মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার কার্যাবলি
- প্রকাশ: ১১:৫৭:১৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২১
- / ৯৮১০ বার পড়া হয়েছে
যে-কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্যই মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মৌলিক কাজ | ছবি: সেবাস্তিয়ান হারম্যান
মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার (Human Resource Management) কার্যাবলি সর্বদা জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই সম্পন্ন হয়ে থাকে। মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার অন্যতম প্রধান কাজ হলো প্রতিষ্ঠানের জন্য দক্ষ ও প্রয়োজনীয় জনশক্তি তৈরি করা। লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হয় প্রয়োজন অনুসারে যোগ্য ও দক্ষ কর্মী সংগ্রহ করা। কর্মী সংগ্রহ করার পর তাদেরকে নির্দিষ্ট কাজে নিয়োগ করার পূর্বে প্রয়োজনে প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হয়। কর্মীদেরকে নিয়োগ প্রদানের পরেও উদ্ভুত কিংবা সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হতে পারে। এছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- কর্মীদের দক্ষতার উন্নতি করা এবং উপযুক্ত পারিতোষিকের মাধ্যমে তাদেরকে ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হয়। এ সবই মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার কাজ।
একেকটি প্রতিষ্ঠানের আয়তন, ধরন, উদ্দেশ্য ইত্যাদি অনুসারে এর যাবতীয় কার্যাবলি বস ব্যবস্থাপনা বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনায়ও প্রতিষ্ঠানভেদে নীতিগতভাবে ভিন্নতা রয়েছে। তবে নীতিগতভাবে ভিন্নতা থাকা স্বত্তেও মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার মূল কার্যাবলি একই রকম।
মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার কাজকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- ১. স্টাফিং বা কর্মী সংগ্রহ (Staffing); ২. প্রশিক্ষণ, উন্নয়ন ও ব্যবহার (Training, Development & Utilization); ৩. প্রেষণাদান ও ক্ষমতায়ন (Motivation & Empowerment); ৪. সংরক্ষণ (Maintenance); এবং ৫. মনিটরিং (Monitoring)
১. স্টাফিং:
প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদ পূরণের প্রক্রিয়া হলো স্টাফিং। প্রতিষ্ঠানের কর্মীর প্রয়োজনীয়তা চিহ্নিত করে কর্মী সংগ্রহ, নির্বাচন ও স্থাপনের মাধ্যমে শূন্যপদ পূরণ করাকে স্টাফিং বলে। স্টাফিংয়ের আওতাভুক্ত কাজগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হয়েছে:
i. কার্যবিশ্লেষণ: যে প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠানের একটি নির্দিষ্ট পদ বা কার্যের বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানা যায় তাকে কার্যবিশ্লেষণ বলে। কার্য বিশ্লেষনের মাধ্যমে কর্মী সংগ্রহ ও নির্বাচন, কর্মীর দক্ষতা, যোগ্যতা ও গুণাবলি ইত্যাদি সম্পর্কে জানা যায়। ফলে সঠিক মজুরি কাঠামো নির্ধারণ সহজ হয়।
ii. মানব সম্পদ পরিকল্পনা: যে প্রক্রিয়া বা পদ্ধতির মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনাসমূহ বাস্তবায়নেরর জন্য জনশক্তির চাহিদা নিরূপণ ও চাহিদা পূরণের যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তাকে মানব সম্পদ পরিকল্পনা বলে। এর মাধ্যমে সংগঠন কর্মী সংক্রান্ত যাবতীয় পূর্ব ধারণা পেয়ে থাকে, ফলে নির্দিষ্ট সময়ে উপযুক্ত কর্মী পেতে অসুবিধা হয় না।
