১২:০৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

সরকার তো চাইলেই অনেক বেশি টাকা ছাপিয়ে দেশকে ধনী দেশ বানাতে পারে, তাহলে ছাপাচ্ছে না কেন?

মোস্তাক আহ্‌মাদ
  • প্রকাশ: ০২:০২:০৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ মার্চ ২০২১
  • / ৫৪০১ বার পড়া হয়েছে

৫০০ টাকার ব্যাংক নোট

প্রশ্নটি হলো আমাদের গরীব দেশ, আমাদের সরকারও উন্নত দেশের তুলনায় বেশ গরীব। অথচ আমাদের সরকারের কাছে টাকা ছাপানোর মেশিন আছে। তাহলে আমরা আর গরীব থাকবো কোন দুঃখে, সরকার তো চাইলেই অনেক বেশি টাকা ছাপিয়ে দেশকে ধনী দেশ বানাতে পারে। আর গরীবদের মাঝে টাকা বিতরণ করে তাদেরকে বড়লোক বানিয়ে দিতে পারে। এতে দেশও ধনী হতো আর দেশের গরীব মানুষেরও ভাগ্যের পরিবর্তন হতো। আদতে বিষয়টি মোটেও তা নয়। আগে আমার মনেও এমন প্রশ্ন জাগতো। সরকার কেন বেশি করে টাকা ছাপছে না, তাহলেই তো আমাদের সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো। বিষয়টি সত্যিই কি তাই, সরকার কি পর্যাপ্ত টাকা ছাপলেই এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? আসুন, একটু জেনে নেওয়া যাক।

অনেকেই ভেবে থাকেন, সরকারের কাছে যেহেতু টাকা ছাপানোর মেশিন রয়েছে, তাহলে দেশে এত গবীর মানুষ কেন? সরকার কেন বেশি বেশি টাকা ছাপিয়ে গরীব মানুষদের বিতরণ করছে না, আর দেশকে কেনই বা ধনী বানিয়ে দিচ্ছে না। তাহলে কেন সরকার নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ছাপায়, এর বেশি কেন ছাপায় না। এবার আসুন! টাকা সম্পর্কে আমাদের এই ধারণা ও জিজ্ঞাসার জবাব জেনে নিই।

সরকার চাইলেই কি অনেক বেশি টাকা ছাপিয়ে সবাইকে ধনী বানিয়ে দিতে পারবে? আর পারলে কেনই বা ছাপছে না

এই প্রশ্নটির উত্তর জানতে হলে, অবশ্যই আপনাকে একটি সহজ ফর্মূলা জানতে হবে। জানতে হবে যখন টাকা বা মুদ্রা ব্যবস্থা চালু হয়নি, তখন আদিম যুগের মানুষ কিভাবে কেনা বেচা বা বিনিময় করতো। হ্যাঁ, আদিম যুগের মানুষ বিনিময় ব্যবস্থার মাধ্যমে কেনা বেচা করতো।

৫০০ টাকার ব্যাংক নোট
৫০০ টাকার ব্যাংক নোট। ছবি: বাংলাদেশ ব্যাংক

আদিম যুগে মানুষ চালের পরিবর্তে ডাল, আর ডালের পরিবর্তে দুধ নিতো অর্থাৎ তারা একটি জিনিস দিয়ে তাদের প্রয়োজনীয় অন্য জিনিস নিতো। এভাবেই তারা একে অপরের প্রয়োজন মেটাতো। এখনও তার ব্যতিক্রম নয়, তবে বর্তমানে মানুষ সেই প্রয়োজন মেটানোর জন্য মুদ্রা বা টাকা ব্যবহার করে। টাকার মূল্য আছে বলেই মানুষ টাকার জন্য কাজ করে। ফসল উৎপাদন করে, এখন মানুষ সকালে ঘুম থেকে উঠে রাত পর্যন্ত যেসব কার করছে তার মূল উদ্দেশ্য থাকে অর্থ উপার্জন করা, আর সেই অর্থ দিয়ে নিজেদের প্রয়োজন মেটানো। তাহলে এখন চিন্তা করে দেখুন সরকার যদি কোটি কোটি টাকা ছাপিয়ে গরীব মানুষের মাঝে বিতরণ করতো, এভাবে প্রতিটি মানুষই কোটিপতি হয়ে যেতো, তাহলে প্রতিটি জিনিসের দাম কয়েক গুণ বেড়ে যেতো। তখন মানুষ যার যা প্রয়োজন সঙ্গে সঙ্গে তা ক্রয় করতো। আর যা কম প্রয়োজনীয় তাও ক্রয় করতো, কারণ তার হাতে নগদ অর্থ আছে। এতে করে বাজারে সকল পণ্যের দাম আকাশ-পাতাল বেড়ে যেতো। টাকার মূল্য অনেক কমে যেতো।

