০১:৩৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

ব্যাংক কাকে বলে এবং ব্যাংকিং কী? ব্যাংকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস

প্রফেসর এম এ মাননান
  • প্রকাশ: ০৪:০৫:২৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১
  • / ১৮৮২৯ বার পড়া হয়েছে

ব্যাংক কাকে বলে এবং ব্যাংকিং কী?

আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাংক (Bank) একটি দেশের প্রধান অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি। অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন। ব্যাংক ব্যবসায় একটি পুরাতন ব্যবসায়। এ ব্যবসায়ের মূল ভিত্তি হলো অর্থ (টাকা, ডলার ইত্যাদি)। অর্থকে কেন্দ্র করে ব্যাংকিং ব্যবসা আবর্তিত হয়। অর্থের প্রচলন শুরু হওয়ার পর থেকেই ব্যাংক ব্যবসায়ের শুরু। মধ্যযুগে ইহুদী ব্যবসায়ীরা এক পক্ষের কাছ থেকে কম সুদের বিনিময়ে অর্থ আমানত হিসাবে গ্রহণ করত এবং অন্য পক্ষের কাছে এই অর্থ অপেক্ষাকৃত বেশি সুদে ধার হিসেবে দিত। এর মধ্য দিয়েই ব্যাংক ব্যবসার জন্ম হয়। কিন্তু বর্তমানে ব্যাংক ব্যবস্থা শুধু আমানত নেওয়া ও ঋণ দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। উৎপাদনখাতে বিনিয়োগ আর ব্যাংকের কাজ হলো উক্তরূপ বিনিয়োগের জন্য পুঁজি সংগ্রহ ও সরবরাহ করা। এই নিবন্ধে ব্যাংকের সংজ্ঞা, ব্যাংকিংয়ের সংজ্ঞা ব্যাংকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ বা ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

এক নজরে এই নিবন্ধ

ব্যাংক কাকে বলে? (Definition of Bank)

ব্যাংক এমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেটি এক পক্ষের কাছ থেকে আমানত হিসাবে অর্থ জমা রাখে এবং অন্য পক্ষকে আমানতি অর্থ থেকে ঋণ দেয়। ব্যাপক অর্থে, ব্যাংক হলো এমন একটি আর্থিক মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান (Financial Intermediary) যা আমানত গ্রহণ করা, ঋণ দেওয়া এবং ঋণ ও অর্থ সৃষ্টি করাসহ বিভিন্ন ধরনের আর্থিক কাজ সম্পন্ন করে।

স্যার অ্যালেক্সান্ডার কির্কল্যান্ড কেইর্নক্রোস (Sir Alexander KirklandAlecCairncross) এর মতে, ব্যাংক হলো একটি আর্থিক মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান, যেটি ধার ও ঋণের ব্যবসায় করে (A bank is a financial intermediary, a dealer in loans and debts)।

১৯৪৯ সালে ভারতীয় ব্যাংক আইন অনুসারে, ব্যাংক হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা ঋণ দেওয়া বা বিনিয়োগ করার উদ্দেশ্যে জনগণের কাছ থেকে আমানত হিসেবে অর্থ গ্রহণ করে, যে অর্থ চাহিবামাত্র বা অন্যভাবে ফেরত দিতে হয় এবং যা চেক, ড্রাফ্ট বা অন্যভাবে উঠিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা থাকে।

অর্থাৎ, ব্যাংক হলো এমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান যা বিভিন্ন ব্যাংক-হিসাব (Bank Account) এর মাধ্যমে কম সুদে আমানত সংগ্রহ করে এবং ঐ অর্থ বেশি সুদে অন্য পক্ষকে ঋণ দিয়ে মুনাফা অর্জন করে।

ব্যাংকিং কী? (What Is Banking?)

সাধারণভাবে, ব্যাংকের অর্থ সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যাবলিকে ব্যাংকিং বলে। প্রশ্ন হলো, ব্যাংকের কাজ কী? চলতি, সঞ্চয়ী ও মেয়াদি হিসাবে অর্থ গ্রহণ করা, গ্রাহকদের চেক গ্রহণ করা, দাবি পরিশোধ করা, ঋণ দেওয়া, বিলবাট্টা করা, গ্রাহকদের অর্থ একস্থান থেকে অন্যস্থানে স্থানান্তরে সাহায্য করা ইত্যাদি ব্যাংকের কাজ। এ সকল কাজই সমষ্টিগতভাবে ব্যাংকিং নামে পরিচিত। এ বিষয়ে ব্যাংকিং আইনের সংজ্ঞাটি জেনে নিই। ১৯৪৯ সালের ভারতীয় ব্যাংকিং আইনের ৫(১) ধারা অনুযায়ী, ঋণ মঞ্জুর বা অর্থ বিনিয়োগ করা, জনগণের অর্থ আমানত হিসেবে সংগ্রহ করা এবং চাহিবামাত্র বা অন্য কোন অবস্থায় তা উত্তোলনের সুযোগ প্রদান করাই হলো ব্যাংকিং (Banking means the accepting, for the purpose of lending or investment of deposits or money from the public, re-payable on demand or otherwise, and withdrawable by cheque, draft, order or otherwise)|

