০৭:৪২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

পরিবার কাকে বলে? পরিবারের সংজ্ঞা, ধারণা, প্রকারভেদ, কার্যাবলি ও গুরুত্ব কী?

বিশ্লেষণ সংকলন টিম
  • প্রকাশ: ০২:৩৫:৩৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ অক্টোবর ২০২১
  • / ১২৫৯৩৭ বার পড়া হয়েছে

পরিবার প্রায়শ সন্তানসহ বা সন্তানবিহীন এক বা একাধিক দম্পতির ছোটো সংসার নিয়ে গঠিত।


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

আমরা জন্ম থেকেই পরিবারের সাথে পরিচিত। আমরা নিশ্চয়ই অবগত আছি যে, পরিবার আসলে কি সে সম্পর্কে। এই নিবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে পরিবার কী বা পরিবারের সংজ্ঞা, পরিবারের ধারণা, পরিবারের কার্যাবলি এবং পরিবারের গুরুত্ব প্রসঙ্গে।

পরিবারের সংজ্ঞা (Definition of Family)

পরিবার Family) হলো মানুষের সংঘবদ্ধ জীবন যাপনের এক বিশ্বজনীন (Universal) রূপ। পৃথিবীতে মানুষের সমাজ যতদিনের পরিবারের অস্তিত্বও ঠিক ততদিনের। পরিবারের একক কোনো সংজ্ঞা পাওয়া কঠিন। পরিবারের সংজ্ঞা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে মত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে পরিবারকে সংজ্ঞায়িত করেছেন।

পরিবারের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Family’ কথাটি এসেছে রোমান শব্দ ‘Famuleas’ শব্দ থেকে যার অর্থ ‘ভৃত্য বা সেবক’। রোমের আইন ব্যবস্থায় ক্রীতদাস ও উৎপাদক গোষ্ঠী, অন্য ভৃত্যগণ, অভিন্ন বংশ বা বিবাহসূত্রে সম্পর্কিত অন্য সদস্যদের বোঝানোর জন্য ‘Famulus’ শব্দটি ব্যবহৃত হতো।

আবার অনেকে মনে করেন, ‘Family’ ’শব্দটি ল্যাটিন ‘Familia’ শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ ‘সেবক’। শব্দের উৎপত্তি নিয়ে যেমন মতভেদ রয়েছে তেমনি সংজ্ঞা নিয়েও মতভেদ থাকাটাই স্বাভাবিক।

এখানে বিভিন্ন মতের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা কয়েকজন সমাজবিজ্ঞানীর মতামত তুলে ধরা হলো:

  • সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ম্যাকাইভার ও পেজ-এর মতে, Family is a group defined by a sex relationship sufficiently precise and enduring to provide for the procreation and upbringing of children (পরিবার হলো এমন একটি গোষ্ঠী যাকে সুস্পষ্ট জৈবিক সম্পর্কের মাধ্যমে অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট করা যায়। এটি সন্তান-সন্ততি জন্মদান ও লালন-পালনের এক স্থায়ী প্রতিষ্ঠান)। 
  • পরিবার সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক নিমকফ (M. F. Nimcoff) তাঁর রচিত ‘ম্যারিজ অ্যান্ড দ্য ফ্যামিলি (Marriage and the Family) গ্রন্থে বলেন, Family is more or less durable association of husband and wife with or without children or of a man or women alone, with children (পরিবার হলো এমন এক ধরনের স্থায়ী সংঘ, যা স্বামী-স্ত্রী সন্তানসহ কিংবা সন্তান ছাড়া অথবা সন্তান-সন্ততীসহ নারী কিংবা পুরুষের দ্বারা গঠিত)।
  • অ্যান্ডারসন ও পার্কার-এর মতে, Family is a socially recognised unit of people related to each other by kinship, marital and legal ties (পরিবার হচ্ছে এমন একটি সমাজিকভাবে স্বীকৃত একক যেখানে সদস্যরা রক্তের বন্ধন, বৈবাহিক ও আইনানুগ সম্পর্কের মাধ্যমে ভূমিকা পালন করে)।
  • বারজেস এবং লক মনে করেন, Family is a group of persons united by the consisting of a single household: interacting and inter communicating with each other in their respective social roles of husband and wife, mother and father, son and daughter, brother and sister creating a common culture (পরিবার হচ্ছে এমন এক ধরনের গোষ্ঠী যেখানে বিবাহ, রক্তের বন্ধন ও দত্তক প্রথার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি সংঘবদ্ধ হয় এবং এরা সবাই একসাথে একটি বাড়িতে বসবাস করে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া ও যোগাযোগ বিদ্যমান। তারা অভিন্ন সংস্কৃতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যথাযথ সামাজিক ভূমিকা পালন করে থাকে। তারা স্বামী ও স্ত্রী, মাতা-পিতা, ছেলে-মেয়ে এবং ভাই-বোন হিসেবে পরস্পর মিলেমিশে অন্তরঙ্গ সম্পর্কে আবদ্ধ থাকে)।