কারণ হিসেবে মনে করুন, আপনি এখন ব্যবসা করছেন আর প্রতিটি পণ্য থেকে চার পাঁচ টাকা লাভ করছেন, কিন্তু আপনি যদি কোটিপতি হয়ে যেতেন, তাহলে আপনি মাত্র চার পাঁচ টাকা দিয়ে কি করতেন, এই টাকা আপনার কাছে কিছুই মনে হতো না, তাই আপনি বেশি লাভ করতে চাইতেন, সেজন্য পণ্যের দামও অনেক বাড়িয়ে দিতেন, এছাড়াও সকলের কাছে কোটি কোটি টাকা থাকায় সকলেই তার প্রয়োজনীয় সকল জিনিস সঙ্গে সঙ্গে ক্রয় করতো এবং বাজারে পণ্যের সংকট সৃষ্টি হতো। অন্যদিকে কেউ উৎপাদন বা কাজ করতে চাইতো না। কারণ কাজ করবে কীসের জন্য, তাদের কাছে তো টাকা আছেই। এই ভেবে অনেকেই তখন ফসলের মাঠে কাজ করতে চাইতো না, কলকারখানার শ্রমিক হতে চাইতো না, কারণ সকলেই কোটিপতি। তাই চাল ডাল ফসল উৎপাদন কমে যেতো। তখন মানুষের প্রয়োজন মেটানোর জন্য জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে যেতো। কেউ আর সহজে টাকা হাতে থাকলেও প্রয়োজনীয় জিনিসটি পেতো না।

প্রায় প্রতিটি দেশেই টাকা ছাপানোর মেশিন রয়েছে। তবে সেই দেশের সরকার সর্বদা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে টাকা ছাপায়। প্রতিটি দেশে মোট যেই পরিমাণে জিনিসপত্র তৈরি করা হয়। ঠিক সেই পরিমাণে টাকা ছাপানো হয়। এই নিয়ম আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিটি দেশকেই মেনে চলতে হয়। তবে কোনো দেশ চাইলেই নিয়মের চেয়ে বেশি টাকা ছাপাতে পারে। কিন্তু কেউ তা করে না, কারণ এতে ঐ দেশেরই মারাত্মক সমস্যা হতে পারে। কিন্তু কিভাবে? সেটাই জানার বিষয়।

এবার একটু হিসাব মিলিয়ে দেখা যাক

আগেই বলেছিলাম, প্রতিটি দেশে মোট যেই পরিমাণে জিনিসপত্র তৈরি করা হয়। ঠিক সেই পরিমাণে টাকা ছাপানো হয়। তাই একটি দেশে ক্রয় করার মতো যে পরিমাণ জিনিস থাকে, তার মূল্য নির্ধারণ করে সেই পরিমাণ টাকা ছাপাতে হয়, এর বেশিও নয় আবার কমও নয়। আর সেই নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী সেই দেশের টাকা ছাপানো হয়ে থাকে। যেমন ধরুণ, বাংলাদেশে মাত্র ১০ জন মানুষ বসবাস করে। আর এখানে মোট ১০ কেজি চাল উৎপাদন হয়। ১০ কেজি চালের দাম যদি হয় ১০০ টাকা। তাহলে সরকার ১০০ টাকা ছাপাবে। সেক্ষেত্রে প্রতি কেজি চালের দাম হবে ১০ টাকা করে। তবে সরকার যদি এ ক্ষেত্রে ১০০ টাকার পরিবর্তে ১০০০ টাকা ছাপায়, তাহলে প্রতি কেজি চালের দাম হবে ১০০ টাকা করে। বিষয়টি ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখুন, আপনার কাছে ১০ টাকা থাকুক কিংবা ১০০ টাকা। আপনি চাল কিন্তু ১ কেজিই পাচ্ছেন। আর এই ফর্মূলাটি বুঝতে না পেরে ২০০১ সালে জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট মনে করেছিল যেহেতু তাদের দেশে গরীব অনেক বেশি, তাই অনেক বেশি টাকা ছাপিয়ে তারা তাদের এই দুঃখ-দুর্দশা দূর করবে। কিন্তু এটি ছিল তাদের সবচেয়ে বড় বোকামী। তার এই বোকামীর ফলে সে অনেক বেশী টাকা ছাপিয়ে ছিল। ফলে প্রতিটি মানুষ কোটিপতি হয়ে গেলেও সকলেই একটি সমস্যায় পড়ে গিয়েছিল, এরফলে তারা একটি রুটি কিংবা সামান্য কলম কিনতে গেলেও সেক্ষেত্রে তাদের লক্ষ লক্ষ টাকা ক্যাশ দিতে হয়েছিল। কারণ আমাদের কাছে যদি টাকা বেশি থাকে। তাহলে জিনিসের চাহিদাও বেড়ে যাবে। এরফলে জিনিসপত্রের দামও বেড়ে যাবে। জিম্বাবুয়ে এখানেই থেমে থাকেনি। তারা এই সমস্যার সমাধান করার জন্য ২০০৮ সাল পর্যন্ত আরও অনেক বেশি করে টাকা ছাপিয়েছিল। এর ফলে তারা কোটি টাকার নোট পর্যন্ত বানিয়েছিল। কিন্তু এতটাকা ছাপানোর পরও তারা এই জটিল সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারেনি। পরবর্তীতে কোনো উপায় না পেয়ে সেখানকার প্রেসিডেন্ট দেশের সকল অর্থ বাতিল করার ঘোষণা দিয়েছিল। আর তারা অন্য দেশের কারেন্সি ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। কিন্তু তাতেও তাদের সমস্যা দূর হয়নি বরং তারা অর্থনৈতিকভাবে অনেক পিছিয়ে পড়েছিল, যা আজও সমাধান হয়নি।

