০৩:৫৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৬ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয়

নাসরীন সুলতানা
  • প্রকাশ: ১০:৪৬:১৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩ জুন ২০২৩
  • / ৪৮৭ বার পড়া হয়েছে


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

বাংলাদেশে আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ না হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ভিসা প্রদান থেকে বিরত থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, ‘নির্বাচন না হলে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। নতুন নীতির আওতায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের কয়েকটি ধারা অনুযায়ী নতুন যে ভিসানীতি ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।’

এ ভিসানীতির আওতায় আছে বিশিষ্ট নাগরিকরাও। অর্থাৎ কার্যত যে কাউকে এ ভিসানীতির আওতায় নির্বাচনে বাধা প্রদানকারী হিসাবে ভিসা প্রদানে অস্বীকৃতি জানাতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। লক্ষ করেছি, অনেকেই মনে করেন, আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়। তবে আশার কথা হলো, বাংলাদেশ সরকার এ ভিসানীতির বিষয়টি আমলে নিয়েছে এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, তাদের এ নীতির বিপরীতে সরকারের প্রতিক্রিয়ায় তারা সন্তুষ্ট।

আক্ষরিক অর্থে আমরা যতই বলি, আমাদের অভ্যন্তরীণ নির্বাচন নিয়ে মার্কিনিদের কী; বাস্তবতা হলো, তারা চাইলে যে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে পারে। কারণ বাস্তবে তারা মোড়ল, এবং এক অর্থে পৃথিবীর শাসক। কানাডায় বসবাসের সুবাদে দেখছি-কানাডা তার অর্থনীতি, বাণিজ্য, শিক্ষা এবং আরও অনেক ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ কানাডার মতো এত বড় একটা দেশ অর্থনীতি থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা প্রভাবিত এবং এ দুই দেশের মধ্যে রয়েছে সহোদরের মতো এক আন্তঃসম্পর্ক।

মার্কিন ভিসানীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয়
মার্কিন ভিসানীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয়

এমনকি বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনের সময় আমাদের করোনা টেস্টের ক্ষেত্রে মার্কিন পাসপোর্টধারী এবং অন্যান্য দেশের পাসপোর্টধারীদের জন্য ছিল ভিন্ন ভিন্ন নীতি। মার্কিন পাসপোর্টধারীদের জন্য নিয়ম অন্যদের তুলনায় শিথিল ছিল। যেমন, করোনা টেস্ট করতে হবে না বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। বিষয়টি এমন যেন রোগ শুধু আমরা এশিয়ানরাই ছড়াই। অর্থাৎ কানাডা নানাভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল এবং অনেক নীতির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করে থাকে।

যা হোক, বাংলাদেশ যদি যুক্তরাষ্ট্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেদের মতো করে নির্বাচন করতে পারে, সেটা অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় গর্বের বিষয় হবে। কিন্তু মার্কিন ভিসার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিক্ষা খাত। আমাদের দেশ থেকে প্রতি বছর কতসংখ্যক শিক্ষার্থী আন্ডার গ্র্যাজুয়েট এবং গ্র্যাজুয়েট এডুকেশনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমায় তার সঠিক পরিসংখ্যান আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি। এ বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর অনেকেই উচ্চশিক্ষার পর উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে নিজেদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে।

এতে একদিকে দেশের মেধাবীরা যেমন সারা বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে সক্ষম হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি বেকার সমস্যার সমাধানে দেশের ওপর চাপ কমছে। দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি ভিসার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, কানাডাও যে সেই পথে হাঁটবে না, তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? যদি এমনটা ঘটে, তাহলে আগামী শিক্ষা বছর সামনে রেখে যেসব শিক্ষার্থী উত্তর আমেরিকায় উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে তাদের একটি বড় অংশ ভর্তি হওয়া সত্ত্বেও শুধু ভিসার অভাবে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিন গুনতে থাকবে। দেশে হতাশাগ্রস্ত বেকারের সংখ্যা বাড়বে।

শিক্ষা খাত ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ওপর বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকাংশে নির্ভরশীল। আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পের একটি বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা। কিন্তু তৈরি পোশাকের এ বাজারও এখন ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও ভারত দখল করে নিচ্ছে। বিজনেস এথিক কোর্সের টিএ হিসাবে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, কানাডিয়ান ছাত্রছাত্রীদের একাডেমিক আলোচনায় বাংলাদেশের তুলনায় ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ায় অবস্থিত সোয়েটশপগুলো বেশি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হচ্ছে।

