয়ার ফলে অথবা চেষ্টার খাতিরে। কেবল অবৈধ সন্তানরা শুধু মিস্টবর্ন বা মিস্টিং হয় না। তাদেরও এই ক্ষমতা সক্রিয় করতে হলে স্ন্যাপ বা গুরুতর কোনো ধাক্কা খাওয়া লাগে।

এই মিস্টবর্নের মধ্যে রয়েছে এক অলৌকিক ক্ষমতা। যে ক্ষমতা ব্যবহার হয় আটটি মৌলিক ধাতু ও দুইটি উচ্চ ধাতুর কার্যকারিতার মাধ্যেম। কী সেই কার্যকারিতা বা ক্ষমতা তা নিয়ে অনুবাদ বইটির শেষে ধারণা রয়েছে।

এই ধাতুর ব্যবহারকারীকে বলা হয় অ্যালোম্যান্সার। যখন একজন ‘অ্যালোম্যান্সার’ কোনো ধাতুকে কাজে লাগিয়ে শক্তির প্রদর্শন করে থাকে সেটাকে বলা হয় ‘অ্যালোম্যান্সি’।  যারা আটটি ধাতুর কার্যকারিতা আয়ত্ত করে কাজ লাগাতে পারে তারাই মিস্টবর্ন। অন্যদিকে মিস্টিং’রা যে-কোনো একটি ধাতু দিয়ে কার্য সিদ্ধি করতে পছন্দ করে।

“ধাতু ব্যবহার করে এই পুশ বা পুল করে চলাটা মোটেও ওড়ার মতো লাগে না, বরং পতনের অনুভূতির মতো লাগে—শুধু সেটা নিচের দিকে না হয়ে উলটোদিকে। সঠিক ভরবেগ পাওয়ার জন্য একজন অ্যালোম্যান্সারকে খুবই শক্তি দিয়ে পুল করতে হয়, আর সেটাই তাকে সবকিছু ভেঙেচুরে অবিশ্বাস্য গতিতে নিক্ষেপ করে তার অবলম্বনের দিকে।” 

‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ উপন্যাসের বাংলা সস্করণের প্রচ্ছদ করেন জুলিয়ান | ছবি: ভূমিপ্রকাশ
‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ উপন্যাসের বাংলা সস্করণের প্রচ্ছদ করেন জুলিয়ান | ছবি: পিয়েল রায় পার্থ

এই উপন্যাস আবর্তিত হয়েছে দুইজন মিস্টবর্ন ঘিরে। এ ছাড়াও রয়েছে আলোচিত কয়েকজন মিস্টিং। যাদের ভূমিকা এই গল্পে অপূরণীয়। তাদের মধ্যকার সম্পর্ক এবং সকলে একত্রিত হওয়ার সংকল্প নিয়ে রচিত হয়েছে জীবনবোধ ও এক স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের গল্প।

আরও একটি জাতি এই উপন্যাসে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে, তারা হচ্ছে—ফেরুকেমিস্ট। এই নিয়ে বিস্তারিত কাহিনি পাবেন উপন্যাসে। যা খুবই চমকপ্রদ ও ভাবনারও বটে। 

আখ্যান

রাতে রাজত্ব করে কুয়াশা…

পুরো বিশ্বই লর্ড রুলারের করায়ত্তে।

প্রায় হাজার বছর ধরে বর্ষিত হচ্ছে ছাই, ফুটছে না কোনো ফুল।

প্রায় হাজার বছর ধরে স্কা-রা লর্ড রুলারের ভয়ে বাস করছে ক্রীতদাসের মতো জঘন্য জীবন। হাজার বছর ধরে, ঈশ্বরের মতোই সবার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে সর্বময় ক্ষমতা আর সীমাহীন আতঙ্ক ছড়িয়ে শাসন করে যাচ্ছে লর্ড রুলার। যার বিরুদ্ধে করা প্রতিটা বিদ্রোহই ব্যর্থ হয়েছে শোচনীয়ভাবে।