আমানত গ্রহণ, ঋণ দেওয়া, চেক পরিশোধ করা, বিলবাট্টা করা, অর্থ স্থানান্তর করা, ঋণ ও বিনিময়ের মাধ্যম সৃষ্টি করা, মক্কেলের মূল্যবান দ্রব্য ও দলিল সংরক্ষণ করা, মক্কেলের বিলের স্বীকৃতি দেওয়া, আমানত হিসেবে প্রাপ্ত অর্থ বিনিয়োগ করাসহ ব্যাংকের যাবতীয় কাজকে একসাথে ব্যাংকিং বলা হয়।

সুতরাং, ব্যাংক হলো একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং এ প্রতিষ্ঠানের কাজগুলোই হলো ব্যাংকিং। ব্যাংক যখন অন্য কোনো ব্যক্তির কাজ করে, তখন ব্যাংক সে ব্যক্তির ব্যাংকার হিসেবে অভিহিত হয়। ধরুন, আপনি সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে যাবতীয় লেনদেন করেন। তাহলে সোনালী ব্যাংকটি হলো আপনার ব্যাংকার। বাংলাদেশ ব্যাংক যেহেতু সরকারের কাজ করে, সে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক হলো সরকারের ব্যাংকার।

ব্যাংকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ (Origin and Evolution of Banks)

অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে বিনিময় প্রথা চালু ছিল। অর্থাৎ পণ্যের বিনিময়ে পণ্য বেচা-কেনা হতো। পরে মুদ্রার প্রচলন ঘটে। প্রাচীনকালে মুদ্রার প্রচলন শুরু হলেও ব্যাংক ব্যবস্থার ধারণাটি জন্ম নেয় পরে। প্রথমদিকে কিছু মানুষের কাছে রক্ষিত অতিরিক্ত অর্থের নিরাপত্তার প্রয়োজন অনুভূত হয় এবং অন্য কিছু মানুষের ঋণ আকারে অর্থের প্রয়োজন হয়। এ ধরনের বিপরীতমুখী চাহিদার সমন্বয়ে ব্যাংকিং-এর জন্ম হয়। সে সময় মহাজন বা উপাসনালয়ের (মূলত চার্চের/মন্দিরের) পুরোহিতরা একপক্ষ থেকে অর্থ নিয়ে সঞ্চিত রাখত এবং অপরপক্ষকে তা ঋণ আকারে দিত। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে, যুগের ধারাবাহিকতায় ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়নের ফলে ব্যাংক ব্যবস্থার পূর্ণ বিকাশ ঘটে। তাই ব্যাংক ব্যবস্থার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশকে এই তিনটি বিষয়ের আলোকে নিচে বর্ণনা করা হলো। যেহেতু সভ্যতার বিবর্তনের সাথে ব্যাংক ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, সে কারণে সভ্যতার সাথে সংগতি রেখে ব্যাংকের ইতিহাস বর্ণনা করা হলো।

১। সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও ব্যাংক ব্যবস্থা

ক) সিন্ধু সভ্যতা (The Indus Civilization)

খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে সিন্ধু সভ্যতার সময় গ্রিস, রোম ও মিসরে ব্যবসায়িক লেনদেনের প্রচলন ছিল। এ সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক কোন ব্যাংক ছিল না। তবে অনানুষ্ঠানিক ব্যাংক ব্যবস্থা ছিল, যেখানে আমানত গ্রহণ, ঋণ দেওয়া ও বৈদেশিক বিনিময় ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল।

খ) ব্যাবিলনিয় সভ্যতা (The Babilonian Civilization)

এ সময়ে উপাসনালয়গুলো মানুষের কাছে বিশ্বস্ত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দে ব্যাবিলনিয় সভ্যতায় উপাসনালয়কে কেন্দ্র করে ব্যাংক ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। জনগণ বাড়তি অর্থ-সম্পদ নিরাপত্তার জন্য উপাসনালয়ের পুরোহিতদের কাছে জমা রাখত। কারণ, তখন পুরোহিতগণ সমাজের সৎ ও প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং উপাসনালয়গুলোতে চোর-ডাকাতের উপদ্রব ছিল না। পুরোহিতগণ জনগণের সঞ্চিত অর্থ জমা রাখতেন এবং অভাবগ্রস্থ মানুষদের সহযোগিতার জন্য ঋণ দিতেন। এসময় জমা রসিদ, চেক বই, নোটস ইত্যাদির প্রচলন ছিল। ব্যাবিলনিয় সভ্যতার পর বৈদিক সভ্যতার উত্থান ঘটে।

গ) বৈদিক যুগ (The Vedic Civilization)

হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদ ও মনুতে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দ থেকে ১০০০ অব্দ পর্যন্ত সময়কালে ভারতীয় উপমহাদেশে আমানত গ্রহণ ও ঋণ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় আদেশ-নিষেধের উল্লেখ রয়েছে। এ সময় ব্যাংকের লেনদেন দিন দিন প্রসার লাভ করে। তবে তখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি।

ঘ) রোমান সভ্যতা (The Roman Civilization)

খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দে রোমান সভ্যতাকালে ব্যাংক ব্যবস্থা অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। এ সময় অর্থ লেনদেনের কিছু নিয়মকানুন সৃষ্টি হয় এবং লেনদেন নিষ্পত্তিতে চেক বা ব্যাংক ড্রাফটের মত দলিলের প্রচলন হয়। সে সময়ে ঋণ দেওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিক ঋণদানকারী ব্যাংক (খড়ধহ ইধহশ) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলেও প্রমাণ পাওয়া যায়। ব্যাংক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেওয়ার পর চীনারা এর প্রসার ঘটায়।

ঙ) চৈনিক সভ্যতা (The Chinese Civilization)

খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে চৈনিক সভ্যতাকালে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। পাশাপাশি ব্যাংক ব্যবস্থাও সুসংগঠিত হয়। সে সময় প্রতিষ্ঠিত ‘শান্সি ব্যাংক’কে অনেকেই বিশ্বের প্রথম সংগঠিত ব্যাংক বলে মনে করেন। এই ব্যাংক আমানত সংগ্রহ এবং ঋণদান ছাড়াও মুদ্রা প্রচলনের দায়িত্ব পালন করত।

মুদ্রা প্রচলনের কারণে ব্যাংকের দায়িত্ব বেড়ে যায়। উপরের আলোচনা থেকে

২. যুগের ধারাবাহিকতায় ব্যাংকের ইতিহাস/ব্যাংক ব্যবস্থার ক্রমবিকাশ

যুগের ধারাবাহিকতায় ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়নের সাথে সাথে ব্যাংক ব্যবসায়ের উন্নয়ন ঘটেছে।

ক) প্রাচীন যুগ (খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দ)

  • সিন্ধু সভ্যতায় গ্রিস, রোম ও মিসরে মুদ্রার প্রচলন, আমানত সংরক্ষণ, ঋণদান ও বৈদেশিক বিনিময় ইত্যাদির প্রচলন ঘটে।
  • ব্যাবিলনিয় সভ্যতায় উপাসনালয় থেকে ব্যাংকিং-এর প্রচলন ঘটে।
  • রোমান সভ্যতায় ঋণ-ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে এটির তেমন প্রসার ঘটেনি।
  • চৈনিক সভ্যতায় ‘শান্সি ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।

খ. মধ্য যুগ (খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ থেকে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ)

  • জনকল্যাণধর্মী উপাসনালয়ের মাধ্যমে ব্যাংক ব্যবস্থার প্রসার ঘটে।
  • ইটালি সরকারের প্রচেষ্টায় ১১৫৭ সালে ব্যাংক অব ভেনিস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
  • জেনেভার বনিকদের যৌথ উদ্যোগে ১১৭৮ সালে ব্যাংক অব সানজর্জিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
  • ইটালির সরকারের উদ্যোগে ১৪০১ সালে ব্যাংক অব বার্সিলোনা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
  • ১৪০৭ সালে জেনেভাতে ব্যাংক অব জেনোয়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

গ. আধুনিক যুগ (১৬০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত)

  • শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংক ব্যবস্থার উন্নয়ন।
  • ১৬০৯ সালে ব্যাংক অব আমস্টার্ডাম প্রতিষ্ঠা।
  • ১৬১৯ সালে ব্যাংক অব হামবুর্গ প্রতিষ্ঠা।
  • ১৬৫৬ সালে সরকারি সনদপ্রাপ্ত ব্যাংক অব সুইডেন প্রতিষ্ঠা।
  • ১৬৯৪ সালে সরকারি সনদপ্রাপ্ত ব্যাংক অব ইংল্যান্ড প্রতিষ্ঠা।
  • ১৭০০ সালে কলকাতায় হিন্দুস্থান ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যাংক ব্যবস্থার সম্প্রসারণ।
  • ১৭৬৫ সালে জার্মানিতে ব্যাংক অব প্রুসিয়া প্রতিষ্ঠা।
  • বিভিন্ন দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, যেমন ব্যাংক অব ফ্রান্স (১৮০০ সাল), জার্মানির রেইখ ব্যাংক (১৮৭৫), ব্যাংক অব জাপান (১৮৮২), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম (১৯২০) ইত্যাদি।
  • বর্তমান সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অর্থনীতি, শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসারে বিশেষায়িত ব্যাংক প্রতিষ্ঠা।

ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাংক ব্যবস্থার ক্রমবিকাশ

প্রাচীনকাল, মোঘল আমল, ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশ আমল- এই পাঁচটি আমলে ব্যাংকের বিবর্তন নিচে আলোচনা করা হলো:

১) প্রাচীনকাল

প্রাচীনকালে ভারতীয় উপমহাদেশে অর্থ ও ঋণের প্রচলনের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রায় দুই হাজার বছর পূর্বে অর্থনীতিবিদ কৌটিল্য তাঁর ‘অর্থশাস্ত্র’ নামক বইয়ে ব্যাংক ব্যবসায়ের আলোচনা করেছেন। মাড়োয়ারী, কাবুলিওয়ালা, মুলতানি, জোদ্দার প্রভৃতি বংশের লোকজন ব্যাংক ব্যবসার প্রচলন ঘটায়। তবে আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান ছিল না। সুদভিত্তিক ঋণের ব্যবসা এই উপমহাদেশে প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত ছিল এবং পরে এটি আনুষ্ঠানিকতা লাভ করে।

