পাঠটীকা কী? পাঠটীকা প্রণয়নের পূর্বশর্ত এবং পাঠটীকার প্রয়োজনীতা কী?
- প্রকাশ: ০২:০৩:২৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১
- / ১১৯৭৭ বার পড়া হয়েছে
শিক্ষা আজ আর সেই সনাতনী পথে কিংবা গতানুগতিক পথে চলে না। শিক্ষাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে তত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব ও বিজ্ঞানের দৃঢ়তায়। ফলে, নতুন শিক্ষাদান পদ্ধতির উদ্ভাবন হয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে পদ্ধতি বিজ্ঞান (methodology)।
বর্তমানে শ্রেণিশিক্ষণ (classroom teaching) কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয় উপযুক্ত পরিকল্পনা অনুসারে। একজন শিক্ষক যদি সহজ ও সঠিকভাবে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের পাঠদান বা শিক্ষাদান করতে চান তাহলে সেক্ষেত্রে তার পাঠ পরিকল্পনা (lesson plan) প্রণয়ন করা কিংবা পাঠটীকা (lesson note) রাখা জরুরি। কারণ শিক্ষক সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হয়ে শ্রেণিকক্ষে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুযায়ী পাঠদান করবেন। তিনি কী পড়াবেন, কীভাবে পড়াবেন, কোন পদ্ধতি অনুযায়ী পড়াবেন, তা আগে থেকেই স্থির করতে হবে।
দৈনন্দিন শ্রেণিশিক্ষা পরিচলানার প্রস্ততি ও পরিকল্পনার লিখিত বৈজ্ঞানিক রূপকে বলা হয় পাঠটীকা বা পাঠ পরিকল্পনা।
পাঠ পরিকল্পনা বা পাঠটীকা প্রণয়ন করার পূর্বশর্ত
একটি সুনির্দিষ্ট ছকে পরিকল্পনা করে শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের জন্য প্রস্তুত হবেন। একটি নির্দিষ্ট বিষয় শিক্ষাদানকে সার্থক বা ফলপ্রসূ করে তোলার জন্য শিক্ষককে আগে থেকেই কিছু চিন্তা ভাবনা করা প্রয়োজন। একে পাঠ পরিকল্পনার পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এ শর্তগুলো নিম্নরূপ:
১. নির্দিষ্ট পাঠের যে বিশেষ অংশটি পড়ানো হবে তা নির্বাচন করতে হবে।
২. নির্দিষ্ট বিষয় সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা অর্জনের জন্য নির্ধারিত অংশটি কয়েকবার পড়ে নিতে হবে।
৩. নির্ধারিত বিষয়টি শেখানোর উদ্দেশ্যগুলো চিহ্নিত করতে হবে।
৪. পাঠের বিশেষ বিশেষ অংশের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
৫. পাঠকে কার্যকর ও বৈচিত্র্যময় করে তোলার জন্য প্রাসঙ্গিক সহায়ক উপকরণ নির্বাচন করতে হবে। এ কাজটি অত্যন্ত সুচিন্তিত হওয়া প্রয়োজন।
৬. পাঠদানের আধুনিক পদ্ধতিগুলো সন্বন্ধে অবহিত হবেন এবং শিক্ষার্থীদের বয়স ও মানসিক সামর্থ্য বিবেচনা করে সর্বাপেক্ষা উপযোগী পদ্ধতিটি অনুসরণ করবেন।
৭. পদ্ধতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে পাঠ পরিবেশনা, অনুশীলন এবং মূল্যায়নের কৌশলগুলো সম্বন্ধে সচেতন থাকতে হবে।
৮. পাঠ পরিকল্পনা শ্রেণি উপযোগী হতে হবে।
৯. সময়ের দিকে লক্ষ্য রেখে পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
১০. পাঠ পরিকল্পনা হবে অংশগ্রহণমূলক; অর্থাৎ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রতিফলন থাকবে।
১১. জীবনমুখী ও বাস্তবধর্মী শিক্ষার কথাও পাঠটীকা প্রণয়নের সময় বিবেচনা করতে হবে।
কেন পাঠটীকা প্রণয়ন করতে হবে?