iv. কর্মী সংগ্রহ ও নির্বাচন: যে পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোনো প্রতিষ্ঠানের শূন্যপদ পূরণের জন্য চাকুরি প্রার্থীদের কাজের প্রতি প্রলুব্ধ করা হয় তাকে কর্মী সংগ্রহ বলে। অন্যদিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে অধিক যোগ্যদের কার্যে নিয়োগ দেয়াকে কর্মী নির্বাচন বলে।
v. নির্দেশনা ও স্থাপনা: কর্মী নিয়োগের পর তাদের সঠিক স্থানে স্থাপন করে কার্য শুরুর নির্দেশ দিতে হয়। এক্ষেত্রে কর্মীদের যোগ্যতা, কাজের প্রতি ঝোঁক, আগ্রহ প্রবণতা ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে উপযুক্ত কর্মীকে উপযুক্ত স্থানে স্থাপন করা যায়।
২. প্রশিক্ষণ, উন্নয়ন ও ব্যবহার
মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে কর্মীদের ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তোলা। এ পর্যায়ে কাজগুলো নিম্নরূপ:
i. কর্মী পরিচিতি ও সামাজিকীকরণ: নতুন নিয়োগকৃত কর্মী প্রতিষ্ঠানের সামগ্রীক পরিবেশ সম্পর্কে অপরিচিত থাকে। তাই কর্মীদের প্রতিষ্ঠানের নতুন পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ, রীতি-নীতি, উদ্দেশ্য ও কার্যাবলির সাথে পরিচিত ও অভিযোজনের
কাজ করতে হয়।
ii. প্রশিক্ষণ: যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কর্মীদের কর্ম দক্ষতা বৃদ্ধি, আচর- আচরণ উন্নত ও কাজ সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান দেওয়া হয় তাকে প্রশিক্ষণ বলে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মী যে কোন পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে।
iii. কর্মী উন্নয়ন বা মানব সম্পদ উন্নয়ন: কর্মী উন্নয়ন হলো একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সংগঠনে কর্মরত সকল নির্বাহী ও কর্মীদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি করা হয়। বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে তাদের কর্মদক্ষতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা, আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা ইত্যাদি সুদূর প্রসারিত করার চেষ্টা করা হয়।
iv. পেশা উন্নয়ন: কর্মরত কর্মীদের ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও ঝোঁকের উপর নির্ভর করে সঠিক কাজে স্থাপন করা হয় এবং সংগঠনের সকল সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়। ফলে কর্মীর পেশার উন্নয়ন ঘটে।
v. সাংগঠনিক উন্নয়ন: সংগঠনের সকল সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের জন্য সঠিক পন্থা অবলম্বন করতে শক্তি বা সামর্থ সৃষ্টি করাই হলো সাংগঠনিক উন্নয়ন।
৩. প্রেষণা দান ও ক্ষমতায়ন
মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো কর্মীদের প্রেষণা দান ও যৌক্তিক ক্ষমতায়ন করা। প্রেষণাদান ও ক্ষমতায়ন পর্যায়ে সংগঠনের বিবেচ্য কাজগুলো হলো-
i. কার্য নকশা: সংগঠনের কাঠামোগত অবস্থা তুলে ধরার চিত্রকে কার্য নকশা বলে। এর মাধ্যমে সংগঠনের সার্বিক কাঠামোগত উপাদান ও এদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ করা হয়।
ii. প্রেষণা ও কর্ম সন্তোষ্টি: কর্মীর প্রত্যাশা অনুযায়ী উপযুক্ত আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা দান করে কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করাকে প্রেষণা বলে। প্রেষিত কর্মী উপযুক্ত কাজ ও পারিতোষিক পায় বলে কাজের প্রতি সন্তুষ্ট থাকে। সন্তুষ্ট কর্মী কাজের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে।
ii. বেতন ও মজুরি প্রদান: প্রয়োজনের জন্য মানুষ কাজ করে। তাই প্রত্যেক কর্মী তার শ্রমের বিনিময়ে উপযুক্ত পারিতোষিক চায়। মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার কাজ হলো কর্মীদের জন্য একটি আদর্শ বেতন ও মজুরির ব্যবস্থা করা।