পরিবারের সাধারণ ধারণা

সাধারণভাবে পরিবার বলতে বোঝায় কতিপয় ব্যক্তির সমষ্টিকে যারা একত্রে বসবাস করে এবং যাদের মধ্যে প্রত্যক্ষ ও আন্তরিক সম্পর্ক বিরাজ করে।

বিবাহ, রক্ত সম্পর্ক ও আত্মীয়তা সূত্রের বন্ধনে আবদ্ধ একটি সামাজিক গোষ্ঠী (Social Group) হলো পরিবার। পরিবার হলো অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, আন্তরিক ও মুখোমুখি সম্পর্কযুক্ত (Face to face relationship) একটি মৌলিক সামাজিক প্রতিষ্ঠান। যেখানে পরিবারের বাইরের কোনো ব্যক্তির স্থান নেই।

অবশ্য দত্তক গ্রহণের মাধ্যমে পরিবার বহির্ভূত ব্যক্তিকে পরিবারের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। তখন সেই ব্যক্তি আর অন্য পরিবারের সদস্য থাকে না, হয়ে যায় সেই পরিবারভুক্ত।

পরিবারের সদস্যদের মধ্যে প্রতিনিয়ত পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া (Interaction) চলতে থাকে। প্রত্যেক পরিবারের নিজস্ব আদর্শ, ঐতিহ্য, প্রথা থাকে যা সেই পরিবারের সদস্যরা বজায় রাখে, সযত্নে লালন করে ও সে অনুযায়ী তাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে।

পরিবারের ধারণা বিচার বিশ্লেষণ করে বলা যায়, নারী-পুরুষের বিবাহের মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ভিত্তিতে সন্তান প্রজনন ও বংশ রক্ষার আকাঙ্ক্ষা থেকে পরিবার গঠিত হয়; তাই পরিবারকে একটি জৈব একক (Biological Unit) বলেও অভিহিত করা যায়।

পরিবারের মার্কসীয় ধারণা

পরিবার সম্পর্কে মার্কসীয় একটি ধারণা প্রচলিত আছে। কার্ল মার্কসের (Karl Marx) ঘনিষ্ঠ সহচর এঙ্গেলস (F. Engels) পরিবার সম্পর্কে তার দুটি রচনা: ‘The origin of family’ এবং ‘Private property and the state’ এ বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। মার্কসীয় ধারণা মতে, আদিম সমাজ ব্যবস্থায় শিকার ও খাদ্য সংগ্রহ যুগে পরিবার ব্যবস্থা ছিল মাতৃতান্ত্রিক।

ইতিহাসে মানব সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ফলে সমাজে কৃষির আবির্ভাব ঘটে ও কৃষি যুগের সূত্রপাত হয়। কৃষি কাজের বিকাশ ও বিস্তারের ফলে উদ্বৃত্ত সম্পদের সৃষ্টি হয়। এ উদ্বৃত্ত সম্পদের মালিকানা ক্রমান্বয়ে চলে আসে পুরুষের হাতে। ফলে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থার সূচনা হয়। এভাবেই পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের মাধ্যমে পুরুষ শাসিত সমাজের উদ্ভব হয়।