জিম্বাবুয়ে এবং শেষ কথা

এখন আমরা যদি ভাবি, যেহেতু আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষই দরিদ্র। রাস্তা ঘাটে দেখা যায় অনেকেই ভিক্ষা করে আবার অনেকের থাকার মতো জায়গাটুকু নেই। তারা রাস্তায় ঘুমায়, তাই আমাদের সরকার যদি বেশি বেশি টাকা ছাপায় তাহলে আমাদের অবস্থাও জিম্বাবুয়ের মতোই হবে। তাই বেশি বেশি টাকা ছাপিয়ে কখনই দেশের মানুষের দুর্দশা দূর করা যায় না। কারণ টাকা যদি পণ্যের চেয়ে বেশি ছাপানো হয় তাহলে পণ্যের দাম অনেক বেড়ে যাবে এবং মানুষ উৎপাদন করা ছেড়ে দেবে, তারা কলকারখানায় কাজ করা বন্ধ করে দেবে। আর দেশে কোনো শ্রমিকও পাওয়া যাবে না। তাই অতিরিক্ত টাকা ছাপিয়ে কখনও দরিদ্র দূর করা যায় না। দেশের এই দরিদ্রতা দূর করার জন্য আমাদের উৎপাদন বাড়াতে হবে, এছাড়াও রফতানি সহ বিভিন্ন খাতে উন্নতির কাজ করতে হবে। মানুষদেরকে নিজেদের মেধা কাজে লাগাতে হবে এবং উৎপাদনমুখি শিল্প কারখানা স্থাপন করতে হবে। যাতে আমরা উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারি এবং আমাদের বিভিন্ন খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি সহ বিদেশে প্রচুর রপ্তানি করতে পারি। আমাদের উৎপাদনের পরিমাণ যত বৃদ্ধি পাবে এবং রপ্তানি আয়ের পরিমাণ যত বেশি হবে আমাদের দেশের টাকার মূল্য ও পরিমাণ ততই বৃদ্ধি পাবে। এই নিয়মতান্ত্রিকভাবে উন্নয়ন হলেই দেশের দরিদ্রতা কমে যাবে এবং মানুষ আর গরীব থাকবে না। তবে দেশ যতো উন্নত হবে এবং গরীব মানুষের সংখ্যা যতো কমে আসবে। শ্রমিকদের চাহিদা ততই বৃদ্ধি পাবে। দেশের জনসংখ্যার প্রায় সকলের হাতেই কাজ থাকবে। তখন কেউ আর বেকার থাকবে না। এতে হয়তো এমনও হতে পারে যে, বিদেশ থেকেও সৌদি আরবের মতো শ্রমিক আনতে হতে পারে। এটা হতে পারে কেবল দেশ উন্নত দেশে পরিণত হলে। অদূর ভবিষ্যতে আমরা সে আশাও করতে পারি।

বিষয়:

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

মোস্তাক আহ্‌মাদ

চার শতাধিক গ্রন্থের লেখক ও গবেষক।

ওয়েবসাইটটির সার্বিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে স্পনসর খোঁজা হচ্ছে।

সরকার তো চাইলেই অনেক বেশি টাকা ছাপিয়ে দেশকে ধনী দেশ বানাতে পারে, তাহলে ছাপাচ্ছে না কেন?