iv. কর্মীদের সুবিধাদি: জীবন যাপনের জন্য আর্থিক সুবিধা ছাড়াও অন্যান্য কিছু সুযোগ সুবিধার প্রয়োজন হয়। যেমন- উৎসব ভাতা, বোনাস, চিকিৎসা ভাতা, অবসর ভাতা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, চিত্ত বিনোদন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এ ধরনের বিবিধ সুবিধাদি কর্মীদের কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়ায়।
v. কর্মী প্রতিশ্রুতি: কর্মীকে চাহিদা মাফিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করলে এবং প্রতিষ্ঠানের সামগ্রীক নীতিমালা সুষ্ঠু ও সুন্দর হলে কর্মীগণ সামগ্রীকভাবে প্রতিষ্ঠানের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। এতে কর্মী ও প্রতিষ্ঠান উভয় লাভবান হয়।
৪. সংরক্ষণ
প্রতিষ্ঠানের সামর্থ্য অনুযায়ী কর্মীদের উপযুক্ত সুযোগ সুবিধা প্রদান করে তাদের সংরক্ষণের মাধ্যমে ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হয়। এ জন্য মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা যে কাজ গুলো করে সেগুলো হলো-
i. নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য: প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সকল নির্বাহী ও কর্মীদের জন্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে যন্ত্রপাতি নিয়ম মাফিক স্থাপন করে অফিসকে ভালভাবে বিন্যাস করতে হয়। অফিসের অভ্যন্তরে স্বাস্থ্যসম্বত পরিবেশ বজায় রাখা। যথাসম্ভব নরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, ঝুঁকি হ্রাস, দূর্ঘটনা প্রতিরোধ এবং ডাক্তার ও ঔষধের ব্যবস্থা রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ii. যোগাযোগ: কার্যকর যোগাযোগের মাধ্যমে যেমন আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক উন্নয়ন হয় একই ভাবে অকার্যকর যোগাযোগের মাধ্যমে আবার আন্তঃদলীয় সমস্যা সৃষ্টি হয়। তাই সঠিক ও সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থা সৃষ্টি করে সর্বক্ষেত্রে সুসম্পর্ক সৃষ্টি করতে হয়।
iii. শ্রম ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক: প্রতিষ্ঠানের শ্রম ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক উন্নত হলে উৎপাদন বাড়ে ও সেবার মানও উন্নত হয়। শ্রম ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক ভাল রাখলে কর্মী মনোভাব, অনুধাবন করে তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী যুক্তিসংগত প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হয়।
iv. কাউন্সিলিং: শ্রমিকদের শারীরিক সুস্থ্যতার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতাও অত্যন্ত জরুরি। কাউন্সিলিং ব্যবস্থার মাধ্যমে কর্মীদের আবেগজনিত সমস্যার সমাধান করে কার্য সম্পাদনে উদ্বুদ্ধ করা যায়।
iv. শৃঙ্খলা: শৃঙ্খলা বিষয়টি ছোটো বড়ো প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানেই গুরুত্বের দাবীদার। প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি ক্ষেত্রে শৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করে তা বজায় রাখতে হয়। বাস্তবক্ষেত্রে যে প্রতিষ্ঠান যত শৃঙ্খলিত সে প্রতিষ্ঠান তত উন্নত।
৫. মনিটরিং বা তদারকি
মনিটরিং এমন একটি ব্যবস্থা যার মাধ্যমে কর্মীদের প্রয়োজনে উপদেশ দেয়া হয় এবং বিশেষ ক্ষেত্রে সতর্ক করা হয়। মনিটরিং ব্যবস্থা মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার সর্বশেষ স্তরের কাজ। এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপক-
- সম্পাদিত কাজের ধরন পরীক্ষা করেন।
- প্রয়োজনে কার্য সম্পর্কে মতামত প্রদান করেন।
- মতামতের উপর ভিত্তি করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের নির্দেশ দেন।