পরিবারের ধারণা বিচার বিশ্লেষণ করে বলা যায়, নারী-পুরুষের বিবাহের মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ভিত্তিতে সন্তান প্রজনন ও বংশ রক্ষার আকাঙ্ক্ষা থেকে পরিবার গঠিত হয়; তাই পরিবারকে একটি জৈব একক (Biological Unit) বলেও অভিহিত করা যায়।

পরিবারের প্রকারভেদ (Types of Family)

১) বংশ পরিচয় বিবেচনায় পরিবার

প্রাচীন যুগে বংশ পরিচয়ের ভিত্তিতে পরিবারকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়, যথা:

ক) পিতৃতান্ত্রিক পরিবার (Patriarchal Family)

যে পরিবারে পিতা প্রধান থাকে তাকে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার বলে। তাই হেনরি মেইনের মতে, “পিতৃতান্ত্রিক পরিবারই আদিম পরিবার।” 

খ) মাতৃতান্ত্রিক পরিবার (Matriarchal Family)

যে পরিবারে মাতা প্রধান থাকেন বা মাতার দিক থেকে বংশ পরিচয় দেওয়া হয় তখন তাকে মাতৃতান্ত্রিক পরিবার বলে। 

২) বৈবাহিক প্রথার বিবেচনায় পরিবারের প্রকারভেদ

ওপর ভিত্তি করে পরিবারকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথা: 

ক) একপত্নীক পরিবার

যদি একজন পুরুষ একজন স্ত্রী গ্রহণ করে পরিবার গঠন করে, তবে তাকে একপত্নীক পরিবার বলে। 

খ) বহুপত্নীক পরিবার

যখন একজন পুরুষ একাধিক স্ত্রী বিবাহ করে পরিবার গঠন করে, তখন তাকে বহুপত্নীক পরিবার বলে।

গ) বহুপতি পরিবার

যখন একজন স্ত্রী একের অধিক স্বামী গ্রহণ করে পরিবার গঠন করে তখন তাকে বহুপতি পরিবার বলে।

৩) পারিবারিক কাঠামো বিবেচনায় পরিবারের প্রকারভের

পারিবারিক কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে পরিবারকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। যথা: 

ক) একক পরিবার (Nuclear Family)

যখন একজন স্বামী ও একজন স্ত্রী তাদের ওপর নির্ভরশীল- সন্তান-সন্ততি নিয়ে  পরিবার গঠন করে তখন তাকে একক পরিবার বলে একক পরিবার ছোটো পরিবার।

খ) যৌথ পরিবার (যৌথ পরিবার)

যে পরিবারে দাদা-দাদি, বাবা-মা, চাচা-চাচি, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে ও অন্যান্যরা একসঙ্গে বসবাস করে, তাকে যৌথ পরিবার বলে।

পরিবারের কার্যাবলি (Functions of Family)

প্রতিটি পরিবারেরই কিছু সাধারণ একই ধরনের কার্যাবলি থাকে যা সর্বজনীন ও বিশ্বজনীন। অর্থাৎ পরিবারের কিছু অপরিহার্য কার্যাবলি রয়েছে যার মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয়। তাই পরিবারে এসব কার্যাবলি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে এবং একটি পরিবারকে ঘিরেই এসব কাজ আবর্তিত হয় বা পরিবার এসব কাজ সম্পাদন করে। যেমন: 