প্রকাশ: ০২:০২:০৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ মার্চ ২০২১

প্রশ্নটি হলো আমাদের গরীব দেশ, আমাদের সরকারও উন্নত দেশের তুলনায় বেশ গরীব। অথচ আমাদের সরকারের কাছে টাকা ছাপানোর মেশিন আছে। তাহলে আমরা আর গরীব থাকবো কোন দুঃখে, সরকার তো চাইলেই অনেক বেশি টাকা ছাপিয়ে দেশকে ধনী দেশ বানাতে পারে। আর গরীবদের মাঝে টাকা বিতরণ করে তাদেরকে বড়লোক বানিয়ে দিতে পারে। এতে দেশও ধনী হতো আর দেশের গরীব মানুষেরও ভাগ্যের পরিবর্তন হতো। আদতে বিষয়টি মোটেও তা নয়। আগে আমার মনেও এমন প্রশ্ন জাগতো। সরকার কেন বেশি করে টাকা ছাপছে না, তাহলেই তো আমাদের সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো। বিষয়টি সত্যিই কি তাই, সরকার কি পর্যাপ্ত টাকা ছাপলেই এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? আসুন, একটু জেনে নেওয়া যাক।

অনেকেই ভেবে থাকেন, সরকারের কাছে যেহেতু টাকা ছাপানোর মেশিন রয়েছে, তাহলে দেশে এত গবীর মানুষ কেন? সরকার কেন বেশি বেশি টাকা ছাপিয়ে গরীব মানুষদের বিতরণ করছে না, আর দেশকে কেনই বা ধনী বানিয়ে দিচ্ছে না। তাহলে কেন সরকার নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ছাপায়, এর বেশি কেন ছাপায় না। এবার আসুন! টাকা সম্পর্কে আমাদের এই ধারণা ও জিজ্ঞাসার জবাব জেনে নিই।

সরকার চাইলেই কি অনেক বেশি টাকা ছাপিয়ে সবাইকে ধনী বানিয়ে দিতে পারবে? আর পারলে কেনই বা ছাপছে না

এই প্রশ্নটির উত্তর জানতে হলে, অবশ্যই আপনাকে একটি সহজ ফর্মূলা জানতে হবে। জানতে হবে যখন টাকা বা মুদ্রা ব্যবস্থা চালু হয়নি, তখন আদিম যুগের মানুষ কিভাবে কেনা বেচা বা বিনিময় করতো। হ্যাঁ, আদিম যুগের মানুষ বিনিময় ব্যবস্থার মাধ্যমে কেনা বেচা করতো।

৫০০ টাকার ব্যাংক নোট
৫০০ টাকার ব্যাংক নোট। ছবি: বাংলাদেশ ব্যাংক

আদিম যুগে মানুষ চালের পরিবর্তে ডাল, আর ডালের পরিবর্তে দুধ নিতো অর্থাৎ তারা একটি জিনিস দিয়ে তাদের প্রয়োজনীয় অন্য জিনিস নিতো। এভাবেই তারা একে অপরের প্রয়োজন মেটাতো। এখনও তার ব্যতিক্রম নয়, তবে বর্তমানে মানুষ সেই প্রয়োজন মেটানোর জন্য মুদ্রা বা টাকা ব্যবহার করে। টাকার মূল্য আছে বলেই মানুষ টাকার জন্য কাজ করে। ফসল উৎপাদন করে, এখন মানুষ সকালে ঘুম থেকে উঠে রাত পর্যন্ত যেসব কার করছে তার মূল উদ্দেশ্য থাকে অর্থ উপার্জন করা, আর সেই অর্থ দিয়ে নিজেদের প্রয়োজন মেটানো। তাহলে এখন চিন্তা করে দেখুন সরকার যদি কোটি কোটি টাকা ছাপিয়ে গরীব মানুষের মাঝে বিতরণ করতো, এভাবে প্রতিটি মানুষই কোটিপতি হয়ে যেতো, তাহলে প্রতিটি জিনিসের দাম কয়েক গুণ বেড়ে যেতো। তখন মানুষ যার যা প্রয়োজন সঙ্গে সঙ্গে তা ক্রয় করতো। আর যা কম প্রয়োজনীয় তাও ক্রয় করতো, কারণ তার হাতে নগদ অর্থ আছে। এতে করে বাজারে সকল পণ্যের দাম আকাশ-পাতাল বেড়ে যেতো। টাকার মূল্য অনেক কমে যেতো।