২) মোঘল আমল

মোঘল আমলে উপমহাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপক প্রসার লাভ করে। ফলে ঢাকা, হুগলী ও মুর্শিদাবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্রে অর্থ-ব্যবসায়ীদের শাখা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। মোঘল শাসকরাও এই সকল ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানকে সহযোগিতা করতো। এ সময়ে মোঘলরা রাজস্ব ও খাজনা মুদ্রার মাধ্যমে আদায় করতেন। হুন্ডি ও বিনিময়পত্র তখন থেকেই প্রচলিত ছিল। বাংলা অঞ্চলের রাজস্ব মুর্শিদাবাদের জগৎশেঠ পরিবারের মাধ্যমে হুন্ডি করে দিল্লিতে পাঠানো হতো। অতএব বোঝা যায় যে, মোঘল আমলে হুন্ডি ও বিনিময়পত্রের প্রচলন ঘটে।

৩) ব্রিটিশ আমল

ব্রিটিশদের প্রচেষ্টায় ১৭৭০ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ইউরোপের আদলে ‘দ্য হিন্দুস্থান ব্যাংক’ কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি আবার ১৮৩২ সালে বন্ধ হয়ে যায়। হিন্দুস্থান ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর বেঙ্গল ব্যাংক (১৭৮৫), জেনারেল ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (১৭৮৫), ব্যাংক অব কলকাতা (১৮০৬), ব্যাংক অব বোম্বে (১৮৪০), ব্যাংক অব মাদ্রাজ (১৮৪৩), ইমপেরিয়াল ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (১৯২০), রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) (১৯৩৫) ইত্যাদি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়।

৪) পাকিস্তান আমল

১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটো দেশের জন্ম হয়। পাকিস্তানের একটি প্রদেশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ)। ভারত বিভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাংক ব্যবসায় সংকটের সম্মুখীন হয়। কারণ অধিকাংশ হিন্দু ব্যাংকার পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে চলে যায়। ১৯৪৮ সালের ১ জুলাই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে ‘দ্য স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান’ প্রতিষ্ঠিত হয়, যার প্রধান কার্যালয় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে। ১৯৪৯ সালে এই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রথম তালিকাভুক্ত ব্যাংক হিসেবে ‘দি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সময়ের সাথে সাথে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের আগ পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল ৩৬। সে সময় দেশীয় মালিকানাধীন ২ টি ব্যাংকের নাম ছিল ‘ইষ্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড’ ও ‘দি ইষ্টার্ণ ব্যাংকিং করপোরেশন লিমিটেড’।

৫) বাংলাদেশ আমল

পাকিস্তান আমলের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘দি স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান’-এর ঢাকাস্থ অফিসে স্বাধীন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার এক অধ্যাদেশ বলে ব্যাংক ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে দুটি দেশি ও ১০টি পশ্চিম পাকিস্তানী মালিকানাধীন ব্যাংককে জাতীয়করণ করে মোট ৬টি পৃথক সত্তা বিশিষ্ট রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে রূপান্তরিত করে।

এক নজরে এই নিবন্ধ

ব্যাংক (Bank) হলো এমন একটি আর্থিক মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান  (Financial Intermediary) যার কাজ হলো আমানত গ্রহণ করা, ঋণ দেওয়া, ঋণ ও অর্থ সৃষ্টি করা। ব্যাংকের অর্থ সংক্রান্ত যাবতীয় কাজকে সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং বলে। ব্যাংকের কাজ হলো আমানত গ্রহণ, ঋণদান, মুলধন গঠন ও বিনিয়োগ, নোট ও মুদ্রার প্রচলন, বিনিময়ের মাধ্যম সৃষ্টি, বিনিময় বিলের বাট্টাকরণ, অর্থ স্থানান্তর, মূল্যবান সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ, বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন, সরকারের অর্থ ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করা ইত্যাদি। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে সিন্ধু সভ্যতাকালে গ্রীস, রোম ও মিসরে অনানুষ্ঠানিক ব্যাংক ব্যবস্থার প্রমাণ পাওয়া যায়, যেখানে আমানত গ্রহণ, ঋণ দেওয়া ও বৈদেশিক বিনিময় ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দে ব্যাবিলনিয় সভ্যতায় উপাসনালয়কে কেন্দ্র করে ব্যাংক ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। বৈদিক যুগে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দ থেকে ১০০০ অব্দ পর্যন্ত সময়কালে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাংক ব্যবস্থার প্রচলন থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দে রোমান সভ্যতাকালে ব্যাংক ব্যবস্থা অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে চৈনিক সভ্যতাকালে ব্যাংক ব্যবস্থা সুসংগঠিত হয়। সে সময় প্রতিষ্ঠিত ‘শান্সি ব্যাংক’ বিশ্বের প্রথম সংগঠিত ব্যাংক। মধ্যযুগের শেষ দিকে কাগজী নোটের প্রচলন ঘটে এবং দেশ-বিদেশে শাখা ব্যাংক বা প্রতিনিধি নিয়োগের পদ্ধতি চালু হয়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার সোনালী, অগ্রণী, রূপালি, জনতা, উত্তরা ও পূবালী ব্যাংক নামে ৬টি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে। এগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক নামে পরিচিত ছিল।