  • ১. জৈবিক কাজ (Biological Function)
  • ২. মনস্তাত্বিক কাজ (Psychological Function)
  • ৩. অর্থনৈতিক কাজ (Economic Function)
  • ৪. শিক্ষামূলক কাজ (Educational Function)
  • ৫. রক্ষণাবেক্ষণ কাজ (Maintenance Function)
  • ৬. বিনোদনমূলক কাজ (Recreational Function)
  • ৭. ধর্মীয় কাজ (Religious Function)
  • ৮. সামাজিক নিয়ন্ত্রণমূলক কাজ (Function of Social Control)
  • ৯. সাংস্কৃতিক কাজ (Cultural Function)
  • ১০. নিরাপত্তামূলক কাজ (ঝবপঁৎরঃরপধষ Function)
  • ১১. রাজনৈতিক কাজ (Political Function)
  • ১২. সামাজিকীকরণের কাজ (Function of Socialization)
  • ১৩. সামাজিক মর্যাদা বিষয়ক কাজ (Function Social Status)

পরিবারের গুরুত্ব (Importance of Family)

পরিবার (Family) হলো একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান (Social Institution) এবং সমাজ কাঠামোর (Social Structure) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মৌল অঙ্গ সংগঠন। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, পরিবার হচ্ছে মানব সমাজের 

সবচেয়ে প্রাচীন, আদি, মৌলিক ও ক্ষুদ্রতম প্রতিষ্ঠান (Institution)। তাই পরিবারকে সমাজের মুখ্য বা প্রাথমিক গোষ্ঠী হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। পরিবার হলো সমাজের কেন্দ্রবিন্দু।

মানব সমাজের উষালগ্ন থেকেই পরিবারের অস্তিত্ব দৃশ্যমান হয়েছে। পরিবারবিহীন সমাজের চিত্র কল্পনা করা যায় না। আদি থেকে বর্তমান পর্যন্ত সব সমাজেই পরিবার দৃষ্ট হয়েছে। হয়তো এর বিবর্তন ঘটেছে, রূপ বদলেছে কিন্তু সমাজে পরিবারের স্থায়ী আসন কখনো বিলুপ্ত হয়নি; পরিবারের প্রয়োজনীয়তা ফুরায়নি। এর অন্যতম কারণ হলো মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করা মানুষের বৈশিষ্ট্য। মানুষ একাকী থাকতে পারে না। স্বভাবতই মানুষ সঙ্গপ্রিয়। একে অন্যের পারস্পরিক সহযোগিতায় একত্রে মিলেমিশে বাস করতে চায় যা মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট। এই সহজাত প্রবৃত্তিই মানুষকে পরিবার গঠনে ধাবিত করেছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একজন মানুষ পরিবারের আবহেই অবস্থান করে। 

পরিবারের মধ্যেই একজন মানুষ জন্মগ্রহণ করে, লালিত-পালিত হয়, বেড়ে ওঠে, শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়, কর্ম করে এবং এক সময় পরিবারের মধ্যেই সে মুত্যুবরণ করে। এমন কি মৃত্যুর পর তার শেষ কৃত্যের অনুষ্ঠান পর্যন্ত পরিবারের মধ্যেই সম্পন্ন হয়। তাই বলা যায়, পরিবার একটি স্থায়ী ও সর্বজনীন (Universal) সামাজিক প্রতিষ্ঠান।

শেষকথা

পরিবার প্রায়শ সন্তানসহ বা সন্তানবিহীন এক বা একাধিক দম্পতির ছোটো সংসার নিয়ে গঠিত। এর আর্থিক ভিত্তি রয়েছে। এই ভিত্তিকে কেন্দ্র করে আত্মীয়, সামাজিক সম্পর্ক ও প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং ঐক্যবদ্ধ কাজের মাধ্যমে তা রূপায়িত হয়। পরিবারের বিকাশে সন্ধানযোগ্য বংশগত সম্পর্ক সাধারণত জ্ঞাতি সম্পর্কের চেয়ে অগ্রাধিকার পায়। এই শৃঙ্খলার মধ্যে সদস্যরা সমাজের আর্থিক ও সামাজিক উপ-প্রথাগুলি গড়ে তোলে।

শেয়ার করুন

6 thoughts on “পরিবার কাকে বলে? পরিবারের সংজ্ঞা, ধারণা, প্রকারভেদ, কার্যাবলি ও গুরুত্ব কী?