কারণ হিসেবে মনে করুন, আপনি এখন ব্যবসা করছেন আর প্রতিটি পণ্য থেকে চার পাঁচ টাকা লাভ করছেন, কিন্তু আপনি যদি কোটিপতি হয়ে যেতেন, তাহলে আপনি মাত্র চার পাঁচ টাকা দিয়ে কি করতেন, এই টাকা আপনার কাছে কিছুই মনে হতো না, তাই আপনি বেশি লাভ করতে চাইতেন, সেজন্য পণ্যের দামও অনেক বাড়িয়ে দিতেন, এছাড়াও সকলের কাছে কোটি কোটি টাকা থাকায় সকলেই তার প্রয়োজনীয় সকল জিনিস সঙ্গে সঙ্গে ক্রয় করতো এবং বাজারে পণ্যের সংকট সৃষ্টি হতো। অন্যদিকে কেউ উৎপাদন বা কাজ করতে চাইতো না। কারণ কাজ করবে কীসের জন্য, তাদের কাছে তো টাকা আছেই। এই ভেবে অনেকেই তখন ফসলের মাঠে কাজ করতে চাইতো না, কলকারখানার শ্রমিক হতে চাইতো না, কারণ সকলেই কোটিপতি। তাই চাল ডাল ফসল উৎপাদন কমে যেতো। তখন মানুষের প্রয়োজন মেটানোর জন্য জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে যেতো। কেউ আর সহজে টাকা হাতে থাকলেও প্রয়োজনীয় জিনিসটি পেতো না।

প্রায় প্রতিটি দেশেই টাকা ছাপানোর মেশিন রয়েছে। তবে সেই দেশের সরকার সর্বদা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে টাকা ছাপায়। প্রতিটি দেশে মোট যেই পরিমাণে জিনিসপত্র তৈরি করা হয়। ঠিক সেই পরিমাণে টাকা ছাপানো হয়। এই নিয়ম আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিটি দেশকেই মেনে চলতে হয়। তবে কোনো দেশ চাইলেই নিয়মের চেয়ে বেশি টাকা ছাপাতে পারে। কিন্তু কেউ তা করে না, কারণ এতে ঐ দেশেরই মারাত্মক সমস্যা হতে পারে। কিন্তু কিভাবে? সেটাই জানার বিষয়।

এবার একটু হিসাব মিলিয়ে দেখা যাক

আগেই বলেছিলাম, প্রতিটি দেশে মোট যেই পরিমাণে জিনিসপত্র তৈরি করা হয়। ঠিক সেই পরিমাণে টাকা ছাপানো হয়। তাই একটি দেশে ক্রয় করার মতো যে পরিমাণ জিনিস থাকে, তার মূল্য নির্ধারণ করে সেই পরিমাণ টাকা ছাপাতে হয়, এর বেশিও নয় আবার কমও নয়। আর সেই নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী সেই দেশের টাকা ছাপানো হয়ে থাকে। যেমন ধরুণ, বাংলাদেশে মাত্র ১০ জন মানুষ বসবাস করে। আর এখানে মোট ১০ কেজি চাল উৎপাদন হয়। ১০ কেজি চালের দাম যদি হয় ১০০ টাকা। তাহলে সরকার ১০০ টাকা ছাপাবে। সেক্ষেত্রে প্রতি কেজি চালের দাম হবে ১০ টাকা করে। তবে সরকার যদি এ ক্ষেত্রে ১০০ টাকার পরিবর্তে ১০০০ টাকা ছাপায়, তাহলে প্রতি কেজি চালের দাম হবে ১০০ টাকা করে। বিষয়টি ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখুন, আপনার কাছে ১০ টাকা থাকুক কিংবা ১০০ টাকা। আপনি চাল কিন্তু ১ কেজিই পাচ্ছেন। আর এই ফর্মূলাটি বুঝতে না পেরে ২০০১ সালে জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট মনে করেছিল যেহেতু তাদের দেশে গরীব অনেক বেশি, তাই অনেক বেশি টাকা ছাপিয়ে তারা তাদের এই দুঃখ-দুর্দশা দূর করবে। কিন্তু এটি ছিল তাদের সবচেয়ে বড় বোকামী। তার এই বোকামীর ফলে সে অনেক বেশী টাকা ছাপিয়ে ছিল। ফলে প্রতিটি মানুষ কোটিপতি হয়ে গেলেও সকলেই একটি সমস্যায় পড়ে গিয়েছিল, এরফলে তারা একটি রুটি কিংবা সামান্য কলম কিনতে গেলেও সেক্ষেত্রে তাদের লক্ষ লক্ষ টাকা ক্যাশ দিতে হয়েছিল। কারণ আমাদের কাছে যদি টাকা বেশি থাকে। তাহলে জিনিসের চাহিদাও বেড়ে যাবে। এরফলে জিনিসপত্রের দামও বেড়ে যাবে। জিম্বাবুয়ে এখানেই থেমে থাকেনি। তারা এই সমস্যার সমাধান করার জন্য ২০০৮ সাল পর্যন্ত আরও অনেক বেশি করে টাকা ছাপিয়েছিল। এর ফলে তারা কোটি টাকার নোট পর্যন্ত বানিয়েছিল। কিন্তু এতটাকা ছাপানোর পরও তারা এই জটিল সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারেনি। পরবর্তীতে কোনো উপায় না পেয়ে সেখানকার প্রেসিডেন্ট দেশের সকল অর্থ বাতিল করার ঘোষণা দিয়েছিল। আর তারা অন্য দেশের কারেন্সি ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। কিন্তু তাতেও তাদের সমস্যা দূর হয়নি বরং তারা অর্থনৈতিকভাবে অনেক পিছিয়ে পড়েছিল, যা আজও সমাধান হয়নি।