যে সকল কারণে শিক্ষককে পাঠটীকা প্রণয়ন করতে হবে, সেগুলো হচ্ছে-
১. পাঠদান একটি সম্পূর্ণ মনোবৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া বলে একে বিশৃঙ্খলভাবে উপস্থাপন করা চলে না। এজন্য একটি সুচিন্তিত কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করা প্রয়োজন।
২. শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন নতুন গবেষণা এবং চিন্তা-চেতনার ফলে পাঠদান পদ্ধতিতে নতুনতর ভাবধারার সংযোজন ঘটেছে।
৩. পাঠটীকার মাধ্যমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়।
৪. পাঠটীকা পাঠের গতিকে স্বচ্ছন্দ করে, শিক্ষার্থীর গ্রহণ ক্ষমতাকে উদ্দীপ্ত করে।
৫. পাঠটীকার মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যে পাঠদান শেষ করা যায়।
৬. পাঠটীকা শিক্ষককে সৃজনশীল তৎপরতায় উজ্জীবিত করে। তিনি পদ্ধতিগত দিক থেকে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করতে পারেন।
৭. পাঠটীকা শিক্ষককে অধিক পাঠে এবং বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে সাহায্য করে।
৮. পাঠটীকার মাধ্যমে শিক্ষক মূল্যায়নের বিভিন্ন দিকগুলো নির্ধারণ করতে পারেন।
৯. পাঠটীকার মাধ্যমে শিক্ষক নির্দিষ্ট পাঠের উদ্দেশ্যের নিরিখে পাঠদানকে পরিচালনা করতে পারেন।
শিক্ষা প্রক্রিয়ার স্তর
হার্বাটের মনস্তাত্তিক বিশ্লেষণ অনুসারে শিক্ষা প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তর ৪ টি, যথা
১. সুস্পষ্টতা (Clearness)
২. সংযোগ (Association)
৩. শ্রেণিভুক্তকরণ (Classification or Systematisation)
৪. প্রয়োগ পদ্ধতি (Method)
হার্বাটের শিক্ষাতত্ত্বের এই চারটি স্তরকে তাঁর অনুগামীরা কিছুটা পরিবর্তিত করে পাঁচটি সোপানে দাঁড় করান। সুস্পষ্টতা (Clearness) স্তরটি শিক্ষা ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই স্তরটিকে ভেঙ্গে আয়োজন (Preparation) ও উপস্থাপন (Presentation) এই দুটি অংশে ভাগ করেন।
হার্বার্টের শিক্ষাতত্ত্বকে অনুসরণ করে তাঁর অনুগামীরা পঞ্চসোপান শিক্ষাপদ্ধতির (Five Format
Steps of Instruction) সৃষ্টি করেন। পাঁচটি সোপান বা স্তর হলো-
১. প্রস্তুতি বা আয়োজন
২. উপস্থাপন
৩. তুলনা
৪. সূত্রগঠন
৫. প্রয়োগ ও অভিযোজন
হার্বার্টের নির্দেশিত আদর্শ অনুযায়ী বর্তমানে পাঁচটি সোপানকে সংক্ষিপ্ত করে তিনটি সোপানে পরিবর্তিত করে পাঠটীকা করা হয়। এই সোপান তিনটি হলো:
১. আয়োজন
২. উপস্থাপন
৩. অভিযোজন
হার্বার্টের পঞ্চসোপানের তুলনা, সুত্রগঠন-এই দুটি সোপানকে উপস্থাপন পর্যায়ে অঅন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শ্রেণি উপযুক্ত করে পাঠটীকা রচনা করতে হবে। পাঠটীকা রচনার সময় শিক্ষার্থীদের সামাজিক, প্রক্ষোভিক ও যৌক্তিক বিকাশের স্তর বা পর্যায়ের কথা সবসময় মনে রাখতে হবে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন অবদান, মনীষীদের বিভিন্ন বক্তব্য, ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা পাঠটীকা রচনাকালে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে অবশ্যই যুক্ত হবে। শিক্ষাদানের বিভিন্ন পিরিয়ড এর ব্যাপ্তিকাল বিভিন্ন ধরনের থাকে। তাই পাঠটীকা রচনার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যে, শিক্ষাদানের জন্য কতখানি সময়
পাওয়া যাবে। কোন ঋতুতে পাঠদান করা হচ্ছে, সে কথাও পাঠটীকা তৈরির সময় মনে রাখতে হবে। কারণ গ্রীষ্মকালে শিক্ষার্থীদের পাঠগ্রহণে ক্লান্তি কম সময়ে আসে। কোথায় কোন শিক্ষা সহায়ক উপকরণ ব্যবহার করা হবে তা নির্দেশিত থাকবে। বিভিন্ন প্রশ্ন, বিভিন্ন পদ্ধতির ব্যবহার, উদাহরণ ইত্যাদি কোথায় কী ব্যবহৃত হবে তা পাঠটীকায় স্থান পাবে। শিক্ষার্থীকে পাঠগ্রহণে
কতখানি সক্রিয় করা যায় তার প্রতিফলন পাঠটীকায় পড়বে। জীবনমুখী ও বাস্তবধর্মী শিক্ষার কথাও পাঠটীকা রচনার সময় বিচার বিবেচনা করতে হবে। পাঠটীকার স্তরগুলি হলো উদ্দেশ্য, উপকরণ, আয়োজন বা প্রস্তুতি, পাঠ ঘোষণা, উপস্থাপন, অভিযোজন ও বাড়ির কাজ।