  1. সংক্ষিপ্ত আকারে গোছানো লেখা ভালই লাগলো

  2. অনেক সুন্দর হয়েছে। আমি মিথ্যা কথা বলছি না। আমি অনেক উপকৃত হয়েছি আর আপনার ব্যাখ্যাটা অনেক সুন্দর হয়েছে। অনেক সুন্দর করে পরিবারের ধারণা গুলো ফুটিয়ে তুলেছেন..অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে আপু… ❤️

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

পরিবার কাকে বলে? পরিবারের সংজ্ঞা, ধারণা, প্রকারভেদ, কার্যাবলি ও গুরুত্ব কী?

প্রকাশ: ০২:৩৫:৩৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ অক্টোবর ২০২১

আমরা জন্ম থেকেই পরিবারের সাথে পরিচিত। আমরা নিশ্চয়ই অবগত আছি যে, পরিবার আসলে কি সে সম্পর্কে। এই নিবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে পরিবার কী বা পরিবারের সংজ্ঞা, পরিবারের ধারণা, পরিবারের কার্যাবলি এবং পরিবারের গুরুত্ব প্রসঙ্গে।

পরিবারের সংজ্ঞা (Definition of Family)

পরিবার Family) হলো মানুষের সংঘবদ্ধ জীবন যাপনের এক বিশ্বজনীন (Universal) রূপ। পৃথিবীতে মানুষের সমাজ যতদিনের পরিবারের অস্তিত্বও ঠিক ততদিনের। পরিবারের একক কোনো সংজ্ঞা পাওয়া কঠিন। পরিবারের সংজ্ঞা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে মত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে পরিবারকে সংজ্ঞায়িত করেছেন।

পরিবারের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Family’ কথাটি এসেছে রোমান শব্দ ‘Famuleas’ শব্দ থেকে যার অর্থ ‘ভৃত্য বা সেবক’। রোমের আইন ব্যবস্থায় ক্রীতদাস ও উৎপাদক গোষ্ঠী, অন্য ভৃত্যগণ, অভিন্ন বংশ বা বিবাহসূত্রে সম্পর্কিত অন্য সদস্যদের বোঝানোর জন্য ‘Famulus’ শব্দটি ব্যবহৃত হতো।

আবার অনেকে মনে করেন, ‘Family’ ’শব্দটি ল্যাটিন ‘Familia’ শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ ‘সেবক’। শব্দের উৎপত্তি নিয়ে যেমন মতভেদ রয়েছে তেমনি সংজ্ঞা নিয়েও মতভেদ থাকাটাই স্বাভাবিক।

এখানে বিভিন্ন মতের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা কয়েকজন সমাজবিজ্ঞানীর মতামত তুলে ধরা হলো:

  • সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ম্যাকাইভার ও পেজ-এর মতে, Family is a group defined by a sex relationship sufficiently precise and enduring to provide for the procreation and upbringing of children (পরিবার হলো এমন একটি গোষ্ঠী যাকে সুস্পষ্ট জৈবিক সম্পর্কের মাধ্যমে অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট করা যায়। এটি সন্তান-সন্ততি জন্মদান ও লালন-পালনের এক স্থায়ী প্রতিষ্ঠান)। 
  • পরিবার সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক নিমকফ (M. F. Nimcoff) তাঁর রচিত ‘ম্যারিজ অ্যান্ড দ্য ফ্যামিলি (Marriage and the Family) গ্রন্থে বলেন, Family is more or less durable association of husband and wife with or without children or of a man or women alone, with children (পরিবার হলো এমন এক ধরনের স্থায়ী সংঘ, যা স্বামী-স্ত্রী সন্তানসহ কিংবা সন্তান ছাড়া অথবা সন্তান-সন্ততীসহ নারী কিংবা পুরুষের দ্বারা গঠিত)।
  • অ্যান্ডারসন ও পার্কার-এর মতে, Family is a socially recognised unit of people related to each other by kinship, marital and legal ties (পরিবার হচ্ছে এমন একটি সমাজিকভাবে স্বীকৃত একক যেখানে সদস্যরা রক্তের বন্ধন, বৈবাহিক ও আইনানুগ সম্পর্কের মাধ্যমে ভূমিকা পালন করে)।
  • বারজেস এবং লক মনে করেন, Family is a group of persons united by the consisting of a single household: interacting and inter communicating with each other in their respective social roles of husband and wife, mother and father, son and daughter, brother and sister creating a common culture (পরিবার হচ্ছে এমন এক ধরনের গোষ্ঠী যেখানে বিবাহ, রক্তের বন্ধন ও দত্তক প্রথার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি সংঘবদ্ধ হয় এবং এরা সবাই একসাথে একটি বাড়িতে বসবাস করে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া ও যোগাযোগ বিদ্যমান। তারা অভিন্ন সংস্কৃতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যথাযথ সামাজিক ভূমিকা পালন করে থাকে। তারা স্বামী ও স্ত্রী, মাতা-পিতা, ছেলে-মেয়ে এবং ভাই-বোন হিসেবে পরস্পর মিলেমিশে অন্তরঙ্গ সম্পর্কে আবদ্ধ থাকে)।