সুতরাং ভিসার সঙ্গে সঙ্গে যদি আমাদের তৈরি পোশাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসে, সেটি আমাদের অর্থনীতির জন্য অনেক বড় এক দুর্যোগ বয়ে আনবে। অতএব, আমি মনে করি, ভিসার ওপর এ নিষেধাজ্ঞাকে একেবারে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। নেই অগ্রাহ্য করারও। সুতরাং নিজেদের স্বার্থেই আমাদের বিবাদ এড়িয়ে চলা উচিত।

অতএব, আওয়ামী লীগের জন্য এ মুহূর্তে দুটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে-এক. একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং দুই. চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন। বিষয়টি এমন যেন সাপও মরল, অথচ লাঠিও ভাঙল না। গাজীপুরের নির্বাচন প্রমাণ করেছে যে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সরকারের সদিচ্ছার কোনো অভাব নেই। সরকারের পক্ষ থেকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও বিভিন্ন মহল থেকে ঘোষণা আসছে। সুতরাং আগামী সংসদ নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হবে, সেটা আমরা আশা করতে পারি।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আওয়ামী লীগের এ মুহূর্তে করণীয় কী? আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ঐতিহ্য এবং দেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে তাদের অবদান এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ নেতৃত্ব এটা প্রমাণ করে যে, আওয়ামী লীগ তার সংকট মোকাবিলায় সম্পূর্ণ সক্ষম। আওয়ামী লীগের গত তিন টার্মে শেখ হাসিনার সুযোগ্য শাসন এবং পরিকল্পনায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোলমডেল। অতএব, এ উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই চাইবে চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করতে, যাতে করে তারা তাদের অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করতে পারে এবং তাদের মিশন ও ভিশন পরিপূর্ণ করতে পারে।

তবে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে সাফল্য পেতে হলে দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে আরও বেশি সতর্ক হতে হবে। বিগত উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনাসহ স্থানীয় পর্যায়ে কিছু অরাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে উঠে আসা এবং ব্যক্তিস্বার্থে রাজনীতি ব্যবহারকারী কিছু সংসদ-সদস্য ও তাদের পরিবার কর্তৃক দলীয় সৎ, ত্যাগী ও অভিজ্ঞ নেতাকর্মীদের বঞ্চিত হওয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিতে হবে। বিগত সময়ে যারা বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের সুযোগ দিতে হবে। মাঠ পর্যায়ে বর্তমান সংসদ-সদস্যদের জনপ্রিয়তা কোন পর্যায়ে সে বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

কিছু সংসদ-সদস্য এবং তাদের পরিবার কর্তৃক অনৈতিক ও অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য দলীয় যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে, সে বিষয়টিও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। স্থানীয় নেতাদের দ্বারা প্রদত্ত তথ্য এবং মাঠ পর্যায়ের সত্যিকারের বাস্তব চিত্রের মধ্যে সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য বিবেচনা করলে দলীয় নেতাদের সত্যিকার স্বরূপ উন্মোচন করা কোনো কঠিন কাজ নয়। অতএব, কোনো ব্যক্তিবিশেষের বিশেষ অরাজনৈতিক গুণাবলিকে গুরুত্ব না দিয়ে মাঠ পর্যায়ে তাদের জনপ্রিয়তা, দেশপ্রেম, সততা এবং চারিত্রিক দৃঢ়তা বিবেচনা করে দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রদান করে মনোনয়নের তালিকা প্রদান করলে আওয়ামী লীগের জন্য এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব হতে পারে।

পরিশেষে বলতে চাই, অনেক ত্যাগ আর আত্মদানের মাধ্যমে আমরা দেশ পেয়েছি। গণতন্ত্র অর্জন করতেও অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। কোনো বিশেষ দেশ বা গোষ্ঠীর হুমকি বা নজরদারিতে বিচলিত হয়ে নয়, বরং দেশ ও দলের স্বার্থেই আওয়ামী লীগ সভাপতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। গাজীপুরের নির্বাচন প্রমাণ করেছে-আওয়ামী লীগ অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে দলটি আবারও প্রমাণ করতে পারে, আওয়ামী লীগ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই সরকার গঠন করতে সক্ষম। আশা করি, আওয়ামী লীগের দলীয় ঐতিহ্য, বিচক্ষণতা ও দেশপ্রেম এ সংকট মোকাবিলায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