শেয়ার করুন

One thought on “ব্যাংক কাকে বলে এবং ব্যাংকিং কী? ব্যাংকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

ব্যাংক কাকে বলে এবং ব্যাংকিং কী? ব্যাংকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস

প্রকাশ: ০৪:০৫:২৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১

আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাংক (Bank) একটি দেশের প্রধান অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি। অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন। ব্যাংক ব্যবসায় একটি পুরাতন ব্যবসায়। এ ব্যবসায়ের মূল ভিত্তি হলো অর্থ (টাকা, ডলার ইত্যাদি)। অর্থকে কেন্দ্র করে ব্যাংকিং ব্যবসা আবর্তিত হয়। অর্থের প্রচলন শুরু হওয়ার পর থেকেই ব্যাংক ব্যবসায়ের শুরু। মধ্যযুগে ইহুদী ব্যবসায়ীরা এক পক্ষের কাছ থেকে কম সুদের বিনিময়ে অর্থ আমানত হিসাবে গ্রহণ করত এবং অন্য পক্ষের কাছে এই অর্থ অপেক্ষাকৃত বেশি সুদে ধার হিসেবে দিত। এর মধ্য দিয়েই ব্যাংক ব্যবসার জন্ম হয়। কিন্তু বর্তমানে ব্যাংক ব্যবস্থা শুধু আমানত নেওয়া ও ঋণ দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। উৎপাদনখাতে বিনিয়োগ আর ব্যাংকের কাজ হলো উক্তরূপ বিনিয়োগের জন্য পুঁজি সংগ্রহ ও সরবরাহ করা। এই নিবন্ধে ব্যাংকের সংজ্ঞা, ব্যাংকিংয়ের সংজ্ঞা ব্যাংকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ বা ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

এক নজরে এই নিবন্ধ

ব্যাংক কাকে বলে? (Definition of Bank)

ব্যাংক এমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেটি এক পক্ষের কাছ থেকে আমানত হিসাবে অর্থ জমা রাখে এবং অন্য পক্ষকে আমানতি অর্থ থেকে ঋণ দেয়। ব্যাপক অর্থে, ব্যাংক হলো এমন একটি আর্থিক মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান (Financial Intermediary) যা আমানত গ্রহণ করা, ঋণ দেওয়া এবং ঋণ ও অর্থ সৃষ্টি করাসহ বিভিন্ন ধরনের আর্থিক কাজ সম্পন্ন করে।

স্যার অ্যালেক্সান্ডার কির্কল্যান্ড কেইর্নক্রোস (Sir Alexander KirklandAlecCairncross) এর মতে, ব্যাংক হলো একটি আর্থিক মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান, যেটি ধার ও ঋণের ব্যবসায় করে (A bank is a financial intermediary, a dealer in loans and debts)।

১৯৪৯ সালে ভারতীয় ব্যাংক আইন অনুসারে, ব্যাংক হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা ঋণ দেওয়া বা বিনিয়োগ করার উদ্দেশ্যে জনগণের কাছ থেকে আমানত হিসেবে অর্থ গ্রহণ করে, যে অর্থ চাহিবামাত্র বা অন্যভাবে ফেরত দিতে হয় এবং যা চেক, ড্রাফ্ট বা অন্যভাবে উঠিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা থাকে।

অর্থাৎ, ব্যাংক হলো এমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান যা বিভিন্ন ব্যাংক-হিসাব (Bank Account) এর মাধ্যমে কম সুদে আমানত সংগ্রহ করে এবং ঐ অর্থ বেশি সুদে অন্য পক্ষকে ঋণ দিয়ে মুনাফা অর্জন করে।

ব্যাংকিং কী? (What Is Banking?)

সাধারণভাবে, ব্যাংকের অর্থ সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যাবলিকে ব্যাংকিং বলে। প্রশ্ন হলো, ব্যাংকের কাজ কী? চলতি, সঞ্চয়ী ও মেয়াদি হিসাবে অর্থ গ্রহণ করা, গ্রাহকদের চেক গ্রহণ করা, দাবি পরিশোধ করা, ঋণ দেওয়া, বিলবাট্টা করা, গ্রাহকদের অর্থ একস্থান থেকে অন্যস্থানে স্থানান্তরে সাহায্য করা ইত্যাদি ব্যাংকের কাজ। এ সকল কাজই সমষ্টিগতভাবে ব্যাংকিং নামে পরিচিত। এ বিষয়ে ব্যাংকিং আইনের সংজ্ঞাটি জেনে নিই। ১৯৪৯ সালের ভারতীয় ব্যাংকিং আইনের ৫(১) ধারা অনুযায়ী, ঋণ মঞ্জুর বা অর্থ বিনিয়োগ করা, জনগণের অর্থ আমানত হিসেবে সংগ্রহ করা এবং চাহিবামাত্র বা অন্য কোন অবস্থায় তা উত্তোলনের সুযোগ প্রদান করাই হলো ব্যাংকিং (Banking means the accepting, for the purpose of lending or investment of deposits or money from the public, re-payable on demand or otherwise, and withdrawable by cheque, draft, order or otherwise)|