পরিবারের সাধারণ ধারণা

সাধারণভাবে পরিবার বলতে বোঝায় কতিপয় ব্যক্তির সমষ্টিকে যারা একত্রে বসবাস করে এবং যাদের মধ্যে প্রত্যক্ষ ও আন্তরিক সম্পর্ক বিরাজ করে।

বিবাহ, রক্ত সম্পর্ক ও আত্মীয়তা সূত্রের বন্ধনে আবদ্ধ একটি সামাজিক গোষ্ঠী (Social Group) হলো পরিবার। পরিবার হলো অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, আন্তরিক ও মুখোমুখি সম্পর্কযুক্ত (Face to face relationship) একটি মৌলিক সামাজিক প্রতিষ্ঠান। যেখানে পরিবারের বাইরের কোনো ব্যক্তির স্থান নেই।

অবশ্য দত্তক গ্রহণের মাধ্যমে পরিবার বহির্ভূত ব্যক্তিকে পরিবারের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। তখন সেই ব্যক্তি আর অন্য পরিবারের সদস্য থাকে না, হয়ে যায় সেই পরিবারভুক্ত।

পরিবারের সদস্যদের মধ্যে প্রতিনিয়ত পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া (Interaction) চলতে থাকে। প্রত্যেক পরিবারের নিজস্ব আদর্শ, ঐতিহ্য, প্রথা থাকে যা সেই পরিবারের সদস্যরা বজায় রাখে, সযত্নে লালন করে ও সে অনুযায়ী তাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে।

পরিবারের ধারণা বিচার বিশ্লেষণ করে বলা যায়, নারী-পুরুষের বিবাহের মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ভিত্তিতে সন্তান প্রজনন ও বংশ রক্ষার আকাঙ্ক্ষা থেকে পরিবার গঠিত হয়; তাই পরিবারকে একটি জৈব একক (Biological Unit) বলেও অভিহিত করা যায়।

পরিবারের মার্কসীয় ধারণা

পরিবার সম্পর্কে মার্কসীয় একটি ধারণা প্রচলিত আছে। কার্ল মার্কসের (Karl Marx) ঘনিষ্ঠ সহচর এঙ্গেলস (F. Engels) পরিবার সম্পর্কে তার দুটি রচনা: ‘The origin of family’ এবং ‘Private property and the state’ এ বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। মার্কসীয় ধারণা মতে, আদিম সমাজ ব্যবস্থায় শিকার ও খাদ্য সংগ্রহ যুগে পরিবার ব্যবস্থা ছিল মাতৃতান্ত্রিক।