কিন্তু তারপরেও বেঁচে থাকে আশা।

এক নতুন ধরনের প্রতিরোধের পরিকল্পনা করা হয়; যেটা নির্ভর করছে এক প্রতিভাবান তস্করের ধূর্ততা আর একজন আপাত অসম্ভাব্য নায়িকার দুঃসাহসের ওপরে, যে কি না রাস্তার এক স্কা-কিশোরী, যাকে একজন মিস্টবর্নের ক্ষমতা “অ্যালোম্যান্সি” শিখে হতে হবে দক্ষ।

কী হবে যদি দৈববাণীতে বলা নায়ক ব্যর্থ হয় ডার্ক লর্ডকে হারাতে? উত্তর পাওয়া যাবে মিস্টবর্ন ট্রিলজিতে, অবাক বিস্ময়ে ভরা এক উপাখ্যান; যা বদলে দিয়েছে চিরাচরিত ফ্যান্টাসির পথ। আর যার সূচনা এই সাড়া জাগানো বই দিয়ে।

মিস্টবর্ন ১ পাঠ প্রতিক্রিয়া ও পর্যালোচনা

‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ উপন্যাস পড়ার সময়ে গাঢ় কুয়াশা যেন আমাকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছিল। সেই কুয়াশার মধ্যে খুলে যাওয়া এক পোর্টালে আমিও চলে গিয়েছি লর্ড রুলারের বিরুদ্ধে স্কা বিদ্রোহের কেন্দ্রস্থল ফাইনাল এম্পায়ারে। দিনের আকাশ থেকে অনবরত পড়তে থাকা ছাই, সেই ছাইয়ে রাস্তার পাশে জমে থাকা স্তুপ, মাথা নিচু করে কাজ করে যাওয়া ক্লান্ত স্কা আর রাতের আঁধারে  অভিজাতদের লালসার শিকারে পরিণত হওয়া নিরুপায় কোনো স্কা নারী—এই যেন আমাদের সমাজের অতি চেনা পরিচিত রূপ। সার্ভাইভার অব হাটসিন খ্যাত কেলিসিয়ের, ধূর্ত তস্কর ভিন, দার্শনিক হ্যাম, বিজ্ঞ ডকসন, চুপচাপ আর রুক্ষ মেজাজের ক্লাবস, দক্ষ মার্শ—এরা যেন অতি পরিচিত কেউ। দর্শন, শাস্ত্র, রাজনীতি, ষড়যন্ত্র এবং সবশেষে যুদ্ধ; পরিকল্পনা গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও ব্যর্থতার শূন্যস্থান পূরণে লেখা ‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ উপন্যাস যেন অদ্ভুত এক মোহগ্রস্ত জগৎ। 

ফাইনাল এম্পায়ার ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং গঠন করা হয়েছে অতি দক্ষতার সাহায্যে। লেখক যে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে নারাজ, তা ওনার বিস্তারিত বর্ণনার মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। খুবই ধীরে, একেবারে কোনো তাড়াহুড়ো ছাড়া পুরো উপন্যাস লেখা হয়েছে। যা একজন ফ্যান্টাসি পাঠক হিসেবে যথাযথ লেগেছে। এই ধীর ও বিস্তারিত বর্ণনার কারণে গল্পের আবহের সাথে মিশে যেতে পেরেছি গভীরভাবে। সূক্ষ্ম কথোপকথন, ম্যাজিক বা অ্যালোম্যান্সি টার্ম বর্ণনা, ইউনিক অ্যাকশন সিকোয়েন্স, গভীর দর্শন, অভিজাতদের চালচলন, স্কা-দের চিন্তাভাবনা, ইনকুইজিটরদের নৃশংসতা-সহ তাত্ত্বিক বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা অনেক সহজ ও সাবলীল লেগেছে। ধৈর্য ও অপেক্ষার মিশ্রণে যদি পুরো উপন্যাস শেষ করা যায়, তাহলে তপ্ত হৃদয়ে এক অন্যরকম প্রশান্তির আবির্ভাব ঘটবে। পুরো উপন্যাসে বুঁদ হয়ে থাকতেও অন্যরকম এক অনুভূতি হচ্ছিল; যেন এই যাত্রা আমার, এই ফাইনাল এম্পায়ারে আমার বসবাস আর বিদ্রোহীরা আমার আপনজন। 

‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ উপন্যাস পড়ার সময়ে গাঢ় কুয়াশা যেন পর্যালোচককে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছিল। | ছবি: ভূমিপ্রকাশ
‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ উপন্যাস পড়ার সময়ে গাঢ় কুয়াশা যেন পর্যালোচককে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছিল। | ছবি: ভূমিপ্রকাশ

স্যান্ডারসন দাদা যে, এই উপন্যাস পড়ার মাধ্যেম আপনাকেও  ‘সুদ’ করে ফেলবে— এই গ্যারান্টি অন্তত দিতে পারি। বাই দ্য ওয়ে, সুদ একটি অ্যালোম্যান্সি। ‘পিতল’ ধাতু পোড়ানোর মাধ্যমে তৈরি হয়। যা আপনার আবেগকে করে দিবে শান্ত। আর ‘সুদ’ যারা করে তাদের বলে ‘সুদার’ (অ্যালোম্যান্স্যার)। 

দ্য ফাইনাল এম্পায়ার গল্পের সূত্রপাত

গল্পের সূত্রপাত লর্ড ট্রেস্টিংয়ের কেল্লা থেকে। যেখানে ফাইনাল এম্পায়ার সম্পর্কে স্বল্প বর্ণনা উঠে আসে ট্রেস্টিং ও আগত অবলিগেটরের কথোপকথন ও দৃশ্যায়নের মাধ্যমে। গল্পের হিরো কেলিসিয়েরের আগমন, কারণ ও কার্য সম্পাদনের মাধ্যমে শুরু হয় এই যাত্রা। এর পরের কাহিনি ঘুরে যায় লুথাডেল শহরের দিকে। যেই শহরে বসবাস লর্ড রুলার-সহ বিভিন্ন অভিজাত পরিবার, শোষিত ও নির্যাতিত স্কা-দের নিয়ে। বাকিটা নিজ দায়িত্ব শুরু করুন… ইহা এক লম্বা যাত্রা হতে যাচ্ছে।

গল্প বুনট

স্যান্ডারসনের গল্পের বুননের প্রশংসা যত বেশি করব তা-ও কম পড়ে যাবে। এত অদ্ভুত সুন্দর গোছানো প্লট খুব কম লেখকের উপন্যাসে দেখা যায়। ফ্যান্টাসিতে ঠিক যেইরকম প্লট একজন পাঠক আশা করবে, ঠিক সেই রকমের উপাদান দিয়ে সাজানো এই উপন্যাসের প্লট। নিখুঁত ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং, সহজ লেখনশৈলী, বিস্তারিত প্রাঞ্জল বর্ণনা, পারফেক্ট চরিত্রায়ন এবং মানানসই সমাপ্তি। 

এত এত কারসাজি চরিত্রদের নিয়ে, গভীর মনস্তত্ত্বত ও হার্ড ম্যাজিক সিস্টেমের সহজ বর্ণনা যেন অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে এই উপন্যাসকে। এই বই পুরো মাখন অথবা বলা যায় পারফেক্ট ডেজার্ট। যদি আপনি পুরো খাবার আয়েশ করে শেষ করতে পারেন তবেই সুস্বাদু ডেজার্টের মর্ম বুঝবেন। 

অনেকটা ‘কাঁসা’ পোড়ানোর মতো। যা করলে শরীরে আলাদা এক শক্তির আভাস পাওয়া যায়। এই বই শেষ করে সেইরকম অনুভূতি ঘিরে ধরবে বলে মনে করি। এই কাঁসা পোড়ানোর প্রক্রিয়া গ্রহণকারীকে বলা হয় ‘পিউটার‌আর্ম বা থাগ’।