নাসরীন সুলতানা

সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিও, কানাডা [email protected]

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয়

প্রকাশ: ১০:৪৬:১৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩ জুন ২০২৩

বাংলাদেশে আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ না হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ভিসা প্রদান থেকে বিরত থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, ‘নির্বাচন না হলে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। নতুন নীতির আওতায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের কয়েকটি ধারা অনুযায়ী নতুন যে ভিসানীতি ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।’

এ ভিসানীতির আওতায় আছে বিশিষ্ট নাগরিকরাও। অর্থাৎ কার্যত যে কাউকে এ ভিসানীতির আওতায় নির্বাচনে বাধা প্রদানকারী হিসাবে ভিসা প্রদানে অস্বীকৃতি জানাতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। লক্ষ করেছি, অনেকেই মনে করেন, আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়। তবে আশার কথা হলো, বাংলাদেশ সরকার এ ভিসানীতির বিষয়টি আমলে নিয়েছে এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, তাদের এ নীতির বিপরীতে সরকারের প্রতিক্রিয়ায় তারা সন্তুষ্ট।

আক্ষরিক অর্থে আমরা যতই বলি, আমাদের অভ্যন্তরীণ নির্বাচন নিয়ে মার্কিনিদের কী; বাস্তবতা হলো, তারা চাইলে যে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে পারে। কারণ বাস্তবে তারা মোড়ল, এবং এক অর্থে পৃথিবীর শাসক। কানাডায় বসবাসের সুবাদে দেখছি-কানাডা তার অর্থনীতি, বাণিজ্য, শিক্ষা এবং আরও অনেক ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ কানাডার মতো এত বড় একটা দেশ অর্থনীতি থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা প্রভাবিত এবং এ দুই দেশের মধ্যে রয়েছে সহোদরের মতো এক আন্তঃসম্পর্ক।

মার্কিন ভিসানীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয়
মার্কিন ভিসানীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয়

এমনকি বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনের সময় আমাদের করোনা টেস্টের ক্ষেত্রে মার্কিন পাসপোর্টধারী এবং অন্যান্য দেশের পাসপোর্টধারীদের জন্য ছিল ভিন্ন ভিন্ন নীতি। মার্কিন পাসপোর্টধারীদের জন্য নিয়ম অন্যদের তুলনায় শিথিল ছিল। যেমন, করোনা টেস্ট করতে হবে না বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। বিষয়টি এমন যেন রোগ শুধু আমরা এশিয়ানরাই ছড়াই। অর্থাৎ কানাডা নানাভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল এবং অনেক নীতির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করে থাকে।

যা হোক, বাংলাদেশ যদি যুক্তরাষ্ট্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেদের মতো করে নির্বাচন করতে পারে, সেটা অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় গর্বের বিষয় হবে। কিন্তু মার্কিন ভিসার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিক্ষা খাত। আমাদের দেশ থেকে প্রতি বছর কতসংখ্যক শিক্ষার্থী আন্ডার গ্র্যাজুয়েট এবং গ্র্যাজুয়েট এডুকেশনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমায় তার সঠিক পরিসংখ্যান আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি। এ বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর অনেকেই উচ্চশিক্ষার পর উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে নিজেদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে।

এতে একদিকে দেশের মেধাবীরা যেমন সারা বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে সক্ষম হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি বেকার সমস্যার সমাধানে দেশের ওপর চাপ কমছে। দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি ভিসার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, কানাডাও যে সেই পথে হাঁটবে না, তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? যদি এমনটা ঘটে, তাহলে আগামী শিক্ষা বছর সামনে রেখে যেসব শিক্ষার্থী উত্তর আমেরিকায় উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে তাদের একটি বড় অংশ ভর্তি হওয়া সত্ত্বেও শুধু ভিসার অভাবে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিন গুনতে থাকবে। দেশে হতাশাগ্রস্ত বেকারের সংখ্যা বাড়বে।

শিক্ষা খাত ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ওপর বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকাংশে নির্ভরশীল। আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পের একটি বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা। কিন্তু তৈরি পোশাকের এ বাজারও এখন ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও ভারত দখল করে নিচ্ছে। বিজনেস এথিক কোর্সের টিএ হিসাবে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, কানাডিয়ান ছাত্রছাত্রীদের একাডেমিক আলোচনায় বাংলাদেশের তুলনায় ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ায় অবস্থিত সোয়েটশপগুলো বেশি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হচ্ছে।