আমানত গ্রহণ, ঋণ দেওয়া, চেক পরিশোধ করা, বিলবাট্টা করা, অর্থ স্থানান্তর করা, ঋণ ও বিনিময়ের মাধ্যম সৃষ্টি করা, মক্কেলের মূল্যবান দ্রব্য ও দলিল সংরক্ষণ করা, মক্কেলের বিলের স্বীকৃতি দেওয়া, আমানত হিসেবে প্রাপ্ত অর্থ বিনিয়োগ করাসহ ব্যাংকের যাবতীয় কাজকে একসাথে ব্যাংকিং বলা হয়।

সুতরাং, ব্যাংক হলো একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং এ প্রতিষ্ঠানের কাজগুলোই হলো ব্যাংকিং। ব্যাংক যখন অন্য কোনো ব্যক্তির কাজ করে, তখন ব্যাংক সে ব্যক্তির ব্যাংকার হিসেবে অভিহিত হয়। ধরুন, আপনি সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে যাবতীয় লেনদেন করেন। তাহলে সোনালী ব্যাংকটি হলো আপনার ব্যাংকার। বাংলাদেশ ব্যাংক যেহেতু সরকারের কাজ করে, সে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক হলো সরকারের ব্যাংকার।

ব্যাংকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ (Origin and Evolution of Banks)

অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে বিনিময় প্রথা চালু ছিল। অর্থাৎ পণ্যের বিনিময়ে পণ্য বেচা-কেনা হতো। পরে মুদ্রার প্রচলন ঘটে। প্রাচীনকালে মুদ্রার প্রচলন শুরু হলেও ব্যাংক ব্যবস্থার ধারণাটি জন্ম নেয় পরে। প্রথমদিকে কিছু মানুষের কাছে রক্ষিত অতিরিক্ত অর্থের নিরাপত্তার প্রয়োজন অনুভূত হয় এবং অন্য কিছু মানুষের ঋণ আকারে অর্থের প্রয়োজন হয়। এ ধরনের বিপরীতমুখী চাহিদার সমন্বয়ে ব্যাংকিং-এর জন্ম হয়। সে সময় মহাজন বা উপাসনালয়ের (মূলত চার্চের/মন্দিরের) পুরোহিতরা একপক্ষ থেকে অর্থ নিয়ে সঞ্চিত রাখত এবং অপরপক্ষকে তা ঋণ আকারে দিত। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে, যুগের ধারাবাহিকতায় ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়নের ফলে ব্যাংক ব্যবস্থার পূর্ণ বিকাশ ঘটে। তাই ব্যাংক ব্যবস্থার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশকে এই তিনটি বিষয়ের আলোকে নিচে বর্ণনা করা হলো। যেহেতু সভ্যতার বিবর্তনের সাথে ব্যাংক ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, সে কারণে সভ্যতার সাথে সংগতি রেখে ব্যাংকের ইতিহাস বর্ণনা করা হলো।

১। সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও ব্যাংক ব্যবস্থা

ক) সিন্ধু সভ্যতা (The Indus Civilization)

খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে সিন্ধু সভ্যতার সময় গ্রিস, রোম ও মিসরে ব্যবসায়িক লেনদেনের প্রচলন ছিল। এ সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক কোন ব্যাংক ছিল না। তবে অনানুষ্ঠানিক ব্যাংক ব্যবস্থা ছিল, যেখানে আমানত গ্রহণ, ঋণ দেওয়া ও বৈদেশিক বিনিময় ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল।

খ) ব্যাবিলনিয় সভ্যতা (The Babilonian Civilization)

এ সময়ে উপাসনালয়গুলো মানুষের কাছে বিশ্বস্ত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দে ব্যাবিলনিয় সভ্যতায় উপাসনালয়কে কেন্দ্র করে ব্যাংক ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। জনগণ বাড়তি অর্থ-সম্পদ নিরাপত্তার জন্য উপাসনালয়ের পুরোহিতদের কাছে জমা রাখত। কারণ, তখন পুরোহিতগণ সমাজের সৎ ও প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং উপাসনালয়গুলোতে চোর-ডাকাতের উপদ্রব ছিল না। পুরোহিতগণ জনগণের সঞ্চিত অর্থ জমা রাখতেন এবং অভাবগ্রস্থ মানুষদের সহযোগিতার জন্য ঋণ দিতেন। এসময় জমা রসিদ, চেক বই, নোটস ইত্যাদির প্রচলন ছিল। ব্যাবিলনিয় সভ্যতার পর বৈদিক সভ্যতার উত্থান ঘটে।

গ) বৈদিক যুগ (The Vedic Civilization)

হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদ ও মনুতে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দ থেকে ১০০০ অব্দ পর্যন্ত সময়কালে ভারতীয় উপমহাদেশে আমানত গ্রহণ ও ঋণ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় আদেশ-নিষেধের উল্লেখ রয়েছে। এ সময় ব্যাংকের লেনদেন দিন দিন প্রসার লাভ করে। তবে তখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি।

ঘ) রোমান সভ্যতা (The Roman Civilization)

খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দে রোমান সভ্যতাকালে ব্যাংক ব্যবস্থা অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। এ সময় অর্থ লেনদেনের কিছু নিয়মকানুন সৃষ্টি হয় এবং লেনদেন নিষ্পত্তিতে চেক বা ব্যাংক ড্রাফটের মত দলিলের প্রচলন হয়। সে সময়ে ঋণ দেওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিক ঋণদানকারী ব্যাংক (খড়ধহ ইধহশ) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলেও প্রমাণ পাওয়া যায়। ব্যাংক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেওয়ার পর চীনারা এর প্রসার ঘটায়।

ঙ) চৈনিক সভ্যতা (The Chinese Civilization)

খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে চৈনিক সভ্যতাকালে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। পাশাপাশি ব্যাংক ব্যবস্থাও সুসংগঠিত হয়। সে সময় প্রতিষ্ঠিত ‘শান্সি ব্যাংক’কে অনেকেই বিশ্বের প্রথম সংগঠিত ব্যাংক বলে মনে করেন। এই ব্যাংক আমানত সংগ্রহ এবং ঋণদান ছাড়াও মুদ্রা প্রচলনের দায়িত্ব পালন করত।

মুদ্রা প্রচলনের কারণে ব্যাংকের দায়িত্ব বেড়ে যায়। উপরের আলোচনা থেকে

২. যুগের ধারাবাহিকতায় ব্যাংকের ইতিহাস/ব্যাংক ব্যবস্থার ক্রমবিকাশ

যুগের ধারাবাহিকতায় ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়নের সাথে সাথে ব্যাংক ব্যবসায়ের উন্নয়ন ঘটেছে।

ক) প্রাচীন যুগ (খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দ)

  • সিন্ধু সভ্যতায় গ্রিস, রোম ও মিসরে মুদ্রার প্রচলন, আমানত সংরক্ষণ, ঋণদান ও বৈদেশিক বিনিময় ইত্যাদির প্রচলন ঘটে।
  • ব্যাবিলনিয় সভ্যতায় উপাসনালয় থেকে ব্যাংকিং-এর প্রচলন ঘটে।
  • রোমান সভ্যতায় ঋণ-ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে এটির তেমন প্রসার ঘটেনি।
  • চৈনিক সভ্যতায় ‘শান্সি ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।

খ. মধ্য যুগ (খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ থেকে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ)

  • জনকল্যাণধর্মী উপাসনালয়ের মাধ্যমে ব্যাংক ব্যবস্থার প্রসার ঘটে।
  • ইটালি সরকারের প্রচেষ্টায় ১১৫৭ সালে ব্যাংক অব ভেনিস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
  • জেনেভার বনিকদের যৌথ উদ্যোগে ১১৭৮ সালে ব্যাংক অব সানজর্জিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
  • ইটালির সরকারের উদ্যোগে ১৪০১ সালে ব্যাংক অব বার্সিলোনা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
  • ১৪০৭ সালে জেনেভাতে ব্যাংক অব জেনোয়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

গ. আধুনিক যুগ (১৬০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত)

  • শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংক ব্যবস্থার উন্নয়ন।
  • ১৬০৯ সালে ব্যাংক অব আমস্টার্ডাম প্রতিষ্ঠা।
  • ১৬১৯ সালে ব্যাংক অব হামবুর্গ প্রতিষ্ঠা।
  • ১৬৫৬ সালে সরকারি সনদপ্রাপ্ত ব্যাংক অব সুইডেন প্রতিষ্ঠা।
  • ১৬৯৪ সালে সরকারি সনদপ্রাপ্ত ব্যাংক অব ইংল্যান্ড প্রতিষ্ঠা।
  • ১৭০০ সালে কলকাতায় হিন্দুস্থান ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যাংক ব্যবস্থার সম্প্রসারণ।
  • ১৭৬৫ সালে জার্মানিতে ব্যাংক অব প্রুসিয়া প্রতিষ্ঠা।
  • বিভিন্ন দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, যেমন ব্যাংক অব ফ্রান্স (১৮০০ সাল), জার্মানির রেইখ ব্যাংক (১৮৭৫), ব্যাংক অব জাপান (১৮৮২), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম (১৯২০) ইত্যাদি।
  • বর্তমান সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অর্থনীতি, শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসারে বিশেষায়িত ব্যাংক প্রতিষ্ঠা।

ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাংক ব্যবস্থার ক্রমবিকাশ

প্রাচীনকাল, মোঘল আমল, ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশ আমল- এই পাঁচটি আমলে ব্যাংকের বিবর্তন নিচে আলোচনা করা হলো:

১) প্রাচীনকাল

প্রাচীনকালে ভারতীয় উপমহাদেশে অর্থ ও ঋণের প্রচলনের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রায় দুই হাজার বছর পূর্বে অর্থনীতিবিদ কৌটিল্য তাঁর ‘অর্থশাস্ত্র’ নামক বইয়ে ব্যাংক ব্যবসায়ের আলোচনা করেছেন। মাড়োয়ারী, কাবুলিওয়ালা, মুলতানি, জোদ্দার প্রভৃতি বংশের লোকজন ব্যাংক ব্যবসার প্রচলন ঘটায়। তবে আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান ছিল না। সুদভিত্তিক ঋণের ব্যবসা এই উপমহাদেশে প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত ছিল এবং পরে এটি আনুষ্ঠানিকতা লাভ করে।