লেখনশৈলী

মোলায়েম। সহজ ও আকৃষ্ট করার মতো। এই উপন্যাসে লেখনশৈলীর বেশ কয়েকটি টার্ম রয়েছে। ম্যাজিক সিস্টেম ব্যবহার করে অনুশীলন ও ফাইটিং সিকোয়েন্স, আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে আলাপচারিতা, লেখকের নিজস্ব দর্শন ও বর্ণনা, চরিত্রের আলাদা মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়াকলাপ—সব মিলিয়ে অনেক মিশ্র প্রক্রিয়া থাকার পরেও কোথাও কমতি দেখা যায়নি। অথবা বলা যায়, অহেতুক বা অস্বাস্থ্যকর কোনো বাক্য ঢুকিয়ে গল্পের রেশ কমিয়ে দেয়নি। পুরো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কয়েকটা রেখায় ভাগ হয়ে গেলেও, লেখনশৈলী নির্দিষ্ট রেখার মধ্যে থেকে গিয়েছে। বিচ্যুতি কোনোভাবে ঘটেনি। 

অনেকটা ‘লোহা’ পুড়িয়ে আশেপাশের ধাতুকে টেনে আনার মতোই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা উজ্জ্বল রেখার মধ্যে থেকে নির্দিষ্ট রেখায় কনভার্ট করে নিজের দিকে পুল করার প্রক্রিয়া। এই ধাতু প্রয়োগকারী বা মিস্টিংকে বলে ‘লার্চার’৷ 

বর্ণনাশৈলী

পারিপার্শ্বিক মোহনীয় বর্ণনা, সেটা বাইরের দুর্দশাগ্রস্থ পরিবেশ হোক কিংবা অভিজাতদের আয়োজন করা বল-এর ভেতরকার পরিবেশ। দিনের ছাই পড়া শুকনো রাস্তা অথবা রাতের কুয়াশা ঢাকা ভেজা পথ। সবই যেন এই পৃথিবীর কোন এক দেশের। অথবা নিকটবর্তী কোনো এলাকার পরিচিত  স্থানের গল্প। দৃশ্যায়ন দর্শনে লেখক কোনো কমতি রাখেননি, বিস্তারিত আর প্রাঞ্জল লেখার এই গুণ সত্যি চমকে দেয়। 

একজন লেখকের সার্থকতা ঠিক এইখানে। যে নিজের জগতে অনায়াসে আপনার মনকে বিচরণ করিয়ে দিতে পারে। ঠিক যেন জেগে থেকে স্বপ্ন দেখার মতো। অতুলনীয়। এই বর্ণনাশৈলী আবেগকে উথলে দেয়। ঠিক যেমন করে একজন রায়টার (অ্যালোম্যান্সার) ‘দস্তা’ পুড়িয়ে অন্য কারও আবেগকে উচ্ছলিত করে থাকে। 

চরিত্রায়ন

প্লটের পাশাপাশি পুরো উপন্যাসের চরিত্রের বৃষ্টি নেমেছে। তবে এই বৃষ্টি; একটা সময় ছাই হয়ে উড়ে গিয়েছে। প্রয়োজনীয়, কম প্রয়োজনীয়-সহ বেশ কয়েকটি নির্দিষ্ট চরিত্র আছে পুরো উপন্যাস জুড়ে। অপ্রয়োজনীয় তেমন কাউকে মনে হয়নি। চাইলেও ‘স্টিল’ পুড়িয়ে কাউকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার মতো না। এই স্টিল পোড়ানো অ্যালোম্যান্সারকে বলা হয় ‘কয়েনশট’। আর এই ধাতু; অন্যান্য আট মৌলিক ধাতু থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণও বটে।

যাহোক, ধাতুর আলাপের সাথে এমনিতে চরিত্রদের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সেইদিক থেকে ব্যাখা দেওয়া। চরিত্র নিয়ে আলাদাভাবে বলতে গেলে, প্রথম সারিতে কেলিসিয়ের ও ভিনের নামের অকপটে আসবে। দুজনের কেরামতি ও কারিশমা ভালোই প্রভাব ফেলেছে পুরো ফাইনাল এম্পায়ারে। প্রিয় চরিত্র কে এই নিয়ে বাক-বিতণ্ডা করতে চাই না। তবে এইটুকু নির্দ্বিধায় বলতে পারি, প্রত্যেকটি চরিত্র মনে দাগ টেনে দিয়েছে। 