সুতরাং ভিসার সঙ্গে সঙ্গে যদি আমাদের তৈরি পোশাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসে, সেটি আমাদের অর্থনীতির জন্য অনেক বড় এক দুর্যোগ বয়ে আনবে। অতএব, আমি মনে করি, ভিসার ওপর এ নিষেধাজ্ঞাকে একেবারে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। নেই অগ্রাহ্য করারও। সুতরাং নিজেদের স্বার্থেই আমাদের বিবাদ এড়িয়ে চলা উচিত।

অতএব, আওয়ামী লীগের জন্য এ মুহূর্তে দুটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে-এক. একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং দুই. চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন। বিষয়টি এমন যেন সাপও মরল, অথচ লাঠিও ভাঙল না। গাজীপুরের নির্বাচন প্রমাণ করেছে যে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সরকারের সদিচ্ছার কোনো অভাব নেই। সরকারের পক্ষ থেকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও বিভিন্ন মহল থেকে ঘোষণা আসছে। সুতরাং আগামী সংসদ নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হবে, সেটা আমরা আশা করতে পারি।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আওয়ামী লীগের এ মুহূর্তে করণীয় কী? আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ঐতিহ্য এবং দেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে তাদের অবদান এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ নেতৃত্ব এটা প্রমাণ করে যে, আওয়ামী লীগ তার সংকট মোকাবিলায় সম্পূর্ণ সক্ষম। আওয়ামী লীগের গত তিন টার্মে শেখ হাসিনার সুযোগ্য শাসন এবং পরিকল্পনায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোলমডেল। অতএব, এ উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই চাইবে চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করতে, যাতে করে তারা তাদের অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করতে পারে এবং তাদের মিশন ও ভিশন পরিপূর্ণ করতে পারে।

তবে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে সাফল্য পেতে হলে দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে আরও বেশি সতর্ক হতে হবে। বিগত উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনাসহ স্থানীয় পর্যায়ে কিছু অরাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে উঠে আসা এবং ব্যক্তিস্বার্থে রাজনীতি ব্যবহারকারী কিছু সংসদ-সদস্য ও তাদের পরিবার কর্তৃক দলীয় সৎ, ত্যাগী ও অভিজ্ঞ নেতাকর্মীদের বঞ্চিত হওয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিতে হবে। বিগত সময়ে যারা বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের সুযোগ দিতে হবে। মাঠ পর্যায়ে বর্তমান সংসদ-সদস্যদের জনপ্রিয়তা কোন পর্যায়ে সে বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

কিছু সংসদ-সদস্য এবং তাদের পরিবার কর্তৃক অনৈতিক ও অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য দলীয় যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে, সে বিষয়টিও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। স্থানীয় নেতাদের দ্বারা প্রদত্ত তথ্য এবং মাঠ পর্যায়ের সত্যিকারের বাস্তব চিত্রের মধ্যে সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য বিবেচনা করলে দলীয় নেতাদের সত্যিকার স্বরূপ উন্মোচন করা কোনো কঠিন কাজ নয়। অতএব, কোনো ব্যক্তিবিশেষের বিশেষ অরাজনৈতিক গুণাবলিকে গুরুত্ব না দিয়ে মাঠ পর্যায়ে তাদের জনপ্রিয়তা, দেশপ্রেম, সততা এবং চারিত্রিক দৃঢ়তা বিবেচনা করে দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রদান করে মনোনয়নের তালিকা প্রদান করলে আওয়ামী লীগের জন্য এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব হতে পারে।

পরিশেষে বলতে চাই, অনেক ত্যাগ আর আত্মদানের মাধ্যমে আমরা দেশ পেয়েছি। গণতন্ত্র অর্জন করতেও অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। কোনো বিশেষ দেশ বা গোষ্ঠীর হুমকি বা নজরদারিতে বিচলিত হয়ে নয়, বরং দেশ ও দলের স্বার্থেই আওয়ামী লীগ সভাপতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। গাজীপুরের নির্বাচন প্রমাণ করেছে-আওয়ামী লীগ অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে দলটি আবারও প্রমাণ করতে পারে, আওয়ামী লীগ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই সরকার গঠন করতে সক্ষম। আশা করি, আওয়ামী লীগের দলীয় ঐতিহ্য, বিচক্ষণতা ও দেশপ্রেম এ সংকট মোকাবিলায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।