২) মোঘল আমল

মোঘল আমলে উপমহাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপক প্রসার লাভ করে। ফলে ঢাকা, হুগলী ও মুর্শিদাবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্রে অর্থ-ব্যবসায়ীদের শাখা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। মোঘল শাসকরাও এই সকল ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানকে সহযোগিতা করতো। এ সময়ে মোঘলরা রাজস্ব ও খাজনা মুদ্রার মাধ্যমে আদায় করতেন। হুন্ডি ও বিনিময়পত্র তখন থেকেই প্রচলিত ছিল। বাংলা অঞ্চলের রাজস্ব মুর্শিদাবাদের জগৎশেঠ পরিবারের মাধ্যমে হুন্ডি করে দিল্লিতে পাঠানো হতো। অতএব বোঝা যায় যে, মোঘল আমলে হুন্ডি ও বিনিময়পত্রের প্রচলন ঘটে।

৩) ব্রিটিশ আমল

ব্রিটিশদের প্রচেষ্টায় ১৭৭০ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ইউরোপের আদলে ‘দ্য হিন্দুস্থান ব্যাংক’ কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি আবার ১৮৩২ সালে বন্ধ হয়ে যায়। হিন্দুস্থান ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর বেঙ্গল ব্যাংক (১৭৮৫), জেনারেল ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (১৭৮৫), ব্যাংক অব কলকাতা (১৮০৬), ব্যাংক অব বোম্বে (১৮৪০), ব্যাংক অব মাদ্রাজ (১৮৪৩), ইমপেরিয়াল ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (১৯২০), রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) (১৯৩৫) ইত্যাদি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়।

৪) পাকিস্তান আমল

১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটো দেশের জন্ম হয়। পাকিস্তানের একটি প্রদেশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ)। ভারত বিভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাংক ব্যবসায় সংকটের সম্মুখীন হয়। কারণ অধিকাংশ হিন্দু ব্যাংকার পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে চলে যায়। ১৯৪৮ সালের ১ জুলাই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে ‘দ্য স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান’ প্রতিষ্ঠিত হয়, যার প্রধান কার্যালয় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে। ১৯৪৯ সালে এই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রথম তালিকাভুক্ত ব্যাংক হিসেবে ‘দি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সময়ের সাথে সাথে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের আগ পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল ৩৬। সে সময় দেশীয় মালিকানাধীন ২ টি ব্যাংকের নাম ছিল ‘ইষ্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড’ ও ‘দি ইষ্টার্ণ ব্যাংকিং করপোরেশন লিমিটেড’।

৫) বাংলাদেশ আমল

পাকিস্তান আমলের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘দি স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান’-এর ঢাকাস্থ অফিসে স্বাধীন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার এক অধ্যাদেশ বলে ব্যাংক ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে দুটি দেশি ও ১০টি পশ্চিম পাকিস্তানী মালিকানাধীন ব্যাংককে জাতীয়করণ করে মোট ৬টি পৃথক সত্তা বিশিষ্ট রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে রূপান্তরিত করে।

এক নজরে এই নিবন্ধ

ব্যাংক (Bank) হলো এমন একটি আর্থিক মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান  (Financial Intermediary) যার কাজ হলো আমানত গ্রহণ করা, ঋণ দেওয়া, ঋণ ও অর্থ সৃষ্টি করা। ব্যাংকের অর্থ সংক্রান্ত যাবতীয় কাজকে সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং বলে। ব্যাংকের কাজ হলো আমানত গ্রহণ, ঋণদান, মুলধন গঠন ও বিনিয়োগ, নোট ও মুদ্রার প্রচলন, বিনিময়ের মাধ্যম সৃষ্টি, বিনিময় বিলের বাট্টাকরণ, অর্থ স্থানান্তর, মূল্যবান সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ, বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন, সরকারের অর্থ ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করা ইত্যাদি। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে সিন্ধু সভ্যতাকালে গ্রীস, রোম ও মিসরে অনানুষ্ঠানিক ব্যাংক ব্যবস্থার প্রমাণ পাওয়া যায়, যেখানে আমানত গ্রহণ, ঋণ দেওয়া ও বৈদেশিক বিনিময় ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দে ব্যাবিলনিয় সভ্যতায় উপাসনালয়কে কেন্দ্র করে ব্যাংক ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। বৈদিক যুগে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দ থেকে ১০০০ অব্দ পর্যন্ত সময়কালে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাংক ব্যবস্থার প্রচলন থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দে রোমান সভ্যতাকালে ব্যাংক ব্যবস্থা অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে চৈনিক সভ্যতাকালে ব্যাংক ব্যবস্থা সুসংগঠিত হয়। সে সময় প্রতিষ্ঠিত ‘শান্সি ব্যাংক’ বিশ্বের প্রথম সংগঠিত ব্যাংক। মধ্যযুগের শেষ দিকে কাগজী নোটের প্রচলন ঘটে এবং দেশ-বিদেশে শাখা ব্যাংক বা প্রতিনিধি নিয়োগের পদ্ধতি চালু হয়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার সোনালী, অগ্রণী, রূপালি, জনতা, উত্তরা ও পূবালী ব্যাংক নামে ৬টি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে। এগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক নামে পরিচিত ছিল।