ইতিহাসে মানব সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ফলে সমাজে কৃষির আবির্ভাব ঘটে ও কৃষি যুগের সূত্রপাত হয়। কৃষি কাজের বিকাশ ও বিস্তারের ফলে উদ্বৃত্ত সম্পদের সৃষ্টি হয়। এ উদ্বৃত্ত সম্পদের মালিকানা ক্রমান্বয়ে চলে আসে পুরুষের হাতে। ফলে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থার সূচনা হয়। এভাবেই পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের মাধ্যমে পুরুষ শাসিত সমাজের উদ্ভব হয়।

পরিবারের ধারণা বিচার বিশ্লেষণ করে বলা যায়, নারী-পুরুষের বিবাহের মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ভিত্তিতে সন্তান প্রজনন ও বংশ রক্ষার আকাঙ্ক্ষা থেকে পরিবার গঠিত হয়; তাই পরিবারকে একটি জৈব একক (Biological Unit) বলেও অভিহিত করা যায়।

পরিবারের প্রকারভেদ (Types of Family)

১) বংশ পরিচয় বিবেচনায় পরিবার

প্রাচীন যুগে বংশ পরিচয়ের ভিত্তিতে পরিবারকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়, যথা:

ক) পিতৃতান্ত্রিক পরিবার (Patriarchal Family)

যে পরিবারে পিতা প্রধান থাকে তাকে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার বলে। তাই হেনরি মেইনের মতে, “পিতৃতান্ত্রিক পরিবারই আদিম পরিবার।” 

খ) মাতৃতান্ত্রিক পরিবার (Matriarchal Family)

যে পরিবারে মাতা প্রধান থাকেন বা মাতার দিক থেকে বংশ পরিচয় দেওয়া হয় তখন তাকে মাতৃতান্ত্রিক পরিবার বলে। 

২) বৈবাহিক প্রথার বিবেচনায় পরিবারের প্রকারভেদ

ওপর ভিত্তি করে পরিবারকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথা: 

ক) একপত্নীক পরিবার

যদি একজন পুরুষ একজন স্ত্রী গ্রহণ করে পরিবার গঠন করে, তবে তাকে একপত্নীক পরিবার বলে। 

খ) বহুপত্নীক পরিবার

যখন একজন পুরুষ একাধিক স্ত্রী বিবাহ করে পরিবার গঠন করে, তখন তাকে বহুপত্নীক পরিবার বলে।

গ) বহুপতি পরিবার

যখন একজন স্ত্রী একের অধিক স্বামী গ্রহণ করে পরিবার গঠন করে তখন তাকে বহুপতি পরিবার বলে।

৩) পারিবারিক কাঠামো বিবেচনায় পরিবারের প্রকারভের

পারিবারিক কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে পরিবারকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। যথা: 

ক) একক পরিবার (Nuclear Family)

যখন একজন স্বামী ও একজন স্ত্রী তাদের ওপর নির্ভরশীল- সন্তান-সন্ততি নিয়ে  পরিবার গঠন করে তখন তাকে একক পরিবার বলে একক পরিবার ছোটো পরিবার।

খ) যৌথ পরিবার (যৌথ পরিবার)

যে পরিবারে দাদা-দাদি, বাবা-মা, চাচা-চাচি, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে ও অন্যান্যরা একসঙ্গে বসবাস করে, তাকে যৌথ পরিবার বলে।

পরিবারের কার্যাবলি (Functions of Family)

প্রতিটি পরিবারেরই কিছু সাধারণ একই ধরনের কার্যাবলি থাকে যা সর্বজনীন ও বিশ্বজনীন। অর্থাৎ পরিবারের কিছু অপরিহার্য কার্যাবলি রয়েছে যার মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয়। তাই পরিবারে এসব কার্যাবলি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে এবং একটি পরিবারকে ঘিরেই এসব কাজ আবর্তিত হয় বা পরিবার এসব কাজ সম্পাদন করে। যেমন: 