অবসান

একটি উপন্যাসকে যদি স্বয়ংসম্পূর্ণ ট্যাগ দিতে হয় তাহলে সমাপ্তি এই ক্ষেত্রে ভালোই প্রভাব ফেলে। তবে এই উপন্যাসের ক্ষেত্রে পূর্ণতার সব কয়টি মার্ক অন্তত আমার থেকে পাবে। অনুবাদে ৭৪২ পৃষ্ঠা শেষ করার পর, নিজের রুচিকে তৃপ্ত করার মতো ❛মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার❜ একটা দুর্দান্ত কাহিনি বটে। স্ট্যান্ড অ্যালোন হিসেবে এই বইয়ে আলাদা ভূমিকা রেখেছে। বলা যায়, পূর্ণতা প্রদান করে শুরুটা মাত্র হয়েছে। নতুন আরেকটি অধ্যায়ের শুরু… যা ‘টিন’ পুড়িয়ে ইন্দ্রিয়কে উদীপ্ত করার মতোই। আর এই কাজ করতে পারে শুধুমাত্র একজন ‘টিন‌আই’ (অ্যালোম্যান্স্যার)।

খুচরা আলাপ

উদাহরণস্বরূপ ছয়টা ধাতুর রূপরেখা টানার চেষ্টা করলাম। বাকি মৌলিক দুই ধাতু আর উচ্চ দুই ধাতু এবং বিশেষ এক ধাতুর চমক এখনও দেওয়া হয়ে ওঠেনি। চেয়েছি রিভিউতে ম্যাজিক সিস্টেম বা অ্যালোম্যান্সির ব্যবহার নিয়ে দুয়েকটা ধারণা দিতে। সত্য বলতে পুরো মিস্টবর্নের এই হার্ড ম্যাজিক বা অ্যালোম্যান্সি প্রক্রিয়া অসাধারণ লেগেছে। ধাতু দিয়ে ম্যাজিক; ভাবা যায় তা-ও পেটের ভেতর পুড়িয়ে!

যাহোক, সব জট আমি খুলে দিলে অনেক না পড়া পাঠকদের হয়তো কিছুই খোলার থাকবে না! ওয়েট, এই কথা পুরোপুরি মিথ্যা। আদতে আমি এই বইয়ের মূল কাহিনির সারাংশ শুধু বলেছি কিন্তু কার্যপরম্পরা নিয়ে কিছুই বলেনি। সাসপেন্স আর টুইস্ট তো বহুত পড়ের কথা। ওইসব নিয়ে লিখতে গেলে, লেখা আর থামবে না। তাই শুধু বলব, একজন সহিষ্ণু পাঠক হলেই তবে বইটি হাতে তুলে নিন। নাহয় পরবর্তীতে ১০০ পৃষ্ঠা পড়ে গাঁইগুঁই শুরু করে দিবেন। আমি যদি বলি পুরো বইয়ের ৬০০ পৃষ্ঠা প্লট বিল্ডাপ আর অ্যালোম্যান্সি নিয়ে ধারণা দিয়ে গিয়েছে তাহলে কি বিরক্ত হবেন? হয়েও লাভ নেই, ফ্যান্টাসি বইয়ের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এইটা। 

তাই ঠান্ডা মাথায়, সময় নিয়ে বইটি নিয়ে বসুন। এর পরে হারিয়ে যান ফাইনাল এম্পায়ারের জগতে একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে। 

‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ উপন্যাসের লেখক ও অনুবাদক নিয়ে কিছু কথা