জিম্বাবুয়ে এবং শেষ কথা

এখন আমরা যদি ভাবি, যেহেতু আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষই দরিদ্র। রাস্তা ঘাটে দেখা যায় অনেকেই ভিক্ষা করে আবার অনেকের থাকার মতো জায়গাটুকু নেই। তারা রাস্তায় ঘুমায়, তাই আমাদের সরকার যদি বেশি বেশি টাকা ছাপায় তাহলে আমাদের অবস্থাও জিম্বাবুয়ের মতোই হবে। তাই বেশি বেশি টাকা ছাপিয়ে কখনই দেশের মানুষের দুর্দশা দূর করা যায় না। কারণ টাকা যদি পণ্যের চেয়ে বেশি ছাপানো হয় তাহলে পণ্যের দাম অনেক বেড়ে যাবে এবং মানুষ উৎপাদন করা ছেড়ে দেবে, তারা কলকারখানায় কাজ করা বন্ধ করে দেবে। আর দেশে কোনো শ্রমিকও পাওয়া যাবে না। তাই অতিরিক্ত টাকা ছাপিয়ে কখনও দরিদ্র দূর করা যায় না। দেশের এই দরিদ্রতা দূর করার জন্য আমাদের উৎপাদন বাড়াতে হবে, এছাড়াও রফতানি সহ বিভিন্ন খাতে উন্নতির কাজ করতে হবে। মানুষদেরকে নিজেদের মেধা কাজে লাগাতে হবে এবং উৎপাদনমুখি শিল্প কারখানা স্থাপন করতে হবে। যাতে আমরা উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারি এবং আমাদের বিভিন্ন খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি সহ বিদেশে প্রচুর রপ্তানি করতে পারি। আমাদের উৎপাদনের পরিমাণ যত বৃদ্ধি পাবে এবং রপ্তানি আয়ের পরিমাণ যত বেশি হবে আমাদের দেশের টাকার মূল্য ও পরিমাণ ততই বৃদ্ধি পাবে। এই নিয়মতান্ত্রিকভাবে উন্নয়ন হলেই দেশের দরিদ্রতা কমে যাবে এবং মানুষ আর গরীব থাকবে না। তবে দেশ যতো উন্নত হবে এবং গরীব মানুষের সংখ্যা যতো কমে আসবে। শ্রমিকদের চাহিদা ততই বৃদ্ধি পাবে। দেশের জনসংখ্যার প্রায় সকলের হাতেই কাজ থাকবে। তখন কেউ আর বেকার থাকবে না। এতে হয়তো এমনও হতে পারে যে, বিদেশ থেকেও সৌদি আরবের মতো শ্রমিক আনতে হতে পারে। এটা হতে পারে কেবল দেশ উন্নত দেশে পরিণত হলে। অদূর ভবিষ্যতে আমরা সে আশাও করতে পারি।