  • ১. জৈবিক কাজ (Biological Function)
  • ২. মনস্তাত্বিক কাজ (Psychological Function)
  • ৩. অর্থনৈতিক কাজ (Economic Function)
  • ৪. শিক্ষামূলক কাজ (Educational Function)
  • ৫. রক্ষণাবেক্ষণ কাজ (Maintenance Function)
  • ৬. বিনোদনমূলক কাজ (Recreational Function)
  • ৭. ধর্মীয় কাজ (Religious Function)
  • ৮. সামাজিক নিয়ন্ত্রণমূলক কাজ (Function of Social Control)
  • ৯. সাংস্কৃতিক কাজ (Cultural Function)
  • ১০. নিরাপত্তামূলক কাজ (ঝবপঁৎরঃরপধষ Function)
  • ১১. রাজনৈতিক কাজ (Political Function)
  • ১২. সামাজিকীকরণের কাজ (Function of Socialization)
  • ১৩. সামাজিক মর্যাদা বিষয়ক কাজ (Function Social Status)

পরিবারের গুরুত্ব (Importance of Family)

পরিবার (Family) হলো একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান (Social Institution) এবং সমাজ কাঠামোর (Social Structure) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মৌল অঙ্গ সংগঠন। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, পরিবার হচ্ছে মানব সমাজের 

সবচেয়ে প্রাচীন, আদি, মৌলিক ও ক্ষুদ্রতম প্রতিষ্ঠান (Institution)। তাই পরিবারকে সমাজের মুখ্য বা প্রাথমিক গোষ্ঠী হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। পরিবার হলো সমাজের কেন্দ্রবিন্দু।

মানব সমাজের উষালগ্ন থেকেই পরিবারের অস্তিত্ব দৃশ্যমান হয়েছে। পরিবারবিহীন সমাজের চিত্র কল্পনা করা যায় না। আদি থেকে বর্তমান পর্যন্ত সব সমাজেই পরিবার দৃষ্ট হয়েছে। হয়তো এর বিবর্তন ঘটেছে, রূপ বদলেছে কিন্তু সমাজে পরিবারের স্থায়ী আসন কখনো বিলুপ্ত হয়নি; পরিবারের প্রয়োজনীয়তা ফুরায়নি। এর অন্যতম কারণ হলো মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করা মানুষের বৈশিষ্ট্য। মানুষ একাকী থাকতে পারে না। স্বভাবতই মানুষ সঙ্গপ্রিয়। একে অন্যের পারস্পরিক সহযোগিতায় একত্রে মিলেমিশে বাস করতে চায় যা মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট। এই সহজাত প্রবৃত্তিই মানুষকে পরিবার গঠনে ধাবিত করেছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একজন মানুষ পরিবারের আবহেই অবস্থান করে। 

পরিবারের মধ্যেই একজন মানুষ জন্মগ্রহণ করে, লালিত-পালিত হয়, বেড়ে ওঠে, শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়, কর্ম করে এবং এক সময় পরিবারের মধ্যেই সে মুত্যুবরণ করে। এমন কি মৃত্যুর পর তার শেষ কৃত্যের অনুষ্ঠান পর্যন্ত পরিবারের মধ্যেই সম্পন্ন হয়। তাই বলা যায়, পরিবার একটি স্থায়ী ও সর্বজনীন (Universal) সামাজিক প্রতিষ্ঠান।

শেষকথা

পরিবার প্রায়শ সন্তানসহ বা সন্তানবিহীন এক বা একাধিক দম্পতির ছোটো সংসার নিয়ে গঠিত। এর আর্থিক ভিত্তি রয়েছে। এই ভিত্তিকে কেন্দ্র করে আত্মীয়, সামাজিক সম্পর্ক ও প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং ঐক্যবদ্ধ কাজের মাধ্যমে তা রূপায়িত হয়। পরিবারের বিকাশে সন্ধানযোগ্য বংশগত সম্পর্ক সাধারণত জ্ঞাতি সম্পর্কের চেয়ে অগ্রাধিকার পায়। এই শৃঙ্খলার মধ্যে সদস্যরা সমাজের আর্থিক ও সামাজিক উপ-প্রথাগুলি গড়ে তোলে।