ব্রান্ডন স্যান্ডারসন নিয়ে কোনো কথা হবে না। বস একজনই। আর সর্বদা ওয়ান পিস হয়ে থাকবেন। চিরাচরিত ফ্যান্টাসির পথ বদলে দেওয়া এক বিস্ময়কর কারিগর; যার লেখার মুগ্ধতায় নির্বাক হওয়ার প্রতিক্রিয়া শুধু মানায়।

অনুবাদক অসীম পিয়াস দাদাকে নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। মূল বই পড়লাম না অনুবাদ টের পাইনি। অবশ্য পেতে দেননি বলা যায়। না হয় হাতে গোনা ৩ দিনের কম সময়ে এই দানবাকৃতির বই শেষ করা অসম্ভব বলা যায়। পিয়াস দাদার কাছ থেকে আরও ফ্যান্টাসি বইয়ের অনুবাদ প্রত্যাশা করছি। আশা করছি দ্রুত পেয়ে যাব। এই দারুণ অনুবাদ কর্মকে কোনোভাবে ‘তামা’ পুড়িয়ে লুকিয়ে রাখা সম্ভব না। যতই সে দক্ষ ‘স্মোকার’ হোক। আমরা পাঠকরা ঠিকই ‘ব্রোঞ্জ’ পুড়িয়ে সেটার সন্ধান বের করে ফেলব, একেকজন ‘সিকার’ হয়। 

সম্পাদনা ও বানান

সম্পাদনা বেশ ভালো হয়েছে। তার জন্য ফুয়াদ ভাইকে ধন্যবাদ। দুয়েকটা লাইনে শুধু বাক্যের অসামঞ্জস্য দেখা দিয়েছে। তবে সেটা খুবই সামান্য, নবম ধাতুর মতো। এমনকি বানান ভুলও সেইরকম। তবে দ্বিতীয় সংস্করণে চাইলে সেগুলো ঠিকঠাক করে নেওয়া যাবে। 

প্রচ্ছদ, অলংকরণ, নামলিপি

প্রচ্ছদ দারুণ। নামলিপি দুটো, দুইরকম ফিল দিয়েছে। অলংকরণ বা কয়েকটি চিত্র ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত করে যথাস্থানে ব্যবহার করার কারণে চরিত্র পরিচিতি অনেকটা সহজ হয়েছে। 

মলাট, বাঁধাই, পৃষ্ঠা

পুরো বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৭৫২। ৭৪২ পৃষ্ঠায় কাহিনি শেষ, বাকি ১০ পৃষ্ঠায় আনুষাঙ্গিক বিষয়বস্তু দেওয়া। সত্য কথা বলতে, এই বই আরাম করে পড়া শেষ হয়েছে। ঢাউস সাইজ হওয়া সত্ত্বেও শক্ত মলাট ও মজবুত বাঁধাইয়ের কারণে কোনো অসুবিধার সৃষ্টি হয়নি। এক কথায় প্রোডাকশন কোয়ালিটি দারুণ।

‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ উপন্যাস পড়াকালীন গাঢ় কুয়াশা যেন পর্যালোচককে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছিল। | ছবি: ভূমিপ্রকাশ
‘মিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার’ উপন্যাস পড়াকালীন গাঢ় কুয়াশা যেন পর্যালোচককে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছিল। | ছবি: ভূমিপ্রকাশ
বইয়ের নামমিস্টবর্ন: দ্য ফাইনাল এম্পায়ার (মিস্টবর্ন #১)
Mistborn: The Final Empire (Mistborn #1)
লেখকব্রান্ডন স্যান্ডারসন (Brandon Sanderson)
অনুবাদকঅসীম পিয়াস
ধরনএপিক ফ্যান্টাসি (উপন্যাস)
প্রকাশ১৭ জুন, ২০০৬ (প্রথম প্রকাশ)
অক্টোবর, ২০২১ (প্রথম বাংলা অনুবাদ প্রকাশ) 
নামলিপি ও প্রচ্ছদজুলিয়ান
বাংলা সংস্করণের প্রকাশকভূমিপ্রকাশ, ঢাকা
মুদ্রিত মূল্য ১০৫০ টাকা মাত্র
পৃষ্ঠা৭৫২